• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • ভাগ্যকণা : রিঙ্কি দাস

    শেষ রাতে ঘুমের ঘোরে একটা অদ্ভুত শব্দ কানে বাজল। ঝুমঝুম ঝুমঝুম… রুমঝুম ঝুমঝুম! মিষ্টি, কিন্তু অচেনা আওয়াজ।

    বেডসাইড টেবিলে রাখা অ্যালার্মঘড়িতে দেখলাম, রাত ঠিক সাড়ে তিনটে। কিন্তু আওয়াজ নির্ভুল। ঝুমঝুম, ঝিনিক ঝিনিক। একটু যেন হাসিও মেশানো তার সঙ্গে।

    গরম পড়েছে জাঁকিয়ে। তাই বারান্দার দরজা খুলে ঘুমিয়েছিলাম। আওয়াজটা ওদিক থেকেই।

    ভূত? অলৌকিক কিছু? ধুর, ওসব বাজে কথা। নেই নেই করে নতুন পাড়াটা গত পাঁচ বছরে পুরোনো পাড়া হয়ে গেছে, একটা তিনতলা বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকি আমরা। আমি, মা-বাবা, ছোট ভাই। আর ঠাকুমা। যিনি কিনা গত এক মাস ধরে একটা নার্সিং হোমে ভর্তি।

    গত ক’বছরেই এ পাড়ার আশপাশে অনেক নতুন ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে, অত্যাধুনিক সেসব কমপ্লেক্সের মধ্যে জিম, সুইমিং পুল, ক্লাবহাউস… তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমাদের অপেক্ষাকৃত পুরোনো বাড়িটাও এ বছর রং করানো হয়েছে, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া শপিং মল, ক্যাফে, আইসক্রিম পার্লার...এই আলো-ঝলমলে চাকচিক্যের মধ্যে কখনো ভূত টেকে?

    আমি মশারি থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালাম। দেখি তিনজন ঘোমটা দেওয়া বউ, পায়ে রুপোর মল ঝমঝমিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সামনের রাস্তা দিয়ে।

    আহা, এটাই তবে ঝুমঝুম! নূপুর বা মল পায়ে কাউকে হাঁটতে দেখিনি, তাই আওয়াজটা চট করে চিনতে পারিনি। কিন্তু এই নিশুত রাতে এই তিনমূর্তি কে?

    আবার মনটা কু গাইল। ভূত, পেত্নী, শাকচুন্নি, ভ্যাম্পায়ার! দিদুনের গল্পে শোনা নিশির ডাক দিয়ে মানুষ-মেরে-ফেলা রূপসী ভূত! ধুর, ওসব গালগল্প। এরা নিশ্চয় চোর।

    কিন্ত চোর কি আলো নিয়ে বেরোয়? এমন শব্দ করে খিলখিল হেসে হেঁটে বেড়ায়? এক জনের হাতে লন্ঠন, দুজনের হাতে বস্তাগোছের ব্যাগ আর ঝাঁটা। সাতসকালে সুইপার যা নিয়ে রাস্তা ঝাঁট দেয়, সেরকম কাঠির ঝাঁটা। একজন আলো ধরছে, অন্য দুজন রাস্তা ঝাঁট দিয়ে কীসব জড়ো করে বস্তায় ঢুকিয়ে নিচ্ছে! নিজেদের মধ্যে অবিরাম গালগল্প চলছে তার সঙ্গে, আর পায়ে পায়ে ঝমঝম।

    আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলোর দিকে তাকাই।

    সব্বাই নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে চুর হয়ে আছে, শেষ প্রহরে ওয়াচম্যানগুলোও বোধ হয় নাক ডাকাচ্ছে, এই তিন রমণীর কলকাকলিতে আমার মত কারুর ঘুম ভেঙে যায়নি।

    কী মনে হলো, হাঁক পাড়লাম একতলার গ্রিল দেওয়া বারান্দা থেকে।

    "কে হে তোমরা? রাতবিরেতে আলো নিয়ে ঝাঁটা নিয়ে এ পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?"

    ওরা ওপরে তাকায়। লণ্ঠনের আলোয় বেশ মিষ্টিমিষ্টি হাসি মুখ, কাজলপরা চোখ, পাট করে আঁচড়ানো চুল। একজন হেসে বললো, "খুকি, তুমি এই রাতবিরেতে জেগে কী করছ?"

    খুকি!! ক্লাস নাইনে পড়ি, কদিন পরেই আই সি এস ই পরীক্ষা দেব, ক্লাসে প্রতিবছর ফার্স্ট হই, চা-ওমলেট-ম্যাগি বানাতে পারি, স্কুলের জামার বোতাম ছিঁড়ে গেলে স্টেপলার দিয়ে "ম্যানেজ" করতে পারি, একটু-আধটু সেতার বাজাতে জানি, এই ঝাড়ুদারনিগুলো কিনা আমায় বলে খুকি!

    তেতো মুখে গ্রিলের গেট খুলে বেরিয়ে এলাম আমি। একটু পা টিপে টিপেই বেরোলাম, মা যদি জানতে পারে এত রাতে সদর দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়েছি তাহলে নির্ঘাত হার্টফেল করবে।

    নাহ্, চোরছ্যাঁচড় যাই হোক না কেন, তিন সখীর পালানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। বরং আমাকে দেখে বেশ মজা পেয়েছে মনে হলো।

    আমি কোমরে দুহাত রেখে গলায় যথাসাধ্য গাম্ভীর্য এনে জিজ্ঞাসা করলাম, "ঠিক করে বলো তোমরা কে। এতরাতে এ তল্লাটে কী করতে বেরিয়েছ?"

    হেসেই বাঁচে না বউগুলো। একজন ঝাঁটা দেখিয়ে বলে, "এই তো, রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছি।"

    "আমি জানি ওটা ছদ্মবেশ। রাত তিনটের সময়ে মিউনিসিপ্যালিটির লোকে কাজে বেরোয় না। তাদের বাঁধা সময় আছে। আসল মতলবটা কী?"

    তিনজন একটু নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে নিল। একজন বললো, "নিয়তি ঠাকুরানীর কাজ। আমাদের কি দিন রাত্তির মানলে চলে?"

    "নিয়তি? ইনি আবার কে? এ পাড়ায় নতুন?"

    "নতুন কেন হতে যাবেন গো! বয়স্ক মানুষ, আমাদের মা ঠাকুরমার চেয়েও বড়ো। ওঁর বয়সের কোনো গাছপাথর নেই!"

    আবার হেসে কুটিকুটি হয় বউগুলো! ভেবে কূল পাই না, আধময়লা শাড়ি পরে নিশুতি রাতে যাদের রাস্তা সাফ করতে বেরোতে হয়, তাদের এত হাসির উৎস কোথায়! তাও নাকি কোন বুড়ির আন্ডারে কাজ করে! এদের মা-ঠাকুমার চেয়ে বড় মানে তো অনেক বয়স! নির্ঘাত তিনি খুব গোমড়ামুখো, সব চুল সাদা, সব দাঁত বাঁধানো! গেঁটে বাত, সুগার প্রেসারে ভুগে কাহিল হন, লাঠিতে ভর দিয়ে কিংবা হুইলচেয়ারে বসে চলাফেরা করেন আর আধিব্যাধির জ্বালায় মেজাজ গরম করে অধস্তন কর্মচারীদের খুব বকাঝকা করেন!

    "তা তোমাদের এই নিয়তিবুড়ি নিজের বাড়ি ছেড়ে রাস্তার আবর্জনা সাফ করানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন কেন?"

    "ছি ছি, খুকি, ওঁকে এভাবে বুড়ি বুড়ি বলতে নেই! দুনিয়ার ভাগ্যের ঝাঁপি সামলাতে হয়, তার জন্য বহু বছরের অভিজ্ঞতা চাই, এসব কি কচিকাঁচাদের কম্ম?"

    আবার খিলখিল হাসি! বিরক্তিকর!

    লন্ঠনওয়ালী এতক্ষণ চুপচাপ ঝাড়ুওয়ালীদের বকবকানি শুনছিল, এবার বলল, "আহা সবাই যেন নিয়তি ঠাকরুনের গল্প জেনে বসে আছে! রাজ্যের বই পড়ে বিদ্যেদিগগজ হয়ে বড়োরাই মানতে চায় না, এ তো বাচ্চা মেয়ে, এর আর কতটুকু জ্ঞান?"

    "আমি বোকা বা বাচ্চা দুটোর কোনোটাই নই। আমি ফার্স্ট হই। গত চার বছরে একটা সাবজেক্টেও কেউ আমায় হারাতে পারেনি।"

    এটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ইস্কুলে এই মুহূর্তে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সেটা সত্যি ... তবে কদিন আগে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য যে টিউটোরিয়াল হোমে ভর্তি হয়েছি, সেখানে একটা নতুন ছেলে ঢুকেছে। অরিন্দম মিত্র। চ্যাপ্টা নাক, সাদামাটা চেহারা, কথাবার্তাও বলে খুব কম। কিন্তু পড়াশোনায় যাচ্ছেতাই রকমের তুখোড়। অঙ্ক, সায়েন্স, সংস্কৃত, ইংরেজি সবেতেই ফুল মার্কস। টিউটোরিয়ালের পরীক্ষায় আর কিছুতেই সেরার শিরোপা ধরে রাখা যাচ্ছে না, আমার রেকর্ড নিয়ে আমি আপাতত খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।

    লন্ঠনধারিণী তখনও বকে চলেছে, "প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে নিয়তি ঠাকরুন মুঠো মুঠো ভাগ্যকণা ছড়িয়ে দেন পৃথিবীতে। সবার কপালেই জুটে যায়, কেউ বেশি পায়, কেউ কম। কেউ কাজে লাগায়, কেউ ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করে। দিনের শেষে যেটা খরচ হয় না, আশপাশে পড়ে থাকে, আমরা রাস্তা থেকে ঝাঁট দিয়ে বস্তাবন্দী করে নিয়ে যাই। ঠাকরুন ফিরিয়ে নেন। তবে হ্যাঁ, সূর্য ওঠার আগে কাজটা শেষ করতে হয়। ভাগ্য বড় দামি জিনিস গো খুকুমণি, রাস্তায় ধুলোয় মিশিয়ে ফেলে ছড়িয়ে অপচয় করার জো নেই।"

    চোখ কটমট করে তিনমূর্তির দিকে তাকাই।

    "ফাজলামি হচ্ছে? রাস্তার ধুলোর মধ্যে ভাগ্য মিশে আছে? আর এমনি ধুলোর থেকে ভাগ্যধুলো তোমাদের ম্যাজিক ঝাঁটা দিয়ে আলাদা করা যায় বলতে চাইছ? সেটা তোমরা ঝাঁট দিয়ে কাছিয়ে তুলে বস্তায় ভরছ?"

    "একদম ঠিক!" ঝাড়ুধারিণী নাম্বার ওয়ানের মুখে প্রশস্ত হাসি ফোটে। "তুমি ছোট্ট হলেও তোমার খুব বুদ্ধি। কেমন টুক করে এমন একটা খটোমটো জিনিস বুঝে ফেললে!"

    সত্যি বুঝে ফেললাম। একদম জলবৎ তরলং। এরা চোর ভূত কিডন্যাপার কিছুই নয়। এরা স্রেফ পাগল। এখান থেকে তিন স্টপেজ পর একটা মেন্টাল হসপিটাল আছে, এরা নিশ্চয়ই সেখানকার পেশেন্ট। কোন ফাঁকে পাহারা এড়িয়ে পালিয়ে এসেছে!

    সব বুঝতে পেরেও তালে তাল মেলালাম তিন বউয়ের সঙ্গে। "তা এই ভাগ্যধুলোর যখন এত দাম, তোমাদের নিয়তিবুড়ি এসব রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে রাখেন কেন? যাকে পছন্দ তাকে হিসেব করে এক চিমটে দিলেই ঝামেলা শেষ, তোমাদের আর রাতবিরেতে ঝাঁটা নিয়ে বেরোতে হয় না!"

    "ওটা বোঝা বড় শক্ত খুকুমণি!" বিজ্ঞের মত হাসে দ্বিতীয় ঝাড়ুদারনি। "আলগাভাবে ছড়িয়ে দিলে সবাই একটু একটু পাবে, কপাল বুঝে কেউ কম কেউ বেশি পাবে, আর কেউ নালিশ করতে পারবে না যে নিয়তি মা তাকে জেনেশুনে কম দিয়েছে, অন্য কাউকে বেশি দিয়েছে!কেউ হয়তো ধুলো জমিয়ে জমিয়ে চড়া দামে কেনাবেচা করবে। মানুষগুলো বড্ড লোভী, ভাগ্য কেনাবেচা শুরু হলে কালোবাজারিটা কোন পর্যায়ে যাবে ভেবে দেখেছ? ওসব বড়ো ঝামেলার ব্যাপার। তার চেয়ে এই বেশ, কেউ জানলো না কে কত পেল, নিয়তি ঠাকরুনও জানলেন, ইচ্ছে করে কাউকে কম দেওয়া হয়নি। সারা দিন যে যেমন পারল তার ভাগের ভাগ্যটুকু খরচ করল, বাকিটুকু আমরা ঝেড়েবেছে ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম! দিনের কাজ শেষ, পরের দিন আবার নতুন হিসাব।"

    রাত্রিশেষে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা আকাশে। একটা সাইরেন গোছের শব্দ হঠাৎ ভেঙে দিল সব নৈঃশব্দ্য। মনে হলো দুর থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স জাতীয় গাড়ি ধেয়ে আসছে এদিকে। ওই মেন্টাল হসপিটালের গাড়ি নয় তো?

    ত্রয়ীর মধ্যেও একটু চাঞ্চল্য চোখে পড়ে।

    লন্ঠনওয়ালী বলে, "ভোর হয়ে এল বলে। আমাদের তো এবার যেতে হয়!"

    এক ঝাড়ুওয়ালী আমার হাতটা টেনে নেয়। বস্তার ভেতর থেকে এক খাবলা ধুলোবালি বার করে আমার মুঠোয় পুরে দেয়। ফিসফিস করে বলে, "এভাবে বিলিয়ে দেওয়ার নিয়ম নেই, জানো? তবু তোমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল, তাই এটুকু দিয়ে গেলাম। এই একমুঠো ভাগ্যকণায় তোমার সারাজীবন চলে যাবে, সাবধানে খরচ করলে তোমার ছেলেমেয়েদের জন্যও থেকে যাবে।"

    এরপর তিনজন লন্ঠন, ঝাড়ু আর বস্তা নিয়ে দৌড় লাগাল রাস্তার ও মাথায়! পায়ে জোর আছে বটে, এক ছুটে কেমন যেন নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। অ্যাম্বুলেন্সটা সত্যি ওই মানসিক রোগীদের হাসপাতাল থেকেই এসেছে, এক মুহূর্ত আমার সামনে থামল, আর ড্রাইভার গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, "মামণি, তিনজন ভদ্রমহিলাকে দেখেছ নাকি? খুব অদ্ভুত কথাবার্তা বলে, আর কারণে অকারণে হাসে? দেখোনি? কী মুশকিল বল তো, হাসপাতালে স্পেশাল ওয়ার্ডে ছিল, গতরাতে তিনজনেই পালিয়েছে।"

    আমি এদের কিছু বললাম না, শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। তারপর সদর দরজা আটকে ঘরে এসে ধুলোগুলো ঝেড়ে ফেলে দিলাম ডাস্টবিনে। রাস্তার ধুলো, নির্ঘাত জীবাণুও রয়েছে নানারকম, খুব ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললাম। অনেক ধুয়েও হাতটা কেমন যেন কুটকুট করছিল, মনে হচ্ছিল কিছুটা ধুলো এখনও হাতে লেগে রয়েছে।

    বউগুলোর মুখ ভুলতে পারছিলাম না কিছুতেই। ওরা কি সত্যি ধরা পড়ে গেল? হাসপাতালে থাকলে কি ওরা খুব কষ্ট পায়? ওদের কি বেঁধে রাখা হয়, শক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়? কী সুন্দর হাসিমুখ, কী আন্তরিক কথাবার্তা, হলোই বা একটু পাগলি!

    সেদিন টিউটোরিয়ালে দুটো পরীক্ষা ছিল। দুটো পেপারই খুব কঠিন। আমাদের রেগুলার স্যারকে হঠাৎ ছুটি নিতে হয়েছে, পেপার সেট করেছেন এক কলেজের প্রফেসর, তাই কয়েকটা প্রশ্ন সিলেবাসের বাইরে। আমার সিলেবাসের বাইরে পড়ার অভ্যেস আছে, কেমন করে যেন সেদিন আমি দুটো পরীক্ষাতেই হায়েস্ট পেয়ে গেলাম। অরিন্দমের থেকে বেশ কিছু নম্বর বেশি। সেই প্রথম, সেই শেষ! টিউটোরিয়াল সেরে নাকেমুখে গুঁজে ইস্কুলে আসার পর ক্লাসের বন্ধুরা বলল, আমায় নাকি ফ্যাব লাগছে। সেই একই ইউনিফর্ম, এক চশমা, তাড়াহুড়োয় চুল বাঁধা হয়নি, লুজ হেয়ার লুক নাকি আমার জন্যই তৈরি! একটা ক্লাস সিক্সের মেয়ে, কী মিষ্টি, সে এসে আমায় বলে ফেলল, ‘দিদি, তুমি কী সুন্দর! একদম ক্যাটরিনা কাইফ!” বোঝো ঠেলা! বড়োসড়ো প্রাপ্তি নয়, তবে সমস্ত দিন ধরে অজস্র মিষ্টি মিষ্টি ভালো লাগা! স্কুল থেকে ফিরে মায়ের বানানো প্যাটিস আর কোল্ড কফি খেয়ে যখন সেতারের ক্লাসে ঢুকলাম, তখনও সমস্ত শরীরমন জুড়ে সেই অবিমিশ্র ভালো লাগা। হোমওয়ার্ক ছিল রাগ ইমন। সেতারের ক্লাসে আমার ম্যাম বলল, দারুণ বাজাচ্ছি, তানগুলো অসম্ভব সাবলীল, দু-একটা বেশ জটিল তানও নিজে বানিয়ে বানিয়ে মিশিয়ে দিলাম, ম্যাম একেবারে ফিদা! এভাবে রোজ বাজালে নাকি একদিন ভালো শিল্পী হতে পারব। আমার সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে সেদিন শুধু একটা আনন্দের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। ঠিক ওদের নূপুরের ঝিনিক ঝিনিকের মত! আর এতেই শেষ নয়! সেতারের ক্লাস থেকে ফিরে শুনলাম, হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে, যে আমার ঠাকুমা, যিনি কিনা অনেকদিন কোমায় ছিলেন, সেদিন একটু আগে তাঁর জ্ঞান ফিরেছে, জড়িয়ে জড়িয়ে একটু কথাও বলছেন। অদ্ভুত সুন্দর একটা দিন বটে। এক সঙ্গে যেন কোথাও একটা সুখবরের ফ্লাডগেট খুলে গেছে, যেখান দিয়ে ছোট বড়ো বিভিন্ন আনন্দসংবাদ এসে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমাকে!

    এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। নাহ্, সে দিনটা ক্ষণকালের গণ্ডি পেরিয়ে চিরকাল হয়ে উঠতে পারেনি। আমি তেমন কেউকেটা কিছু হইনি। অবশ্য খুব খারাপও নেই, একটা বেশ নামী বহুজাতিক সংস্থায় মিডল ম্যানেজমেন্ট লেভেলে কাজ করি। পে প্যাকেজ যথেষ্ট ভালো। কেরিয়ারকে ভালবেসেছি, তাই সেদিকটার কথা ভেবে বিয়ে করিনি। দৈনন্দিনের জাঁতাকলে ভালোয় মন্দয় মিশিয়ে দিন কাটে। ডেডলাইন থাকে, থাকে ক্লায়েন্টদের চোখরাঙানি। প্রতিদিন নিজেকে প্রমাণ করার জন্য, পরবর্তী প্রমোশনের জন্য প্রাণপাত খাটি, কাজকর্ম নিয়ে টেনশনও করি খুব। সেতার নিয়ে বসার সময় হয় না আর, ওটা শোপিস হয়ে পড়ে থাকে বসার ঘরের এক কোনায়। আমার সেই টিউটোরিয়ালের সহপাঠী অরিন্দম এখন একজন নামী মহাকাশবিজ্ঞানী। একবার টিভিতে একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছিল, জীবনে একবার ক্লাস নাইনের দুটো টিউটোরিয়ালের পরীক্ষায় ছাড়া কোনোদিন নাকি সে সেকেন্ড হায়েস্ট মার্কস পায়নি! এটাকে কি আমার কৃতিত্ব বলে দাবি করা যায়? ধুর, একটা জীবনে ওই তাৎপর্যহীন পরীক্ষার আর কী দাম! ওই যে বলছিলাম, জীবন সম্পর্কে অভিযোগ করার মতো কিছুই নেই। তবে কখনো কখনো সমস্ত যুক্তিবোধ ছাপিয়ে প্রশ্ন জাগে, আমার বাকি জীবনের প্রতিটা দিন কি অন্যরকম হতে পারত? ঠিক সেই বিশেষ দিনটার মত?

    আমি একটু ইনসোমনিয়ায় ভুগি আজকাল। এক-এক দিন রাত তিনটের সময়ে ঘুম ভেঙে যায়, বিছানায় ওলটপালট করি কিছুক্ষণ। তারপর এক কাপ কফি নিয়ে বারান্দায় এসে বসি। আমার বর্তমান ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে এখনও স্পষ্ট দেখা যায় বড়ো রাস্তা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে আর কোনো হাসিমুখো ঝাড়ুদারনির দেখা মেলে না।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments