• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • রোদ্দুরের গন্ধ — স্মৃতির নকশিকাঁথা : পাপিয়া ভট্টাচার্য

    রোদ্দুরের গন্ধ — গোপা দত্ত ভৌমিক ; প্রচ্ছদ- তাপস কোনার; প্রকাশক- লা স্ত্রাদা, কলকাতা; প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০২৪; ISBN: 978-81-967090-6-8

    সময়-- সে তো বহতা নদী। তার থেমে থাকা নেই। নদী যেমন তার বুকের মধ্যে জমে থাকা অজস্র নুড়ি-পাথর নিয়ে বয়ে যায় পাহাড় থেকে সমতলে, ভেসে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে, সময়ও ঠিক তেমন করেই বয়ে যায় বুকে নিয়ে আসমুদ্র-হিমাচল জীবন। ফ্রেমবন্দী করে রাখে সৃষ্টি এবং তার ধ্বংসাবশেষ। স্মৃতির আতস কাঁচে কখনো ধরা দেয় সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বেঁচে থাকা কিছু অমলিন প্রাণ, আর কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি।

    লেখিকা গোপা দত্ত ভৌমিকের স্মৃতিকথন ‘রোদ্দুরের গন্ধ ’ সেরকমই একটি টুকরো স্মৃতির অ্যালবাম, যা তাঁর নিভৃতবাসের অক্ষরযাপন।

    এই স্মৃতিকথা শুধুমাত্র সমান্তরাল পথে হেঁটে যাওয়া কোনো আশৈশবের বেড়ে ওঠার আখ্যান নয়। ‘রোদ্দুরের গন্ধ’ এমন একটি আত্মজীবনী যেখানে লেখিকা তাঁর স্মৃতিগুলিকে খণ্ড খণ্ড করে এক একটি ছোটোগল্পের রূপ দিয়েছেন। প্রতিটি কাহিনি বেড়ে উঠেছে আলাদা আলাদা চরিত্রকে কেন্দ্র করে। ঋতুবদলের মতো চারুবালাদাসী, প্রীতিলতা, রানুমাসি, বাজগা বেগম, বন্ধু মনিদীপা এবং আন্টিজি,--এই চরিত্রগুলি লেখিকার দিনযাপনের কালবেলায় বয়ে নিয়ে এসেছে মরসুমি আঘ্রাণ। তুলে নিয়ে এসেছে সমাজ জীবনের আলাদা আলাদা চিত্র। এদের সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসি, আলো-ছায়ার জীবনে লেখিকা যেন শুধুমাত্র একজন সূত্রধর।

    প্রতিটি জীবনই নিত্যনতুন গল্পের প্রেক্ষিত তৈরি করে। সময়ের সাথে শুধু তার প্রাসঙ্গিকতা বদলে যায়। নশ্বর জীবন ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও মানস কক্ষে রেখে যায় স্মৃতির পায়ের ছাপ। এখানে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে লেখিকা আলোকপাত করেছেন খুব কাছ থেকে দেখা কয়েকটি নারী জীবনের উপর। বেড়ে ওঠার বিভিন্ন স্তরে তিনি যাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছেন, হয়েছেন বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষীও। দেখা-অদেখার এই ধারাবিবরণীতে দশক এসেছে আবার দশক চলেও গেছে, মেয়েদের অবস্থান কি বদলেছে?-- এই প্রশ্নচিহ্নটাই হয়তো রয়ে গেছে গোটা স্মৃতিচারণায়।

    বইয়ের শুরুতে ‘ফেলাছড়ার জীবন ও চারুবালা দাসী’ নামাঙ্কিত প্রথম পর্বে একটি জায়গায় লেখিকা বলছেন, “বেশিরভাগ সময়েই খোসার দিকে তার মন থাকতো! লাউয়ের খোসার স্বর্গীয় স্বাদের চচ্চড়ি বা কাঁচকলার খোসাবাটা তাঁর পাতেই খেয়েছি। বড়ো হয়ে বুঝতে শিখেছি চারুবালাও ছিলেন পরিবারের খোসার মতো--নিতান্ত বাড়তি।” (পৃ-১৫) চারুবালা দাসী লেখিকার মায়ের জ্ঞাতি সূত্রে পিসিমা। এ জীবনচিত্র শুধু চারুবালা দাসীর একার নয়, ষাট কিম্বা সত্তরের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রায় প্রতিটি বিধবার। ফেলে দেওয়া শাকসব্জির অংশ বিশেষ দিয়ে শুধু যে নিজের গ্রাসাচ্ছাদন করতেন তাই নয়, পরিবারের সকলকে সে খাবার পরিবেশন করতেন। বিনিময়ে চাপিয়ে দেওয়া কঠিন নিয়ম নীতির বেড়াজালে বন্দী হয়ে মৃত্যুর দিন গুনতেন। সমসাময়িক সময়েই বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা বিনোদনের অপর কোনো মাধ্যম না পেয়ে রান্নবান্নাকেই প্রায় শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন। দিদিমা প্রীতিলতার হাতে তৈরি সুরসপোয়া, ইচামুড়া প্রভৃতি সুখাদ্যের স্বাদ লেখিকা তাই আজও ভুলতে পারেননি।

    কথার পৃষ্ঠে যেমন কথা আসে তেমনি একটি ঘটনার হাত ধরে আসে আরও অনেক ঘটনা, অনেক গল্প। কিসের অভিমানে নীহারিকা পিসিমা শ্বশুরবাড়িতে শুধুমাত্র রান্নাঘরের সঙ্গে সই পাতালেন, কেনই বা মুসলিম অধ্যাপিকা বাজগা বেগম লেখিকাকে নিজের মেয়ে বলে ডাকলেন, এ সবই এই বইয়ের শরীরী উপাদান। এ ছাড়াও শিশুবয়সে দেখা পঁয়ষট্টির যুদ্ধে পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অথবা চাকরি জীবনে শাকাহারী হোটেলে চানাচুরের ঝোল খাওয়ার মতো মজার গল্পও জায়গা করে নিয়েছে এই স্মৃতিকথনে। তাপস কোনারের প্রচ্ছদ এবং সুদেষ্ণা মিত্রের অলংকরণ লেখিকার স্মৃতিচারণার মেদুর যাত্রাপথে যথাযথ সঙ্গত করেছে।

    গোপা দত্ত ভৌমিকের জন্ম ১৯৫৬ সালে। স্মৃতিকথাটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৪-এ। এই দীর্ঘ বিস্তৃত জীবনপথে কেটে গেছে কয়েক দশক। এতটা সময় সাতাশি পাতার একটি নাতিদীর্ঘ বইয়ের পাতায় ছোটো ছোটো বারোটি পর্বের মধ্যে সীমায়িত করেছেন লেখিকা। এহেন কষ্টসাধ্য কাজটি সম্ভব হয়েছে ভাবনার স্বতন্ত্রতা এবং শব্দের জাদুতে। এ যেন জমা-খরচের হিসেব কষার খাতায় বদলে যাওয়া সমাজ জীবনের চালচিত্র আঁকা। স্মৃতি বিজড়িত সময়ের ডিঙি বেয়ে চলা। স্মৃতিকথাটির প্রতিটি চরিত্র যেন এক-একটি জানলা। যে জানলা দিয়ে প্রতিদিন রোদেলা সকাল আসে, আসে রোদ্দুরের গন্ধ।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments