হাতি শুঁড় তুলে বলল, "ঝগড়া থামাও সবাই। বাঘ, সিংহ, কারো রাজা হয়ে কাজ নেই। চিতল হরিণকে রাজা করা হোক।”
কয়েক মূহূর্তের স্তব্ধতা। তারপর বাঘ বলল, “রাজি। সিংহ না হলেই হল।”
সিংহ--"বেশ, আপত্তি নেই।"
লাফিয়ে উঠল সম্বর, “খুব ভালো প্রস্তাব। জঙ্গলের প্রথম তৃণভোজী রাজার জয় হোক।”
অন্যেরা--“অসাধারণ, অবিস্মরণীয়। ওকে সিংহাসনের কাছে নিয়ে যাও।"
*******************************************
চিতল গিয়ে দাঁড়াল হ্রদের ধারে। ভোর হয়ে আসছে। কচি ঘাসগুলোর চোখে শিশিরের অশ্রু। জলে আলোর মায়া। ওপারের ঘাসজমিতে মৃত্যুর বাস।
কুয়াশা ছিঁড়ে গলা তুলল চিতল, “স্মরণীয় হতে চাই না। অসাধারণত্বও লাগবে না। আমি ঘাসে-জলে- মৃত্যুভয়ে সাধারণ থেকে যেতে চাই চিরকাল।”
তারপর পরম নিশ্চিন্তে জলে মুখ দিল।
সুষমা রোজ খাঁচাটাকে গড়ে উঠতে দেখেন।
জানলা দিয়ে দেখেন দিনে দিনে তৈরি হচ্ছে খাঁচাটা।
এখনকার চেয়ে বড় হলেও খাঁচা তো! সুষমা ভাবেন।
সুষমা ভাবেন, মনোজ বলেছিলেন, "সু, টাকাকড়ি, সম্পত্তি তো তেমন রেখে যেতে পারলুম না। তবে আকাশ-বাতাস দিয়ে গেলুম অনেকটা করে।”
ছাদে দাঁড়িয়ে বলতেন মনোজ, উঠোনে দাঁড়িয়ে বলতেন।
বলতেন, "ধরো, এই তোমার সম্পত্তি।”
কই! সে সম্পত্তি সুষমা ধরে রাখতে পারলেন কোথায়! হারিয়ে ফেললেন তো ছেলের আবদারে।
আকাশ-বাতাস, ছাদ, উঠোন হারিয়ে উঠে এলেন তো এই ছোট্ট খাঁচায়! আসতে হল।
সুষমা রোজ খাঁচাটাকে গড়ে উঠতে দেখেন।
জানলা দিয়ে দেখেন দিনে দিনে তৈরি হচ্ছে খাঁচাটা।
এখনকার চেয়ে বড়, নতুন, তবু খাঁচা তো! সুষমা ভাবেন,
রোজ,
একমনে,
একা।
"শোন না!"
"হ্যাঁ, বল।"
"আমার হার্টের তো খুব অসুখ।"
"সে কি? কী হয়েছে?"
"আরে এমনিতে অসুবিধা নেই কিছু, বুঝলি! শুধু থেকে থেকে..."
"কী হয়?"
"কী হয় বলতে, থেকে থেকেই..."
"হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ, থেকে থেকেই...বলো, শুনছি।"
"থেকে থেকেই তোর দিকে ছুটে যেতে চায়।"
"ধ্যাৎ!"
পাতাটা রাইয়ের নখের ডগায় এসে মুখ গুঁজল। রাই জানত। জানত যে শুকিয়ে কুঁচকোতে শুরু করা এই পাতা তাকে ছুঁয়েই শান্ত হবে। তাই-ই হয়। কৌশানি হোক বা কলকাতা, ঝরে যাওয়ারা বন্ধু ভাবে তাকে।
কতবার হয় কলকাতাতে, কোত্থাও কিছু নেই, হঠাৎ একটা হাওয়া দলছুট হয়ে আলতো বসে তার গালে। রাই একটাও কথা বলে না হাওয়াটার সঙ্গে, বুঝতেই দেয় না যে সে আসাটা টের পেয়েছে, শুধু সে রাতের মতো ওর সঙ্গে বিষণ্ণতা মাখামাখি করে শুয়ে পড়ে।
রাই দেখেছে, শেষ কয়েক বছর, সে মানুষের থেকে যত সরে বসেছে, টুকরোটাকরা ভালোলাগা পাতা, হাওয়া, আলো, অন্ধকার হয়ে তত ঘেঁষে এসেছে তার দিকে। তবে কি ওরাও ততটা পছন্দ করে না মানুষ আর মানুষের সভ্যতাকে? ওদেরও দমবন্ধ হয়ে আসে, রাইয়ের মতোই? কে জানে!
শুকনো পাতাটা এবার টানছে রাইকে পশ্চিমের খাদের ধারে। কেন, রাই জানে। ওখানে মৃত্যু আর সূর্যাস্তের আলো এখন পাশাপাশি হাত ধরে। রাই খাদের কাছে দাঁড়াল। চলে যেতে যেতে শেষ আলো প্রথম আলোর প্রতিশ্রুতি রেখে যাচ্ছে পৃথিবীর ঘাসে ঘাসে, তিরতিরে নদীতে, ঠিক যেভাবে কবিতাকে কথা দেয় ভালোবাসা। রাই সে ভালোবাসা চোখে ধরে নিতে নিতে অনুভব করল শুকনো পাতাটা হারিয়ে যাচ্ছে নিচের কালো খাদে, যেন ওটুকুই কাজ বাকি ছিল ওর, ওই রাইকে সূর্যাস্ত অবধি পৌঁছে দেওয়াটুকুই। রাই ধরবার চেষ্টা করল না পাতাটাকে, যেতে দিল, শুধু অবসৃত আলোর মায়ায় জড়িয়ে যেতে লাগল তার অস্ফুট কন্ঠস্বর, "বাসাংসি জীর্ণানী যথা বিহায়...।”