• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • টুকটুকি সিং : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

    আমার মা ফোন করে বলছে, তোর বর তো আবার বিয়ে করছে। আমি বললুম, কাকে? মা বললে, এসে দেখে যা। আমি বললুম, দেখতে যাব কেন? দেখার কী আছে। মা বলে, বরের বিয়ে দেখবি না? আমি বলি, না। বলি, কাকে বিয়ে করল? পাশের বাড়ির সেই ঢুপসি মেয়েটাকে? ওর সঙ্গে তো কত আশনাই! মা বলে, না। দেখাশোনা করে বিয়ে। আমি বলি, ওর বিয়ে তাও আবার দেখাশোনা করে? মা বলে, হ্যাঁ, তাই তো শুনি। আমি বলি, মেয়েটা কে? মা বলে, শুনেছি বর-পালানো মেয়ে। আমি হেসে বলি, তবে ওর এই বরটাও পালাবে। মা বলে, তোর বরের খবর কী? আমি বলি, কী আবার, তিনদিন কাজ করবে বাকি তিনদিন মদ খাবে। মা বলে, ওই জন্যে আগের বউ পালিয়েছে। আমি বলি, তাতে কী? তেমন হলে আমিও পালাব। মা বলে, তুই আর কতবার বিয়ে করবি? আমি বলি, মন যতবার চাইবে।

    আমার বিয়ের খবর পেয়ে আমার আগের পক্ষের বর ফোন করেছিল। আমি ফোন ধরিনি। আমার নতুন বর রেগে গেছিল। বাড়িতে সবাই আছে তখন ফোন করেছে। তার ফোন এসেছে শুনে আমার এ-পক্ষের বর রেগে গেছিল। আমার নতুন শাশুড়ি বলে, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? ও কি তার ফোন ধরেছিল? ধরেনি। ও কি তার সঙ্গে কথা বলেছে? বলেনি। আর ও-তো কিছু লুকায়নি। সোজা এসে বলে দিয়েছে। তারপরে এক সময়ে আমি পুরানো বরকে ফোন করি। বলি, ফোন করেছিলে কেন? ওদিক থেকে সে বলে, তোকে দেখতে ইচ্ছে যাচ্ছিল।

    আমি বলি, তাই বলে রাতে ফোন করবে? আগের বর বলে, স্বামী-স্ত্রীর কাছে দিন-রাত আবার আলাদা হয় নাকি? পুরোটাই তো একটি দিন।

    তুমি আর ফোন করবে না।

    তোকে দেখতে ইচ্ছে গেলেও নয়?

    না।

    কেন?

    জানো না, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

    সে তো জানি।

    তাহলে আর বিরক্ত কোরো না। আমার সংসারে আগুন লাগিয়ো না।

    আমার নতুন স্বামীকে কোনো কথা বলা যাবে না। সব গিয়ে ওর মা-বাবাকে বলে দেবে। এজন্যে আমার শাশুড়ি আমাকে বলে দিয়েছে, ওকে সব বলবে কেন? কেন ওকে সব দরকারি কথা বলো? ও পেটে কোনো কথা রাখতে পারে না। তোমার নিজের কথা নিজের মধ্যেই চেপে রাখতে হবে। সে একটু নেশা করে। মদ খায়। এক মাতালকে ছেড়ে তুমি অন্য এক মাতালকে পেলে। মদ ছাড়ানোর ওষুধ নিয়ে আসো। মদ খাওয়া আমি সহ্য করতে পারি না!

    একটা বউ, সে ঘটকগিরি করে, সে-ই এই সম্বন্ধটা দেখে দিয়েছে। একদিন অটো করে আসছি, তার সাথে দেখা। সে-ও কোথা থেকে ফিরছে। সে নিজে আমাকে বললে, তোমার বরের সঙ্গে তো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? আমি বললুম, হ্যাঁ। মাতালের সঙ্গে কে থাকবে? সে তখন বলে, তুমি কি আবার বিয়ে করবে? আমি চুপ করে থাকি। সে বলে, যদি করো, আমাকে জানিয়ো। একটা ছেলে আছে। যদি পছন্দ হয় বিয়ে হয়ে যাবে তোমার। আমি একটু ভেবে বলি, বিয়ে করতে আমার অসুবিধা নেই। যদি আমার মেয়েকে সে মেনে নেয়।

    আমার মেয়ের বিয়ে দিয়েছি খানাকুলে। জামাই চাষি। ছেলেটা ভালো। জামাইয়ের কোনো নেশা নেই। তাদের মাটির বাড়ি। মাটিরই ঘরদোর। মেয়েরবাড়ি গিয়েছিলাম কদিন আগে। মেয়েও আমাকে বলে, মা, তুমি বিয়ে করে নাও। একা-একা কী করে থাকবে?

    ঘটকবউ একদিন ফোন করল। আমি তখন কাজে। রবিবার ছাড়া ছুটি নেই। তেমনিই একটা রবিবার দেখে দেখাশোনা হল। আমিই দেখা দিতে গেলুম ওদের বাড়ি। এক দেখাতেই আমাকে পছন্দ হয়ে গেল। ছেলের মায়ের সামনে রঙিন, সোন্দর কাপড় পরে বসেছি। কাপড়টা মেয়ে দিয়েছিল। ছেলের মা জিজ্ঞাসা করল, কে কে আছে বাড়িতে। বললুম। ঘটকবউ হাত-পা নেড়ে বলল, খুব ভালো মেয়ে। একাই থাকে। আয়ার কাজ করে। একটা বুড়িকে দেখাশোনা করে উত্তরপাড়ায়। মাসে তিন হাজার টাকা পায়। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে; একেবারে ঝাড়া-হাত-পা। স্বামী নেই, ছেড়ে দিয়েছে। এখন আর কোনো যোগাযোগও নেই। এমন বউমা আর কোথাও পাবে না।

    বিয়েতে বরকে জিন্স আর শার্ট দিলাম। শাশুড়িকে একটা ভালো কাপড়। ওরা আমাকে এক কাপড়েই নেবে বলেছিল। শাশুড়ি এত ভালো মানুষ, আমাকে বলে, ঘরে ভালো কাপড় না থাকলে আমার কাছেই এসে পরে নেবে। কিন্তু আমাকে তা করতে হয়নি। আমি নিজের জন্যি একটা কাপড় কিনে নিছিলাম। আমার ননদ একটা। তাকেও দিয়েছি। আমার শাশুড়ি খুব ভালো। বলে, ওকে আমরা কী দিয়েছি? ও-ই আমাদের সকলকে দিয়েছে।

    আমার নতুন বর যা কামায় তাতে সবই মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়। বিয়ের পরে ওর নেশার বহর আরও বেড়ে গেল। আমার মা বলল, এক মাতালের খপ্পর থেকে বেরিয়ে তুই আবার এক মাতালের হাতে গিয়ে পড়লি! বিয়েটা করলি, কিন্তু বড্ড তাড়াহুড়ো হয়ে গেল। একটু খোঁজ নিলি না? এসব বলে তবুও মা বলে, মিলেমিশে থাকবি, যা হবার হয়ে গেছে। অশান্তি করবি না।

    আমার মেয়ে আমার বিয়েতে আসেনি। পরে জামাইকে নিয়ে এসে আমার নতুন সংসার দেখে গেছে। বলেছে, মা ভালো করেছ বিয়ে করে নিয়েছ। তুমি বিয়ে না করলে আমিই ছেলে দেখে দিতাম। আমার আগের বর আমার গায়ের মধ্যে কেরোসিন তেল ঢেলে দিয়েছিল। তখন ভাড়াতে ছিলাম। সে এক দিন গেছে। মিস্ত্রি লাগাতে হবে। ঘর খালি করতে হবে। তখন একটি বাচ্চার দেখাশোনা করতাম। বিকেলে কেরোসিন দিয়েছে, অই অবস্থায় তিন ঘন্টা বসে আছি। গায়ে তেল বসে বিষ হয়ে গেছে। চামড়া পুড়ে কালো হয়ে গেছে। চম্পা রোডে চামসির ডাক্তার দেখিয়েছি। ভাইকে ডেকেছি। ভাই এসে বলেছে, পুলিশ কেস করবে। আগুনে পোড়ানোর কেস। বাড়িওলা দেশলাইটা হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল বলে আগুনটা গায়ে লাগাতে পারেনি। ভাইয়ের কথায় ওর পোঁদে ভয় ঢুকে গেছে। আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছে।

    তখন ঘরভাড়া ছিল ১৬০০ টাকা আর সঙ্গে ইলেকট্রিক বিল, মাসে ৫০০ টাকা। বরের ঘর থেকে এসে বাপের ভিটেতে থাকছিলাম। ভাই মুদিখানা চালায়। আমায় বলছে, এ বাড়িতে থাকতে হলে মাসে ১৫০০ টাকা করে দিতে হবে। এদিকে বাড়িতে থাকলে ছুটির দিনে আমি ভাইয়ের দোকান গুছিয়ে দিই, নানা কাজ করে দিই। তাও এমনি দাবি তার। ও আমার বড় ভাই। ওর বউ তখন প্রেগনেন্ট। এক মেয়ে আছে। ছোট ভাইয়ের বাচ্চা হয়নি। বিয়ে হয়েছে সাত বছর।

    আমি বাঙালি। আমার আগের বর বিহারী। কাজ সেরে একদিন বাড়ি ফিরে দেখি, জামাকাপড় সব ভিজে গেছে। শুকুতে দেওয়া ছিল, তোলেনি। বলি, বৃষ্টিতে সব ভিজে গেল আর তুমি জামাকাপড়গুলো তুলতে পারলে না?

    সে বলে, আমি বাড়িতে ছিলাম না।

    বললাম, গেসলে কোথা?

    সে বলে, শ্যাওড়াফুলি।

    আবার শ্যাওড়াফুলি কেন?

    সে বলে, কেন? যেতে পারি না? কত সবাই যায়।

    ছিঃ, নোংরা জায়গা! কত রকম রোগ হয় ওখানে গেলে।

    কিচ্ছু হয় না। বলে সে খ্যা-খ্যা করে হাসতে থাকে।

    তখন ছিল অমন। হপ্তায় একদিন করে শ্যাওড়াফুলি যাবেই। একবার এমন হয়েছে, কাজ সেরে ফিরছি, রাত হয়ে গেছে, ইস্টিশনে নেমে টোটো পাই না। ব্যাগ থেকে ফোন বার করে বরকে ফোন করি। বলি, এসো। ফিরব কী করে? টোটো নেই। সে বলে, দাঁড়া। যাচ্ছি। দাঁড়িয়েই আছি, সে আর আসে না। অনেক পরে সে সাইকেলে নিয়ে এসে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বললাম, এত দেরি করলে? বাড়ি ফিরব কখন, রান্নাই বা চাপাব কখন? শুনে বর হেসে ফেললে। কিন্তু উত্তর করলে না। আমাকে রডে বসিয়ে নিল। ফিরছি। রাস্তা ছাড়িয়ে জ্যাঙ্গালের উপরে সাইকেল উঠে পড়ল। চারিদিক ধু-ধু করছে। কুয়াশা জমে আছে। এখানে এসে সে খিলখিল করে হাসল। বলল, আন্দাজ কর দেখি গেসলুম কোথা। আমি বলি, কোথা? সে আবার বলে, আন্দাজ কর। আমি বলি, শ্যাওড়াফুলি? সে অমনি খ্যা-খ্যা করে হাসে। বলে, হ্যাঁ। আমি বিরক্ত হয়ে বলি, বার বার সেখানে যাও কেন? কী আছে সেখানে? সে অমনি আরো জোরে জোরে হাসতে থাকে। বলে, তুই একটা মেয়েমানুষ হয়ে কী বুঝবি কী আছে সেখানে। আর এখন, বিয়ের পরে ফোন করে বলছে, একদিন দেখা করো। বলি, কেন? না, তোকে অনেকদিন দেখিনি।

    আগের বর লরি চালাত। আর নতুন বর জুটমিলে কাজ করে। কোনোদিন কাজ পায়, কোনোদিন পায় না। কোনোদিন যায় কোনোদিন যায় না। খুব কুঁড়ে। একদিন আমার সঙ্গে এমন ঝগড়া হল যে, ঘর থেকে চাল, ডাল, তেল, নুন যা ছিল সব বাইরে নিয়ে গিয়ে হাফ দামে বিক্রি করে মদ খেয়ে চলে এল। আমার পোড়া কপাল।

    সেদিন পুরানো শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পুরানো বরের বউকে দেখে এসেছি। বেশ দেখতে। গায়ে মাংস আছে। শাঁসে-জলে চেহেরা। আমার মা যদিও বললে, মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে; তবুও আমার মনে হয় মেয়েটা হয়ত শ্যাওড়াফুলির। সেখান থেকেই ওকে তুলে এনেছে। তাই আজকাল আর সে রোজ রোজ ওখানে যায় না।

    আমার জামাই কাঠের কাজ করে। বিয়েতে ১০ হাজার টাকা ক্যাশ দিয়েছি। জামাই ভালো। মেয়ে আমার ভালো আছে। আমার মত কষ্ট কারো নেই। আমার মেয়ে সুখী থাক। সুখে সংসার করুক। ও ভালো থাক। আমি তাহলে ভালো থাকব।

    আমার নতুন বর কাজটা ছেড়ে দিয়েছে। মানে আর যায় না। তাই ওকে আর ডাকে না। ও স্থায়ী শ্রমিক ছিল না। ঠিকা কাজ করত। তবুও মাসের মধ্যে দশ দিন কাজ পেত। এখন ছেড়ে দিয়ে একদম বাড়িতে বসে। সংসার চলে না। ওর শরীরও চলে না। আমার আগের বর আর যাই হোক, তার শরীরখানা সচল ছিল। আর এ অচল। তার পরে নতুন বরের মাথায় একটু গোলযোগ দেখা দিয়েছে। ফলে শাশুড়ির সঙ্গে যুক্তি-বিবেচনা করে ওকে ওয়ালশ হাসপাতালের আউটডোরে মাথার ডাক্তার দেখাতে যাই। আমিই নিয়ে যাই। কোনোদিন আমার শাশুড়ি সঙ্গে থাকে, কোনোদিন থাকে না। কোনোদিন ফ্রি ওষুধ পাই, কোনোদিন পাই না। আমার শাশুড়ি বলে, বৌমা, তোমার মতন মেয়ে হয় না। তুমি আছ বলেই আমাদের দুমুঠো অন্ন জুটছে। নইলে ভিক্ষে করে খেতে হত।

    আমি আবার আয়ার কাজ নিয়েছি। তবে এই আয়ার কাজ আগের মতন নয়। কোনো বুড়িকে দেখাশোনা করা নয়। এই ‘আয়ার কাজ’ আমি শ্যাওড়াফুলিতে করি। বাড়ির লোক জানে আমি উত্তরপাড়ায় কাজে যাই।

    পেটের জন্যে মিথ্যে বলায় পাপ নেই।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments