• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • সিখ্‌নীর শরণে : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

    পর্ব ১             পর্ব ২             পর্ব ৩



    [পুরোনো দিল্লী/চণ্ডীগড়, ১৯৮৩]

    নক্‌শ-এ-পা

    কবুতরী বুটিক থেকে দুটো কালো গোলাপের মতো গাঢ় রঙের ইম্পোর্টেড লিপস্টিক কিনেছিলাম। পম্পা আমাকে দোকানের এক কোণে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে বলল – এইগুলো পরলে তুই আমার প্রতি আকৃষ্ট হবি?

    - আরেকটা আছে। বলে তাকে একটা প্রায় ছ ইঞ্চি উঁচু হিল তোলা জুতো দেখাই।

    - ও, এই পোল দুটোতে উঠলে তোর আমাকে তুলতে একটু সুবিধে হয়ে যায়, তাই না? এটা পরে কিন্তু আমি বাসে উঠব না। তাহলে একটা স্কুটার ধরতে হবে।

    ছ ইঞ্চি উঠে গেলে বান্ধবী আমার চেয়ে এক চুল লম্বা হয়ে যায়, আর তার শরীরের সবচেয়ে সরু অংশটা হাতের আরো নাগালে এসে পড়ে। নাচ প্র্যাকটিস করার সময়ে দুই বাহু মন্দিরের ভঙ্গিতে মাথার উপরে তুলে জুতো ছাড়াই সে যখন এক পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াত তখন মেঝেতে বসে লিলিপুট সৈন্যের একজন অকিঞ্চন ল্যান্সনায়কের মতো বিস্ময় ও সমীহের দৃষ্টিতে আমি তাকে দেখতাম। দুশো হাত দড়ি আর গজাল সমেত যেন আমাকে একটা দুরূহ পাহাড়ের চূড়া আরোহণ করতে পাঠানো হয়েছে।

    কাশ্মীরী গেটের ভুলভুলাইয়ার মতো গলি। একটা পেরিয়ে আরেকটাতে ঢুকি আর সেটা একটু দূর গিয়ে গোল হয়ে ঘুরে উলটোদিকে যেতে শুরু করে। পম্পা আমাকে বলল – ওরকম ধুপ ধাপ করে হাঁটছিস কেন?

    মুহতরমার নতুন স্যান্ডেলের সরু হিলের পাশে আমার থ্যাবড়া কেড্‌স জুতোজোড়া থপ থপ করে ভাঙা পিচের রাস্তায় মারছিলাম। যদি কয়েকটা দাগ ফেলা যায়। তাকে বললাম – তোমার কাছাকাছি থাকার সময় বোধহয় আমার টেস্টোস্টেরোন লেভেল হাই হয়ে যায়। এটা কি তার ফল?

    - হরমোন লেভেল বাড়লে মানুষ বনমানুষের মতো ব্যবহার করে নাকি?

    হোক বনমানুষী। কিছু পায়ের ছাপ রেখে যাওয়ার একটা মূল্য আছে। বিশেষ করে যাদের জীবনে বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের লেখা এরকম একটা কাব্য আমার রুচিশীলা বান্ধবীকে পড়িয়েছিলাম। তার মাঝখানে ছিল –

        মেরে তেরে শহর কী
        হর ইক গলি মেঁ
        মেরে তেরে নক্‌শ-এ-পা কে বেনিশাঁ মজার হ্যাঁয়

    তাকে সেটা মনে করিয়ে বললাম – দ্যাখো, তুমি আর আমি যেরকম অলিগলি চলি রাম করে সময় কাটাই এটা আমাদের গল্পও হয়ে যেতে পারে। একদিন হয়তো তুমি বা আমি এই গলিতে ফিরে এসে দেখব আমাদের পায়ের ছাপগুলোর উপর এক একটা শ্বেতপাথরের মাজার হয়ে গেছে আর আমাদের অতীতের দেহগুলো তাদের প্রদক্ষিণ করে চলেছে।

    - লাইনগুলো খুব সুন্দর! কিন্তু এরকম দুঃখের গল্প আমাদের হোক সেটা আমি চাইব কেন?

    - না, সেটা আমিও চাইব না। তবু এর মধ্যে একটা চিরদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে লুকিয়ে আছে না?

    পায়ের ছাপগুলো আপাতত দৃষ্টির অতীত কোনো জগতে চলে যাচ্ছে। ইহজগতের গলিতে একটু নিরিবিলি পেলেই পম্পা ইচ্ছে করে গা ঘেঁষে হাঁটছিল। পা ফেলার সময় তার কোমরের পেন্ডুলাম এদিক থেকে ওদিক দোলে। চলার তালে তালে আমার শরীরে একটা স্কার্ট পরা হিপ বোন এসে ধাক্কা মারছে। আমার তন্বী সঙ্গিনী সামনের দিকে তাকিয়ে টান টান হয়ে হেঁটে চলেছিল। যেন কিছুই জানে না।

    মনে পড়ল, যার টাকায় এই দামী স্যাণ্ডেলটা কিনেছি সেই কাহারের মেয়ে তারাবাঈ নিজে বাজারের সবচেয়ে শস্তা প্লাস্টিকের চটি পরে। দৃষ্টির অতীত কোনো জগত যদি থাকে, সেখানকার মাটিতে হয়তো সেই গোলাপি চপ্পলের ছাপও আমাদের পায়ের ছাপের পাশাপাশি ফুটে উঠবে।


    কাঠবেড়ালির হাসি

    চণ্ডীগড়ে তার কলেজ শুরু হতে চলল। দুটো দিন বাদ দিয়ে তৃতীয় দিন পম্পা দিল্লী ছাড়ছে। আমরা সেই দুটো দিনের কর্মসূচী আগেই ঠিক করে ফেলব বলে কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলাম। নয় নয় করে ছাব্বিশটা আইটেম। এত কম সময়ে দিল্লীর এতগুলো পয়েন্ট ছুঁয়ে আসা অসম্ভব।

    - কাঠবেড়ালিদের বাই-বাই করার প্রোগ্রামটা বাদ দাও না? অনুনয় করলাম। - আর খুনী তালাবে সন্ধ্যেবেলা যাওয়া কি খুব জরুরী?

    - শুনছি শহর ছাড়ার আগে সন্ধ্যেবেলা একলা গিয়ে পা ডুবিয়ে এলে দিল্লীতে করা নিজের অজানা ভুলচুক মাফ হয়ে যায়। মোঘল যুগের ট্র্যাডিশান। আমাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত।

    খুনী তালাবে পা ডুবিয়ে বসার ব্যাপারটা অবশ্য আমিও শুনেছি। ব্রিটিশরা ফেরত যাওয়ার আগে দলে দলে করে গিয়েছিল। যারা এই প্রথা ভাঙত এই জিন আর ভূতের শহর নাকি তাদের ক্ষমা করেনি। অদৃশ্য হাত এসে পেনশন আটকে দিত। কেউ দেশ ছাড়ার পরেও বিলেতে বসে ইলেক্ট্রিসিটির বিল পেয়ে গেছে। কারো নামে বেরিয়েছে জেল ভাঙার জন্য হুলিয়া। কিন্তু মোঘল আর ব্রিটিশদের প্রশাসন এখন কোথায়? রিজের দুর্গম ভিতরে তালাবের দিকে সন্ধ্যেবেলা একলা যাওয়াটা পম্পার বয়সী মেয়েদের পক্ষে মোটেও নিরাপদ নয়। বারণ করতে গেলেও বিপদ। বলবে – তুই যেতে পারলে আমি পারব না কেন?

    ছাব্বিশটা আইটেম কমিয়ে আঠেরোতে নামানো হয়েছিল। সারা দিনে তার মাত্র চারটে সমাধা হয়েছে। আমরা কমলা নগর থেকে কিছু কেনাকাটা করলাম। দিল্লী ছাড়ার আগে পার্কটাউনের শকুন্তলা বাজারের সমস্ত শৌখিন জিনিস দিয়ে তার খোকাপুতুলকে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের লরির মতো বোঝাই করে যেতে চায়। না চাইতেই সবুজ শুঁয়োপোকা আঁকা সাদা গেঞ্জি পেয়ে গেলাম। উলটে পরা যায় সেরকম দ্বিবর্ণ ক্যানভাসের বেল্ট। একটা খুব দামি র‍্যাংলারের ফেডেড আর তাপ্পি মারা জিন্‌স্‌ যা আমি কিনতে দিচ্ছিলাম না। পম্পা ছলছলে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল – যাওয়ার আগে শুধু কাঠবেড়ালিদের দেখিয়ে আসতে চাইছিলাম আমাদের সম্পর্কটা কীরকম স্পেশাল।

    দোকান থেকে সেই ফেডেড জিন্‌স্‌ পরে বেরোতে হল।

    পরে রিজের ভিতর ঘাসের উপর আমরা জুত হয়ে বসে আছি। টোপ হিসেবে নুন দেওয়া কালোজামও আনা হয়েছে। এদিকে কাঠবেড়ালিদের দেখা নেই।

    অনেক দিন পরে আবার জিজ্ঞেস করলাম – কেন তোমাকে দিল্লী ছেড়ে পালাতে হচ্ছে সেটা অন্তত আজ জানতে পারব কি?

    পম্পা অধৈর্য হয়ে বলল – বলে কী লাভ? সবাই ভাববে আমি পাগল।

    - থাক তাহলে। আমাদের স্পেশাল সম্পর্কটা পণ্য আদান-প্রদানের মধ্যেই সীমিত থাকুক।

    জবাবটা আমার বান্ধবীর পছন্দ হয়নি। সে ভর্ৎসনার দৃষ্টি দিয়ে আমাকে ভালো করে চাবকাবার পর একটা নীরিহ কালোজামের পেটে হিংস্রভাবে দাঁত বসিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত বের করে দিয়েছিল। পরে সে বলল – ঘাড়ে একটা সন্দেহের ভূত চেপে বসে আছে। সেটাকে চিরদিনের মতো তাড়িয়ে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য দূরে থাকা দরকার।

    - সন্দেহটা একেবারে অমূলক। আমি কোনো নতুন গার্লফ্রেণ্ড খুঁজছি না।

    - না, না। সেই সন্দেহ নয়।

    আমরা বসে একের পর এক কালোজাম ধরে খাচ্ছিলাম। টুপ টুপ করে ঘাসের উপর তাদের রস ঝরছে। - এরপর আর তুই আমাকে সুস্থ বলে ভাবতে পারবি না, এই বলে অভিলষিতা কলেজগার্লটি নিজের মনের উল থেকে একটা অদৃশ্য কালো সুতো ধরে টানতে শুরু করল। পম্পা যত তার মনের সোয়েটার খুলে দিচ্ছিল, আমরা তত একে অপরের অচেনা হয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের ভিতরের দূরত্ব কি একদিন দিল্লী আর চণ্ডীগড়ের চেয়ে বেশি হওয়া সম্ভব? ভাবনা হয়ে যায়।

    পম্পা বলেছিল – এই যে পাশাপাশি পাড়ায় কেটেছে আমাদের ছেলেবেলা, এই যে তোর সাথে এসে এই গাছটার তলায় বসেছি, এই যে আমরা পুরোনো শহরের গলিগুলোতে হাজার হাজার নকশ-এ-পা’য়ের মাজার বানিয়েছি – আমার ভয় হয় যে এই সব কাণ্ড একটা লম্বা স্বপ্নের ভিতর ঘটে গেছে। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে জানতে পারব এই দিনগুলো আমার অপূর্ণ ইচ্ছে দিয়ে তৈরি একটা সিনেমার মতো, যা জীবনে একবার মাত্র দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। ঘুম ভেঙে গেলে একটা আলাদা পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে যেখানে আমি পম্পা মুখার্জি নই, অন্য কেউ। আর বয়ম্যান, তুইও নেই। অবিশ্বাস্য লাগছে তো? কিন্তু এই সম্ভাবনাটা বেশ কিছুদিন ধরে আমার মনে গভীরভাবে বাসা বেঁধে ফেলেছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ভয়ের চোটে চোখ বুজে থাকি। মনে হয় চোখ খুললেই একটা আলাদা জগৎ দেখব, যার বিষয়ে আমার কিচ্ছু এখন মনে নেই।

    ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে থেমে গিয়েছিল।

    চিন্তাটা শুধু অস্বাভাবিক নয়, বেশ ভয়াবহ। পার্কটাউনের এই হাসি-খুশী মেয়েটা তার ভিতরে এরকম একটা অশান্ত সত্তাকে লুকিয়ে রেখেছিল এবং আমি জানতেও পারিনি? খবরটা কালোজামের সঙ্গে চিবিয়ে গিলে ফেলার চেষ্টা করছি। পম্পা বলছিল যে তার ধারণা কোনো নতুন শহরে গিয়ে নতুন লোকজনের মধ্যে থেকে আমাদের পরিবেশটাকে নিজের মধ্যে থেকে বের করে দিতে পারলে হয়তো এই স্বপ্ন-স্বপ্ন ভাবটা কেটে যাবে। একদিন এই দিনগুলোকে সে হয়তো আবার সত্যি বলে চিনতে পারবে।

    একটা কাঠবেড়ালি কখন ভুল করে এসে পড়েছিল আমাদের বন্ধুত্ব ভিক্ষা করতে। অতিপরিচিতা মানুষ মেয়েটাকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে থমকে গেল। আমি তাকে ইশারায় কেটে পড়তে বলে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলাম – কবে থেকে এরকম মনে হচ্ছে তোমার?

    - গতবছর তুই আমাদের বাড়িতে বৃষ্টির মধ্যে কাক-ভেজা হয়ে এলি। মা তোকে তোয়ালে আর একটা গেঞ্জি বার করে দিল। গেঞ্জিটা ছিল এক দূর সম্পর্কের মামার। বাবার জামা তো তোর হয় না। তুই বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে দিয়ে গা মুছে সেটা পরছিলি। তোর পিঠের স্কিনটা এমন সিল্কের মতো স্মুদ, আমি আঙুল দিয়ে ছুঁতে গিয়ে বুঝলাম সেটা একটা স্বপ্ন।

    আমি বললাম - সেদিন তোমাদের দেওয়া ঢোলা গেঞ্জি পরে পাক্কা দেড় ঘন্টা বসে ছিলাম আর মাসিমা আমার জামা ইস্তিরি করে শুকিয়েছিলেন। ঘটনাটা একশোবার ঘটেছে। মোটেও এটা স্বপ্ন নয়।

    পম্পা বলল – মানুষ না তেরো ইঞ্চির গাধা? আমারই স্বপ্নের ভিতরে বসে কি তুই বলবি যে আমি স্বপ্ন দেখছি?

    তারপর সে হি-হি করে হাসতে শুরু করে দিল। এই হাসিটা তার স্বাভাবিক হি-হি হাসি নয়। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আসলে এটা হাসিই নয়। হাসির উলটো দিক।


    আমাদের ত্বক

    কাঠবেড়ালিদের কাছে বিদায় গ্রহণের পালা সাঙ্গ করে আমরা ইউনিভার্সিটির কফি হাউসে গিয়েছিলাম লিস্টের ছ নম্বর আইটেমে দাগ মারতে। পম্পার সঙ্গে থেকে থেকে আমার কফি গেলার অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে, যদিও বাড়িতে আমরা চা ছাড়া আর কিছু খেতাম না। গোধূলির দরজায় দাঁড়িয়ে আমি কড়া পানীয়টা খেয়ে সাহস বাড়াচ্ছিলাম। আরেকটু অন্ধকার হলে বান্ধবীকে খুনী তালাবে পৌঁছে দেব।

    গার্লফ্রেণ্ডের কবজির পাশে নিজের কবজি রেখে আমাদের ত্বকের তফাৎগুলো ধরার চেষ্টা করলাম। তারটা আমার চেয়ে বেশি টানটান এবং পীতাভ। যদি কারো চামড়া সিল্কের মতো হয় তো সেটা তার। আমারটা মোটা ব্রাউন কার্ডবোর্ডের মতো। যার ভিতর থেকে খোঁচা খোঁচা হাড়গুলো বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

    - ত্বকের উপরের অংশটাকে বলে এপিডারমিস বা বহিস্ত্বক। পম্পাকে বললাম। - এপিডারমিসের চারটে স্তর। তার সবচেয়ে বাইরের স্তরটাকে আমরা চামড়া বলে চিনি, যা আসলে মৃত দেহকোষ দিয়ে তৈরি। আমরা পরস্পরকে শরীরের শুধু একটা মৃত অংশ ছুঁতে দিই। জীবন্ত অংশটাকে অন্যের ছোঁয়া থেকে সরিয়ে রাখি।

    পম্পা আশ্চর্য হয়ে কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলল – ডক্টর বাজাজ তোকে এসব বলেছেন?

    নইলে আর কে? এবং এ ছাড়া আরো কত? বহিস্ত্বকের চারটে স্তর নিয়ে গড়গড় করে কিছু তথ্য দিয়ে দিলাম। এপিডারমিসকে ঘাড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চামড়ার সবচেয়ে মোটা পরত। যার নাম ডারমিস। ডারমিসকে দৃঢ়তা দেয় কোলাজেন আর ইলাস্টিন নামের প্রোটিন দিয়ে তৈরি তন্তুর মজবুত জাল। বয়সের সঙ্গে এই জালটা ফিনফিনে হয়ে আসে, যার ফলে চামড়া কুঁচকে যায় ও আমরা লোলচর্ম হয়ে পড়ি। ডারমিস আর এপিডারমিসের মাঝখানে চামড়ার নতুন কোষগুলো জন্মায় এবং মাসখানেক ধরে ধীরে ধীরে উপর দিকে ওঠে। যতদিনে তারা ত্বকের সবচেয়ে উপরের স্তরে গিয়ে পৌঁছোয় ততদিনে তাদের আয়ুও ফুরিয়েছে।

    - ও মাই ঠাকুর! বাজাজ কেন তোকে এসব উলটো পালটা জিনিস পড়াচ্ছেন? এই লোকটার উদ্দেশ্য কী?

    আমি সন্দেহ করি ডক্টর বাজাজ তাঁর ল্যাবরেটরিতে আমার উপর অবর্ণণীয় কিছু একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চান। কিন্তু সেটা পম্পাকে মুখ ফসকে বলে দিলে সে চেঁচিয়ে পাড়া জড়ো করে দেবে। প্রশ্নটার সোজা জবাব না দিয়ে তাই বললাম - শোনো, ত্বকের ভিতরে আছে হাজার হাজার মাইল লম্বা সূক্ষ্ম রক্তবাহী উপশিরা। সেগুলো কখন কীভাবে ফেটে রক্ত জমেছে তা বোঝা যায় চামড়ার রং দেখে। পোস্ট মর্টেম করার সময় শবের চামড়ার প্রতিটি বর্গ ইঞ্চির দিকে অটপ্‌সি সার্জেনদের নজর রাখতে হয়। সেইজন্য গুলজারীলাল বাজাজের প্রিয় আলোচনার বিষয়ও এই দুটো – শবদেহ আর ত্বক। তিনি আমাকে বলেছেন শিমলিপুরের মানুষের চামড়া সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা।

    - এরপর শুনবি তোরা মানুষই নয়। সরীসৃপ। বিশ্বাস করিস না এসব। তোর স্কিন খুব নর্মাল। আমার চেয়েও ভালো।

    - কোথায় ভালো? দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। আমার পিতৃদেব ছিলেন তোমার বাবার ঠিক উলটো। শরীরটা রোগা। উপরে ভাল্লুকের মতো লোম। আমারও বুক জুড়ে বাবাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করার জন্য অগুনতি লোম গজিয়ে গেছে। তিন বছর পরে এসে আমার জায়গায় একটা অন্য জন্তুকে পাবে। তখন দেখবে তুমি দিন গুনছ কখন এই দুঃস্বপ্ন ভাঙে।

    পম্পা গ্যাঁট হয়ে বসে আমার কবজির পাশে নিজের কবজি রেখে বলল – দ্যাখ, আমার স্কিন ঠিক মায়ের মতো, এবং সেরকমই থাকবে। তুইও চাইলে তোর সব লোম ওয়্যাক্স দিয়ে তুলে দিতে পারি। তাহলে তোর আর আমার মধ্যে যেটুকু তফাৎ না থাকলে নয় সেটুকু থাকবে শুধু।

    কিন্তু তার বদলে যদি আমার শরীর সত্যিই একটা সরীসৃপের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যায়? বা কোনো আরো অদ্ভুত উপসর্গ দেখা দেয়? আমার সঙ্গিনী আর আমি পরস্পরের ত্বক জরিপ করছিলাম। তিন বছর পরে যখন দেখা হবে, তখন যাতে চিনতে কোনো অসুবিধে না হয়।

    পম্পা মুখার্জি যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে আরেকটু কাছে এসে বসল। তারপর পিঠে হাত রেখে সে বলল – বাজাজ লোকটা নিজেকে সুপারম্যান ভাবে। একদিন বোঝাবার চেষ্টা করবে যে তোরা সাপ বা কেঁচোর মতো কোনো লোয়ার স্পিশিস। হী ফীড্‌স্‌ অন ইয়োর ফীয়র। তার কথায় একদম ভয় পাবি না।


    লেম ট্রি

    পরের দিন সকাল থেকে বৃষ্টি। পম্পা লিস্ট ছিঁড়ে ফেলল। আমরা সারাদিন তার ঘরে বসে বসে গান শুনলাম আর কুড়মুড়ে আলুভাজা খেলাম।

    আমার বান্ধবীর বাবা-মা তাকে চণ্ডীগড়ে পৌঁছে দিতে যাবেন। কয়েকদিন সবাই থাকবে সেখানে। চারটে স্যুটকেসে সব জিনিস প্যাক হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। যতবার দেখছি একটা ধাক্কা লাগছে কোথাও। কালকের পর থেকে আমাদের জীবন কীরকম পালটে যাবে সেটা আমরা দুজনেই বোধহয় বুঝতে পারছি না।

    মাসিমা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে পড়লেন। হাতে একটা ছোট অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই আর খুন্তি। আমরা ছোটরা যতই ঝিমিয়ে পড়ছি, মাসিমা ততই ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন। বললেন – এগুলো যাবে তোর সঙ্গে।

    পম্পা হতভম্ব হয়ে বলল – আমি রান্না করব কোথায়? জায়গা কই?

    - যদি একটা স্টোভ কি হিটার পেয়ে যাস? লুচি-টুচি খেতে চাইলে?

    - ছাড়ো মা। ওসব যদি সম্ভব হয় পরে নিয়ে যাব। এখন গিয়ে দেখি জায়গাটা কীরকম।

    মাসিমা বেরিয়ে গিয়ে একটু পরে আবার ফিরে এলেন। এবার হাতে একটা কাগজের ঠোঙা। সেটাকে মেয়ের হ্যাণ্ডব্যাগের ভিতর ভরতে যাচ্ছিলেন, মেয়ে কেড়ে নিয়ে মেঝেতে উপুড় করে দিল। বেরোল দুটো শুকনো লঙ্কা আর তাদের চেয়েও শুকনো একটা রসুন। মোটা সাদা সুতোর গোছা থেকে বেকুবের মতো সবাই ঝুলছে।

    - এ কী মা?

    - এটা ভীষণ দরকারি জিনিস। দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। অপদেবতা হোক, দুষ্টজন হোক, কারো হিংসের নজর পড়লে সেটাকে পুড়িয়ে দেবে।

    পম্পা কথা না বাড়িয়ে জিনিসটা মাকে ফেরত দিয়ে বলল – নিজের ব্যাগে ভরে নাও।

    ইচ্ছে ছিল কনট প্লেস থেকে কিছু নতুন গানের টেপ কিনে বান্ধবীকে বিদায় উপহার দেব। বৃষ্টির জন্য সকালবেলা করা যায়নি। বিকেলে আমরা কমলা নগরে গিয়ে হাজির হলাম চাট আর চা খেতে। মাসিমা বাড়িতে বসে বসে বোর হচ্ছেন বলে তাঁকেও টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভেবেছিলাম একটা হিন্দী আর একটা ইংরেজি গানের সংগ্রহ কিনতে পারব। কিন্তু একমাত্র ভালো ক্যাসেটের দোকানের মালিকটি উন্নাসিক। আমার আর মাসিমার আপত্তি গায়ে না মেখে সে জোর করে পম্পার হাতে মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার ধরিয়ে দিল। শুনেছিলাম গানগুলো একগাদা গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছে। দাম হিন্দী ক্যাসেটের দুগুণ। সুতরাং বিদায়-উপহার হিসেবে বান্ধবী একটা মাত্র টেপই পেল।

    তিনজনে মিলে এদিক সেদিক ঘুরছি। পার্কের ধারে একজন মহিলা মেহেন্দীর নকশা করছিলেন। আমাদের দেখে তিনি ছুটে এসে মাসিমার একটা হাত ধরে টানতে শুরু করলেন। অন্য হাত ধরে পম্পা টানছে। লোকজন থেমে গিয়ে দেখছে কী কাণ্ড। আমি মাসিমাকে বললাম – কয়েকটা টাকার ব্যাপার। করিয়ে নিন না? কটাই বা খদ্দের পায় এরা? মাসিমা খেপে উঠে বললেন – তোর পয়সা বেশি তো তুই করাচ্ছিস না কেন? একটা হাতে করবে শুধু। দশ-বারো টাকা দেব তার জন্য?

    আমি বললাম – মাসিমা আমার কাছে দুটো দশ-টাকার নোট পড়ে আছে। দুজনকেই করিয়ে দেব?

    মাসিমার কন্যা হঠাৎ গৎ পালটে বলল – চলো মা, জয় যখন টাকা দিচ্ছে তখন করিয়ে নিই। চণ্ডীগড়ে গিয়ে দুজনে মিলে ঘুরব। ভালোই লাগবে।

    - তুই করা। আমার এই বুড়ো বয়সে ওসবের দরকার নেই।

    পম্পা মাকে জাপটে ধরে বলল – একদম নিজেকে বুড়ো বলবে না। তোমাকে এত মিষ্টি দেখতে। জয় ঠিক বলেছে। আমরা ওই বজ্জাত ক্যাসেটওয়ালাটাকে এত পয়সা দিয়ে এসেছি। একে কেন দেব না?

    আমাদের কথা শুনে মাসিমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন – বিশ্বসুদ্ধু লোককে তোরা পয়সা দিয়ে বেড়াবি নাকি? জমাবি না? নিজেদের জন্য কী থাকবে? আরে পয়সা একটা একটা করে জমাতে হয়। আমার মেয়েটা একদম বোকা। ও বোকাই থাকবে। তুই ওর মতো হতে যাস না।

    পম্পা হাসতে লাগল। আমি মাসিমাকে আশ্বস্ত করে বললাম – জমাব। আমরা কট্টর সুবিধেবাদী ফ্যামিলি। তায় একটু বামপন্থী ধাত আছে। মা বলে দিয়েছে প্রচুর রোজগার করতে হবে। যাতে দুহাতে ছড়াবার পরেও অনেক থাকে। বনের লেম ট্রি-র মতো হতে বলা হয়েছে আমাকে। বুঝলেন তো? লেমন নয়, লেম। মানে ল্যাংড়া আম। গাছ ভর্তি ফল হয়ে খসে যাচ্ছে। গাছ নিজে একটাও খাচ্ছে না। পশু-পাখিরা খায় তো খাবে। গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী খাক। ডাকাত-তস্করের মাথায় দুম-দাম খসে পড়ুক। পথ হারানো পথিক হঠাৎ পেয়ে গিয়ে কুড়িয়ে নিক। আজে বাজে ফলও নয়। বেনারসের ল্যাংড়া। নীম আর বটের জঙ্গলে এরকম একটা টপ কোয়ালিটির জিনিস এল কোত্থেকে? সবাই তাজ্জব। এদিকে গাছ ভাবছে, পড়ে নষ্ট হয় হোক। পরের বছর আরো বেশি হবে।

    - ছেলেটা আবার বাজে বকতে শুরু করেছে। মাসিমা গজগজ করতে থাকলেন। - সংসারে বাঁচতে পারবি না তোরা। সন্ন্যাসী হয়ে যা। বুদ্ধ হ।

    আমি গিয়ে মহিলাটিকে বললাম – বারো টাকা দিতে পারি, দুজনেরই একটা হাতে করে দিতে হবে। নকশা হালকা হলেও চলবে। জবরজং আমাদের পছন্দ নয়।

    - কুড়ি দিতে হবে।

    - তাহলে অন্য খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকুন। আমরা আইসক্রীম খেতে চললাম।

    আমি উলটো দিকে মুখ ঘোরাতেই মহিলা রাজি হয়ে গেলেন। অর্থাৎ ব্যবসা মোটেও ভালো হয়নি আজ।

    পম্পা মাকে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য আগে নিজে বসল। আমি মাসিমাকে বললাম – দেখলেন কেমন শস্তায় হল? হাফেরও কম আসলে। দিল্লীর যে কোনো বাজারে আমি এত তাড়াতাড়ি দাম কমিয়ে দিতে পারি যে দোকানদারদের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে যায়।

    ছ-টাকায় এক-একজনের হয়ে যাচ্ছে বলে মাসিমা অভিভূত। অকস্মাৎ হাতে ল্যাংড়া আম পাওয়ার মতো আনন্দে উপচে পড়ছেন। বাংলায় কথা বলছিলাম আমরা, যাতে মেহেন্দীওয়ালিটি বুঝতে না পারেন। মাসিমা হাসতে হাসতে বললেন – সত্যি দারুণ রেটে নামাতে পেরেছিস রে। এবার থেকে শপিং করার সময় আমরা তোকে নিয়ে যাব। কী করে পারলি এটা?

    আমি বললাম – সাইকোলজি মাসিমা। আজ এদের কিচ্ছু বিক্রি হয়নি। হবে কী করে? সারাদিন তো বৃষ্টি ছিল। বিকেলেও বেশি লোক বেরোয়নি মার্কেটে দেখছেন তো? হাত খালি। বৌনি করাচ্ছি আমরা। তার উপরে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা আইসক্রীমের দোকানে ঢুকলে দেউলে হয়ে বেরোয়। সে জন্য এরা আইসক্রীমের দোকানগুলোকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না।

    মহিলার হাতের কাজ খুবই ভালো। আমরা হালকা চেয়েছি বলে উনি পম্পার অনামিকার ডগা থেকে শুরু করে বুড়ো আঙুলের গোড়া অবধি একটা বাঁকানো লতা এঁকে ছেড়ে দিলেন। বেশি সময় লাগল না। ছ-টাকারই কাজ আসলে। কিন্তু দেখাচ্ছে দুর্দান্ত।

    মেয়ের হয়ে গেলে মাসিমা বললেন – আমাকেও ঠিক ওটাই দাও। দুজনের একরকম হোক।

    পম্পা আমার মুখের সামনে লতা আঁকা হাতটা ধরে রেখেছে। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি কপালের উপর দিয়ে একটা কোঁকড়া চুলের গুছি এসে পড়েছে চোখের উপর। পিছনে পার্কের রেলিঙের গায়ে দুটো মোড়া পেতে বসেছেন মাসিমা আর মেহেন্দীর আর্টিস্ট। ফুটপাথের উপর একটা জলের আয়না। তাতে আকাশের ছাই রঙের পর্দার আলো নিভে আসছে। নিরাশ ফিরিওয়ালারা মুহূর্তগুলো গুনছে। আমাদের চারদিকে লোকজনের চলাফেরা কমে এল। বাড়িগুলোতে বাতি জ্বালাবার সময় হয়নি তাও।

    ক্যামেরা থাকলে এই শেষ বিকেলের দৃশ্যটা আমি হারাতে দিতাম না। পম্পার আঙুলের ভিউফাইন্ডার দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখতে দেখতে আমি বুঝতে পারলাম যে এটা প্রকৃতই স্বপ্ন। পম্পার নয়। আমার। আমার স্বপ্নের ভিতরে একটুকরো চেতনার ঢেউয়ের মতো উঠে এই মেয়েটা আমাকে একটা খবর দিতে এসেছিল। যেন আমি প্রস্তুত থাকি। এই ঘুমের সুতো যেদিন ছিঁড়বে, সেদিন থেকে তাকে বা তার সঙ্গে আসা পৃথিবীটাকে দেখতে পাব না।

    ***

    মাসিমা কেন বারবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন? হাতছানি দিয়ে ডাকলেন একসময়। আমরা কাছে যাওয়ার পর বললেন – ভাবছি কুড়িটা টাকাই দিয়ে দিই। কী বলিস? জয় যখন বলেছে আজ বৌনিও হয়নি বেচারার। বাড়িতে কী নিয়ে যাবে? ওরও তো একটা সংসার আছে।

    পম্পা বলল – এখন ডবল দেবে? তাহলে বেশরমের মতো দরদাম করে হাফ প্রাইসে নামাবার কী দরকার ছিল? অত ঢং করো কেন তোমরা?

    আমি মাসিমাকে সমর্থন করে বললাম – মাসিমা, আপনার এই স্টাইলের জবাব নেই। একই সঙ্গে গরমা গরম চা আর চিল্‌ড্‌ সোডা খাওয়ার মতো লাক্সারি এক্সপিরিয়েন্স করাচ্ছেন আপনি। কুড়িই দেওয়া যাক।

    মাসিমা বললেন - তোকে দিতে বলিনি। আমি দেব। আমরা কি ন্যায্যমূল্য দিতে চাই না? বামপন্থী-টামপন্থী নই, আমরা সাধারণ মানুষ। তাহলেও আমরা দিই।

    পম্পা মায়ের হাত থেকে বটুয়া ছিনিয়ে নিয়ে বলল – খবরদার না। এটা জয় দেবে বলে আমরা রাজি হয়েছিলাম। দিলে ওকেই দিতে হবে।

    পরে যখন বারোর বদলে দুটো দশের নোট গছাচ্ছি তখন দেখলাম নির্মমভাবে দর কমাবার জন্য মহিলা আমাকে ক্ষমা করেননি। নোট দুটো থলের মধ্যে গায়েব করে দেওয়ার পর ধন্যবাদের বদলে নাকটা একটু কুঁচকে বললেন – এতটা কাজ নেওয়ার পর বারো দিতে লজ্জা করল, তাই না?

    কী টেটিয়া রে বাবা! মাসিমা কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। শুনতে পেয়ে একটু ভড়কে গেছেন। মুখটা কালো হয়ে যাচ্ছে। আমি মেহেন্দীওয়ালিকে বললাম – বারো তো দিলাম এই কাউয়ার পায়ের মতো ডিজাইনটার জন্য। আর আট দিয়েছি বাকি দুটো হাত খালি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আট টাকা কম নিলে বাকি দুটো হাতেও নিজের কীর্তি দেখাতে পারেন।

    মহিলা হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে না পেরে দাঁত বের করে চেয়ে রইলেন। আমিও দাঁত দেখিয়ে বিদায় নিলাম।

    যেতে যেতে মাসিমা আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে বললেন – দেখলি জয়, কীরকম অকৃতজ্ঞ আর সেয়ানা? বেশি পেয়েও খুশি তো হলই না, উপরন্তু তোকে যা-তা বলছিল।

    আমি মাসিমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম – চিন্তা নেই। চণ্ডীগড় থেকে ঘুরে আসুন, একসঙ্গে বাজারে যাব একদিন। দেখবেন কতগুলো সেয়ানাকে নাকের জলে চোখের জলে করে ছেড়েছি। আজ যা গেছে তার দশগুণ উসুল হয়ে যাবে। তবে একটা কথা মানতে হবে মাসিমা, মেহেন্দীর কাজটা এত ভালো হয়েছে, চল্লিশ দিলেও বেশি হত না।

    কিন্তু ততক্ষণে মাসিমা আর আমার কথা শুনছিলেন না। মা-মেয়ে মুগ্ধ হয়ে একে অন্যের বিচিত্রিত হাত দেখছে।

    পরের দিন সন্ধ্যেবেলা স্টেশনে গিয়েছি সবাইকে ছাড়তে। ট্রেন সময়ের আগে এসে দাঁড়িয়েছিল। মাসিমা জিনিসপত্র নিয়ে আগে ভাগে উঠে বসে রইলেন। মেসোমশাই বাইরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এক সহযাত্রীর সঙ্গে গল্প জুড়েছেন। পম্পা আমার সঙ্গে পায়চারি করছে। হুইলারের স্টল থেকে সে কিছু এক্লেয়ার্স কিনে আমাকে অর্ধেক দিল। তারপর বলল – বয়ম্যান, একমাসের আগে দেখা করতে আসিস না। আমাকে একটু থিতু হয়ে বসতে দে। তুই এলে তো পুরো সময়টাই তোকে দেব।

    তাদের সিট পড়েছিল প্ল্যাটফর্মের উলটোদিকে। ট্রেন ছাড়ার পর আমার বান্ধবীকে দেখতে পাওয়ার আশা ছিল না। কিন্তু স্টেশন থেকে গাড়ি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন জানালা দিয়ে অনেক হাতের মধ্যে হঠাৎ একটা মেহেন্দীর লতা আঁকা বাঁ হাত বেরিয়ে এসে ঝিরঝির করে নড়তে লাগল।

    আমিও হাত তুলে নাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যদি স্টেশনের এতগুলো হাতের মধ্যে আমার হাতটাকে ত্বক দেখে চেনা যায়।


    পর্ব ১             পর্ব ২             পর্ব ৩
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments