• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • বেলজিয়ামের ঘেন্ট শহর বেড়ানোর রোজনামচা : স্বস্তিকা চ্যাটার্জী দাস

    গত বছর এপ্রিলে, পশ্চিম ইউরোপে একটা লম্বা সফর সেরে কলকাতা ফেরার আগে কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিতে গিয়েছিলাম আমাদের মেয়ের কর্মস্থান বেলজিয়ামের “ঘেন্ট” শহরে। সেই সুবাদে বেশ স্বচ্ছন্দ আরামে ঘুরে ফিরে দেখলাম সুন্দর শহরটাকে।

    প্রথমদিন সারা সকাল হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করে, বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম কাছেই সিটাডেল পার্কে। এই জায়গাটা কিন্তু শুধুই একটি সাধারণ শহুরে পার্ক নয়; “লাইয়ে (বা লিস)” ও “শ্ক্লেড” নদীর মাঝে বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠা এই পার্কটি বেশ ভালোই একটি পর্যটন স্থান। কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে আমাদের সেই জায়গা সম্বন্ধে একটু-আধটু পড়াশুনো করে নেওয়ার অভ্যেস আছে। সেই সুবাদে জেনেছিলাম যে ১৯ শতকের গোড়ার দিক থেকে প্রায় কুড়ি বছর ধরে এখানে নির্মাণ করা হয়েছিল সেই সময়ের ইউরোপের একটি অন্যতম দুর্গ – “ডাচ সিটাডেল” এবং তারপর অনেকদিন অবধি জায়গাটা সৈন্যদের থাকার ও অস্ত্রশস্ত্র রাখার জন্যে ব্যবহার হত। পরে ওই শতকেরই শেষের দিকে জায়গাটাকে পার্ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়; তারপর নানা সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তনের সাথে সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে।


    সিটাডেল পার্ক

    সবুজের সমারোহের সাথে, নানা ধরনের ফুলের বাগান, বড়সড় সুন্দর একটা হ্রদ, ছোটদের জন্যে খেলার জায়গা, সবুজ ঘাসে মোড়া ছোট ছোট পাহাড়, নানা জায়গায় ছড়ানো-ছেটানো প্রচুর মূর্তি আর ভাস্কর্য – সব মিলিয়ে অপূর্ব পরিবেশ। পার্কের ভেতরে পুরনো দিনের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শনের ভেতরে সবচেয়ে অন্যতম হল “ঘেন্ট”এর তৎকালীন স্থপতির তত্ত্বাবধানে বানানো পাথরের ভিতের ওপরে লোহা দিয়ে তৈরি আটকোনা গম্বুজাকৃতির একটা “মিউজিক কিওস্ক” (সঙ্গীত শামিয়ানা)।

    বাচ্চাকাচ্চা, বয়স্ক মানুষ, প্রেমে মগ্ন দম্পতি, নেশায় আচ্ছন্ন ছন্নছাড়া মানুষ...এরকম নানা রকমের লোকজনে পার্ক বেশ জমজমাট। আর যাদের কথা না বললে এই পার্কের গল্প সম্পূর্ণ হবে না, তারা হল হাঁসের দল – আর এই হাঁসেদের মধ্যে আবার রাজহাঁসগুলোর ভয়ঙ্কর রকমের জাত্যভিমান! তারা নিজেরা মাঝে মাঝেই লেকের জল থেকে উঠে পাড়ের উপর এসে নরম ঘাসে রাজকীয় চালে পায়চারি করছে; কিন্তু পাতিহাঁসগুলো তাদের ধারে কাছে এলেই, সবাই মিলে বিশ্রীরকম প্যাঁকপ্যাঁক আওয়াজ করে তাদের তাড়িয়ে জলের দিকে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের মস্তানি হাবভাব দেখে বেশি কাছে যাওয়ার সাহস হল না। তাই আমরা দূর থেকেই খানকয়েক ছবি তুলে ক্ষান্ত হলাম।

    এমন সুন্দর পরিবেশে, রোদ ঝলমলে দিনে, মনোরম মিঠে বাতাস গায়ে মেখে আমাদের মনেও বেশ উড়ু-উড়ু ভাব এসে গেল – আমরা দুটি প্রবীণ দম্পতি লেকের ধারে রাখা কাঠের বেঞ্চে বসে দিব্যি কাটিয়ে দিলাম সন্ধ্যেটা।

    বেলজিয়ামের “ফ্লেমিশ” অঞ্চলে অবস্থিত “ইস্ট ফ্লান্ডার্স” প্রদেশের রাজধানী এবং দেশের তৃতীয় বৃহত্তম “ঘেন্ট” শহরটি, বন্দর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে সুবিখ্যাত। তবে এই প্রাচীন শহর এককালে (১৮ থেকে ১৯ শতক) বয়ন শিল্পের জন্যেই বিখ্যাত ছিল। শহরের প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্য অত্যন্ত যত্ন সহকারে সংরক্ষিত রাখা আছে, কিন্তু অতিরিক্ত ভিড়ের চাপ নেই - তাই আমাদের মত ভ্রমণবিলাসীদের পর্যটনের পক্ষে ভারি আকর্ষণীয়।

    পরের দিন আমরা ঠিক করলাম ঐতিহাসিক “সিটি সেন্টারে” যাব – উদ্দেশ্য বিখ্যাত দুটি গির্জা “সেন্ট ব্যাভো’স ক্যাথেড্রাল” আর “সেন্ট নিকোলাস” দেখে “লাইয়ে (বা লিস)” নদীর ধারের “ঘ্রাস্লেই” (বা “গ্রাস স্লেট”), “কোরেনলাই” (বা “কর্ণলে”) আর “সেন্ট মাইকেল ব্রিজে” খানিক বেড়ানো। কিন্তু সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া আর মাঝেমাঝেই ঝোড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টি – আমরা ঘুম থেকে উঠে খানিক দমে গেলেও, চা-জলখাবার খাওয়ার পর চাঙ্গা হয়ে ছাতা বগলদাবা করে বীরদর্পে বেরিয়ে পড়লাম।


    সেন্ট ব্যাভো’স ক্যাথেড্রাল

    কন্যার বাসস্থানটি ঘেন্ট সেন্ট পিটারস স্টেশনের খুব কাছে হওয়ায় আমাদের বেশ সুবিধে হয়েছিল। ওই একই চত্বরেই বাস ও ট্রামের ডিপো। আগে থেকে মেয়ের কাছে ভাল করে বুঝে নিয়েছিলাম আর ট্রামের পাস কাটা ছিল। ইয়োরোপে পাব্লিক পরিবহন এত ভালো বলে বেড়ানো খুবই আরামদায়ক।

    দিব্যি পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। তবে স্টপে নামার পর দেখলাম, যা হাওয়ার দাপট তাতে আমাদের ভারতীয় আজকালকার শৌখিন ছাতা অচিরাৎ হাড়গোড় ভাঙ্গা “দ” হয়ে যাবে। আর ঠাণ্ডাও বেশ জবরদস্ত। আমরা অবশ্য ভালোই প্রস্তত ছিলাম – ভারী ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট মুড়ি দিয়ে জলদি পা চালিয়ে ঢুকে পড়লাম “সেন্ট ব্যাভো’স ক্যাথেড্রালে”।

    ইউরোপের মধ্য যুগের ইতিহাসে ঘেন্ট যে কীরকম সমৃদ্ধ শহর ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় এখানকার সুবিশাল ও অপূর্ব শিল্প সম্ভারে সাজানো গির্জাগুলো দেখলে। তার মধ্যে এই “সেন্ট ব্যাভো’স ক্যাথেড্রাল” অন্যতম। দশম থেকে সপ্তদশ শতক ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে ওঠা গথিক শৈলীতে তৈরি প্রায় ৯০ মিটার উঁচু এই ক্যাথেড্রালটি বিশেষ ভাবে বিখ্যাত তার ভেতরে রাখা অসাধারণ সব শিল্পকর্মের জন্যে। তার মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে বিখ্যাত ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের শিল্পী “ইয়ান ভন এইক” আর তার ভাই, “হুবার্ট ভন এইকের” আঁকা ফ্লান্ডার্স চিত্রকলার অপূর্ব নিদর্শন, “ঘেন্ট অলটার পিস” বা “দ্য এডোরেশন অফ দ্য মিস্টিক ল্যাম্ব”।


