আতিশয্য সাউ-এর সাথে আমার আলাপ রবীন্দ্রসরোবরের পাশে একটা ক্লাবে। অতনু ওই ক্লাবের মেম্বার। আমার বন্ধু। অতনুর সাথে ক্লাবে গেছিলাম মাল আর ফিশ ফ্রাই খেতে খেতে আড্ডা মারতে।
সন্ধে তখন সাড়ে সাতটা। সুখদুঃখের কথা হচ্ছিল দুই বন্ধুতে। হঠাৎ অতনুকে ফোন করে আতিশয্য এসে হাজির হল কিছু একটা মার্কেটিং সংক্রান্ত পরামর্শ নিতে।
আতিশয্যর বয়স চব্বিশ। পরে জানলাম - সে কলকাতায় দু-একটা কম্পানির বিনীত মালিক। একটা কম্পানি বাড়ি-কেনাবেচা সংক্রান্ত। আরেকটা কীসব এ-আই টে-আই নিয়ে কাজ করে, ঠিক বুঝিনি। তার উপর আতিশয্য কবিও বটে। তায় আবার প্রকাশিত কবি! সাথে করে ছাপানো বই নিয়ে এসেছে।
আমি যাকে বলে ইমপ্রেস্ড। চোখ যাতে ছানার বড়া না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রেখেছি। ঢুকঢুক করে উইস্কি খাচ্ছি আর ওদের কথোপকথন শুনছি মন দিয়ে। মনে মনে ভাবছি জীবনটা শেষ হতে চলেছে, কিছুই করে উঠতে পারলাম না।
অতনু বলল, “সেদিন তোমার বই-এর লঞ্চ্টা খুব ভালো হয়েছিল। সুন্দর উদ্বোধন।”
“হ্যাঁ। থ্যাংকিউ।”
“মিতা, নমিতা, প্রমিতা, রূপা, সুরূপা, অপরূপা — টিভি সিরিয়ালের অনেক অভিনেত্রীকে দেখলাম।”
“হ্যাঁ, সবাইকে ডেকেছিলাম। সবাই না আসলেও, অনেকেই এসেছিল।”
“খুব ভালো। ভেরি ইম্প্রেসিভ।”
“কয়েকজন সোশাল মিডিয়ার ইন্ফ্লুয়েন্সারও এসেছিল। আপনি কি শেষের দিকে ওদের কথাবার্তা শুনেছিলেন?”
“না, সরি। সেদিন শেষ পর্যন্ত থাকতে পারিনি।”
“ওঃ!” আতিশয্যর কন্ঠস্বরে হতাশা। “খুব ভালো হয়েছিল।”
“আসলে আমার আরেকটা কাজ ছিল…”
আমার দিকে তাকিয়ে অতনু বলল, “আতিশয্য একটা কবিতার বই লিখেছে। ইংরিজিতে। প্রেমের কবিতা। ওর নিজের জীবনের প্রেমের গল্প। প্রথমে প্রেমে পড়া। তারপর বিরহ। তারপর বিচ্ছেদ। শেষে যন্ত্রণা থেকে উত্তরণ ও পুনর্জন্ম।”
আমি বললাম, “বাঃ এ তো দারুণ ব্যাপার!”
দেখলাম আতিশয্যর হাতে বই ধরা।
বললাম, “একটু দেখতে পারি?”
“নিশ্চই।”
বইটা নিয়ে উলটে পালটে দেখতে লাগলাম।
আতিশয্য বলল, “প্রচ্ছদটা ক্যানাডা থেকে বানিয়েছি। দেশে এইসব ভালো হয় না। ভালো করতে গেলে অনেক খরচা।”
দেখলাম কালো একটা পটভূমিতে একটা কমলা রঙের বিস্ফোরণ। সেটা আগুনও হতে পারে, সন্ধ্যার মেঘও হতে পারে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিম্বা হয়তো আধুনিক কোনো প্রতীক-টতিক। বিদেশী ব্যাপার!
সেই কমলা মেঘের পটভূমিতে একটা ছেলের মুখের আদল, কালো রঙে। কালোর মধ্যে কমলা আর কমলার মধ্যে কালো।
ছেলেটার মুখের চারপাশে কয়েকটা জন্তুর অবয়ব, দুয়েকটা পাখি মনে হয়, আর একটা তাল গাছ। জন্তুগুলো চেনা যাচ্ছে না, সাইজও বোঝা যাচ্ছে না। এই ছবির মধ্যে যে এক বা একাধিক রূপক আছে, সেটা স্পষ্ট। যেটা অস্পষ্ট — মানে আমার কাছে স্পষ্ট নয় — সেটা হল রূপকের মানে।
অতনুকে আতিশয্য বলল, “বইটার পাবলিসিটির ব্যাপারে আপনার কাছে একটু পরামর্শ নেবার ছিল।”
ওরা কথা বলছে। কিন্তু আমার চোখ চলে গেছে প্রচ্ছদের উপরের দিকে। সেখানে ছাপা আছে, “অ্যামাজনে এক নম্বর বেস্ট-সেলার!”
আমি বিস্ময় ঠেকাতে না পেরে ওদের কথোপকথনের মাঝে বাধা দিয়ে বলে উঠলাম, “বইটা কবে বেরিয়েছে?”
“দু সপ্তাহ আগে,” আতিশয্য বলল।
আমার মাথায় বেরসিক প্রশ্ন এল, “এরই মধ্যে বেস্ট-সেলার হয়ে গেল? এত বিক্রি যে দ্বিতীয়বার প্রিন্ট বেরিয়ে গেল ‘বেস্টসেলার’ লিখে? শুধু বেস্ট-সেলার নয়, একেবারে এক নম্বর বেস্ট-সেলার?”
মুখে বললাম, “বাবা!”
তারপর পড়লাম ‘বেস্ট-সেলার’ ইত্যাদির নিচে ছাপা রয়েছে টেলিগ্রাফ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করা একটা বাক্য। তাতে বইটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা।
আবার প্রশ্ন এল, “এত ভালো রিভিউ এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে? তার মানে নিশ্চই এটা প্রথম প্রিন্ট নয়।”
তারপর ভাবলাম, “না। হয়তো বই হয়ে বেরোনোর আগেই কোনো সমালোচককে পাণ্ডুলিপির কপি পাঠানো হয়েছিল।”
মুখে কিছু বললাম না।
শুনলাম অতনু বোঝাচ্ছে কীভাবে পাবলিসিটির জন্য ভিডিও বানানো যায়। সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা যায়। কীরকম খরচা হতে পারে। – এইসব নানা কথা।
আমি বইটা উলটে পালটে দেখলাম। বিভিন্ন অংশ থেকে কয়েকটা পাতা পড়লাম।
জীবনে আমি কিছু কিছু কবিতা পড়েছি। ইংরিজিতেও পড়েছি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ থেকে শুরু করে হালের মেরি অলিভার পর্যন্ত খানিকটা আমার পরিচিত। কবিতা আমার ভালোই লাগে।
কিন্তু এই ছোকরার লেখাটা ঠিক কবিতা মনে হল না। মনে হল এক অপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালকের ডায়েরি জাতীয় কিছু। দুর্বল কয়েকটা মামুলি গদ্যসুলভ বাক্য আঁকাবাঁকা লাইনে ভেঙে ছাপা হয়েছে। গুণের মধ্যে বলতে হয় যে দুর্বোধ্য নয়। হবেই বা কী করে? দুর্বোধ্য হতে গেলে তো কিছু একটা অন্তর্নিহিত ওজন থাকতে হবে। চা ফিকে হতে পারে কড়া হতে পারে, লাল চা হতে পারে দুধ চা হতে পারে, ফার্স্ট ফ্লাশ হতে পারে ধাবার মশলা-চা হতে পারে। কিন্তু এ পোড়া বঙ্গদেশে চা-পাতা ছাড়া কি চা হয়?
বইটা বন্ধ করে আতিশয্যকে ফেরত দিলাম। উইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে শুনলাম অতনু বলছে, “ভিডিও বানানোর লোকেশন ঠিক করতে হবে। সেখানে যাতায়াতের খরচা আছে। অভিনেতাদের পয়সা দিতে হবে। আপলোড করার পর ভিডিওটাকে মার্কেটিং করতে হবে। অনলাইন মার্কেটিং। তারও খরচ আছে।”
আতিশয্য বলল, “আমি ভাবছিলাম যদি কোনো ইন্ফ্লুয়েন্সারকে দিয়ে ভিডিও বানানো যায়। তাঁকে যারা ‘ফলো’ করে, তারা সবাই ভিডিও দেখবে। মার্কেটিং করতেই হবে না।”
“ইন্ফ্লুয়েন্সার?”
“হ্যাঁ। যেমন ধরুন বন্ধু ব্যানার্জি।”
“বন্ধু ব্যানার্জি?”
“হ্যাঁ, খুব নাম করেছে। বন্ধু ব্যানার্জি ফ্রম্ অক্স্ফোর্ড বলে একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে। অনেক ফলোয়ার।”
“বন্ধু ব্যানার্জি?” অতনু আবার বলল। “জগবন্ধু?”
“না না, শুধুই বন্ধু।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বন্ধু ব্যানার্জি ফ্রম্ অক্স্ফোর্ড বলতে কি সে-এ-ই অক্স্ফোর্ড বোঝাচ্ছে, মানে ইংল্যান্ড?”
“না না। অক্স্ফোর্ড মানে পার্ক স্ট্রীটের বইয়ের দোকানটা।”
“ওঃ কলকাতা!”
অতনু বলল, “তুমি তো চাও তোমার বই লোকে পড়ুক। তাই নয় কি?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
“ইন্ফ্লুয়েন্সারদের যারা ফলো করে, তারা বইটই পড়ে না।”
আতিশয্যর মুখ দেখে মনে হল কথাটা ওর একেবারেই পছন্দ হয়নি। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম – কী বলে শোনার জন্য।
এমন সময়ে টেবিলে রাখা আতিশয্যর মোবাইলটা বেজে উঠল। কে ফোন করছে দেখে নিয়ে, আতিশয্য আঙুলের ইঙ্গিতে জানালো ওকে কলটা নিতে হবে। উঠে দাঁড়িয়ে ও ফোনটা কানে দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের থেকে দূরে চলে গেল।
অতনু উইস্কিতে চুমুক দিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে এই ইন্ফ্লুয়েন্সার ব্যাপারটা বোঝা তো! বস্তুটা কী?”
এক গাল হেসে অতনু বলল, “কলকাতা সম্বন্ধে সেই পুরোনো গল্পটা মনে আছে? কেউ যদি কোনো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একনিষ্ঠভাবে ওপর দিকে এক অভিমুখে তাকিয়ে থাকে, তাহলে খানিকক্ষণের মধ্যেই তার চারপাশে লোক জড়ো হয়ে যাবে। প্রথম লোকটা যে দিকে তাকিয়ে আছে, সবাই সে দিকেই তাকিয়ে থাকবে।”
আমি হাসলাম।
অতনু বললো, “ওই প্রথম লোকটা – ইন্ফ্লুয়েন্সার হল ওই প্রথম লোকটার আধুনিক সংস্করণ।”
“বন্ধু ব্যানার্জি তার মানে ‘জনবন্ধু’?”
“হ্যাঁ। ইন্ফ্লুয়েন্সারের বাংলা অনুবাদ হিসেবে ‘জনবন্ধু’টা মন্দ নয়।”
“বা ‘গণবন্ধু’।”
অতনু হাসল, “হ্যাঁ। শুনলেই কীর’ম ‘গণধোলাই’ শব্দটা মনে পড়ে।”
“তুই বলছিস লোকজন বিনা কারণে গণবন্ধুকে ফলো করে?”
“তা তো বলিনি! আমার চেনা কেউ ফলো করে, তাই আমিও ফলো করি। ইউটিউবে, টুয়িটারে (যাকে এখন এক্স্ বলে), টিকটক-এ, ফেসবুকে ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ইন্ফ্লুয়েন্সার রোজ চ্যাঁচাচ্ছে (মানে ভিডিও পোস্ট করছে বা জ্ঞান বিতরণ করছে)। আর সবাই সেই হাবিজাবি শুনছে আর তার উপর ‘লাইক’ বর্ষণ করছে। এ এক নতুন যুগ রে।”
“তুই বলছিস ইন্ফ্লুয়েন্সারের কোনো বক্তব্য নেই?”
“না না। বক্তব্য কিছু থাকতেই পারে। যেটা নেই সেটা হল শিক্ষা। মতামত তো মানুষ মাত্রেই থাকবে। আমার ছোটমামাকে মনে আছে?”
“হ্যাঁ, যিনি প্রত্যেক গরস বত্তিরিশ বার চিবিয়ে খেতেন?”
“হ্যাঁ। ছোটমামা ছিল কোনো-দিন-ডাক্তারি-না-পড়া ডাক্তার। প্রত্যেক পরিবারেই একজন করে এর’ম থাকে বোধহয়। কোন্ অসুখ হয়েছে বা কোন্ কোন্ অসুখ হয়ে থাকতে পারে, সেটা বলে দিতেন চটপট — কোনো অসুখ আদৌ হোক বা না হোক। আর সেই অসুখের জন্য কী কী ওষুধ খেতে হবে সেটাও সবিস্তারে নির্ধারণ করে দিতেন।”
“হ্যাঁ, মনে আছে।”
“কলেজে ছোটমামা অ্যাকাউন্টেন্সি পড়েছিলেন। ওই বিষয়ে যদি কিছু বলতেন তাহলে হয়তো ঠিকই বলতেন। কিন্তু ওনার সব বক্তব্যই ছিল ডাক্তারি সংক্রান্ত।…
এখন ওয়াট্স-অ্যাপ-এর যুগে সবাই আমার ছোটমামা হয়ে গেছে। যে যা পারছে বলে যাচ্ছে। আর আমরাও ইচ্ছেমত সব কিছু ‘ফরওয়ার্ড’ করে যাচ্ছি। সত্যি-মিথ্যে গুলি মারো। চিন্তা করতে বড্ড সময় লাগে। এক ক্লিক্-এ ফরওয়ার্ড করা খুব সোজা। মনে হয় - বাঃ বেশ কিছু একটা বলে ফেললাম। কোনো কষ্ট করতে হল না, কিন্তু দিব্যি একটা কিছু করে ফেললাম।…
তাছাড়া করব না-ই বা কেন। আর সবাই-ই তো করছে।”
“বুঝলাম। সবার হাতে লাউড-স্পিকার। যে কেউ তার মতামত প্রকাশ করতে পারে।”
“ঠিক। কিন্তু ইন্ফ্লুয়েন্সার ব্যাপারটা আরো ঘোলাটে। তার কারণ অনেক ইন্ফ্লুয়েন্সারই – বিশেষ করে যাদের নাম-ডাক খুব বেশি – তারা বড় বড় কম্পানি থেকে টাকা পায়। তারা বস্তুত বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থার ঠিকাদার কর্মচারী, বা অন্য ভাবে বললে — দালাল। তাদের হয়তো টাকা দিচ্ছে কোনো ফ্যাশান সংস্থান, হয়তো কোনো ইলেক্ট্রনিক্সের কম্পানি, বা কোনো বই প্রকাশক, বা মিউজিক কম্পানি, বা বড় রেস্তোরাঁ বা হোটেল, বা অন্য কোনো ব্যবসা। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দল-ও হতে পারে। তাদের আসল কাজ হল – যাকে বলে – জনমত তৈরি করা।”
“বিজ্ঞাপন বলছিস?”
“একদম। পিছনে টাকা না থাকলে এই গণবন্ধু ব্যাপারটা এত সর্বব্যাপী হত? এটা হল পুঁজিবাদের আধুনিকতম উদ্ভাবন। বঙ্কিমচন্দ্র বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন - অজ্ঞ-কে বিজ্ঞ-মাধ্যমে আপন করা। এই হল বিজ্ঞাপন। ধূর্ত আইডিয়া।”
একটু থেমে, উইস্কিতে চুমুক দিল অতনু। তারপর আবার বলতে শুরু করল।
“বিজ্ঞাপন মানেই তো মগজ ধোলাই। কিন্তু বিজ্ঞাপনের জগতে শ্রেষ্ঠ হল সেই বিজ্ঞাপন যেটা ডবল ভণ্ড – ভান করছে যেন বিজ্ঞাপন-ই নয়। আমাদের ছোটবেলাকার ‘দাদু খায়, নাতি খায়, থিন্ অ্যারারুট্ বিস্কুট’ সেই তুলনায় নিষ্পাপ।”
আমি চুপ করে রইলাম। নিজের জীবনটা এই মুহূর্তে মন্দ লাগছে না।
খানিক নীরবতার পর আমি বললাম, “তুই উইজ্ডম অফ্ দ্য ক্রাউড সম্বন্ধে শুনেছিস?”
অতনু বলল, “শোনা শোনা লাগছে। কী জানি ব্যাপারটা?”
“এক মিনিট দাঁড়া।”
চট করে একটা গুগ্ল সার্চ করে বললাম, “১৯০৬ সালে বিলেতের এক গ্রাম্য মেলায় এক ভদ্রলোক একটা প্রতিযোগিতা করেছিলেন। কাজটা ছিল একটা গরুর ওজন অনুমান করা। আট শ’ জন লোক তাদের অনুমান কাগজে লিখে জমা দিয়েছিল। সেই সব অনুমানের গড়, মানে অ্যাভারেজ, হয়েছিল ১১৯৭ পাউন্ড। গরুটার সঠিক ওজন ছিল ১১৯৮ পাউন্ড।”
“বাবা!”
“তারপর, ২০১৫ সালে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটা গরুর ছবি দিয়ে এক্সপেরিমেন্টটা আবার করা হয়। এবারে ১৭ হাজার লোকের অনুমান পাওয়া যায়, যার গড় ছিল আসল ওজনের থেকে মাত্র ৫% তফাতে।”
“একেই বলে উইজ্ডম অফ্ দ্য ক্রাউড?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। বাংলায় বলতে পারিস ‘জন-প্রজ্ঞা’।”
“ভালো বলেছিস। অনেক অজ্ঞ-র সম্মিলন থেকে উৎসারিত প্রজ্ঞা।”
আমরা দু’জনেই উইস্কিতে চুমুক দিলাম।
অতনু বলল, “আর এখন সোশাল মিডিয়ার যুগে, অনেক অজ্ঞ-র সহযোগিতায় নানান বিজ্ঞ। মানে গণবন্ধু।”
আমি হেসে বললাম, “একটা পদ্য শুনবি? কিছুদিন আগে ইন্টারনেটে পড়েছিলাম। সম্পূর্ণ বুঝিনি। এখন মানেটা আরেকটু পরিষ্কার হল। শুনবি?”
“শোনা।”
আবার একটা গুগ্ল সার্চ করে পড়ে শোনালাম -
যুক্তি ছেড়ে ভক্তি ভরে অজ্ঞ বলেছে, আজ্ঞে।
বিজ্ঞ বেড়াল হাসে একগাল, শিকে ছেঁড়ে তার ভাগ্যে।
গলাবাজি যার, জয় হোক তার। প্রাজ্ঞ যায় তো যাক্ গে!
অতনু গম্ভীর গলায় বলল -
জেনো – বৃষ-বিষ্ঠা তথা পর্বত-প্রমাণ।
সোশাল মিডিয়ার কথা অমৃত সমান॥
আমি হা হা করে হেসে উঠলাম।
অতনুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, আতিশয্য এই বইটা বার করল কী করে? আর এতসব প্রশংসাই বা জোগাড় করল কী করে?”
“প্রশংসা?”
হা-হা করে হাসল অতনু।
“সেটা তুই নিজেই বুঝে নে। তবে কী করে বইটা বার করল সে বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি।”
“কী করে?”
“প্রথমতঃ - দিল্লিতে এখন একটা প্রকাশনা সংস্থান আছে যারা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘প্রথম লেখক’-দের প্রকাশক হিসাবে। লেখক — বা কবি — নিজেই ছাপানোর খরচাটা দেয়।”
“তাই নাকি?”
অতনু মাথা নেড়ে সায় দিল।
“দ্বিতীয়তঃ - ভারতবর্ষের আরেকটি সংস্থান আছে যারা অন্-ডিমান্ড বই ছাপায়। অর্থাৎ তুই অনলাইনে -– যেমন অ্যামাজনে -– অর্ডার দিলি। তখন ওরা এক কপি ছেপে তোকে পাঠিয়ে দিল।”
“উরিব্বাবা!”
“তৃতীয়তঃ - শুনলি তো আতিশয্যর অন্তত দুটো কম্পানি আছে। পেটে কতটা বিদ্যে আছে বলতে পারব না। কিন্তু বুঝতেই পারছিস – বাপের অনেক টাকা।”
আমি দেখলাম হেঁটে হেঁটে আতিশয্য আমাদের দিকে ফিরে আসছে। ফোনে কথা শেষ।
গলা নামিয়ে ফিসফিস করে অতনুকে বললাম, “আসছে।” অতনু চুপ করে রইল।
আতিশয্য ফিরে এল।
ফোনটা টেবিলে রেখে বলল, “সরি। দরকারি কল ছিল। নিতেই হল।”
অতনু বলল, “ঠিক আছে ভাই, কোনো ব্যাপার না।”
আমি বললাম, “তোমার বইটা তো কিনতে হচ্ছে! খুব ইম্প্রেসিভ।”
খুশি হয়ে আতিশয্য হাসল। ওর হাসিটা ডায়েট কোক-এর মত। প্রথমে মিষ্টি লাগে। কিন্তু তার পরই স্যাকারিনের মত একটা স্পর্ধার মোহ ছায়া ফেলে। একটা অস্বস্তিকর মিষ্টি-তেতো টানাপোড়েন। যাক গে।
উইস্কি খেতে খেতে আমার মেজাজটা এখন ফুরফুরে হয়েছে।
বললাম, “তুমি তো আমার ছেলের বয়সী। তোমায় একটা পরামর্শ দেব?”
“নিশ্চই।”
“আকিহরে-র নাম শুনেছো?”
“না।”
“আকিহরে হল কলকাতার একটা নামকরা সংস্থান। খুবই উচ্চমার্গীয়। ইংরিজিতে যাকে বলে এক্স্ক্লুসিভ। তোমার প্রতিভাকে ওরা মর্যাদা দেবে। তোমার মত ট্যালেন্টকেই ওরা খোঁজে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করো।”
“জাপানি নাকি? নাম শুনে মনে হচ্ছে…”
হেসে বললাম, “না না, বাঙালি সংস্থান। আমার মনে হয় তোমার বই নিয়ে ওরা অনেক সাহায্য করতে পারবে।”
“নামটা অদ্ভুত। আকিহরে মানে কী? কিছু মানে আছে?”
“হ্যাঁ,” আমি বললাম। “আকিহরে মানে - আমি কি হনু রে।”
অতনুর দিক থেকে হঠাৎ জোরে একটা আওয়াজ এলো।
তাকিয়ে দেখি বেচারা ভীষণ একটা বিষম খেয়েছে। উইস্কিটা নীট্ খাচ্ছিল, জল-টল না দিয়ে। এত ভয়ানক বিষম খেয়েছে যে নাকের ফুটো দিয়ে এখন কয়েক ফোঁটা উইস্কি গড়াচ্ছে।
https://www.npr.org/sections/money/2015/08/07/429720443/17-205-people-guessed-the-weight-of-a-cow-heres-how-they-did