সেই মেয়েটিকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে। এবং দেখা হওয়ার প্রেক্ষিতটাও একটু ভিন্ন রকম ছিল।
কী রকম?
বলি।
সীমা-মাসীমাকে আমরা ছোটবেলা থেকেই চিনতাম, কারণ ওঁদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ির একতলায় আমরা ভাড়া থাকতাম আশৈশব। ওঁর ছেলে অনীক আমার প্রাণের বন্ধু ছিল, আছে আজও। আর, আমার মা ও সীমা-মাসীমা ‘সই’ ছিলেন। ‘সই’ মানে সখী, অর্থাৎ বন্ধু। সেকালের মেয়েরা/মহিলারা অনেকে পরস্পরকে ‘সই’ পাতাতেন। যেমন, ‘বকুল-ফুল’, ‘গঙ্গাজল’। ওঁরা পাতিয়েছিলেন ‘আতর’। এ ওকে ‘আতর’ বলে ডাকতেন। আমার মায়ের অকালমৃত্যুতে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিলেন মাসীমা।
অনীক সিংগী-রা কলকাতার এক আদি ধনী বাঙালি পরিবার। ওদের পারিবারিক চা-বাগান ছিল অনেকগুলো। উত্তরবঙ্গে। আমরা সদলবলে বেড়াতেও গিয়েছি সেখানে বেশ কয়েকবার। বড়লোকের ছেলে অনীক, ওরফে বুবু, বিশাল একটা মনের মানুষ! কত কত দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে যে কত কত বার! কিন্তু খামখেয়ালি। কোনো একটা কাজে বেশিদিন মন টেঁকে না তার। ভিন্টেজ কার, বিলিয়ার্ড, পিয়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক প্রকার শখই তার ছিল, আছে এখনও কমবেশি। এখনও বাড়িতে তার চার-পাঁচটি রেয়ার প্রজাতির সারমেয় রয়েছে। অতি প্রিয় তার।
সে হবে ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকের কথা। এহেন অনীকবাবুর বিয়ে হচ্ছে না বিয়ে হচ্ছে না ত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সেও, যদিও আমাদের বন্ধুদলের আর আর প্রায় সকলেরই বিয়ে-থা হয়ে গিয়েছে ততদিনে। এ’নিয়ে ওর মা যথেষ্ট অধৈর্য ছিলেন। অনীকের বিয়ে না-হওয়ার আদৌ কোনো কারণ ছিল না অবশ্য, ওর খামখেয়াল ছাড়া। ভালো ভালো ঘরের সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ের সম্বন্ধ আসে, কিন্তু অনীক-সাহেব এ’কারণ বা সে’কারণ দেখিয়ে কাটিয়ে দেন।
বললাম যে, এ’ হলো ঊনিশশ’ আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা, যখনও ঘটকের দ্বারা সম্বন্ধ আনা, বা মেয়ের বাড়ি গিয়ে ‘দেখে’ আসার চল ছিল। আগে আগে কয়েকবার আমিও ওর সঙ্গে গিয়েছি মেয়ে দেখতে।
এমন সময় নাগাদ একদিন ওর মানিকমামা এসে উপস্থিত হলেন কলকাতায়, ওদের বাড়িতেই এসে উঠেছেন, যেমন প্রতিবারেই ওঠেন। এই রকমভাবে মাঝে মাঝে এসে কিছু কিছুদিন কাটিয়ে যান উনি। আগেও অনেকবার এসেছেন। আমরা জানি।
অনীকের এই মামা ভদ্রলোক ছিলেন এক আকর্ষণীয় চরিত্র। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ অবিবাহিত এক মানুষ, সাদা ঢোলা পাঞ্জাবী-পাজামা পরেন। বছরের বেশিরভাগ সময়েই শিলঙের পৈতৃক বাড়িতে থাকেন ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায়, বা এ’দেশ ও’দেশ ঘুরে বেড়ান। ফটোগ্রাফি করেন। মুক্তপুরুষ একজন!
অনীক নিশ্চয়ই মনে মনে মামাকে আইডল ভাবে। এ’সময়ে মামার বয়স পঞ্চাশের চেয়ে বছর চার-পাঁচ কমই ছিল বলে মনে হয়।
মানিকমামা এলে খুব হই-হুল্লোড় হয়। খবর পেয়ে অনীকদের অন্য অন্য কাজিনরাও এসে পড়ে। আমরা পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুদলের কয়েকজনও ওঁর বিশেষ গুণগ্রাহী। ঘিরে বসে থাকি মামা এলে, ওঁর কাছ থেকে নানান গল্প শুনি। ফিল্ম সোসাইটিতে সিনেমা দেখতে যাওয়া হয়।
এবার যেমন উনি বলছিলেন ইরানের প্রখ্যাত ‘নওরোজ’ উৎসবের গল্প, যেখানে উনি সম্প্রতি গিয়েছিলেন উৎসবের ফটো তুলতে। প্রি-ইসলামী যুগ থেকেই এই নববর্ষের উৎসব শুধু ইরান নয়, সমগ্র মধ্য এশিয়ায় সাড়ম্বরে পালিত হয়। কী অসাধারণ রঙচঙে ও বাহারি তাদের সব সাজ পোশাক, খাওয়াদাওয়া--সে-সবের ছবি হাঁ করে দেখছিলাম আমরা। বিশেষ করে, রঙিন স্টিল ফটোগ্রাফ তখন আমরা নতুন নতুন দেখছি। দেখছি দু’ চোখ ভরে।
মানিকমামার কাছে থাকত অনেক ছোট্ট ছোট্ট ফিল্ম-স্লাইড আর ছোট একটা প্রজেক্টর। তা দিয়ে অন্ধকার ঘরের সাদা দেওয়ালে ছায়া ফেলে ফেলে উনি আমাদের দেখাতেন ওঁর তোলা হাজারো ফটোগ্রাফ। সফট ফর্মে। ওঁকে আর তাই মোটা এলবাম সঙ্গে নিয়ে নিয়ে ঘুরতে হতো না। মুভি না, স্টিল ফটো ছিল সেসব।
এবার দেখাচ্ছেন মধ্য এশিয়ার প্রান্তর, ইউফ্রেটিস নদী, সেখানকার ফেস্টিভ্যাল ইত্যাদি ইত্যাদি। ফটো দেখানোর পাশে পাশে চলতো মামার ন্যারেশন, সেই সেই সব দেশ-কাল-মানুষ সম্পর্কে গল্প বলা।
***
সেই সন্ধ্যায় আমরা জনা পাঁচ-ছয় জন অনীকদের দোতলার বড় ঘরটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি চেয়ারে-স্টুলে--চোখ কিন্তু সামনের দেওয়ালের দিকে। প্রজেক্টর চালিয়ে ছবি দেখাচ্ছেন মানিকমামা সেখানে ফেলে ফেলে।
ইজিচেয়ারে হাফ-শুয়ে শুয়ে ফটো দেখতে দেখতে সীমা-মাসীমা বললেন, ‘হ্যাঁরে মানিক, তুই সত্যি সত্যি গেছিস নাকি এই সব জায়গায়? কীভাবে যায় সেখানে? জাহাজ বা প্লেন তো যায় না ও’সব জায়গায়?’
--যায়, যায় ছোড়দি। নইলে আমি গেলুম কী করে? তুমি যাবে? চলো এর পরের বার তোমাকে মরুতীর্থ হিংলাজ দেখিয়ে আনবো। বালুচিস্তানে। বুঝলে?
বলতে বলতে প্রজেক্টরের ছবি আসা চলছে একাদিক্রমে।
হঠাৎ পুরো স্ক্রিন জুড়ে এলো একটি কিশোরী মেয়ের মুখ। ইরানী এক গ্রাম্য সুন্দরী!
‘দাঁড়া, দাঁড়া, দেখি, দেখি। ব্যাক কর তো!’ মাসীমা বলে উঠলেন।
পরের ছবিতে চলে গিয়েছিলেন মামা। হাতের সুইচ টিপে ফিরে এলেন আগেরটায়।
মাথায় চ্যাপ্টা গোল টুপি পরা একটি মেয়ে। মস্ত বড় বড় চোখ দুটি তার মুখের প্রধান আকর্ষণ। আইভরি গাত্রবর্ণ। অপূর্ব হাসি মেয়েটির। যেমন তিরতিরে ঠোঁট, বাঁশির মতো নাক, কানের লতি! হাসিটি তো ভুবনভোলানো! মুক্তোর মতো সেটিং দাঁতের। বাম চিবুকের কোণে আবার ছোট্ট একটি তিল বা আঁচিল। এক্কেবারে ক্লাসিকাল বিউটি-স্পট!
‘বাঃ, কী সুন্দর দেখতে রে মেয়েটাকে। ইরান দেশের মেয়ে? তুই চিনিস নাকি ওকে ?’ সীমা-মাসীমার প্রশ্ন।
‘কী করে চিনব আমি, বল তো ছোড়দি ? একটা গ্রাম্য মেলা দেখতে গিয়েছিলাম ওখানে। সেখানে হঠাৎ তুলেছি।’ মানিকমামা বললেন পরের এক পাহাড়ের দৃশ্য দেখাতে দেখাতে।
‘ছোট্-জেঠিমার খুব মনে ধরেছে। ছেলের বউ করে ঘরে আনবে। রাঙাদাও কেমন হাঁ করে দেখছে দেখ।’ পাশ থেকে ফুট কাটলো অনীকের খুড়তুতো বোন। সদ্যবিবাহিতা। চোখেমুখে কথা বলছে সে সব সময়ে।
‘গাঁট্টা খাবি কিন্তু রুমি। বড্ড ফাজিল হয়েছিস, না?’ অনীক গম্ভীর গলায় বলে উঠল।
এ’ ‘গল্পের’ সেদিন ওখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেছিল, বা ঘটা উচিত ছিল। কিন্তু আসলে না, সেদিনই শুরু হয়েছিল গল্পটির। যদিও তার কিন্তু কোনো কারণ ছিল না।
এবং, আমাদের আজকের গল্প এই নিয়েই!
|| ২ ||
এর সপ্তাহ দুয়েক পরে এক রবিবারের রোদ-ঝলমলে সকালে সীমা-মাসীমা আমাকে ড্রাইভার দিয়ে ডেকে পাঠালেন। ততদিনে আমরা আমহার্স্ট স্ট্রিটের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে সল্ট লেকের নতুন বাড়িতে উঠে গেছি। টেলিফোন তখনও অতি দুষ্প্রাপ্য বস্তু ছিল এদেশে; মোবাইল ফোন তো স্বপ্নের মধ্যেও আসেনি।
দোতলার বারান্দায় টবের গাছগুলোয় জল দিচ্ছিলেন সীমা-মাসীমা। আমাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে ঝারির জলে হাত ধুয়ে নিয়ে হাউজকোটে মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে গেলেন। আমায় বললেন, ‘ভেতরে আয়। একটা জিনিস দেখাবো তোকে।’
আমি বললাম, ‘বুবু তো কার র্যালিতে টাটানগর গেছে, না মাসীমা? পরশু ফিরবে তো ?’
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে আঁচলের চাবি দিয়ে ঘরের মস্ত মেহগিনি-কাঠের আলমারিটা খুলতে খুলতে মাসীমা বললেন, ‘গতকাল নন্দ ঘটক এসেছিল, বুঝলি। বুবুর জন্যে একটা নতুন সম্বন্ধ এনে দিয়েছে….এই দ্যাখ্…’ বলতে বলতে একটা লালচে খামের মধ্যে থেকে কাগজে মোড়া একটা রঙিন ফটো বের করে আমার হাতে ধরালেন উনি।
ফুলসক্যাপ পাতাটায় এজ ইউজুয়াল পাত্রীর নিজহস্তে নাম-ধাম-শিক্ষা-গোত্র হেনতেন লেখা আছে কিন্তু সে সব পড়ব কি, আমার চোখটা সরাসরি চলে গেছে পাত্রীর ফোটোটায় যেটা দেখে চমকে উঠলাম আমি।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাসীমাও বললেন, ‘বাপি রে, গতকাল এ’ছবিটা প্রথম দেখে আমিও চমকে উঠেছিলাম!’
অবাক হয়ে সেই ফটোটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি।
হ্যাঁ, এ তো হুবহু সেই ইরানী মেয়েটির মুখ যাকে মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে মানিকমামার স্লাইড শো-তে দেখেছিলাম আমরা।
‘মামা তো গত সপ্তাহেই শিলং ফিরে গেছেন,না?’ প্রশ্নটা এমনিই বেরিয়ে গেল আমার মুখ দিয়ে।
ঘাড় নাড়লেন মাসীমা। হ্যাঁ।
যদিও মামার কলকাতায় থাকা-বা-না-থাকার সঙ্গে নন্দঘটকের দ্বারা এই সম্বন্ধ আনা, ও এই ফটো দেখানোর এমনিতে কোনো সম্পর্ক থাকবার কথা নয়, সেটা আমি জানি।
***
এর পরের দিন, মানে সোমবার, আমার অফিসের শেষে সন্ধ্যার দিকে ঠিকানা মিলিয়ে মিলিয়ে পার্ক সার্কাসের কাছে এক পেল্লায় বাড়ির তিন তলায় চড়ে দুই নম্বর ফ্ল্যাটের পুরনো কালো-সাদা গোল কলিং বেলটি চ্যাঁ-চ্যাঁ করে টিপলাম।
মাসীমা গতকালই বলেছিলেন, ‘দ্যাখ্ বাবা বাপি, তুই হলি আমার একমাত্র সন্তানের, যাকে বলে, বেস্ট ফ্রেন্ড। আবাল্য বন্ধু। বুবু তোর কথা ফেলতে পারবে না। ওর সঙ্গে গিয়ে আগেও কয়েকবার পাত্রী দেখে এসেছিলিস তুই। এবার বুবু কলকাতায় ফেরবার আগেই এই মেয়েটিকে তুই কাল একা একা গিয়ে দেখে আয় তো একবারটি--এটাই আমার অনুরোধ বা আদেশ। মানিকের ক্যামেরায় ঐ ইরানী মেয়ের ছবি্র সঙ্গে কলকাতার এই বাঙালি মেয়ের মুখের এতো মিল থাকে কী করে?
সঙ্গের সাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজে বড় বড় অক্ষরে মেয়েটির
নাম, লেখা রয়েছেঃ
কুমারী কান্তা রায়চৌধুরী।
পিতার নামঃ ঁ রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরী। ইত্যাদি
|| ৩ ||
ঘড় ঘড় শব্দ করে মস্ত কাঠের দরোজাটি দু’ভাগ হয়ে খুলে গেল তিনতলার ফ্ল্যাটের। আমি আশা করিনি যে প্রথমেই ছবির সেই সুন্দরীকে সামনেই
দেখতে পেয়ে যাব।
একটা হালকা এসেন্সের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। এ’গন্ধটা আমার চেনা। কান্তা সেন্টের গন্ধ। আমার মা মাখতেন।
কী ভাবে বর্ণনা করব সেই রমণীকে?
উচ্চতাটা তার একটু কম। পাঁচ ফুট দু’এক ইঞ্চি হতে পারে। ঊর্ধ্বাঙ্গে ঘটিহাতা সাদা একটি ঢোলা ব্লাউজ; কোমর থেকে লাল রঙের একটা ফ্রক নিচে গোড়ালির একটু উপর পর্যন্ত পরে আছে। মেয়েটির গড়নটা একটু মোটার দিকে। নেহাত তন্বী বলা চলবে না। মুখের বর্ণনা তো আগেই দিয়েছি সেই মানিকমামার ফটো-শো এর সময়ে। চুলের রং তার কটা; দৈর্ঘ্যে স্বল্প।
‘আজ্ঞে আমি…(থতমত খেয়ে কী বলব বুঝতে পারছি না)…আমহার্স্ট স্ট্রীটের সিংহ বাড়ির তরফ থেকে আসছি। মানে…’
কোনো কথা না বলে সেই মেয়ে সটান আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নির্বাক, কিন্তু যেন বলছে, ‘হ্যাঁ, বলুন?’
ঘাবড়ে গিয়ে কি-না-কি ভেবে সেই লালচে খামটা পকেট থেকে বের করে সামনে এগিয়ে ধরলাম (ভাগ্যিস গতকাল সীমা-মাসীমার কাছ থেকে এটি চেয়ে এনেছিলাম রেফারেন্সের জন্যে), বললাম, ‘আজ্ঞে, নন্দ ঘটক এটি আমার মাসীমাকে দিয়ে এসেছিল পরশু; আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে।’
স্মার্টলি সেটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে সেই মেয়ে বললে, ‘আমার বিয়ের সম্বন্ধ তো? কিন্তু, পিসিমা তো সন্ধ্যে-আহ্নিকে বসেছেন। একটু অপেক্ষা করতে হবে যে আপনাকে।’
তারপর পাশের সোফার দিকে ইঙ্গিত করে বললে, ‘আপনি একটু বসুন। চা নেবেন, না বীয়র?’
বিষম খেলাম জবরদস্ত। মনে মনে।
বিয়ের সম্বন্ধ করতে আসা আগন্তুককে বীয়র অফার করাটা সেকালেই যথেষ্ট আন-ইউজুয়াল ছিল, হয়তো বা এখনও তা-ই আছে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে।
থতমত খেয়ে, হয়ত ঘাবড়াহাট দূর করতে, বললাম, ‘আপনি লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে পড়তেন তো? শ্যামলী চক্রবর্তীকে চেনেন নাকি? আমার বোন।’
‘আমি কারোকেই চিনি না, আবার কেউই আমাকেও চেনে না। বরঞ্চ ওদেরই জিজ্ঞেস করে দেখবেন এখন…’
কী রকম যেন ঘোরালো উত্তর দিল মেয়েটি।
একটু মুষড়ে পড়লাম।
এই মেয়েকে বিয়ে করবে আমার প্রাণের বন্ধু?! কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না।
অতি-সপ্রতিভ মেয়েটি হঠাৎ বলে উঠল, ‘বন্ধুর বিয়ের সম্বন্ধ করতে এসে কী দেখছেন আপনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, বলুন তো ?’
এতই ঘাবড়ে গেলাম এ’কথায় যে পালিয়ে বাঁচতে পারলে হতো।
‘কালক?’ শুধালো সেই মেয়ে।
‘মানে ?’ আমার গলায় বিস্ময় প্রবল!
‘কালক মানে তিল, বা জরুল। তৎসম শব্দ। এই যে এটিকে আপনি দেখছেন এখন?’ ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বাম চিবুকের তিলটি ছুঁয়ে প্রশ্ন করল মেয়েটি, যার ভালো নাম (কুমারী) কান্তা রায়চৌধুরী!
‘কে রে মানু? কে এসেছে?’
বলতে বলতে যিনি এই ড্রয়িং স্পেসের দিকে এগিয়ে এলেন তাঁকে দেখে সম্ভ্রম হলো। উঠে দাঁড়ালাম সোফা ছেড়ে। হাতজোড় করে নমস্কার জানালাম।
লালপাড় ঘিয়ে রঙের গরদের শাড়ি পরনে ছিল ওঁর। বছর পঞ্চান্নর পৃথুলা এক রমণী। সিঁথিতে লাল টকটকে সিন্দুর। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মুখাবয়বের মধ্যে ওঁর অতি টিকালো নাকটি প্রথমেই নজরে পড়ে যায়। আর হ্যাঁ, মহিলা খানিকটা ট্যারা টাইপের ছিলেন বটে। লক্ষ্মীট্যারা বলি আমরা।
পাশের সোফাটিতে গুছিয়ে বসে ও আমার ভণিতা ইত্যাদি শুনে-টুনে, এবং ঘটকের দেওয়া সেই খামটি উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে অতি পরিশীলিত স্বরে ও সম্ভ্রমের সঙ্গে সেই প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বললেন, ‘নন্দের বাবা সিধু ঘটক আমার বিয়ের সম্বন্ধ করেছিল, এটা জানো কি?’
কী করে জানবো? জেনে কী-ই বা হবে আমার? বর্তমান বিবাহের সমন্ধের সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কী?
‘আমরা কিন্তু উত্তর রাঢ়ী কায়স্থ। অতি প্রাচীন উচ্চবংশ…’ বললেন সেই বর্ষীয়সী মহিলা।
‘কন্যা যদিও অনাথা।’ পাশ থেকে ঠোক্ পাড়লো সেই মেয়েটি, যে নিজেই কিনা পাত্রী। পিসির পাশে সোফায় বসে যে এতক্ষণ শুনছিল আমাদের কথা।
‘অনাথা?!’ ঢোঁক গিললাম আমি। কই, এ’তথ্যের তো উল্লেখ ছিল না সেই ফটোর সঙ্গের কাগজটিতে।
ঢং ঢং করে পাশের গীর্জার ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা ঘোষণা করল। আমাকে উঠতে হবে। যেতে হবে অনেকটা দূর। সেই সল্ট লেক।
কী বলব ফিরে গিয়ে মাসীমাকে? অনীক জিজ্ঞেস করলেই বা কী বলব? কেমন দেখলাম পাত্রীটিকে? এত বিভ্রান্ত জীবনে হইনি আমি।
আমাকে সেই নন্দ ঘটকের লালচে খামটা ফিরত দিতে দিতে বললেন সেই বয়স্কা মহিলা, ‘ইরানের সম্রাট শাহ্ মোহম্মদ রেজা পহলভী-র একজন স্টেনোগ্রাফার ছিলেন আমার দাদা ঈশ্বর রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরী। ইংল্যান্ডের পাবলিকস্কুল-এডুকেটেড! ইনিই এই কান্তা মেয়েটির বাবা, বুঝলে? ১৯৫৩-র ক্যু-তে পারস্যদেশে নিহত হন উনি। কান্তার মা ছিল…. ’
‘এক আদিবাসী বাসেরী নর্তকী। ’ বললে সেই মেয়ে, যার কোনো যমজ বোন ছিল কিনা বা আছে কিনা সেটা জানতে পারলাম না, যার ছবি গত মাসে ইরানে বেড়াতে গিয়ে মানিকমামা তুলে এনেছিলেন দৈবাৎ। আমরা দেখেছি স্লাইড শো-তে।
|| ৪ ||
আমার প্রাণের বন্ধু অনীক সিংহের সঙ্গে উত্তররাঢ়ী কায়স্থ কুমারী কান্তা রায়চৌধুরীর বিয়েটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি, যদিও এই প্রথমবার কোনো মেয়েকে দেখে পছন্দ করেছিল উন্নাসিক অনীক সিংগী, এবং সেকালে যেটা খুব কমন ছিল না, বিয়ের আগেই ওরা বারবার দেখাসাক্ষাৎ মেলামেশা, এমনকি মিনি-মধুচন্দ্রিমা পর্যন্ত যাপন করে এসেছিল কোনো সমুদ্রসৈকতের রিসর্টে। অনীক কেবল অপেক্ষা করছিল কবে কান্তার সঙ্গে তার বিয়ের দিনটা ঘোষিত হয়--এতই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তার মেয়েটিকে।
কিন্ত মিঃ এন কে সিনহা, অর্থাৎ শ্রী নবনীতকান্তি সিংহ, মানে অনীকের বড় জ্যেঠামশায়, পিতৃহারা অনীকের ও তাদের ক্ল্যানের গার্জেন ছিলেন যিনি, অত্যন্ত বিপক্ষে ছিলেন এহেন এক অনাথ যুবতীর সঙ্গে ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহ দিতে। অনীক বা তার মাতৃদেবীরও সাহস হয়নি তাঁর আদেশ অমান্য করে এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার।
বিয়েটা কেটে যায়। যদিও তার পিছনে এইটি ছাড়াও অন্য কারণ ছিল বলে আমার ধারণা, কারণ স্বেচ্ছাচারী অনীক সিংগী শুধুমাত্র তার জ্যেঠামশায়ের কথায় দয়িতকে ত্যাগ করবে--এটা আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।
***
এর বেশ কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় টলি ক্লাবে বসে আকণ্ঠ পান করতে করতে অনীক আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বাপী, তোর কি নারী-সংসর্গের অভিজ্ঞতা আছে?’
‘নারী সংসর্গ, মানে ….ডু ইউ মীন সেক্সুয়াল রিলেশন?’ বিষম-টিষম খেয়ে বলেছিলাম আমি।
‘না তো কী হে বাংলা মিডিয়মে পড়া সুবোধ বালক?’ অনীকের গলা টলটলে।
আমার উত্তর নঞর্থক হওয়ায় হো হো করে হেসে উঠে অনীক বলেছিল, ‘জানিস বাপী, ডে-ট্রিপে বেরিয়ে ডায়মণ্ড হারবারের হোটেলের ডিলাক্স স্যুটে আমরা যখন বিলীন হয়ে গিয়েছিলাম একে অপরের মধ্যে, কান্তা আমাকে বলেছিল, বুবু, তোর সঙ্গে বিশ বছর পরে আমার আবার দেখা হবে কিন্তু তখন কি আর তুই আমাকে চিনতে পারবি? হয়তো তখন আমি আর এ’শরীরে থাকব না ।’
মানে কী এ’কথার? বুঝিনি। বিভ্রান্ত হয়েছিলাম যথেষ্ট। না সেকালে স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে তুই-তোকারির সম্পর্ক চালু হয়েছিল, না কেউ তেমন ডাকত, কিন্তু কান্তা নির্দ্বিধায় তুই তুই করে ডেকেছিল অনীককে। মাচ্ আহেড অব্ টাইম।
|| ৫ ||
এর দুই দশক পরে ২০০৩ নাগাদ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইংরেজিতে এক দীর্ঘ ই-মেইল করেছিল আমাকে অনীক সিংহ, যদ্দিনে কাগজ-কলমে লেখা এরোগ্রাম ব্রাত্য হয়ে ইলেকট্রনিক মেইল, মানে ই-মেইল চালু হয়ে গিয়েছে বিশ্বজুড়ে।
অনীক লিখেছিলঃ (আমি বাংলা করে দিচ্ছি এখানে--)
ভাই বাপী,
দুবাই থেকে এখন লিখছি তোকে যে… যে-কান্তাচৌধুরীর সঙ্গে আজ থেকে বিশ বছর পূর্বে আমার বিবাহ হয়নি বলে আমি আর বিয়েই করলাম না, তাকে গত সপ্তাহে এখানে মীট করলাম!
তাকে ? হ্যাঁ, এবং না।
কী রকম? বলি তোকেঃ একটা ফোটগ্রাফিক ক্লাবের একজিবিশনে যোগ দিতে এসেছিলাম এখানে। বিশ্বের তাবড় তাবড় ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফাররা এসেছে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে। সেখানে ‘ইয়াং ফটোগ্রাফার অব্ দ্য ইয়ার’ পুরস্কারটা জিতে নিয়ে স্টেজে উঠল যে কিশোরী মেয়েটি তাকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি!
তার নামটাও ঘোষণা করা হলো, ‘ মিস্ ক্যান্টা আর সি’ ফ্রম ইণ্ডিয়া!
অনুষ্ঠান শেষে ভিড় ঠেলে মেয়েটির নিকটে পৌঁছে প্রায় তার কানের কাছে মুখ এনে বললাম, ‘কান্তা?! কেমন আছ তুমি?’
ভীষণ চমকে উঠে যে সে আমার দিকে তাকিয়েছিল তা নয়, কিন্তু যে স্নিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে চোখটা তুলল সে তাতে আছে পরিচিতির ছোঁয়া! মানে, সে চিনতে পেরেছে আমাকে; অন্তত আমার মুখটা অপরিচিত নয় তার কাছে।
কিন্তু দীর্ঘ বিশ-বিশটা বছরে একজন মানুষের একটুও বয়স বাড়ে না…মুখে বা অঙ্গে তেমন কোনোই ছাপ নেই--এটা হতে পারে কি করে ? সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখলে যে কেউই বলবে বছর বিশ-বাইশের মেয়ে সে, চল্লিশ-বিয়াল্লিশের নয়।
আমি চাইছিলাম ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে। কিন্তু ওর বোধহয় তাড়া ছিল। অন্য কোথাও যাবে হয়ত। অনুষ্ঠানশেষের ভিড়ভাড় হট্টগোলের মধ্যে শুনতে পাচ্ছিলাম না আমি আর কিছু। অনেকেই বুফে ডিনার করতে যাবে বলে সেদিকে ঠেলাঠেলি করছে। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ফস্ করে নিজের একটা ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে গুঁজে দিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে
গেল মেয়েটা। দূর থেকে দেখলাম হলের গেট দিয়ে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে সে।
সেই রাত্রেই দুবাইয়ের হোটেলে ফিরে এসে ওর নম্বরে অনেকবার ট্রাই করলাম। প্রত্যেকবারই সুইচড-অফ্ আসছিল।
***
পরের দিনই ছিল আমার দেশে ফেরবার টিকিট। সকালে তাই আর দেরি না করে শহরের উত্তরপ্রান্তে দিয়েরা অঞ্চলের গন্ধ-পট্টির এক পুরনো তিনতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। মধ্যপ্রাচ্যের আতর ও অন্যান্য
গন্ধদ্রব্য এককালে জগৎবিখ্যাত ছিল। এখনও আছে। এ’ হলো সেই পট্টি। পরপর অনেক অনেক আতরের দোকান রয়েছে এখানে। যদিও এত সকালে সেগুলো খোলেনি।
এই বাড়িটি অতি প্রাচীন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে এসে দুই নম্বর ফ্ল্যাটের দরজার পাশে লাগানো পুরনো এক কালো-সাদা কলিং বেল চ্যাঁ চ্যাঁ করে বাজালাম। কান্তার সঙ্গে দেখা করে কথা বলে এই রহস্যের উদ্ঘাটন না করা পর্যন্ত শান্তি নেই আমার।
দরজাটা খুলে গেল। কিন্তু সামনেই কেউ দাঁড়িয়ে নেই তো!
হঠাৎ ফ্ল্যাটের ভিতরের যেন কোনো এক পাব্লিক এড্রেস সিস্টেমে এক ভারি মহিলাকণ্ঠ বলে উঠল (বা, হয়ত রেকর্ডেড মেসেজ), ‘প্লিজ বি সিটেড। আই শ্যাল বি উইথ ইউ শর্টলি। প্লিজ মেক ইয়োরসেলফ কম্ফর্টেবল।’
টেবিল চেয়ার সোফাসেটি দিয়ে সাজানো বড় একটি ড্রয়িংরুম এটি। সামান্যক্ষণ সোফায় বসে থেকে উঠে পড়লাম সামনের দেওয়ালে টাঙানো এক স্নানরতা নারীর পেইন্টিংটা ভালো করে দেখব বলে। ইসলামী দুনিয়ার কোনো ছবিতে উন্মুক্তবক্ষা নারীর ছবি আগে দেখিনি। এ’ছবিটি যেন
কৃষ্ণের গোপিনী-র বস্ত্রহরণের ছবি।
‘ও হলো গিয়ে পারস্যের সুন্দরী শিরিন। গোসল করছে সে। আর ঘোড়ায় চড়ে যুবরাজ খশরু দেখছে। লুকিয়ে লুকিয়ে!’ পরিষ্কার বাংলাভাষায় পাশ থেকে গলাটা শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি পৃথুলা মধ্যবয়স্কা এক রমণী কখন এসে দাঁড়িয়েছেন আমার গা ঘেঁষে, তরল গলায় বললেন তিনি কথাটা। হাসতে হাসতে। সদ্য স্নান সেরেছেন, সেটা ওঁর ভেজা চুল দেখে বোঝা গেল। পরনে লাল পাড় ঘিয়ে রঙের গরদের শাড়ি। সিঁথিতে লাল টকটকে সিন্দুর। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। মুখাবয়বের মধ্যে ওঁর অতি টিকালো নাকটি প্রথমেই নজরে পড়ে যায়। আর হ্যাঁ, মহিলা খানিকটা ট্যারা বটে। লক্ষ্মীট্যারা বলি আমরা। মনে হলো, সদ্য পূজা সেরে উঠে এসেছেন উনি।
কী বলব ওঁকে আমি? কী বলে ইন্ট্রো দেব নিজের?
টুং টাং টুং টাং করে মিষ্টি সুরে একটি টাইমপিস সকাল আটটা ঘোষণা করলে। বুকসেলফে রাখা সেই চমৎকার ঘড়িটির দিকে তারিফের দৃষ্টিতে তাকালাম। কারুকার্য করা দুটি কাঁচের পাখির মাঝে গোল ডায়ালটি রয়েছে। হালকা গোলাপী রঙ তার। ঘড়িটিকে কাছ থেকে ভালো করে দেখব বলে সেলফের নিকটে এগিয়ে যেতে পাশেই ছোট ফ্রেমে বাঁধানো বহু পুরানো একটা সাদাকালো ফটো দেখে চূড়ান্ত চমকে উঠলাম আমি।
কী বলব তোকে, বাপী, এই অভিজ্ঞতা এখন লিখতে লিখতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে আমার! পাশাপাশি দু’জন যুবক-যুবতী পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে পোজ্ দিয়েছে, আর তাকিয়ে আছে সো-জা ক্যামেরার দিকে। সুন্দরীর বাম চিবুকের তিল-টি স্পষ্ট দৃশ্যমান!
আজ থেকে বিশ বছর আগে নেহাতই ইয়াং বয়সে ডায়মণ্ড হারবারের এক স্টুডিওতে এ’ফটো যখন তুলেছিলাম আমরা তখন ভেবে নিয়েছিলাম যে আমাদের বিবাহ শুধু দিন ঘোষণার অপেক্ষা!
কিন্তু এ’ফটো দুবাই-এর এই পুরাতন অট্টালিকায় এখন এল কী করে ?
সেই প্রশ্ন নিশ্চয়ই আমার চোখেমুখে স্পষ্ট ছিল যখন ঘাড় ঘুরিয়ে সেই বয়স্কা মহিলার দিকে তাকালাম।
স্মিত হেসে উনি বললেন, ‘এতদিন পরে এলে। বসো। অনেক কথা তো আছে। কান্তা কাল রাতে ফিরে বললে বটে যে তোমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল।’
‘কিন্তু কোথায় সে এখন? সামনে আসছে না কেন ? এই বিশ বছরে তার কি বয়স বাড়েনি এতটুকুও?’ হয়ত এক প্রকার হাহাকারের সুর বেজে উঠেছিল আমার গলায়।
‘ও আবার কী কথা গো? বাড়বে না কেন তার বয়স? দেখতে দেখতে আমাদের চোখের সামনে একুশে পা দিল মেয়ে গত অঘ্রানে।’
‘মানে, ওর বয়স মাত্র একুশ এখন, বলতে চান? তাহলে বিশ বছর আগে তোলা ঐ ফটো….? ’ আঙুল তুলে বুক-সেলফের ফটোফ্রেমের দিকে দেখালাম আমি।
হে হে হে হে করে দুলে দুলে হাসতে হাসতে সেই বয়স্কা মহিলা বললেন, ‘আসলে, তুমি নিজের মেয়েকে আগে কখনও দেখোনি কিনা, অনীকবাবু! !’
কী বলব তোকে, বাপী, এই কথা শুনে আমার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া বাকি ছিল মাত্র। মরীয়া হয়ে শুধালাম, ‘কিন্তু ওর নামও কান্তা কী করে হলো?’
হা হা হা হা করে হাসতে হাসতে মহিলা বললেন, ‘কেন? রাণী হলেই এলাউড ? প্রথম এলিজাবেথ দ্বিতীয় এলিজাবেথ--এই রকম নাম শুনলে তো তখন আর এই প্রশ্নটা কর না বাপু?’
ঠিক এই সময়েই চ্যাঁ চ্যাঁ করে দরোজার কলিং বেল টা বেজে উঠতে, ‘ঐ মেয়ে রাইডিং ক্লাস থেকে ফিরলেন’, বলতে বলতে উনি দরোজাটা খুলে দিতে গেলেন।
|| ৬ ||
না না, আমার প্রাণের বন্ধু অনীক সিংগীর এই দীর্ঘ ই- মেইলের কোনো জবাব সেদিন আমি দিতে পারিনি। কেবল একটি লাইন মাত্র লিখেছিলাম, ‘লেট ইউ কাম ব্যাক টু ক্যালকাটা… তুই কলকাতায় ফিরে আয়, বাকি কথা তখন হবে।’
এরপর বুবু অর্থাৎ অনীক সিংগী কলকাতায় ফিরে এলে টলিক্লাবের এক দীর্ঘ সান্ধ্য আড্ডায় নিজের ইরানীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে ও’ আমায় যা যা বলেছিল তার কিছু বুঝেছিলাম, কিছু বুঝিনি।
যা-ই বুঝে থাকি, ওর বলা সেই গল্প দিয়েই আজকের এই
আখ্যান শেষ করব।
[ হ্যাঁ, ভালো কথা, সেই সন্ধ্যায় কিন্তু আমাদের কারোরই টলটলায়মান অবস্থা হয়নি; উত্তেজনায় অতি সজাগ হয়ে ছিলাম আমরা। ]
বুবু, অর্থাৎ অনীক সিংগী বলেছিলঃ
কাকতালীয় ঘটনাবলী, বা এক্সিডেন্টাল কো-ইন্সিডেন্স যে কীভাবে ও কত ভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে ফেলে তা হয়ত অনেক সময়েই খতিয়ে দেখি না আমরা, কিন্তু দুশ্চিন্তিত হই, কত রকম ব্যাখ্যা যে করে ফেলি মনে মনে!!
অনীক, অর্থাৎ বুবু, বলে চলেছিলঃ সেই মধ্যপ্রাচ্যে বসে সেদিন কান্তা চৌধুরীর রহস্য উদ্ঘাটনে মরিয়া হয়ে আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ইরানে যাবার ভিসা জোগাড় করে ফেলেছিলাম, কারণ আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে এ’রহস্যের মূল লুকিয়ে আছে প্রাচীন পারস্যদেশের মাটিতে। মনে পড়ে গেল, মানিকমামার তোলা ছবিতে সেখানকার নওরোজ উৎসবের ফটোর মধ্যে ‘কান্তা’-কে প্রথম দেখেছিলাম আমার উঠতি যৌবনে!
দুবাই থেকে ইরানের ভৌগোলিক দূরত্ব দীর্ঘ না হলেও আয়াতোল্লাহ্ খোমেইনির ধর্মীয় শাসন চলছে তখন ইরান দেশে, তাই ভিসা জোগাড় করা সহজ ছিল না। ভাগ্যিস দুবাই-এর ভারতীয় দূতাবাস থেকে এপ্লাই করেছিলাম আমি। তাই পাওয়া গিয়েছিল ভিসা।
***
তেহরান পৌঁছে আবার একটি উড়োজাহাজে চড়ে শিরাজ শহরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। মহাকবি সাদী-হাফেজের শহর এই প্রাচীন শিরাজ, আবার এই পার্স-প্রদেশ-ই হলো গিয়ে বাসেরী আদিবাসীদের প্রাচীন আবাসস্থল, প্রি-ইস্লামিক কাল থেকেই যারা এখানে বাস করে আসছে বহু বহু শতাব্দী ধরে।
কান্তার বাবা, লণ্ডনের হ্যারো পাবলিক স্কুলে শিক্ষিত ইতিহাসপ্রেমী বঙ্গসন্তান রাঘবেন্দ্র রায়চৌধুরী যে কী সূত্রে ইরানদেশে গিয়ে পড়েন, ও সম্রাটের নিজস্ব অফিসের স্টেনোগ্রাফার হয়ে যোগ দেন---সেটা আমি জানতে পারিনি, কিন্তু উনি যে সম্রাটের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছিলেন, ও শেষাবধি ১৯৫৩-র শাহ্ - বিরোধী ক্যু-তে প্রাণ দেন সেটা তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। এর আগেই কান্তা-র মা-কে বিবাহ করেছিলেন উনি শিরাজ শহরের আশেপাশে আদিবাসী উপাচার মেনে, যাঁর-ও কিনা বাম চিবুকে একটি তিল ছিল।
কালক!
তৎসম শব্দটি সেই মেয়েটির পার্ক সার্কাসের ফ্ল্যাটে বসে প্রথম শুনেছিলি ও শিখেছিলি তুই বাপী, মনে পড়ে কি?
কী গেরো! কে রাখে বলতো এত এত হিসেব?!
***
ইরানের প্রাচীন বাসেরীয় উপজাতিদের মধ্যে বহু শতাব্দীকাল ধরে এক উপকথা চালু হয়ে রয়েছে। লণ্ডনের এক ইরানপ্রেমী সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি আমি তা, অনীক বলে চলেছিল--‘কান্টিস্’ নামের এক প্রাচীন অমর দেবী ছিলেন বা আছেন তাঁদের, যাঁর উপাচারের বা পূজার উপকরণ ছিল শুধুমাত্র সুগন্ধদ্রব্য!
‘কান্তা’ সেন্ট! আমার মা ও তার সই সীমা-মাসীমা মাখতেন।
‘আতর’ বলে ডাকতেন যাঁরা পরস্পরকে।
আতর মানে সুগন্ধী। পারফ্যুম!
হ্যাঁ, এই ‘কান্টস’ উপদেবীর বাম চিবুকেও ছিল একটি ছোট্ট কালো তিল বা আঁচিল। কালক! তৎসম শব্দ!!
***
অনীক বলে চলেছিল, “ সেকালে আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়ির দোতলায় বসে মানিকমামার স্লাইড-শোতে সেই সুন্দরী ইরানীয় কিশোরীর ছবি দেখানোটা সমাপতন হতেই পারে, কিন্তু আজকের জেনেটিক্স বিজ্ঞানীদল পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু অঞ্চল বা জনগোষ্ঠী আবিষ্কার করেছেন যাদের মধ্যে যমজ বা ট্রিপলেট বা কোয়াড্রুপ্লেট জন্মানোর হার খুবই বেশি।
রাঘবেন্দ্রকে বিবাহ করবার আগেও সেই বাসেরী রমণীটির পূর্ব-বিবাহ ছিল, এবং তার সন্তান থেকে থাকতে পারে। কন্যা। হয়ত তারও বাম চিবুকে ছিল একটি তিল। হ্যাঁ, কাকতালীয়ভাবে সেই মেয়েটির ফটোই মানিকমামা তুলে এনে স্লাইড-শো তে দেখিয়েছিলেন আমাদের।
‘কিন্তু বুবু অত ভালো লেগে যাওয়া সত্ত্বেও সেকালে তুই কান্তাকে বিয়ে করিসনি কেন বল তো? সে কি শুধুমাত্র জ্যেঠামশায়ের কথা মান্য করেই?’ এই প্রশ্নটা বহুকাল থেকেই করবার ছিল আমার।
‘না রে,’ টলিক্লাবে বসে সেই রাত নয়টায় গল্প শেষে প্রথম গ্লাস গ্লেনফিডিচে চুমুক দিতে দিতে বুবু বলেছিল, ‘ডায়মণ্ড হারবারের হোটেলের ডিলাক্স রুমে কান্তাকে বুকে পিষে নিতে নিতে একটা গন্ধ নাকে এসেছিল আমার।
কান্তা সেন্টের গন্ধ! আমার মা মাখেন।
সেদিনই বুঝেছিলাম এই মেয়েকে আমি বিয়ে করতে পারি না।’ এবং, করিনি।
***
গল্প শেষে একটাই প্রশ্ন করেছিলাম আমি অনীককে।
‘কেন? হর্স-রাইডিং ক্লাস-ফেরতা নিজের মেয়েকে কি তুই মীট করিসনি সেদিন দুবাইয়ে? বলিসিনি তার সঙ্গে কথা?’
‘না, সেই কলিং বেলটা ছিল ওদের দুধ-ওয়ালার। ছাগলের দুধ দিতে আসতো সে রোজ সকালবেলা ওদের ফ্ল্যাটে! ’
হায় রে! কী এন্টি-ক্লাইম্যাক্স!!
***
ঢং ঢং করে কাছের কোনো ক্লারেট ক্লকে রাত দশটা ঘোষণা করল। এবার উঠতে হবে আমাদের। অনেকটা পথ ফিরতে হবে যে!
যদিও দীর্ঘ গল্পশেষেও সুগন্ধী-সুন্দরী কান্তা-র রহস্য যেন আমার কাছে অনুন্মোচিতই রয়ে গিয়েছিল। যদিও বিশ্বাস রাখি যে সুধী পাঠকগণ কান্তার সুগন্ধ-প্রহেলিকা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছেন।
অলমিতি!