আমাদের ছোটোবেলায়, অর্থাৎ ষাট সত্তর বছর আগে, বিয়েবাড়ির মেজাজটাই ছিল অন্যরকম – যা এখনকার থেকে আশমান জমিন ফারাক বললে অত্যুক্তি হবে না। সমকালীন প্রকাশনা আবদুল জব্বারের ‘বাংলার চালচিত্রে’র অন্তর্গত ‘চাষিবাড়ির সাদিয়া’ পাঠ করলে সেটা মালুম হবে। মিয়াবিবির রাজি হওয়ার কোন গল্পই ছিল না। দুই মুরুব্বি – দুজনেই চাষি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোন অঞ্চলের—ঠিক করে ফেললেন তাঁদের পুত্র আর কন্যার বিবাহের। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল তোড়জোড় – চাল কোটা নাড়ু বানানো থেকে শুরু করে মেয়েলি আচারের নানা প্রস্তুতি, এবং শেষমেশ সাদিয়া বা বিয়ের দিন সকালে নিজস্ব পুকুর থেকে জাল ফেলে নিয়ে আসা মহাকায় রুই কাতলার সম্যক সদ্ব্যবহারের জন্য রান্নার আয়োজন। বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা পরিবারের মধ্যেই সীমিত ছিল না – পাড়াপড়শি এবং সমাগত আত্মীয়স্বজনের সম্মিলিত অংশগ্রহণে সে এক মহামেলা, এবং তার পরিণতি সম্মিলিত জনের উদর আর হৃদয় পূরণে।
চাষিবাড়ির বাইরে সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজে – গ্রামে বা শহরে – ব্যাপারটা প্রায় অনুরূপই ছিল। নিজের পুকুরের মাছ না হলেও বাজার থেকে কিনে আনা হত সেরা মাছ। রান্নাটা সমবেত মহিলারাই সামলাতেন, শহরে হয়তো প্রফেসনাল রাঁধুনির তলব পড়ত। মেনু ছিল মোটের উপর একই রকম – সাদা ভাত, নুন লেবু, লম্বা করে কাটা বেগুন ভাজা, ডাল, নিরামিষ চচ্চড়ি অথবা মাছের মাথা সহযোগে ছ্যাঁচড়া, একটা তরকারি, মাছের দুটো পদ, চাটনি, দই, রসগোল্লা, আর সব শেষে মিষ্টি পান। পরিবারের এবং প্রতিবেশী ছেলেছোকরারা কোমরে গামছা বেঁধে মেঝেতে বসে থাকা পঙ্ক্তিবদ্ধ অভ্যাগতদের অনলস পরিবেশন করে যেত। আর একটা মাছ কিংবা দই বা মিষ্টির প্রয়োজন আছে কিনা সেটাও সবিনয়ে জিজ্ঞেস করত। আর পরিশেষে গৃহকর্তা এসে দাঁড়িয়ে করজোড়ে ত্রুটির মার্জনার জন্য এবং নবদম্পতিকে আশীর্বাদের অনুরোধ জানাতেন।
এখন কেটারিং–এর যুগ। ভাত ডাল মাছ দই বিদায় নিয়েছে-- এমন কী পোলাও-ও – তার জায়গায় এসেছে বিরিয়ানি। দই-এর বদলে আইসক্রিম। বাড়ির চত্বরে কিংবা বাড়ির ছাদে শামিয়ানা খাটিয়ে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও অপসৃয়মান। তার স্থান নিয়েছে কমিউনিটি হল কিংবা ব্যবসায়িক অনুষ্ঠান ভবন। যাঁরা অবস্থাপন্ন, তাঁরা ভাড়া করেন রিসর্ট। ভেনু (venue) এবং মেনুর (menu) চরিত্র বদল ঘটেছে, তার সঙ্গে নীরবে বিদায় নিয়েছে সেকালের বিয়ের এক আবশ্যিক অঙ্গ—বিয়ের পদ্য।
স্বনামধন্য অথবা সাধারণ – সেকালে বিয়ে উপলক্ষ্যে কবিতা রচনার রেওয়াজ ছিল সব মহলেই। অনেক স্নেহাস্পদজনের বিবাহে কবিতায় আশীর্বচন জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কোনটা সিরিয়াস, কোনটা লঘুচালের। তাঁর রচনাবলিতে আমরা তার পরিচয় পাই। সেগুলো অথবা প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য কবিদের অনুরূপ কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি না। আমাদের আলোচ্য পারিবারিক গণ্ডিতে রচিত সাদামাটা বিয়ের পদ্য।
রঙিন কাগজে ছাপা বিয়ের পদ্য পরিবেশিত হত কনের বাড়িতে বরযাত্রীদের আগমনের অব্যবহিত পরে জলযোগের সময়। মুখ্যত কন্যাবাড়ির তরফ থেকেই, তবে বরপক্ষের দিক থেকেও ঘাটতি হত না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। পদ্যগুলো ছিল কনে বা বরকে উদ্দেশ্য করে আত্মীয়স্বজনদের – মুখ্যত ভাইবোন এবং মা বাবার – ভালোবাসা অথবা আশীর্বাণীর প্রকাশ। বাঙালির একটা সহজাত প্রবণতা আছে প্রথম বয়সে পদ্য লেখার – ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’র মতো পাঠ্যপুস্তকের পঙ্ক্তিগুলোর অভিঘাতেই হয় তো – অন্ত্যমিল খুঁজে নিজস্ব পদ্যের পঙ্ক্তিরচনায়। স্কুলের ম্যাগাজিন কিংবা ছোটো পত্রিকাগুলো হয়ে ওঠে তাদের প্রকাশক্ষেত্র। পারিবারিক বিবাহ অনুষ্ঠান অভ্যাগতদের মধ্যে তাদের স্বীয় কাব্যপ্রতিভা প্রদর্শনের একটা লোভনীয় সুযোগ এনে দেয় বই কী!
তবে বিয়ের পদ্যের অধিকাংশই স্বরচিত হত না – ভাইবোন মা বাবা আত্মীয়বন্ধুর জবানিতে পদ্যগুলো লিখে দিতেন পরিচিত মহলের কাব্যবিশারদরা অথবা উঠতি কবিরা। স্থানীয় ছাপাখানাগুলোতেও মজুত থাকত পুরানো পদ্য – নাম এবং অনুষঙ্গ বদল করে নতুন আসরে ঘটত তাদের পুনরাবির্ভাব। ব্যাপারটা সর্বজনবিদিতই ছিল, তবে সেটা রসগ্রহণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত না। রঙিন কাগজগুলো সঞ্চয়ে নেই, স্মৃতিতে কিছু কিছু পদ্য রয়ে গেছে। সেগুলোরই পুনরুদ্ধার করে পরিবেশনে সচেষ্ট হচ্ছি।
সত্তর বাহাত্তর বছর আগের এক বিয়ের অনুষ্ঠান দিয়েই শুরু করা যাক। দিদির বিয়েতে সাত থেকে সতেরো বছর বয়সী সাতজন সহোদর এবং খুড়তুতো ভাইদের নামে পরিবেশিত পদ্যের আরম্ভটা ছিল এই রকম—
ভোর বাতাসে বাজছে সানাই কোন্খানে?
বিয়ের ফুলটি ফুটল যাহার সেই জানে।
পুব আকাশে সূর্য হাসে চাঁপার গন্ধ পাই বাতাসে
বনকোকিলে উলু যে দেয় আনমনে।
প্রস্তাবনার এই পঙ্ক্তিগুলোর কাব্যগুণকে উপেক্ষা করা চলে না। অপোগণ্ড ভাইদের পক্ষে সম্ভব ছিল না এই রচনা। কৃতিত্ব মফস্বলের এক কলেজের বাংলা অধ্যাপকের।
পরবর্তী লাইনগুলোতে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তৎকালীন রেশন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভোজের জন্য খাদ্যবস্তু সংগ্রহের সমস্যার কথা –-
জোগাড় করি কথায় চিনি সাধনার ধন চিন্তামণি
দেবদুর্লভ ময়দা সাদা আনছি তো!
উৎসাহেতে জোরে কোমর বাঁধছি তো!
পরিশেষে আসে দিদির সঙ্গে আসন্ন বিচ্ছেদ আশঙ্কায় ভারাক্রান্ত অভিব্যক্তি –-
যাক গে দিদি ললাটলিপি করবে কি?
মন মুকুরে একটি ছবি ধরবে কি?
শ্বশুরবাড়ির বউটি হয়ে গয়নাগাঁটির বোঝা বয়ে
আমাদের এই সংঘটিরে ভুলবে কি?
প্রায় কাছাকাছি সময়ে কাকার বিয়েতে ভাইপোদের কাব্য উপহার –-
প্রতীচের কোলে জাহ্নবী কূলে শোভিছে কুটিরখানি
তাহার মাঝারে কে সে বিরাজে বলো না গো কাকুমণি!
বাজিছে সানাই বিরাম যে নাই উঠিছে মধুর তান,
শঙ্খের ধ্বনি আনিতেছে টানি মঙ্গলশুভ গান।
এ সব দেখিয়া মুচকি হাসিয়া পরিতেছ বরবেশ
শিরে দিয়া তাজ ঢাকিতেছ লাজ চলিতেছ কোন্ দেশ?
প্রথম লাইনটি কিছু ব্যাখ্যার দাবি রাখে – কন্যার পৈতৃক নিবাস গঙ্গার পূর্বকূলবর্তী কোন এক শহরে, স্থানের নাম উল্লেখ না করে সেটাই ব্যক্ত হয়েছে -- প্রতীচের কোলে জাহ্নবী কূলে। বলা বাহুল্য, এই পদ্যটিও স্কুল-পড়ুয়া ভাইপোদের স্বরচিত ছিল না। তবে এক কিশোর তার মামার বিয়েতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল তার স্বরচিত পদ্য দিয়েই ---
মামিমা আজ আসছে ঘরে বরণ সাজাও তাহার তরে
সিঁদুররাঙা সিঁথির পরে অরুণ আলোর কিরণ ঝরে।
পাঠকগণের ক্ষমা প্রার্থনীয় -- কেন না পদ্যটির ল্যাজামুড়ো স্মৃতির অতলে চলে গেছে, উদ্ধার করা গেল না।
এর কয়েক বছর আগে তার দিদির বিয়েতে এই কিশোরের কলম থেকে বেরিয়েছিল –-
ভুবন ভরেছে মধুর সুবাসে
পবনে কাহার শুভাশিস আসে
ফুলদল যেন মিটিমিটি হাসে
কোকিল গাহিছে গান,
নব বসন্তে দিদির বিয়েতে প্রাণ করে আনচান।
এর পরের পঙ্ক্তিগুলোতে বিয়েবাড়ির সম্ভাব্য আনন্দময় কর্মকাণ্ডের এবং লোভনীয় ভোজ্যবস্তুর বর্ণনা দিয়ে তারপর উপসংহার টানা হয়েছিল –
জামাইবাবু যে আসিবেন রাতে
দিদির বিয়ে তো হবে তাঁরই সাথে
যাইবেন ফিরে পাহাড়পুরেতে
দিদিকে লইয়া সাথে,
বলে যাও দিদি আমাদের তুমি পারিবে কি কভু ভুলিতে?
পাহাড়পুর জামাইবাবুর পৈতৃক নিবাস। আর উল্লেখ্য, পদ্যটির কৃতিত্বের দাবি কিশোরটি একা করেনি, তার সব ভাইবোনদের নাম পদ্যটির নীচে উল্লিখিত হয়েছিল।
সেই কন্যার দাদু দিদিমার আশীর্বচনের পদ্য শুরু হয়েছিল এই ভাবে –
একক জীবনে আজ দশকের আগমন হবে
হেরো তার সাক্ষী হয়ে লক্ষ তারা জ্বলে দূর নভে;
আমরা রয়েছি পাশে, আছে আরও আত্মীয়স্বজন,
আজি সাঙ্গ হল তব পথ চাওয়া অনুক্ষণ।
দাদু দিদিমা তাঁদের ষোলো বছরের নাতনির পথ চাওয়ার সমাপনে সবিশেষ আনন্দিত, কিন্তু কন্যার পাশের বাড়ির ঠাকুমার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম। তাঁর অনুযোগ, যে নাতনি তার মনের সব কথা তাঁর কাছে নিবেদন করত সে আজ সাধ করে তার মন অন্যের কাছে সমর্পণ করতে চলেছে। তাই তিনি অতি রুষ্ট হয়ে জানাচ্ছেন ---
ভীষণ রেগে অভিশাপ জানাই তোমায় শোনো
মনের মতো স্বামী নিয়ে একশ বছর গোণো;
হয় যেন সব নাতিপুতি সবাই তোমায় জ্বালায় অতি
স্বর্গ থেকে দেখতে পেয়ে হাস্য করি আমি –
আজকে দিনের এই অভিশাপ সবার চেয়ে দামি।
কী সুন্দর ব্যাজস্তুতি! অবশ্য সহজেই অনুমেয়, আগের এবং এই পদ্যের পদকর্তা তাঁরা নিজেরা নন।
ওই বিবাহ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে রচিত এই পদ্যগুচ্ছের একটা ট্র্যাজিক পরিণতি ঘটেছিল। বরযাত্রীদের বিলম্বে আগমনের কারণে আর সারাদিনের ক্লান্তির জন্য এই কিশোরটি পদ্যের বান্ডিল পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। পরে সেগুলোর বন্টন হয়েছিল ঠিকই, তবু এই লগ্নভ্রষ্টতার দুঃখ তাকে অনেকদিন বহন করতে হয়েছিল।
আর এক বিবাহ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত বিয়ের পদ্যে বরের মা লিখছেন –
হে মোর পুত্র, কর্মক্ষেত্রে জাগোরে ধীরে
এই সংসার মহাসাগরের মুখর তীরে।
জীবনের এক বিশিষ্ট পর্বান্তরে এই আহ্বানের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
তবে শুধু গুরুগম্ভীর আশীর্বচন কিংবা নির্দেশনা তো বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে আশা করা যায় না – তারা বেহেশতের পথযাত্রী, ‘যুবা-যুবতির সেদেশে ভিড়/ সেথা যেতে নারে বুঢঢা পির’ –এই ভাবধারার পথিক। তাই বন্ধুর বিয়েতে লেখা তাদের পদ্যে অনেক লঘুতা, অনেক ভাবোচ্ছ্বাস, এবং কখনও বা কিছুটা অশালীনতা। মনে পড়ছে তেমনই একটা বিয়ের পদ্যের কিছু অংশ ---
সময় এখন পাবে নাকো বেলায় ভাঙবে ঘুম,
লুকিয়ে কিনবে চিঠির কাগজ এসেন্স অটোব্লুম।
স্মৃতির ভাণ্ডার আপাতত শূন্য। তাই অলমিতি বিস্তারেণ। এই স্মৃতিচারণা আজকের প্রজন্ম কী ভাবে নেবে জানি না, তবে ‘তে হি নো দিবসাঃ’—আমাদের দিনগুলো এই রকমই ছিল।