আজ সন্ধেয় ঝড়বৃষ্টি হবে, আবহাওয়ার খবরে বলেছিল। যদিও আবহাওয়া দপ্তরের স্বভাব ছোটবেলা থেকে একইরকম দেখে আসছি, ছোটোখাটো ঝড়বৃষ্টির ভবিষ্যদ্বাণী প্রায়শই মেলে না। লোকে বলে, হাওয়া অফিস যা বলছে তার উল্টোটা ধরে নাও, দেখবে, মিলে যাবে। অবশ্য প্রলয়ঙ্কর ঝড়গুলোর ক্ষেত্রে ছবিটা একেবারেই আলাদা। সেসব সময়ে হাওয়া অফিস নিখুঁত খবর জানিয়ে বহু প্রাণ ও সম্পদ রক্ষা করে।
সে যা হোক, আজ বলেছিল ঝড়বৃষ্টি হবে, সেইমতো বিকেলে হাঁটতে যাওয়া ক্যান্সেল করেছি। একটু আগে বেরিয়ে মিনিট কুড়ি হেঁটে আসাই যেত, কিন্তু ওই, যেখানেই শরীরকে সাধ করে খাটাতে হয়, মন সেখানে কেবলই অজুহাত খোঁজে!
হাঁটতে তো গেলাম না, সময় কাটবে কী করে? ভাবতে ভাবতে রাতের রুটি আর আলুভাজাটাও করে ফেললাম। ঝড় আসবে বলে আগেই রুণুকে বলে দিয়েছিলাম, বিকেলে আর আসতে হবে না, একার মতো খাবার, একদিন আমিই করে নেব। রান্না সেরে চা-টা নিয়ে বসে অবশ্য মনে হচ্ছিল, এখনও তো ঝড় আসেনি, মেয়েটাকে বারণ না করলেই হত। আসলে রুণুকে যে রান্নার সুবিধের জন্যই কেবল রাখা, তা নয়। একা মানুষের রান্নার আর কী এমন জোগাড়! সে আমিই সেরে ফেলতে পারি। কিন্তু এতবছর সারাদিন অত মানুষের মাঝে থেকে আর সারাদিন বকবক করে অভ্যেস, এই বুড়ো বয়সে সে অভ্যেস হুট করে বন্ধ হয়ে গেলে খালি খালি লাগে বড়। তাই রিটায়ারের পরেও রুণুকে রেখেই দিয়েছি। সকাল বিকেল রুণু, আর দুপুরে অঙ্ক করতে আসা পাঁচ ছ’টা ছেলেমেয়ে, গোপালনগর হাই স্কুলের অঙ্কের দিদিমণির বক্তৃতা শোনার লোক আপাতত এই ক’জনই।
স্কুল ছিল আমার বাড়ি থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ। তাই স্কুলের অন্যান্যদের সঙ্গে আজকাল আর সেভাবে দেখাসাক্ষাৎ হয় না। ফোনেই যেটুকু যা কথাবার্তা হয়, তাও এখন তো কথার চেয়ে মেসেজেরই চল বেশি। একেকসময় মজাই লাগে, মুখচোরা মানুষেরও আজকাল কথা চালাতে বিশেষ সমস্যা হয় না, কথার ভারও বইতে হয় না সেভাবে। তবে হ্যাঁ, কণ্ঠস্বরের উষ্ণতা ছুঁতে পারাটা কঠিন হয়ে পড়ে বটে! সে যাকগে, যোগাযোগ থাকলেই হল। ভাইঝি বোনপোদের হাত ধরে ইদানীং আমিও বেশ এসবে দক্ষ হয়ে উঠেছি। হোয়াটসঅ্যাপ জিনিসটাকে মন্দ লাগে না। বছর খানেক আগে পরে রিটায়ার করা চার-পাঁচজন সহকর্মীর একখানা গ্রুপ আছে, কার কেমনভাবে দিন কাটছে দিব্যি জানা যায় সেখানে। ভাইঝি বোনপো মিলে বাড়ির সবাইকে নিয়েও একখানা গ্রুপ খুলেছে, তাদের ক্ষুদেদের কার্যকলাপ হামেশাই দেখতে পাওয়া যায় সেখানে। বছরে দু’বার চাক্ষুষ দেখা হলেও সারা বছর এভাবেই বাচ্চাগুলোকে চোখের সামনে বড় হতে দেখি। ভালোই লাগে।
তবে আজ সকাল থেকে সব গ্রুপে একটাই আলোচনা। ঝড় কোথায়, কেমন তার চেহারা, আর কতখানি বাড়ল তার শক্তি। ভাইঝি বোনপো দুজনেই দেশের পশ্চিম প্রান্তের দুই শহরে, ঝড়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব তাদের ওপর কিছুই আসবে না, তারা ভেবে সারা তাদের তাদের মা বাবা মাসিপিসিদের নিয়ে।
“জল স্টোর করে রাখবে, খাবার স্টক করে রাখবে।”
“প্লাগ যেন সব খোলা থাকে দেখে নেবে।”
“মাসি তুমি ওয়াশিং মেশিনের সুইচ অফ করতে ভুলে যাও, মনে করে অফ করবে। আজ কিছু কেচো না। যা থাকবে কাল পরশু কেচো।”
“মোমবাতি কিনে রাখবে, মোমবাতি, আর দেশলাই। ইনভার্টার, কমপ্লেক্সের পাওয়ার ব্যাকআপ কতক্ষণ টানতে পারবে জানা নেই তো!”
এমন হাজারো সাবধানবাণী ধেয়ে আসছে কাল থেকে হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপে, একবার বড় নাতনির ভয়েস মেসেজও এসেছে, “দাদুন দিদুন মাসিদিদুন তোমরা সবাই সেফ থাকবে। বাইরে যাবে না, উইণ্ডো ক্লোজড রাখবে।”
তার গিন্নিপনার বহর শুনে হেসে বাঁচি না!
এই হল মোটামুটি আমার ঝড়ের সাথে মোকাবিলার প্রস্তুতি। সবার সব কথা শুনে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, ফোনেও বেশি করে চার্জ দিয়ে রাখা আছে। রুণুকে একবার ফোন করেছিলাম, বারবার বলল ভয় যেন না পাই, কাল সকালেই চলে আসবে। রাতে দরকার হলে যেন ডেকে পাঠাই। ফোন রেখে হাসি পেল। ফোনটা আমিই ওদের সাবধান করতে করেছিলাম!
দিদি আর ভাইয়ের ফোন এল একটু আগে পরে। আলোচনার বিষয় একটাই, এখনও তেমন ঝড় উঠল না তো! টাইমটা কখন বলেছিল যেন? নাকি সেরকম গতিবেগ নিয়ে ঝড় আর আসছে না? এই সকাল থেকে এত টান টান উত্তেজনা, টিভিতে খবরের চ্যানেলগুলোয় ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঝড়ের গতিবিধির বিবরণ, ইউটিউবের হরেক চ্যানেলে আবার সেইসব খবরের বিশ্লেষণ, লোকজন এত খেটেছে ব্যাপারটা নিয়ে, শেষমেশ ঝড়ই আসবে না? ফোনের মাঝেই একবার বারান্দার দিকের জানলার পর্দা সরিয়ে দেখে এসেছি, এল কি না। নাহ্, সেই একইরকম থমথমে পরিবেশ।
আমার ফ্ল্যাট এই পাঁচতলা স্ট্যাণ্ড-অ্যালোন অ্যাপার্টমেণ্টের দোতলায়। পাড়াটা এখনও পুরোপুরি ঝাঁ-চকচকে হয়ে ওঠেনি। তিনটে স্ট্যাণ্ড-অ্যালোন অ্যাপার্টমেণ্ট, আর তাদের আশেপাশে বাকি সব টালি-অ্যাসবেস্টসের বাড়ি। স্বীকার করতে বাধা নেই, ওই টালি-অ্যাসবেস্টস আছে বলেই এই তিনটে অ্যাপার্টমেন্ট তাদের ঠিকে কাজের লোক, রান্নার লোক, বাচ্চা দেখার লোকের জোগান মোটামুটি পেয়ে যায়। আর, আমিও ওই যেক’জন ছেলেমেয়েকে দুপুরে পেয়েছি অঙ্ক দেখিয়ে দেওয়ার জন্য, তারাও ওই বাড়িগুলো থেকেই। আজকের ঝড় আসার খবর ওরাও সবাই শুনেছে। আজ দুপুরে আর অঙ্ক তেমন হয়নি, আগের কোন ঝড়ে কাদের বাড়ির চাল কতটা উড়েছিল, কাদের গোটা বিছানাটাই ভিজে গিয়েছিল, কাদের রেশনের চালে জল পড়ে সে চাল আর খাওয়ার যোগ্য থাকেনি, সেসব গল্পই আসছিল ঘুরে ফিরে। আমি মাঝেমাঝে চেষ্টা করছিলাম জিওমেট্রির এক্সট্রার দিকে মনগুলোকে ঘোরাতে, থেমে যাচ্ছিলাম ওদের গল্পের তোড়ে,
“জানো দিদিমণি, তোমাদের এই ফেলাট তখনও হয়নি, এখানে একটা মস্ত আমগাছ ছিল। সে বিশাল গাছ। হিমসাগর, পাকলে যেন চিনি! আর গন্ধে ম ম করত চারিদিক। আমরা গাছের ডালে টায়ার বেঁধে দোল খেতাম, আর দুকুরবেলায় আম পাড়তে উঠতাম।”
ঝড়ের গল্পে আমগাছের প্রবেশে বিস্মিত হলাম। “হচ্ছিল ঝড়ের গল্প, গাছ চলে এল কোত্থেকে?”
“ঝড় নিয়েই কথা গো দিদিমণি! সেবারে গরমের সেই ঘূর্ণিঝড়ে গাছটা শেকড়বাকড়সুদ্ধু উপড়ে গেল জানো? কী ভয়ানক আওয়াজ! ঝড়ের মাতন, আর সেই সাথে ওই মস্ত দামাল গাছ উপড়ে আছড়ে পড়ল।”
“হ্যাঁ গো দিদিমণি, আমরা তখন ছোট ছোট, ওয়ানে টোয়ানে পড়ি, ভয়ে ঠাকমার কোলে বসে কাঁপছিলাম মনে আছে।”
“একটা কুকুর চাপা পড়েছিল না রে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ!” সোৎসাহে জেগে ওঠে আরও দুটি কণ্ঠস্বর।
নাহ্, আজ আর অঙ্ক হবে না।
হয়ওনি। গল্প বেশি হচ্ছে দেখে আমিই ক্লাস ছুটি করে দিয়েছিলাম। “সাবধানে থাকিস সব। ঝড় মাথায় করে বেরোস না কেউ!” আমার সাবধানবাণীর উত্তরে ওরাও আমায় সাবধানে থাকতে বলে বাড়ি চলে গিয়েছিল।
বারান্দায় দাঁড়ালে ওদের কারও কারও ঘরকন্না দিব্য স্পষ্ট দেখা যায়। এসব টালি-অ্যাসবেস্টসের ঘরে সেভাবে আড়ালের পরিসর থাকে না তো! ঘরের বাইরে একচিলতে দালানটার একপাশে রান্নাঘর কারও, নজর করলে এই দোতলার বারান্দা থেকে দেখেও সে রান্নাঘরের কড়াইয়ে সোয়াবিন চাপল নাকি কলমিশাক, অনায়াসেই বুঝে ফেলা যায়। বলতে দ্বিধা নেই, রুণু রান্নার পাট সেরে দিয়ে যাওয়ার পর অখণ্ড অবসরে মাঝেমাঝেই বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি, আলো না জ্বেলে। ওদের ঘরকন্নার ভাগ নিই দোতলার ওপর থেকে। জানি না ওদের কারও চোখে পড়েছি কি না, তবে আমার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। যে তিনটে বাড়ির অন্দরমহলে চোখ পড়ে, তাদের সবারই রোজনামচা মুখস্থ করে ফেলেছি এতদিনে। সৌভাগ্যক্রমে তিন বাড়ির কেউই আমার কাছে পড়তে আসে না। এলে জানি না সহজ হতে পারতাম কি না।
আজ বোধহয় তিন বাড়ির হাঁড়িতেই খিচুড়ি চেপেছে, সুবাস তো তাই জানান দিচ্ছে। তিন বাড়িতেই আজ বড় ব্যস্ততা, ত্রাসও কি? রান্নাঘরে আজ কোনও বাড়িরই বউরা নেই। তারা ঘরের বাক্স-তোরঙ্গ সরিয়ে রাখছে সম্ভাব্য নিরাপদ স্থানে, তোষক বিছানা সরিয়ে রাখছে সম্ভাব্য শুষ্ক কোনও স্থানে। পূর্বাভাস অনুযায়ী ঝড় এলে আজকেও ছাদ উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
ওদের ঘরকন্না দেখতে দেখতে একটা বেপরোয়া ইচ্ছে লাগামছাড়া হতে থাকে ক্রমশ। ঝড়টা আসুক, হাতের কাছে ফোনটাকে রাখতে হবে, ক্যামেরা চালু রাখতে হবে। দীঘায় জলোচ্ছ্বাসের সরাসরি সম্প্রচার করেছিল একবার একটা টিভি চ্যানেল, সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। বাহবা আর কটাক্ষ, দু’রকমই জুটেছিল তাদের ভাগ্যে। দেখেছিলাম লাইভ টেলিকাস্টটা, ড্রইংরুমের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বসে। বয়সে হয়তো আমার ভাইঝির চেয়েও ছোট হবে ছেলেটা, রাক্ষুসে ঢেউয়ের হাত ছাড়িয়ে নিরাপত্তার দিকে ছুটতে ছুটতে বর্ণনা দিয়ে চলেছিল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, ভাগ্যিস আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো কেউ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়নি। আবার একই সঙ্গে বেশ রোমাঞ্চকর লাগছিল। সোফায় বসেই বেশ পৌঁছে গেলাম দীঘার উত্তাল সৈকতে, চাক্ষুষ করে ফেললাম জলোচ্ছ্বাসের মতো একখানা হাড় হিম করা ব্যপার! চাট্টিখানি কথা!
আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর হাল্কা ঝড় উঠল। ব্যস, ওই হাল্কাই। সাধারণ কালবৈশাখীর চেয়ে মোটেই বেশি নয় তার গতিবেগ। এই ঝড়ের কথাই দু’দিন ধরে বলে চলছিল আবহাওয়া দপ্তর? এই ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েই ভয়ে কাঁপছিলাম আমরা? যাহ্, কিছুই তো হল না তেমন! হ্যাঁ, কারেণ্ট চলে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য, বুঝতে পারিনি, ইনভার্টার তো আছেই। বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিয়েছিলাম ওই তিনটে বাড়ির ঘরকন্নায়, এত সাধারণ ঝড়ে ছাদ উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম, তবুও যদি তেমন কিছু হয়, না দেখলে আফসোস হবে পরে। আশাহতই হলাম, ছাদ অক্ষত আছে সব বাড়িরই। দেখলাম দালানের একপাশে কুপির আলো জ্বলছে, দেওয়ালে বড় বড় ছায়া দুলছে, বাড়ির মানুষজনের। বুঝলাম লোডশেডিং। ততক্ষণে ঝড়ের জায়গা নিয়ে নিয়েছে বৃষ্টি। বারান্দায় জলের ছিটে আসছে, দাঁড়ানো গেল না আর।
ঝড়বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ হল। বারান্দায় তিনবাড়ির খিচুড়ির মিলিত সুঘ্রাণ, আমার থালায় দুটো রুটি আর আলুভাজা। কাল সকালেও বাদলা থাকলে রুণুকে বলব খিচুড়ি চাপাতে। খেতে বসতে একটু দেরিই হল, পরপর ফোন আসছিল। ভাইঝি, বোনপো-বউ, ভাইয়ের বউ, দিদি। ঝড় যে কিছুই হয়নি সেই শুনে ভাইঝি বোনপোরা নিশ্চিন্ত। দিদির সঙ্গে ওই নিয়ে আফসোস করেই একটু সময় কাটল, জল ধরে রাখা, মোম কিনে রাখা, সব পণ্ডশ্রম হল যেন!
খেতে বসেছি, রুণুর ফোন। ঠিক আছি তো ঝড়ের পর? যদিও রুণুর গলায় হাল্কা উচ্ছাস,
“বড্ড ভয় পেয়েছিলাম জানো মাসিমা? নতুন অ্যাসবেস্টস, এই সেদিন অতগুলো টাকা দিয়ে করালাম। যদি নয়ছয় কিছু হয়ে যেত, বড় ধাক্কা আসত গো একখানা! ঠাকুর বাঁচিয়েছেন।”
একটু পরে আবার ফোন। এক ছাত্রের মা।
“দিদিমণি ঠিক আছে তো সব? দরকার লাগলে বলবেন, সোম আর ওর বাবাকে পাঠাব। ঝড় যদিও তেমন কিছু হল না আপনাদের আশীর্বাদে, এযাত্রা সব টিকে গেল। ঠাকুর রক্ষে করেছেন!”
ঐ তিন বাড়ি থেকে উঠে আসা মিলিত সুঘ্রাণ কখন যেন আমার দোতলার সবক’টা ঘরেই মায়াজাল ছড়িয়ে ফেলেছে, তাতে বন্দী হয়ে পড়েছে থালায় রাখা রুটি আলুভাজা, আর ফোনের ক্যামেরা চালু রাখার সেই বেপরোয়া ইচ্ছেটা।