    দ্য এডোরেশন অফ দ্য মিস্টিক ল্যাম্ব

    এছাড়াও আছে সেই যুগের অন্যান্য সুবিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা বহু ছবি। এই ক্যাথেড্রালে একমাত্র “দ্য মিস্টিক ল্যাম্ব” দেখার জন্যেই টিকিট কাটতে হয়। পুরো শিল্পকর্মটি প্রায় ৩.৫ মিটার উঁচু ও ৪.৫ মিটার চওড়া, যার দু’পিঠ মিলিয়ে কুড়িটি ভাঁজ যোগ্য প্যানেলে অসাধারণ তুলির টানে ফুটে উঠেছে যীশু খৃষ্টের জন্ম কাহিনী থেকে ক্রিশ্চান ধর্মের বিভিন্ন বিশ্বাস ও আখ্যান। এছাড়া আছে ক্যাথেড্রালের আদি যাজকদের (সেন্ট জন, সেন্ট বাভো), ও সেই সময়ের ঘেন্ট শহরের বিশিষ্ট নাগরিক ও পৃষ্ঠপোষকদের ছবি। এই সবের মধ্যমণি হল ১৮ নম্বর প্যানেলে আঁকা সেই বিশ্ব বিখ্যাত ছবি “দা অ্যাডোরেশান অফ দ্য মিস্টিক ল্যাম্ব” – এখানে “ল্যাম্ব” যীশু খৃষ্টের প্রতীক; তিনি দাঁড়িয়ে আছেন একটা বেদীর (অলটার) ওপর, আর তাকে ঘিরে আছে চোদ্দজন দেবদূত; সেই ভেড়ার শরীর থেকে রক্তধারা এসে জমছে একটা পাত্রে, কিন্তু তার স্থির শান্ত দৃষ্টি সামনের দিকে সমাহিত - মানুষের জন্যে যীশুখৃষ্টের আত্ম নিবেদনের কী অপূর্ব প্রতীকী! এই শিল্প দেখা আমার কাছে জীবনের এক অন্যতম অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।


    অসাধারণ সব শিল্পকর্ম

    ব্যাভো’স ক্যাথেড্রালে অনেকটা সময়ে কাটানোর পরে বেরিয়ে দেখলাম, বৃষ্টি থেমে গেছে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দেরি করলাম না। বিশাল চত্বরে ঘুরেফিরে, ছবি তুলে, ঘেন্টের বিশেষ খাবার “ফ্রিজেস” (ফ্রাইস) আর “মেজেল” (দারচিনি “প্যাস্ট্রি” বা বান) দিয়ে কিঞ্চিত পেটপুজো সেরে নিলাম।

    তারপর রাস্তার ওপারে পাঁচ মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেলাম “সেন্ট নিকোলাস চার্চে”। পুরনো “করে(ন)মার্কট” অঞ্চলের পাশেই তেরো শতকে স্থাপিত এই প্রাচীন গির্জাটির বিশেষত্ব তার নীলচে ছাই রঙের পাথরে তৈরি এই অঞ্চলের অসাধারণ “শ্ক্লেড গথিক” গঠনশৈলী। গির্জার মাথায় যে মিনার বা চূড়া সেগুলো বেশ অভিনব, যেমন “ল্যান্টর্ন টাওয়ার”-যার ওপর আলো পড়লে মনে হয় যেন লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাখা আছে। এই গির্জাটির আরেকটা বিশেষ আকর্ষণ এখানে রাখা প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো একটা “অরগ্যান”, যদিও এখন আর সেটা বাজে না, কিন্তু বেলজিয়ামের সঙ্গীতের ইতিহাসে এই অরগ্যানটি ও তার নির্মাতা “কাভাইয়ে কল” এর বিশেষ মর্যাদার স্থান আছে। ইউরোপের বেশিরভাগ গির্জার মতোই, এখানকার অপূর্ব সব পেন্টিং আর “স্টেনড গ্লাস” শিল্প খুবই চিত্তাকর্ষক।

    ইউরোপের প্রায় সব জায়গাতেই মধ্যযুগের গথিক শৈলীর এত চার্চ দেখেছি, কিন্তু তার মধ্যে “ঘেন্ট” শহরের এই দুটি গির্জা আমাদের দেখা অন্যতম গুলোর মধ্যে পড়ে।

    আমাদের পরিকল্পিত সময়ের থেকে অনেকটা বেশিই এই দুটি গির্জাতে কাটিয়ে আমরা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাছেই এই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন ও বিখ্যাত কফি শপ “মকাবন”; আমরা দুই কফি-প্রেমী ঢুকে পড়লাম সেখানে। আহা! সেই কফির স্বাদই আলাদা; মন ভরে গেলো আর শরীরও চাঙ্গা!

    এবার গন্তব্য “লাইয়ে (বা লিস)” নদীর ওপরে “সেন্ট মাইকেল ব্রিজ”। বিখ্যাত স্থপতি “লুই ক্লকেট” পরিকল্পিত, একশো বছরের বেশি পুরনো, এই পাথরের ব্রিজটির ওপর থেকে নদীর ধারের ঐতিহাসিক “ঘেন্ট সেন্টারের” দৃশ্য দেখতে ভারি ভালো লাগল। এছাড়া, ড্রাগনের সাথে যুদ্ধরত বর্ম-পরা সেন্ট মাইকেলের ব্রোঞ্জ মূর্তিটি ভাস্কর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। কন্যা আমাদের বিশেষ করে বলে দিয়েছিল যে এই ব্রিজ যাকে বলে “রোম্যান্টিক” প্রাণেদের ছবি তোলার অন্যতম পীঠস্থান আর তাই দুজনের যুগল ছবি একেবারে আবশ্যিক কর্তব্য! আকাশ পরিষ্কার থাকতে থাকতে নদীর ওপারের ঘেন্টের বিখ্যাত টাওয়ারগুলি দৃশ্যপটে রেখে বেশ কিছু ছবি তোলা হল। অনেক পর্যটক, উৎসাহী ফটোগ্রাফারেরও কমতি নেই, তাই বেশ ক’টি যুগল ছবিও তোলা হল।


    সেন্ট মাইকেল ব্রিজ

    ব্রিজ দিয়ে নেমে আমরা পৌঁছে গেলাম সেই পঞ্চম শতাব্দী থেকে গড়ে ওঠা “লাইয়ে (বা লিস)” নদীর দুই বিপরীত ঘাট “ঘ্রাস্লেই” (বা “গ্রাস স্লেট”) আর “কোরেনলাই” (বা “কর্ণলে”) অঞ্চলে। নদীর দুই ধার দিয়ে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যযুগীয় ফ্লেমিশ ও ইউরোপীয় স্থাপত্যের অনন্য সুন্দর রূপের ডালি সাজিয়ে অসংখ্য বাড়ি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান – যেন এক রূপকথার দেশ! সমস্ত বাড়ির সামনের দিক (“ফ্যাসাড”) গুলোর পুরনো স্থাপত্য এমন সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখা আছে যে মনে হয় সময় যেন এখানে থমকে গেছে। আমাদের সাথে এক জার্মান পর্যটকের আলাপ হয়েছিল, তিনি “ম্যারিয়ট হোটেলের” “ফ্যাসাডের” একটা বেশ আকর্ষণীয় নকশার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন – দুটো বিপরীতমুখী হলুদ রঙের রাজহাঁস, এবং বললেন যে সেকালে বাঁ-দিকেরটি “মহিলা” ও ডান দিকেরটি নাকি “মদিরা” হিসেবে ভেবেই এই শিল্পকর্মটি নাকি করা হয়েছিল। ওনার এই তথ্যের সত্যতা কতটা জানি না, কিন্তু আমাদের কাছে গল্পটা বেশ মজাদার লেগেছিল।

    এই পুরো অঞ্চলটাতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই পর্যটকদের ভিড় বেশ বেশি। সবাই একেবারে নিরুদ্বেগ স্বচ্ছন্দ আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে বা নানারকম পানীয় হাতে বসে গল্পগুজব করছে।

    আমাদের পরের দিন সকাল থেকেই ভ্রমণ শুরু হল “গ্রাভেন্সটিন” দুর্গ দর্শন দিয়ে। “লাইয়ে (বা লিস)” নদী থেকে প্রশাখা কেটে বানানো পরিখার মাঝে অবস্থিত, পাথরে গাঁথা এই মধ্যযুগীয় সুবিশাল দুর্গটি “ইস্ট ফ্ল্যানডারস” এর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী। ১২ শতকের শেষের দিকে “কাউন্ট ফিলিপ ১ অফ আলসাস”এর আমলে তৈরি হওয়া এই দুর্গ, প্রায় দুশো বছর ধরে “ফ্ল্যানডারস” এর “কাউন্ট” বা শাসকদের বাসভুমি ছিল। পরবর্তী কালে আদালত, কারাগার, টাঁকশাল বা কখনও তুলোর কারখানা ইত্যাদি কাজকর্মের জন্যে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে। তারপরে অনেকদিনের অব্যবহার ও অযত্নে প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল। পরে বেশ অনেকদিনের পুনরুদ্ধারের প্রয়াসের ফলে আজকেও সে এই শহরের এক প্রধান সৌধ হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।


    গ্রাভেন্সটিন দুর্গ

    আমরা আগেই অনলাইনে টিকিট কেটে নিয়েছিলাম, তাই চটপট দুর্গের ইতিহাস আর গল্প শোনার অডিও হেডফোন লাগিয়ে শুরু করলাম ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটা। এই দুর্গের বিশেষত্ব মাঝখানের বিশাল মিনার যার ভেতরের অলিগলি, সরু সরু খাড়া সিঁড়ি দিয়ে দুর্গের একেবারে ছাদে পৌঁছে যাওয়া যায়, যেখান থেকে পুরো “ঘেন্ট” শহরের অসাধারণ “প্যানোরেমিক” দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়। ছাদ জুড়ে অনেক ছোট ছোট ঝুলন্ত বারান্দার মত করা আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে ঘেন্ট শহরের পটভূমিতে বেশ কিছু ছবি তোলা হল।

    দুর্গের ভেতরে অজস্র ছোট-বড় কালো পাথরে গাঁথা প্রকোষ্ঠে মধ্যযুগীয় শাসকদের বিচিত্র বিলাসবহুল জীবন, তাদের যুদ্ধের ইতিহাস, জীবনের অন্ধকার কলঙ্ক, নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী এই সব দেখতে দেখতে (এবং শুনে) মনে হচ্ছিল যেন সেই সুদূর অতীতের জীবন-নাটক আমাদের সামনেই ঘটে চলেছে। এখানকার “টর্চার মিউজিয়াম”-এ রাখা বীভৎস সব অত্যাচারের যন্ত্র ও পদ্ধতি দেখে শিউরে উঠেছিলাম।

    “গ্রাভেন্সটিন” দেখে, আমরা ট্রামে চড়ে চলে গেলাম আগের দিনের ঘুরে আসা “সিটি সেন্টারে”; তার প্রধান কারণ আগের দিন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম বলে, শহরের একটি অন্যতম আকর্ষণ “বেলফ্রাই” (বা ঘণ্টাঘর)-এর ভিতরে ঢুকে দেখা হয়নি – সেই সাধ মেটানোর জন্যে। “সেন্ট ব্যাভো’স ক্যাথেড্রাল” আর “সেন্ট নিকোলাস চার্চ”-এর মধ্যস্থলে অবস্থিত, প্রায় ৯০ মিটার উঁচু ৫৪টি ঘণ্টায় সজ্জিত ঘন্টাঘরটি, “ইউনেস্কো হেরিটেজ” স্থাপত্য হিসেবে স্বীকৃত ও মধ্যযুগীয় ঘেন্টের সমৃদ্ধির অন্যতম প্রতীক। এর মাথার উপরের সোনালি বর্ণের আগুনমুখো ড্রাগন যেন এই শহরের পাহারাদার।

    প্রথমে গেলাম “ক্লথ হল”, যেখানে ছিল ঘেন্টের উল আর কাপড়ের বিখ্যাত বাজার। তারপর “বেলফ্রাই”এর গড়ে ওঠার ইতিহাস, ড্রাগনের গল্প ইত্যাদি দেখে-শুনে, ঘণ্টাঘরের মাথায় ওঠার খুব ইচ্ছে হল। কিন্তু আড়াইশোর বেশি সিঁড়ি বেয়ে ওঠা তো আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অগত্যা লিফটের খোঁজ – দোতলার পর থেকে একটা লিফট আছে, খানিক লাইনে দাঁড়ানোর পর, সেই লিফটে করে উঠে গেলাম ঘণ্টাঘরের মাথায়। সেখানে রাখা আছে ৩০ টন ওজনের ৫৪টি “ঘণ্টামালা” (“ক্যারিলন”) বাজানোর সেই আশ্চর্য যন্ত্র যা কিনা আজও প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর বাজায় অপূর্ব সুরের মূর্ছনা। ঘণ্টাঘরের মাথা থেকেও ঘেন্ট শহরের পরিদৃশ্য দেখতে খুবই সুন্দর লাগল।

    পরের দিন গেলাম আমাদের অবশ্য দ্রষ্টব্য তালিকার শেষ গন্তব্য সিটাডেল পার্কের সংলগ্ন বেলজিয়ামের সবচেয়ে পুরনো সংগ্রহশালা “মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস”। স্থপতি “ভ্যান রাইসেলবার্গের” সৃষ্টি এই মিউজিয়াম ভবনটির খোলামেলা পরিবেশটি আমার বেশ লাগল। মধ্যযুগীয় থেকে বিশ শতকের আধুনিক ফ্লেমিশ শিল্পীদের ও ইউরোপের অন্যান্য বিশিষ্ট শিল্পীদের অসাধারণ চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যের এমন প্রদর্শন সত্যি অনবদ্য। স্ব-নির্দেশিত সফরের সাহায্যে সম্পূর্ণ সংগ্রহশালাটি বেশ স্বচ্ছন্দ আরামে ঘুরে দেখলাম। এছাড়া এখানে “ঘেন্ট অলটার পিসের” (যা “সেন্ট ব্যাভো’স ক্যাথেড্রালে” দেখার কথা আগেই লিখেছি) যে পুনরূদ্ধার কাজ চলছে তা সরাসরি সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এক অনন্য সংযোজন। সব মিলিয়ে এই সংগ্রহশালাটি সত্যি মনে রাখার মত।

    আমাদের হাতে আর সময় নেই – দেখতে দেখতে ঘরে ফেরার দিন এসে গেল। একটু বাজারহাট আর বেলজিয়ামের সুবিখ্যাত চকোলেট, বীয়ার ইত্যাদি সংগ্রহ না করে কি আর ফেরা যায়? তাই ফিরতি যাত্রার আগের দিন কিছু স্মারক জিনিসপত্র, নানারকম স্বাদের চকোলেট আর বীয়ার ব্যাগস্থ করা হল।

    ইউরোপের নানা সুবিখ্যাত পর্যটন স্থানের ভিড়ে হয়তো ঘেন্টের নাম কখনই বিশেষ জায়গা পায় না, কিন্তু আমাদের মতে বেলজিয়ামের এই পুরনো শহরটি ইউরোপের বুকে লুকোনো এক অজানা মণি, যার কোণে কোণে যেমন ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের অগুন্তি স্মারক আর রূপকথার দেশের সৌন্দর্য, তেমন আছে এক আধুনিক শহরের প্রাণবন্ত নবীন রূপের উচ্ছলতা।


    ঘ্রাস্লেই



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments