• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • আমার যাত্রা হল না শুরু : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    আমার স্বামীর পরিবারটি বেশ বড়সড়। সাত ভাই, ছয় বোন। আমরা সবাই বেড়াতে ভালবাসি, অনেকেই ছোটখাটো দল বেঁধে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছি। তবে এই বয়সে অনেকেরই আর একলা বেড়াতে সাহস হয় না। আমাদের সবার বয়েস সত্তরের ওপরে, নানারকম রোগব্যাধি তো লেগেই আছে। এরমধ্যেই চার জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিদেরও যেকোন সময় ওপর থেকে ডাক আসতে পারে।

    তাই ঠিক করলাম সবাই মিলে একসঙ্গে একটা লাস্ট ট্রিপ করা যাক, একটা লাস্ট হুররে! ঠিক করলাম শুধু ভাইবোনেরা আর তাদের স্বামী-স্ত্রীরা যাব। সত্তরের নিচে কাউকে নেওয়া হবে না! ভাইবোনেরা সারা পৃথিবীতে ছড়ানো, ভারত, ইংল্যান্ড, আবু ধাবি, ক্যানাডা, আমেরিকা। কিন্তু ঠিক করলাম ইন্ডিয়াতেই বেড়ানো হবে, সবাই দেশে বেড়াতেই ভালবাসে আর ভিসা ইত্যাদির ঝামেলা কম। আমাদের অনেকের কাশ্মীর বেড়ানোর ইচ্ছা কিন্তু নানা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কারণে সেদিকে যাওয়া হয়নি। তাই দুই সপ্তাহের কাশ্মীর ও লাদাখ সফর ঠিক করা হল। অগস্ট মাসে, বৃষ্টি ও বরফের মাঝামাঝি সময়টা সব থেকে ভালো ও নিরাপদ। তবুও স্বাস্থ্যের কারণে কয়েকজন যোগ দিতে পারলেন না। সব মিলিয়ে তিন ভাই, তিন স্ত্রী, ও তিন ননদ --ন' জন। একটা বড়ো সাইজের প্রাইভেট ভ্যান, সঙ্গে একজন ড্রাইভার/ গাইড।

    আমাদের সবারই নানা রোগ--ক্যান্সার, ডিমেনশিয়া, ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, আর বাতের রোগ তো সবার--কারুর হাঁটুতে, কারুর কোমরে, কারুর বা পিঠে, কারুর আবার সব জায়গাতে! এছাড়াও আছে উঁচুতে ওঠার অসুস্থতা। আমরা সবাই ডায়ামক্স ট্যাবলেট সঙ্গে নিয়েছিলাম, আর অক্সিজেন ট্যাংকও।

    আমাদের প্ল্যান সবাই দিল্লীতে জড়ো হওয়ার। তারপর প্লেনে সোজা শ্রীনগরে। সেখানে কিছুদিন হাউসবোটে আরাম করা, আশপাশে পহলগাম, গুলমার্গ ইত্যাদি বেড়ানো, তারপর গাড়িতে সোনমার্গ ও কারগিল হয়ে নুরলা, সেখান থেকে খারদুংলা পাস হয়ে লেহ। লেহতে কিছুদিন উচ্চতা সইয়ে নিয়ে কাছাকাছি প্যানগং লেক, নুব্রা ভ্যালি, ইনডাস ভ্যালি, ইত্যাদি বেড়ানো, কিছু কেনাকাটা, তারপর লেহ থেকেই প্লেন ধরে যে যার বাড়ির দিকে।

    এই সফরের প্রধান উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে সবাই একসঙ্গে আড্ডা মারা। আমাদের কারুরই হাইকিং, ট্রেকিং বা পাহাড়ে চড়ার যোগ্যতা আর নেই। বেশি হাঁটাচলারও ইচ্ছা নেই। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আরাম, ব্যায়াম নয়। অবশ্য, অনেক সময় পারিবারিক মিলনে পুরনো বাদবিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রাজনৈতিক আলোচনায় মতানৈক্যও এক বিশেষ ঝামেলা-- কেউ রিপাবলিকান, কেউ ডেমোক্রাট; একজন কট্টর মোদীভক্ত তো অন্যজন মোদীবিরোধী। এইসব আলোচনায় যত সম্ভব না যাওয়াই মঙ্গল। তর্ক থামাবার জন্য দলের সিনিয়র একজনকে (আমি নয়) রেফারি নির্বাচন করে রাখা হয়েছিল। এইসব আগে থেকে ঠিক করে না রাখলে ঝগড়া ও মনোমালিন্য অনিবার্য।

    এ পর্যন্ত সব ঠিক চলছিল। যাবার দশ দিন আগে, বিপর্যয়! এবার আমিই একটা শক্ত অসুখ বাধিয়ে বসলাম। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ কোথাও যাওয়া চলবে না। অত সাধের প্ল্যান, কত লিস্টি করেছিলাম কী কী দেখব, পাহাড়, বন, লেক, কোথায় কোথায় যাব, কত জায়গা বেছে রেখেছিলাম কাশ্মীরের পাখি দেখব বলে। সব বানচাল হয়ে গেল। ডাক্তারি কারণ দেখানো সত্ত্বেও অনেক জায়গাতেই পুরো পয়সা গচ্চা দিতে হল। টিমের আর সবাই গেছিলেন, শুধু আমরা দুজনেই বাদ। হোয়াটস-অ্যাপ-এ সবাই প্রচুর ছবি পাঠিয়েছেন। সেগুলো ঘরে বসে দেখি আর হাত কামড়াই।

    সম্পাদক মশাইকে কথা দিয়েছিলাম কাশ্মীরের যাত্রা নিয়ে লিখব বলে। ঘরে বসে আছি, হয়তো আমার দেশে বিদেশে বেড়াবার পালা শেষ হল। মন ভারী, ভাবছি কী নিয়ে লেখা যায়। লেখালেখিই আমার মন ভালো করার অন্যতম উপায়। মনে পড়ল, এরকম যাত্রাভঙ্গ তো আমার এই প্রথম নয়, আগেও হয়েছে কয়েক বার। শুধু আমি কেন, যেকোন যাত্রীই এর ভুক্তভোগী। সব গোছগাছ করেও অনেক প্ল্যানের পুরোটাই কিংবা অন্তত কিছু অংশ বাতিল করে দিতে হয়। আর সেসব পরে কখনোই করে ওঠা হয় না। ওই যে বলে, Man proposes, God disposes. সম্পাদক মশাই-এর সাজেশন অনুযায়ী সেই রকমই কিছু গল্প জুড়ে দিলাম।

    তুর্কী দেশে যে-বছর ডাক্তারি মিটিঙে গেছিলাম, প্ল্যান ছিল ইস্তানবুল থেকে দেশের মাঝখানে মরু অঞ্চল ক্যাপাদোশিয়ায় বেড়াবার। ব্রোঞ্জ যুগের সময় থেকে লোকে সেখানে বসবাস করে এসেছে পাহাড়ের গুহার ভেতরে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি, ছোট, বড়ো, জটিল, বিজড়িত গুহাগুলিতে হাজার হাজার বছরের বসতি। এখন অনেকগুলিতে দোকান, রেস্তরাঁ এমনকি হোটেলও বানানো হয়েছে। এমনটি এক হোটেলে থাকার প্ল্যান ছিল। আর ভেবেছিলাম হট এয়ার বেলুনে চড়ে আকাশ থেকে এই গুহা পাহাড়গুলি দেখব। এরকম জায়গা তো পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

    ইস্তানবুলে শেষদিন, পেট ভরে কাবাব খেয়ে, বাক্স-পেঁটরা গুছোচ্ছি, কাল সকালেই কাপাদোশিয়ার প্লেন। হঠাৎ আমার আসন্নপ্রসবা বড়ো কন্যার জরুরি ফোন এল --ডাক্তাররা তার সি-সেকশন প্ল্যান করেছে তাড়াতাড়ি (কথা ছিল আরও দশ দিন পরে হবার)। এটা তার প্রথম প্রসব আর সে আমাদের পাশে থাকতে চায়। ব্যাস, কাপাদোশিয়া মাথায় রইল, প্রথম নাতির জন্ম বলে কথা, আমরা হাসিমুখে সব প্ল্যান বদলে বাড়ি ফিরলাম। এরকম প্ল্যান বাতিল অবশ্য আনন্দেরই, আফসোসের নয়। কিন্তু কাপাদোশিয়ায় আর কখনোই ফেরা হল না।

    আরেকবার, দক্ষিণ আফ্রিকায়। আফ্রিকা মহাদেশের পায়ের কাছেই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রপাত--ভিক্টোরিয়া ফলস। উচ্চতায় না হলেও আয়তনে দক্ষিণ আমেরিকার ইগুয়াসুর পরেই এর স্থান। আমার জলপ্রপাত ভীষণ ভালো লাগে। আমাদের নেব্রাস্কায় আছে একটা ঘরোয়া ছোট্ট জলপ্রপাত, স্মিথ ফলস। মাত্র তেষট্টি ফিট উঁচু। আমাদের বাড়ি থেকে চার ঘণ্টা দূরে নিওব্রারা নদীর ওপর এই প্রপাতটি আমার প্রিয়, কারণ একেবারে কাছে পর্যন্ত যাওয়া যায়, এমনকি প্রপাতের তলায় দাঁড়িয়ে চানও করা যায়। এদেশে নায়াগ্রা ফলসের নাম তো সবার চেনা। ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ সত্ত্বেও এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অটুট। শীত গ্রীষ্ম সব ঋতুতে এই ফলসের আলাদা রূপ। ইগুয়াসু ফলসের উচ্চতা ৬৭০ ফিট, তুলনায় ভিক ফলস যদিও ৩৫৫ ফিট উঁচু কিন্তু আয়তনে বিশাল। জাম্বেজি নদীর ওপর এই ফলসটি দুই দেশ জাম্বিয়া আর জিম্বাবওয়ের ঠিক মাঝখানে। বড়ো বড়ো প্রপাতগুলি বেশিরভাগই দুই দেশের মাঝখানে-- নায়াগ্রা আমেরিকা আর ক্যানাডার মধ্যে, আর ইগুয়াসু ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মধ্যে।

    দক্ষিণ আফ্রিকা দেশে বেড়াতে গেছিলাম, মহাদেশের একেবারে দক্ষিণে কেপ টাউন থেকে উত্তরে ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে সাফারি করে জোহানেসবারগ, সেখান থেকে প্লেন ধরে দু' ঘণ্টার মধ্যে জাম্বিয়া ও ভিক্টোরিয়া ফলস। জানা ছিল এয়ারপোর্টেই অল্পদিনের ভিসা পাওয়া যায়। কিন্তু কাজের সময় দেখা গেল আমাদের অজান্তে নিয়ম বদল হয়েছে। আগে থেকে ভিসা না করালে দেশে প্রবেশ অসম্ভব। জিম্বাবওয়েরও একই অবস্থা। এত কাঠখড় পুড়িয়ে, এত কাছে এসেও ফলসটা ফসকে গেল। আর, একবার মিস হয়ে গেলে নানা কারণে এতদূর আবার আসা যায় না। তাই, আরও অনেক জায়গার মত ভিক ফলসও আমার অদেখা রয়ে গেল।

    চারধাম ভারতের অন্যতম পবিত্র তীর্থস্থান। অনেকেই নিশ্চয়ই নাম শুনেছেন ও দেখে এসেছেন। নাম নিয়ে কিছু মতভেদ আছে তবে পুরনো শাস্ত্রানুযায়ী চারধাম হল ভারতের চার দিকে চারটি মন্দির-- পূর্বে পুরীর জগন্নাথ মন্দির, দক্ষিণে রামেশ্বরম, পশ্চিমে দ্বারকা, ও উত্তরে বদরীনাথ। আমার এই চারটিই জানা ছিল। আমি যদিও সিরিয়াস তীর্থপ্রেমী নই, তবু কোনোভাবে রামেশ্বরম আর জগন্নাথ মন্দির দুটোই দেখেছিলাম। কিন্তু আমার জানা ছিল না ইদানীং উত্তরাখণ্ডের ট্যুরিজম বাড়াতে চারধামের আরও একটি ছোট সংস্করণ তৈরি হয়েছে। এই 'ছোট' চারধামের সব কটি মন্দির কাছাকাছি উত্তরাখণ্ডে, তাই সবার পক্ষে সহজগম্য, এক চক্করেই সব কটা দেখে নেওয়া যায়। পুরনো চারধামের মতো দেশের চার কোণে ছোটাছুটি করার দরকার নেই। এই চারটি তীর্থ হল গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ ও বদরীনাথ। এই নিয়ে এখন মডার্ন চারধাম। আমি ঠিক জানি না, কিন্তু পুণ্যফল হয়তো দুই চারধামেই সমান।

    কয়েক বছর আগে, আমার এক গুরুস্থানীয় আত্মীয়ের মাথায় খেয়াল চাপল চারধাম দেখতেই হবে, না হলে এ জন্মই বৃথা। তাঁর মতে আমাদেরও তাঁর সঙ্গে যাওয়া দরকার। আমার পুণ্যের কলসি নাকি একেবারেই ঠনঠন করছে --দুইধাম দেখা সত্ত্বেও। এইবেলা যত সম্ভব পুণ্য পরজন্মের জন্য জোগাড় করে রাখা উচিত, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমার কিন্তু এইসব তীর্থটীর্থয় মন লাগে না। সব জায়গায় প্রচণ্ড ভিড়, ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতি, পুজোর নামে এন্তার পয়সা খরচ, মন্দিরের বাইরে বেচারা ভিখারিদের শুকনো মুখ... আমি বলতে চেষ্টা করলাম যে আমার চারধাম হল দেশের চারদিকে চারটে ন্যাশনাল পার্ক, নৈসর্গিক, শান্তিময় -- উত্তরে করবেট, পূর্বে কাজিরঙ্গা, পশ্চিমে গীর ও দক্ষিণে পেরিয়ার--আমি সব কটাই দেখে নিয়েছি। তিনি কানেও তুললেন না। স্বাস্থ্যের অজুহাতও খাটল না। হাঁপাহাঁপি করে পাহাড়ে চড়ার দরকার নেই। আমাদের মত শ্রমবিমুখ পুণ্যলোভীদের জন্য ঘোড়া বা খচ্চরও নয়, একেবারে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা! দেরাদুন থেকে সোজা ফ্লাইট। কোন কষ্ট না করেই কেষ্ট মেলার সুযোগ। এবার আমিও নেচে উঠলাম। দুর্গম পাহাড়ের মন্দিরে হয়তো এত ভিড় বা জঞ্জাল হবে না। তাছাড়া উত্তরাখণ্ডের বনেজঙ্গলে প্রচুর হিমালয়ের পাখির সমারোহ। তাইতেই আমার পুণ্য।

    কিন্তু এখানেও বাধা। আমার বরাতই খারাপ। এত পুণ্য বোধহয় আমার সয় না। সে বছর কোভিডের কড়াকড়ি সবেমাত্র শিথিল হয়েছে। আমরা কী করে জানব এতদিন ধরে সারা দেশ উন্মুখ হয়ে ছিল তীর্থদর্শনের জন্য। তিন বছর ধরে জমানো সব প্রার্থনা, সব মানত। সব মন্দিরে, সব জায়গায় কী প্রচণ্ড ভিড়! ছ' মাস আগেও হেলিকপ্টার রিজার্ভেশনে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট এ বায়ুযান। বছরে মাত্র ছয়মাস খোলা থাকে, তাই এত হুড়োহুড়ি। আমাদের নয়জনের দলের তো প্রশ্নই ওঠে না। অনেক হাতে-পায়ে ধরে, ঘুষটুস দিয়ে কোন মতে চারজনের সীট পাওয়া গেল। আমি পত্রপাঠ পদত্যাগ করলাম, আমার সঙ্গীদের পুণ্য পিপাসা আমার থেকে অনেক বেশি। চারধাম আমার নাগালের বাইরেই থেকে গেল।

    অনেক দেশ বিদেশ ঘুরেছি। কিন্তু অনেক জায়গা মিস করেছি। যেতে যেতেও যাওয়া হয়নি, অথবা খুব কাছে গিয়েও যেতে পারিনি। বাকেট লিস্টে অনেক নাম রয়ে গেল। তা থাক। এ নিয়ে আমার কোন খেদ নেই। ভ্রমণের আনন্দ পেয়েছি প্রচুর। একটা জীবনের জন্য এই-ই যথেষ্ট।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments