• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • সিখ্‌নীর শরণে : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত


    [পুরোনো দিল্লী/চণ্ডীগড়, ১৯৮৩]

    নক্‌শ-এ-পা

    কবুতরী বুটিক থেকে দুটো কালো গোলাপের মতো গাঢ় রঙের ইম্পোর্টেড লিপস্টিক কিনেছিলাম। পম্পা আমাকে দোকানের এক কোণে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে বলল – এইগুলো পরলে তুই আমার প্রতি আকৃষ্ট হবি?

    - আরেকটা আছে। বলে তাকে একটা প্রায় ছ ইঞ্চি উঁচু হিল তোলা জুতো দেখাই।

    - ও, এই পোল দুটোতে উঠলে তোর আমাকে তুলতে একটু সুবিধে হয়ে যায়, তাই না? এটা পরে কিন্তু আমি বাসে উঠব না। তাহলে একটা স্কুটার ধরতে হবে।

    ছ ইঞ্চি উঠে গেলে বান্ধবী আমার চেয়ে এক চুল লম্বা হয়ে যায়, আর তার শরীরের সবচেয়ে সরু অংশটা হাতের আরো নাগালে এসে পড়ে। নাচ প্র্যাকটিস করার সময়ে দুই বাহু মন্দিরের ভঙ্গিতে মাথার উপরে তুলে জুতো ছাড়াই সে যখন এক পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াত তখন মেঝেতে বসে লিলিপুট সৈন্যের একজন অকিঞ্চন ল্যান্সনায়কের মতো বিস্ময় ও সমীহের দৃষ্টিতে আমি তাকে দেখতাম। দুশো হাত দড়ি আর গজাল সমেত যেন আমাকে একটা দুরূহ পাহাড়ের চূড়া আরোহণ করতে পাঠানো হয়েছে।

    কাশ্মীরী গেটের ভুলভুলাইয়ার মতো গলি। একটা পেরিয়ে আরেকটাতে ঢুকি আর সেটা একটু দূর গিয়ে গোল হয়ে ঘুরে উলটোদিকে যেতে শুরু করে। পম্পা আমাকে বলল – ওরকম ধুপ ধাপ করে হাঁটছিস কেন?

    মুহতরমার নতুন স্যান্ডেলের সরু হিলের পাশে আমার থ্যাবড়া কেড্‌স জুতোজোড়া থপ থপ করে ভাঙা পিচের রাস্তায় মারছিলাম। যদি কয়েকটা দাগ ফেলা যায়। তাকে বললাম – তোমার কাছাকাছি থাকার সময় বোধহয় আমার টেস্টোস্টেরোন লেভেল হাই হয়ে যায়। এটা কি তার ফল?

    - হরমোন লেভেল বাড়লে মানুষ বনমানুষের মতো ব্যবহার করে নাকি?

    হোক বনমানুষী। কিছু পায়ের ছাপ রেখে যাওয়ার একটা মূল্য আছে। বিশেষ করে যাদের জীবনে বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের লেখা এরকম একটা কাব্য আমার রুচিশীলা বান্ধবীকে পড়িয়েছিলাম। তার মাঝখানে ছিল –

        মেরে তেরে শহর কী
        হর ইক গলি মেঁ
        মেরে তেরে নক্‌শ-এ-পা কে বেনিশাঁ মজার হ্যাঁয়

    তাকে সেটা মনে করিয়ে বললাম – দ্যাখো, তুমি আর আমি যেরকম অলিগলি চলি রাম করে সময় কাটাই এটা আমাদের গল্পও হয়ে যেতে পারে। একদিন হয়তো তুমি বা আমি এই গলিতে ফিরে এসে দেখব আমাদের পায়ের ছাপগুলোর উপর এক একটা শ্বেতপাথরের মাজার হয়ে গেছে আর আমাদের অতীতের দেহগুলো তাদের প্রদক্ষিণ করে চলেছে।

    - লাইনগুলো খুব সুন্দর! কিন্তু এরকম দুঃখের গল্প আমাদের হোক সেটা আমি চাইব কেন?

    - না, সেটা আমিও চাইব না। তবু এর মধ্যে একটা চিরদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে লুকিয়ে আছে না?

    পায়ের ছাপগুলো আপাতত দৃষ্টির অতীত কোনো জগতে চলে যাচ্ছে। ইহজগতের গলিতে একটু নিরিবিলি পেলেই পম্পা ইচ্ছে করে গা ঘেঁষে হাঁটছিল। পা ফেলার সময় তার কোমরের পেন্ডুলাম এদিক থেকে ওদিক দোলে। চলার তালে তালে আমার শরীরে একটা স্কার্ট পরা হিপ বোন এসে ধাক্কা মারছে। আমার তন্বী সঙ্গিনী সামনের দিকে তাকিয়ে টান টান হয়ে হেঁটে চলেছিল। যেন কিছুই জানে না।

    মনে পড়ল, যার টাকায় এই দামী স্যাণ্ডেলটা কিনেছি সেই কাহারের মেয়ে তারাবাঈ নিজে বাজারের সবচেয়ে শস্তা প্লাস্টিকের চটি পরে। দৃষ্টির অতীত কোনো জগত যদি থাকে, সেখানকার মাটিতে হয়তো সেই গোলাপি চপ্পলের ছাপও আমাদের পায়ের ছাপের পাশাপাশি ফুটে উঠবে।


    কাঠবেড়ালির হাসি

    চণ্ডীগড়ে তার কলেজ শুরু হতে চলল। দুটো দিন বাদ দিয়ে তৃতীয় দিন পম্পা দিল্লী ছাড়ছে। আমরা সেই দুটো দিনের কর্মসূচী আগেই ঠিক করে ফেলব বলে কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলাম। নয় নয় করে ছাব্বিশটা আইটেম। এত কম সময়ে দিল্লীর এতগুলো পয়েন্ট ছুঁয়ে আসা অসম্ভব।

    - কাঠবেড়ালিদের বাই-বাই করার প্রোগ্রামটা বাদ দাও না? অনুনয় করলাম। - আর খুনী তালাবে সন্ধ্যেবেলা যাওয়া কি খুব জরুরী?

    - শুনছি শহর ছাড়ার আগে সন্ধ্যেবেলা একলা গিয়ে পা ডুবিয়ে এলে দিল্লীতে করা নিজের অজানা ভুলচুক মাফ হয়ে যায়। মোঘল যুগের ট্র্যাডিশান। আমাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত।

    খুনী তালাবে পা ডুবিয়ে বসার ব্যাপারটা অবশ্য আমিও শুনেছি। ব্রিটিশরা ফেরত যাওয়ার আগে দলে দলে করে গিয়েছিল। যারা এই প্রথা ভাঙত এই জিন আর ভূতের শহর নাকি তাদের ক্ষমা করেনি। অদৃশ্য হাত এসে পেনশন আটকে দিত। কেউ দেশ ছাড়ার পরেও বিলেতে বসে ইলেক্ট্রিসিটির বিল পেয়ে গেছে। কারো নামে বেরিয়েছে জেল ভাঙার জন্য হুলিয়া। কিন্তু মোঘল আর ব্রিটিশদের প্রশাসন এখন কোথায়? রিজের দুর্গম ভিতরে তালাবের দিকে সন্ধ্যেবেলা একলা যাওয়াটা পম্পার বয়সী মেয়েদের পক্ষে মোটেও নিরাপদ নয়। বারণ করতে গেলেও বিপদ। বলবে – তুই যেতে পারলে আমি পারব না কেন?

    ছাব্বিশটা আইটেম কমিয়ে আঠেরোতে নামানো হয়েছিল। সারা দিনে তার মাত্র চারটে সমাধা হয়েছে। আমরা কমলা নগর থেকে কিছু কেনাকাটা করলাম। দিল্লী ছাড়ার আগে পার্কটাউনের শকুন্তলা বাজারের সমস্ত শৌখিন জিনিস দিয়ে তার খোকাপুতুলকে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের লরির মতো বোঝাই করে যেতে চায়। না চাইতেই সবুজ শুঁয়োপোকা আঁকা সাদা গেঞ্জি পেয়ে গেলাম। উলটে পরা যায় সেরকম দ্বিবর্ণ ক্যানভাসের বেল্ট। একটা খুব দামি র‍্যাংলারের ফেডেড আর তাপ্পি মারা জিন্‌স্‌ যা আমি কিনতে দিচ্ছিলাম না। পম্পা ছলছলে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল – যাওয়ার আগে শুধু কাঠবেড়ালিদের দেখিয়ে আসতে চাইছিলাম আমাদের সম্পর্কটা কীরকম স্পেশাল।

    দোকান থেকে সেই ফেডেড জিন্‌স্‌ পরে বেরোতে হল।

    পরে রিজের ভিতর ঘাসের উপর আমরা জুত হয়ে বসে আছি। টোপ হিসেবে নুন দেওয়া কালোজামও আনা হয়েছে। এদিকে কাঠবেড়ালিদের দেখা নেই।

    অনেক দিন পরে আবার জিজ্ঞেস করলাম – কেন তোমাকে দিল্লী ছেড়ে পালাতে হচ্ছে সেটা অন্তত আজ জানতে পারব কি?

    পম্পা অধৈর্য হয়ে বলল – বলে কী লাভ? সবাই ভাববে আমি পাগল।

    - থাক তাহলে। আমাদের স্পেশাল সম্পর্কটা পণ্য আদান-প্রদানের মধ্যেই সীমিত থাকুক।

    জবাবটা আমার বান্ধবীর পছন্দ হয়নি। সে ভর্ৎসনার দৃষ্টি দিয়ে আমাকে ভালো করে চাবকাবার পর একটা নীরিহ কালোজামের পেটে হিংস্রভাবে দাঁত বসিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত বের করে দিয়েছিল। পরে সে বলল – ঘাড়ে একটা সন্দেহের ভূত চেপে বসে আছে। সেটাকে চিরদিনের মতো তাড়িয়ে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য দূরে থাকা দরকার।

    - সন্দেহটা একেবারে অমূলক। আমি কোনো নতুন গার্লফ্রেণ্ড খুঁজছি না।

    - না, না। সেই সন্দেহ নয়।

    আমরা বসে একের পর এক কালোজাম ধরে খাচ্ছিলাম। টুপ টুপ করে ঘাসের উপর তাদের রস ঝরছে। - এরপর আর তুই আমাকে সুস্থ বলে ভাবতে পারবি না, এই বলে অভিলষিতা কলেজগার্লটি নিজের মনের উল থেকে একটা অদৃশ্য কালো সুতো ধরে টানতে শুরু করল। পম্পা যত তার মনের সোয়েটার খুলে দিচ্ছিল, আমরা তত একে অপরের অচেনা হয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের ভিতরের দূরত্ব কি একদিন দিল্লী আর চণ্ডীগড়ের চেয়ে বেশি হওয়া সম্ভব? ভাবনা হয়ে যায়।

    পম্পা বলেছিল – এই যে পাশাপাশি পাড়ায় কেটেছে আমাদের ছেলেবেলা, এই যে তোর সাথে এসে এই গাছটার তলায় বসেছি, এই যে আমরা পুরোনো শহরের গলিগুলোতে হাজার হাজার নকশ-এ-পা’য়ের মাজার বানিয়েছি – আমার ভয় হয় যে এই সব কাণ্ড একটা লম্বা স্বপ্নের ভিতর ঘটে গেছে। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে জানতে পারব এই দিনগুলো আমার অপূর্ণ ইচ্ছে দিয়ে তৈরি একটা সিনেমার মতো, যা জীবনে একবার মাত্র দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। ঘুম ভেঙে গেলে একটা আলাদা পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে যেখানে আমি পম্পা মুখার্জি নই, অন্য কেউ। আর বয়ম্যান, তুইও নেই। অবিশ্বাস্য লাগছে তো? কিন্তু এই সম্ভাবনাটা বেশ কিছুদিন ধরে আমার মনে গভীরভাবে বাসা বেঁধে ফেলেছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ভয়ের চোটে চোখ বুজে থাকি। মনে হয় চোখ খুললেই একটা আলাদা জগৎ দেখব, যার বিষয়ে আমার কিচ্ছু এখন মনে নেই।

    ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে থেমে গিয়েছিল।

    চিন্তাটা শুধু অস্বাভাবিক নয়, বেশ ভয়াবহ। পার্কটাউনের এই হাসি-খুশী মেয়েটা তার ভিতরে এরকম একটা অশান্ত সত্তাকে লুকিয়ে রেখেছিল এবং আমি জানতেও পারিনি? খবরটা কালোজামের সঙ্গে চিবিয়ে গিলে ফেলার চেষ্টা করছি। পম্পা বলছিল যে তার ধারণা কোনো নতুন শহরে গিয়ে নতুন লোকজনের মধ্যে থেকে আমাদের পরিবেশটাকে নিজের মধ্যে থেকে বের করে দিতে পারলে হয়তো এই স্বপ্ন-স্বপ্ন ভাবটা কেটে যাবে। একদিন এই দিনগুলোকে সে হয়তো আবার সত্যি বলে চিনতে পারবে।

    একটা কাঠবেড়ালি কখন ভুল করে এসে পড়েছিল আমাদের বন্ধুত্ব ভিক্ষা করতে। অতিপরিচিতা মানুষ মেয়েটাকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে থমকে গেল। আমি তাকে ইশারায় কেটে পড়তে বলে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলাম – কবে থেকে এরকম মনে হচ্ছে তোমার?

    - গতবছর তুই আমাদের বাড়িতে বৃষ্টির মধ্যে কাক-ভেজা হয়ে এলি। মা তোকে তোয়ালে আর একটা গেঞ্জি বার করে দিল। গেঞ্জিটা ছিল এক দূর সম্পর্কের মামার। বাবার জামা তো তোর হয় না। তুই বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে দিয়ে গা মুছে সেটা পরছিলি। তোর পিঠের স্কিনটা এমন সিল্কের মতো স্মুদ, আমি আঙুল দিয়ে ছুঁতে গিয়ে বুঝলাম সেটা একটা স্বপ্ন।

    আমি বললাম - সেদিন তোমাদের দেওয়া ঢোলা গেঞ্জি পরে পাক্কা দেড় ঘন্টা বসে ছিলাম আর মাসিমা আমার জামা ইস্তিরি করে শুকিয়েছিলেন। ঘটনাটা একশোবার ঘটেছে। মোটেও এটা স্বপ্ন নয়।

    পম্পা বলল – মানুষ না তেরো ইঞ্চির গাধা? আমারই স্বপ্নের ভিতরে বসে কি তুই বলবি যে আমি স্বপ্ন দেখছি?

    তারপর সে হি-হি করে হাসতে শুরু করে দিল। এই হাসিটা তার স্বাভাবিক হি-হি হাসি নয়। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আসলে এটা হাসিই নয়। হাসির উলটো দিক।


    আমাদের ত্বক

    কাঠবেড়ালিদের কাছে বিদায় গ্রহণের পালা সাঙ্গ করে আমরা ইউনিভার্সিটির কফি হাউসে গিয়েছিলাম লিস্টের ছ নম্বর আইটেমে দাগ মারতে। পম্পার সঙ্গে থেকে থেকে আমার কফি গেলার অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে, যদিও বাড়িতে আমরা চা ছাড়া আর কিছু খেতাম না। গোধূলির দরজায় দাঁড়িয়ে আমি কড়া পানীয়টা খেয়ে সাহস বাড়াচ্ছিলাম। আরেকটু অন্ধকার হলে বান্ধবীকে খুনী তালাবে পৌঁছে দেব।

    গার্লফ্রেণ্ডের কবজির পাশে নিজের কবজি রেখে আমাদের ত্বকের তফাৎগুলো ধরার চেষ্টা করলাম। তারটা আমার চেয়ে বেশি টানটান এবং পীতাভ। যদি কারো চামড়া সিল্কের মতো হয় তো সেটা তার। আমারটা মোটা ব্রাউন কার্ডবোর্ডের মতো। যার ভিতর থেকে খোঁচা খোঁচা হাড়গুলো বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

    - ত্বকের উপরের অংশটাকে বলে এপিডারমিস বা বহিস্ত্বক। পম্পাকে বললাম। - এপিডারমিসের চারটে স্তর। তার সবচেয়ে বাইরের স্তরটাকে আমরা চামড়া বলে চিনি, যা আসলে মৃত দেহকোষ দিয়ে তৈরি। আমরা পরস্পরকে শরীরের শুধু একটা মৃত অংশ ছুঁতে দিই। জীবন্ত অংশটাকে অন্যের ছোঁয়া থেকে সরিয়ে রাখি।

    পম্পা আশ্চর্য হয়ে কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলল – ডক্টর বাজাজ তোকে এসব বলেছেন?

    নইলে আর কে? এবং এ ছাড়া আরো কত? বহিস্ত্বকের চারটে স্তর নিয়ে গড়গড় করে কিছু তথ্য দিয়ে দিলাম। এপিডারমিসকে ঘাড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চামড়ার সবচেয়ে মোটা পরত। যার নাম ডারমিস। ডারমিসকে দৃঢ়তা দেয় কোলাজেন আর ইলাস্টিন নামের প্রোটিন দিয়ে তৈরি তন্তুর মজবুত জাল। বয়সের সঙ্গে এই জালটা ফিনফিনে হয়ে আসে, যার ফলে চামড়া কুঁচকে যায় ও আমরা লোলচর্ম হয়ে পড়ি। ডারমিস আর এপিডারমিসের মাঝখানে চামড়ার নতুন কোষগুলো জন্মায় এবং মাসখানেক ধরে ধীরে ধীরে উপর দিকে ওঠে। যতদিনে তারা ত্বকের সবচেয়ে উপরের স্তরে গিয়ে পৌঁছোয় ততদিনে তাদের আয়ুও ফুরিয়েছে।

    - ও মাই ঠাকুর! বাজাজ কেন তোকে এসব উলটো পালটা জিনিস পড়াচ্ছেন? এই লোকটার উদ্দেশ্য কী?

    আমি সন্দেহ করি ডক্টর বাজাজ তাঁর ল্যাবরেটরিতে আমার উপর অবর্ণণীয় কিছু একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চান। কিন্তু সেটা পম্পাকে মুখ ফসকে বলে দিলে সে চেঁচিয়ে পাড়া জড়ো করে দেবে। প্রশ্নটার সোজা জবাব না দিয়ে তাই বললাম - শোনো, ত্বকের ভিতরে আছে হাজার হাজার মাইল লম্বা সূক্ষ্ম রক্তবাহী উপশিরা। সেগুলো কখন কীভাবে ফেটে রক্ত জমেছে তা বোঝা যায় চামড়ার রং দেখে। পোস্ট মর্টেম করার সময় শবের চামড়ার প্রতিটি বর্গ ইঞ্চির দিকে অটপ্‌সি সার্জেনদের নজর রাখতে হয়। সেইজন্য গুলজারীলাল বাজাজের প্রিয় আলোচনার বিষয়ও এই দুটো – শবদেহ আর ত্বক। তিনি আমাকে বলেছেন শিমলিপুরের মানুষের চামড়া সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা।

    - এরপর শুনবি তোরা মানুষই নয়। সরীসৃপ। বিশ্বাস করিস না এসব। তোর স্কিন খুব নর্মাল। আমার চেয়েও ভালো।

    - কোথায় ভালো? দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। আমার পিতৃদেব ছিলেন তোমার বাবার ঠিক উলটো। শরীরটা রোগা। উপরে ভাল্লুকের মতো লোম। আমারও বুক জুড়ে বাবাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করার জন্য অগুনতি লোম গজিয়ে গেছে। তিন বছর পরে এসে আমার জায়গায় একটা অন্য জন্তুকে পাবে। তখন দেখবে তুমি দিন গুনছ কখন এই দুঃস্বপ্ন ভাঙে।

    পম্পা গ্যাঁট হয়ে বসে আমার কবজির পাশে নিজের কবজি রেখে বলল – দ্যাখ, আমার স্কিন ঠিক মায়ের মতো, এবং সেরকমই থাকবে। তুইও চাইলে তোর সব লোম ওয়্যাক্স দিয়ে তুলে দিতে পারি। তাহলে তোর আর আমার মধ্যে যেটুকু তফাৎ না থাকলে নয় সেটুকু থাকবে শুধু।

    কিন্তু তার বদলে যদি আমার শরীর সত্যিই একটা সরীসৃপের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যায়? বা কোনো আরো অদ্ভুত উপসর্গ দেখা দেয়? আমার সঙ্গিনী আর আমি পরস্পরের ত্বক জরিপ করছিলাম। তিন বছর পরে যখন দেখা হবে, তখন যাতে চিনতে কোনো অসুবিধে না হয়।

    পম্পা মুখার্জি যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে আরেকটু কাছে এসে বসল। তারপর পিঠে হাত রেখে সে বলল – বাজাজ লোকটা নিজেকে সুপারম্যান ভাবে। একদিন বোঝাবার চেষ্টা করবে যে তোরা সাপ বা কেঁচোর মতো কোনো লোয়ার স্পিশিস। হী ফীড্‌স্‌ অন ইয়োর ফীয়র। তার কথায় একদম ভয় পাবি না।


    লেম ট্রি

    পরের দিন সকাল থেকে বৃষ্টি। পম্পা লিস্ট ছিঁড়ে ফেলল। আমরা সারাদিন তার ঘরে বসে বসে গান শুনলাম আর কুড়মুড়ে আলুভাজা খেলাম।

    আমার বান্ধবীর বাবা-মা তাকে চণ্ডীগড়ে পৌঁছে দিতে যাবেন। কয়েকদিন সবাই থাকবে সেখানে। চারটে স্যুটকেসে সব জিনিস প্যাক হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। যতবার দেখছি একটা ধাক্কা লাগছে কোথাও। কালকের পর থেকে আমাদের জীবন কীরকম পালটে যাবে সেটা আমরা দুজনেই বোধহয় বুঝতে পারছি না।

    মাসিমা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে পড়লেন। হাতে একটা ছোট অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই আর খুন্তি। আমরা ছোটরা যতই ঝিমিয়ে পড়ছি, মাসিমা ততই ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন। বললেন – এগুলো যাবে তোর সঙ্গে।

    পম্পা হতভম্ব হয়ে বলল – আমি রান্না করব কোথায়? জায়গা কই?

    - যদি একটা স্টোভ কি হিটার পেয়ে যাস? লুচি-টুচি খেতে চাইলে?

    - ছাড়ো মা। ওসব যদি সম্ভব হয় পরে নিয়ে যাব। এখন গিয়ে দেখি জায়গাটা কীরকম।

    মাসিমা বেরিয়ে গিয়ে একটু পরে আবার ফিরে এলেন। এবার হাতে একটা কাগজের ঠোঙা। সেটাকে মেয়ের হ্যাণ্ডব্যাগের ভিতর ভরতে যাচ্ছিলেন, মেয়ে কেড়ে নিয়ে মেঝেতে উপুড় করে দিল। বেরোল দুটো শুকনো লঙ্কা আর তাদের চেয়েও শুকনো একটা রসুন। মোটা সাদা সুতোর গোছা থেকে বেকুবের মতো সবাই ঝুলছে।

    - এ কী মা?

    - এটা ভীষণ দরকারি জিনিস। দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। অপদেবতা হোক, দুষ্টজন হোক, কারো হিংসের নজর পড়লে সেটাকে পুড়িয়ে দেবে।

    পম্পা কথা না বাড়িয়ে জিনিসটা মাকে ফেরত দিয়ে বলল – নিজের ব্যাগে ভরে নাও।

    ইচ্ছে ছিল কনট প্লেস থেকে কিছু নতুন গানের টেপ কিনে বান্ধবীকে বিদায় উপহার দেব। বৃষ্টির জন্য সকালবেলা করা যায়নি। বিকেলে আমরা কমলা নগরে গিয়ে হাজির হলাম চাট আর চা খেতে। মাসিমা বাড়িতে বসে বসে বোর হচ্ছেন বলে তাঁকেও টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভেবেছিলাম একটা হিন্দী আর একটা ইংরেজি গানের সংগ্রহ কিনতে পারব। কিন্তু একমাত্র ভালো ক্যাসেটের দোকানের মালিকটি উন্নাসিক। আমার আর মাসিমার আপত্তি গায়ে না মেখে সে জোর করে পম্পার হাতে মাইকেল জ্যাকসনের থ্রিলার ধরিয়ে দিল। শুনেছিলাম গানগুলো একগাদা গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছে। দাম হিন্দী ক্যাসেটের দুগুণ। সুতরাং বিদায়-উপহার হিসেবে বান্ধবী একটা মাত্র টেপই পেল।

    তিনজনে মিলে এদিক সেদিক ঘুরছি। পার্কের ধারে একজন মহিলা মেহেন্দীর নকশা করছিলেন। আমাদের দেখে তিনি ছুটে এসে মাসিমার একটা হাত ধরে টানতে শুরু করলেন। অন্য হাত ধরে পম্পা টানছে। লোকজন থেমে গিয়ে দেখছে কী কাণ্ড। আমি মাসিমাকে বললাম – কয়েকটা টাকার ব্যাপার। করিয়ে নিন না? কটাই বা খদ্দের পায় এরা? মাসিমা খেপে উঠে বললেন – তোর পয়সা বেশি তো তুই করাচ্ছিস না কেন? একটা হাতে করবে শুধু। দশ-বারো টাকা দেব তার জন্য?

    আমি বললাম – মাসিমা আমার কাছে দুটো দশ-টাকার নোট পড়ে আছে। দুজনকেই করিয়ে দেব?

    মাসিমার কন্যা হঠাৎ গৎ পালটে বলল – চলো মা, জয় যখন টাকা দিচ্ছে তখন করিয়ে নিই। চণ্ডীগড়ে গিয়ে দুজনে মিলে ঘুরব। ভালোই লাগবে।

    - তুই করা। আমার এই বুড়ো বয়সে ওসবের দরকার নেই।

    পম্পা মাকে জাপটে ধরে বলল – একদম নিজেকে বুড়ো বলবে না। তোমাকে এত মিষ্টি দেখতে। জয় ঠিক বলেছে। আমরা ওই বজ্জাত ক্যাসেটওয়ালাটাকে এত পয়সা দিয়ে এসেছি। একে কেন দেব না?

    আমাদের কথা শুনে মাসিমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন – বিশ্বসুদ্ধু লোককে তোরা পয়সা দিয়ে বেড়াবি নাকি? জমাবি না? নিজেদের জন্য কী থাকবে? আরে পয়সা একটা একটা করে জমাতে হয়। আমার মেয়েটা একদম বোকা। ও বোকাই থাকবে। তুই ওর মতো হতে যাস না।

    পম্পা হাসতে লাগল। আমি মাসিমাকে আশ্বস্ত করে বললাম – জমাব। আমরা কট্টর সুবিধেবাদী ফ্যামিলি। তায় একটু বামপন্থী ধাত আছে। মা বলে দিয়েছে প্রচুর রোজগার করতে হবে। যাতে দুহাতে ছড়াবার পরেও অনেক থাকে। বনের লেম ট্রি-র মতো হতে বলা হয়েছে আমাকে। বুঝলেন তো? লেমন নয়, লেম। মানে ল্যাংড়া আম। গাছ ভর্তি ফল হয়ে খসে যাচ্ছে। গাছ নিজে একটাও খাচ্ছে না। পশু-পাখিরা খায় তো খাবে। গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী খাক। ডাকাত-তস্করের মাথায় দুম-দাম খসে পড়ুক। পথ হারানো পথিক হঠাৎ পেয়ে গিয়ে কুড়িয়ে নিক। আজে বাজে ফলও নয়। বেনারসের ল্যাংড়া। নীম আর বটের জঙ্গলে এরকম একটা টপ কোয়ালিটির জিনিস এল কোত্থেকে? সবাই তাজ্জব। এদিকে গাছ ভাবছে, পড়ে নষ্ট হয় হোক। পরের বছর আরো বেশি হবে।

    - ছেলেটা আবার বাজে বকতে শুরু করেছে। মাসিমা গজগজ করতে থাকলেন। - সংসারে বাঁচতে পারবি না তোরা। সন্ন্যাসী হয়ে যা। বুদ্ধ হ।

    আমি গিয়ে মহিলাটিকে বললাম – বারো টাকা দিতে পারি, দুজনেরই একটা হাতে করে দিতে হবে। নকশা হালকা হলেও চলবে। জবরজং আমাদের পছন্দ নয়।

    - কুড়ি দিতে হবে।

    - তাহলে অন্য খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকুন। আমরা আইসক্রীম খেতে চললাম।

    আমি উলটো দিকে মুখ ঘোরাতেই মহিলা রাজি হয়ে গেলেন। অর্থাৎ ব্যবসা মোটেও ভালো হয়নি আজ।

    পম্পা মাকে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য আগে নিজে বসল। আমি মাসিমাকে বললাম – দেখলেন কেমন শস্তায় হল? হাফেরও কম আসলে। দিল্লীর যে কোনো বাজারে আমি এত তাড়াতাড়ি দাম কমিয়ে দিতে পারি যে দোকানদারদের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে যায়।

    ছ-টাকায় এক-একজনের হয়ে যাচ্ছে বলে মাসিমা অভিভূত। অকস্মাৎ হাতে ল্যাংড়া আম পাওয়ার মতো আনন্দে উপচে পড়ছেন। বাংলায় কথা বলছিলাম আমরা, যাতে মেহেন্দীওয়ালিটি বুঝতে না পারেন। মাসিমা হাসতে হাসতে বললেন – সত্যি দারুণ রেটে নামাতে পেরেছিস রে। এবার থেকে শপিং করার সময় আমরা তোকে নিয়ে যাব। কী করে পারলি এটা?

    আমি বললাম – সাইকোলজি মাসিমা। আজ এদের কিচ্ছু বিক্রি হয়নি। হবে কী করে? সারাদিন তো বৃষ্টি ছিল। বিকেলেও বেশি লোক বেরোয়নি মার্কেটে দেখছেন তো? হাত খালি। বৌনি করাচ্ছি আমরা। তার উপরে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা আইসক্রীমের দোকানে ঢুকলে দেউলে হয়ে বেরোয়। সে জন্য এরা আইসক্রীমের দোকানগুলোকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না।

    মহিলার হাতের কাজ খুবই ভালো। আমরা হালকা চেয়েছি বলে উনি পম্পার অনামিকার ডগা থেকে শুরু করে বুড়ো আঙুলের গোড়া অবধি একটা বাঁকানো লতা এঁকে ছেড়ে দিলেন। বেশি সময় লাগল না। ছ-টাকারই কাজ আসলে। কিন্তু দেখাচ্ছে দুর্দান্ত।

    মেয়ের হয়ে গেলে মাসিমা বললেন – আমাকেও ঠিক ওটাই দাও। দুজনের একরকম হোক।

    পম্পা আমার মুখের সামনে লতা আঁকা হাতটা ধরে রেখেছে। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি কপালের উপর দিয়ে একটা কোঁকড়া চুলের গুছি এসে পড়েছে চোখের উপর। পিছনে পার্কের রেলিঙের গায়ে দুটো মোড়া পেতে বসেছেন মাসিমা আর মেহেন্দীর আর্টিস্ট। ফুটপাথের উপর একটা জলের আয়না। তাতে আকাশের ছাই রঙের পর্দার আলো নিভে আসছে। নিরাশ ফিরিওয়ালারা মুহূর্তগুলো গুনছে। আমাদের চারদিকে লোকজনের চলাফেরা কমে এল। বাড়িগুলোতে বাতি জ্বালাবার সময় হয়নি তাও।

    ক্যামেরা থাকলে এই শেষ বিকেলের দৃশ্যটা আমি হারাতে দিতাম না। পম্পার আঙুলের ভিউফাইন্ডার দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখতে দেখতে আমি বুঝতে পারলাম যে এটা প্রকৃতই স্বপ্ন। পম্পার নয়। আমার। আমার স্বপ্নের ভিতরে একটুকরো চেতনার ঢেউয়ের মতো উঠে এই মেয়েটা আমাকে একটা খবর দিতে এসেছিল। যেন আমি প্রস্তুত থাকি। এই ঘুমের সুতো যেদিন ছিঁড়বে, সেদিন থেকে তাকে বা তার সঙ্গে আসা পৃথিবীটাকে দেখতে পাব না।

    ***

    মাসিমা কেন বারবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন? হাতছানি দিয়ে ডাকলেন একসময়। আমরা কাছে যাওয়ার পর বললেন – ভাবছি কুড়িটা টাকাই দিয়ে দিই। কী বলিস? জয় যখন বলেছে আজ বৌনিও হয়নি বেচারার। বাড়িতে কী নিয়ে যাবে? ওরও তো একটা সংসার আছে।

    পম্পা বলল – এখন ডবল দেবে? তাহলে বেশরমের মতো দরদাম করে হাফ প্রাইসে নামাবার কী দরকার ছিল? অত ঢং করো কেন তোমরা?

    আমি মাসিমাকে সমর্থন করে বললাম – মাসিমা, আপনার এই স্টাইলের জবাব নেই। একই সঙ্গে গরমা গরম চা আর চিল্‌ড্‌ সোডা খাওয়ার মতো লাক্সারি এক্সপিরিয়েন্স করাচ্ছেন আপনি। কুড়িই দেওয়া যাক।

    মাসিমা বললেন - তোকে দিতে বলিনি। আমি দেব। আমরা কি ন্যায্যমূল্য দিতে চাই না? বামপন্থী-টামপন্থী নই, আমরা সাধারণ মানুষ। তাহলেও আমরা দিই।

    পম্পা মায়ের হাত থেকে বটুয়া ছিনিয়ে নিয়ে বলল – খবরদার না। এটা জয় দেবে বলে আমরা রাজি হয়েছিলাম। দিলে ওকেই দিতে হবে।

    পরে যখন বারোর বদলে দুটো দশের নোট গছাচ্ছি তখন দেখলাম নির্মমভাবে দর কমাবার জন্য মহিলা আমাকে ক্ষমা করেননি। নোট দুটো থলের মধ্যে গায়েব করে দেওয়ার পর ধন্যবাদের বদলে নাকটা একটু কুঁচকে বললেন – এতটা কাজ নেওয়ার পর বারো দিতে লজ্জা করল, তাই না?

    কী টেটিয়া রে বাবা! মাসিমা কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। শুনতে পেয়ে একটু ভড়কে গেছেন। মুখটা কালো হয়ে যাচ্ছে। আমি মেহেন্দীওয়ালিকে বললাম – বারো তো দিলাম এই কাউয়ার পায়ের মতো ডিজাইনটার জন্য। আর আট দিয়েছি বাকি দুটো হাত খালি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আট টাকা কম নিলে বাকি দুটো হাতেও নিজের কীর্তি দেখাতে পারেন।

    মহিলা হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে না পেরে দাঁত বের করে চেয়ে রইলেন। আমিও দাঁত দেখিয়ে বিদায় নিলাম।

    যেতে যেতে মাসিমা আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে বললেন – দেখলি জয়, কীরকম অকৃতজ্ঞ আর সেয়ানা? বেশি পেয়েও খুশি তো হলই না, উপরন্তু তোকে যা-তা বলছিল।

    আমি মাসিমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম – চিন্তা নেই। চণ্ডীগড় থেকে ঘুরে আসুন, একসঙ্গে বাজারে যাব একদিন। দেখবেন কতগুলো সেয়ানাকে নাকের জলে চোখের জলে করে ছেড়েছি। আজ যা গেছে তার দশগুণ উসুল হয়ে যাবে। তবে একটা কথা মানতে হবে মাসিমা, মেহেন্দীর কাজটা এত ভালো হয়েছে, চল্লিশ দিলেও বেশি হত না।

    কিন্তু ততক্ষণে মাসিমা আর আমার কথা শুনছিলেন না। মা-মেয়ে মুগ্ধ হয়ে একে অন্যের বিচিত্রিত হাত দেখছে।

    পরের দিন সন্ধ্যেবেলা স্টেশনে গিয়েছি সবাইকে ছাড়তে। ট্রেন সময়ের আগে এসে দাঁড়িয়েছিল। মাসিমা জিনিসপত্র নিয়ে আগে ভাগে উঠে বসে রইলেন। মেসোমশাই বাইরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এক সহযাত্রীর সঙ্গে গল্প জুড়েছেন। পম্পা আমার সঙ্গে পায়চারি করছে। হুইলারের স্টল থেকে সে কিছু এক্লেয়ার্স কিনে আমাকে অর্ধেক দিল। তারপর বলল – বয়ম্যান, একমাসের আগে দেখা করতে আসিস না। আমাকে একটু থিতু হয়ে বসতে দে। তুই এলে তো পুরো সময়টাই তোকে দেব।

    তাদের সিট পড়েছিল প্ল্যাটফর্মের উলটোদিকে। ট্রেন ছাড়ার পর আমার বান্ধবীকে দেখতে পাওয়ার আশা ছিল না। কিন্তু স্টেশন থেকে গাড়ি যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন জানালা দিয়ে অনেক হাতের মধ্যে হঠাৎ একটা মেহেন্দীর লতা আঁকা বাঁ হাত বেরিয়ে এসে ঝিরঝির করে নড়তে লাগল।

    আমিও হাত তুলে নাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যদি স্টেশনের এতগুলো হাতের মধ্যে আমার হাতটাকে ত্বক দেখে চেনা যায়।


    ইয়ে ইশ্‌ক্‌ নহীঁ আসাঁ

    পম্পা চলে যাওয়ার পর দুটো সপ্তাহ কেটে গেছে। তাকে দেখতে যাওয়া দূরের কথা আমি একটা চিঠি অবধি লিখিনি। ফোন করার তো উপায়ই নেই। শনিবার বিকেলে স্কুল ছুটির পরে প্রবুদ্ধর সঙ্গে বেরোচ্ছি, এমন সময় কেউ বলল – জয়ের দাদা ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য ইস্কুলের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

    আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম – টোটোদা বম্বে থেকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এসেছে নাকি? হয়তো কয়েকটা দিন ছুটি কাটিয়ে যাবে। কিন্তু মেইন গেটে নয় কেন?

    যা হোক প্রবুদ্ধকে টা টা করে দিয়ে ইস্কুলের পিছনে পাঁচিলের ছোট ফাঁকটার দিকে হাঁটা দিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছে আমার সেই অনুভূতিটা শুরু হল যেটা বোধহয় একটা উড়ন্ত ঘুড়ি যখন আচমকা কেটে গিয়ে নিজেকে নিরালম্ব শূন্যে ভাসতে দেখে তখন তার পেটের ভিতর হয়।

    কারণ পিছনের রাস্তায় হেলমেট হাতে নিয়ে ইয়েজদি মোটর-সাইকেল সহ আমার অপেক্ষায় যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি আর কেউ নন, পম্পার প্রেমিক ও স্তনবৃন্তের রসজ্ঞ অনুগ্রাহী স্বয়ং গৌরাঙ্গ মাস্টার ওরফে রঙ্গা।

    আমাকে পাঁচিলের ফাঁকে দেখতে পেয়ে রঙ্গা এমনভাবে হাসছিল যেন আমরা কতদিনের ইয়ার। তারপর বাইকের সীট ঝেড়েঝুড়ে নির্লজ্জভাবে সে বলল – বাড়ি যাচ্ছ ভাই? চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই।

    রঙ্গাকে দেখে প্রথম আমার মনে যে প্রশ্নটা উঠেছিল তা হল - এটা কি সত্যি ঘটছে, না স্বপ্ন দেখছি? কতটা চোখের চামড়াহীন আর বদ্‌তমীজ হলে একটা মানুষকে ‘ফাক্‌ অফ’ বলার পরেও সে ফিরে আসে?

    এদিক ওদিক তাকিয়ে পাঁচিলের ফাঁক গলে ইস্কুলের মাঠে ফিরে এলাম। মনের ভিতর ঝড়। ভাবছি এই লুচ্চের লাট কি আমাদের পিছু ছাড়বে কোনোদিন? আমার বান্ধবীকে তো ফয়েলে জড়ানো টফির মতো চুষেছে। আমাকে এবার খোসা ছাড়িয়ে চিনেবাদামের মতো খাবে। বিল্ডিং লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করেছিলাম, এমন সময় পিছন থেকে একটা গা-ঘিনঘিনে ঘাম জবজবে হাত আমার কাঁধে এসে পড়ল।

    - জয়, দাঁড়াও প্লীজ। আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।

    - ক্ষমা? আমার শুকনো জিভে শব্দটা পুনরুচ্চারিত হয়েছে।

    - আমি তোমার আর পম্পার সম্পর্কটা ধরতে পারিনি জয়। পারবে আমায় ক্ষমা করতে? এমন নাটকীয়ভাবে বলল রঙ্গা যে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম ব্যাটা মদ কিম্বা গাঁজা খেয়ে এসেছে, যদিও গন্ধ পাচ্ছিলাম না বিশেষ।

    কাঁধ থেকে হাত সরছে না। আমার গার্লফ্রেণ্ডের শরীরের সবচেয়ে সরু জায়গাটা এই নোংরা হাতেই নরাধমটা জড়িয়ে ধরেছিল; তারপর… অ্যাঃ হেল্‌!

    আপদটাকে তাড়াবার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে বললাম - পেরে যাব। মনে হচ্ছে পেরে যাব ক্ষমা করতে। আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান বাড়ি। এ নিয়ে আর ভাববেন না।

    - আমার উপর খুব রাগ হয়েছিল তোমার?

    - খুব নয়, একটু আধটু…। জোর লাগিয়ে তার হাতের আঙুলগুলো খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বললাম – যো হুয়া সো হুয়া। ভুলে যাওয়া যাক না?

    - পম্পা আমাকে সব বলেছে। তুমি বারবার অনুরোধ না করলে সে আমার সঙ্গে দেখা করত না। সে জন্য আমি তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব জানি না।

    বলে কী? আমি নাকি পম্পাকে অনুরোধ করেছি তার সঙ্গে দেখা করতে! নিজের এরকম মহত্বের কথা তো নিজেই জানতাম না। কবার আমার সৌজন্যে এই চঞ্চু-বাড়ানো ক্রৌঞ্চমিথুনের দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে কে জানে? ঊরুভঙ্গ হওয়া দুর্যোধনের মতো আমার দুপা থেকে হাঁটার শক্তি বিদায় নিচ্ছিল।

    যেদিন পম্পার সঙ্গে আশাদি আর সত্যা স্যারের করা ‘দহেজ মুবারক’ নাটকের রিহার্সালে যাই সেদিন দুপুরবেলা পার্কটাউনের স্টপে বাস থেকে নামার সময় একটা সাইলেন্সার খোলা ইয়েজদির আওয়াজ পেয়েছিলাম। আমার কোনো সন্দেহ ছিল না যে শব্দটা রঙ্গার গাড়ি থেকে আসছে। দু-মিনিট পরে পম্পা আমাকে তাদের গলির মোড়ে এসে ধরে। দুয়ে দুয়ে চার করতে আমার এক-সেকেণ্ডও লাগেনি। তাদের গলির বেশ খানিকটা দূরত্বে রঙ্গার মোটর সাইকেল থেকে নেমেছিল আমার শকুন্তলা। তখন আমার পাপচিত্ত সাবধান করে দিয়েছিল - জয়, তোর গার্লফ্রেণ্ড একটা নগরবধূ। কথাটা আমি মুখ ফসকে বলেও ফেলি।

    তখনই আন্দাজ করেছিলাম রঙ্গার সাথে দেখা করার নামে পম্পা যেদিন আমাকে ইউনিভার্সিটির কফি হাউসে ঠায় এক ঘন্টা বসিয়ে রেখেছিল সেদিন কেন তার প্রেমিকের টিকিও দেখা যায়নি। ঘটনাটার জন্য মাসিমা ভারি আশ্চর্য হলেও তাঁর মেয়ে খুব একটা বিস্ময় প্রকাশ করেনি। আসলে সেদিন আদৌ রঙ্গার আসার কথা ছিল না। তাদের রাঁদেভুর তারীখ ছিল অন্য, যেটা পম্পা কাউকে জানায়নি। আমি আশা করেছিলাম আমার বান্ধবী সেদিন রঙ্গাকে শেষবারের মতো দফা করতেই গিয়েছিল। এই অনুমানগুলো আমার সঙ্গে শিমলিপুরের মাটিতে একদিন চাপা পড়ত, যদি এই উজবুকটা সামনে এসে আবার খাড়া না হত।

    সেদিনের পরে দুটি পাখি আরো কয়েকবার এক ডালে বসেছে কি?

    পালাতে চাইছি, কিন্তু পা উঠছে না। রঙ্গা ধীরেসুস্থে আবার কাছে এসে একেবারে গায়ের সঙ্গে ঘেঁষে বলল – একটা রিকোয়েস্ট আছে। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেব না তোমার। প্রমিস।

    পরে রঙ্গা আর আমি তার ইয়েজদির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কখন স্কুলের মাঠ খালি হয়ে গেছে। পিছনের এই মাটির গলিটাতে আমরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। বিকেলের দুঃখী পায়রাগুলো কোথায় যেন বকম বকম করছে।

    - আমি তোমার বন্ধু হতে চাই, জয়। রঙ্গা একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে আমাকে অফার করে বলেছিল।

    সিগারেট আমি খাই না। স্কুলের এত কাছে দাঁড়িয়ে জিনিসটা হাতে ধরলেও আমার যথেষ্ট সমস্যা, এই বুদ্ধির ঘন্টাঘরের মাথায় সেটা আসেনি। সংক্ষেপে ‘না’ বললাম। রঙ্গাও বেমালুম প্যাকেট পকেটে ঢুকিয়ে নিল; ছেলেটার পেটানো, স্বাস্থ্যসচেতন চেহারা। হয়তো সেয়ানাটা নিজেও খায় না, লোক দেখাবার জন্য নিয়ে ঘোরে। মোটর সাইকেলের সীট আরেকটু ঝেড়েঝুড়ে সে বলল - তোমার বিষয়ে যা শুনেছি সব হুবহু মিলে যাচ্ছে। আশ্চর্যভাবে চিনেছে তোমাকে পম্পা। থ্যাঙ্ক গড!

    খুক্‌ খুক্‌ করে কাশলাম একটু। পম্পা কী বলেছে আমার নামে? এই ধড়িবাজ মক্কেল সত্যি আমার বিষয়ে কিছু শুনেছে না সব বানিয়ে বলছে? বললাম – আমরা যা শুনি তার মধ্যে কিন্তু অনেক ভুল খবরও থাকে।

    - ভুল তো পম্প্‌স্‌ ভাঙিয়ে দিয়েছে ব্রাদার। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদের মধ্যে একটা, ইউ নো, ইল্লিসিট সম্পর্ক আছে। পম্পার মতো ফিগার আর তুমি পাবে কোথায়? ফিগারের প্রকৃত সমঝদারের মতো দুচোখ বন্ধ করে আমার বান্ধবীর দেহলতাকে এই সুযোগে আবার স্মরণ করে নিয়ে বলল রঙ্গা। - তার কাছে প্রাইভেটলি নাচ শিখতে গেলে কিছু তো একটা ঘটবে? অন্তত সেটাই আন্দাজ করবে লোকে। কিন্তু পম্প্‌স্‌ ধৈর্য সহকারে আমাকে বুঝিয়েছে তোমাদের সম্পর্ক কীরকম শুদ্ধ, আর তুলনাহীন।

    পম্প্‌স্‌ শব্দটা শুনে আমার রক্তের কেটলি ফুটতে শুরু করেছিল। রঙ্গাকে বললাম - এত সব বলে দিয়েছে? কিন্তু সম্পর্কটা তুলনাহীন কেন? সেটা বুঝিয়েছিল?

    - অফ কোর্স! ঝেড়েঝুড়ে ক্লিয়ার করে দিয়েছে ও কীরকম তোমাকে নিজের ভাই কিম্বা বোনের মতো দেখে। রঙ্গা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ ভাবে বলল কথাটা।

    লর্ড ইন হেভেন! বোনের মতো!! ঠিক শুনেছি কিনা জানবার জন্য ভজ-গৌরাঙ্গকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – ভাই কিম্বা বোন বলেছে? এটা কি একটা জোক? ঠিক শুনেছেন আপনি?

    - মাইণ্ড কোরো না। তোমার ভিতরে এখনো ঠিক ম্যাস্কুলিনিটি আসেনি কিনা। সেই ফ্লুইডিটি থেকে একটা শুদ্ধতার অ্যাপিল বেরোয়। রঙ্গা এমনভাবে বলল যেন আমার প্রশংসা করছে। - এই জিনিসটা পম্প্‌স্‌ আমাকে ভালোভাবে চিনতে অনুরোধ করেছিল। এটা বুঝে যাওয়ার পর তোমার সঙ্গে আরো ভালো ব্যবহার না করার জন্য আমি খুবই অনুতপ্ত।

    রাগে টগবগ করে ফুটছি আর ভাবছি আইটেমটাকে পিষে তার ম্যাস্কুলিনিটির তেল বার করতে হবে এবার। রঙ্গা উলটোদিকের পাঁচিলের দিকে ফিরে প্যান্টের জিপ খুলতে শুরু করেছিল। প্রথমে বুঝতে পারিনি কী ঘটছে। তারপর কোথায় গেল রাগ, বিস্ময়ে থ হয়ে গেছি। এটা ইস্কুলের গলি। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা হাঁটে। এই অশ্বশাবক পম্পার হৃদয়ে স্থান করবে? শান্তভাবে বললাম – এখানে কাজটা করবেন না, প্রাইমারির হেডমিস্ট্রেস ওয়াদিয়া দিদিমণি উপরের জানালা দিয়ে নজর রেখেছেন।

    - চিন্তা নেই, কেউ ধরার আগে আমি বেরিয়ে যাব।

    - আপনি তো যাবেন, কিন্তু আমাকে উনি চেনেন। আমার কাছ থেকে আপনার নাম জানা হবে। ঠিকানাও ওরা বার করে ফেলবে। দিল্লীতে আপনাদের বাড়িতে দেয়াল নেই?

    রঙ্গা একটু অবাক হয়ে বলল – দেয়াল সব বাড়িতেই থাকে।

    - ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, কাঁচের বাড়িতে যারা থাকে তাদের উচিত নয় অন্যদের তাক করে ঢিল ছোঁড়া? দিল্লী বোর্ডের নিয়ম কিনা জানি না কিন্তু সব জায়গায় দেখি হেডমিস্ট্রেসের পদটাতে খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ কাউকে বসানো হয়। কাল সকালের মধ্যে আপনার মা-বাবাকে গিয়ে বলা হবে সন্তানের অপকীর্তিটা যেন তাঁরা নিজের হাতে সাবান জল দিয়ে ধুয়ে যান, নইলে ওয়াদিয়া দিদিমণি হিসির পিপের মতো দুটো কুকুর আর দুটো ছেলেকে আপনাদের বাড়ির দেয়ালের উপর শোধ নেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেবেন। সে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঘেন্নায় কেউ ঢুকতে পারবে না।

    - আর ইউ মেকিং দিস আপ, জয়?

    - ইগনোর মী। নিজেদের বাড়ির দেয়াল ভুলে যান। তার চেয়েও বড়ো কথা কি বলুন?

    - কি?

    - জানাজানি হতে বাধ্য। পম্প্‌স্‌ কি পছন্দ করবে? এটা তারও স্কুল ছিল।

    রঙ্গার দুই কাঁধ ডাউন। জিপার আপ হয়ে গেল।

    হঠাৎ দেরি হয়ে গেছে ভাব দেখিয়ে বললাম – ঠিক হ্যায়, যা ঘটে গেছে তা ঘটে গেছে। এবার চলি তাহলে। রাইড লাগবে না কারণ বাড়িতে যাচ্ছি না, আমাকে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

    রঙ্গা খপ করে আমার কবজি চেপে ধরে বলল – যাওয়ার আগে একটা ছোট রিকোয়েস্ট। সেদিনের পরে তার আর কোনো খোঁজ নেই। প্লীজ তাকে আরেকবার অন্তত একটা ফোন করতে রাজি করাও। তুমি চাইলেই কাজটা হবে।

    - সে বলেছিল ফোন করবে?

    - মুখে বলেনি। কিন্তু চোখের ভাষা বুঝতে হয়, জয়। আমি জানি সে কী চায়। রঙ্গাকে পোষা বুলডগ বানিয়ে নিজের পায়ের কাছে এনে ফেলতে না পারলে সেই চোখদুটো সুখী হবে না। ভাঙোড়ির মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল গৌরাঙ্গদেব।

    প্রচণ্ড ইচ্ছে করছিল আমার রগচটা বন্ধু মলয় রক্ষিতের কায়দায় তক্তা ঘুরিয়ে ছেলেটার লাল টুকটুকে ঠোঁটদুটো বুলডগের মতো ভোঁতা করে দিই, তবু অস্বীকার করা যায় না যে পম্পার সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছাড়া এই লুচ্চের লতিফ করনাল থেকে এতদূর ধাওয়া করে এসেছে শুধুমাত্র এই দুরাশায় যে একটা কিছু খবর বার করতে পারবে। এদিকে দুসপ্তাহ হয়ে গেল, আমি আমার বান্ধবীর খোঁজ নিতে এখনো চণ্ডীগড়ে যাইনি।

    আমাদের তুখোড়তম প্রেমিক গালিব ভবিষ্যতের আশিকদের সাবধান করে বলেছিলেন -

      ইয়ে ইশ্‌ক্‌ নহীঁ আসাঁ বস্‌ ইতনা সমঝ লীজে,
      এক আগ কা দরিয়া হ্যায়, অওর ডুব কে যানা হ্যায়।

      এই ইশ্‌ক সহজ নয় করা, ব্যস্‌ এইটুকু বুঝে নিন আগে
      আগুনের দরিয়া সে এক, আর ডুবেই পেরোতে হয় তাকে।

    চোখের সামনে সেই আগুনের নদীটা সাঁতরে পার হচ্ছে রঙ্গা, আর আমি বেওকুফের বাদশা হয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি।

    রঙ্গাকে স্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি না দিয়ে বললাম – যদি ঠিকঠাক একটা সুযোগ পাই তাহলে কথাটা তোলার চেষ্টা করব।


    রাজ করেগা খালসা

    এক মাস পরেই পম্পার গ্রীন সিগন্যাল এল। তাকে দেখতে চণ্ডীগড়ে যেতে পারি। এই আতঙ্কের দিনে একা পাঞ্জাবে যেতে অনুমতি দেয়নি আমার বরিষ্ঠা বান্ধবী। সঙ্গে চলেছে প্রবুদ্ধ। আমাদের ক্ষ্যাপা ও রাস্টিকেট-মুখো সতীর্থ মলয় রক্ষিতকে প্রবুদ্ধ আর আমি সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখি, পাছে সে ইস্কুলে আবার একটা ঝামেলা পাকিয়ে নিজের ভবিষ্যতটা ঝোলায়। সুতরাং রক্ষিতকেও নিতে হল দলে।

    বাড়িতে এসব কিচ্ছু বলা হয়নি। মাকে বলেছিলাম প্রবুদ্ধর কিছু দরকারি কাজ আছে, সে চায় আমি তার সঙ্গে থাকি, তাই এক দিন স্কুল কামাই হতে পারে, আর দুটো রাত প্রবুদ্ধর বাড়িতে থাকব। মামা মাঝখানে নাক গলিয়ে দিয়ে বলল – এক দিন কেন? একবারে পাঁচ-সাত দিন কামাই করে ফ্যাল। তোকে ওই ডাফারদের ইস্কুলটায় ভর্তি করার পাপে আমার নরকভোগ আছে। এবার তুই নিজের কৃতিত্বে সেখান থেকে বহিষ্কৃত হয়ে আমাদের দুজনকেই উদ্ধার কর।

    সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরানো কথা। ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম - যা-তা ইঙ্গিত কোরো না। বহিষ্কৃত হচ্ছে কে? এক দিনেরই ছুটি নেব। অন্যরাও নেয়। সব কিছুতে তুমি আগ বাড়িয়ে এত টিটকিরি দাও কেন?

    মা ছুটে এসে হাতে পঞ্চাশটা টাকা গুঁজে দিয়ে বলল – কে তোকে বারণ করেছে? আমাদের উপর রেগে যাচ্ছিস খামোখা। হঠাৎ মা এতগুলো নোট কেন দিল সেটা বুঝতে পারছিলাম না। চণ্ডীগড়ের ভাড়া তো আমি আগেই সরিয়ে রেখেছি, তাছাড়া প্রবুদ্ধ যখন থাকছে সঙ্গে তখন চিন্তা কীসের। তাও এই হঠাৎ ভালোবাসার নিদর্শনে আমার রাগ জল হয়ে গিয়েছিল। বীরের মতো বেরিয়ে আসার আগে মামাকে শুনিয়ে বললাম – আমার পিছনে এই ফ্যামিলি যে কটা টাকা ঢেলেছে তার দশগুণ একদিন ফেরত পাবে। এটা তোমরা মনে রেখো।

    প্রবুদ্ধ বা মলয় তাদের বাড়িতে কী বলেছিল আমায় জানায়নি।

    সন্ধ্যে সাড়ে আটটায় পম্পা হোস্টেলে ঢুকে যায়। চণ্ডীগড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছোবার জন্য সকাল ছটার বাস ধরার প্ল্যান করেছিলাম। মলয়দের বাড়ি বাস আড্ডার কাছে নয়, সে শুনে সাফ বলল – দশটার আগে সম্ভব না। প্রবুদ্ধ নিউট্রাল। মলয়কে সাড়ে সাতটার বাসে রাজি করানোর জন্য হাতে পায়ে ধরতে হয়। তার পরেও মলয় আমার উপর একটু অপ্রসন্ন হয়ে ছিল।

    যাওয়ার দিন দেখা গেল অবাক কাণ্ড! মলয়কুমার স্নান-টান করে দাড়ি কামিয়ে আগেই এসে বসে আছে। কাঁধে কিটব্যাগ আর গলায় একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড জেনিট ক্যামেরা। ফুটফুটে ছেলেটাকে স্কুটারের পিছনে বসিয়ে পৌঁছে দিতে এসেছিল এক খুড়তুতো দাদা। সেই দাদা আমাদের সবাইকে বাসের সামনে দাঁড় করিয়ে মলয়ের ক্যামেরায় একটা ছবি তুলে দেয়। তারপর রক্ষিত একবার আমার সঙ্গে আর একবার প্রবুদ্ধর সঙ্গে গলা জড়িয়ে একটা করে ছবি তোলাল। অনুষ্ঠানের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, শুধু আমার চেনা ছেলেটার চরিত্রের সঙ্গে আমি খাপ খাওয়াতে পারিনি।

    একাদশ শ্রেণীর একটা হাসিখুশি প্রেমের অ্যাাম্বাসাডর যেন প্রবুদ্ধ আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লীর ঝাণ্ডা হাতে বিদেশ ভ্রমণে চলেছে। পানিপতে চা, আর আম্বালাতে বিস্কুট খাইয়েছে সে আমাদের। প্রধান বাস স্টপগুলোতে নেমে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে ছবি তুলছে, যেন আগে কোনোদিন বাড়ি থেকে বেরোয়নি। এই ছেলেটা আর যেই হোক আমাদের মলয় নয়। যেরকম বেহিসেবী ভাবে সে ক্যামেরার রোল নষ্ট করছিল তাতে প্রবুদ্ধরও ভুরু কুঁচকে যায়। ওষুধের দোকানের ছবি তুলে কোনো লাভ আছে কিনা সে জিজ্ঞেস করেছিল। মলয় আহত হয়ে বলল - দোকানের সামনে তুই আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম না? সেই স্মৃতির ভ্যালু তো ইনফাইনাইট।

    এই সংবেদনশীল ঋষি বালকই কি সেই মলয় রক্ষিত যে সরস্বতী পূজোর চারদিন আগে ফুটবলে ব্যানানা কিক মেরে স্কুলের প্রতিমার একটা হাত শুধু ডিসলোকেট করেনি, তারপর ভাঙা হাতটাকে ট্রফি হিসেবে প্রতিমার বডি থেকে কেটে নিয়ে যাবে বলে রাতে একটা হ্যাক-স নিয়ে ফিরে এসে ধরা পড়েছিল?

    পরে জেনেছিলাম, মলয় যখন দিল্লীতে অনুপস্থিত তখন তার পরিবারের সদস্য ও গুণ্ডা আত্মীয়রা আমাদের স্কুলের যে ছাত্রীটি মলয়ের সবচেয়ে বড়ো শত্রু তার জ্যাঠার গাড়িতে আগুন দেয়। মলয় আমাদের সঙ্গে চণ্ডীগড় ভ্রমণটাকে তার অ্যালিবাই হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

    যা হোক, সে এক অন্য ট্র্যাজেডি। আমাদের যাত্রা এইভাবে শুরু। বেলা সাড়ে বারোটার একটু পরে বাস থামে চণ্ডীগড়ে। সবই কেমন অস্বাভাবিকরকম নির্বিঘ্নে চলছিল। রক্ষিতকে আমার বান্ধবীর বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। বলা হয়েছিল আমি এক আত্মীয়ের বাড়িতে পৈতের নেমন্তন্ন রাখতে এসেছি। বাস স্টপের কাছাকাছি একটা ঢাবায় গিয়ে আমরা দুপুরের রুটি ছিঁড়ি। প্রবুদ্ধ আর রক্ষিতকে বসিয়ে আমি পাবলিক বুথ থেকে পম্পার দেওয়া ফোন নম্বরটাতে কল করেছিলাম। নম্বরটা আসলে তাদের হোস্টেলের নয়, একটা দোকানের। অন্য দিক থেকে এক কর্কশ মহিলা বললেন – দশ মিনিট বাদে আবার করো। দ্বিতীয় বার যখন করলাম তখন পম্পা ফোন ধরে বলল – হোস্টেলের বাইরে বড়ো রাস্তার উপর বেস্টলি স্ন্যাক্‌স্‌ বলে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, আমরা বীস্টলি স্নেক্‌স্‌ বলি। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। জঘন্য খাবার, কিন্তু মালিক আর মালকিন দুজনেই ভালো। তুই এখানে চলে আয়। উত্তরে বলেছিলাম – এক ঘন্টা লাগবে আমার। তার আগে তুমি এসো না।

    দেড়খানা রুটি গোগ্রাসে গেলার পর রাত্রে আবার এই ঢাবাতে দেখা হবে ঠিক করে আমি প্রবুদ্ধ আর রক্ষিতের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বাস স্ট্যাণ্ড থেকে একটা থ্রি-হুইলার স্কুটার পাকড়েছিলাম যাতে আমার বান্ধবীকে বীস্টলি স্নেক্‌সে গিয়ে বসে থাকতে না হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট আগে পৌঁছে গিয়ে দেখি যা ভেবেছি তাই, পম্পা আমারও আগে এসে সিঁড়ির একটা ধাপে রোদ চশমা পরে বসে আছে। তার পরনে নতুন গোলাপি রঙের সালোয়ার স্যুট। ইচ্ছে করে খানিকটা দূরে নেমেছিলাম। ব্যাগ থেকে তার দেওয়া কালো চশমা আর মাসিমার দেওয়া টুপিটা পরে রাস্তার ঢিলগুলোকে পা দিয়ে এদিক ওদিক শট মারতে মারতে এগোলাম। যেন চণ্ডীগড় আমার বাপের জমিদারী।

    পম্পা উলটোদিকে তাকিয়ে আছে। লক্ষ্য করলাম টাইট কামিজটা তার হাঁটুর দু-তিন ইঞ্চি উপরে শেষ হয়েছে, সালোয়ার সেই আগেকার দিনের পাঞ্জাবী মহিলাদের মতো ঢোলা। এরকম ছোট কামিজ দশ বছর আগে দিল্লীতেও খুব দেখতাম। এখানে মেয়েরা যত্র তত্র স্কুটার, মোপেড, এমনকী মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। দিল্লীতেও মেয়েদের এতটা দাপট নেই। দেশাচার। আবার দিল্লীর ডজন ডজন কো-এড হাই-ইস্কুলের কথা জানার পর রাজধানীতে বেড়াতে আসা বাঙালি আত্মীয়দের ভুরু তালু স্পর্শ করছে দেখতাম। নারীবাদী বলে আস্ফালন করলে কী হবে, নিজেদের পাড়ায় তারা কো-এজুকেশানের নামে ভির্মি খায়। আমার দেরাদুন ও দিল্লীপ্রবাসী দিদিরাও বছর পাঁচেক আগে কলকাতার রাস্তায় সামান্য সাইকেল চালাবার চেষ্টা করে পাড়ার হিংসুটে ছেলেদের মন্তব্যের শরজালে ঝাঁঝরা হয়ে ফিরেছিল। যাই হোক শাস্ত্রে বলেছে (বা অন্তত আমার মামারা বলে) মগধে মদ্যপান এবং গৌড়ে মৎস ভোজন দোষের নয়। কারণ যস্মিন দেশে যদাচারঃ পারম্পর্য্যং বিধিয়তে। সেই শাস্ত্র মেনে আমার গার্লফ্রেণ্ড এখানে আসার এক মাসের মধ্যে পাঞ্জাবিনী হয়েছে। রোদ্দুর থেকে ঘিলু বাঁচাবার জন্য তার দুপাট্টাটা মাথায় পেঁচিয়ে জড়ানো। এতদিনে কট্টর সিখনীই হয়ে গেছে বোধহয়। গর্বে আমার সীনা চওড়া হয়ে যাচ্ছিল। বুকটা চিতিয়েছি সবে, এমন সময়ে পম্পা আমাকে দেখতে পেয়ে যায়। আমার গন্তব্যহীন চিন্তার পাখিগুলোকে কচুকাটা করতে করতে সে সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নামতে লাগল।

    - সৎ সিরি অকাল। এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা করলাম। - ওয়াহে গুরুজী কা খাল্‌সা। তারপর একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। আকর্ষণীয়া খালিস্তানী প্রতিমাটির সামনে শির নুইয়ে তার প্রশস্তিগান করার লোভ সামলাতে পারিনি আমি।

      রাজ করেগা খাল্‌সা, আক্কি রহে না কোয়
      খুয়ার হোয়ে সব মিলায়েঙ্গে, বচে শরণ যো হোয়ে।
      খালিস্তান জিন্দাবাদ!

      সিখরা শাসন করবে (দিল্লী), শত্রুরা পরাহত
      হারানোরা ফিরে আসবে ঘরে, বাঁচবে শরণাগত।
      খালিস্তান জিন্দাবাদ!

    - ওয়াহে গুরুজী কী ফতহ্‌! বলতে বলতে ছুটে এসে পম্পা থাপ্পড়ের স্পীডে আমার মুখে ডান হাতটা চাপা দিল।

    শাম্পু করা চুল খোলা। মাথায় চুন্নি আর খাটো কামিজ ছাড়া কোনো পরিবর্তন নেই। হীরের নেকলেসের মতো হাসিটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য উধাও হলেও ম্যাচিং চোখদুটো স্বস্থানে কটমট করছে।

    - কী রেকলেস ছ্যাবলামো শুরু করেছিস ছাগল? খবরদার খালিস্তান নিয়ে কোনো ফালতু জোক নয়! ভুলে যাস না এটা পাঞ্জাব। ভালোয় ভালোয় যে এসে পড়েছিস সেটা আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য।

    ভালোয় ভালোয় আসব না কেন? যেমন বলা তেমন কাজ আমার, যদিও তা নিয়ে গর্ব করি না। এর কারণ আমাদের বাড়িতে বড়োরা কেউ কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না। এটা নাকি আমাদের কপাল। দৈবাৎ কিছু না কিছু বাধা এসে পড়ে। বড়োমামা আমাকে বলেছে যে আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলে আমার ভাগ্যেও সেই কপালদোষ আছে।

    পম্পার এক হাতে স্টিলের জাপানি ছাতা, অন্য হাতে একটা টফির বাক্স, যেমনটা বাচ্চাদের জন্মদিনে উপহার দেওয়া হয়। বকুনি দিয়ে শুরু করার পর সে ঝটপট মিছরির মেঠাই হয়ে গিয়ে বলল – বয়ম্যান, এই নে, এখানে যত রকমের লজেন্স আর টফি পাওয়া যায় স-ব জমিয়েছি তোর জন্য। আশা করি ভালো লাগবে।

    কিছুদিন আগে পর্যন্ত বন্ধুদের ছোট ভাই বা বোনের জন্মদিনে গেলে আমার জন্য টফি আর চকোলেট নিয়ে আসত পম্পা, যেন আমি একটা ন-দশ বছরের বাচ্চা। আট বছরের ছেলের মতো টগবগে উৎসাহ দেখিয়ে বাক্সটা ব্যাগে ঢোকালাম। পালটা উপহার হিসেবে আমি এনেছি দরিয়া গঞ্জের সেকেণ্ড হ্যাণ্ড মার্কেট থেকে কেনা দুটো বই।

    আমার বান্ধবীর কামিজের কাট অত্যাধুনিক টাইট। অথবা সে একটু বেড়েছে আগের চেয়ে। চোখ বার বার বেয়াদবের মতো আটকে যাচ্ছিল সেখানে। এক মাস পরে আবার তার দেহের চেনা সুগন্ধটা পাচ্ছি। ইউক্যালিপ্টাসের পাতার মতো ভারি হয়ে নেমে আসা চোখের পলকগুলো হাওয়ায় দুলছে। হঠাৎ একসঙ্গে এতগুলো স্মৃতি এসে বুকে হাতুড়ির মতো আছড়ে পড়ছিল যে সংযম হারিয়ে গেল আমার। নিরেট গবেটের মতো বললাম – পালিয়ে এসে তুমি যা চেয়েছিলে তা পেয়েছ?

    বলেই ভাবলাম ছি, ছি, এতদিন বাদে গার্লফ্রেণ্ডের সাথে দেখা হবার পর কি কেউ এরকম নির্দয় ব্যবহার করে? কীরকম পাষণ্ড আমি? পম্পা মুখার্জির চোখের ঝকঝকে আলোটা যায়নি, কিন্তু হাসিটা আর নেই। নিজের প্রতি ঘেন্নায় কাকের ছানার মতো ভিজে গিয়ে ভূরি ভূরি ক্ষমা চাইতে যাব, এমন সময় সে আমার দিকে মুখ তুলে বলল – এই যে গুরমুখীতে লেখা সাইনবোর্ডগুলো দেখছিস? এগুলো আমি স্বপ্নে বানাতে পারতাম না। হরফগুলো এখনো আমার অচেনা।

    বুঝবার চেষ্টা করলাম তার মানে কী। দিল্লী ছেড়ে আসার পর এই নতুন জীবনটাকে তার স্বপ্ন বলে মনে হয় না? এই জন্যই তো এখানে আসা।

    এবার অন্তত প্রসঙ্গ পালটানো উচিত ছিল। কিন্তু পতঙ্গ যেরকম আগুনের কাছাকাছি এসে আর পালাতে পারে না, সেরকম নিজেদের ক্ষতগুলো খোঁচাবার দুর্নিবার আকর্ষণে বললাম - সেরেই উঠেছ যদি তাহলে আরো তিন বছর থাকার দরকার আছে?

    দেখার পর পাঁচ মিনিটও হয়নি, আমি একটা উজবুকের মতো সমস্ত ফয়সালা করতে উদ্যত হয়েছি! পার্কটাউনের শকুন্তলা ধৈর্য আর চিনি দিয়ে তৈরি একটা পুতুলের মতো আমার হাত একবার ছুঁয়ে দিয়ে বলল – আয় আমরা কোথাও গিয়ে বসি।


    পাঞ্জাবিনী

    ছবির মতো সাজানো ইউনিভার্সিটির ভিতর কফি হাউসে গিয়ে আমরা বসেছিলাম। ঠিক যেন দিল্লীর কফি হাউসের আরেকটু পরিচ্ছন্ন সংস্করণ। একই রকম সাদা উর্দি পরা বেয়ারা। মাথার উপর ঘড় ঘড় করে ফ্যান চলছে। এক স্বাদের কফিও এসে গিয়েছিল। কথা নেই বার্তা নেই সন্দেহ-মেজাজ মুহতরমাটি যেন আমার গায়ের গন্ধ শুঁকে বলল – তুই কি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছিস?

    - ন্‌-ন-না তো! কেন বলছ এটা?

    - কারণ ভেবেছিলাম তোর বকবকানি থামানো যাবে না। এখন দেখছি মুখে তালা চাবি লাগানো।

    - ও। আমি কী ভেবেছিলাম জানো? তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ফেরত যাব। দিল্লীতে কোনো একটা কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হবে আর সেখানকার ইউনিভার্সিটির কফি হাউসে বসে আমি তোমার ত্বকের রং পালটাচ্ছে কিনা দেখব। মেহেন্দীর দাগটা তো এর মধ্যেই তুলে ফেলেছ মনে হচ্ছে।

    পম্পা তাড়াতাড়ি হাতটা আড়াল করে বলেছিল – যাঃ, ইচ্ছে করে তুলেছি নাকি? নিজের থেকেই উঠে গেছে কখন। তোর স্কিন কিন্তু পুড়ে পুড়ে আগের চেয়ে অনেক কালো হয়েছে। কার সঙ্গে সারাদিন রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াস বলতো?

    রোদ্দুর আর কোথায় পাব? সারাদিন স্কুলের খাঁচায় বাস করি। আসলে চামড়াটা মোটা হয়ে যাচ্ছে। বললাম - টেস্টো-স্টেরোনের কল্যাণ। দুষ্মন্তের মতো ক্রিমিনাল টেনডেন্সিগুলো আসবে এবার।

    শকুন্তলা বলল – তুই চৌদ্দতেই দুষ্মন্তকে ছাড়িয়ে গেছিলি। আচ্ছা, আমাকে যে ভুলিসনি তার কী প্রমাণ দেখাচ্ছিস?

    - তাড়া কীসের? কফিটা খাওয়া হয়ে যাক না।

    কফি খেতে খেতে আমার বান্ধবী উৎসাহের সঙ্গে তার নতুন কলেজের বন্ধুদের কথা বলছিল। সঙ্গে হাত দুটো নাচের ভঙ্গীতে অভিনয় করে চলেছে। এটা তার নিজস্ব অভিজ্ঞান, যা তার মায়ের মধ্যেও আমি দেখিনি। ভাবছিলাম এই মেয়েটা কলেজে উঠে এখন আমার চেয়ে আরো কত বড়ো হয়ে গেছে। ছুঁলেও নাগাল পাব না। এরই মধ্যে ক্লাসের সবাই মিলে বাসে করে কালকা ঘুরে এসেছে। সঙ্গে ছেলেরা ছিল। তার সেই সমবয়সী পুরুষদের কাছে আমি কী? কিছুই না। একটা বালকম্যান। এক্ষুনি সেরকম দুচারজন মুশকো জোয়ান এসে বলতে পারে ‘আবে ছোটু, কোন সাহসে তুই একটা কলেজের ছোকরির সাথে ফন্টুসি করছিস? শালা ফোট!’ তখন আমি কোন মুখে বসে থাকব?

    ভুলতে পারছিলাম না যে কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে আমাদের ব্যবধান আরো প্রকট হয়ে পড়ছে। কফি শেষ হয়ে গেলে জোর করে উঠে পড়েছিলাম। পম্পা হার মেনে বলে – আচ্ছা, চল তোকে রক গার্ডেন দেখিয়ে আনি।

    পরে দুপুর রোদে রক গার্ডেনটা প্রায় ছুটতে ছুটতে দেখে নেবার পর আমরা লেকের কাছে ছায়ায় একটা পাথরের উপর দুটো আঠা দিয়ে সাঁটা ভাঙা ইঁটের মূর্তির মতো বসি। ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করে পম্পাকে দিয়ে বললাম – কী আছে বলব না। খুলে নিজেই দেখে নাও।

    নতুন কোনো গল্প ভেবে হাসি হাসি মুখে পড়তে শুরু করেছিল সে। এক মিনিটের মধ্যে সেই হাসি গার্ডেনের গরম হাওয়ায় উবে গেছে। গল্প টল্প নয়। গরমের ছুটিতে আমাদের যতবার কথা হয়েছে তার প্রতিটা বাক্য ও শব্দ আমি যথাসম্ভব মনে করে করে লিখতে শুরু করি। তারপর দেখলাম একটা নেশার মতো হয়ে যাচ্ছে। গত দু-বছর ধরে আমাদের মধ্যে যে সংলাপের আদান-প্রদান হয়েছে তার সবই জাদুঘরের মতো সংগৃহীত এই ডায়েরিতে। তার আগে তো আমাদের দেখা হত কালে-ভদ্রে।

    আমার স্মৃতিশক্তি এমনিতে খুবই দুর্বল। কিন্তু স্বর আর ব্যঞ্জন বর্ণের ভিতর থেকে আদা পেঁয়াজ রসুন মার্কা বিভিন্ন ধরণের মশলার গন্ধ আমি পাই, আর কুকুরের মতো সেই গন্ধ একবার শুঁকে ফেললে তারপর ভুলি না। লিখবার সময়ে তাও আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করেছিলাম যে দুজনের মধ্যে যা যা কথা হয়েছে তার একটা লফ্‌জ্‌ও ভুলে যাইনি।

    ভাবলেশহীন মুখে পড়ে যাচ্ছে আমার বান্ধবী। যাকে আমার মামাবাড়িতে বলে স্পিকটি নট। মিনিট দশেক এইভাবে চলার পর সে শুধু দুটো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। ‘কবে থেকে লিখছিস?’ আর, ‘আমরা দুজন ছাড়া তৃতীয় কেউ নেই কেন?’

    আমি কোনোদিন ডায়েরি ফায়েরি লিখি না। সবাই জানে শিমলিপুরের ছেলেরা কীরকম কুঁড়ে। বললাম - শুরুই করেছি তোমার দিল্লী ছাড়ার পরে। আর সত্যি বলছি অন্যরা কে কী বলেছিল আমার তত ভালো মনে নেই।

    ব্যাস্‌, আরো দশ মিনিট পম্পার মুখে রা নেই। আমার দিকে ফেরেওনি সে। নেড়ি কুকুরের মতো একবার লেকের দিকে তাকাচ্ছি, একবার নিজের লেজের দিকে। পাখিদের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে ওড়ার বিজ্ঞানটা বোঝার চেষ্টা করছি। মনে মনে ভাবছি জিনিসটা না দেখালেই কি ভালো হত? হিতে বিপরীত হল নাকি?

    পরে যখন বুঝলাম সে আর কিছু বলবে না এবং আমাদের ছুটির এই একটামাত্র বেলায় ঘড়ির টিকটিক আওয়াজগুলো লেকের জলে ছুঁড়ে দেওয়া নুড়ির মতো চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে, তখন ক্ষমার আশা ছেড়ে দিয়ে বললাম – এসব কারো কাছে প্রশংসা পাওয়ার জন্য লিখিনি। আসলে স্কুল থেকে ফিরে এসে বিকেলগুলো বড্ড ফাঁকা হয়ে যায়।

    নিজের অনুচিত কীর্তিগুলোকে মনের সাউণ্ডপ্রুফ ঘরে আগলে রাখার নিয়ম। বলতে সাহস হল না যে ডায়েরিতে আমাদের অভিভাবকহীন সংলাপগুলো লেখার সময় প্রত্যেকটাকে আমি জিভ দিয়ে উচ্চারণ করতাম আর আমার গলাটা পম্পা মুখার্জির গলার মতো হয়ে যেত। অনুভব করতাম চামড়াটা হয়ে গেছে সিল্কের মতো মসৃণ। বুকের সামনের দিকটা নরম তুলতুলে। মনে এমন সব জিনিস আসত যা একটা ম্যানের পক্ষে গর্বের তো নয়ই, কোনো বয়কেও মানায় না।

    পম্পা আমার দিকে না ফিরে লেকের জল আর বাগানের বাতাসকে শুনিয়ে চারটে সংক্ষিপ্ত বাক্য উচ্চারণ করেছিল – অবসেশান। একটা। মানসিক। রোগ।

    আন্দাজ করলাম এর পর সব কিছু আরো কঠিন হয়ে যাবে, কারণ এতদিন শুধু তার মুখের কথাগুলো সঞ্চয় করিনি, নিঃশ্বাসের শব্দ, সালোয়ারের সঙ্গে পায়ের ঘষা লাগার খসখস, জুতোর হিল মাটিতে ঠোকার ঠুকঠুক আওয়াজ, এমনকী চোখের পলকের শ্রুতির অগম্য ওঠাপড়া, এসবও তো দু-বছরের বেশি ধরে তাকে লুকিয়ে দেখার সময় হুবহু মনে রেখেছি! পম্পা মুখার্জি এগুলো জানতে পারলে আমার কী শাস্তি হবে?

    খাটো কামিজ পরিহিতা মুহতরমাটি আবার মুখ ফিরিয়েছিল আমার দিকে। সে বলল – জয়, প্লীজ আমাকে আবার একটা অবাস্তব ফ্যান্টাসির জগতে টেনে নিয়ে যাস না। অবসেশানগুলো ছাড়। আমি একটা সাধারণ ছেলে চেয়েছিলাম, যে মেয়েদের সাধারণ মেয়ে হিসেবে দেখে। তুই আমাকে কোথাকার একটা অলীক কল্পনা বানিয়ে বসে আছিস। দু-দশ বছর পরে যদি মোটা হয়ে যাই, চামড়া কুঁচকে যায়, চোখে ছানি পড়ে তখন কী হবে?

    - তার বহু আগেই আমরা মরে যেতে পারি।

    - এই তোর জীবনের প্ল্যান? এর ভরসায় বসে থাকব আমরা?

    - কে বলতে পারে, হয়তো মরার আগে বড়ো হয়ে যাব আর এই অনুভূতিগুলো থাকবে না। হয়তো তোমাকে রঙ্গার চোখে দেখতে শুরু করব।

    পম্পা তীব্রভাবে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল – রঙ্গার কথাটাই তুই লুকোচ্ছিলি, তাই না?

    আমি সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বললাম – তিরিশের পরেও আমরা দুজন বেঁচে থাকব তার কোনো গ্যারান্টি আছে? তা নিয়ে ভেবে কী হবে?

    আমার সঙ্গিনী তীর খাওয়া পাখির মতো ছটফট করে উঠে বলল – বিশ্বশুদ্ধু মানুষ মরতে চায় না, বাঁচতে চায়! সবাই যেরকম সেরকম হতে তোর প্রবলেম কী? আমিও বাঁচতে চাই। আমি চাই তুই আমার বুকের সঙ্গে লেগে বাঁচিস। সামান্য এই স্বাভাবিক জীবনটা পাওয়ার জন্য কি তোর ব্রেনে সার্জারি করাতে হবে?

    তাকে শান্ত করার জন্য তরলভাবে বললাম – কানের উপর এক আধটা থাপ্পড় মারলেই যে কাজ হয় তার জন্য কেউ ব্রেনে সার্জারি করে না। আচ্ছা, মনে করো একদিন শীতের ভোরবেলা ঘুম থেকে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দেখলে তোমার আর আমার শরীরদুটো পালটাপালটি হয়ে গেছে। আমি তোমাকে বললাম – এসো আমরা চটপট আমাদের জামাকাপড়ও বদলাবদলি করে নিই কারণ তোমার তো আর ব্রা লাগবে না আর আমিই বা ছেলেদের এই বোকার মতো দরজাওয়ালা আণ্ডারওয়্যার দিয়ে কী করব? তো তখন কি তুমি আমাকে পাগল বলবে?

    লেকের ধারে এই রোদ্দুরে কদাচিৎ কেউ আসে। কলারে হ্যাঁচকা টান মেরে পার্কটাউনের প্যান্থারনী আমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছিল। তার বুকের রেলগাড়ির সঙ্গে রক্তের নদ-নদী এমন শোরগোল তুলেছে যা একবার শুনলে আর ভুলবার যো নেই।

    আমার কানের ভিতর নিজের গরম নিঃশ্বাসের হাওয়া পাম্প করতে করতে পম্পা বলল – একদিন যদি আমি না থাকি তো তুই আমার বেওয়ারিস পরিচয়টা দখল করে নিস। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে তুই পম্পা হতে পারবি না। যখন আমার কথা মনে পড়বে তখন এই হাড়মাংসের শরীরটার কাছেই তোকে আসতে হবে।

    শরীরের প্রসঙ্গ এনে ফেলে সে বোধহয় আপশোস করছিল। উজবুকের মতো দুটো সানগ্লাস পরা টুরিস্ট আকাশ থেকে টপকে পড়েছে। তারা সরে গেলেই আমি সঙ্গিনীর বেহতরীন টফিদুটো খাব কিনা ভাবছি। মুহতরমা আবার আমার মনের কথা টের পেয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি তার বাক্স থেকে দুটো অমৃতসরী লজেন্স নিয়ে আমার মুখে একসঙ্গে ঠুঁসে দিল।


    পারুলবেন

    বিকেলে আমরা তাদের কলেজের কাছে একটা বাজারে হাঁটছিলাম। কখনো এখানে ঢুকছি, কখনো ওখানে। পম্পা সঙ্গে থাকলে মেয়েদের জামাকাপড় আর গয়নার দোকানগুলোতে অবারিত প্রবেশের অনুমতি পেয়ে যাই এবং বিজ্ঞের মতো সব হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। দিল্লীর শীতে যখন কাঁসার থালার মতো সূর্য দুপুরে সবার খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাওয়ার পর নিজেও ঘুমে নরম হয়ে আসত তখন করোলবাগের কাপড়ের দোকানগুলোতে ফর্সা চাদর পাতা গদির উপর ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে এসবই তো করতাম আমরা। শিমলিপুরের নেকড়ের বাচ্চা আমি, চাইলে তার থেকে অনেক ভালো দরদাম করতে পারি। ইচ্ছে করলে এমন আস্তে আস্তে এই লোকগুলোকে চিবিয়ে খেতে জানি যে দুঘন্টা কেটে যাওয়ার এবং অর্ধেক দাম ছেঁটে দেওয়ার পরেও বিক্রি হয়নি দেখে তারা আধপেটা জন্তুর মতো সেল কমপ্লিট করতে মরিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু আমার সেটা করার অনুমতি নেই। মা সারাক্ষণ কানের কাছে বলে – জয় তুই নিজের মামাদের মতো গরিব হবি না, মামীর মতো হাত খুলে সবাইকে দিবি।

    পুরোনো দিল্লী জুড়ে এরকম শস্তা জামাকাপড় আর গয়নার দোকান এত আছে যে আমাদের পক্ষে এক জীবনে দেখে ফুরোনো সম্ভব নয়। কিছু মোঘল আমল থেকে ছিল, বেশির ভাগ জন্মেছে লাহোরীরা আশার পর। চণ্ডীগড়ে এসেও সেই লাহোরীদের পায়ের ছাপ দেখতে পাচ্ছিলাম। এখানে অবশ্য আমি রাস্তাঘাট চিনি না। চওড়া রোডগুলো নিরাপদে ক্রস করিয়ে দেবার জন্য পম্পা লোকাল গার্জেনের মতো শক্ত করে আমার কবজি ধরছে। একবার এরকম একটা রাস্তা পার করার সময়ে হঠাৎ তার মাস্‌ল্‌গুলো খিঁচুনি লাগার মতো টান টান হয়ে গিয়েছিল। তারপর সে ছিটকে কয়েক ইঞ্চি দূরে সরে যায়। দেখি সামনের ফুটপাথে গোটা চারেক কলেজের কবুতর-কবুতরী নিজেদের মধ্যে বকম-বকম করছে। পরে জেনেছিলাম চারজনের মধ্যে একজন মেয়েদের হোস্টেলে থাকে। বাকিরা এখানকার ভুট্টাক্ষেতের দানা খেয়ে বড়ো হওয়া লোকাল তিতির।

    শকুন্তলা মরিয়া হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। কোনো গাছের আড়ালে আমাকে লুকিয়ে ফেলা যায় কিনা দেখছে। দুর্ভাগ্য, উপযুক্ত একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল না। এদিকে মেয়েদের একজন পম্পার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাত নাড়াতে শুরু করেছিল।

    মেয়েটির নাম পারুল। সে আহমেদাবাদ থেকে এসেছে এবং বন্ধুরা তাকে আদর করে পারুলবেন বলে ডাকে। পম্পার সঙ্গে বেশ ভাব থাকলেও পারুলবেন দু-বছর সিনিয়ার। এদের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে পার্কটাউনের পম্পা মুখার্জির মাস্তানি শেষ। ঘাবড়ে সে আমার পরিচয় দিয়েছিল মামাতো ভাই বলে।

    - ওঃ, তোর ভাইও চণ্ডীগড়ে পড়তে এসেছে?

    - না, না, দিল্লীতে হাইস্কুলে পড়ে। ক্লাস ইলেভেন হল।

    আমি বললাম – একদিনের জন্য ছুটি নিয়ে এসেছি। কাল চলে যাব।

    আর যাবে কোথায়? ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখে পারুলবেন মুগ্ধ। বার বার বলছে সে – কী আদর্শ ফ্যামিলি! দিদিকে দেখার জন্য স্কুল ছুটি করে এসেছে ভাই। আর আমার মায়ের পেটের দুই দাদা জুতোর ব্যবসা নিয়ে এত ব্যস্ত যে একদিনের জন্য কেউ আমার খবর নিতে চণ্ডীগড়ে আসে না। এবার গিয়ে দেখি আমার ঘরটাকে গোদাম বানিয়েছে। কী বিশ্রী চামড়ার গন্ধ! যাওয়া মাত্র দশ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে বলল – এ-সিতে জুতো ভালো থাকে, তাই তোর ঘরটা টেম্পোরারিলি নিতে হল। দোকানের শো-রুমটাতে গিয়ে কিছুদিন থাকতে পারবি না লক্ষ্মী পারুল? মাটিতে বিছানা করে দেব। ভয় নেই, দিনের বেলাতেও বেশি কাস্টমার আসে না। জানিস তো বিজনেসের অবস্থা।

    হো হো করে হাসলাম সবাই। তারপর পম্পা আমতা আমতা করে বলল – জয় এখনও ছোট আছে তো? তাই আমার এরকম ন্যাওটা…।

    ব্যাপারটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আগ বাড়িয়ে বলি – মামাতো ভাই হলেও কাছাকাছি বাড়িতে থাকি কিনা। বলতে গেলে দিদির হাতে মানুষ হয়েছি, তাই না সিস্টার?

    ইচ্ছে করেই বলেছিলাম। মা-বোনের গাল শুনে লোকেরা ততটা খচে না যতটা আমার মুখে সিস্টার শব্দটা শুনলে পম্পা খচে যায়। ঊরুর পিছন দিকে একটা রাম চিমটি এসে গেল পত্রপাঠ।

    কলেজের দুজন ছেলের মধ্যে বলবীর সিং ওরফে বল্লু হল একজন বেঁটেখাটো কিন্তু দশাসই পাগড়ি পরা সর্দার। অন্যজনকে এরা লল্লু বলে, কারণ সে বল্লুর সঙ্গে ছায়ার মতো ঘোরে। তার আসল নাম করমজিৎ সিং ধিংড়া। তৃতীয়জনও চণ্ডীগড়ের লোকাল। তার নাম চান্দ্‌নি। বল্লু একটু বুক চিতিয়ে পুরোভাগে দাঁড়াতে ভালোবাসে। বোঝা যায় লীডার। সবাইকে সরিয়ে একটু জায়গা করে নিয়ে সে বলল – হোট্টল-ওয়ট্টল মেঁ উঠেছিস নাকি জয়?

    কোথায় উঠছি সেটা তো এখনও ঠিক জানি না। তবে সেরকমই একটা কিছু হবে আশা করা যায়। বল্লু পরামর্শ দেয় এরপর থেকে এসে যেন হোট্টল নয়, হোস্টলে উঠে ফ্রি-তে থাকি। তার বন্ধুদের বলে সে ব্যবস্থা করে দেবে। প্রস্তাবটা আমার কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য। তাহলে পরের বার যদি একা আসি আমার থাকার জায়গা নিয়ে পম্পাকে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। বল্লুর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম, পারুলবেন আমাকে মাঝপথে থামিয়ে বলল – তার চেয়েও ভালো প্ল্যান আছে আমার কাছে। চল তোকে ফালুদা দেওয়া কুলফি খাওয়াই আগে, তারপর বলব।

    এর পর আমরা বেস্ট্‌লি স্ন্যাক্‌সের কাছে একটা কুলফির দোকানে চলে এসেছিলাম। হিন্দী সিনেমার গানে শুনেছি, চান্দ্‌নি চার দিন কী হ্যায়। চণ্ডীগড়ের চান্দ্‌নি নামের মেয়েটা চার মিনিটের মধ্যে কেটে পড়ে, ফলে তাকে আমি ভালো করে চিনতে পারিনি, কিন্তু বল্লু-লল্লু বিশ্বস্তভাবে আমাদের সঙ্গে রয়ে গিয়েছিল। পাখার তলায় একটা টেবিল খুঁজে নিয়ে বসবার পর পারুলবেন হাতের ছোট্ট রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম শুষতে শুষতে পরামর্শ দেয় – বয়েজদের হোস্টলে কেন? ছেলেটা তো বাচ্চাই আছে। প্র্যাকটিকালি শিশু। দিদির সঙ্গে মেয়েদের হোস্টলে থেকে যাবে। কোনো অসুবিধে নেই।

    কথাটা পারুলবেনের মুখ থেকে বেরোতে না বেরোতে আমার নতুন দিদি চেয়ার ছেড়ে সটান খাড়া। বেচারার মুখ এমনভাবে হাঁ হয়ে গিয়েছিল যেন বিনা টিকিটে হাটের মাঝখানে তার স্ক্যাণ্ডালের হাঁড়ি ফাটানো হচ্ছে। টেবিল থেকে উঠে যাবে এরকম ভাব করে সে বলে - এটা কী হচ্ছে পারুল? রুল-বুকে স্পষ্ট লেখা আছে মেয়েদের হোস্টেলে কোনো বয়সের ছেলেই অ্যালাউড নয়। ধরা পড়ে গেলে আমার রেপুটেশান, হোস্টল দুটোই যাবে। তখন আমি কোথায় জায়গা পাব?

    - কুছ্‌ছ্‌ছ নহীঁ হোতা। পারুলবেন সবলে ফুঁ দিয়ে পম্পার আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছিল বাতাসে। - সব্বার ফ্যামিলি এসে থাকে। তুই কাঁচা আছিস বলে দেখতে পাস না। পারুলবেনের যুক্তি সরল। রুল-বুক জিনিসটাকে কে রেস্‌পেক্ট করে না? তাই বলে কি সব রুল মানতে হবে? রুল-বুকের প্রতি শ্রদ্ধা আছে বলেই তো যার ভাই বা ফ্রেণ্ড এসে থাকছে সে পাঁচজনকে জানান দিয়ে বেড়াচ্ছে না। যা করার কোয়ায়েটলি সারছে। পিছনের দরজায় বসা ম্যাডামকে একটু চায় পিলাবার প্রমিস করে সন্ধ্যের দিকে পার্টিকে ঢুকিয়ে নিতে হয়। তারপর ঘর থেকে না বেরোলেই হল।

    পম্পা আমার দিকে একবার দেখে নিয়ে কোঁকড়া চুল ভর্তি মাথাটা ঘন ঘন নাড়িয়ে বলল – যাঃ এটা হয় না। আমি এসব পারব না।

    - আরে তোর পাশের ঘরে জস্‌প্রীতের কাছে তার হোলি ফ্যামিলি দুদিন ধরে আছে। শুনলাম ওর দাদা, বৌদি, আর একটা দশ-বারো বছরের ভাইপো এসেছে। ছেলেটা জয়ের চেয়ে কয়েক বছর ছোট হবে। স্বচক্ষে সকালে জস্‌প্রীতকে চারটে চা নিয়ে যেতে দেখেছি। বাথরুমে তার পিছু পিছু একটা চাদর ঢাকা দেওয়া মূর্তি এসেছিল। গাঁওয়ের লোক মনে হয়, হোটল-ফোটলে বাজে খরচ করে না। ট্রেনেও আসেনি। দেখেছিস তো, হোস্টলের পিছনের গলিতে দুদিন ধরে একটা ট্র্যাক্টর খাড়া?

    পম্পা প্রথমে বলেছিল - গুল দিস না পারুল! এতটা সাহস কারো হবে না। তারপর একটু চিন্তা করে সে বলে - আর হলেও ফুলহার্ডি কাজ। ধরা পড়ে গেলে কী করত?

    পারুলবেন জানায় ধরা পড়লে নাকি হাত ধুয়ে স্টেটমেন্ট দিতে হয়, ‘চিনি না’। ম্যাডাম পিছনের গেট দিয়ে অনুপ্রবেশকারী পার্টিকে দফা করে দেন। আর কিছু হয় না। পারুলবেনের মতে অবশ্য ধরা পড়াই অসম্ভব, কারণ চুকলি করে বড়োলোক হয় না কেউ, বরং সঙ্গে সঙ্গে তার চারটে শত্রু পয়দা হয়ে যায়।

    পরে পারুলবেন এদিক ওদিক দেখে নিয়ে নিজের একটা গোপন কথা ফাঁস করেছিল। সে নাকি দুবছর ধরে ঘরের ভিতর ফাফরা ভাজে। রুল-বুকে যেটা মোস্ট স্ট্রিক্টলি বারণ। - সবাই গ্লাস হাউজে বাস করে রে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল পারুলবেন। - সেজন্য কেউ কারো গায়ে ঢিল ছুঁড়তে পারে না।

    পারুলবেন যতই বোঝাক, পম্পা মুখার্জির মতো রুল-বুক উপাসিকা এ ধরণের কাজ করতে পারবে না সেটা আমি জানতাম। চোখে চোখে তাকে নৈতিক সমর্থনও দিয়েছিলাম। কিন্তু চণ্ডীগড়ের কলেজগামী পাবলিকের সঙ্গে তখন আমার ভালো করে পরিচয় হয়নি। আমার বান্ধবীও বোধহয় তাদের ভালো করে চিনত না। কারণ আলোচনাটা ঠান্ডা কুলফির মতো আরম্ভ হবার পর ফালুদার শুঁড় হয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে কোথায় গিয়ে হাজির হবে তা পম্পা বা আমি কেউই আন্দাজ করতে পারিনি।


    নো-স্মোক বম্ব

    প্রথমে বলবীর সিং ওরফে বল্লু আমাদের সাহায্য করার জন্য আখাড়ায় নেমে প্রসঙ্গের ভিতর সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা অ্যাঙ্গেল ঢুকিয়ে দেয়। - মেয়েদের হোস্টেল না, এটা একটা হাওয়ালাতের লক-আপ হয়ে গেছে। লক-আপ ভাঙার সলিউশান কী বলতো? এই বলে সে নিজের পাগড়ি পরা মাথাটাকে আমাদের মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে গুঁজে দিয়েছিল। - স্মোক বম্ব! এবার একটা কিনে রাখ!

    - স্মোক বম্ব? কোনো করুণ গৃহপালিত পশুর মতো আমার সরল দিদি শব্দটা পুনরাবৃত্তি করে দেয়। বলা বাহুল্য আমরা বাকিরাও মনে মনে একই প্রশ্ন করেছিলাম কারণ বল্লু কী বলছে কেউ তার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না। এদিক ওদিক চাইছি সবাই। সকলের হয়ে পম্পাই আবার জিজ্ঞেস করল – বল্লু, এটা আবার কী?

    বল্লু দিশী ভাষায় প্রাঞ্জল করে দিয়েছিল। – ধুঁয়ে কা পটাখা! কেউ ধরলেই মাটিতে ফটাস করে ফাটাবি। চারদিকে এমন ধোঁয়া হবে যে নিজের নাক অবধি দেখা যাবে না। সেই ফাঁকে জয় পালিয়ে যেতে পারে।

    আশ্চর্য সরল সমাধান। নিমেষে চোখ খুলে গেল সবার। এরকম একটা উপকারী জিনিস ঘরে ঘরে নেই কেন? পারুলবেন উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করল – কোথায় পাওয়া যায় রে? আমি একটা নেব।

    - আসে সবই অর্ডন্যান্স ফ্যাক্ট্‌রি থেকে। বুঝিস তো, তাদের ভিতরের লোকটার পরিচয় একদম টপ সিক্রেট। খুব হাই পোস্টের মানুষ, এটুকু বলতে পারি। এর বেশি বলতে পারব না। জিনিসটা চাই কিনা জানাস, এনে দেব। তিনশো টাকা দাম।

    বল্লুর কল্যাণে পারুলবেনের কৌতুহল এবং আমাদের আলোচনাটা অন্য খাতে ঘুরে যাচ্ছিল। পম্পার সুবিধেই হত এতে, কিন্তু সে অনাবশ্যক কাতর হয়ে প্রতিবাদ করতে গেল, যেন পারুলবেন স্মোক বম্ব কিনলে রুল-বুক ভাঙার দোষ পড়বে তার ঘাড়ে। – আমাকে কেউ এইসব আজে বাজে কাজ করতে বলিস না। আমার দ্বারা হবে না। বলল সে।

    বল্লু যেরকম সহজে পারুলবেনের মনোযোগ দখল করেছিল তাতে বোধহয় আমার শ্রদ্ধা কিছুটা বেড়ে যায়। আমি তার দিকে ঝুঁকে বললাম – একটা স্মোক বম্ব কি আমিও পেতে পারি?

    নিশ্চিত ছিলাম জবাব আসবে – একটার বেশি নেই। তার বদলে বলবীর গোঁফ নাচিয়ে বলল - কিঁউ নহীঁ পাপ্পে? একটা কেন, পাঁচটা নিয়ে নে। একটা নিজের জন্য, বাকি চারটে দিল্লীতে গিয়ে বেচে দিবি।

    তারপর যে কী হল আমার! পম্পাকে চণ্ডীগড়ে দেখার প্রথম মুহূর্তে যেরকম হয়েছিল আরেকবার প্রায় সেরকম নেচে উঠল চিত্ত। যেন চণ্ডীগড়ে এসে কিস্মতের লটারি খুলে গেছে, পথে ঘাটে সোনার তাল পেয়ে যাব এবার। এর বেশি চিন্তা করতে পারছিলাম না। মুখ দিয়ে ফটাস করে বেরিয়ে গেল - ঠিক আছে, পাঁচটাই নেব। মনে মনে তখন ভাবছি রক্ষিত তো নেবেই, প্রবুদ্ধও একখানা কিনবে নিশ্চয়ই। আর যা বাকি থাকবে তা অক্কিকে দেখালে আকাশ থেকে টাকার বৃষ্টি অবধারিত।

    মিলিটারি হার্ডওয়্যার বোধহয় শিমলিপুরের মানুষদের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা। বেচারা পম্পা সেটা জানত না। এখন হাতেনাতে তার প্রমাণ পেয়ে গিয়ে আমার হতভম্ব বান্ধবীর চোখ হাঁসের ডিমের মতো বিস্ফারিত। সে বলল – জয়, হোয়াট অন আর্থ আর ইউ গোয়িং টু ডু উইথ আ স্মোক বম্ব?

    আমতা আমতা করে বললাম – নাথিং।

    - নাথিং? নাথিং করার জন্য তোর পাঁচটা স্মোক বম্ব না হলে চলছে না?

    বল্লু তখন আমার চিন্তাশক্তি এমন ঘেঁটে দিয়েছে যে ভাবছি পারুলবেন তো কিনছে, তাহলে আমিই বা কেন কয়েকটা রাখতে পারব না? পিসতুতো দিদি হিসেবে পম্পার পদমর্যাদার কথা ভেবে মুখে মুখে জবাব দিতে পারলাম না। ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে গিয়েছিল। ধীরে সুস্থে তাকে অর্ডার দেবার পর বল্লু বলল – স্মোক বম্ব ইজ টু মাচ ইউজফুল। মুহল্লে কে বীচোঁ-বীচ শাম কো এক পটক দে। পাঁচ-ছ ঘন্টা কোনো মশা আসবে না। চিকেনের ভিতর সেলাই করে তন্দুরে ঢুকিয়ে দে। স্মোক্‌ড্‌ চিকেন। বেস্ট ইউজ হল পার্টিতে। ডান্স্‌ ফ্লোর পে দনাদ্দন ফোড়। দেখবি ছেলেমেয়েরা খুশিতে পাগল হয়ে গেছে।

    আমার গুস্‌সেওয়ালি গার্লফ্রেণ্ড বল্লুর দিকে তাক করে চোখ পাকাচ্ছিল। পারুলবেন তার হাতটা ছুঁয়ে বলল – বল্লু চিরকাল ওরকম থাকবে। বর্ন সেল্‌স্‌ম্যান। লেকিন সেইজন্যই তো যখন যা-কিছু দরকার সাপ্লাই করতে পারে। তারপর সে আমাকে দেখিয়ে বলল - বাচ্চা ছেলেটা এতদূর এসে একটা সামান্য জিনিস চাইছে, বাধা দিচ্ছিস কেন? সামান্য কয়েকটা টাকার মামলা। জন্মদিনের গিফ্‌ট ভেবে দিয়ে দে। দেখছিস না বেচারার মুখটা কালো হয়ে গেছে?

    পারুলবেনকে সমর্থন করার জন্য আমার মুখ আরো কালো করার চেষ্টা করছিলাম, নতুন দিদি আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন একটা ঝাপড় মেরে এক্ষুনি কালো মুখ লাল করে দেবে। তারপর সে বল্লুকে বলল – বল্লু, ইধর-কা-মাল-উধরের ধান্দায় তোর নিজের লেখাপড়া তো ভাড়-মেঁ গেছে। লল্লুর উপর তরস খা, তাকে এই পথে টানিস না। আর জয়কে তো একেবারেই না। জয়ের জীবনের উদ্দেশ্য অন্য। এ সমস্ত উলটাসিধা জিনিসে তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

    এতক্ষণ ধরে লল্লুজী তাঁর নিজস্ব কোনো দুনিয়ায় হারিয়ে গিয়ে চোখ বুজে বসে ছিলেন। আমি অনুমান করেছিলাম তিনি ঠিক ফুল-টাইম চরসী না হলেও অবসর সময়ে চরস-বিনোদী। জন্মদিনের উপহার কথাটা হয়তো তাঁর নেশার ঘোরে ভালো লেগে গিয়েছিল। নিজের নাম শুনে এবার চোখ ফুটল। লল্লুজী পম্পার দিকে ফিরে ঘুম ঘুম একটা হাসি দিয়ে বললেন – বল্লুর কাছে এর চেয়েও উম্‌দা একটা তোহ্‌ফা আছে। সেটাকে বলে নো-স্মোক বম্ব। সেটা তুই তোর ভাইকে জন্মদিনে দিচ্ছিস না কেন? এরকম ফর্স্ট ক্লাস ভাই কোথায় পায় লোকে?

    গুড লর্ড! কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখি? স্মোক বম্বের পর এখন এই চরসী বলে নো-স্মোক বম্ব! সেরকম কিছু বল্লুর কাছে সত্যি আছে নাকি? থাকলেও বল্লু কিছু বলছে না। কুলফির সরোবরে গোঁফ ভিজিয়ে নিয়ে সে মিটি মিটি হেসে যাচ্ছিল।

    পম্পা সবে স্মোক বম্বের বিপদটা সামলে উঠেছিল। মনে হল উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে বেচারা আরেকটাতে পড়ে গেছে। বল্লুকে সে তার পাঞ্জা দেখিয়ে বলল – বল্লু, সত্যি বলছি আমার ভাইয়ের মাথায় যত্ত সব কুড়-কচড় আইডিয়া ঢোকালে এই পাঁচ আঙুলের চাঁটা খাবি। দিল্লীতে প্রচণ্ড সিকিওরিটির কড়াকড়ি। স্মোক বম্ব টম্ব ফাটানো তো দূর, সেরকম কিছু সঙ্গে আছে জানলে ওকে টেররিস্ট ভেবে পুলিশ ধরে নিতে পারে। তখন আমরা বাঁচাব কী করে?

    লল্লু আর বল্লু পরস্পরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসি হাসছে আর ‘তুই বল, তুই বল’ করছে। হয়তো দুজনেরই পেটে ম্যাণ্ডির ক্যাপসুল গলতে শুরু করেছিল। শেষে লল্লু বলে – আরে টিউব-লাইট, নো-স্মোক বম্বটা তো বানানোই হয়েছে সে জন্য। সেটাতে কোনো স্মোক নেই। দেখেও মনে হয় একটা নির্দোষ আজমেরের প্যাঁড়া।

    আমি আর পারুলবেন অবাক হয়ে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম – স্মোক নেই? তো আছেটা কী?

    পম্পা বলল – বারুদ ছাড়া কী? এক্সপ্লোশন হয় নিশ্চয়ই। ধামাকায় মানুষ মরে যায়।

    লল্লু একদিক থেকে অন্যদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল – ধামাকাও নেই।

    পারুলবেন বলল – স্টুপিড, কিছুই যখন নেই তো সেটাকে বম্ব বলছিস কেন?

    লল্লু আর বল্লু আবার মুচকি হাসছিল। বল্লুর গোঁফ ঢুকে আছে ফালুদার গেলাসে। লল্লু বলল – ‘কিছু নেই’ বলিনি তো! স্মোক বম্বে যে ফায়দাগুলো হয় সেগুলো সবই নো-স্মোক বম্বেও হবে। শুধু তারপর যদি কাউকে জিজ্ঞেস করিস কী দেখলে ভাই, সে বলবে কিচ্ছু হয়নি।

    বল্লু দুহাতের চেটো আকাশের দিকে খুলে দিয়ে বলল – সবই হয় বহনজী, শুধু নো মেম্‌রি আফ্‌ স্মোক। কেউ মনে রাখতে পারবে না কী হয়েছিল। পুলিশকে রিপোর্ট করবে কী?

    আমরা সবাই হতবাক। পারুলবেন কয়েক সেকেণ্ড তাজ্জব হয়ে থাকার পর বলল – একটু তো রেশ থাকবে, নইলে বম্বটা ফাটল কিনা বুঝব কী করে?

    বল্লু বলল – হ্যাঁ, খুব ভালো করে যে লক্ষ্য করবে তার একটা ঝাপসা স্মৃতি থাকতে পারে। নিজে ফাটালে আমার সাধারণত থাকে। অন্যেরা ফাটালে ধরতে পারি না। আসলে যে পয়সা দিয়ে কেনে তার মেম্‌রিটা স্প্যাশল, সাইকল্‌জিতে বলে প্রাইম্‌ড্‌ মেম্‌রি। একমাত্র সে-ই একটু বুঝতে পারে। বাকিরা শুধু খানিকক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে যায়। দ্যাট্‌স্‌ আল্‌।

    সভা নিস্তব্ধ। পম্পা সীটে নড়াচড়া করছে বলে খসখস আওয়াজ পাচ্ছি। খবরটা হজম করার চেষ্টা চলছে। পারুলবেন আস্তে আস্তে বলল – এরকম একটা জিনিস পৃথিবীতে আছে তা-ই জানতাম না।

    - স্মোক বম্ব হল ইণ্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির আবিষ্কার। বল্লু ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে বলে। - নো-স্মোক বম্বটা পাকিস্তানের উত্তর। সি-আই-এ অবধি মেনেছে দ্য গ্র্যাটেস্ট্‌ ইনভ্যানশন আফ্‌ ম্যানকাইণ্ড।

    পম্পার জামার খসখসানিও নীরব এবার। সবাই আনমনা হয়ে গিয়েছি এবং হয়তো একসঙ্গে ভাবছিলাম বল্লু বা লল্লু আড্ডা দিতে দিতে টেবিলের নিচে একটা নো-স্মোক বম্ব ফাটিয়ে দিল নাকি।

    নো-স্মোক বম্ব দিয়ে স্মোক্‌ড্‌ চিকেন হয় কিনা পরে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করি আমি।

    - দুর্দান্ত হয়। লল্লু আমাদের জানিয়েছিল। - আরো ড্যালিক্যাট ফ্ল্যাভর আসে। কিন্তু হাজার টাকা খরচ করে কে চিকেন বানাবে বল? নো-স্মোক বম্বের ট্রিপ্‌ল্‌ দাম।

    এইসব আলোচনা চলতে চলতে প্রায় আধঘন্টা কেটে গিয়েছিল। বল্লু আরো এক এক গেলাস সরবত আনিয়েছে। লল্লু বাথরুমে যাওয়ার চেষ্টায় নাক বরাবর হেঁটে একটা চুনকাম করা সাদা দেয়ালে দড়াম করে ঢুঁ মারল। ম্যানড্র্যাক্সের লক্ষণগুলো সব একে একে বেরোচ্ছে। আমার অসহায় বান্ধবী আর আমি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ভাবছি কখন এদের খপ্পর থেকে ছাড়া পাব। দিনটা গরমের হলে কী হবে, আমাদের তৃষ্ণা চোখে। পারুলবেন আমাকে আর একটা ফালুদা নিতে অনুরোধ করল। আমার হয়ে আমার লোকাল গার্জেন বলল – জয়ের এসব বেশি খাওয়া বারণ। ওর পেটের রোগ আছে। রাতেও তো হোটেলে খেতে হবে বেচারাকে।

    এর পরের দৃশ্যে বল্লু পকেট থেকে তিনটে এবড়ো-খেবড়ো কিশমিশের আকারের ঢিল বের করে টেবিলে রেখে বলে – পেটের রোগ কার? আজকে তার লক্কি ডে। এটা ট্রাই করে দেখ।

    - এটা কী, বল্লু? জিনিসটা হাতে নিয়ে পারুলবেন বলল। - পাথরের টুকরো মনে হচ্ছে।

    - পাথরই, কিন্তু আসলে হজমের গোলি।

    পারুলবেন আমায় বলল – খেয়ে নে জয়। আজ যা খাবি সব হজম হয়ে যাবে।

    আঙুল নেড়ে বল্লু বলল - নো, নো, নো, নো। ট্রুথ ইন অ্যাডভার্টাইজিং। পত্থরটা একবার শরীরে ঢুকে গেলে আর বেরোয় না। গলেও না। প্রথম সাতদিন কোনো এফেক্ট নেই। তার পর সব কিছু স্লোলি ইমপ্রুভ করবে। ফর লাইফ। মরবার পর বডির ছাইটা একবার ঘেঁটে দেখতে হয় কোনো গয়না-টয়না পড়ে আছে কিনা। সেই সময়ে সোনাদানার সঙ্গে জমির উপর এই পাথরও অপনে আপ চকচক করে ওঠে। তখন নেক্সট জেন্‌রেশন ব্যবহার করতে পারে।

    - একটা মাত্র ডোজ?

    - তাও পাওয়া যায় না ভই। ফোর্টিন্থ্‌ সেঞ্চুরির মাল। কবীর এই পাথরটাকে মাথার বালিশ করে ঘুমোতেন। পরে একটাই প্রকাণ্ড তাল এসেছিল মাস্টর তারা সিংয়ের কব্জায়, সেটা ব্রিটিশরা তিনভাগ করে বড়োটা নিজেরা নিয়ে গেছে, বাকি দুটোর একটা গুরদুয়ারা প্রবন্ধক কমেটির কাছে ছিল। স্বাধীনতার পর সেখান থেকে ভেঙে ভেঙে সারা ভারতে বিলি হয়। যারা পেয়েছিল তারা আরো ছোট টুকরো করে এখন বিলোচ্ছে। আগে এদেশে তাগা-তাবীজ হত। ব্রিটিশরা তো ওসবে বিশ্বাস করে না, তারা বরফ না পেলে হুইস্কি অন দা রক্‌সের ভিতর দিত। তারাই আবিষ্কার করে যে জিনিসটা একবার পেটে ঢুকে গেলে সারাজীবনের জন্য ডিস্পেপ্‌সিয়া থেকে মুক্তি। একটা পায়রার ডিমের সাইজের টুকরো খেলে ক্যান্সারও সারে কিন্তু তত বড়ো টুকরো আর পাওয়া যায় না।

    - তৃতীয় অংশটা কোথায়? জিজ্ঞেস করল পারুলবেন।

    - সেটা কোথায় হারিয়েছে কেউ জানে না।

    গোটা পৃথিবীতে একটা মাত্র তাল ছিল শুনে আমরা সবাই পিছিয়ে গিয়েছিলাম। পারুলবেন বলল – জাস্ট আউট অফ কিউরিওসিটি, কত দাম হবে রে বল্লু?

    দু-কান ছুঁয়ে বল্লু বলল - কবীরের জিনিস। অমূল্য। তাই দাম নিতে পারব না। যে কটা আছে বন্ধু-বান্ধবদের স্যাম্পল্‌ করতে দিচ্ছি।

    বল্লু এগিয়ে একটা নুড়ি দু-ইঞ্চি ঠেলে দিয়েছিল আমার দিকে। তার বেশি সাধতে হয়নি। আমি ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে তুলে নিয়ে পকেটে ভরি। পম্পা গাঁই-গুঁই করছিল। পারুলবেন বলল – কাজ হবে কিনা কে জানে, কিন্তু কবীরের জিনিস ফেলা উচিত নয়। তুই না নিলে আমি নিয়ে নিচ্ছি। এই বলে সে বাকি দুটোকে কুড়িয়ে নিজের বটুয়াতে ভরে ফেলে।


    বচে শরণ যো হোয়ে

    পরে লল্লু-বল্লুদের কাটিয়ে যখন আমরা দোকান থেকে বেরিয়ে আসছিলাম তখন বল্লু সবার নজর এড়িয়ে আমার পকেটে একটা কিছু গুঁজে দেয়। স্ট্রিট লাইটের আলোয় দেখেছিলাম সেটা একটা সাধারণ কাগজের উপর ফোটোকপির মেশিনে ছাপানো কোম্পানির নাম।

        বঞ্জারা ট্রেডার্স
        রিটেল অ্যান্ড হোলসেল
        বলবীর সিং সান্ধু (ওনার)

    তলায় একটা ফোন নম্বর। দিল্লীতে ট্রেডার্স বলতে যে কোম্পানিগুলোকে আমি দেখেছি তারা সাধারণত মেশিন পার্ট্‌স্‌, লোহা, তামা ইত্যাদি ধাতুর চাদর, কিংবা বাথরুম ফিটিংস্‌ বিক্রি করে। বঞ্জারা ট্রেডার্সের বিশেষজ্ঞতা কীসে? বল্লু ইশারায় বলছিল ফোন করতে। পম্পা সেটা দেখতে পেয়ে আকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং ছোঁ মেরে আমার কবজি ধরে আমাকে টানতে টানতে বল্লুর সান্নিধ্য থেকে দূরে নিয়ে চলল।

    সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। তাড়া অনুভব করছি। এবার প্রবুদ্ধ আর রক্ষিতের খোঁজে বেরোনো উচিত। এদিকে পারুলবেন আমাকে হোস্টেল না দেখিয়ে যেতে দেবে না। কিছুতেই তার হাত থেকে ছাড়া না পেয়ে বান্ধবী আর আমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। শেষে মরিয়া হয়ে পম্পা বলল - জয়, তোর কিছু হারায়নি তো? আমি খড়ের কুটোর মতো সিগনাল আঁকড়ে ধরে বললাম – আরে একটা বেল্ট কিনেছিলাম, সেটা পাচ্ছি না! ওটা কি দোকানে ফেলে এলাম? এটা শুনে অতিষ্ঠ নতুন দিদি আমার মাথায় একটা চাঁটি বসিয়ে বলে – বোকারাম, আমরা তো কুলফির দোকানে ঢোকার আগেও পাঁচটা শপে ঢুকেছি, অচেনা শহরে রাস্তাঘাট না চিনে কোথায় খুঁজবি? কী ঝামেলা! চল আমিও যাই তোর সাথে।

    তারপর পারুলবেনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে পম্পা আমার সঙ্গে চটি ফটফট করতে করতে উলটোদিকে বেরিয়ে আসে। পাছে পারুলবেন আমাদের ধরে ফেলে, তাই এক ছুটে রাস্তা ক্রস করে একটা অন্ধকার গলিতে আশ্রয় নিই আমরা। সেখান থেকে হনহনিয়ে বাজারের পিছন দিকটা ঘুরে একেবারে পগার-পার। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক খোঁজার পর একটা ফাঁকা গুরদুয়ারার পিছনে একটু গাছগাছালির অন্ধকার আড়াল পাওয়া যায়। পম্পা আমাকে সেখানে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরেছিল।

    - তুমি কি আমার উপর জবরদস্তি করবে? ক্ষীণ আশার সাথে জিজ্ঞেস করি আর পম্পা আমাকে পাত্তা না দিয়ে আমার ঢোলা বুশ-শার্টের তলা দিয়ে হাত চালিয়ে দেয়। উপর থেকে নিচ অবধি মেরুদণ্ড বরাবর সেটা বুলোবার সময় সে মুগ্ধ হয়ে বলল – কী স্মুদ তোর পিঠ, বয়ম্যান! এপিডারমিসের এই আস্তরণটাও কি মৃত? আর আমার হাত? সেটাও ডেড? তাহলে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে কেন?

    আমরা জানতাম চণ্ডীগড়ের ঘড়িতে দেওয়া দম ফুরিয়ে এসেছে। ‘একবেলার আসার চেয়ে না আসা ভালো’, বলেছিল শকুন্তলা। সে যাতে পালাতে না পারে সেজন্য কোমরের সবচেয়ে সরু জায়গাটা ধরার কথা ছিল আমার, কিন্তু বান্ধবীর কাছ থেকে পাওয়া শাস্ত্রজ্ঞানে গুলি মেরে আমি সবচেয়ে চওড়া অংশটাকে ধরে ফেলতেই ভয়ে তার সমস্ত জারিজুরি শেষ। ভয় কাটাবার জন্য আমি ফিসফিস করে বলি – রঙ্গা তোমাকে এখানেও ধরেছিল, তাই না?

    - কই, না তো!

    ‘হুম্‌ম্‌’ বলে ডাক্তারদের মতো মাথা নাড়ালাম, যেন রুগীর জবাবটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এগ্‌জামিনেশন আরেকটু এগোবার পর তার ফুটবলদুটো কব্জায় চলে আসে, দু বছর আগে শিমলিপুরের কলেজ গ্রাউন্ডের মাঠে যা ভূপিন্দার আর প্রীতপালের থাবা থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলাম আমিই। জানতে চাইলাম রঙ্গা কি তাহলে এখানে ধরেছিল তাকে। ফিসফিস করে পম্পা বলল – নো-ও-ও-ও-ও। তুই অনেক এগিয়ে গিয়েছিস বয়ম্যান। লক্ষ্মী ছেলে এবার থাম প্লীজ। এটা কলেজ পাড়া!

    কলেজের সিলেবাস তো এর চেয়ে ঢের অ্যাডভান্স্‌ড বলে শুনেছি। শকুন্তলা কি তার আশেপাশে কী হচ্ছে দেখতে পায় না? না কি রঙ্গার মতো মস্তান না হলে এই অধিকার পাওয়া যায় না? মনে মনে বললাম – তোমাকে ঠিক করতে হবে রঙ্গা না আমি। তার কানে বললাম – আমি এখনো কলেজে ঢুকিনি বলে তুমি এসবের যোগ্য বলে আমাকে মনে করো না, তাই না?

    - না, না, তা নয়। বলছি ভেবেচিন্তে কাজ করা উচিত আমাদের। নইলে ভুল হয়ে যাবে।

    আমি হাত না সরিয়ে বললাম – আসলে আমি একটা হালকা-পলকা বয় যার দাড়িও ভালো করে গজায়নি। তুমি চাইছ একজন ম্যাস্কুলিন পুরুষ।

    - আরে বাবা এত চিন্তা কেন? তুইও তো একদিন পুরোপুরি ম্যান হয়ে যাবি। চিরকাল কি কেউ বয় থাকে? কে আটকাচ্ছে তোকে?

    - কিন্তু আমার ম্যাচিওরিটি কেমন ঢিমে হয়ে গেছে। শরীরটা লম্বা হলেও আর চওড়া হচ্ছে না। যদি আমার দাড়ি গোঁফ কুকুরছানার রোঁয়ার মতো নরম রয়ে যায়? যদি আমি পুরোপুরি পুরুষ না হয়ে অর্ধেক পুরুষ অবস্থায় থেকে যাই? এদিকেরও না ওদিকেরও না হয়ে মাঝখানে ঝুলে থাকি?

    আমার বুকের উপর তালফলাদপি গুরুমতিসরসম কিছু একটা এসে পড়েছে। পম্পা বলছিল – তাহলে ক্লাস এইটে যেভাবে নিজের চেয়ে সিনিয়ার একটা মেয়েকে নষ্ট করেছিলি সেরকম কোনো নতুন উপায়ে আমাকে আবার নষ্ট করার পথ খুঁজে নিস। তোর মতো পারভার্ট কোথায় গেলে পাব? উফ্‌ফ্‌ কী হচ্ছে জয়? সরে আয়, ওটা একটা গুরদুয়ারার পাঁচিল, আমি ভীষণ সম্মান করে চলি।

    পাঁচিলের ক্ষমাহীন দৃষ্টির সামনে নিজের বেহায়া চুলগুলোকে ঢাকার জন্য দুপাট্টাটা ভালোভাবে মাথায় জড়িয়ে নেয় পার্কটাউনের পম্পা মুখার্জি। - কী যা-তা করছিস? কেউ এসে পড়লে কী হবে?

    - এবার বুঝলে কেন পাঁচটা নো-স্মোক বম্ব চাই আমাদের? পরের বার থেকে কেউ এলেও তার কিছু মনে থাকবে না। শুধু তুমি আর আমি জানব কী হয়েছিল।

    তারপর? তারপর আর কী, তারারা আমাদের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিল যাতে কেউ গলার আওয়াজ পেয়ে দেখতে না আসে কীভাবে শিমলিপুরের একটুকরো অংশ এই নতুন কলেজে ওঠা সিখ্‌নীর শরণে চলে যাচ্ছে।



    (অপ্রকাশিত উপন্যাস থেকে)

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments