• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || নন্দিনী, সুচেতনা বা আগুনে-তহমীনার কথা ||

    তহমীনা খাতুন: এক আগুনপাখি—তহমীনা খাতুন স্মৃতিরক্ষা কমিটি; ছোট জাগুলিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা; প্রথম প্রকাশ জুন, ২০২৪; ISBN 978-93-92251-72-6

       সকালের রোদ নয়, রাতের নিস্তব্ধতা
       বলে দিল তুমি নেই।
       সমস্ত বিশ্বাস ধুয়ে গেল আঁধারে,
       কারা যেন ঘুমের ভিতরে কেঁদে উঠল সশব্দে…

    এই কবিতা যাঁর লেখা তিনিই ছোট্ট এক পাখিকে নিয়ে লেখেন অনবদ্য ছোটগল্প ‘টিকলি’, বা, কলম ধরেন ‘সতী’-না-হতে-চাওয়া গুজরাটী কন্যে সঙ্গীতা লাখড়ার স্মরণে, এবং ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’-র মুখপত্রে তাঁর আত্মজীবনীগ্রন্থটির ‘uncompromising’ চরিত্র প্রশংসিত হয়!

    কিন্তু, তবু তাঁকে আমরা চিনি না।

    উত্তর চব্বিশ পরগণার প্রত্যন্ত হাড়োয়া শহরে জন্ম নিয়েছিল যে মেয়েটি (১৯৬৬) তাঁর বাপ-দাদারা ছিলেন কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যদিও কালে ক্ষমতাসীন বামপন্থীদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব গড়ে উঠতেও দেরি হয়নি। ১৯৯৩-তে বি এড পড়তে চেয়ে দরখাস্তের ফর্মে ‘ধর্ম’-র স্থানে ‘X’ চিহ্ন দিয়েছিলেন শ্রীমতী তহমীনা খাতুন। কেটে দিয়েছিলেন। যদিও ততদিনে সাংবাদিক সুকুমার মিত্রের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি। সুকুমার-ও নামে ‘হিন্দু’ কিন্তু বিশ্বাসে ধর্মোর্ধ্ব! তহমীনা কিন্তু ‘হিন্দু’ বা ‘মুসলিম’ হিসেবে চিহ্নিত হতে চাননি এই সেক্যুলার ভারতবর্ষে।

    কলেজ কর্তৃপক্ষ সটান বানচাল করে দিয়েছিল তহমীনার দরখাস্তপত্র। মাত্র ঐ ধার্মিক বা অধার্মিক কারণেই।

    ছেড়ে দেবার পাত্রী ছিলেন না কিন্তু উনি।

    দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের শেষে জয় যখন পেলেন, ‘দেশ’-পত্রিকা লিখল, ‘জেদ আছে বটে রমণীটির…’ (১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০০২)! হিন্দুস্তান টাইমস ও টাইমস অব্‌ ইণ্ডিয়ার নিউজ-আইটেমে সর্বভারতীয় প্রচার পায় তহমীনার লড়াই (August 20, 2002)। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজ্যসরকার ফর্মে ‘ধর্ম’-এর উল্লেখটা ঐচ্ছিক করতে বাধ্য হল তবে থেকে।

    ***

    তহমীনার এই আগুনে চরিত্র তাঁর লেখকসত্ত্বাটিকে যেন ঢেকে দিয়েছে--এটাই আক্ষেপ। ওঁর এই আইনি-তথা-সামাজিক জেহাদে মহাশ্বেতা দেবীর আশীর্বাদ ও পথনির্দেশ উনি সদাই পেয়ে এসেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ থেকে নবনীতা দেব সেনের কলমে উঠে এসেছেন তহমীনা। ইতিহাসবিদ্‌ নিশীথরঞ্জন রায় আশীর্বাণী জানিয়ে চিঠি লেখেন তহমীনা-সুকুমারের বিবাহে। সুকুমারী ভট্টাচার্য যুগলকে কলকাতায় এসে থাকবার পরামর্শ দিয়ে বাসা খুঁজে দেবার প্রয়াস পান। এ’সব এক নবীন লেখিকার মস্ত পাথেয় নয় কি?

    তবু আমরা চিনি না, চিনিনি তহমীনাকে; আজ সে চলে যাবার পরে আক্ষেপ করছি।

    ***

    ‘চেনামুখ অচেনা মানুষ’ ও ‘পথিকৃৎ বাঙালি নারী’-- তহমীনা খাতুনের এই দু’টি মাত্র রচনা-সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া ওঁর অজস্র লেখা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে---যার বেশ কিছু কুড়িয়ে এনে এনে পৃথুলা এই সংগ্রহে গ্রন্থিত হয়েছে, যেটা বড় প্রাপ্তি (পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬০০+)। আর, কী কী সব বিষয়ে নিবন্ধ লিখে গিয়েছেন উনি! ‘দুর্গাপুজো ও গোরাচাঁদের মেলা’, ‘রান্নায় ধর্মভেদ’, ‘বোরখা-সিঁদুর’, ‘কালো মেয়ে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ওঁর হাতে লেখা ছিল, কিন্তু মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে চলে গিয়ে অপূর্ণ রেখে দিয়ে গেলেন পাঠকদের আকাঙ্ক্ষা—এটাই আক্ষেপ।

    ***

    তহমীনাকে পড়া এই গ্রন্থেই মাত্র আবদ্ধ নয়, বরং এখান থেকে তাঁর পাঠ শুরু। পড়তে পড়তে মনে হয়ে তিনি এক ‘দূরতর দ্বীপ বিকালের নক্ষত্রের কাছে’, যিনি একাধারে কবি, সমাজকর্মী ও এক প্রতিবাদী চরিত্র, শুধু বই পড়ে যাঁকে চেনা যাবে না। ঐ যেন তিনি নন্দিনীর মত বলে উঠছেন, ‘ফাগুলাল, তোমাদের চেয়ে সর্দার ভালো, সেই আমার জয়যাত্রার পথ খুলে দিলে--’

    ভারতের হাজারো গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য অচেনা তহমীনারা এই গ্রন্থপাঠে উজ্জীবিত হয়ে উঠবেন--এই আশা জাগে মনে।

    || বিন্দুতে সিন্ধু , বা গোস্পদে সমুদ্রের সন্ধান! ||

    তিন পলকের আরও গল্প--অচিন্ত্য দাস; EditionNext, Kolkata-59; প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি, ২০২৪;

    ISBN: 979-889277005-7

    পশ্চিমা বিশ্ব যখন প্রথম ‘হাইকু’ পড়ল, তার ক্ষুদ্রত্বের সৌন্দর্যে হলো মোহিত! অত কম শব্দ খরচে ঐ অত্যুচ্চ ভাব প্রকাশ করা সম্ভব?! ‘বনসাই’-এর জন্মও ঐ জাপানেই। একটা ছোট্ট পাত্রের উপরে পূর্ণ এক বৃক্ষ দেখে চমকে উঠতে হয় বৈকি! আর সেই যে মিনিয়েচার কোরান-শরীফ! এক মুঠোর মধ্যে এসে যায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থটি---পঞ্চম শতাব্দীতে খালিফা হারুন-অল-রশিদ নাকি ফ্রাঙ্ক-নরেশ শার্লমেনকে সেটি উপহার পাঠিয়েছিলেন!

    বিন্দুতে সিন্ধু!

    বিন্দু কি উপেক্ষা করবার?

    বনফুল যখন ‘ক্যানভাসার’ ছোটগল্প লিখলেন, বা ‘নিমগাছ’ বা, ‘তর্পণ’--বঙ্গসাহিত্যের উজ্জ্বল মাণিক্য হয়ে উঠল সেগুলি।

    না, তুলনা করছি না। তবে, এই ছোটগল্প সংকলনটি পড়তে পড়তে আজকের ‘অণুগল্প’-র ধারাটির ব্রাশ-আপ হয়ে যায়। যদিও লেখক বর্ষীয়ান মানুষ, কোনো উঠতি কলমচি নন। পরবাস পত্রিকাতে এঁকে মূলত ছোটদের গল্পকার হিসেবেই চিনতাম, বর্তমান সংকলনটি হাতে নিয়ে ওঁর গভীরতর জীবনবোধের সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল--যিনি নিউইয়র্ক মেট্রো-স্টেশনের বাইরে চড়ুইপাখির খাবার খুঁটে খাওয়া দেখে মনুষ্যচরিত্রের সঙ্গে মিল খুঁজে পান তার (‘স্টেশনের চড়ুইপাখি’), বা, মায়ের তিরস্কার মিস্‌ করা বালকের চোখে জল দেখতে পান (‘সমু’)।

    এমন এমন গল্পপাঠ প্রাণের আরাম!

    ***

    সাকুল্যে চুয়াল্লিশখানি গল্প আছে বর্তমান তন্বী সংকলনটিতে--গড় দৈর্ঘ্য দেড় পৃষ্ঠা। ‘রাত্তিরের গান’, ‘মাছের দিন’, ‘হরপ্পার রাজমিস্ত্রী’, ‘মেঘদূত’ পড়ে ভালো লেগেছে, তার মানে অবিশ্যি এই নয় যে বাকিগুলি মনে দাগ কাটেনি। অন্য পাঠকের নিশ্চয়ই আরও অন্য গল্পগুলি বেশি ভালো লাগবে। সেটাই স্বাভাবিক। পাঠকভেদে পছন্দও বদলে যায় কিনা।

    যেমন, ‘আমফান’ গল্পটি। একাকিনী বৃদ্ধার ঘরের জানালায় যে ফাটল ধরিয়ে দিয়ে গেল প্রলয়ংকর ঝড়--সে চিহ্ন চন্দনচর্চিত করে রাখেন তিনি, কাঁচটা বদলান না। সে প্রভঞ্জন তো তবু এসেছিল তাঁর খোঁজ নিতে, ছেলেপুলেরা তো আর কৈ আসে না।

    ‘নিজের নিজের গান’ গল্পটিতে ভাটিয়ালি থেকে সাঁওতালি সুর যেভাবে লীন হয়ে যায়--মনটা কেড়ে নেয় তা!

    ***

    শুরুতে মনোজ্ঞ একখানি মুখবন্ধ লিখেছেন উনি, যেখানে সেই আদিম মানুষের কাল থেকে আজকের কৃত্রিম মেধার যুগের গপ্প বলার কথা উঠে এসেছে। এটির দরকার ছিল। কারণ, যুগ বদলে যাবে, বদলে যাবে টেকনোলজি, কিন্তু গল্প শোনার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক যে টান সেটি মরবে না। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতবর্ষে ‘দাস্তানগো’-দিগের এক সুপুষ্ট পরম্পরা ছিল ও আছে। আজকের এন.এস.ডি-গ্রাজুয়েট সৈয়দ সাহিল আগা সাহেবের ‘দাস্তান’ শোনানোর শো পরের পর হাউজ ফুল যায় মুম্বাই-দেহলীতে। এ’সবই গল্প শোনার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণের কারণেই, আমাদের অচিন্ত্যবাবু যে শিল্পের এক নিপুণ শিল্পী।

    নব্য প্রকাশনালয়ের ছাপাই-বাঁধাই ভালো। তবে, সম্পাদনায় আরেকটু নজর দেওয়া উচিত ছিল। যেমন, মুখবন্ধতেই ‘সহযোগীতা’-র মতো বানান পীড়া দেয় চোখকে। উদয় চট্টোপাধ্যায় লিখিত দ্বিতীয় মুখবন্ধটি অনাবশ্যক দীর্ঘ, যেমন দীর্ঘ শেষ পৃষ্ঠার ব্লার্বটি। গ্রন্থমূল্যটি অত্যুচ্চ রাখা হয়েছে!

    এ’বইয়ের শীর্ষনামে ‘আরও’-র সংযুক্তি দেখে প্রথম ‘তিন পলকের গল্প’ কেতাবখানি পড়বার ইচ্ছে জেগে উঠল মনে।

    || পাঠ নয় কেবল, অবগাহনের মহাসমুদ্র! ||

    বাংলার বিয়ের গান: নারীকণ্ঠের বহুস্বর---চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়; তবুও প্রয়াস প্রকাশন, কলকাতা-১২; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০২৫; ISBN 978-81-970339-3-3

    ইদানীং শহুরে বাঙালি মেয়ের বিয়ের আগেরদিন নাচা-গানাময় ‘সঙ্গীত’ অনুষ্ঠানটির প্রচলন বেড়েছে (এখানে ‘স’-এর উচ্চারণটি ইং S!)। এটিকে অনেকে পাঞ্জাবী/মাড়বারী প্রভাবাধীন বড়লোকিপনা বলছেন। সেদিন এক আসরে এই নিয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে বর্তমান কেতাবখানির হদিশ পাওয়া গেল, যেটির পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে আমার পঁচাশি বছরের পিসিমা নাকিসুরে গেয়ে উঠলেন, ‘কনে বলেচে যেতে/পান-সুপুরি খেতে/পানের ভেতর মৌরি কোটা/ ইস্কে বিস্কে ছবি আঁটা/আমার নাম সরোবালা/গলায় দেব ফুলের মালা!’

    ‘ধরতে পারলিনি তো, কোত্থেকে বললুম? স্বয়ং বিভূতিভূষণ ইছামতী-তে ব্যবহার করে এ’ মেয়েলি গান-কে জেতে তুলে দিয়ে গেছেন!’ জানান উনি।

    বোঝো!

    ***

    আনন্দানুষ্ঠান ‘বিবাহ’ ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ‘সঙ্গীত’--এ’দুয়ের মিলমিশ কোন্‌ সেই আদি কাল থেকে চলে আসছে! ভোজ বা বরকনের সাজসজ্জা যেমন বিবাহানুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তেমনই বিয়ের গান! এবং এটা ধর্ম-কৌম নির্বিশেষ! চট্টগ্রামের আব্দুল গফুর আলীর ‘বিয়ের গান’ যেমন শোনা যায়, তেমনই বাঁকুড়ার আশালতা দেবী-ও গেয়ে ওঠেন:

    ‘বড় বাঁধের জল বাবা করে টলমল গো/ওঠো বাবা সিনান করো, করো কন্যাদান গো!’

    সাঁওতালী-জননী অবলীলায় গান

    ‘বেড়ে বান্দে গেলেয়া বরদা/এক পৌইলা ধনিকের/কিনালাম সিন্দুরা/জনমে জনমে রহি গেলা!’

    ওদিকে, মুর্শিদাবাদের কুরসিয়া বিবি গাইলেন,

    ‘দামাদ গেছে হলদি বাগান/আটক গেছে কলুর দোকান/কী দিয়া দামাদ ছাড়াই?/ ঘরে আছে রূপসী ভাবী...’ ইত্যাদি ইত্যাদি…

    অর্থাৎ, বিয়ের গান বাংলা-আসামের ঘরে ঘরে, কেবল ভিক্টোরিয় বা ব্রাহ্ম প্রভাবে কলকেতার উচ্চবর্ণীয়ঘরে গত এক-ডেড় শতকে তার একটু ভাঁটা পড়ে থাকবে।

    ***

    গোড়াতেই বলে রাখা ভালো, তিনশতাধিক পৃষ্ঠার এই বই শুধু পড়বার নয়, এ’ হলো অবগাহনের। বিয়ে তো কেবল কয়েকটি মন্ত্রের মধ্যেই আবদ্ধ নয়, না এক পেট ভোজের মধ্যে। তার ‘জোরন’ (জোড় বা সম্বন্ধ-প্রস্তাব) থেকে ‘পানচিনি’ (পাকাকথা) থেকে ‘জলসহা’ থেকে ‘কন্যাবিদায়’ ও ‘বধূবরণ’ ইত্যাদি ইত্যাদি নানা উপবিভাগের কথা শুনিয়েছেন লেখিকা সতেরোখানি অধ্যায় জুড়ে; তাতে ,এমনকি, ‘রঙ্গরসিকতা’ থেকে ‘পুনর্বিবাহ’ পর্যন্ত অধ্যায় রয়েছে।

    ‘পুনর্বিবাহ’ বা ‘পাছবিয়া’ উত্তরভারতে আজও বহুলপ্রচারিত ‘গহনা’-র সমতুল। শৈশবেই সেকাল বিয়ে হয়ে যেত মেয়ের কিন্তু সে থেকে যেত পিতৃগৃহেই। তার রজোদর্শন হলে মহা উপচারের মাধ্যমে তাকে শ্বশুরঘর করতে পাঠানো হত। মেয়েলী গান বাঁধা হত, ‘সাধের গাছে কী ফুল ফুটেছে/খবর গেল ছেলের ঠাগমার কাছে…’ (ফরিদপুর)

    আবার, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অনেক অনেক কাল আগে থেকেই বাঙালি হিন্দুর নানান উপবিভাগে বিধবা বিবাহ ও স্বামী-পরিত্যক্তার বিবাহও অ-চালু ছিল না। রংপুর-গোয়ালপাড়া অঞ্চলে এই উপলক্ষ্যে বাঁধা হরেক গান ঠাঁই পেয়েছে চন্দ্রাদেবীর বর্তমান গ্রন্থে। প্রাজ্ঞ লেখিকা দীর্ঘ তিন-সাড়েতিন দশক ধরে বাংলা ও আসামের নানান অঞ্চলে পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে বিশেষ সযতনে গড়ে তুলেছেন এই মহাগ্রন্থ। এমন নিবেদিতপ্রাণতাকে কুর্নিশ জানাই। এর তুলনা দুর্গাদাস লাহিড়ী মশায়ের যুগগ্রন্থ ‘বাঙালির গান’ , ৬১-তম সংখ্যা পরবাসে যার কথা ছিল।

    ***

    সুর তো গানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাকে ছাড়া তো আর একটি কবিতা ‘গান’ হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু কাগজে-কলমে লেখা এমন একখানি বইয়ের মাধ্যমে কী করে সুরের ছোঁয়া লাগানো যেতে পারে পাঠক/শ্রোতার মনে (এ’ তো আর গানের স্বরলিপি-বই নয়)? তবে, আজকের এই ইউটিউবের যুগে তারও নিদান পাওয়া সম্ভব। তেমন কিছু লিংক/সাইটের উল্লেখও করেছেন লেখিকা।

    প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে সেখানে ব্যবহৃত বেশ কিছু আঞ্চলিক বা স্বল্প-ব্যবহৃত শব্দের একটি লিস্টি দেওয়া রয়েছে (শব্দার্থ সহ)। এইটি বড় কাজের। নৈলে, শোলোইদ মানে হলুদ, বা জাঙাল মানে পথ বা জাঙ্গি মানে পালকি আমরা জানতুম কী করে?

    এই গোত্রেরই ‘নারীর গান শ্রমের গান’ বলে আরেকটি বই চন্দ্রা লিখেছেন অবহেলিত নারীশ্রম নিয়ে। ব্লার্বে এ’তথ্য জানতে পেরে বইখানি পড়বার উদগ্র আগ্রহ জেগে উঠছে!

    ***

    সবশেষে , বইটির অসাধারণ ‘উৎসর্গ-পৃষ্ঠা’টি হুবহু এখানে তুলে দিয়ে আজকের এই লেখাটি শেষ করবার লোভ সামলাতে পারছি না:

      বাবায় পুছারি করে বরু যায়রে কোন্ দ্যাশে?
      কথার দোসর নাই যাই বাবা শ্বশুর দ্যাশে।
      মায়ে পুছারি করে বরু যায়রে কোন্ দ্যাশে?
      বিছিনার দোসর নাই যাই মাই শ্বশুর দ্যাশে।”

      যে মেয়েরা বিয়েকে বোঝাতে   এমন গান বাঁধতে পারেন---তাঁদের সবার উদ্দেশে-
    এমন উৎসর্গপত্রের সামনে শির না ঝুঁকিয়ে উপায় নেই।

    || তোমার লেখনী যেন ন্যায়দণ্ড ধরে… ||

    আনন্দবাজার পত্রিকা ও সমসময়ের শতকথা--সুবর্ণ বসু; আনন্দ পাবলিশার্স; কল-৯; ২০২৩ . ISBN : 978-93-5425-204-4

    • দ্য টাটা আয়রন এণ্ড স্টিল কোম্পানি
    • বম্বে ডায়িং এণ্ড ম্যানু কোং লিঃ
    • পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, বা
    • দক্ষিণের ই আই ডি প্যারি গ্রুপ

    খুঁজলে, শতবর্ষ-পেরোনো ভারতীয় কোম্পানির নাম কম পাওয়া যাবে না সংখ্যায় । পুস্তক-ও-প্রকাশনার জগতেও বম্বের সাহু জৈনদের ‘টাইমস অব্‌ ইণ্ডিয়া’ বা মাদ্রাজের হিগিনবথাম (প্র. ১৮৪৪) বুকস্টোর শতবর্ষ পেরিয়েছে; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির কাছে কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র একটা আলাদা স্থান আছে, আছেই, যাকে গালি না দিয়ে অনেক বিপ্লবীর দিন শুরু হয় না (কিন্তু তথায় স্থান পেলে তাঁরাই আবার শ্লাঘা বোধ করেন নেপথ্যে)!

    আর, এইখানেই আনন্দবাজারের জয়।

    ব্রিটিশ ভারতের প্রেস অর্ডিনান্স বলে ছয় মাস বন্ধ ছিল আনন্দবাজার পত্রিকা (১৯৩০), তো ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার করিয়ে এসে মানুদা মন্ত্রীমণ্ডলীতে সদম্ভে আবাপ-র ভুষ্টিনাশ করেছিলেন (১৯৭৫), তো সুনির্বাচিত বামামলে গায়ের জোরে ডেড় মাস পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল (১৯৮৪)।

    তবুও শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আনন্দবাজার একশ’ বছর পূর্ণ করল (২০২২)।

    ***

    সন ১৯২১।

    দেশসেবায় দৃঢ়সংকল্প প্রফুল্লকুমার সরকার (১৮৮৪-১৯৪৪) ততদিনে ঢেঙ্কানলের রাজপরিবারের গৃহশিক্ষকতার চাকুরি ছেড়ে কলকাতায় ফিরে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য় মামাশ্বশুর মতিলাল ঘোষের সাকরেদি শুরু করেছেন। কিন্তু এ’টুকুতে মন ভরলো না তাঁর। বাল্যবন্ধু ও জেলখাটা বিপ্লবী সুরেশচন্দ্র মজুমদার তখন সদ্য এক প্রেস খুলেছেন বাগবাজার স্ট্রিটে। শ্রীগৌরাঙ্গ প্রেস। সেইখান থেকে ১৩ই মার্চ ১৯২২, দোলপূর্ণিমার দিনে রাঙাকালিতে ছেপে বেরোল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’। কালির রঙটিতে ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা বিপ্লবীয়ানার গন্ধ তখনই পেয়েছিল; প্রফুল্লকুমার অবিশ্যি একে দোলের রঙ বলেছিলেন। এমন সব তথ্য দিয়ে যে বইয়ের শুরুয়াত, সে প্রায় সাড়ে তিনশত পৃষ্ঠার পৃথুলা হলেও রাত জাগিয়ে পড়িয়ে নেয় পাঠককে।

    বড় মনোজ্ঞ এর লিখনভঙ্গিমা!

    বিশ্বের সর্বাধিক প্রচারিত ইং দৈনিক ‘টাইমস অব্‌ ইণ্ডিয়া’র ইতিহাস লিখেছিলেন শ্রীমতী সঙ্গীতা মালহান সে প্রায় এক যুগ আগে। বাংলায় এমন ‘জীবনীগ্রন্থ’ আগে পড়েনি চোখে (যদিও অতি সম্প্রতি অমৃতবাজারের উপরে এমন এক বই দেখলাম বটে।)

    নবীন লেখক সুবর্ণ বসু এক প্রলিফিক কাজ করেছেন: একটি পত্রিকার জীবনী লিখতে বসে দুই মলাটের মধ্যে এক জাতির ইতিহাস ধরে রেখেছেন। বা, চলমান পৃথিবীরই হয়তো। কারণ, আনন্দবাজারের প্রতিষ্ঠাকালে গান্ধীর অহিংস যজ্ঞের সূত্রে যেমন খিলাফত আন্দোলন (তৎসঙ্গে তুরস্ক ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস) এসেছে, তেমনি স্বাধীনতাপ্রাপ্তি থেকে দেশভাগ-দাঙ্গা-বাংলাদেশযুদ্ধ-ইন্দিরাহত্যা-কোভিডাতঙ্ক…কী নয়?! এবং ঐ ঐ কাণ্ডে আনন্দবাজারের ভূমিকা/অবস্থান কী ছিল, সম্পাদকীয় কলাম ঘেঁটে ঘেঁটে লেখক সে-সব মণিমুক্তা তুলে এনেছেন--যার কিছু আমি পছন্দ করতে পারি আবার অন্য তেমন কিছুর ঠাঁই ভাবি আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু ইতিহাস তো ইতিহাসই--নির্বাক ও অকপট! সেই নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে ইতিহাস পাঠ করতে এই কেতাবের কাছে ফিরে ফিরে আসতে হবে বৈকি!

    ***

    আনন্দবাজারের দীর্ঘ চলার পথে বাঁক যেমন নানান এসেছে, তেমনি এসেছেন বহু কাণ্ডারী, যাঁরা কখনও পাদপ্রদীপের আলোকে, যদিও বেশিরভাগ সময়ে অলক্ষ্যে থেকেই, প্রকাশনা-হাউজটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এঁদের মধ্যে সন্তোষকুমার/সাগরময় ঘোষ তো কিংবদন্তী, কিন্তু আলোকচিত্রী বীরেন সিংহ বা লাইব্রেরিয়ান শক্তি রায় বা দীপঙ্কর পুরকায়স্থ বা এম ডি শোভা সুব্রহ্মণ্যম্‌ অনালোচিতই থেকে যান বা যেতেন, যদি না এই গ্রন্থে তাঁদের সচিত্র উপস্থিতি ও আলোচনা থাকত। সাধুবাদ!

    ***

    চমৎকার ছাপাই-বাঁধাই বইটির। কয়েকটিমাত্র তথ্য/মুদ্রণপ্রমাদ নজরে এসেছে:

    ‘নেপার’ পৃ ৯৮, ‘ভারত মহাসাগর’ পৃ ১১৫, ‘গভর্নর জেনারেল হার্বার্ট’ পৃ ১১৯, ‘জিজ্যেস’ পৃ ১৩১, ‘মধ্যে’ পৃ ১৫৩, ‘তালিবানদের’ পৃ ২৯২

    কিন্তু সুবৃহৎ এই বই থেকে অপ্রাপ্তি কিছুই থাকবে না, তা কি হয়?

    দোসর অমৃতবাজার গোষ্ঠীর সঙ্গে এঁদের পারিবারিক বিবাদ অজ্ঞাত নহে। তা বলে আনন্দবাজারের ইতিহাস লিখতে বসলে অমৃতবাজার/যুগান্তরের কথা একেবারেই আসবে না তা কি হয়? মোহনবাগানের ইতিহাস কি কভু ইস্টবেঙ্গলকে না নিয়ে লেখা যাবে?

    ঘরের পাশে বাংলাদেশ যুদ্ধের কথা সামান্য ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে মাত্র। আর, ঘরের মধ্যেই নকশাল আন্দোলনের কথা প্রায় নেইই--যা বাংলা/বাঙালি তথা আনন্দবাজারকে ছেয়ে থেকেছিল দীর্ঘকাল।

    বানতলা হত্যা প্রসঙ্গে জ্যোতি বসুর বিতর্কিত ‘অমন তো কতই ঘটে’ উক্তিটিকে সেইরূপেই রাখা হয়েছে, সত্য-উন্মোচনের চেষ্টা হয়নি। আর, সাতাত্তরে ভোটে জিতে এসে কবে কখন উনি শিল্পপতিদের ঘেরাও করে রেখে পানীয় জলটুকু পর্যন্ত না দিয়ে অমন কঠোর উক্তি করেছিলেন জানি না/কোথাও পড়িনি (‘পুঁজিবাদীরা আমাদের শ্রেণীশত্রু। কোনো রকম দয়ামায়া যেন তারা আশা না করে।’)

    ***

    এমন বিতর্ক আর না বাড়িয়ে আবাপ-র দ্বাদশবর্ষে রবীন্দ্রনাথের পাঠানো সেই আশীর্বাণীটি দিয়ে এ’কলম আজকের মতো গুটনো যাক্‌:   তোমার লেখনী যেন ন্যায়দণ্ড ধরে
      শত্রু মিত্র নির্বিভেদে সকলের পরে।
      স্বজাতির সিংহাসন উচ্চ করি গড়ো,
      সেই সঙ্গে মনে রেখো সত্য আরো বড়।
      স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্দ্ধে ওঠো,
      কোরো না দেশের কাছে মানুষেরে ছোট।

    এই ক’টি গুরুবাণীর মধ্য দিয়েই নবীন লেখকের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। (ভয় নেই, ম্যাকিয়াভেলিও মেডিচিদের দাক্ষিণ্যেই ‘দ্য প্রিন্স’ লিখে কালজয়ী হয়ে রয়েছেন)।

    পুনঃ বইটির শেষে আবাপ-র যাত্রাপথের একটি ‘টাইমলাইন’ দেওয়া থাকলে বড্ড উপকারী হতো।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments