• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | প্রবন্ধ
    Share
  • ট্রপিকাল রোগের ইতিহাস : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    ট্রপিকাল রোগ বলতে আমরা বুঝি গ্রীষ্মপ্রধান দেশের রোগ, যেগুলো উত্তরে বা দক্ষিণে ঠান্ডার দেশে বড়ো একটা দেখা যায় না। এই দেশগুলি বিষুব রেখার দুই দিকে ছড়ানো, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার অন্তর্গত। আবহাওয়ার উষ্ণতার জন্য এইসব দেশে মশা, মাছি, ফাঙ্গাস ও নানারকম পরজীবীর প্রাচুর্য। অনেক রোগ বহু প্রাচীন, আদিম মানুষের বিবর্তনের সময় থেকে চলে আসছে। ইতিহাসে এদের বিবৃতি আছে কিন্তু গত দু'শো বছরের আগে পর্যন্ত এদের উপরে কোনো গবেষণা বা চিকিৎসার বিবরণ পাওয়া যায় না।

    হয়তো যেতও না যদি ওইসব দেশে ইউরোপীয় উপনিবেশ না ছড়িয়ে পড়ত। ১৭-১৮ শতাব্দী থেকে ভারতে ও অন্যান্য ট্রপিকাল দেশগুলিতে ইউরোপীয় রাজত্ব গেড়ে বসল। নেটিভ কালো বাসিন্দাদের চেয়ে সাদা চামড়ার বিদেশীরা নানরকম নতুন ট্রপিকাল রোগে বেশি ভুগত। পেটের অসুখ, কৃমি, ম্যালেরিয়া, কলেরা, যক্ষ্মা, এবং আরও অনেক। শ্বেতাঙ্গরা কালো নেটিভদের বেশি শক্তপোক্ত মনে করত, ভাবত এদের রোগভোগ, ব্যথাবেদনা বা অন্য সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো কম। তখনকার সাহিত্য, কলা, রাজনীতি ও আইনে নানারকম জাতিবৈষম্যের উদাহরণ পাই। এমনকী কথায় কথায় 'teeming Asia’ বা ‘dark continent’ ব্যবহার এইরকম বৈষম্যেরই উদাহরণ।

    এইভাবেই একটা উত্তর-দক্ষিণ বিভেদ গড়ে উঠেছিল। উত্তরের (ইউরোপীয়) ধনী দেশগুলি মনে করত তারা বেশি সভ্য, পরিচ্ছন্ন, উন্নত, কর্মঠ আর তুলনায় দক্ষিণের (ট্রপিকাল, গ্রীষ্মপ্রধান,গরিব ও সাম্রাজ্যবাদীদের পদানত) দেশগুলি অলস, অশিক্ষিত, কর্মবিমুখ। মনে করত এদের উত্তরের ক্ষমতাধীন থাকাই উচিত।

    অবশ্য ট্রপিকাল দেশের সংক্রামক রোগগুলি সাদা-কালো বা ধনী-গরিব বাছাবাছি করে না। ক্রীতদাস জাহাজ ও অন্যান্য পথে অচিরেই রোগগুলি উত্তরের দেশেও ছড়াতে লাগল। শিল্পায়নের দরুন সেখানে শহরগুলির ঘিঞ্জি অবস্থা, জল-হাওয়ার দূষণ, এইসবের মধ্যে যক্ষ্মা ও কলেরা মহামারির আকার নিল। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জ্ঞান ও জীবাণুর আবিষ্কার তখনো অনেক দূর।

    সেই সময় (১৭-১৯ শতাব্দী) ইউরোপীয় দেশগুলি রোগের মোকাবিলা করতে তৎপর হয়েছিল। তারা নিজেদের দেশের পরিকাঠামো (infrastructure) উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত করে তুলল বটে কিন্তু অধিকৃত দেশগুলি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ সৈন্য ও প্রবাসীরা ট্রপিকাল দেশেও মারা যাচ্ছিল। সেই সময়ে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সংক্রামক রোগগুলি নিয়ে এই প্রথম ভালোরকম বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হল। ট্রপিকাল রোগ-বিজ্ঞানের এই শুরু। তখন ভারত ছিল ব্রিটিশ রাজের মুকুটমণি, রাজধানী কলকাতার মেডিকাল কলেজে ও গবেষণাগারে নামজাদা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কলেরা, গোদ ইত্যাদি রোগের জীবাণু ও কীভাবে মশা ও মাছি দ্বারা সংক্রমণ হয়। তার সঙ্গে সেইসব রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ওষুধও উৎপাদন হল। কিন্তু দেশের গরিব লোকেদের কপালে তার ছিটেফোঁটাই জুটল। (ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন মনে করুন।)

    উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। ব্রিটিশ রাজ ও অন্যান্য উপনিবেশের জমানা শেষ। আস্তে আস্তে গরিব দেশগুলিতে জনস্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধের কাজ শুরু হল। আমার মেডিকাল কলেজ এইমস-এ (AIIMS) Preventive Medicine বিভাগটি ষাটের দশকে একেবারে আনকোরা নতুন। কোটিপতি বিল গেটস, ম্যাকআর্থার ফাউনডেশন-এর মতো সংস্থাগুলি নানাদেশে প্রচুর সাহায্য করে আসছেন। অবশেষে আমরা এইসব গবেষণার ফল পেতে শুরু করি। কিন্তু এই বিষাক্ত উত্তর-দক্ষিণ মনোভাব অনেক জায়গায় এখনও অটুট। আমি মাদাগাস্কারে বিখ্যাত পাস্তুর ইন্সটিটিউটের ফরাসী বিজ্ঞানীদের দেখেছি গরিব দেশের রোগব্যাধি নিয়ে গবেষণা করছেন কিন্তু দু'পা বাইরে সেই দেশেরই লোকদের একটুও সাহায্য করা বা স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা নেই।

    কলোনির দেশগুলি পশ্চিম ইউরোপীয়-- ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, হল্যান্ড, পর্তুগাল ইত্যাদি। ট্রপিকাল রোগের গবেষণায় আমেরিকার অবদানের শুরু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে-- যখন দলে দলে আমেরিকান সৈন্যরা কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপিনস, জাপান ও অন্যান্য দ্বীপগুলিতে পা ফেলল। এ ছাড়াও গ্রীষ্মপ্রধান মধ্য আমেরিকায় পানামা ক্যানাল তৈরির সময় হাজার হাজার কর্মী ইয়েলো ফিভারে আক্রান্ত হয়েছিল। এইসব কারণে ট্রপিকাল রোগ নিয়ে আমেরিকাতেও জোর গবেষণা শুরু হল। আমেরিকার মিলিটারি এ বিষয়ে বিশেষ অগ্রণী। কারণ তাদের সৈন্যরাই এইসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছিল। দেশের রাজধানী ওয়াশিংটনে ওয়াল্টার রীড নামক প্রধান মিলিটারি হাসপাতাল ট্রপিকাল রোগের জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে নামকরা বিজ্ঞানীরা ট্রপিকাল রোগ সম্বন্ধে প্রথম পাঠ্যবইগুলি লেখেন। এঁদের লেখা AFIP (Armed Forces Institute of Pathology) ট্রপিকাল রোগের বইগুলি পৃথিবীবিখ্যাত ও আমার মতো প্রত্যেক প্যাথলজির ছাত্র-ছাত্রীদের বাইবেল!

    ওয়াল্টার রীড হাসপাতালে সত্তর-আশির দশকে ট্রপিকাল রোগ নিয়ে খুব ভালো সপ্তাহব্যাপী কোর্স শেখানো হতো। মিলিটারি সংস্থা হওয়ার দরুন শুধু আমেরিকান নাগরিকদেরই প্রবেশাধিকার ছিল। এক বছর আমি না জেনে ঢুকে পড়েছিলাম। পরদিন তাঁদের তক্ষুনি জানিয়েছিলাম কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ আমায় ফিরিয়ে দেননি, বরং খুব যত্ন করেই ট্রেনিং দিয়েছিলেন।

    সব দেশেরই রোগব্যাধি ও চিকিৎসার ইতিহাস নানারকম তাৎপর্যপূর্ণ ও মুখরোচক তথ্যে ভর্তি। তারই কিছু নমুনা দিলাম। আগ্রহী পাঠক ইন্টারনেটে ও লাইব্রেরিতে এ বিষয়ে প্রচুর বই পাবেন।

    ম্যালেরিয়া একটি প্রাচীনতম রোগ। আফ্রিকা, মধ্য আমেরিকা ও এশিয়ার গরম দেশগুলিতেই এর রাজত্ব সীমাবদ্ধ, কারণ ম্যালেরিয়া বহনকারী মশা ঠান্ডার দেশে বাঁচতে পারে না। আজকাল অবশ্য বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নের দরুন অনেক ঠান্ডা দেশও গরম হচ্ছে আর ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। ম্যালেরিয়ার পরজীবী প্লাসমোডিয়াম, অ্যানোফিলিস মশা ও ভুক্তভোগী মানুষ সবাই হাজার বছর ধরে একসঙ্গে বিবর্তিত হয়েছি। পরজীবীর প্রভাব এড়াবার জন্য আমাদের রক্তকণিকাগুলি (red blood cell) অনেকরকম বিবর্তিত রূপ নিয়েছে। যেমন sickle cell, thallassemia, Duffy blood group ইত্যাদি। এরা সবাই অল্পস্বল্প পরিমাণে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ করতে পারে কিন্তু বেশি ডোজে নিজেরাই রোগ বাধিয়ে বসে। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যে একসময় রোমান সাম্রাজ্য ছিল। অন্যান্য কারণের সঙ্গে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবও সেই সাম্রাজ্যপতনের এক কারণ।

    ভারতে, সেকেন্দ্রাবাদে ১৮৯৭ সালে স্যর রোনাল্ড রস মশার পেট থেকে ম্যালেরিয়ার পরজীবী আবিষ্কার করেন ও পরে নোবেল পুরস্কার জয় করেন। মশা ও ম্যালেরিয়ার যোগাযোগের এই প্রথম প্রমাণ। ম্যালেরিয়ার ওষুধ হিসেবে দক্ষিণ আমেরিকার উপজাতিরা সিঙ্কোনা গাছের ছালের পাঁচন খেত। পর্তুগিজরা প্রথম সিঙ্কোনা গাছ ভারতে আনায়। ব্রিটিশরা ভারতে ও সিংহলে পুরোদমে তার চাষ শুরু করে ও ছাল থেকে কুইনিন ওষুধ তৈরি করে। তারও বেশিরভাগই বিদেশে চালান যেত আর শ্বেতাঙ্গ সৈন্য ও কর্মীদের জন্য বরাদ্দ থাকত। (সমীর সেনগুপ্তের ‘এক অখ্যাত বাঙালির জীবনচরিত’ বইতে এই নিয়ে একটি সুন্দর সত্য কাহিনি আছে।) তাদের রোজ তেতো ওষুধ খাওয়াতে কুইনিন বিয়ারের সঙ্গে মেশানো হল। এখনও 'বিটার' বিয়ার ও টনিক খুব জনপ্রিয় ।

    উত্তর-দক্ষিণ বৈষম্যের আরেকটি কারণ ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য দুরারোগ্য ক্রনিক রোগ। ঘন-ঘন দু-তিনদিন অন্তর জ্বর মানুষকে দুর্বল করে তোলে। ফলে তারা ঠিকমতো পড়াশোনা বা কাজকর্ম করতে পারে না। উপরন্তু গরিব হওয়ায় আর পুষ্টিকর খাবারের অভাবে যক্ষ্মা ও অন্যান্য রোগও দেহে বাসা বাঁধে। এর ফলে জাতিবিশেষে সবার কুঁড়ে, অলস, মূর্খ ইত্যাদি বদনাম হয়ে যায়।

    দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছিল। ডিডিটি ও অন্যান্য কীটনাশক ওষুধের ব্যবহারে মশা কিছুটা দূর করা গেল কিন্তু গরিব দেশে ম্যালেরিয়ার অন্য কারণগুলি দূর করা হল না এবং কয়েক বছরের মধ্যেই ডিডিটি প্রতিরোধক মশার দল বেড়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে কুইনিন প্রতিরোধক পরজীবীও। এখন নতুন ওষুধ, ভ্যাকসিন ইত্যাদির গবেষণা চলছে কিন্তু ম্যালেরিয়া এখনও অপ্রতিরোধ্য।

    কলেরা আরেকটি গ্রীষ্মপ্রধান ট্রপিকাল দেশের রোগ। এই রোগটির প্রধান কেন্দ্র ভারতীয় উপমহাদেশ। বিশেষ করে বাংলা দেশের জলাভূমি অঞ্চল। এখান থেকে মহামারীর ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সারা এশিয়ায় ও ইউরোপেও। ১৮১৭ সাল থেকে সাতটি মহামারী ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়েছিল। সবই ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ, আর সুয়েজ খাল কেটে সুগম যাতায়াতের ব্যবস্থার ফল। সব দেশেই ঘিঞ্জি বস্তি, এঁদো পুকুর, জলনিকাশ ও পরিস্রুত জলের অভাব এই রোগকে আরও বাড়িয়ে তোলে। নেপলস ইটালিতে ১৯১১ সালে কলেরা মহামারীর সময় সরকার জোর করে খবর চাপা রেখেছিলেন যাতে শহরের দুর্নাম ও ব্যবসার ক্ষতি না হয়। ফলে জাহাজের মাধ্যমে রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত। ঠিক আধুনিক কালে চীনের SARS আর কোভিড-এর খবর চেপে যাওয়া ও পরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার মতোই।

    ১৮৮৩ সালে কলকাতাতেই আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট কখ কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করেন। ইউরোপে অনেক শতাব্দী থেকে রোগের কারণ হিসেবে 'miasma theory’ (পূতিবাষ্প ) মানা হতো। কখ-এর জীবাণু আবিষ্কার এই থিওরির সমাপ্তি ঘটায়। কখও ১৯০৫ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান।

    গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স রোগ অনেক পুরনো। গরমের দেশেই এর জন্ম। মিশরে হাজার বছর পুরনো মমির গায়ে বসন্তের ছাপ পাওয়া গেছে। ভারত ও চীনের প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে এই রোগের উল্লেখ পাই। ইউরোপীয় উপনিবেশের অনেক আগেই বসন্ত ইউরোপে ছড়িয়েছিল, হয়তো ক্রুসেডার সৈন্যদের মাধ্যমে মধ্য প্রাচ্য থেকে আমদানী। স্মল পক্স ঢিমে আঁচে সারা বছর থাকে ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে, মাঝে মাঝে মহামারীর আকারে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বড়োদের মোটামুটি ইমুনিটি থাকে। গরুর পক্স অনেকটা একই রকম কিন্তু কম উগ্র। গরুর পক্স দিয়ে ইমুনিটি বাড়াবার কৌশল এশিয়ায় অনেক আগেই জানা ছিল। টার্কি থেকে সেই জ্ঞান ইংল্যান্ড হয়ে ভারতে পৌঁছোয় ও স্মল পক্সের টিকার ব্যবহার শুরু হয়।

    এই রোগ ১৫ শতাব্দী পর্যন্ত ‘পুরনো বিশ্বেই’ (এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ) সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কলম্বাসের অভিযানের সময় খাবারদাবার, পশুপাখি, অস্ত্রাদি, ও গাছপালার সঙ্গে সঙ্গে বসন্ত ও হামের মত অনেক রোগের জীবাণুও অ্যাটলান্টিক পার হয়ে আমেরিকায় পৌঁছল। দেশী লোকেদের এসব রোগের বিরুদ্ধে কোনো ইমুনিটি ছিল না। এক ঝটকায় হাজার হাজার লোক বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে মরতে লাগল। বন্দুকের গুলির চেয়েও রোগের জীবাণু বেশি লোক মেরেছিল। যদিও বেশিরভাগ রোগই ছড়িয়েছিল অনিচ্ছাকৃত ভাবেই, কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় সাদা লোকেরা ইচ্ছা করেই ইন্ডিয়ানদের মধ্যে রোগ ছড়াবার জন্য কোনো বসন্ত রোগীর কম্বল বা কাপড়জামা দান করত। এইভাবেই শ্বেতাঙ্গরা উত্তর, দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে দখল বসাতে পেরেছিল। হাইতিতে এক বছরের মধ্যে স্থানীয় আরাওয়াক উপজাতিদের সংখ্যা এক মিলিয়ন থেকে পনেরো হাজারে নেমে গেছিল। শুধু পশ্চিম গোলার্ধেই নয়, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডেও এইরকম মহামারী সাদা লোকেদের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল।

    এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি। শোনা যায়, ম্যাসাচুসেটসে বিখ্যাত অ্যামহার্স্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড জেফ্রি অ্যামহার্স্ট নাকি এইরকম হীন কাজে যোগ দিতেন। ইউনিভারসিটির ডাইনিং হলে পুরনো খাবার প্লেটের চারধারে ছবি আঁকা --শ্বেতাঙ্গরা কম্বল নিয়ে ইন্ডিয়ানদের তাড়া করছে! এই নিয়ে ষাটের দশকে অনেক ছাত্রবিক্ষোভও হয়েছিল।

    নিয়মিত টিকার ব্যবহারের ফলে স্মল পক্স সারা পৃথিবীতে কমে আসে। ১৯৭৭ সালে সোমালিয়ায় শেষ রোগী দেখা গেছিল। ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদ (WHO) এই প্রথম একটি ট্রপিকাল রোগ একেবারে নির্মূল ঘোষণা করেন। এখন স্মল পক্সের অস্তিত্ব সারা পৃথিবীতে একমাত্র দুটি (আমেরিকা ও রাশিয়া) গবেষণাগারের টেস্ট টিউবে নিবদ্ধ।

    যক্ষ্মারোগের (টিবি) নাম সবারই পরিচিত। ম্যালেরিয়ার মতো এটাও এক সুপ্রাচীন, ক্রনিক রোগ। গ্রীস, মিশর, ভারত, চীন, সব দেশের ইতিহাসে আমরা এই রোগের বিবরণ পাই। এই রোগের শুরু ১৫-২০ হাজার বছর আগে, যখন মানুষ প্রথম পশুপালন করতে শিখেছিল। গরু, হরিণ ও অন্য কয়েকটি সমজাতীয় প্রাণী থেকে এই জীবাণু মানুষের শরীরে প্রথম প্রবেশ করে। আমাদের মহাপূজনীয়া গোমাতাই যক্ষ্মা রোগের বাহক! শিল্পায়ন, যাতায়াতের সুবিধা ও ঔপনিবেশিকতার কল্যাণে এই রোগ সহজেই এশিয়া, আফ্রিকা থেকে উত্তরে ইউরোপীয় দেশগুলিতে ছড়াল। শীতের দেশের ঘিঞ্জি বাড়িঘরে লোকেদের গাদাগাদি, আলোহাওয়ার অভাব, সবই এই রোগ বাড়িয়ে তোলে। তখনো জীবাণু আবিষ্কার হয়নি। লোকেরা পূতিবাষ্প (miasma) থিওরীতে বিশ্বাস করত। তারা ভাবত কোনোরকম অস্বাস্থ্যকর হাওয়ার মাধ্যমে যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি ছড়ায়। ম্যালেরিয়া নামের মানেই হল 'দূষিত হাওয়া' mal air. রবার্ট কখ যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার করে ওই থিওরি খণ্ডন করেন।

    শ্বেতাঙ্গ বাসীদের ধারণা ছিল যে দেশী, কালো নেটিভরা যক্ষ্মায় কাবু হয় না। সাদা লোকেরা 'ডেলিকেট', তাই বেশি ভোগে। যক্ষ্মার আরেক নাম ছিল 'হোয়াইট প্লেগ'। সেই সময়, ১৮-১৯ শতাব্দীতে ইউরোপে যক্ষ্মা একরকম ফ্যাশনেবল রোগ হয়ে উঠেছিল। যক্ষ্মা রোগীদের পাণ্ডুর, শীর্ণ চেহারা 'সেক্সি' বলে মনে করা হত। প্লেগ, কলেরা, স্মল পক্স ইত্যদি রোগীকে নোংরা, কুশ্রী করে দেয়। তার তুলনায় যক্ষ্মা বেশ 'পরিষ্কার' রোগ। নানা দেশে অনেক বিখ্যাত লেখক, কবি, আর্টিস্ট, সঙ্গীতজ্ঞ, গুণীজ্ঞানী লোকেরা এই রোগের শিকার হয়েছেন-- কীটস, শেলী, শোপ্যাঁ, চেকভ, হিউগো, ব্রাউনিং, ভারদি, পুচিনি ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য ১৮৮২ সালে যখন কখ যক্ষ্মার জীবাণু আবিষ্কার করেন, যক্ষ্মার ফ্যাশনেরও তখনই শেষ।

    আমেরিকাতেও লোকের মিথ্যা ধারণা ছিল যে কালো ক্রীতদাসরা যক্ষ্মায় ভোগে না। ভালো ভালো জায়গায়, পাহাড়ের উপর, সমুদ্রতীরে যক্ষ্মার স্যানাটোরিয়াম খোলা হল যেখানে ধনীরা আরাম করে, খোলা হাওয়ায়, ভালো খাবার খেয়ে যক্ষ্মা সারাতে পারেন। তখন এই-ই ছিল যক্ষ্মার ওষুধ। ইয়েল ইউনিভারসিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এডওয়ার্ড লিভিংস্টোন ট্রুডো (বিখ্যাত কার্টুনিস্ট গ্যারি ট্রুডোর প্রপিতামহ) নিউ ইয়র্কের অ্যাড্রিয়নড্যাক পাহাড়ে আমেরিকার প্রথম স্যানিটোরিয়াম খোলেন। ভদ্রলোক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। স্যানিটোরিয়ামের চারপাশে একটা শহর বানিয়ে তার মেয়র হয়ে বসেন। এখানে অনেক ডাক্তারও যক্ষ্মার চিকিৎসা শিখতে আসতেন। সেই থেকেই শুরু হয় TB Association যা পরে জাতীয় American Lung Association-এ পরিবর্তিত হয়।

    কখ-এর জীবাণু আবিষ্কারের পরেই যক্ষ্মা রোগে জীবাণুনাশক streptomycin ব্যবহার আরম্ভ হয় ও স্যানাটোরিয়ামগুলিতে শেষ ঘণ্টা পড়ে যায়।

    কিন্তু গরিব দেশে যক্ষ্মা যেমনকে তেমনই আছে। তার সঙ্গে এইডস, কয়লা খনির অসুখ ইত্যাদি যোগ হয়েছে। সম্প্রতি ওষুধ-প্রতিরোধক যক্ষ্মা জীবাণু খুব বেড়েছে আর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে।

    এইসব রোগ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ থেকে শুরু হয়ে মানবিক সংঘাত, ঔপনিবেশিকতা ও ব্যবসায়িক আদানপ্রদানের মাধ্যমে আজ সারা পৃথিবীতে ব্যাপ্ত। শুধু কলম্বাসের অভিযানই নয়, ক্রুসেড, হজ, সিল্করুট, পানামা ও সুয়েজ ক্যানাল, জাহাজ, ট্রেন, প্লেন, বিশ্বায়নের সব হাতিয়ার নানা রোগব্যাধিদেরও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু শাপের সঙ্গে আমরা কিছু বরও পেয়েছি বইকি। পেয়েছি ট্রপিকাল চিকিৎসাবিদ্যার অভ্যুদয়। পেয়েছি বহু বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসকের কঠিন পরিশ্রম ও সাধনার ফল। জোসেফ লিস্টার (অ্যান্টিসেপটিক ব্যাবহার), লুই পাস্তুর (জীবাণুমুক্ত দুধ), রবার্ট কখ (কলেরা, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের জীবাণু আবিষ্কার), রোনাল্ড রস (ম্যালেরিয়ার পরজীবী আবিষ্কারক), প্যাট্রিক ম্যানসোনাই (পায়ের গোদের পরজীবী আবিষ্কার), ইগনাজ সেমেলওয়াইস (সার্জারির আগে হাত ধোয়া! ভাবতে পারেন, সার্জেনরা হাত না ধুয়ে অপারেশন করতেন! কত সহস্র রোগী শুধু এইজন্য মারা গেছেন তার হিসেব নেই।) এঁরা না থাকলে চিকিৎসা আজও সেই ভয়াবহ মধ্যযুগে পড়ে থাকত। তাঁদের কাহিনী অনেকেই লিখেছেন। তাঁরা সবাই আমাদের নমস্য।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments