কস্তুরী আর চন্দন মেশানো গন্ধ…দেবদারু গাছের পিছনে লুকোচুরি খেলছে চাঁদ…
প্রণয়চিহ্ন দিচ্ছেন, নাকি উৎকোচ?
স্মৃতির বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে কথাগুলো গড়িয়ে এল। হেমন্তের ঘোর-লাগা অন্ধকারে যেন স্বপ্ন বলে মনে হয়। সেনাপতি সুসীম উত্তরীয়র প্রান্তভাগ চেপে ধরলেন। না, স্বপ্ন নয়। সত্যি। ঘরের কোনায় জ্বলা প্রদীপের শিখার মতো অপরিবর্তনীয় বাস্তব। হাত বাড়ালে আগুনের উত্তাপও অনুভব করা যায়।
কুয়াশা ধীরে ধীরে আকাশপ্রদীপের আলো ঢেকে দিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সেনাপতি ভ্রুকুটি করলেন।
“আকাশপ্রদীপের আলো দেখছ?”
ঘরের বাইরে থেকে অভিজাত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সুসীম এক মুহূর্তের জন্য স্থির রইলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন।
“মহারাজ, আপনি?”
রাজা মহেন্দ্র সেনাপতির ঘরে ঢুকে এলেন।
“ওরকম আনমনা হয়ে কী দেখছিলে, সুসীম?”
“ভাবছিলাম, আকাশপ্রদীপের আলো আজ কার আত্মাকে পথ দেখিয়ে আনবে…”
রাজার ঠোঁটের প্রান্তে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
“যদি বলি, প্রথম যাকে হত্যা করেছিলে তার?”
“সে বেচারা কোন হতভাগ্য ছিল আজ আর মনেও নেই।”
“…যুদ্ধের কথা বলছি না…”
মুহূর্তের জন্য সেনাপতির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
“গত পনেরো বছর ধরে তুমি তারই অপেক্ষায় বসে আছ। কিন্তু আজও সে তোমার ডাকে সাড়া দিল না।”
রাজা মহেন্দ্র গদির আসনে বসে পাশের দিকে ইঙ্গিত করলেন।
“বসো।”
রাজধানীতে নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও রাজার আদেশে প্রাসাদের একটা ঘর সুসীমের জন্য বরাদ্দ আছে। যদিও সুসীম কদাচিৎ সেই ঘরে থেকেছেন।
“যুদ্ধের ব্যাপারে আমি আশাবাদী,” রাজা মহেন্দ্র মাথা হেলিয়ে সুসীমের দিকে তাকালেন। “গুপ্ত ঘাতকদের পাঠিয়ে শত্রুর শিবিরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সফল হবে বলে মনে হয়। তা ছাড়া, তোমার মতো প্রধান সেনাপতি থাকলে আমাদের জয় নিশ্চিত।”
সুসীম মাথা নীচু করলেন।
“যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
মহেন্দ্র নিজের সুন্দর আঙুলের ডগা দিয়ে সুসীমের চিবুক তুলে ধরলেন।
“পঁচিশ বছর আগে হেমন্তের সকালে যখন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম, তখন জানতাম না এই আদিত্য সাম্রাজ্য এক রত্ন পেতে চলেছে।”
পঁচিশ বছর আগে হেমন্তের সকাল…
থামাও! পালকি থামাও!
রাজ্যের জন্য রত্ন খুঁজে আনার ক্ষমতা তাঁর মতো কারও ছিল না। শুধু একবার ভুল হয়ে গিয়েছিল।
তোমার প্রথম গুপ্তহত্যার পুরস্কার।
সুসীম চোখ বন্ধ করে নিলেন।
****
পনেরো বছর আগের কথা।
গোটা রাজধানী রাজা মহেন্দ্রর রাজ্যাভিষেকের আনন্দে মত্ত হয়ে আছে। শুধু অন্তঃপুরের একটা বিশেষ ঘর থেকে দীপক রাগের সুর ভেসে আসছে। কেউ নিপুণ হাতে বীণায় তান তুলছে। ঠান্ডা চাঁদের আলোর নীচে চকচকে ধারালো তলোয়ারের মতো নির্মম, নির্ভুল সুর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
সেনাপতি সুসীম গুপ্ত দরজার পিছনে অপেক্ষা করে আছেন। বীণার স্বামিনী কি তাঁর উপস্থিতি টের পেয়েছেন? তাই কি তানগুলো বরফ-ঠান্ডা হাতে তাঁর গলা টিপে ধরছে? অথবা হয়তো সবটাই তাঁর মনের ভুল।
মূর্ছনার শেষে ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা। তারপর,
“ভিতরে এসো।”
স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো কণ্ঠস্বর। ঝাপসা হয়ে আসা হেমন্তের ভোরের কথা মনে করিয়ে দেওয়া মেদুর কণ্ঠস্বর।
সুসীম দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন।
আকাশে বসন্ত পূর্ণিমার চাঁদ। তার ঠিক নীচেই, খোলা জানলার সামনে কারুকার্য করা কাঠের আসনে বসে রাজকন্যা চন্দ্রিকা। সুসীমকে দেখে তিনি কোলের বীণা নামিয়ে রাখলেন। তারপর চোখের ইশারায় নিজের আসনের দিকে ইঙ্গিত করলেন। যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো সুসীম আজ্ঞার পালন করল।
“তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
সুসীমের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
“কেন আসতে হয়েছে, তাও নিশ্চয়ই জানেন?”
“অনুমান করা কঠিন নয়।”
সুসীম নিজের বুকের উপর দু'হাত ভাঁজ করে নিলেন। যেন রাজকন্যার বিরুদ্ধে ঢাল তৈরি করছেন।
“আপনার বড় ভাই, যুবরাজ সুরসেনের হত্যাকারীদের বিচার শেষ হয়েছে। দোষীদের শাস্তিবিধান হয়েছে। কিন্তু সন্দেহের আঙুল আরেকজনের দিকেও ঘুরেছে। তার বিচার করা বাকি আছে।”
চন্দ্রিকার সুন্দর ভুরুতে সামান্য তরঙ্গ উঠল।
“ওহো! আরও একজন চক্রান্তকারী?”
“উপহাস করছেন?”
চন্দ্রিকা সুললিত ভঙ্গিতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঘরের একপ্রান্তে রাখা মদ আর দুটো রুপোর পাত্র নিয়ে এলেন।
“আমার পরিচারিকাদের রাজ্যাভিষেকের উৎসবে পাঠিয়েছি, তাই আজ আমার আপ্যায়নেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।”
নিয়ম অনুযায়ী রাজকন্যারও উৎসবে যোগদান করার কথা।
চন্দ্রিকা একটা পাত্রে মদ ঢেলে সুসীমের দিকে এগিয়ে দিলেন। সুসীমের হাত সামান্য কেঁপে গেল।
“ভয় নেই, পাত্রে বিষ মেশাইনি।”
“…সেই ভয় আমার একেবারেই নেই।”
সুসীম রাজকন্যার হাত থেকে সুরাপাত্র নিয়ে নির্দ্বিধায় চুমুক দিলেন।
“এবার বলো, কোন নতুন ষড়যন্ত্রীর খবর পাওয়া গেছে?”
সুসীম একটু সময় নিয়ে নিজের বক্তব্য গুছিয়ে নিলেন।
“ঘটনার পরম্পরা আপনার অজানা নয়। আজ থেকে ছ'মাস আগে সামন্তরাজ হরিসেন যুবরাজ সুরসেনকে তাঁর প্রাসাদে আমন্ত্রণ করেন। যুবরাজ সেখানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান। যুবরাজের অঙ্গরক্ষক ছাড়া কোষাধ্যক্ষ রাধাগুপ্ত আর অমাত্য বজ্রবাহুও সেখানে যান। কেউ জানত না, কিন্তু ইতিমধ্যে বজ্রবাহু যুবরাজকে হত্যা করার জন্য গুপ্ত আততায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কোষাধ্যক্ষ রাজকোষ থেকে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা অপসারণ করে তাদের এই কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। হত্যার রাত্রে রাধাগুপ্ত যুবরাজের খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে চলচ্ছক্তিহীন করে দেন, যাতে তিনি অঙ্গরক্ষকদের ডাকতে না পারেন। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে হরিসেন আততায়ীদের গোপন পথে নিয়ে এসে কাজ সম্পন্ন করেন।”
চন্দ্রিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
“এরকমই শোনা গেছে।”
“সামন্তরাজা হরিসেন, কোষাধ্যক্ষ রাধাগুপ্ত, অমাত্য বজ্রবাহু – প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন যে রাজকুমার সুরসেনকে হত্যার চক্রান্ত তাঁরাই করেছেন। কিন্তু…”
“কিন্তু?”
সুসীম ভ্রুকুঞ্চন করলেন।
“হিসাবে কোথাও গণ্ডগোল হচ্ছে।”
“অর্থাৎ?”
“তথ্যের বিচার করলে আমরা দেখতে পাই, রাজা হরিসেন চিরকাল মদের শৌখিন। গত বছর তিনি যখন রাজধানীতে এসেছিলেন, তখন অন্তঃপুর থেকে তাঁর জন্য এক বিশেষ মদের আয়োজন করা হয়, যার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। নিজের রাজ্যে ফেরার সময় এই মদ প্রচুর পরিমাণে তাঁকে যৌতুকে দেওয়া হয়েছিল। রাজ্যে ফিরে তিনি রোজ এই মদ পান করতে শুরু করেন, এবং তাঁর আসক্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শেষে এমন অবস্থা হয়েছিল, যে একদিনও মদ ছাড়া থাকলে তিনি পাগলের মতো হয়ে যেতেন।”
রাজকন্যা নিজের হাতের উপর চিবুক রাখেন।
“খুবই দুঃখের কথা। হরিসেন যখন এখানে এসেছিলেন তখন পিতা মহারাজের আদেশে আমি তাঁর আদরযত্নের ব্যবস্থা করি। তাঁকে আমাদের ভাণ্ডারের শ্রেষ্ঠ সুরা দেওয়া হয়, এবং যেহেতু তিনি এই সুরার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাই তাঁকে সেই সুরা যৌতুকেও দেওয়া হয়। তখন জানতাম না, পরবর্তীকালে সুরার কারণে তাঁর এই অবস্থা হবে।”
সুসীমের ভ্রুকুটি গভীর হল।
“রাজা হরিসেন বহুকাল যাবৎ সুরাপানে অভ্যস্ত। কোন সাধারণ সুরায় তিনি এতটা আসক্ত হয়ে পড়বেন, এটা মানতে আমার অসুবিধা হয়। আমার অনুমান, এই সুরায় এমন কিছু ছিল যা মানুষকে সহজে বশ করে ফেলতে পারে। যাই হোক, ছ'মাস আগে এই সুরার ভাণ্ডার শূন্য হয়ে যায়। বলা বাহুল্য যে সুরার অভাবে তিনি প্রায় উন্মাদের মতো হয়ে যান। ঠিক সেই সময়ে কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে বলে, যে চাইলে সে অনায়াসে রাজার প্রিয় সুরার ব্যবস্থা করতে পারে। পরিবর্তে রাজা হরিসেনকে একটা কাজ করতে হবে। যুবরাজ সুরসেনকে তাঁর প্রাসাদে ডেকে আনতে হবে, এবং নির্দিষ্ট সময়ে প্রাসাদের গুপ্তদ্বার খুলে দিতে হবে।”
রাজকন্যা চন্দ্রিকার বিশাল চোখ সামান্য বিস্ফারিত হল।
“কে রাজা হরিসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল? এত বড় সাহস কার?”
“সে ব্যক্তি নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিল। রাজা হরিসেন তার সম্বন্ধে কোন তথ্য জোগাড় করতে পারেননি। কিন্তু যে সুরার প্রতিশ্রুতি সে দিয়েছিল, তার ভাণ্ডারের চাবি একমাত্র এই অন্তঃপুরেই আছে।”
“সে ব্যক্তি যে সত্যি বলেছে তার কোন প্রমাণ আছে? অথবা পুরো কথাটাই যে রাজা হরিসেনের কল্পনা নয় তারই বা প্রমাণ কী?”
সুসীম রাজকন্যার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলেন।
“দ্বিতীয় চক্রান্তকারী – কোষাধ্যক্ষ রাধাগুপ্ত। তাঁর মতে, যে বিষ প্রয়োগ করে যুবরাজ সুরসেনকে চলচ্ছক্তিহীন করা হয়েছিল, তা প্রস্তুত করার প্রণালী স্বয়ং রাজকুমারীর কাছ থেকে জানা গেছে। সেও ওই মাস ছয়েক আগে।”
“রাধাগুপ্ত…” রাজকন্যা যেন ঈষৎ ভাবিত হলেন। “স্বভাবতই তিনি এই অন্তঃপুরে প্রবেশ করেননি। তবে তাঁর মেয়ে ইন্দুমতী আমার ছোটবেলার সখী। এখন মনে পড়ছে, কথাপ্রসঙ্গে ইন্দুমতী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, প্রাণঘাতী নয়, অথচ তীব্র বিষ কতরকমের হয়। আমি রাজবৈদ্যর কাছে যেটুকু শিখেছিলাম তা বলেছিলাম। ইন্দুমতী তার বাবাকে সেকথা বলে থাকবে।”
“রাধাগুপ্ত একথাও বলেছেন, যে দেবী ইন্দুমতীর প্রেরণায় তিনি বজ্রবাহুর গৃহে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন। সেখানেই দু'জনের মধ্যে যুবরাজকে হত্যা বিষয়ক পরিকল্পনা হয়েছিল। এসব ঘটনা কি সত্যিই কাকতালীয় হতে পারে?”
“সবই সম্ভব।”
সুসীম আবার মদের পাত্র তুলে নিলেন।
“তৃতীয় চক্রান্তকারী – অমাত্য বজ্রবাহু। যুবরাজ সুরসেন তাঁর পুত্র কুণালকে অপরিণত বয়সে যুদ্ধে নিয়ে যান, এবং সেখানে সে শত্রুর হাতে মৃত্যুবরণ করে। এ হল গত বছরের কথা। মাস ছয়েক আগে এক গণৎকার বজ্রবাহুর বাড়িতে যায়। সে জানায় যে তাঁর পুত্র কুণালের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে, অকালমৃত্যুর জন্য বজ্রবাহুকে অভিসম্পাত করছে। বজ্রবাহুর মতে, এ কথা শুনে তাঁর প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে। তিনি ঠিক করেন, যে তাঁর প্রিয় পুত্রকে এত কষ্ট দেওয়ার পরে যুবরাজের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। সেই কারণেই তিনি হত্যার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন।”
“করে থাকবেন। আমাকে এ কথা জানানোর তাৎপর্য?”
“অমাত্য বজ্রবাহুর বাড়ি যাওয়ার আগে সেই গণৎকারকে অন্তঃপুরে দেখা গিয়েছিল।”
রাজকন্যা অভিজাত ভঙ্গিতে পাশে রাখা ময়ূরপুচ্ছের পাখা তুলে নিলেন।
“এইসব সামান্য ঘটনার ভিত্তিতে তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছ যে আমিই অদৃশ্য চক্রান্তকারী?”
সুসীম ঈষৎ হাসলেন।
“আপনি রাজদুহিতা। স্বয়ং আসরে অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই কাজ সৈনিকদের। তাদের হাত শত্রুর রক্তে দূষিত হয়। অস্ত্র আপনার হাতেও আছে, কিন্তু কস্তুরীর গন্ধ রক্তের গন্ধ ঢেকে দেয়।”
চন্দ্রিকা এবার প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন।
“বেশ রোচক মতবাদ। তা, আমার হাতে কোন অস্ত্র দেখেছ?”
“আপনি মানুষের হৃদয়ের ভিতরটা সহজে দেখতে পান।”
হেমন্তের ভোর। সোনায় মোড়া পালকি।
থামাও! পালকি থামাও!
“রাজা হরিসেনের মদের আসক্তির কথা আপনি আগেই জানতেন। তাই তাঁর জন্য এমন মদের আয়োজন করেছিলেন যা তাঁকে উন্মাদের মতো নেশাগ্রস্ত করে দিতে পারে। রাজ্যে ফেরার সময়ে তাঁকে বশ করার জন্য সেই মদ যৌতুকে দেন, কিন্তু এই পরিমাণে যাতে ছ'মাস পরে আবার প্রয়োজন হয়। মদের প্রতি হরিসেনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আপনি তাঁকে যুবরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তে জড়িয়ে ফেলেন।
কোষাধ্যক্ষ রাধাগুপ্তের কন্যা ইন্দুমতী শুধুমাত্র আপনার সখী নন, মহারাজ মহেন্দ্রর বাগদত্তাও ছিলেন। রাজকুটুম্ব হওয়ার লোভ রাধাগুপ্তর মনে বহুকাল ধরেই ছিল। আপনি সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে আরও বড় স্বপ্ন দেখালেন – একেবারে মহারানীর বাবা হওয়ার সুযোগ। শর্ত শুধু একটা – যুবরাজ সুরসেনকে পথ থেকে সরাতে হবে।
অমাত্য বজ্রবাহু তাঁর পুত্রের শোকে মুহ্যমান ছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রতিশোধের চিন্তা তাঁর মাথায় একবারও আসেনি। আপনি গণৎকারকে তাঁর বাড়ি পাঠিয়ে তাঁর মনে প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিলেন। আমি খবর নিয়ে জেনেছি, সেই গণৎকার অত্যন্ত অর্থলোভী। স্বস্ত্যয়ন করার আশায় সে অর্থবান নাগরিকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। সেই আশাতেই সে বজ্রবাহুকে কুণালের আত্মার দুর্ভোগের গল্প শুনিয়েছিল।
আর তারপরেই, রাজধানীর গুপ্ত ঘাতকের দল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারাই জানায় যে আরো অনেকে যুবরাজের মৃত্যুর যোজনা বানাচ্ছে। বজ্রবাহু প্রলুব্ধ হয়ে পড়েন। তিনি জানতেন না সেই গুপ্ত ঘাতকের দলকে পরিচালনা করেন এই প্রাসাদেরই এক অন্তঃপুরিকা।”
চন্দ্রিকার ঠোঁট কেঁপে উঠল। আবেগে না কৌতুকে, তা সুসীম বুঝতে পারে না।
“তুমি এ কথা কী করে জানলে?”
“পদ্মফুল আর সর্পচিহ্ন…”
হেমন্তের এক ভোর। রাত কেটে দিনের আলো সবে ফুটছে। রাজধানী শংকরপুর থেকে কিছু দূরে নির্জন পথ দিয়ে শুধু একটা শকট ধীরগতিতে চলেছে। শকটের মধ্যে এক পরিবার – এক চিত্রকর, তাঁর স্ত্রী আর আট বছরের ছেলে। বাড়তি আয়ের আশায় নিজেদের শেষ সম্বল, গয়নাগাটি সব গুছিয়ে নিয়ে শংকরপুরে নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছে।
এমন সময়ে –
বর্ষার মেঘের মতো চারিদিক থেকে কারা যেন সেই শকটকে ঘিরে ফেলল। অস্ত্রের ঝনঝন শব্দে ছেলেটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। নিমেষের মধ্যে তার বাবা, মা, গাড়ির চালক, সবাই ধারালো তলোয়ারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। টাকাপয়সা, গয়নাগাটি যা ছিল দস্যুরা ছিনিয়ে নিল।
তারপর তাদের চোখ পড়ল ছেলেটার উপর। হাতে ধরা তলোয়ারের উপর তাদের মুঠি দৃঢ় হল – পদ্মফুল আর সাপের চিহ্ন আঁকা তলোয়ার। সাক্ষাৎ যমদূতের মতো এক পা এক পা করে তারা এগিয়ে আসতে লাগল।
“থামাও! পালকি থামাও!”
আচমকা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কুয়াশা ভেদ করে সোনায় মোড়া এক পালকি কাঁধে চারজন কাহার এগিয়ে এল। দস্যুদের সামনে এসে পালকি থামল। তার পর্দা কিঞ্চিৎ ফাঁক হল।
“তোমাদের কি কাজের অভাব হয়েছে?” আবার সেই কণ্ঠ, কিন্তু বজ্রের মতো কঠোর। “এই পরিবারকে কেন অকারণে হত্যা করলে?”
দস্যু দলের সর্দার পাল্কির দিকে এগিয়ে গিয়ে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করল।
“ক্ষমা করবেন, রাজকুমারী। টাকার অভাব চলছে। দলের সবাই অশান্ত হয়ে উঠেছিল…”
“বাজে অজুহাত আমি শুনতে চাই না! এই কাজের জন্য তোমরা ক্ষমা পাবে না!”
দস্যু সর্দার ঘাড় চুলকোতে লাগল। তারপর হঠাৎ তার কী যেন মনে পড়ল।
“এই বালক এখনও বেঁচে আছে!”
মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য।
“ওকে শিবিকায় তুলে দাও।”
ভয়ে, শোকে প্রায় হতচেতন ছেলেটিকে কারা যেন তুলে নিয়ে একটা ঘরের মধ্যে বসিয়ে দিল। চারিদিকে পাতলা কাপড়ের পর্দা আর সামনে –
এক দেবীর মূর্তি। কল্পনার চেয়েও সুন্দর, অথচ পর্বতের চেয়েও শীতল, দুরূহ। কুরঙ্গনয়না সেই দেবীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার অন্তঃকরণ পর্যন্ত ভেদ করে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে ছেলেটার মনে হল দেবী তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছেন, কিন্তু সেটা তার মনের ভুল। মূর্তিরা কথা বলতে পারে না। ঘরের মধ্যে কস্তুরী আর চন্দন মেশানো গন্ধ। হতভম্ব ছেলেটি ঝপ করে দেবীর পায়ে পড়ে প্রণাম করতে লাগল।
এর পর সুসীমের কিছু মনে নেই।
“রাজা হরিসেন যখন ঘাতকদের গুপ্তপথে নিয়ে আসছিলেন, তখন তাদের তলোয়ারে পদ্ম আর সাপের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন।”
রাজকন্যা মন্দ গতিতে হাতপাখার সঞ্চালন করতে লাগলেন।
“তোমাকে সেদিন পাল্কিতে তুলে আনাই ভুল হয়েছিল!”
“অনুতাপ করছেন?”
রাজকন্যা মাথা নাড়লেন।
“রাজগুরু শিক্ষা দেওয়ার সময়ে আমাকে ওই একটা শব্দের অর্থ বোঝাতে ভুলে গেছেন।”
সুসীম নিঃশব্দে সুরাপান করতে লাগল। এর মধ্যেই তার মাথার মধ্যে একটা ঝিমুনির ভাব আসছে।
“যাই হোক, তোমার ব্যাখ্যা শুনে বেশ লাগল,” চন্দ্রিকা রহস্য করে হাসলেন, “কিন্তু এর একটা কথাও বিচারসভায় প্রমাণ করতে পারবে?”
“পারব না,” সুসীম অকপটে স্বীকার করলেন। “বরং আপনি মিথ্যের জাল বুনে সভাসদদের নিজের পক্ষে টেনে নেবেন।”
“রাজার জন্য তা সুবিধাজনক হবে না।”
“সেই কারণেই আজ আমাকে আসতে হয়েছে,” সুসীম রাজকন্যার সামনে মাথা নত করলেন। তারপর নিজের আংটি থেকে তরল কিছু চন্দ্রিকার সুরাপাত্রে ঢেলে দিলেন।
রাজকন্যা অলস দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন। তরল ঢালা হলে তিনি সুসীমের হাত নিজের শীতল হাতের ভিতর টেনে নিলেন। তারপর অঙ্গুরীয় নাকে ঠেকালেন।
“প্রাণঘাতী বিষ। দ্রুত কার্যকরীও বটে,” তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “তোমার মহারাজের কল্পনাশক্তি দুর্বলই রয়ে গেল। আমি হলে এমন বিষ প্রয়োগ করতাম যাতে আমার মৃত্যু হত না, কিন্তু চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে যেত। সারা জীবন মহেন্দ্রর হাতের পুতুল হয়ে থাকতাম।” সুসীমের হাত তিনি ঠেলে দিলেন। “তোমাকে সুরসেনের কাছে না পাঠিয়ে আমার নিজের হাতে তৈরি করা দরকার ছিল। তাহলে হয়তো তুমি একটু আকর্ষণীয় হতে।”
“মহারাজ আজই আপনাকে এই বিষ পান করতে আদেশ করেছেন।”
সুসীম আসন ছেড়ে ওঠার উপক্রম করলেন। আর একটুও অপেক্ষা করলে দেবী চন্দ্রিকার সামনেই তাঁর মুখ কান্নায় বেঁকেচুরে যাবে।
“এত তাড়া কেন সুসীম? আমার পরিচারিকার ফিরতে এখনো দেরি আছে।”
“তাড়া না করলে আপনি আবার মিথ্যের জাল বুনতে শুরু করবেন। আমাকে বিভ্রান্ত করে কর্তব্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন,” সুসীম দ্রুতগতিতে বলতে থাকেন। “চক্রান্ত, মিথ্যা, কুহক – এর বাইরে আপনি কিছু জানেন না!”
রাজকন্যা কাঠের জানলায় আরাম করে হেলে বসলেন।
“না, জানি না। ভেবে দেখো, সুসীম। রাজ্য শুধু বাহুবল দিয়ে চালানো যায় না। আমার মতো কেউ মহেন্দ্রর পক্ষে থাকলে তার সুবিধাই হবে।”
মুহূর্তের জন্য সুসীমের হৃৎপিণ্ড থেমে গেল।
“আপনি মহারাজ মহেন্দ্রকে ভালোবাসেন?”
“হ্যাঁ।”
“মহারাজের রাজ্যাভিষেক সমর্থন করেন?”
“হ্যাঁ।”
“আজীবন মহারাজের হিত কামনা করবেন?”
“হ্যাঁ।”
“এও কি আরেক মিথ্যা?”
চন্দ্রিকার হাসি গাঢ়তর হল। সুসীম রাজকন্যার দিকে ঘুরে বসলেন।
“রাজ্যের সবাইকে আপনি প্রতারিত করতে পারেন, কিন্তু আমি আপনার স্বরূপ চিনে গেছি। আপনি শুধু নিজের পথে চলবেন, নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করবেন। তার জন্য যত ষড়যন্ত্র, যত মিথ্যা, যত প্রতারণার প্রয়োজন, সবকিছু আপনি করবেন। শুধু নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য!”
রাজকন্যার দৃষ্টি জানলার বাইরে চলে গেল। বসন্তের চাঁদের দিকে, কিম্বা আরো সুদূরে – মিটমিটে তারার জগতে।
“…হ্যাঁ।”
নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর ভেসে এল। দ্বিধাহীন, আবেগহীন।
“কিন্তু…কেন?”
“তুমি বুঝবে না…” বলে রাজকন্যা সেনাপতিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করে নিলেন। “অথবা হয়তো অন্য সকলের চেয়ে বেশি বুঝবে।”
“দেবি, আমি ঠিক…”
“সবাই জানতে চায়, রাজকন্যা চন্দ্রিকা ছাব্বিশ বছর বয়স অবধি অবিবাহিতা রয়েছে কেন? কিন্তু কেউ জানে না, যে তার এক গুপ্ত প্রেমিক আছে। মহারাজ ধর্মাদিত্যের স্থাপন করা এই আদিত্য সাম্রাজ্য। একনিষ্ঠ প্রেমিকার মতো আমি এই সাম্রাজ্যকে আমার সর্বস্ব দান করেছি। এখানেই তোমার আর আমার মিল, আবার এখানেই আমাদের সব থেকে বড় বিরোধ। তুমি রাজার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেছ, আর আমি রাজ্যের কাছে।”
“যুবরাজ সুরসেন--”
“আমার বড় ভাই। অসামান্য যোদ্ধা, কিন্তু কূটনীতির জ্ঞান নেই। রাজা হলে সে পৃথিবী জয় করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করত। অকারণ যুদ্ধ ডেকে এনে রাজ্যের ধন এবং সৈন্যবাহিনীর জীবন – দুই-ই শেষ করত। অস্ত্রের আঘাতে এই রাজ্যকে ক্ষত বিক্ষত করে দিত। তাই পিতা মহারাজ যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, আমি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই। সুরসেন নয়, এই মুহূর্তে মহেন্দ্রই সিংহাসনের উপযুক্ত পাত্র।”
রাজকন্যা কি নতুন কোন নাটিকার রচনা করছেন? সুসীমের মনে হল না। হয়তো এই প্রথম রাজকন্যা সম্পূর্ণ সত্যি কথা বলছেন।
“কিন্তু মহারাজ মহেন্দ্রকেও আপনি পূর্ণ সমর্থন করেন না। প্রয়োজনে তাঁকেও সরিয়ে দেবেন।”
“যদি মনে করি সে তার পদের অন্যায্য সুবিধা নিচ্ছে, বা নিজের দায়িত্ব পালন করছে না, তাহলে অবিলম্বে।”
ঘরের মধ্যে এক ঝলক বসন্তের হাওয়া ঢুকে এল। প্রদীপের শিখাগুলো মুহূর্তের জন্য শিউরে উঠল। কস্তুরী আর চন্দন মেশানো গন্ধে সারা ঘর ভরে গেল, সেই সঙ্গে কোন এক নাম-না-জানা ফুলের গন্ধ। সেনাপতি চোখ বন্ধ করলেন।
“প্রথম যেদিন আপনাকে দেখেছিলাম, আমার মনে হয়েছিল এক দেবীমূর্তির সামনে বসে আছি। রাজপ্রাসাদে পৌঁছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার বাকি জীবন আপনার সেবায় কাটিয়ে দেব…কিন্তু আপনি আমাকে যুদ্ধ শিক্ষা করার জন্য যুবরাজ সুরসেনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। গত দশ বছর ধরে আমি তাঁর সঙ্গে অসংখ্য যুদ্ধ লড়েছি!”
চারিদিক থেকে শত্রুরা ঘিরে ধরেছে। হাতের তলোয়ার ভেঙে দু'টুকরো হয়ে গেছে। শুধু ঢাল দিয়ে শত্রু সেনাকে আক্রমণ করে, তার তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছি। আদিত্য সাম্রাজ্যের অজেয় সেনাপতি…
“অনেকবার ভেবেছি, এই শক্তি, বেঁচে থাকার এই অদম্য ইচ্ছার উৎস কী? মা, বাবা কবেই গত হয়েছেন। এই পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব রইল কি না, কে-ই বা খোঁজ করবে? তাও কেন?”
তাও কেন? পরাজিত না হওয়ার জেদ? যোদ্ধা হিসেবে নিজের আত্মসম্মান রক্ষা? রাজার কাছে পুরস্কৃত হওয়ার বাসনা?
নাকি আরও কিছু?
আরেকবার সেই দেবীকে দেখার বাসনা। আরও একবার…আরও একবার…
রাজকন্যার দীর্ঘশ্বাস বসন্তের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। নিঃশব্দে হাতের বালাটা খুলে তিনি সেনাপতির দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। সুসীম তিক্ত হাসির সঙ্গে প্রশ্ন করলেন,
“প্রণয়চিহ্ন দিচ্ছেন? নাকি উৎকোচ?”
“তোমার প্রথম গুপ্তহত্যার পুরস্কার।”
এক মুহূর্তের জন্য সুসীম পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলেন। তারপর রাজকন্যার হাত থেকে বালাটা নিয়ে নিজের উত্তরীয়র প্রান্তে বেঁধে নিলেন।
“যদি রাজার আদেশ লঙ্ঘন করতে পারতাম, তাহলে আজ রাতে আপনাকে এই রাজ্যের সীমানার বাইরে নিয়ে চলে যেতাম।”
“কিন্তু তুমি রাজার আজ্ঞা লঙ্ঘন করবে না।”
আর আপনি এই রাজ্যের সীমা অতিক্রম করবেন না।
“সুতরাং এই শেষ।”
রাজকন্যার চোখে কৌতুক ঝিলিক দিল। সুরাপাত্র তুলে নিয়ে তিনি এক নিঃশ্বাসে সবটা পান করলেন।
“যাও,” চন্দ্রিকা গুপ্ত দরজার দিকে হাতের ইশারা করলেন। “আমার পরিচারিকারা যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসবে। তোমাকে এখানে দেখতে পেলে অকারণে তোমার হাতে তাদের প্রাণ যাবে।”
“কিন্তু দেবি, আপনি একা…”
“এই রাজপ্রাসাদে সবাই একা…”
****
“সুসীম,” মহেন্দ্রর মার্জিত উচ্চারণ শুনে সুসীমের সংবিৎ ফিরে এল। তিনি কতক্ষণের জন্য অতীত জগতে চলে গিয়েছিলেন? প্রাসাদের মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে আসছে। ঘরের প্রদীপের শিখাও নিভে এসেছে।
“দিদির কথা উল্লেখ করে তোমাকে বিচলিত করে দিলাম কি?” মহেন্দ্র সেনাপতির কাঁধে হাত রাখলেন। “একজন রাজদ্রোহীকে হত্যা করে তুমি কোনও অন্যায় কাজ করনি। যদিও গুপ্ত ঘাতকের কাজ করা সেনাপতির পদমর্যাদার বিরুদ্ধ, কিন্তু সেই সময়ে তুমি ছাড়া আমার বিশ্বাসভাজন আর কেউ ছিল না।”
সেনাপতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
“তাই আমি নির্দ্বিধায় নিজের কর্তব্য করেছি। কিন্তু পরবর্তীকালে আমি যুবরাজ সুরসেনের হত্যার ব্যাপারে অনেক চিন্তা করেছি।”
“…কেন?”
“আমি বুঝতে পারিনি, যুবরাজকে হত্যা করার এত বড় পরিকল্পনা শুধুমাত্র অন্তঃপুর থেকে চালনা করা সম্ভব হল কী করে? ঘটনার পাত্রদের সঠিক সময়ে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করানো, মনের ভাবের আদান-প্রদান করানো, সবাইকে এক সূত্রে বেঁধে দেওয়া – এত সব কি একজন অন্তঃপুরবাসিনী একা করতে পারেন?”
“কিন্তু তুমি তো নিশ্চিত ছিলে, এ কাজ দিদি ছাড়া আর কারও নয়?”
“সেই সময়ে সেরকমই ভেবেছিলাম কিন্তু… ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ খুব সহজেই জোগাড় হয়ে যায়নি কি? প্রমাণ গোপন করার বিষয়ে তাঁরা খুব চিন্তিত ছিলেন বলে মনে হয় না। তা থেকে মনে হয় ক্ষমতাবান কেউ তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিল, যে তাঁদের কুকীর্তি কখনো জনসমক্ষে আসবে না।”
মহেন্দ্র সুসীমের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন।
“তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ?”
“আমার বিশ্বাস, দেবী চন্দ্রিকার সঙ্গে আরো একজন চক্রান্তকারী ছিল। যে অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিল, রাজসভায় যার অবাধ বিচরণ ছিল, যার আশ্বাস ছাড়া রাধাগুপ্তর মতো বিচক্ষণ ব্যক্তি কোষাগার থেকে স্বর্ণমুদ্রা অপসারণ করতেন না।”
সেনাপতি সরাসরি রাজার চোখে চোখ রাখলেন। নিভন্ত প্রদীপের আধো আলোয় মহেন্দ্রর মুখের অভিব্যক্তি ধরা পড়ল না।
“দিদি কি সেরকম কোন ঈঙ্গিত করেছিলেন?”
“…না।”
রাজা মহেন্দ্রর রাজ্যাভিষেক তিনি সমর্থন করেছিলেন। আদিত্য সাম্রাজ্যের যদি মহেন্দ্রকে প্রয়োজন হয়, তিনি সেই পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতেন না।
মহেন্দ্র যেন আশ্বস্ত হলেন।
“দিদি যখন কিছু বলেননি, তখন আমার মনে হয় এই প্রসঙ্গে আর চিন্তা না করাই ভালো। যদি অন্য কোন চক্রান্তকারী থেকেও থাকে, গত পনেরো বছরে সে রাজ্যের কোন ক্ষতি করেনি। তুমি অতীতের চিন্তায় কাল ব্যয় না করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও।”
সুসীম নিশ্চল রইলেন, কিন্তু এক লহমার জন্য। পরক্ষণেই রাজার সামনে মাথা নত করে দাঁড়ালেন।
“যথা আজ্ঞা, মহারাজ।”
“বিজয়ী হও।”
মহেন্দ্র দ্রুত পায়ে সেনাপতির ঘর থেকে প্রস্থান করলেন। সুসীমের দৃষ্টি জানলার বাইরে চলে গেল। হেমন্তের কুয়াশা দেবদারু গাছের মাথা ছুঁয়েছে। দূরে কোথাও থেকে বীণার ঝংকার ভেসে আসছে। এক এক করে রাজপ্রাসাদের ঘরের প্রদীপ নিভে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে সুসীম উত্তরীয়র প্রান্তভাগ খুলে রত্নখচিত বলয় বের করলেন। অদ্ভুত! সোনা আর পাথরের সমষ্টি, পৃথিবীর যে-কোন কোনায় যা সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই সামান্য বস্তুই সেনাপতির কাছে পৃথিবীর সমস্ত ধনরত্নের চেয়েও বেশি মূল্যবান। শুধুমাত্র 'তাঁর' হাতের অলংকার ছিল বলে।
সুসীম নিমেষহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন। রাজকন্যা চন্দ্রিকা – যিনি রাজ্যের জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছেন, আর সেনাপতি সুসীম – যিনি রাজার আদেশে অসংখ্য প্রাণ নিয়েছেন। দু'জনের মধ্যে কয়েক লক্ষ যোজনের দূরত্ব। আকাশপ্রদীপের সামান্য আলো সেই দূরত্ব অতিক্রম করে তাঁকে সুসীমের কাছে নিয়ে আসতে পারবে না।
হেমন্তের বিষন্ন চাঁদ অকারণ প্রতীক্ষায় জেগে থাকে।