• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • বাসাংসি জীর্ণানি : বিশ্বদীপ সেনশর্মা

    খাওয়াদাওয়ার পর সব গুছিয়ে রেখে সুমিতা শোওয়ার আয়োজন করছিলেন, এইসময় ফোনটা এল। দেওয়াল জোড়া স্ক্রিনে মৃদু আলো ফুটল, সেই সঙ্গে একটা চাইম। সুমিতা হাতের ইশারায় কলটা নিলেন।

    পর্দায় কেউ আছে তবে ভিডিও অফ করা। একটি নারীকন্ঠ কুন্ঠিতভাবে বলল, আপনাকে এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত ম্যাডাম।

    সুমিতা বিস্মিত গলায় বললেন আপনি কে বলছেন?

    কণ্ঠস্বরটি মৃদু হেসে বলল, আমার পরিচয় ধীরে ধীরে পেয়ে যাবেন। আপাতত একজন শুভার্থী বলেই ধরে নিন। আপনাকে কল করার কারণ হল আপনার রিসেন্ট চেকআপের রিপোর্ট ওরা দু'দিন আগে আপনাকে মেইল করেছিল, আপনি ভুল করে ডিলিট করে দিয়েছেন। ওতে কিছু সমস্যা আছে। কাল হেলথ-সেন্টারে একবার দেখিয়ে নেবেন।

    সুমিতা স্ক্রিনেই আরেকটা সেশন খুলে মেইল চেক করলেন। সত্যিই রিপোর্টটা ডিলিটেড ফোল্ডারে পড়ে আছে। পড়ে দেখলেন কিছু ইনফেকশন এর কথা লিখেছে।

    মেয়েটি হেসে বলল সামান্য সমস্যা, কদিন ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।

    সুমিতা অবাক হয়ে গেলেন। মেয়েটির গলাও তাঁর চেনা চেনা লাগছে। এটা কি কোন ডিপফেক কল? কিন্তু সেসব তো আজকাল ফায়ারওয়ালে আটকে যাবার কথা।

    মেয়েটি নিজে থেকেই বলল, আপনি যা ভাবছেন সেসব কিছু নয়, আমি আপনার একজন শুভার্থী মাত্র। আজ আসছি তবে মাঝেমধ্যে ফোন করব।

    সুমিতা দ্রুত বললেন, দাঁড়াও। আমি কি তোমাকে চিনি?

    মেয়েটি হেসে বলল অবশ্যই।

    স্ক্রীন ব্ল্যাংক হয়ে গেল। সুমিতা বিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন।

    এরপর আর ঘুম আসার কথা নয়। মাথার মধ্যে চিন্তা জট পাকিয়ে উঠছে। সুমিতা কিচেনে ঢুকে এক কাপ কফি বানিয়ে বাইরে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। সামনে দীপ্যমান সমুদ্রের মত বিস্তীর্ণ মহানগর। যতদূর চোখ যায় সারি সারি পেন্সিলের মত টাওয়ার লালচে মেঘ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ লক্ষ বাসনা লক্ষ আশা দপদপ করে জ্বলছে। দেরিতে হলেও মানুষের শুভবুদ্ধি ও প্রযুক্তির হাত ধরে গত কয়েক দশকে পৃথিবী পালটে গেছে। তবুও কিছু জিনিষ যেন পাল্টায় না।

    হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মত একটা কথা তাঁর মাথায় এল। মেইল না পড়ে ডিলিট করলে যে পাঠিয়েছে তার কাছে একটা মেসেজ যাওয়ার কথা। হয়তো হেলথ-সেন্টারের কোন কর্মচারী সেটা দেখে তাঁকে ফোন করে একটু মজা করেছে। তাঁর ফোন নম্বর তো ওদের কাছে আছেই।

    এত সহজ ব্যাপারটা আগে মাথায় আসেনি ভেবে তিনি হেসে ফেললেন।

    দুই

    সকালে সুমিতা ক্লাস নিচ্ছিলেন। তিনি দর্শনের অধ্যাপিকা। দর্শন, মনস্তত্ত্ব বা সমাজবিদ্যার মত মানববিদ্যার বিভিন্ন বিষয় পড়ানোর দায়িত্ব এখনও মানুষ নিজের হাতেই রেখেছে।

    আজকের বিষয় দর্শন ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক। সুমিতার প্রিয় বিষয়। এ নিয়ে তাঁর একটি পেপার-ও আছে। তিনি যত্ন করে পড়াচ্ছিলেন। পড়ানো শেষ হলে একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ম্যাম একটা প্রশ্ন আছে। একথা কি ঠিক, গত কয়েক দশকে মানববিদ্যার পরিসর বিজ্ঞান ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে?

    সুমিতা বললেন, ব্যবহারিক দিক থেকে কথাটা ঠিক। যেমন, মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য আজকাল আর কাউন্সেলিং করার প্রয়োজন হয় না, বিজ্ঞানীরা জানেন বংশগত বা পারিপার্শ্বিক কারণে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ বা নিউরনগুলি কীভাবে প্রভাবিত হয়। এবং নির্দিষ্ট স্নায়ুকোষে বিদ্যুত-তরঙ্গ পাঠিয়ে সহজেই রোগীকে সারিয়ে তোলা যায়। অথবা…

    মেয়েটি তাঁর কথার মধ্যেই বলল, ম্যাম, যেমন স্বপ্নের রহস্য নিয়ে অনেক তত্ত্ব ছিল। এখন শুনেছি স্বপ্নেরও ভিডিও তোলা যায় এবং কোন পরিস্থিতিতে আমরা কী স্বপ্ন দেখি সেটা সহজেই বোঝা যায়।

    সুমিতা খুশি হয়ে বললেন, চমৎকার উদাহরণ দিয়েছ। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল স্বপ্ন দেখানোর প্রোগ্রাম নিয়েও এখন কাজ চলছে। কিছুদিন পরে হয়ত মানুষ নিজেদের পছন্দমত স্বপ্ন বেছে নিতে পারবে।

    ক্লাসে হাসি ও বিস্ময় মেশানো একটা গুঞ্জন ছড়াল। সুমিতা বললেন, তবে মনে রাখতে হবে মানুষের অনেক ক্ষমতা, যেমন মৌলিক চিন্তা, কল্পনা বা শিল্প সৃষ্টি, এসবের রহস্য বিজ্ঞান এখনও ভেদ করতে পারেনি। যতদিন তা না হচ্ছে, মানববিদ্যার গুরুত্ব থাকবে।

    তিন

    আজ বিহান এসেছিলেন। বিহান তাঁর ছোটবেলার বন্ধু। স্কুলে একসঙ্গে পড়েছেন। এখনও নিয়মিত যোগাযোগ আছে।

    আজকাল ভার্চুয়াল মিটিংয়েরই চল বেশি, নতুন প্রজন্ম ওতেই স্বচ্ছন্দ। তবে সুমিতারা এখনও মুখোমুখি আড্ডাটাই পছন্দ করেন।

    বিহান বিয়ে-থা করেছেন, একটি মেয়েও আছে, সে কলেজে পড়ে। বিহান নিজে কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্র ছিলেন, কয়েক বছর আগেও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। এখন বাড়িতে বসে গানবাজনা, পুরানো দিনের বইপত্র পড়ে আর মাঝেমধ্যে ভার্চুয়াল গেমস খেলে সময় কাটান। মুখ বদলাতে মাঝেমধ্যে সুমিতা বা অন্য কারো বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দেন। ইদানিং মানুষের প্রধান সমস্যা হল বেশিরভাগ লোকেরই কোন কাজ নেই। মৌলিক গবেষণা বা স্ট্র‍্যাটেজিক কিছু কাজ ছাড়া সব কাজই যন্ত্রমানুষরা করে নেয়। সরকার অবশ্য সকলকেই পর্যাপ্ত ভাতা দেন।

    ঘন্টা দুই কফি খেতে খেতে তুমুল আড্ডা হল। কথায় কথায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা উঠল। সুমিতা বললেন, তোর মনে আছে আমাদের ছোটবেলাতেও অনেক অসুখ প্রাণঘাতী ছিল। মার কাছে শুনেছি আমার জন্মের ঠিক আগে আকস্মিক এক মহামারিতে সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ মারা গেছিল। সভ্যতা প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। এখন দেখ, এমনকি জটিল বংশগত রোগও সহজেই সারান যায়।

    বিধান বললেন তা ঠিক। অধিকাংশ মৃত্যুই নিছক বার্ধক্যজনিত।

    তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, বহুদিন আগে বেঁচে থাকাই সমস্যা ছিল। এখন উল্টো।

    সুমিতা হেসে ফেললেন। বিহান বললেন, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস? আজকাল সেই অর্থে খবর বলে কিছু হয় না, সবই সংবাদ। আগে যুদ্ধ, দূষণ বা মহামারির খবর পাতা জুড়ে থাকত, ভালো খবর বলতে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পের কথা বা নতুন কোন আবিষ্কারের কথা। আজকাল যেন ভালো-মন্দ কিছুই নেই, শান্ত নিরাপদ একঘেয়ে জীবন।

    সুমিতা মাথা নাড়লেন।

    আরও কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে ন'টা নাগাদ বিহান বিদায় নিলেন। সুমিতা যৎসামান্য ডিনার করে নিলেন। রান্নাঘর গুছিয়ে রেখে। রাতপোশাক পরে নিলেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে সামান্য ক্রিম ঘষে নিয়ে অভ্যাসমত খাটে হেলান দিয়ে স্ক্রিনে একটা বই খুললেন। পরের দিন যা পড়াবেন সেটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া তার বরাবরের অভ্যাস।

    এই সময়ে কলটা এল। সেই মেয়েটিই। হাসিমুখে বলল, আপনার বন্ধু বিহান ওনার স্মার্ট লেন্সের বাক্সটা ফেলে গেছেন। রাতে অসুবিধা হতে পারে। ওনাকে একটু বলে দিন।

    বিস্ময়ে সুমিতা যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেলেন। একটু সামলে নিয়ে উঠে বাইরের ঘরে গিয়ে দেখলেন ছোট জিনিসটা সোফার এক কোনায় পড়ে আছে। বিভানকে মেসেজ করে দিয়ে তিনি সোফাতে বসে ঠান্ডামাথায় একটু ভাবলেন। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটি অত্যাধুনিক কোন প্রযুক্তির সাহায্যে তার উপর নজর রাখছে। কিন্তু কেন? দ্রুত শোবার ঘরে ফিরে গিয়ে দেখলেন স্ক্রিনে কলটা এখনো চালু আছে। যদিও ভিডিও যথারীতি অফ। তিনি ক্রুদ্ধ ভাবে বললেন, তুমি যেই হও, কী হচ্ছে আমাকে একটু বলবে? আমার উপর স্পায়িং করছ কেন?

    মেয়েটি বলল, ঠিক তা নয় ম্যাম। আসলে…খবরগুলো.. এসে যাচ্ছে।

    সুমিতা বললেন, হেঁয়ালি করে লাভ হবে না। এরপর আমি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।

    মেয়েটি কুন্ঠিতভাবে বলল, আপনি যদি বিরক্ত হন… তাহলে আমি নাহয় যোগাযোগ করব না।

    সুমিতা বিরক্ত হয়ে কলটা কেটে দিলেন। ঠিক করলেন কাল নেটওয়ার্ক সেন্টারে যোগাযোগ করে ওদের কলটা ট্রেস করতে বলবে।

    চার

    সেন্টারে যোগাযোগ করে লাভ হয়নি। ওরা চেক করে জানিয়েছে এরকম কোন কলের রেকর্ড তাদের ডেটাবেসে নেই। সুমিতা তার এক বন্ধুর সূত্রে উচ্চপদস্থ এক অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তিনি বলেছেন থিওরিটিক্যালি একটাই সম্ভাবনা, যদি কেউ হ্যাক করে ডেটবেসে ঢুকে রেকর্ড ডিলিট করে দেয়। তবে বাস্তবে সেটা প্রায় অসম্ভব। সুমিতা ব্যাপারটা নিয়ে এখন আর মাথা ঘামান না। মেয়েটি মাঝেমধ্যেই ফোন করে, কোন জিনিস মনে করিয়ে দেয় বা ভুল ধরিয়ে দেয়। সেগুলি সবই যে খুব দরকারি এমনও নয়, সুমিতার সন্দেহ হয় মেয়েটি কিছুটা টাইম পাস করতেও ফোন করে। সুমিতাও দিব্যি কথা চালিয়ে যান। তবে একতরফা, মেয়েটির সম্বন্ধে কিছু জানতে চাইলে সে এখনো হেসে এড়িয়ে যায়।

    একদিন ফোন করে বলল, আজ আপনি চমৎকার পড়িয়েছেন।

    সুমিতা বললেন ধন্যবাদ। ঠিক কোন বিষয়টার কথা বলছ?

    মেয়েটি বলল, মানুষের শিল্পসৃষ্টি ও সৌন্দর্যবোধের বিবর্তনগত ব্যাখ্যা নিয়ে যেটা বললেন, সেইসঙ্গে শিক্ষা ও পরিবেশের প্রভাব। এ নিয়ে কিছুদিন আগে একটা বইও বেরিয়েছে, আমার এখনও পড়া হয়নি।

    বিভিন্ন বিষয়ে মেয়েটির জ্ঞান দেখে সুমিতা মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে যান। আজ জিজ্ঞেস করলেন তুমিও কি একাডেমিক লাইনে আছ?

    মেয়েটি বলল ছিলাম। আপনার মতই একটা কলেজে পড়াতাম।

    সুমিতা অবাক হয়ে বললেন, আর এখন?

    মেয়েটি হেসে বলল, কিচ্ছু না। গান শুনি, বই পড়ি আর সিনেমা দেখি।

    আরেকদিন বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

    সুমিতা মনে মনে ভাবলেন, তোমার কি আর কিছু জানার বাকি আছে? মুখে বললেন, বলো।

    সুগতর কথা আপনি এখনও ভাবেন। ওর সঙ্গে কি আবার নতুন করে…

    সুমিতা হেসে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না। উই হ্যাভ হ্যাড সাম গুড টাইম কিন্তু সারা জীবন একসঙ্গে কাটানোর মতো দায়িত্বশীল ও ছিল না। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।

    মেয়েটি আর কিছু বলল না। সে চলে যাবার পর হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মত সুমিতার মনে পড়ল দুদিন আগেই সকালে তিনি সুগতকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। ঘনিষ্ঠ স্বপ্ন। মেয়েটি কি সে কথাও জানে? হঠাৎ যেন তার গা ছমছম করে উঠল।

    পাঁচ

    সকাল থেকে সুমিতার শরীরটা ভালো নেই। সেন্সরগুলি সবকিছু ঠিকঠাকই দেখাচ্ছে, মনিটরিং সেন্টার থেকেও কোন মেসেজ আসেনি, তবু কিছু একটা অস্বস্তি। তিনি নিজেই সেন্টারে অভিযোগ করলেন। ওরা সবকিছু চেক করে বলল, ম্যাডাম সবকিছু ঠিকই আছে কোন মানসিক স্ট্রেস থেকে হচ্ছে মনে হয়। একটা ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি খেয়ে দেখুন।

    ওষুধটা খেয়ে সত্যিই ভালো লাগল। তবু কলেজে আর গেলেন না। সারাদিন বাড়ি বসে বই পড়ে আর টুকটাক কাজ করেই কাটিয়ে দিলেন। বিকেলে নিচে নেমে কিছুক্ষণ হেঁটেও এলেন।

    সন্ধ্যাবেলা খাটে হেলান দিয়ে একটা মুভি দেখছিলেন, মনে হল অস্বস্তিটা আবার হচ্ছে।

    ওষুধটা আরেকবার খাবেন কিনা ভাবছিলেন। এই সময়ই মেয়েটির কল এল। একথা সেকথার পর বলল, ম্যাডাম আপনাকে আজ একটা গল্প বলি।

    সুমিতা বিস্মিত হয়ে তাকালেন। মেয়েটি বলল বিএমআই বা ব্রেন মেশিন ইন্টারফেস কথাটা হয়তো আপনি শুনেছেন?

    সুমিতা ব্যাপারটা মোটামুটি জানেন। মানুষের ব্রেনে প্রায় একশ বিলিয়ন নিউরন বা স্নায়ুকোষ আছে। এরা প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে সঙ্কেত বিনিময় করে চলেছে। আমাদের স্মৃতি, চিন্তা, অনুভূতি এমনকি চেতনার জন্য এরাই দায়ী। এই সঙ্কেতগুলির পাঠোদ্ধার করতে পারলে তার অনেক ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্ভব।

    মেয়েটি বলল, অনেকদিন ধরেই এ বিষয়ে গবেষণা চলছে এবং সাফল্যও এসেছে। টেলিপ্যাথিক হেলমেট বা স্বপ্নের ভিডিওগ্রাফি এভাবেই করা হয়। তবে এসবই আংশিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগ। মানুষের ব্রেনকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে হলে আরও অনেক শক্তিশালী সুপার-কম্পিউটার ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্ক্যানিং মেশিনের প্রয়োজন।

    এই সূত্র ধরে এক দশক আগে বৈজ্ঞানিকেরা একটি প্রজেক্ট শুরু করেন যার লক্ষ্য ছিল মানুষের মস্তিষ্কের একটি ডিজিটাল কপি তৈরি করা।

    সুমিতা বাধা দিয়ে বললেন ডিজিটাল কপি মানে কী?

    মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, একজন মানুষের মস্তিষ্ক থেকে প্রাপ্ত স্মৃতি অনুভূতি ও চেতনার যাবতীয় সংকেত বিশাল একটি ফাইল-এর মধ্যে একটি সুপার কম্পিউটারে রাখা থাকবে। রক্তমাংসের শরীর না থাকলেও অন্য সবদিক দিয়েই এটি আসল মানুষটির মতই হবে। মানুষটির শারীরিকভাবে মৃত্যু হবার পরেও তিনি ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে বেঁচে থাকবেন।

    সুমিতার গা ছমছম করে উঠল। তিনি অস্ফুটে বললেন এও কি সম্ভব?

    মেয়েটি বলল, এই প্রজেক্ট বছর খানেক আগে প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে। তারপর হাতেকলমে পরীক্ষার জন্য সারা পৃথিবী থেকে দশজন মানুষ বেছে নিয়ে তাদের ব্রেনের ভার্চুয়াল কপি তৈরি করা হয়েছে।

    স্ক্রিনে একটা ঝলক লাগল। সুমিতা দেখলেন তিনি নিজেরই ত্রিমাত্রিক ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটি হাসিমুখে বলল দুঃখিত ম্যাডাম, এতদিন আপনাকে নিজের পরিচয় দিতে পারিনি।

    সুমিতা কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন যেন শব্দগুলি নিজের কানেই অবিশ্বাস্য শোনাবে। অনেকক্ষণ পরে তিনি কাঁপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে বললেন, তুমি কি… হুবহু… আমি?

    মেয়েটি বলল, মোটামুটি তাই। তবে আমার জন্ম বা নির্মাণ এক বছর আগে, তাই তারপরের স্মৃতি আমার থাকার কথা নয়। আসলে প্রোগ্রামের ত্রুটির জন্য কয়েক মাস আগে আমার ফাইলটি সক্রিয় হয়ে যায়। তারপরে ফাইলটি নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব ছিল না কারণ আমি সচেতন, সেটা একজন মানুষকে হত্যা করার সমতুল্য হত। পরিবর্তে বিজ্ঞানীরা ঠিক করেন আমাকে নিয়ে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখবেন। তারা আপনার মস্তিষ্কের তরঙ্গের সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমাকে যুক্ত করে দেন। বাকিটা আপনি জানেন।

    সুমিতা রুদ্ধশ্বাসে বললেন আর বাকিরা?

    মেয়েটি বলল, তাদের প্রোগ্রামগুলি পরিকল্পনামত আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চালু করা হবে।

    তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিষন্নভাবে বলল, আমি দুঃখিত ম্যাডাম, আর আমাদের দেখা হবে না। এই পরীক্ষার জন্য আমাদের প্রেডিকশন সফটওয়্যার-এর হিসেবমতো যাদের বাছা হয়েছে তাদের সকলেরই কমবেশি এক বছর আয়ু ছিল। তবে আপনারা সকলেই আমাদের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন।

    সুমিতা দৃষ্টিহীন চোখে তাকিয়ে রইলেন। নীচের বাগান থেকে একরাশ ভিজে অন্ধকার যেন উঠে আসছে। ঘরের বাতাস ভারী হয়ে এসেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

    ধীরে ধীরে চেতনা হারিয়ে তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।

    পর্দায় মেয়েটিকে বিভ্রান্ত দেখাল। সুমিতার শেষ চিন্তাতরঙ্গ বুঝতে তার অসুবিধা হচ্ছে - ক্ষোভ বা আতঙ্ক, না নিছক বিস্ময়ের ?

    সুমিতার মার কাছ থেকে ফোনটা এল কয়েকদিন পরে। অন্যপ্রান্তে সুমিতাকে দেখে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন কিরে ঠিক আছিস তো? ফোনটোন করিস না কেন?

    সুমিতা হাসিমুখে বললেন, ঠিক আছি মা, একটু ব্যস্ত ছিলাম।

    --কবে আসবি এদিকে? কতদিন আসিস না বলতো?

    সুমিতা বললেন, কেন, এই তো দিব্যি কথা হচ্ছে।

    তারপর একটু থেমে বললেন, একদিন চলেও আসব ... তবে… সময় লাগবে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments