• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • অথ মার্জার-মার্জারী কথা : দেবাশিস দাস

    অফিসে ঢুকেই টের পেলাম আজকের আবহাওয়া বেশ থমথমে। ঝানুদা পাশের টেবিল থেকে বললেন আজ বস এসেই ফাইফরমাশ খাটার ছেলে হরিকে খুব ঝেড়েছে। বসের মন নাকি একদম বশে নেই। মনে মনে ভাবলাম কবেই বা ওনার মন বশে থাকে। আর ‘হরি হরি’ করতে করতে হরিকে দুবেলা ঝাড়াও নতুন কিছু নয়। এতে হরিনামও হয় আবার ঝাড়াও হয়। কাজেই বসের বশে থাকা না থাকা মন নিয়ে আমার কীসের চিন্তা?

    কাজকর্ম শুরু করার জন্য আমার দোকান খুললাম। এখানে অফিসে নিজের টেবিলে বসে দিনের কাজ শুরু করাটাকে অনেকেই ‘দোকান খোলা’ বলে। অনেকে তো অফিসে এসে প্রথমেই পুজো করে, ধূপ জ্বালায়, মন্ত্র পড়ে, তার পরে দোকান খোলে। সকাল সকাল একটা ভক্তিভাব ছড়িয়ে পড়ে সারা অফিসে। গতকালের কিছু বাকি ফাইলের কাজ সারতে সারতে হরির চা এসে গেল টেবিলে। ঝানুদা নিজের চা নিয়ে আমার সামনে এসে বসলেন।

    ‘জানিস কেন টেকোটা এত চিন্তার মধ্যে আছে?’

    ‘টেকোর মানে বসের মনের খবর আমি কী করে জানব ঝানুদা?’

    ‘ওকে ফ্যামিলি নিয়ে জার্মানিতে ছেলের কাছে যেতে হবে।’

    ‘তাতে চিন্তার কী হলো? আজকাল তো লোক প্রতি মাসে জার্মানিতে যাচ্ছে আসছে। ওনার কি ভিসাতে গণ্ডগোল হয়েছে, না কোন ক্রিমিনাল রিপোর্ট আছে?’ আমি মজা করলাম একটু।

    ‘না ওনাকে বেশ কিছুদিনের জন্য যেতে হবে, আর পোষা বেড়ালটাকে কোথায় রেখে যাবেন সেটা নিয়েই চিন্তা।’

    ‘কেন এখানে নিশ্চয়ই “পেট” রাখার জায়গা আছে?’

    ‘তা না, বিদেশি একটা বেড়াল অত দিনের জন্য কোথাও রাখা মুশকিল। অন্য বেড়ালদের সাথে থেকে ইনফেকশনের ভয় আছে। তাছাড়া বেড়ালেরও তো একটা চেনা অচেনার ব্যাপার আছে।’

    ‘তবে পরিবারের একজন গেলেই তো পারে। বাকিরা ঘরে বসে বেড়াল পাহারা দিক।’ আমার সরল সমাধান।

    ‘না রে ওর ছেলের কী যেন একটা কেস হয়েছে। মানসিক ভাবে বড্ড ভেঙ্গে পড়েছে নাকি সে। শুনছি নাকি প্রেমঘটিত ব্যাপার। অফিসের কোন এক বিদেশিনীর সঙ্গে লটঘট করেছে সে। বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বিদেশিনীর পরিবার পাত্রের পরিবারের সবাইকে দেখতে চায়। সবাই না গেলে বিয়ে হবে না।’

    ‘সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছে যখন তখন তো বিড়ালটাকেও নিয়ে গেলে পারে। ও তো ফ্যামিলিরই লোক।’

    ‘না রে বেড়াল পার করতে এমনিতেই তো অনেক হ্যাপা। আর বর্ডার পার করতে হলে তো কথাই নেই। বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স পেট এলাও করে না। যারা করে তারাও বলে কেবিনে নয় বিমানের পেটে মানে মালপত্রের মধ্যে বিড়াল রেখে যাত্রা করো। মালপত্রের মধ্যে অতক্ষণ থাকলে বিড়ালের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। এভাবে এক পুত্রসন্তানের জন্য আরেক পুত্রসন্তান বিয়োগ কোন বাবা-মা চাইবে? তাছাড়া যেতে গেলে বেশ কটা এনওসি আর ইমিউনিটি ইনজেকশন নিতে হবে বেড়ালটাকে। এক লম্বা কাজ। খরচাও প্রচুর। আবার যদি কেবিনে নিজেদের সাথে নিতে হয় পেটকে তাহলে ইকোনমি ক্লাস ছেড়ে এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টিকিট কাটতে হবে। কিপটে টেকোটাই মরে যাবে তাহলে।’ একটু থেমে ঝানুদা আবার বললেন-

    ‘ওদের প্ল্যান হচ্ছে সবাই মিলে যাবে, বিদেশিনীর পরিবারের সাথে কথা বলবে, সব কিছু ঠিক থাকলে একেবারে ওদের বিয়ে দিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে লাখ কথার দরকার নেই বিয়ের জন্য। শুধু দুটো পরিবার রাজি হলেই হল।’

    ভাবলাম, সত্যিই তো, বেড়াল কি মালপত্রের সাথে যেতে পারে? মনুষ্যেতর হলেও ওদের মনুষ্যত্বও তো কম নেই।

    মুখে বললাম, ‘তাহলে উপায় কী? সত্যিই তো এটা চিন্তার বিষয়।’

    ‘উনি চাইছেন আত্মীয়-স্বজন কারো বাড়িতে বেড়ালটাকে রেখে যেতে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ রাজি হয়নি। এদিকে টিকিট কাটা হয়ে গেছে, ভিসা হয়ে গেছে, যাওয়ার দিন ক্রমে এগিয়ে আসছে। চিন্তায় টেকোর রাতের ঘুম উড়েছে।’

    চা শেষ করে ঝানুদা নিজের টেবিলে গেলেন। যাবার সময় আমার দিকে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। আমাকে তৈরি থাকতে বললেন কি কোন কাজের জন্য? উনি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করেন। পুরনো লোক হওয়াতে অফিসের সবার ঘাঁতঘোঁত জানেন। আমাকে নানা ভাবে গাইড করেন।

    **********

    এই অফিসে আমি চাকরি করছি প্রায় দুবছর হলো। কলিগরা সবাই বেশ ভালো হলেও বস একটু বিচিত্র। বিদেশে বহুদিন চাকরিবাকরি করে দেশে ফিরে নিজের একটা ফার্ম খুলেছেন। ভালোমতো কাজও হচ্ছে এখানে। কিন্তু তাঁর মেজাজের ঠিক ঠিকানা নেই। কারোর সাথে এই ভাল ব্যবহার করছেন তো এই গালাগাল করছেন। আর কোন কিছুতে ‘না’ শোনার অভ্যেস নেই ওনার।

    তখন সবে মাসখানেক কাজ করেছি কি করিনি, একদিন বস আমাকে ডেকে একটা খালি অ্যালবাম দিলেন। সাথে একটা ছোট প্যাকেট, তাতে অজস্র স্ট্যাম্প। বললেন ওনার মেয়ের কলেজে একটা ইন্টারকলেজ হবি কম্পিটিশন আছে। এতে মেয়ে নাম দিয়েছে ‘স্ট্যাম্প কালেকশনে।’ এই অ্যালবামে সমস্ত স্ট্যাম্প সুন্দরভাবে লাগিয়ে দিতে হবে আমাকে।

    বস বললেন ‘এমপ্লয়ি ডাটাবেসে দেখলাম তোমারও হবি ছিল স্ট্যাম্প কালেকশন।’ তো তুমি একটু শকুন্তলাকে সাহায্য করে দাও না। অফিসে তো পারবে না, বাড়িতে নিয়ে যাও। স্ট্যাম্পের অ্যালবামটা সুন্দরভাবে পুরো তৈরি করে কাল মানে রোববার সকালে আমাদের বাড়িতে দিয়ে যেও। শকুন্তলাকে একটু বুঝিয়েও যেও অ্যালবামটার ব্যাপারে কী কী বলতেটলতে হবে। ওর কম্পিটিশন কিন্তু কাল বিকেলেই।

    সেই সময় আমি অফিসের মাঠে ব্যাটসম্যান হিসেবে একেবারে নতুন নেমেছি। নতুন পিচে নতুন বোলারদের খেলছি। পিচ বুঝতে খেলাটা একটু ধরে খেলতে হবে শুরুতে। কাজেই আমার অন্যরকম ভাবার অবকাশই ছিল না। নিয়ে নিলাম অ্যালবাম আর স্ট্যাম্পগুলো। যদিও মনটা খচখচ করছিল। নিজে একটু হীনম্মন্যতাতেও ভুগছিলাম। এত লোক থাকতে আমায় কেন? আমি কি কষ্ট করে ‘কস্ট আকাউন্টেন্সি’ কোর্স শেষ করে এই কাজের জন্য এখানে আছি নাকি?

    ঝানুদাকে বলাতে উনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার সমস্যা। বিকেলের দিকে টেবিলে এসে বললেন ‘তুই ভাবিস না। এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ কর। জানিস তো ‘ফাস্ট ইম্প্রেশন ইজ দা লাস্ট ইম্প্রেশন।’ ফাটিয়ে কাজটা কর আর বসের নেকনজরে পড়ে যা। তারপর দেখবি কত সুযোগ-সুবিধা পাবি অফিসে। অনেকের থেকেই নানা ব্যাপারে অনেক এগিয়ে থাকবি।’ তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ‘আরেকটা কথা তো তোকে বলাই হয়নি। যার জন্য স্ট্যাম্প অ্যালবাম তৈরি করছিস, সে কিন্তু ডানাকাটা পরী। তাছাড়া তোকেও তো দেখতে বেশ। উত্তমকুমার না হলেও একেবারে হরিপদ নোস। সেভাবে কাজ করলে অর্ধেক রাজত্ব মানে অফিসে সব সুযোগ-সুবিধা আর রাজকন্যা দুটোই জুটে যেতে পারে।’

    যে কোনো কারণেই হোক সেবার প্রচুর খেটে কাজটা করেছিলাম। রাতে চিলেকোঠার পুরনো জিনিসপত্রের মধ্যে রাখা আমার স্কুলজীবনের স্ট্যাম্পের খাতাটা থেকে বের করলাম বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য স্ট্যাম্প। সেগুলো দিয়ে একটা দুষ্প্রাপ্য স্ট্যাম্পের সেগমেন্ট তৈরি করলাম বসের মেয়ের অ্যালবামে। আমি নিজের জন্যও কখনো এত যত্ন করে স্ট্যাম্প লাগাইনি। অ্যালবামটার গেট আপ আর কনটেন্ট দুটোই দুর্দান্ত হল।

    পরের দিন রোববার বসের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সল্টলেকে অত্যন্ত সুদৃশ্য একটি দোতলা বাড়ি। সবুজ লন পেরিয়ে মূল দরজার কলিংবেল বাজানোর পরেই ভেতর থেকে একটা ‘ঘেউ ঘেউ’ আওয়াজ এল। একটি সুন্দরী সদ্য-তরুণী দরজা খুলল। পেছনে বাদামির সাথে সাদা বড় বড় লোমওয়ালা ঘেউ ঘেউ আওয়াজের মালিক। বসের কথা জিজ্ঞেস করতেই আমাকে সোফাতে বসিয়ে ‘‘ড্যাডি ড্যাডি” বলে ডাকতে ডাকতে ভেতরে চলে গেল মেয়েটি। আর আমাকে চোখে চোখে রাখল বাদামি জীবটি।

    বস এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে নিজের মেয়ে শকুন্তলা মানে সেই সুন্দরী সদ্য তরুণীর সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। এমনকি সারমেয়টিকেও আদিখ্যেতা করে বার বার বলতে লাগলেন ‘ওনাকে তোমার নাম বলো, নাম বলো।’ ভাবতে থাকলাম এখন কুকুর যদি সত্যিই তার নাম বলে, তাহলে উত্তরে আমারও কি নিজের নামটা ওকে বলা উচিত? সারমেয়টি অবশ্য আমার দিকে সারাক্ষণ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় আর নাম বলেনি। যাই হোক, শকুন্তলাকে সেদিন উজাড় করে দিলাম আমার ‘যা কিছু সম্বল’ মানে স্ট্যাম্প সম্পর্কিত সমস্ত জ্ঞান। কীভাবে কী বলতে হবে, কোন সেগমেন্টে কী কী আছে, বিশেষ বিশেষ স্ট্যাম্পের ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ট্যাম্পের অ্যালবাম অর্পণ করে সেদিন শকুন্তলাকে প্রায় ‘স্টাম্প আউট’ করে ফেললাম বলে মনে হল। যদিও ‘ডি আর এস’ থাকাতে আউটের ডিসিশন ঝুলে রইল অদৃশ্য থার্ড আম্পায়ারের কাছে।

    মেয়ে সেবার প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়াতে বস আবার বাড়িতে ডেকে আমাকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন। শকুন্তলা সেদিন খুব খুশি ছিল। দুবার আমাকে ওর মিষ্টি হাসিও উপহার দিয়েছিল। ভেজা ভেজা গলায় বলেছিল ‘আবার আসবেন।’ এরপর থেকে শকুন্তলাকে মাঝে মাঝে ওর কলেজের সামনের রাস্তায় দেখতে পেতাম। কোন অজ্ঞাত কারণে কলেজ টাইমে ওই রাস্তায় আমার কাজ পড়ে যেত। শকুন্তলা আমাকে দেখেছে কিনা বোঝা যায়নি। কারণ ‘শকুনের চোখে নাকি পলক পড়ে না।’

    ***********

    ঝানুদার আশঙ্কামতোই বিকেলের দিকে বসের ঘরে আমার ডাক পড়ল। ঢুকেই দেখলাম বস গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। ঘরে ওনার পি এ ছিল। সে বেরিয়ে যাবার পর আমাকে গলা নামিয়ে বললেন,

    ‘জানো বোধহয় একটা বেড়াল এডপ্ট করেছি।’ বুঝলাম খাপছাড়া একটা কাজ আসছে আমার কাছে। উনি বলে যেতে লাগলেন- ‘টাইগার, মানে আমাদের কুকুরটা ইহজগৎ ছেড়ে চলে যাবার পর আমাদের বাড়ি একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘কর্ণ’ আসার পর সেই শূন্য ঘর একেবারে ভরে গেছে। মহাভারতের কর্ণের মতোই নিজের বাবা মা ছেড়ে ও অন্য পরিবারে বড় হচ্ছে। শুরু থেকেই আমাদের সবার মনও জয় করে নিয়েছে। আর আমাদের ছাড়াও ও একেবারেই থাকতে পারে না। বেড়ালটা বিদেশি, ‘ব্রিটিশ শর্ট হেয়ার’ বংশোদ্ভুত, একদম সাহেবদের মত স্বভাব। খাওয়াদাওয়া, ব্যবহার, চলাফেরা সব। আমরা ওর এটিকেট দেখে মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে যাই। জন্মের পরে ব্রীডারের কাছেই ও নানারকম ট্রেনিং নিয়েছে। কীভাবে পরিবারের সাথে থাকতে হবে তা ওর চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। তবে এই মুহূর্তে আমরা বিদেশ যাব বলে ওকে নিয়ে একটু অসুবিধার মধ্যে আছি।’

    আমি বিশেষ কথা না বলে ওনার দিকে চেয়ে রইলাম। উনি বলতে লাগলেন,

    ‘তোমাকে একটা সাহায্য করতে হবে। জানি তুমি না বলবে না, আর কাজটাও তোমার কাছে এমন কিছু না। কাজটা হল, আমরা যখন বিদেশ যাব, তোমাকে আমাদের বেড়ালটাকে সপ্তাহ খানেকের জন্য রাখতে হবে। অন্য কোন জায়গায় রাখতে ভরসা পাচ্ছি না।’

    একটু ভয় পেয়েই বললাম- ‘আমাদের বাড়িতে সাহেব বেড়াল কি থাকতে পারবে? অচেনা লোকের বাড়িতে থাকতে সাহেবরা তো এমনিতেই বিশেষ পছন্দ করে না।’

    ‘না, না, তোমার বাড়িতে রাখতে হবে না। ও নিজের বাড়িতেই থাকবে। তাছাড়া ও এসি ছাড়া থাকতে পারে না। সন্ধ্যায় ও স্মার্ট টিভিতে, নেটফ্লিক্সে ওয়েব সিরিজ দেখে। এগুলো তো সব জায়গায় সম্ভব নয়। কাজেই ও এখানেই থাকবে তুমি শুধু প্রত্যেকদিন দুবেলা এসে ওকে খাবারদাবার দেবে। আমি বলে দেব তোমাকে কীভাবে কী করতে হবে। বেসিক্যালি ওকে একটু সঙ্গ দেওয়া আর কি। আমাদের ছেড়ে ও যাতে একা না হয়ে যায়। বেশিরভাগ সময়ে ও ঘুমোয় কাজেই ওই সময় ওর কাউকে দরকার হয় না।

    আজ সন্ধ্যায় একবার আমাদের বাড়িতে এসো, ‘কর্ণ’র সাথে আলাপ করিয়ে দেব। ও সাহেব হলেও আলাপ হবার পর ও কিন্তু দারুণ মিশুকে। কেন জানি না একজনের পলকহীন চোখের কথাও মনে পড়ল। ওর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা আমার এখনও ফলপ্রসূ হয়নি।

    **********

    আজকাল প্রতিদিন দুবেলা করে বসের বাড়িতে আসছি আমি। অফিস যাবার পথে আর অফিস ফেরতা। ওনারা সামনের ড্রয়িংরুম, লাগোয়া বাথরুম আর পাশের বারান্দাটা খুলে রেখে গেছেন। বাড়ির বাকি অংশ রয়েছে ‘আন্ডার লক অ্যান্ড কি।’ আমি রোজ বাইরের দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকি, বেড়ালের খাবার দিই। এসি চালিয়ে ঘর ঠান্ডা করি। সবচেয়ে বাজে কাজ হচ্ছে ওর লিটারবক্সের বালি থেকে ছোট বেলচা দিয়ে ওর প্রাতঃকৃত্য বা বর্জ্যগুলো কালো প্লাস্টিকে ভরে, যাবার সময় বাইরের ক্লিয়ারিং ওয়েট-ওয়েস্টবিনে ফেলে দিয়ে যাওয়া। তাছাড়া কর্ণর ঘন লোমে চিরুনি চালানো, ঘর ভ্যাকুয়াম দিয়ে পরিষ্কার করা তো আছেই। দুদিন পর পর বস ভিডিও কলে বিড়ালের সাথে কথা বলেন। ওনার বউ মেয়েও কথা বলে। বেড়ালটাকে ভারচুয়ালি আদর করেন তারা। এই পারিবারিক আদিখ্যেতায় আমার শুধু হ্যাংলা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোন রোল নেই। এখনও শকুনের চোখে পলক পড়েনি। তাই আমার ব্যাপারটা এগোচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। তবু চেষ্টা ছাড়িনি। যদিও এই কদিনে দুবার হেসেছে ও, তবে সেটা আমাকে দেখে না কর্ণকে দেখে তা পরিষ্কার করে বোঝা যায়নি। ছেলের সম্বন্ধে কোন কথা বলেন না তারা। আমাকে তো দিন সাতেকের ভ্রমণ বলে চলে গেছেন। কিন্তু সপ্তাহ-দুই পার হতে চলল, এখনো ফেরার ব্যাপারে কারো কোনো উচ্চবাচ্য নেই। জানি না আর কতদিন এভাবে আমাকে আটকে থাকতে হবে।

    এদিকে কর্ণ সারাদিন ঘুমায়। ওর ‘মুখটা হাঁড়ি, গতর ভারী।’ রূপেরও যথেষ্ট বাহার আছে। ধূসর আর কালোয় ডোরাকাটা। দেখতে প্রায় ছোট্ট একটা ব্যাঘ্রশাবকের মতোই। বাঘের মাসি বলে কথা। আমি এসে দুবেলা ওকে জাগাই। ওর ‘ক্যাট ফুড’ দিই, লিটারবক্স পরিষ্কার করি। ওকে আদর করি। ইয়ুটিউব দেখে শিখে নিয়েছি কীভাবে এদের আদর করতে হয়। এদিকে ওর খাবার আর লিটারের বালিও শেষ হয়ে আসছে। তাই পরদিনই বসকে বলে ফেললাম সে কথা। উনি বললেন ‘কোন ব্যাপার না। আমাজন থেকে আনিয়ে নাও। তবে ঠিক ওই ব্র্যান্ডের খাবার আর বালি আনাবে। অন্য কোন ব্র্যান্ডের বালিতে ওর প্রাতঃকৃত্যে অসুবিধা হয়।’ যাই হোক আমাজনে পরের দিন খুঁজে দেখলাম বালি আর খাবারের প্রচুর দাম। সব মিলে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের ধাক্কা। ব্র্যান্ড চেঞ্জ করলে কিছু কম হত হয়ত কিন্তু ওর প্রাতঃকৃত্যে যাতে কোনরকম অসুবিধে না হয় সেই ভেবে কিছুই চেঞ্জ করলাম না। পেমেন্ট কে করবে সে ব্যাপারে কোন কথা হয়নি। বসকে পেমেন্টের কথা বলাও যাবে না। আমার সবরকম পারফরমেন্স নির্ভর করছে বেড়ালের দেখভালের উপরে। কাজেই দেরি না করে অর্ডার দিয়ে দিতেই হলো। সময়মতো জিনিসগুলিও এসে গেল। গ্যাঁট থেকে ভালরকম মালকড়ি খসল আমার।

    আমি কিন্তু বেড়াল-সিটিং-এর সাথে সাথে নিয়মিত অফিস-কাছারিও করছি। বসের যে সেকেন্ড ইন কমান্ড সেই লাহিড়ী সাহেব একজন ‘নো ননন্সেন্স’ মানুষ। গোবদা গম্ভীর। ওনাকে আমার এই বিড়াল সিটিং-এর কথা জানানো হয়নি। কাজটা প্রায় প্রাইভেট সার্ভিস এর মতো চলছে। ব্যাপারটা একমাত্র ঝানুদা ছাড়া অফিসের আর কেউ জানে না।

    **********

    এক মেঘলা সন্ধ্যায় বেড়ালের সাথে বসে নেটফ্লিক্স দেখছি। ‘ব্রেকিং ব্যাড’ নামের একটা পুরনো সিরিজ কর্ণর নাকি খুব পছন্দ। ও খুব এনজয় করে। সেটাই দেখছি। আমারও দারুণ লাগছে। ব্যাপক জমে গেছে সিরিজটা। এক একটা এপিসোড এক এক দিনে দেখে ফেলি। সাবটাইটেল আছে বলে আমার বিশেষ অসুবিধা হয় না। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ‘ব্রেকিং ব্যাডে’র অ্যাকশন সিনে কর্ণ চোখ বুজে রয়েছে। দেখছে না। এরকমটা ভাবা যায় না। আরও খেয়াল করলাম বেড়ালটা ইদানীং খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। লিটারবক্সেও বিশেষ কিছু আউটপুট নেই। আমি প্রমাদ গণলাম। হোয়াটসঅ্যাপ কলে বসকে জানালাম। উনি মৃদু ধমক দিলেন আমাকে। ‘এতদিন জানাওনি কেন, এখুনি ডাক্তার জৈনের কাছে নিয়ে যাও, দেরি কোরো না,’ ইত্যাদি। সেইমতো পরদিন সকালে রোগীকে নিয়ে নিউ টাউনে ডাক্তার আনন্দ জৈন-এর পেট ক্লিনিকে এলাম।

    সুদৃশ্য, মূল্যবান, খাঁচার মতো একটা ব্যাগে ওকে ভরে নিয়ে এসেছি। বস বলেছে বেড়াল নাকি উবের প্রিমিয়াম ছাড়া চড়ে না। অন্য ট্যাক্সিতে অসুবিধা হয়।

    গিয়ে দেখলাম পেট ক্লিনিকে সারে সারে রোগীরা অপেক্ষা করছে। যদিও আগে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছি। কিন্তু ডাক্তার তখনো আসেনি। তাছাড়া আমার আগেও অনেকে আছে। ডাক্তার অন্য হসপিটালে একটা ইমারজেন্সি সার্জারিতে বিজি আছে। ক্লিনিক দেখে মনে হল কোন সাত-তারা হোটেলের রিসেপশনে এসেছি। এক দিকে ফ্রন্ট ডেস্কে বসে আছে সুন্দরী রিসেপশনিস্ট। অন্যদিকে সুদৃশ্য কেবিনের মধ্যে সাজানো নানারকম পেট টয়। মাঝের সেগমেন্টে নানা ধরনের ওষুধ। একদম ভেতরের দিকে একটা কাঠের কেবিনে লেখা ‘ডক্টর’। ওটাই ডাক্তারের চেম্বার। এদিকে রোগীদের ধৈর্য ধরে বসিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে উঠেছে। খান দশেক নানা জাতের ছোট-বড় কুকুর, গোটা পাঁচেক বেড়াল, তিনটে খরগোশ এমনকি একটা কাকাতুয়াও আছে রোগীদের মধ্যে। প্রত্যেকেই তাদের বাবা-মার সঙ্গে এসেছে। সবাই গম্ভীর। আমার ডানদিকে বসা সুবেশা ভদ্রমহিলা কারো সাথে ফোনে কুকুরের ব্লাড টেস্টের রেজাল্ট নিয়ে কথা বলছেন। পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে একটা বড় কুকুর। সিনেমায় দেখা ডালমেশিয়ানের মত। দুবার সে আমার বিড়ালের ঢাকা খাঁচাটা দেখে গরর গরর আওয়াজ করল। তার মা মানে সেই সুবেশা তাকে চাপা স্বরে ধমক দিলেন- ‘বিহেভ ইয়োরসেলফ শ্যাম।’ শ্যাম সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল। এতক্ষণে ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকালেন, ‘বিড়াল?’ আমি ‘হ্যাঁ’ বলাতে আরো বললেন ‘ডাঃ আনন্দকে পেয়ে আমার জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ওকে ছাড়া আমার আর শ্যামের একদিনও চলে না। বোঝা গেল ওই সারমেয়র ভালো থাকা না থাকাই মহিলার একমাত্র সমস্যা। ওনার কথা শুনে শ্যাম দেখলাম একবার ‘ভৌ’ করে আওয়াজ করে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রয়েছে। ভদ্রমহিলা বললেন ‘আনন্দ’র নাম শুনলেই ও এভাবে ডাক দেয়।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম একটা লম্বা ঝাঁ-চকচকে লাল মার্সিডিস চেম্বারের সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ভেতর থেকে নামলেন ৩০-৩৫ বছরের একজন ঝকঝকে যুবক। হলিউড ছবির সাইডরোলে চালিয়ে দেওয়া যায় তাকে। হাতে আইফোন আর কানে লাগানো রয়েছে তারবিহীন ইয়ারপড। কারো সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকলেন তিনি। রোগীদের মধ্যে যেন খুশির হাওয়া বয়ে গেল। ‘হাই বেবিস’ বলে সম্ভাষণ করলেন তিনি সবাইকে। দেখলাম ডাক্তারবাবু এক এক করে রোগীদের জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন আর প্রত্যেকের নাম ধরে ডেকে ডেকে তাদের সম্ভাষণ করছেন। এরকম ডাক্তার-রোগী যোগাযোগ আগে কখনও দেখিনি। আমার বেড়ালের কাছে এসে ঢাকা সরিয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনি কি প্রথম এলেন কর্ণর সাথে?’ আমি হ্যাঁ বলাতে বললেন- ‘ওর তো ‘জিঞ্জিভাইটিস’ কেস। বসুন আমি যথাসময়ে ডাকব।’

    সেই যাত্রা ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পারলাম যে কর্ণর দাঁতের মাড়ির ইনফেকশন হয়েছে। মাড়িতে মলম লাগাতে হবে। ওষুধ খাওয়াতে হবে। সকালে বিকেলে খাবার পরে স্পেশাল পেস্টে দাঁত মাজাতে হবে। এক সপ্তাহ পরে আবার এসে রিপোর্ট দিতে হবে। এবারে ডাক্তারের ফিস, ওষুধ এবং অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রায় হাজার তিনেক টাকা বিল হল। চড়াক করে মাথাটা ঘুরে গেল আমার। অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যার কথা ভেবে নিজেকে সামলে নিয়ে বিল পে করলাম। এভাবে বেশিদিন চালাতে পারব না। ওনাদের ফিরতে আরও দেরি হলে কী হবে, এটা ভেবেই শরীর ঘর্মাক্ত হল। মুশকিল আসান করার জন্য পরদিন অফিসে গিয়েই ঝানুদার শরণাপন্ন হলাম।

    **********

    আরো মাস খানেক পরে ওনারা ফিরলেন। ছেলের বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ে যদিও পরে হবে। রাজকন্যাও দেখলাম বাড়ি ফিরে বেশ খুশি। কারণ ওর বেড়াল কর্ণ বেশ মোটাসোটা হয়েছে, আর প্রচুর আনন্দে আছে। খেলছে, আদরে মিউ মিউ করছে। ওদের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ওরা ভাবতেই পারছে না ওদের ছাড়াও বেড়াল এত খুশি থাকল কীভাবে। কয়েকটা খেলনা ওরা এনে ছিলেন। সেগুলো নিয়ে বাড়িময় লাফালাফি করল কর্ণ। বসও খুব খুশি হয়ে বললেন ‘বাঃ, দারুণ ভাবে রেখেছো তো কর্ণকে!’ কিন্তু শকুনের চোখে এখনও পলক পড়ল না। আমার সব চেষ্টা কি বৃথা যাচ্ছে নাকি?

    অফিসে ঝানুদা বললেন, বসের ঘনিষ্ঠ মহলে নাকি কানাঘুষো চলছে যে ওনার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ঠিকই, তবে সাথে একটা এক্সচেঞ্জ অফারও আছে। শকুন্তলাকেও ওই বিদেশিনীর বাবা-মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে ওদের একমাত্র ছেলের জন্য। বসেরা অবশ্য ‘ভাই-বোন’ দুজনেরই বিদেশে এবং একই বাড়িতে বিয়েতে রাজি হচ্ছেন না। ভাবার জন্য সময় চেয়েছেন। তবে ছেলেটাকে নাকি অনেকটা ‘বরিস বেকারের’ মত দেখতে। ওদের দারুণ মানাবে।

    আমি প্রাণপণে ভাবার চেষ্টা করছি যে শকুন্তলা নিশ্চয়ই এপ্রস্তাবে রাজি নয়। তবে আমি নিশ্চিত নই। বিদেশ থেকে ফেরার পর ওর এত খুশি কি অন্য কথা বলছে? কে জানে। আমি যে কাজগুলো করলাম এতদিন তা কি সব বেকার গেল? ‘বেকার’ই জিতল শেষ পর্যন্ত। ঝানুদা বললেন ‘তোর তো শ্যাম থুড়ি রাধা আর কূল দুটোই গেল মনে হচ্ছে। তবে হাল ছাড়িস না।’

    সপ্তাহদুয়েক যেতে না যেতেই বসের কেবিনে তলব পড়ল আমার। ‘কী ব্যাপার বলত? কর্ণ তো লিটারের বালিতে প্রাতঃকৃত্য করতেই চাইছে না। দু-তিন দিন চেষ্টা করে, তারপর একদিন কোনরকমে করে। সেইকারণে বোধ হয় খাচ্ছেও না। এভাবে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে ও। কী অসুবিধা হচ্ছে কে জানে? ডাক্তারও ধরতে পারছে না কিছু। বেশ মনমরা হয়ে পড়ছে সবাই। লিকু বলল তোমার কথা। তুমি আজ সন্ধ্যেবেলায় একবার এসো আমাদের বাড়িতে। পারিবারিক ভিডিও কলের সময় জেনেছিলাম লিকু হলো শকুন্তলার ডাকনাম।

    বিকেলে গেলাম বসের বাড়ি। আমি ঘরে ঢুকতেই কিন্তু কর্ণ লাফিয়ে আমার কোলে এল। আমি ওকে ইউ টিউব থেকে শেখা আদর দিলাম। এরই মধ্যে বেড়ালের চোখে একটা ক্লান্তির ছাপ আমার চোখ এড়াল না। গম্ভীর মুখে আমাজনের বালি পরীক্ষা করলাম, লিটারবক্স পরীক্ষা করলাম। বললাম ‘ওর কিছু অসুবিধা আছে মনে হচ্ছে।’ যাই হোক ভালো-মন্দ খাওয়াদাওয়া হল। নেটফ্লিক্স দেখা হল। ফেরার সময় বসের চিন্তিত পরিবারকে বললাম ‘আমাদের পাড়ায় একজন ডাক্তার আছেন, আমি আজ কর্ণর ব্যাপারে ফোনে কথা বলেছিলাম। উনি সাজেস্ট করেছেন প্রাতঃকৃত্যর জন্য বালি ইউজ না করে মেডিকেটেড স্পেশাল গ্রাস ট্রাই করতে। যদি বলেন তো আমি জিনিসটা ওনার থেকে কালই এনে দেব।

    পরদিন সকালে একটা অটো নিয়ে ওর বাড়িতে গেলাম, সাথে একটা বস্তা। বস্তায় ছোট ছোট করে কাটা কচি সবুজ ঘাস। সেগুলো লিটার বক্সে বিছিয়ে দিলাম। বললাম ‘প্রতি দু দিন অন্তর বক্স পরিষ্কার করে আবার নতুন ঘাস ঢেলে দিতে হবে। দেখুন কয়েকদিন, মেডিকেটেড গ্রাস-এ কাজ হয় কিনা।’

    কিছুদিন বাদে বস নিজেই আমার টেবিলে এসে বললেন ‘মিরাকেল হয়েছে, প্রবলেম চলে গেছে।’ একটু থেমে আবার বললেন,

    ‘কিন্তু আর একটা অসুবিধে হয়েছে, ক্যাট ফুডে ওর অরুচি ধরেছে। এমনকি শ্রিম্প বা ওর প্রিয় স্পেশাল চিংড়ি মাছও মুখে দিচ্ছে না। এর মধ্যে একদিন নাকি ও ডাইনিং টেবিলে রাখা রান্না করা মাছ চুরি করে খেয়েছে। অবাক কাণ্ড, পাড়ার বিড়ালগুলোর মতো স্বভাব হয়ে যাচ্ছে নাকি? আগে কাঁটার জন্য মাছ দিতাম না। এখন তো নিজেই কাঁটা চিবিয়ে খাচ্ছে। কী যে হচ্ছে?

    বেশ কিছুদিন আবার সব শান্ত। আমার ঠিক করে দেওয়া একটা ছেলে নিয়মিত বসের বাড়িতে বস্তা করে মেডিকেটেড গ্রাসের জোগান দেয়। কিছু পয়সাও হয় তার। শুনেছি এখন হুলোর জন্য বাজারের রান্না করা মাছই একটু জল দিয়ে ধুয়ে রোজ দেওয়া হয়। দুধ-ভাতও বেশ পছন্দ করে ও। খরচাও বেশ কমেছে। কিপটে বস বেশ খুশি।

    কদিন বাদে বস আবার চিন্তিত মুখে আমায় বললেন- ‘জানো? আরেকটা অসুবিধা হয়েছে। কোথা থেকে একটা মেনি বিড়াল এসে জুটেছে। ব্যালকনিতে প্রায়ই আসে। আর আমাদের কর্ণ কাঁচের জানলার ভেতর থেকে উদাস হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায় প্রতিদিন একই ঘটনা। মেনি কোনদিন না আসলে কর্ণ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। একদিন তো দেখলাম মেনিটাও ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে।’

    বললাম ‘এগুলো নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না স্যার। সামান্য ব্যাপার। মেনি নিজেই হয়ত চলে যাবে।’

    ‘না না চলে গেলে তো আরও মুশকিল। আবার মেনিটা ঘরে ঢুকলে কর্ণর ইনফেকশন হয়ে যাবে।’

    ‘ঠিক আছে স্যার আমি আমাদের পাড়ার ডাক্তারবাবুকে আর একবার জিজ্ঞেস করব নাহয়।’ ডাক্তার আনন্দ নয় সব ব্যাপারেই আজকাল ওনারা আমার পাড়ার ডাক্তারের পরামর্শের ওপর বেশি ভরসা করেন। কাজ হচ্ছে, খরচও বাঁচছে।

    পরদিন বসকে জানালাম ‘আমাদের পাড়ার ডাক্তার বলেছেন এটা নাকি ফ্রেন্ডশিপ সিনড্রোম। পুরুষ বিড়াল বা হুলোদের হয়। আপনি ওই মেনি বিড়ালটাকে কদিন বারান্দাতে খাবারদাবার দিন। ও রেগুলার আসবে আর কর্ণ খুশি হবে। মেনি দেখবেন দিন কতক পরে উধাও হয়ে যাবে। কর্ণও ততদিনে সিনড্রোম থেকে মুক্তি পাবে।

    এরপর বেশ কিছুদিন কোন সমস্যার কথা শুনিনি। এরমধ্যে অফিসে আমার একটা ছোট ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। আমার টেবিলটা বসের কেবিনের কাছে শিফট করা হয়েছে। আমাকে একটা ছোট ওয়ার্কিং গ্রুপের হেড করা হয়েছে। বস ইদানীং এতটাই খুশি থাকে যে হরিকেও আজকাল বিশেষ ঝাড় খেতে হয় না। কূল তো রইল কিন্তু রাধা? তবে আমার কাউকে ‘স্টাম্প আউট’ করার রেজাল্ট এখনও জানা যায়নি। আর ওদিকে ‘বেকার’ যদি জিতে গিয়ে থাকে তাহলে আমি আর বেকার ঝুলে থাকি কেন?

    বেশ চলছিল। হঠাৎ বস নিজেই একদিন কাজ দেবার অছিলায় আমার টেবিলে এসে বললেন- ‘সন্ধ্যেবেলা এসো তো আজ আমাদের ওখানে। লিকু তোমাকে একবার যেতে বলেছে। একেবারে ডিনার করে ফিরবে।’ এখন বস শকুন্তলার নাম করেই আমাকে বাড়িতে ডাকেন।

    সন্ধ্যেবেলা আবার সোফায় বাবা-মা মেয়ে। সামনে স্মার্ট টিভিতে চলছে ‘ব্রেকিং ব্যাড।’ মেয়ের পাশে আমি আর আমার কোলে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে আর নামছে মার্জারটি। মাঝে মাঝে কাঁচের জানালায় উঠে বাইরের খালি বারান্দায় কী যেন দেখে আসছে সে আর ঘরর ঘরর করে মৃদু তৃপ্তিসুচক আওয়াজ করছে। এটা নাকি ‘পার’ করা বলে। প্রচণ্ড খুশির আমেজে এই আওয়াজ করে ওরা।

    হঠাৎ মনে হল আমার পাশে শকুনের চোখে অল্প পলক পড়ল। পুলকিত হলাম। না তাকিয়েই বুঝলাম তার দৃষ্টি এখন সরাসরি আমার দিকেই।

    বস বললেন ‘প্রতি সপ্তাহে একদিন করে যদি অফিস ফেরতা এখানে আসতে পারো তবে খুব ভালো হয়। সময়টা একটু ম্যানেজ করে নিও। কর্ণ ভালো থাকবে।’

    হঠাৎ দেখি বেড়ালটা বারান্দার দিকে জানলার কাছে গিয়ে মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করছে।

    শকুন্তলা উত্তেজিত হয়ে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সেই জানলায়। প্রথম করস্পর্শে শরীরে শিহরন খেলে গেল আমার। শকুন্তলা জানল কি?

    তাকিয়ে দেখলাম বারান্দায় রাখা চটের বিছানায় আবির্ভূত হয়েছে একটা সাদা ধবধবে ছোট্ট মেনি বিড়াল। শকুন্তলা বলল ওর ‘ড্যাডি’ নাকি কাউকে দিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানের পাশের নর্দমার থেকে মেনিকে পাকড়িয়ে এনে ব্যালকনিতে থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। অবশ্য কিছু ইনজেকশন নিতে হয়েছে মেনিকে। মেনি যখন খুশি যায় আর আসে। এই মার্জারী আসার পর থেকে কর্ণর আর কোন অসুবিধা হচ্ছে না।

    ডিনারে চর্ব্যচোষ্য খেতে খেতে মনে মনে হাসলাম- ভাগ্যিস বেড়াল-সিটিং এর সময় পকেটে টান পড়াতে ‘পাড়ার ডাক্তার’ থুড়ি ঝানুদার পরামর্শে কর্ণকে প্রাতঃকৃত্যে আমাজনের বালি ছেড়ে মাঠের ঘাস আর ক্যাট ফুডের বদলে বাড়ির খাবারের অভ্যেসটা করিয়েছিলাম। মেনিটা অবশ্য নিজেই মাঝে মাঝে আসত। আমি শুধু খাবার দিতাম তাকেও।

    সেদিন রাতে আমাকে বিদায় জানাতে বাড়ির লনে এল শকুন্তলা। বারান্দার অল্প আলোয় তার ‘পলকহীন দৃষ্টি’ নয়, একেবারে ‘আনত দিঠি’র মানে পরিষ্কার হয়ে গেল। অদৃশ্য আম্পায়ার সাথে সাথেই তর্জনী তুলে স্ট্যাম্প আউটের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। কী আশ্চর্য! আমি তৃপ্তিসূচক মৃদু ‘ঘরর ঘরর’ আওয়াজ করতে করতে বাইরের রাস্তায় পা ফেললাম। মানসচক্ষে দেখলাম বরিস বেকার স্ট্রেট সেটে হেরে কোর্টের পাশের চেয়ারে বসে ঘাম মোছার ছলে তোয়ালেতে মুখ ঢেকেছে। মনে মনে ভাবলাম কিছুদিনের মধ্যেই মেনির মতোই আরেকটা দেশি হুলো এই সংসারে ঢুকবে। তবে তাকেও মধ্যবিত্ত ইনফেকশন তাড়াবার জন্য কোন ইনজেকশন নিতে হবে কিনা জানা নেই।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments