ঢাকা রেডিওতে সঙ্গীত শিক্ষার আসরে একসময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন আবদুল আহাদ। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি সেখানে তখন একমাত্র। কী তাঁর সমাদর! "সেই-যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখানো -- তার পর আর এ পর্যন্ত রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখানো হয়নি কখনো। একমাত্র ব্যতিক্রম উনিশশো বাহাত্তর-তেহাত্তর সালে টেলিভিশনে জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা' শেখানোর ব্যবস্থা। তবে এ গানকে আমরা তো রবীন্দ্রনাথের গান বলে দেখি না -- এ গানকে নতুন করে পেয়েছি আমরা আমাদের দুঃখের ভিতর দিয়ে -- এ আমাদেরই গান। নতুন সৃষ্টি একেবারে, এ-গানকে রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে ভাববার দরকার নেই আর।" এমন কথা যিনি অকপটে বলতে পারেন, তিনিই সন্জীদা খাতুন। রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে যার পথ চলা, রবীন্দ্রনাথের গানকে বুকের মাঝে গুনগুনিয়ে যার ঘুম ভাঙা, তিনিই পারেন জোর গলায় গানের মালিকানা দাবি করতে, 'এ আমাদেরই গান'! রবীন্দ্র-সংস্কৃতিকে মানুষ গড়ার, মনুষ্যত্ব গড়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। রবীন্দ্রমনস্ক এক বাঙালি সমাজের স্বপ্ন আজীবন তাঁর দুচোখ জুড়ে বাস করেছে। সন্জীদা খাতুন, ওপার বাংলার মিনু আপা, একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, অন্যদিকে রবীন্দ্র গবেষক, রবীন্দ্রসংস্কৃতির প্রচারক, সংগঠক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তিযোদ্ধাও। ওপার বাংলার রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের কথা উঠলে এ দেশের গড়পড়তা বাঙালির মুখে সন্জীদা খাতুনের নাম আসে না। এ আমাদের দুর্ভাগ্য। দীর্ঘ নয় দশকের পথ চলা শেষে চলে গেলেন তিনি। না, কবরের অন্ধকারে না। তাঁর শেষযাত্রা সুরের আনন্দপথে। তাঁর অজস্র ছাত্র-ছাত্রী ও শুভাকাঙ্খী সমবেত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মায়াবী আবহে পায়ে পায়ে তাঁকে বিদায় জানিয়েছেন, পৌঁছে দিয়েছেন আলোকের ঝর্ণাধারায়। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর মরণোত্তর দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজে গবেষণার জন্য দান করা হয়েছে। এক নিখাদ রবীন্দ্র-অনুরাগীকে হারালো বাংলাদেশ, আর পশ্চিমবঙ্গ হারালো তাঁকে অন্তরঙ্গভাবে জানার সুযোগ।
বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর তাড়নায় কলকাতায় অঙ্ক নিয়ে পড়তে আসা। তারপর কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিট্যুট থেকে সংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা। দেশে ফিরে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের সূচনা তাঁর হাতেই হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত হন ড. হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেয় সাম্মানিক ডি. এস. সি। তিনি একজন বিখ্যাত দাবাড়ুও। সাত বারের অল ইন্ডিয়া চেস চ্যাম্পিয়ন, অধ্যাপক হোসেন 'বাংলাদেশ দাবা সঙ্ঘ'-এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার। মা সাজেদা খাতুন বড় হয়েছেন হুগলী জেলায়। তাঁদের পরিবারে উর্দু ভাষার চর্চা ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের দুটি উপন্যাস বাংলা থেকে উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন সাজেদা। এগারো জন ভাইবোনের ঠিক মধ্যম জন ছিলেন সন্জীদা। "বাড়িতে দিদিরা নানাধরণের গান গাইতেন। বারান্দায় মাদুর পেতে হার্মোনিয়াম নিয়ে বসা হলেই কছে গিয়া বসতাম। অপেক্ষা, কতোক্ষণে দিদি গাইবেন 'কলকল ছলছল-- এসো হে তৃষ্ণার জল'"।... শৈশবস্মৃতিতে আছে বাবার মুখে শোনা গান - "'মম যৌবননিকুঞ্জে গাহে পাখি', 'ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী', 'যদি বারণ কর তবে গাহিব না'। আমাদের কাউকে না কাউকে কোলে নিয়ে বারান্দায় পায়চারী করতে করতে গাইতেন তিনি।" আবার এই মানুষই কোনোদিন গাইতেন রামপ্রসাদী গান, 'জেনেছি জেনেছি মা তারা, তুমি জানো ভোজের বাজি/ যে তোমায় যা বলে ডাকে, তাতে তুমি হও মা রাজি'। বাড়িতে সঙ্গীতচর্চার পরিবেশ ছিলই। তাই মিনুও যে গান শিখবে, সে আর নতুন কথা কি!
"ক্লাস টু-তে যখন পড়ি, তখন একদিন স্কুল ছুটি হয়ে গেল হঠাৎ। ছেলেমানুষি স্বভাববশত খুশি হয়ে উঠলাম, কিন্তু স্কুলের হলঘরের সমাবেশে উঁচু ক্লাসের মেয়েদের কান্না দেখে একটু থমকে যেতে হলো। গান হলো 'মরণের মুখে রেখে দূরে যাও, দূরে যাও চলে'। বাড়ি ফিরে এলে মা বললেন - কত বড় মানুষটা শেষ হয়ে গেলেন, তাই অমন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি হচ্ছিল আজ। ১৩৪৮ সালে বাইশে শ্রাবণের তাৎপর্য বুঝবার মতো বড় হইনি আমি।" আর বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান যে শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে পড়বে তাঁর কণ্ঠে, বুকের মাঝে জীবনভর বইবে রবীন্দ্র-ভাবনার স্রোত, তা-ই বা কে জানত!
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সন্জীদার বাবা মোতাহার হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ভালবেসে তিনি ডাকতেন 'মোতিহার' বলে। নজরুলের কোলে বসে 'বাগিচায় বুলবুলি তুই' শুনিয়েছেন সন্জীদার বড়দিদি। কাজী সাহেবের কোলে-পিঠে বড় হয়েছেন সন্জীদাও। অনেক স্মৃতি জমে আছে তাঁকে ঘিরে। আছে কিছু মজার কথাও। "আমাদের বাড়িতে একটা ভাঙা লাঠি ছিল। তার নাম 'নজরুল-মারা লাঠি'। নজরুল তখন প্রতিভা বসুকে গান শেখাতে যেতেন। পাড়ার কিছু বখাটে ছেলে ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখে না। অতএব নজরুলকে শায়েস্তা করা দরকার। একদিন গান শিখিয়ে বেরোতেই, সেই ছেলের দল নজরুলের ওপর লাঠি নিয়ে চড়াও হয়। নজরুল তাদের একজনের হাতের লাঠি কেড়ে নিয়ে কয়েকজনকে পিটিয়ে দৌড়ে বন্ধু মোতাহারের বাসায় হাজির হন। সেই লাঠিই সন্জীদা আর তার ভাইবোনদের কাছে 'নজরুল-মারা লাঠি'। লাঠির সঙ্গে মজার স্মৃতিটিকেও সযত্নে আগলে রেখেছিলেন নব্বই-পেরোনো সন্জীদা।
১৯২৬ সাল। 'ঘরে বাইরে'-র নিখিলেশ কিংবা গোরার মতো সমাজ বদলের বার্তা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মুসলমান ছাত্র-শিক্ষক গড়ে তোলেন 'বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন'-এর সংগঠন 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ'। তাদের মুখপত্র 'শিখা'। সংগঠনের তৃতীয় অধিবেশনে কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, "আমরা চাই সমাজের চিন্তাধারাকে কূটিল ও পঙ্কিল পথ হইতে ফিরাইয়া প্রেম ও সৌন্দর্য্যের সহজ সত্য পথে চালিত করিয়া আমাদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে।" এই সংগঠন ধর্মান্ধতার বিরোধী ছিল, ধর্মের না। 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' বা তার মুখপত্র 'শিখা' পত্রিকার মধ্যে দিয়ে পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমান সমাজে যে চেতনার বীজ বপন করেছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেন কিংবা কাজী মোতাহার হোসেনেরা, বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন তারই উত্তরাধিকার বহন করেছে। পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই সন্জীদা-ও সেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে পা বাড়িয়েছেন। আজীবন হেঁটেছেন সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের লক্ষ্যে, সাংস্কৃতিক জাগরণের স্বপ্ন চোখে নিয়ে। তাঁকে নিরন্তর সাহস যুগিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান।
তাঁর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করেছে ১৯৪৮-এর সেই দিনটার কথা, যেদিন কামরুন্নেসা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী সন্জীদা আরো হাজার ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে মিছিল করে গিয়েছিল রমনার রেসকোর্সের মাঠে, জিন্না সাহেবের সমাবেশে। 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ', 'কায়েদে আজম্ জিন্দাবাদ' ধ্বনিতে স্লোগান দিতে দিতে সেদিন গলা ভেঙে গিয়েছিল কিশোরী মিনুর। এর বছর চারেকের মধ্যেই তার মতো হাজারো মানুষের কন্ঠরোধ করবে রাষ্ট্র। পালটে যাবে 'মিছিলের মুখ'। সময়ের কী পরিহাস! মরিয়া হয়ে পাকিস্তানী মুসলমান থেকে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় খুঁজবে সন্জীদা এবং তাঁর সমকাল। দাবি উঠবে, উর্দূ নয়, বাংলাই হবে বাঙালির ভাষা। রাষ্ট্রযন্ত্রের যাঁতাকল থেকে বাংলাভাষাকে উদ্ধার করে আনার জন্যে অচিরেই ঘটবে ভাষা আন্দোলন। তামাম দুনিয়ার কাছে যা চিরকালীন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
২২ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল। আগের দিনই ভাষা শহিদের রক্তে লাল হয়েছে ঢাকার রাজপথ। সন্জীদা কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা লিফলেট পান। 'নুরুল আমিনের রক্ত চাই'। সেদিন বিকেলে অভয় দাস লেনের এক বাড়িতে আহূত সভায় মহিলাদের যোগ দিতে আহ্বান করা হয়েছে। সন্জীদা মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন, যেতেই হবে। সেগুন-বাগিচার বাড়িতে ফিরেই ফের বের হচ্ছেন। মা-ও পিছু নেন মেয়ের। না, সভায় যোগ দিতে নয়, মেয়ের আসন্ন বিপদের আশঙ্কায়। পথে মিলিটারি সৈন্যরা নেহাত ভয় দেখাতেই বুট জুতো ঠুকে আওয়াজ তোলে। মা ভয়ে পিছন ফিরে দৌড় লাগান। সন্জীদা তাতে বিচলিত না হয়ে এগিয়ে চলেন। আবার ভয়ে ভয়ে মেয়ের পিছু নেন মা। সভায় উপস্থিত কেউ সেদিন সভাপতিত্ব করতে রাজি হন না, বলা ভাল সাহস পান না। সন্জীদার ভীতু মা-ই সেদিন সভায় সভাপতিত্ব করেন আর মঞ্চে উঠে ভাষণ দেন কলেজ পড়ুয়া সন্জীদা। জীবনে প্রথমবার। নিজের প্রতিবাদী সত্ত্বাকে আবিষ্কার করলেন সন্জীদা, "একুশে আমাকে ভাষা দিয়েছে"। এ কেবল একলা-মেয়ে সন্জীদার মূক থেকে মুখরতায় উত্তরণের গল্প নয়। ভুবনজোড়া মানুষের মুখে 'একুশে' পৌঁছে দিয়েছে মাতৃভাষায় নির্ভয় কথালাপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪-তে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স করে সন্জীদা চলে যান শান্তিনিকেতনে এম এ পড়তে। পাশাপাশি শুরু হয় সঙ্গীত শিক্ষাও। রবীন্দ্র ভাবধারায় জারিত হচ্ছে তাঁর মনন। গবেষণার জন্যে এখানেই আবার ফিরে আসবেন দু-দশক পরে। এদিকে তাঁর স্বদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আছড়ে পড়ছে নিত্য নতুন অভিঘাত। "বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করতে হল বলে কর্তৃপক্ষ শঙ্কিত এবং সাবধানী হয়ে উঠলেন। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক মিল ভাঙবার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনার ছক কাটা শুরু হলো। স্কুলের পাঠ্যবইগুলোতে বিশেষ বদল হতে লাগল, রবীন্দ্রনাথের লেখা গেল কমে। খুব ধীরে ধীরে পরির্তনের কাজ চললো।... ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের গানের আদর কমে গেল। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু হলে সভাগৃহ কলরবে ভরে যেত। কাজেই ক্রমে মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া বন্ধ হলো।" পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতি থেকে মুখ ফেরাতে বিলাসদ্রব্যের অবাধ আমদানিতে জীবনাচরণের ধরন পালটে যাচ্ছে এ সময়ে। বিদেশি গান-বাজনার রেকর্ডের সঙ্গে দেশের মাটিতে মিশছে ঝকঝকে নতুন সংস্কৃতি। ছাপ্পান্ন সাল থেকে 'পূর্ব বাংলা' নাম বদলে 'পূর্ব পাকিস্তান' হয়েছে। তাই 'আমার সোনার বাংলা' গানটি আর গাওয়া যাবে না। পূর্ব পাকিস্তানে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। আটান্নয় আয়ুব খানের সামরিক শাসনের পর অবস্থা আরো প্রকট হল। এক দুর্বিসহ ভয়ের পরিবেশ। সন্জীদাকে শুনতে হয়েছে তিনি নাকি 'শান্তিনিকেতনী কালচার' আমদানি করছেন। রবীন্দ্রনাথকে আমরা এপার বাংলার মানুষেরা বড় সহজে পেয়েছি। তাই হয়ত তাঁকে আগলে রাখার আকুতি কখনো বাঙালি অনুভব করেনি। যে কোন আন্দোলনের সাংস্কৃতিক অভিমুখ হিসেবে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও সাহিত্যের আশ্রয় তেমন ভাবে খুঁজেছি কি আমরা! আজ-ও কি খুঁজি! কিন্তু পদ্মাপারের রবীন্দ্র-অনুরাগীদের লড়াইটা সেদিন বেশ কঠিন ছিল। সামাজিক-রাজনৈতিক সঙ্কট মুহূর্তে তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে যত আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন, আশ্রয় খুঁজেছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে, ততই যেন মনে হয়েছে "হারাই হারাই সদা ভয় হয়..."।
এল ১৯৬১ সাল। সংস্কৃতি-সচেতন বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন নিয়ে বিপুল উন্মাদনা। রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে মুখর হলেন বহু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক থেকে সাধারণ মানুষ। অধ্যাপক মোফজ্জল হায়দার, বিচারপতি মাহবুর মোরশেদ থেকে শুরু করে আনিসুজ্জামান, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব। তবে এই অনুষ্ঠানের পুরোভাগে ছিলেন মোখলেসুর রহমান সিধু, সকলের সিধুভাই। তাঁর বাড়িতেই চলত মহড়া। সন্জীদা ছিলেন এই উদযাপনের অন্যতম প্রধান মুখ। ১৯৬১'র ২৪ থেকে ২৭ শে বৈশাখ রমনার বটমূলে হলো রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষের সফল উদযাপন। সংস্কৃতি-মনস্ক বাঙালি বুকে বল পেল। অনুষ্ঠান শেষে বনভোজনে মিলিত হন সবাই। সেখানেই সিধুভাই এক নতুন সংগঠন গড়ার প্রস্তাব দেন। যে সংগঠন বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কাজ করবে। গড়ে উঠল 'ছায়ানট'। প্রথম সভাপতি হিসেবে সন্জীদা খাতুনের নাম প্রস্তাব হলেও তিনি যেহেতু সরকারি চাকরি করেন, তাই তাঁর পক্ষে সামনে থেকে দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব ছিল না। 'ছায়ানট'-এর প্রথম সম্পাদক হলেন বেগম সুফিয়া কামাল, সহ-সম্পাদক ফরিদা রহমান। 'ছায়ানট' একের পর এক অনুষ্ঠান করতে লাগল। সরকারি রোষের তোয়াক্কা না করে 'ছায়ানট'-এর মধ্যে সংস্কৃতি-অনুরাগী বাঙালিরা খুঁজে পেলেন একরাশ মুক্ত বাতাস। রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের মানুষের সকল সংগ্রামের সাথী। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, বাঙালি সংস্কৃতির যা কিছু গৌরবের ধন, তা-ই পরিবেশন করা হতো আসরে। রাগসঙ্গীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্তের গান, সব। ১৯৬৩ তে সন্জীদা এবং এবং তাঁর স্বামী ওয়াহিদুল হক মিলে তৈরি করলেন 'ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তন'।
সংগঠক সন্জীদাকে আরো সক্রিয়ভাবে পাই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে। একাত্তরের উত্তাল সময়ে তিনি গড়ে তোলেন 'বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'। সন্জীদার প্রত্যয় ছিল, সঙ্গীত শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, তা প্রতিবাদের জোরালো ভাষাও। তাই গানকে গলায় নিয়ে দিনবদলের সংগ্রামে সামিল হন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ও ওয়াহিদুল হকের সক্রিয় উদ্যোগে গড়ে ওঠে 'রূপান্তরের গানের দল'। সেই গানের দল মুক্তিযোদ্ধা শরণার্থী শিবির সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছিল মানুষকে একত্রিত করার মাধ্যম। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। আর সন্জীদাও কঠিন পথে পা বাড়িয়ে পিছিয়ে আসার মানুষ নন।
রবীন্দ্রগানের প্রসার ও প্রচারের লক্ষ্যে সন্জীদা স্থাপন করেন 'জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ'। 'ছায়ানট'-এর মধ্যেই শিশুশিক্ষার প্রাঙ্গণ হিসেবে গড়ে তোলেন নালন্দা বিদ্যালয়। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা বা গবেষণার সুত্রে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার বাস্তবায়নের প্রয়াসকে নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল সন্জীদার। হয়ত নালন্দা তারই ফলশ্রুতি। নালন্দা শুধু একটা স্কুল নয়, একটা ভাবধারা, একটা আদর্শ। নেই কোন বকাঝকা, নেই কোন পড়াশোনার চাপ। খেলা, গান, নাটক, আঁকা আরো অনেক কিছুর মধ্যে শিশু মনের সার্বিক বিকাশ ঘটবে, এ-ই হল নালন্দার দর্শন। বর্তমানে বাংলাদেশের নানা শহরে নানা নামে বিকশিত হচ্ছে সন্জীদার স্বপ্নের আদলে গড়া ছোটদের আনন্দ পাঠশালা। এটাই তো চাইতেন তিনি।
আজীবন সাংস্কৃতিক অববদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সন্জীদা পেয়েছেন 'একুশে পদক', বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, পেয়েছেন পদ্মশ্রী, বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধি দিয়েছে, কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিট্যুট তাঁকে 'রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য' উপাধিতে সম্মনিত করেছে। 'নজরুল মানস' বই-এর জন্যে পেয়েছেন 'ব্রাক ব্যাঙ্ক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার'। এসেছে আরো অনেক স্বীকৃতি। বাংলা সংস্কৃতিকে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর দিশারী। 'সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে' যখন জীবন কেটেছে, তখনও হাত ছাড়েননি চিরসখা রবীন্দ্রনাথ। কপালে লাল টিপটির মতোই ধ্রুব ছিল তাঁর প্রত্যয়। কিন্তু চলে যাবার দুদিন আগে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ক্ষীণ দুর্বল কন্ঠে তিনি অস্ফুটে বলেন, "দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। বাংলাদেশ তো এমন ছিল না। কী হয়ে গেল!" যে বাংলাদেশ বাহান্ন দেখেছে, একাত্তর দেখেছে, সে কি পারবে না আরো একবার মাথা তুলে দাঁড়াতে। নালন্দার শিশুরা তো আজ আর ছোট্টটি নেই। যে দর্শনে তারা দীক্ষিত, তার কি কোন প্রতিফলন ঘটবে না! তারা কি পারবে না আজকের অশান্ত বাংলাদেশকে আবার নতুন পথের দিশা দেখাতে! পারতে তো হবেই। প্রতি বছরের মতো এবারেও হয়তো পয়লা বৈশাখের ভোরে রমনার বটমূলে জড়ো হবে ওরা। গভীর বিশ্বাসে সহস্র কন্ঠে ওরা হয়ত গেয়ে উঠবে "নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে/ যদি পণ করে থাকিস, সে পণ তোমার রবেই রবে"। শুধু আক্ষেপ থেকে যাবে একটাই। এবারে আর সে গানে গলা মেলাবেন না সন্জীদা আপা।