• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • ফ্যান্সি হেয়ার কাটিং সেলুন فینسی ہیرکٹنگ سیلون : গুলাম আব্বাস
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়




    [গুলাম আব্বাস (১৯০৯-৮২) রচিত গল্পটির অনুবাদের জন্য ‘রাহরাওয়ান-এ-আদব’, কলকাতা থেকে প্রকাশিত এবং নাদিম আহমদ সম্পাদিত ‘কুল্লিয়াত-এ গুলাম আব্বাস’-এ মুদ্রিত সংস্করণটি ব্যবহার করেছি।

    —অনুবাদক]



    দেশভাগের পরে দেশছাড়া চার নাপিত জীবিকার সন্ধানে এসে জুটল এক অচেনা শহরে। চারজনেই ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে চা খেতে এসেছে। একই পেশার মানুষ তো, সহজেই পরস্পরকে চিনে নেয়। পরিচয় হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। স্বদেশ ছেড়ে আসা চারমূর্তি একে অপরের দুঃখের কাহিনি শুনে ভাবতে বসল যে এখন তারা করবেটা কী? অল্প পুঁজি আর কাজের কাঁচি- চিরুনি-নরুন সকলের কাছেই ছিল। শেষমেশ ঠিক হল চারজনে মিলেই একটা দোকান ভাড়া নিয়ে যৌথ মালিকানায় কাজ শুরু করা যাক।

    সবে দেশভাগ হয়েছে। শহরে বিভ্রান্তি আর বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। মন দিয়ে কোনও কাজ করার উপায় আছে? ব্যবসা-কারবার সব ঠাণ্ডা মেরে আছে। হলে হবে কী, একটা দোকান খুঁজে পেতেও তাদের অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হল। বেশ কিছুদিন সরকারি দপ্তরে ঘোরাঘুরি চলল। ছোট অফিসার, ক্লার্ক, এমনকী চাপরাশিদেরও নিজেদের দুঃখের কাহিনি বাড়িয়ে-চাড়িয়ে শোনাল। অবশেষে এক অফিসারের দয়া হওয়ায় তিনি ওই চার নাপিতকে শহরের একটা ব্যস্ত মোড়ে এমন একটা দোকানের ব্যবস্থা করে দিলেন যা আগে কোনও নাপিতেরই ছিল। হাঙ্গামা শুরু হওয়ায় দোকানে তালা মেরে সে ভেগে পড়েছে।

    দোকানটা খুব বড় না হলেও আগের মালিক সেটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে বেশ সুন্দর একটা সেলুনের চেহারা দিয়েছিল। দেওয়ালে লাগানো কাঠের তক্তা। তার সঙ্গে মার্বেল পাথরের লম্বা লম্বা টুকরো লাগিয়ে তৈরি হয়েছে টেবিল। একদিকে তিনটে, উল্টোদিকে দুটো। সব টেবিলের সামনেই দেওয়ালে লাগানো ছিল আয়না। আর ছিল লম্বা পায়াওলা চেয়ার, পেছনে গদিওলা কাঠের স্ট্যান্ড লাগানো। খদ্দের বেঁটে হলে সেই স্ট্যান্ড নিচু করে নেওয়া যেত। আর লম্বা হলে আরও উঁচু করা যেত। মাথা পেছনে হেলিয়ে স্ট্যান্ডের গদির ওপর রাখলেই দিব্যি সুন্দর দাড়ি কামানোর ব্যবস্থা হয়ে যেত।

    এসবই দোকানে ছিল বটে। কিন্তু সেগুলো ঠিক হাল ফ্যাশনের ছিল না। কিছু ফাটাছেঁড়াও ছিল। মার্বেল পাথরের স্ল্যাবের কোণগুলোর কোথাও কোথাও চিলতে উঠে গেছে। আয়নাগুলো বড় হলেও কিছুটা পাতলা। খদ্দেরদের মুখের যে ছবি তাতে ফুটে উঠত, তা যেন একটু থ্যাবড়া আর চ্যাপ্টা। একটা আয়না এমন ফাটা যে খদ্দের তাতে মুখ দেখলে একটা মুখের বদলে দুটো মুখের ছবি ফুটে উঠবে। কিন্তু দুটোই আধলা মুখ, দেখলে হাসি পাবে। তাই সে আয়নার সামনে বসা খদ্দেরের তিন চারবার ঘাড়টাকে এপাশ ওপাশ, ওপর নিচে ঘোরানো ফেরানো ছাড়া কোনও উপায় থাকত না।

    তবে চার নাপিত এই সব খামতি নিয়ে মাথা ঘামাল না। আসলে এতসব জিনিসে ভর্তি একটা আস্ত সেলুন যে তারা পেতে পারে তা তো স্বপ্নেও ভাবেনি। স্বদেশে তাদের কেই বা চিনত? এদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড় যে, যাকে অন্যরা ওস্তাদ বলত, তার কয়েকজন বাঁধা খদ্দের ছিল। সেই সব খদ্দেরদের বাড়িতে সে রোজ বা একদিন অন্তর গিয়ে দাড়ি কামিয়ে আসত। তার থেকে বয়েসে একটু ছোট যে নাপিত, সে রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম আর ট্রাক-লরির ডেরাগুলোতে নিজের কারবার চালাত। দিনভর নাপিতের বাক্সটা গলায় ঝুলিয়ে দাড়ি বড় হয়েছে এমন লোকের সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। তারা কখনও এ-দোকান, কখনও সে দোকানে ঘুরে ঘুরে দিনে দেড় থেকে দু টাকা মজুরিতে কাজ করত। এখন হঠাৎই ভাগ্যের আশীর্বাদে জীবনে এই প্রথম স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছেমত কাজ করার সুযোগ পেয়ে তারা ভারি খুশি। তাই সেলুনের আর সেই সঙ্গে নিজেদের অবস্থার আরও উন্নতির জন্য তারা কোমর বেঁধে লেগে পড়ল।

    প্রথমে তো বাজার থেকে একটা রংয়ের ব্রাশ আর কিছু চুন কিনে দোকানের দেওয়াল চুনকাম করে দিল। মেঝেটাকেও খুব ধুয়েমুছে ঝকঝকে করে তুলল। তার পরে নিলামঘর থেকে হাত ফেরতা বিদেশী কাপড়ের দু-তিন গাঠরি সস্তায় কিনে এনে তার থেকে জামা-প্যান্টের ছিট আলাদা করে কেটে রেখে বাকি কাপড় দিয়ে নিজেদের পুরনো জামাকাপড়ের ছেঁড়া জায়গায় তালি লাগাল। ছেঁড়াফাটা অংশ সেলাই করে দিল। যা ছোট করার ছিল তা কেটে ছোট করল, আর এইভাবে দু-তিন জোড়া পোশাক সকলেরই তৈরি হয়ে গেল। এছাড়াও প্রত্যেকের একটা করে চাদরেরও দরকার ছিল, যা চুল কাটার সময় খদ্দেরের গায়ে জড়িয়ে গলার নিচে গুঁজে দেওয়া হত। এই চাদর জোগাড় করা কঠিন হলেও কাপড়ের টুকরো, পুরোনো জাম্পার, কোট আর পাতলুন ছিঁড়ে কোনও ভাবে খদ্দেরের গায়ে ঢাকা দেওয়ার দুটো চাদর তৈরি করা গেল। জামা-কাপড়ের স্তূপের মধ্যে সোনালি রঙের মৌমাছি সেলাই করা রেশমের একটা কালো পর্দাও মিলল। কাপড়টা পুরোনো হলেও তার জলুস তখনও ম্লান হয়নি। পর্দাটাকে সযত্নে ধুয়ে দোকানের দরজায় টাঙিয়ে দেওয়া হল।

    চুল দাড়ি কাটার সরঞ্জাম সকলেরই সঙ্গে থাকাতে তা নিয়ে কোনও চিন্তা ছিল না। তবুও কম দামি কয়েকটা জিনিস কেনা হল: সেলুলয়েডের সাবানদানি, দাড়ি কামানোর বুরুশ, ফিটকিরি, ছোট-বড় চিরুনি, তোয়ালে, দু-তিনটে উগ্র গন্ধের তেলের শিশি, সস্তার ক্রিম আর পাউডারের ডিবে। কাবাড়িওয়ালার দোকান থেকে আরও জোগাড় হল বিলিতি ল্যাভেন্ডারের শিশি। তাতে ভরে রাখা হল সর্ষের তেল।

    দোকানের সাজসজ্জাকেও তারা অবহেলা করেনি। আগের মালিক কে জানে কোন যুগের কিছু ছবি দেওয়ালে লটকে রেখেছিল। সেগুলো নামিয়ে রেখে পুরোনো মার্কিন ফিল্মের বড় বড় রংদার পোস্টার দোকানের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হল। তামাদি জিনিসের দোকানে সেগুলো পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়াও সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা চতুষ্পদী কবিতার স্তবক আর দেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের ছবি দেওয়া একটা ক্যালেন্ডার দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা হল।

    দোকান যাতে ঝটপট খদ্দের ধরতে পারে তার জন্য অনেক কম দামে এই নাপিতরা কাজ শুরু করল -- সেলুনগুলোয় হালে যে দর নেওয়া হত তার আদ্ধেকেরও কম। একটা বোর্ডের ওপর কালো কালিতে চুলদাড়ি কাটার হরেক দর লিখে দেওয়ালের এমন একটা জায়গায় লটকে রাখা হল যাতে খদ্দের দোকানে ঢুকলে প্রথমেই তার ওপর নজর পড়ে।

    সেলুনের আগের মালিক নাম রেখেছিল ‘ফ্যান্সি হেয়ার কাটিং সেলুন’। দোকানের মাথায় সে নাম ইংরেজি আর উর্দুতে বড় হরফে লেখা ছিল। কোনও সরকারি বাবুর কাছ থেকে ‘ফ্যান্সি’ শব্দটার মানে জানার পরে তারা এতই খুশি যে ঠিক হল আপাতত ওই নামেই কাজ চালানো যাক। নতুন নাম রাখতে গেলে পুরনো নামটা মোছা আর তারপরে আবার নতুন নাম লিখতে ভালো রকম খরচের ধাক্কা যে!

    যেদিন সেলুনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার কথা, সেদিন দুপুরে সবাই সযত্নে একে অপরের চুল দাড়ি কেটে, লম্বা-লম্বা জুলফিগুলো ছেঁটে, গরম জলে শরীর খুব দলাই মলাই করে স্নান করে নিল। সাফসুতরো জামা-প্যান্ট গায়ে দিল, যা তারা কাছের একটা লন্ড্রিতে কাচিয়ে ইস্তিরি করে রেখেছিল। চুলে তেল দিয়ে চুলগুলো পেতে আঁচড়িয়ে ঘাড়ে আর মুখে হালকা করে পাউডার লাগাল। তারপরে ধূপের হালকা সুগন্ধে সেই চার নাপিত আগের রাতে মার্বেল পাথরের ওপর ঘষে ঘষে ধারালো করে রাখা ক্ষুরগুলোকে চৌকশভাবে হাতের তালুতে হালকা চাপ দিয়ে ঘষতে ঘষতে জনগণের সেবার জন্য তৈরি হয়ে রইল।

    প্রথম সন্ধ্যায় তেমন সাফল্য এল না। সব মিলিয়ে খদ্দের মিলল পাঁচজন। তিনজন শেভ আর দুজনের চুল কাটা। তাও জুটল পনের মিনিট, আধঘন্টা পর পর। তবে নাপিতরা তাতে হতাশ হয়নি। সব খদ্দেরকে সোৎসাহে স্বাগত জানিয়ে তারা বসার আগে চেয়ারগুলোকে আবার ঝাড়পোঁছ করে দেওয়া হল। খদ্দেরের টুপি, পাগড়ি বা কোটগুলোকে সযত্নে হুকে টাঙিয়ে রাখা হল। দাড়ি নরম করার জন্য অনেকক্ষণ ধরে বুরুশ চালিয়ে খুব ফেনা তৈরি করে নরম হাতে ক্ষুর চালানো হল। আর এত সতর্কতার পরেও যদি কোথাও সামান্য কেটে ছড়ে গেল, তো দ্রুত সাবানের ফেনা তুলে ফেলে শেভ শেষ করে গালে ফিটকিরি ঘষে সেই ক্ষত নির্মূল করে দেওয়া হল।

    কোনও এক নাপিতের মনে হয়েছিল চুল কাটতে অনেক সময় নিলে খদ্দের বুঝিবা খুশি হবে। সে একবার চুল কাটা শেষ হলে চুলের ওপর আরেকবার কাঁচি চালাচ্ছিল। সবশেষে খদ্দেরের চুলে অল্প তেল মাখিয়ে মাথা এমন হালকা মালিশ করে দিচ্ছিল যে খদ্দেরের সেকী আরাম! ওই নাপিত খুব তাড়াতাড়িই মেহনতের ইনাম লাভ করল। চুল কাটার দামের ওপর আরও এক আনা বখশিসও জুটল। খদ্দের কম হলেও সেই সন্ধ্যায় তারা অনেকক্ষণ দোকান খুলে রেখেছিল। তারপরে দোকান বন্ধ করার পরেও দীর্ঘ সময় নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টায় সময় কাটিয়েছিল।

    পরদিন কোনও কারণে অফিসগুলো বন্ধ ছিল। সকাল আটটা থেকেই দোকানে খদ্দের আসা শুরু হল। দশটার পরে তো এমন হল যে একজন যেতে না যেতেই আর একজন এসে যাচ্ছে। কখনও কখনও তো নাপিতদের মধ্যে তিনজনকে কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল। রাতে দোকান বন্ধ করে হিসেব করতেই দেখা গেল যে সবার ভাগে চার টাকা করে আয় হয়েছে। তৃতীয় দিন বাজার আবার মন্দা। কিন্তু চারদিনের দিন আবার খদ্দেরের ভিড় লাগায় চার নাপিত নিশ্চিন্ত হল যে দোকানটা তা হলে এবার ভালোই দাঁড়িয়ে গেল।

    নাপিতরা সেই অজানা শহরে যে যার মত একলাই এসেছিল। তাই রাতে দোকানের মেঝেতে বিছানা পেতে সেখানেই শুয়ে থাকত। একটা ছোট কেটলি, স্টোভ আর কয়েকটা রং করা পিরিচ পেয়ালা কিনে নিয়েছিল। সকালে দোকানেই চা তৈরি হত, নাস্তারও ব্যবস্থা হয়ে যেত। দুপুরে কাছের কোনও তন্দুর থেকে দু-এক রকমের তরকারি আর রুটি এনে চারজনে পেট ভরাত।

    দোকান তখন সবে দিন আটেক চলেছে। একদিন বিকেল গড়িয়ে গেলে মাঝবয়সী, রোগাপাতলা, খুব ভদ্র চেহারার একজন দোকানে ঢুকল। তার জামাকাপড় ময়লা হলেও ছেঁড়াফাটা নয়। ভদ্রলোকের মাথায় সেই ধরনের পাগড়ি যা সচরাচর মুনশি বা ক্লার্কদের বাঁধতে দেখা যায়। পায়ে ভেড়ার চামড়ার জুতো, গালে বড় বড় দাড়ি। এ ফয়সালা বড় সহজ নয় যে তার মধ্যে পাকা বেশি না কাঁচা। চোখে সস্তার চশমা -- একদিকের ডাঁটিটা ভেঙে যাওয়াতে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। নাপিতরা আগন্তুককে চেয়ারে বসতে বললে সে একটু ইতস্তত করলেও শেষমেশ বসে পড়ল।

    এক নাপিত জিজ্ঞেস করল, ‘শেভ?’

    সে বলল, ‘না।’

    ‘চুল?’

    ‘না।’

    ‘তা হলে কি চাইছ?’ বড় নাপিত জিজ্ঞেস করল।

    ‘দয়া করে আমার নখগুলো কেটে দাও।’

    নখ কাটা হলে পরেও লোকটি সেখানেই বসে রইল। শেষ পর্যন্ত যখন নাপিতরা বারবার তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইতে থাকল, তখন সে মুখ খুলল: ‘সাহেব, আমি এক গরিব মুহাজির – দেশছাড়া। দেশে এক ব্যবসায়ীর মুনশি ছিলাম। দোকানের রেশন কার্ডের পর্চার ওপর লেখালেখি আর হিসেব রাখার কাজ করতাম। দেশ ছাড়ার পরে সে রোজগারও বন্ধ হয়ে গেল। এই শহরে বেশ কিছুদিন হল বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছি। কয়েক জায়গায় চাকরির খোঁজেও গেছি। কিন্তু সব জায়গায় দেখছি মুনশির কাজ করার লোক আগে থেকেই মজুত আছে। যদি আমাকে কোনও কাজ দেন, তা হলে আপনাদের উপকারের কথা আজীবন মনে রাখব। বেকার বসে থাকার জ্বালায় এতই হতাশ হয়ে পড়েছি যে আপনারা যে কাজই দিন না কেন মন প্রাণ দিয়ে করার চেষ্টা করব। হিসাব-কিতাবের কাজ ছাড়াও আমি খানা পাকানোর কাজও ভালোই পারি।’

    লোকটার কথা শুনে নাপিতেরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল -- তারা চোখে চোখে যেন আলোচনা সেরে নিল। শেষে ওস্তাদ নাপিত মুখ খুলল: ‘দেখো মিয়াঁ, আমরাও মুহাজির, সবে এই কাজ শুরু করেছি। মাইনে তো তোমাকে দিতে পারব না। তবে হ্যাঁ, দিনে দুবার আমাদের সঙ্গে খেতে পাবে। রান্নাটা তুমিই করতে পারো, কারণ তুমি তো আমাদের ভাইয়ের মত। আর এই দোকানটার ঝাড়পোঁছ করতে হবে। এই করতে করতে কোথাও কাজ পেলে স্বাধীন ইচ্ছেয় চলে যেতে পারো। আমরা তোমাকে আটকাব না।’

    লোকটি খুশি হয়ে ওস্তাদের এই শর্ত মেনে নিল। নাপিতদের ধন্যবাদ জানিয়ে সে সেখানেই থেকে গেল।

    পরদিন বাজার থেকে অ্যালুমিনিয়ামের একটা ডেকচি আর কয়েকটা বাটি কিনে দোকানেই রান্নাবান্নার সব জোগাড় যন্ত্র করা হল। কিন্তু প্রথম দিনেই ব্যাপারটা সকলে স্পষ্ট বুঝে নিল যে লোকটা রান্না করতে তেমন জানে না। তা সত্ত্বেও তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল না। ঝাড়পোঁছের কাজে অবশ্য সে বেশ চৌকস ছিল। দৌড়োদৌড়ি করে বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে আনত। আসলে সে এমন একটা লোক যে অষ্টপ্রহর গোলামি করতে তৈরি, চিঠিপত্র লিখতে পারে, হিসেব রাখার কাজ জানে আর মনিবদের সম্মান দেয়। এমন একজনকে দিনে দুবার খেতে দিলে তেমন লোকসান কিছু হয় না।

    এইভাবে দিন চলতে লাগল। দোকান খোলার পর দুমাস হতে চলল, এর মধ্যেই সেলুনের বেশ উন্নতি ঘটেছে। কিছু নতুন ফার্নিচারও কেনা হয়েছে। শ্যাম্পু করার জন্য বেসিন ইত্যাদিও লাগানো হয়েছে। সকলেই কিছু কিছু টাকা পয়সা জমাতেও পেরেছে।

    তৃতীয় মাসের সবে অর্ধেক কেটেছে। একদিন খুব ভোরে ওস্তাদ নাপিতের নিজের বিবি-বাচ্চার কথা মনে করে খুব কষ্ট হতে লাগল। দুপুর হতে না হতে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করল। বিকেল হলে দুঃখ যেন আরও বাড়ল। সন্ধ্যের আগেই সে তার সঙ্গীদের কাছ থেকে চার দিনের ছুটি চেয়ে নিয়ে বিবি-বাচ্চাদের আনার জন্য রওনা দিয়ে দিল। তার পরিবার প্রায় ২০০ মাইল দূরের কোনও শহরে আত্মীয়ের বাড়িতে অনাহুত অতিথি হিসেবে কোনও প্রকারে দিন কাটাচ্ছিল।

    ওস্তাদ চার দিনের মধ্যে ফিরে আসার পাকা কথা দিয়ে গিয়েছিল -- খুব দিব্যি দিয়ে বলেছিল। কিন্তু তার ফিরতে পুরো পনেরো দিন লেগে গেল। বিবি-বাচ্চাদের স্টেশনের মুসাফিরখানায় ফেলে রেখে নিজে দোকানে এসে পৌঁছোল। সাথীদের বিবি আর বাচ্চাদের অসুস্থতার দীর্ঘ কাহিনি শোনাল। আর তাদের এখান পর্যন্ত আনতে ওস্তাদের যে কষ্ট হয়েছে তাও বলল। শেষমেশ সে তার আর্থিক দুরবস্থার কথা শুনিয়ে দুটো টাকা ধার চেয়ে বসল।

    এটা তো স্পষ্ট ছিল যে ওস্তাদ যতদিন সেলুনে কাজ করেনি ততদিন দোকানের আয়ের ওপর তার কোনও অধিকার ছিল না। আর একজন কারিগর কম হওয়ায় দোকানের আমদানির ওপর তার কিছু প্রভাব তো অবশ্যই পড়ে থাকবে। কিন্তু কিছুটা বয়সে বড়কে সম্মান আর কিছুটা সঙ্গীর প্রতি দয়ার কারণে -- মুখে সে কথা না জানালেও -- ওস্তাদের তিন সাথী পকেট থেকে পাঁচটা করে টাকা বার করে ওস্তাদের হাতে দিল। ওস্তাদের প্রয়োজনের তুলনায় সে পনেরো টাকা খুবই কম হলেও সে চুপচাপ টাকা নিয়ে চলে গেল।

    পরদিন থেকে আবার চারজনে কাজ শুরু করল। এতদিন তো নিয়ম ছিল যে খদ্দেরদের থেকে পাওয়া সারা দিনের রোজগার এক জায়গাতেই রাখা হতো। রাতে দোকান বন্ধ করার আগে টাকা নিজেদের মধ্যে সমান ভাগ করে নেওয়া হত। দোকানের রক্ষণাবেক্ষণ, ভাঙাচোরা মেরামত, নিজেদের আর চাকরের খাওয়া দাওয়ার খরচও সকলে সমানভাবে মেটাত। কিন্তু পরদিনই ওস্তাদ কথায় কথায় তার সাথীদের বলল, ‘ভাই, আমার তো বিবি-বাচ্চারা আছে। অচেনা দেশে এসে পড়েছি। এখন এদের একলা কোথায় ছেড়ে আসব? তাই রাতে শোয়ার সময় আমি ওদের কাছে চলে যাব। দ্বিতীয় কথা হল খাওয়া-দাওয়াও আমি ওদের সঙ্গেই করব। আজ থেকে খানাপিনার খরচ থেকে তোমরা আমার নামটা বাদ দিয়ে দাও...........ভাইরা, তোমাদের এখানে টাকা দিলে আমি পরিবারের খরচ কীভাবে মেটাব?’ সাথীরা ওস্তাদের কথা শুনে চুপ করে গেল। এবারে ওস্তাদ দুপুরে খাবার জন্য ঘরে চলে যেত। কাছাকাছি কোথাও সপরিবারে থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। দু'ঘণ্টা পরে ফিরত। রাতেও সে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে নিজের হিস্যা নিয়ে কেটে পড়ত।

    কয়েক হপ্তা ধরে এই নিয়মই চলল। কিন্তু তারপরেই ওস্তাদের তিন সঙ্গীর ধরন ধারণও একদম বদলে গেল। এখন তারা অনেক সময়ই নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে আর ওস্তাদের হাবভাব লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে থাকে। বিশেষত যখন চুল-দাড়ি কাটার পর সে খদ্দেরদের কাছ থেকে টাকা নেয়। তারা আড় চোখে লক্ষ রাখে টাকাটা ওস্তাদের কোন পকেটে ঢুকছে।

    এক রাতে যখন ওস্তাদ দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, তার তিন সাথী অনেক রাত পর্যন্ত জেগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে চলল। ওস্তাদের বিরুদ্ধে তাদের কিছু অভিযোগ আছে, ধৈর্য ধরে যেগুলো এতদিন চেপে রেখেছিল। কিন্তু এখন যেহেতু তারা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছে যে টাকাপয়সার ব্যাপারেও ওস্তাদের ওপর আর বিশ্বাস রাখা যাচ্ছে না, তখন তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। ওস্তাদের এই ধোঁকাবাজি বন্ধ করার জন্য বেশ কয়েকটা উপায়ের কথা ভাবলেও কোনওটাকেই তেমন লাগসই বলে মনে হল না। শেষে, অনেক রাতে একটা পরিকল্পনা তাদের ঠিক বলে মনে হল বলেই তারা শান্তিতে ঘুমোতে যেতে পারল।

    পরদিন ওস্তাদ দোকানে এলে তিনজনে নিজেদের মধ্যে লড়াই আর ঝগড়া শুরু করল। একজন আরেকজনকে বলল, ‘আমি আমার এই পাপী চোখ দুটো দিয়ে দেখেছি যে গতরাতে তুমি খদ্দেরের কাছ থেকে একটা সিকি নিয়ে নিজের পাতলুনের পকেটে ঢোকালে। এমনিতে তো তুমি সব পয়সা শার্টের পকেটে রাখো?’

    অন্যজন বলল, ‘কী বাজে বকছো? তুমি নিজেই তো পাক্কা বেইমান। পরশুই তো এক খদ্দের তোমাকে একটা দু-আনা আর দুটো এক আনা দিয়েছিল। একটা দু-আনা আর একটা এক আনা তো তুমি পকেটে রেখেছিলে, কিন্তু আরেক আনা পয়সা আঙুলের ফাঁকে লুকিয়েছিলে।’

    এবারে তৃতীয় নাপিত বলল, ‘আরে মিয়াঁ, হঠাৎ লড়াই ঝগড়া শুরু করে দিলে কেন? যা হয়ে গেছে মাফ করে দাও। কিন্তু ভবিষ্যতে আমি এমন একটা ব্যবস্থার কথা ভাবছি যাতে আমাদের মধ্যে কেউ চাইলেও আর এইভাবে অন্যদের ধোঁকা দিতে না পারে। সেটা হল দরজার কাছে একটা টেবিল আর চেয়ার রেখে দাও। চেয়ারে মুনশিকে বসিয়ে রাখো, আর টেবিলের ওপর এমন একটা সিন্দুক রেখে দাও যার ঢাকনায় ছেঁদা আছে। ব্যস, খদ্দের চুল-দাড়ি কাটার পয়সা নিজেরাই সিন্দুকে ফেলে দেবে। আমাদের আর পয়সা নেওয়ার কাজটা করতে হবে না। মুনশি তো রুটি আমাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েই খালাস। সে এটুকু কাজ করতে পারবে না? সে এটাও খেয়াল রাখবে যাতে কেউ পয়সা ফাঁকি দিয়ে চলে না যায়। অচল সিকে পয়সা দিচ্ছে কি না তাও দেখে নেবে। আর যদি চাও তো সেই সঙ্গে মুনশি একটা খাতায় টাকা পয়সার হিসেবটাও না হয় লিখে রাখবে। না হলে তাকে রাখাই বা কেন?’

    শুনে প্রথমজন বলল, ‘বহত্‌ ঠিক, মঞ্জুর করছি। কিন্তু এ তো এটা মানবে না, এর মনের ভেতরেই তো বেইমানি আছে!’

    দ্বিতীয় জন খিঁচিয়ে উঠলো, ‘কেন, আমি কেন রাজি হব না? এটা তো ভালো কথা। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

    তৃতীয় জন ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ওস্তাদ, তুমি কি মনে করো?’

    ওস্তাদ কিছু বলতে পারল না -- না সেই পরামর্শের সমর্থনে, না বিপক্ষে। সে চুপ করে থাকাই ঠিক মনে করল।

    পরদিনই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেল। রাতে সারাদিনের আমদানির নিয়মমত হিসেব কষে প্রত্যেককে তাদের পুরো পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু মাত্র চার দিনের মধ্যেই ব্যবস্থাটা একটু বদলানো হল। ঠিক হল প্রতিদিনের বদলে সপ্তাহের আয় হিসেব করে ভাগাভাগি করা হবে, যাতে সকলেই মোটামুটি টাকাপয়সা পায়। রোজ অল্প অল্প পয়সা পেলে তাতে কোনও প্রয়োজনই মেটে না। যদি সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই কারো কিছু টাকার দরকার পরে, তা হলে সে মুনশিকে হাতে লেখা রসিদ দিয়ে টাকা নিতে পারবে।

    ওস্তাদ এই ব্যবস্থার পক্ষে বা বিরুদ্ধে কোনও কথা বলল না, চুপ করে থাকল। তবে খুব বেশিদিন নিশ্চুপ থাকতে পারল না। একদিন সাতসকালে দোকানে এসে ক্ষুরে ধার দিতে দিতে সঙ্গীদের ওপর গর্জে উঠল : ‘যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট! আমি আর তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে পারব না। এ তো ন্যায়বিচারের যুগই নয়। তোমরা গাধা আর ঘোড়াকে সমান চোখে দেখছ, তোমাদের মধ্যে একজনও তো আমার মত পুরোনো কারিগর নও, না কারও কাজকর্মে এমন মুন্সিয়ানা আছে। এত হালকা হাতে দাড়ি কামাই যে সবাই আমার কাছেই দাড়ি কাটতে চায়। এমন বেশ কয়েকজন আদমিকে জানি যারা আমি কাজে ব্যস্ত থাকলে দোকানেও ঢোকে না। বাইরে পায়চারি করতে থাকে এই ভয়ে যে অন্য কারো কাছে যেন দাড়ি কাটতে না হয়। তারপরে আমার হাত খালি হলেই তাড়াতাড়ি আমার সামনের চেয়ারটায় এসে বসে। মুনশি এই ব্যাপারটার সাক্ষী যে আমার রোজের কামাই তোমাদের থেকে অনেক বেশি। এখন তোমরাই এই বিচার করো যে যখন আমার এলেম তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি, আর খদ্দেররাও আমার কাছেই বেশি আসে -- যখন আমাকেই বেশি কাজ করতে হয় -- তখন রোজগারও তো আমারই বেশি হওয়া উচিত। তা হলে এটা কেন যে আমি যা পাচ্ছি তোমরা সকলেও তাই পাচ্ছ? তার থেকে ভালো হয় এটাই যে এই সেলুনের রোজগার থেকে আমার অংশটা তোমরা আমাকে দিয়ে দাও, আর এরপর থেকে নিজেরাই দোকান সামলাও। আর যদি তা না হয় তাহলে প্রত্যেকের কাজ অনুযায়ী তার বেতন ঠিক করো। বেতন দেওয়ার পরে যে টাকা পড়ে থাকবে তা আমরা চারজনে ভাগ করে নিতে পারি। তোমরা এই প্রস্তাব মেনে নিলে তার চেয়ে ভালো কথা আর কিছু নেই। আর তা না হলে সাহোব, এই রকম দোকান আর এই ব্যবস্থাকে আমি দূর থেকে সেলাম জানাব। অন্য কোথাও গিয়ে আমার ভাগ্যে কি আছে তা দেখার চেষ্টা করব। এখানে যে পয়সা পাই তা তো চোখ বন্ধ করে অন্য যে কোনও সেলুনে গিয়েই আমি রোজগার করতে পারি!’

    ওস্তাদের কথা তিন সঙ্গী খুব মন দিয়ে শুনল। তার কিছু কথার মধ্যে যুক্তিও ছিল। বিশেষত কেরামতির দিক থেকে ওস্তাদ বাকি তিনজনের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই অংশীদারি ব্যবসায় এসে দক্ষ বলে সে অন্যায় সুযোগ নেবে। যখন তারা অংশীদারি ব্যবসা শুরু করেছে, তখন ব্যক্তিগত দক্ষতার কেন পরোয়া করবে? অংশীদারী হল একটা পরিবারের মত, যেখানে যে মানুষ আয় করে সেই পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। মোটামুটিভাবে রোজগেরে আর বেকারদের মধ্যে এমন কিছু তফাৎ করা হয় না। ওস্তাদ যে এই এলেমের কথা তুলেছে তার মানে হল সে দক্ষতার পরিমাপের দোহাই দিয়ে তাদের মধ্যে বিভেদ গড়ে তুলতে চায়।

    ওস্তাদ যদি দোকানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তা হলে তার পরিণাম কি হতে পারে তাও অন্য নাপিতরা ভালোই বুঝত। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে তাদের এমন মোটা টাকা ওস্তাদকে চুকিয়ে দিতে হত যা তাদের কাছে ছিল না। অন্য বিকল্পটা হল তাদের তিনজনের দোকান ছেড়ে চলে যাওয়া -- কিন্তু দোকান ছেড়ে দিলে তারা যাবে কোথায়? কাজেও তারা এমন দক্ষ আর অভিজ্ঞ নয় যে অন্য কোথাও গিয়ে সহজেই কাজ পাবে, মাথা গোঁজারও তো কোনও ঠাঁই নেই। তাই অভিযোগ আর নালিশ অনেক হলেও শেষমেশ কিন্তু তারা বেতনের ব্যাপারে ওস্তাদের দাবি মেনে নিল।

    বেতন ঠিক করার কাজটা অবশ্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াল। অনেক আলোচনার পরে ঠিক হল যে ওস্তাদ পাবে মাসে দেড়শো টাকা, আর দক্ষতার বিচারে তার ঠিক পরেই যে কারিগর সে পাবে একশো কুড়ি টাকা। তার পরের দুজন পাবে একশো আর আশি টাকা করে। এটাও ঠিক হল যে বেতনের হিসেব মাসে একবারই করা হবে।

    ওস্তাদ এই ভেবে মনে মনে খুব খুশি হল যে শেষ পর্যন্ত নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া গেছে। সঙ্গীরা অবশ্য কিছুদিন বেশ মনমরা হয়েই রইল। তবু মাস গেলে একসঙ্গে বেশ অনেকটা টাকা হাতে আসবে এই ভাবনা ধীরে ধীরে তাদের দুঃখ দূর করে দিল। সবাই কখন মাস শেষ হবে তার জন্য অধীর অপেক্ষায় দিন গোনে।

    শেষ পর্যন্ত মাসটা শেষ হয়ে বেতন পাওয়ার দিন এলে চার নাপিতের হয়রানি আর দুঃখের কোনও সীমা রইল না যখন তারা দেখল যে আগে যে মাইনে ঠিক হয়েছিল গত মাসের আমদানিতে তারা তার অর্ধেকও পাবে না। অথচ অবাক কাণ্ড এই যে সে মাসে তাদের ব্যবসা কিন্তু অন্য সময়ের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছিল। খদ্দেরও আগের তুলনায় অনেক বেশি এসেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে মাসের জমা টাকা তারা প্রথম যখন সেলুন খুলেছিল সেই সব দিনের তুলনাতেও কম। মুনশির খাতার হিসেব পরীক্ষা করে দেখা হল। মুনশি পাইপয়সার হিসেব মিলিয়ে দেখিয়ে দিল প্রত্যেকের রোজের কামাই, চারজনের প্রতিদিনের আয়, প্রতি সপ্তাহের আর মাসের রোজগার। আলাদা আলাদা করে এবং সকলের মিলিত সব হিসেবের খাতা সে তাদের সামনে খুলে ধরল। সে হিসেবে কেউ ভুল ধরে তার সাধ্য কী!

    সাধারণত টাকা পাওয়ার আশা থাকলে মানুষের খরচ বেড়ে যায়। কেউ আবার টাকা পাওয়ার আশায় ধারকর্জ করে ফেলে। নাপিতদের মধ্যে ওস্তাদ এবং আরও একজন মাসের শেষে বেতন পাবে এই আশায় মহল্লার কোনও কোনও দোকানদারের কাছ থেকে ধারে জিনিসপত্র নিয়েছিল। সে ধার মেটানোর চাপ তো ছিলই, উপরন্তু আগামী দিনে আর ধার পাওয়া যাবে না সে ভয়ও ছিল।

    সে রাতে দোকান বন্ধ হওয়ার সময় সকলেই ভীষণ হতাশ আর মনমরা হয়ে ছিল। মুনশিকে দেখে সবচেয়ে দুঃখী বলে মনে হচ্ছিল। তার জন্য কোনও বেতন ধার্য না হলেও মনিবদের দুঃখের শরিক তো সেও। সে ধীর পায়ে তাদের কাছে এসে ব্যথায় কাতর হয়ে আমতা আমতা করে বলল, ‘আপনারা আমার যে উপকার করেছেন আমি সারা জীবন তা ভুলব না। আজ আপনাদের এই কষ্ট দেখে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। এখন আমি আপনাদের সত্যি কথাটা বলছি। সেটা হল এই যে আমি যখন নিজের দেশে এক ব্যবসায়ীর কাছে চাকরি করতাম, তখন প্রতি মাসে কষ্টেসৃষ্টে না খেয়েও কিছু টাকা বাঁচাতাম। কয়েক মাসের মধ্যেই বেশ কিছু টাকা বাঁচিয়েছিলাম।দেশ ছেড়ে আসার সময় সেই টাকা সঙ্গে করে এনে এখানে ডাকঘরে জমা করে দিয়েছিলাম যাতে অসুবিধের সময় তা কাজে লাগে ....... কিন্তু এখন আপনাদের কষ্ট দেখে মনে মনে ঠিক করেছি যে আমার কাছে যখন টাকা আছে তখন আমি তা নিজের ভাইদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখব কেন? আপনারা চাইলে আমি কালই পোস্ট অফিসে গিয়ে টাকাটা তুলে নিয়ে আসব। আপনারা সেটা কাজে লাগাতে পারেন। দোকানের আমদানি আবার বেড়ে গেলে না হয় সে টাকা আমাকে ফেরত দেবেন। আমি আপনাদের কাছ থেকে কোনও সুদ নেব না।

    ‘তোমার কাছে কত টাকা আছে?’ নাপিতরা জিজ্ঞেস করল। একটু দ্বিধা করে মুনশি বলল, ‘একশো টাকা।’

    পরদিন মুনশি ডাকঘর থেকে একশো টাকা তুলে নিয়ে এল। প্রত্যেকের কাছ থেকে আলাদা আলাদা রসিদ নিয়ে সেই টাকা চার নাপিতের মধ্যে ভাগ করে দিল। এই ভাবে নাপিতদের কষ্ট একটু কমলেও তার পরের মাসে সেলুনের আমদানি আরও কম হল। এবারে তো নাপিতরা আরওই ঘাবড়ে গেল। মুনশি অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানাল যে মন্দার বাজারের কারণে অথবা তাদের দেখাদেখি চকের অন্য হেয়ার কাটিং সেলুনগুলোও চুল-দাড়ি কাটার দাম কম নিতে শুরু করায় যারা শুধু সস্তার কথা ভেবে তাদের সেলুনে আসত, তারা এখন অন্য সেলুনগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেছে।

    মুনশির এই ব্যাখ্যা নাপিতদের কিছুটা বিশ্বাস হল, বা হয়ত হল না। যাই হোক, তখন তারা আর কীই বা করতে পারে? এখন যখন মুনশি তার ভাইদের একশো টাকা ধার দিচ্ছে, তখন তাদের কষ্টের ভার একটু তো লাঘব হয়েছে। তৃতীয় মাসে অবস্থা আরেকটু ভালো হল, চার নাপিত যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু তার পরের মাসে রোজগার একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকল। উপরন্তু এবার মুনশি তাদের সাহায্য করতে অপারগ বলে জানিয়ে দিল। সে বলল, ‘ভাই সকল, যদি আমার কাছে টাকা থাকত বা আমি কোনওখান থেকে টাকা আনতে পারতাম, তা হলে আমি অবশ্যই তা এনে আপনাদের পায়ের কাছে ছড়িয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার কাছে যেটুকু যা ছিল আমি তো আগেই তা আপনাদের দিয়ে দিয়েছি।’

    সেদিন চার নাপিত তার ওপর আর চাপ দিল না। কিন্তু পরদিন সকাল হতে না হতেই চারজনে মিলে আবার তাকে চেপে ধরল। যখন নাপিতদের খোশামোদ আর অনুনয়-বিনয় চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছোল, তখন মুনশি বলল, ‘আচ্ছা ভাইরা, সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করো।’

    সন্ধে হলে মুনশি চার নাপিতের উদ্দেশ্যে বলল, ‘সাহেব, আমার মনে হয় এই দোকানের হাল কখনও শুধরোবে না। কারণ আপনারা নিজেদের যে বেতন ঠিক করে রেখেছেন তা সেলুনের আমদানির চেয়ে অনেক বেশি। যদি চান দোকানটা চলুক আর আপনাদের কষ্ট দূর হোক, তা হলে সবার আগে নিজেদের শুধরোন। আমি বলতে চাইছি আপনারা নিজেদের বেতনের পরিমাণ কম করুন। আর দ্বিতীয় কথা হল বেতন এমন ভাবে ঠিক করুন যা সাধারণত এই ধরনের চাকরি যারা করে তাদের দেওয়া হয়। যদি আপনারা আমার পরামর্শ মত বেতন নিতে রাজি হন, তা হলে আমি আপনাদের বলতে পারি অথবা বলা যায় এই দায়িত্ব নিতে পারি যে প্রতি মাসের গোড়াতেই আপনারা পুরো বেতন পাবেন। আমি তো এটাও বলব যে আমার কথা শুনে চললে মাসের শুরুতেই আপনাদের আগাম বেতন দিয়ে দেওয়া হবে। সে টাকা কোত্থেকে আসবে তা নিয়ে আপনাদের চিন্তা করতে হবে না। আমি চুরি করি বা ডাকাতি করি, আপনারা নিশ্চিন্তে বেতন পেয়ে যাবেন। আপনারা আমার এত উপকার করেছেন যা আমি সারা জীবন ভুলব না। আর ভাইরা, যদি এই শর্ত আপনাদের মঞ্জুর না হয়, তা হলে আপনারাই ঠিক করুন না কী করবেন! আমি আপনাদের জন্য টাকার বন্দোবস্ত করতে পারব না।’

    কয়েক মুহূর্ত সকলেই চুপ থাকার পর ওস্তাদ মুনশিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বলো তো, তুমি আমাদের জন্য কেমন বেতন ঠিক করবে?’

    মুনশি বললো, ‘গুস্তাখি মাফ করবেন, আপনাকে খুব বেশি হলে আশি টাকা দিতে পারব। পরের জনকে ষাট, তারপরে পঞ্চাশ আর শেষের জনকে চল্লিশ। যদি আপনারা এই বেতন মেনে নেন, তা হলে আমি এখনই গিয়ে প্রয়োজনের দ্বিগুণ বা তিনগুণ সুদেও যদি ধার নিতে হয়, তাই নিয়ে আপনাদের মাইনে দেওয়ার জন্য দুশো তিরিশ টাকা নিয়ে আসছি। আর শপথ করছি, সব মাসে এই ভাবেই আপনাদের বেতন আগাম দিয়ে দেব। মনে রাখবেন বন্ধুরা এই বেতন যে কোনো বড় হেয়ার কাটিং সেলুনে নাপিতদের বেতনের চেয়ে কোনও ভাবে কম নয়। আপনারা নিজেরা গিয়ে গিয়ে জেনে আসতে পারেন। আর অবশ্যই বেতনভোগীদের আগাম বেতন দেওয়া শুধু এই সেলুনেরই বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য হবে!’

    মুনশির এই বক্তৃতা শোনার পর চার নাপিতই বাক্যহারা হয়ে গেল। কেউ তার কথার জবাবে কিছু বলতে পারল না। সে নিস্তব্ধতা যেন অসহ্য বোধ হচ্ছিল! নাপিতরা অসহায়ভাবে নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়া চাউই করে মাথা নামিয়ে নিল।



    অলংকরণ (Artwork) : অনুবাদক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments