এবার কোলকাতায় কুয়াশা বেশ ভালোই ছিল, ভোর থেকে সেই সকাল সাড়ে সাতটা আটটা অব্দি। সাদাটে ছাইরঙা সেই পর্দা ভেদ করে বিশেষ কিছুই দেখা যেত না। দূরে অটো, ব্যাটারি রিকশ, বাসের আওয়াজ; কাছে চারপাশে চড়ুইয়ের কিচিমিচি—তার মাঝে নিজের তৈরি এক টুকরো জঙ্গুলে বাগানে চায়ের কাপ নিয়ে আমেজ—এমনি কাটছিল এবারের শীত।
তারই মাঝে এল সংক্রান্তি--সকালের কুয়াশা মনে করালো ‘অমৃতকুম্ভ’ উপন্যাসের ধূসর প্রেক্ষাপট। সেইসঙ্গে মনে এল বহুদিন আগে পড়া জেনারেল বেংগলির পাঠ্যপুস্তক ‘কপালকুণ্ডলা’র কথা। ‘জলোচ্ছ্বাস আরম্ভ’-এ নদীপাড় ভেঙে ছিন্নমূল শাপলার মত কপালকুণ্ডলার ভেসে যাওয়া। তাঁর খোঁজে নবকুমারেরও গঙ্গাবক্ষে হারিয়ে যাওয়া আর লেখকের প্রশ্ন ‘সেই অনন্ত গঙ্গাপ্রবাহমধ্যে, বসন্ত বায়ুবিক্ষিপ্ত বীচিমালায় আন্দোলিত হইতে হইতে কপালকুণ্ডলা ও নবকুমার কোথায় গেল?’ মনকে আর একবার তোলপাড় করলো। আর মন তো জলে-ভাসা পাতার মত, আগে পরে ভাবে না; হয়তো তাই সেই কবেকার সূত্র ধরে মনে হল অনেক দিন জোয়ার দেখিনি। নেট-এ দেখলাম ভোর রাতে, প্রায় অন্ধকারে ছিল জোয়ারের সময়। তারপর বেলায় দেড়টার দিকে। সময় হাতে নিয়ে ওই বারোটার দিকে বেরলাম। উবেরের ড্রাইভার নিয়ে গেল বাগবাজার মায়ের ঘাট। সে ঘাট নাকি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
যা আশা করে গেলাম তা পেলাম। হুগলীর জল তখন বাড়ছে। খরস্রোত টেনে নিয়ে যাচ্ছে শাপলা। হাওড়ার দিকের পাড় ধূসর আস্তরণে প্রায় অদৃশ্য। নদীর জল রুপোলি ছাইরঙা, আমরা ঝুঁকে-পড়া প্রাচীন বটগাছের নীচে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে ফিরলাম।
সেই ক্ষণিকের কারণ যা আশা করে গিয়েছিলাম তার থেকে বিপরীত না-আশা-করা অনেক কিছু পাওয়া। আর ফিরে দেখতে বসে মনে হল আমার সংক্রান্তির দিনে ছিল ‘প’ অক্ষরের আধিক্য।
পুণ্যসলিলা হুগলী তাঁর স্নিগ্ধতায় বইছিলেন। হঠাৎ মনে হল সত্যি কি তিনি পুণ্যসলিলা? কেন্দ্রের গঙ্গা প্রজেক্ট অন্তর্ভুক্ত হুগলীরও শুদ্ধিকরণ হয়েছে। কিন্তু আদতে মূর্তি বিসর্জনের কেমিক্যাল রং, বাসি ফুলমালা, স্নানরত নানান মানুষের শরীরের ক্লেদ, সবই তো আছে।
আবার ভাবি নয় কেন? ঘুরিয়ে দেখলে বারবণিতা যেমন গ্রাহকের গলিত ক্লেদাক্ত কামনাবাসনা বহন করে নিজে শরশয্যায় শায়িত--অসীম ক্ষমা নিয়ে, হুগলীও তো একরকম তাই-ই- সে কারণেই তিনি পুণ্যসলিলা।
রঙের বৈপরীত্যও ছিল। দূরে ছাইরঙা বৈরাগী জল। পাড়ে হলুদ কমলা চাদর জড়ানো পুরোহিতদল পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মে ভীষণ ব্যস্ত। সাদা উড়ুনি গায়ে মধ্যবিত্ত শ্রাদ্ধশেষে কাককে পিণ্ডদানরত। আমরা না জেনে সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, মনে হল আত্মার শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে, সরে এলাম। ক্ষণিকের দাঁড়ানো তাই।
মাহেন্দ্রক্ষণের পুণ্য স্নানার্থে জুটেছিলেন মানুষ। আবার স্নান সেরে ভিখারিকে খিচুড়ি পয়সা বিতরণ পাপ স্খলনের আর এক উপায়ও বটে। ঘাটে ঢোকার মুখে তাই দুধারে সার দিয়ে ভিখারির ভিড়। আর আরেকবার ‘প’ অক্ষরের ছড়াছড়ি। পূতিগন্ধময় চারিদিক।
আমার কল্পনা রূঢ বাস্তবে ধাক্কা খেল। মন খারাপের কথা, কিন্তু মনে হল যতটুকু আশা করেছিলাম তার থেকে তো অন্য আরো অনেক পেলাম- কোলকাতার মধ্যবিত্ততা। কত শত মধ্যবিত্তের কাছে ঘাটই পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের একমাত্র স্থান। ঘাট আর শুধুই সুন্দর নয়। সেও বারবণিতার শয্যার মত ক্লেদাক্ত। অন্তত সেদিনকার অভিজ্ঞতা তো তাই বলে।
২৬শে ফেব্রুয়ারি—শিবরাত্রি—সেদিন ছিল সংক্রান্তির শেষ পুণ্য স্নান। ফিরে দেখার দিনও এক মাস আগের শুরুতে। যেন মনে হল অসুন্দরকে স্বীকার না করলে সুন্দরকে পাওয়া যায় না। কবিগুরুর ‘শাপমোচন’-এ কমলিকা অসুন্দর অরুণেশ্বরের বীণার মাধ্যমে তাঁর অন্তরের মাধুর্য উপলব্ধি করার পরই তাঁদের শাপমোচন হয়, তাঁরা স্বর্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। ঠিক তেমন করেই সেদিনকার দুর্গন্ধময় ঘাটকে মেনে নিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন স্নিগ্ধ পুণ্যসলিলা হুগলীকে নিজের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করলাম।