• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • দুটো চারটে কথা : অচিন্ত্য দাস

    আমি ট্যুর ম্যানেজার তাই বাস থেকে আগে নামলাম। মোট একুশ জন যাত্রী নিয়ে আমাদের কোম্পানীর প্যাকেজ-ট্যুরে এসেছি। আজকের জায়গা মানে ‘দ্রষ্টব্য স্থান’ হলো এই নদীর কিনারা। কতবার এসেছি তবু প্রতিবারই এই নদীতীর আমার বেশ সুন্দর লাগে। নদীর পরিষ্কার টলটলে জল ছোট ছোট ঢেউ তুলে বয়ে যাচ্ছে। এখানকার সরকার নদীর পাড় বরাবর অনেকটা এলাকা জুড়ে বাগানের মতো করে দিয়েছে – হরেক রকমের ফুল গাছ আর মাঝেমাঝে ছায়াচ্ছন্ন বড় বড় বট-অশ্বত্থ-নিম । বসার জন্য এদিকে ওদিকে অনেক কাঠের বেঞ্চি আর তার ওপরে রোদ্দুর আটকাবার জন্য খড়ের বাহারে ছাউনি। গোটা এলাকাটা পরিষ্কার, গালচের মতো ঘাসের জমি। সেখানে প্লাসটিকের ঠোঙা, জলের খালি বোতল ইত্যাদি পড়ে নেই। নদীর ওপারে ছবির মতো পাহাড়ের সারি। সে পাহাড়ের ঢালে ঘন বন, এতদূর থেকে কালচিটে সবুজ মনে হয়। পাহাড়ের ওপর একটা সাদা ফলক দেখা যায় – ওটা আসলে বহু পুরোনো এক মহাকাল মন্দিরের চুড়ো।

    “ভাই, একটু হাতটা ধরো তো …”

    এক বয়স্কা মহিলা বাসের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। যাত্রীদের নামের তালিকা আমাদের কাছে থাকে আর তাছাড়া যেতে যেতে এক-আধটু পরিচয় হয়েই যায়। এনার নাম ব্রততী বসুরায়। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই, স্বামী গত হয়েছেন। শরীর-স্বাস্থ্য মোটামুটি ঠিকই আছে আর যেটুকু ঠিক নেই সেটুকু মনের জোরে পুষিয়ে নেন।

    “হ্যাঁ, মাসীমা। না, না এই দিকের সিঁড়িটায় পা দিন... ব্যাস, এই তো, আপনি নিজেই পারেন…”

    ব্রততী-মাসীমাকে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দিলাম। তারপর উনি বলাতে বাস থেকে জলের বোতল আর টিফিন কৌটোটা এনে দিচ্ছি এমন সময় আরেকটা বাস এসে ঢুকল। আমাদের কোম্পানীরই বাস, তবে এর রুট আলাদা। এই নদীর ধারটা দুটো বাসের যাত্রীদেরই শেষ দ্রষ্টব্যস্থল। দুটো বাসের যাত্রীরা কিছুক্ষণ, মানে ঘণ্টা দুয়েক এক সঙ্গে কাটায়, তারপর দুটো বাস আবার দুদিকে চলে যায়। ঠিক বেলা আড়াইটের সময় আমাকে এখান থেকে বাস নিয়ে রওনা দিয়ে জংশন স্টেশন পৌঁছতে হবে। সাড়ে চারটেতে ট্রেন ছাড়ে। সবাইকে নিয়ে ওঠার ব্যাপার আছে, তাই একটু সময় হাতে রাখতে হয়।

    ও বাস থেকে দেখলাম বাসের ড্রাইভারের হাত ধরে এই বয়স্কা মহিলাটির মতই একজন নামলেন। দুজনের মধ্যে বেশ মিল আছে। আশির কাছাকাছি বয়স, স্বামী নেই, হালকা রঙের শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। এই ধরনের মহিলাদের আমাদের মত ভ্রমণ-সংস্থার সঙ্গে একলাই বেরিয়ে পড়তে অনেক দেখেছি। আসলে বুড়ো বয়সে ছেলে-মেয়ে-পরিবারের সঙ্গ আজকাল কে আর পায়। সঙ্গ দেবেই বা কারা। যা যুগ পড়েছে – কারোরই নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। সকলেই তো ব্যস্ত অথবা অতিব্যস্ত।

    বাস থেকে নেমে মহিলাটি বেঞ্চিতে বসে থাকা ব্রততীমাসীমাকে দেখে একেবারে শিশুর মতো উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। “আরে, তুমি!! তুমি এখানে? তুমি দীপালি না …”

    আমি কাছেই ছিলাম। দেখলাম ব্রততীমাসীমা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন, ঠাহর করতে পারলেন না ইনি কে। আর তাঁর নামও তো দীপালি নয়। বললেন, “না, মানে ঠিক চিনতে পারছি না, আজকাল সব ভুলে ভুলে যাই। আমার নাম ব্রততী।”

    “এই দেখো, আমারও কি মনে থাকে ছাই। যাকগে নামটা ভুল হয়ে গেলেও তোমাকে কিন্তু আমি চিনি।”

    “হ্যাঁ, আমারও মনে হচ্ছে তোমাকে চিনি। তোমার নাম চন্দ্রা না?”

    “না, আমার নাম দীপা, দীপা সান্যাল। বিয়ের আগে ভৌমিক ছিলাম।”

    “তাহলে কোথায় দেখেছি বলতো তোমাকে…”

    “ইস্কুলে হতে পারে। আমি দুর্গাপল্লী বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তাম। তুমি?”

    “আমি সর্বমঙ্গলা গালর্স থেকে পাশ করেছি।”

    “তাহলে তোমাদের ইস্কুল হয়তো কাছাকাছি ছিল, কিংবা তোমরা হয়তো কাছেই থাকতে।”

    ইস্কুল, পাড়া, নাম কিছুই মিলছে না। দুই বুড়ির কাণ্ড দেখে আমার তো হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। আসলে কেউ কাউকে চেনেন না, এখানেই দেখা হয়েছে। বয়সের ভারে স্মরণশক্তি দুর্বল, তাই কেউ ঠাহর করতে পারছেন না চেনা না অচেনা। তবে একটা কথা। দুজনেই বন্ধু পেতে চাইছেন। সেই চাওয়াটা এত বেশি যে চেনা-অচেনাকে পাত্তা না দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি দুজনের মধ্যে ভাব জমে গেল।

    আমার অন্য দিকটায় কিছু হিসেব-নিকেশ আর ব্যবস্থা-পত্র সংক্রান্ত কাজ ছিল। কাজ হয়ে গেলে এদিকটায় এলাম। তখন দুপুর বেলা, খাবার সময়। এখানে রাস্তার ধারে অনেক ছোট-বড় খাবার দোকান আছে। ট্যুরিস্টরা যার যেমন রুচি, যার যেমন বাজেট সেই মতো দোকান খুঁজে খাওয়াদাওয়া করে নেন। আমি আগে দেখেছি ব্রততী-মাসীমা ধরনের একলা বেড়াতে আসা বয়স্কা মহিলারা বাইরে আলগা জায়গায় একদম খেতে চান না। বাড়ি থেকে চিঁড়েমুড়ি যা নিয়ে আসেন তাই খান।

    আমি তবু এসে বললাম, “মাসীমারা খাবেন তো কিছু। এখানে সবই পাবেন। ভাত, রুটি, ধোসা, ইডলি সব।”

    যা ভেবেছিলাম তাই। দেখলাম দোকানে খেতে এঁদের একটুও আগ্রহ নেই। আমার কথা শুনে দুজনে দুজনের টিফিন বাটি খুললেন। আড়চোখে নজরে পড়ল একটাতে মুড়ি আর শুকনো আলুভাজা। আরেক জনের কৌটোতে চিঁড়েভাজার সঙ্গে দুটো গজা। টিফিনবাটির ঢাকনা দুটো কাজে লাগিয়ে ভারি যত্ন করে খাবার ভাগ হলো।

    কানে এল পাতানো সই দুজন পুজোর বাজারের গল্প করছেন। “আমি বাপু আর যাই না, হাতিবাগান বাজারে কী যে ভিড় সে তুমি না দেখলে বুঝবে না…আর কার জন্যই বা কিনব, আজকালকার কী যে সব পছন্দ হয়েছে …”

    “সে আমাদের দিকের গড়িয়াহাটেও তাই। কেউ হাত ধরে নিয়ে না গেলে যাওয়াই যায় না।”

    সামান্য আটপৌরে কথা। তবু টের পেলাম এই কটা বাক্যের ভেতরে কোথা থেকে যেন মনখারাপের একটা বাতাস বয়ে গেল – কেউ যদি একটু বাজারে নিয়ে যেত তাহলে পুজোর মুখে কিছু কিনতে কাটতে দুজনেরই কত যে ভালো লাগত …।

    এই নদীতে নৌকো চলে – ট্যুরিস্টদের নিয়ে ওপারটা দেখিয়ে আনে। টিকিটের দাম বেশি হওয়াতে সকলে যায় না। যারা গিয়েছিল তাদের নিয়ে নৌকোগুলো ফিরে এসেছে। রাস্তার ধারের ধাবাগুলোতে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছে যাত্রীরা। দু-একজন রসিক মানুষ ধাবার বাইরের টেবিলে বসে বিয়ারের গেলাশে চুমুক দিচ্ছে। নদী বয়ে যাওয়ার আলতো ছলছল শব্দের ভেতরেও বোধ হয় নেশা আছে। সে যাই হোক, আমি আমার যা কাজ তাই করতে লাগলাম। আমার বাসের একুশ জন যাত্রীকে নজর করা যাচ্ছে কি না ঘুরে ঘুরে গুণে দেখে নিলাম।

    আড়াইটে বাজতে আর কয়েক মিনিটই বাকি। আড়াইটেতে তো আমাদের বাস ছাড়ার কথা। বাসের যাত্রীরা ট্রেন ধরে ফিরে যাবে যেখান থেকে ভ্রমণ শুরু হয়েছিল সেই স্টেশনে। এবার তো ব্রততীমাসীমাকে ডাকতে হয়। অন্যজনের অবশ্য সময় আছে, ওদের বাস পরে ছাড়বে।

    পা চালিয়ে গেলাম। একটু দূর থেকে দেখলাম দুই মাসীমার আলাপ খুব জমে উঠেছে, কাছাকাছি বসে দুজনে নিবিষ্ট হয়ে কথা বলেই চলেছেন, বলেই চলেছেন। কিন্তু এবার তো যেতে হবে একজনকে…

    তাড়া দিতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু সত্যি বলছি ঠিক ওই মুহূর্তে আমার মনটা যেন কেমন অন্য রকম হয়ে গেল।

    সামনে নদী বয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট ঢেউ তুলে। এ নদী কোথা থেকে এসেছে আর কোথায় যাচ্ছে তা আমি জানি না। যেখান থেকেই আসুক আর যেখানেই যাক, নদী কখনো থামে না। নদীর পাড়ে দুজন বয়স্কা মহিলা – একজনের সময় হয়ে এসেছে। এবার পাতানো সইএর সঙ্গে গল্প-গুজব ছেড়ে রওনা দিতে হবে।

    আমি খুব যে একটা দেব-দেবতা মানি তা নয়, তবু আজ এই প্রথম ওপারের মহাকালের মন্দিরটা তাকিয়ে দেখলাম ভালো করে। মন্দিরের দিকে চেয়ে মনে মনে বললাম:

    জয় মহাকাল তোমার জয় হোক! সামান্য এই ট্যুর ম্যানেজারের অন্তরের প্রণাম নিয়ো। মালিকের কথায় উঠি-বসি আর একটু এদিক-ওদিক হলেই বকাঝকা খাই। এত খেটে মাস গেলে মাত্র ষোল হাজার চারশ বেয়াল্লিশ টাকা হাতে আসে। মানে বলতে চাইছি যে আমার নিজের ক্ষমতা বা টাকা পয়সার জোর বলতে কিছুই নেই। হে মহাকাল, তোমার তো অসীম ক্ষমতা! হাজার-লক্ষ-কোটি বছর নিয়ে কারবার – আমাকে তার থেকে শুধু পনেরোটা মিনিট দেবে? তুমি শুধু একবার গল্পে মজে থাকা পাতানো সই দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখো। বয়সের ভারে স্মৃতি দুর্বল – অতীত বলে তেমন কিছু নেই। যেটুকু আছে তা ধোঁয়াশার আড়ালে আবছা কিছু খাপছাড়া ছবির মতো। আর ভবিষ্যৎ? ভবিষ্যৎ বলে এ অবস্থায় আর কীই বা বাকি থাকতে পারে বলো! আছে শুধু এই ক্ষণ, বেলা পড়ে আসা গোধূলি বেলার এই সময়টুকু। বসে বসে প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মিলিয়ে দুটো চারটে কথা বলা – এইটুকুই তো সব, এইটুকুই তো বেঁচে থাকা।

    হে মহাকাল, আর শুধু পনেরোটা মিনিট দাও, তারপর নয় বাস ছাড়ব। তুমি একটু দেখো ট্রেনটা যেন ফেল না করি। নিজের ক্ষমতা বলতে তো কিছুই নেই, তবু তোমার আশীর্বাদে দুজনকে যদি আর একটু সময় করে দিতে পারি। ছাড়াছাড়ি তো হতেই চলেছে তবু এই অপরাহ্নবেলায় নদীর ধারে দুই যাত্রীবন্ধু পাশাপাশি বসে আর দুটো চারটে কথা বলে নিক না...



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments