• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • একটি মামুলি ভুতুড়ে গপ্পো : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    এটা হয়তো ঠিক ভূতের গল্প নয়। ভূত সম্বন্ধীয় বা ভূতুড়ে গল্প বলা যেতে পারে। আমার এক নিকট আত্মীয়র নিজস্ব অভিজ্ঞতা। তার মুখ থেকেই শোনা। তাই সত্যি হলেও হতে পারে।

    আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। রুডি তখন চোদ্দো বছরের কিশোর, সবে হাইস্কুলে পা দিয়েছে। তার বাবার বদলি হল মিডওয়েস্টের একটি ছোট্ট শহর সিউ ফলস-এ। আবার নতুন স্কুলে অ্যাডমিশন, নতুন ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো, নতুন পাড়াপড়শীদের সঙ্গে পরিচয়। তবে রুডি ও তার ভাইবোনদের এটা অভ্যেস হয়ে গেছিল। তাদের বাবা প্রতি চার-পাঁচ বছর চাকরি ও শহর বদলাতেন। তারা চটপট নতুন জায়গার আদবকায়দা রপ্ত করতে শিখে গেছিল।

    রুডিরা পাঁচ ভাই-বোন। সবাই হাইস্কুল বা স্থানীয় কলেজের ছাত্রছাত্রী। রুডিই সবথেকে ছোট। জন্ম থেকেই বড়ো দাদা-দিদিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মারপিট করে ও বেশ ডানপিটে ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিল। বয়সের তুলনায় দায়িত্ববোধও অন্যদের চেয়ে বেশি ছিল।

    সিউ ফলস-এ ওরা একটা পুরনো ভাড়া বাড়িতে ছিল চার-পাঁচ বছর। বাড়িটা খুব পুরনো। হয়তো ষাট বা সত্তর বছরের কিংবা বেশিই। কাঠের মেঝে, পা ফেললে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে। দরজা জানলার পাল্লাগুলো বেঁকাটেরা, ভালো করে চাপ না দিলে ঠিকমতো বন্ধ হয় না। আলগা খোলা থাকে আর হাওয়ায় খটাখট শব্দ করে।

    তবে এসবই ওদের অভ্যেস হয়ে গেছিল। বাড়িটা বেশ বড়সড়, তিন-তলা, ওপরে ছাদে চিলেকুঠুরি, যাকে এখানে অ্যাটিক বলে। নীচে বেসমেণ্ট—কোনো অসুবিধে নেই।

    অসুবিধে শুধু একটাই। মাঝেমধ্যেই একটা অদ্ভুত খট খট শব্দ আসে ওপর তলা থেকে। ক্যাঁচ কোঁচ, দুম দাম, সব সময় নয়, শুধু কদাক্বচিৎ। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও দু-একটা আরশোলা আর ইঁদুর ছাড়া চিলেকুঠুরিতে আর কিছুই পাওয়া যায়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই সবাই ওই আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে গেল। কেউ আর চমকে ওঠে না। শুধু বাড়িতে যখন ওদের বন্ধুরা আসে আড্ডা দিতে বা রাত কাটাতে, তাদের ভয় দেখানোর মজাটা ওরা বেশ উপভোগ করে। রাতারাতি ওদের বন্ধুমহলে রুডিদের ভূতুড়ে বাড়িটা বেশ একটা টুরিস্ট আকর্ষণ হয়ে গেল। পাড়ায় নতুন কেউ এলে তাদের এই বাড়িটা অবশ্যই দেখানো হতো।

    তারা কয়েকবার বাড়িওয়ালাকে এই ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করেছিল কিন্তু কোনও সদুত্তর পায়নি। বেশি পীড়াপিড়ি করলে ভদ্রলোক গোমড়া মুখে বলতেন 'আপনাদের অসুবিধা হলে অন্য জায়গা দেখতে পারেন। আমার ক্লায়েন্টের অভাব নেই।' পড়শীরাও শুধু বলে যে এ বাড়িতে বেশিদিন কেউ টেঁকে না, দু-এক বছর অন্তর ভাড়াটে পালটায়। কিন্তু কারণটা কেউই জানে না।

    দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেল। রুডির বাবার সেই 'হেথা নয়, অন্য কোনখানে' ভাবটা আবার মাথা চাড়া দিচ্ছিল। এবার আইওয়ার ছোট্ট শহর এমস-এ যাওয়ার পালা। রুডির হাই স্কুলে শেষ বছর। ওর স্কুলপর্ব শেষ হলেই সবাই এ বাড়ি ছেড়ে নতুন শহরে পাড়ি দেবে। এ-ই প্ল্যান। গরমের ছুটি প্রায় এসে গেল। রুডি ও তার বন্ধুরা স্কুলের শেষ ফেয়ারওয়েল পার্টি, প্রম ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। অনেক ছেলে অন্য শহরে কলেজে ভরতি হয়েছে। তাই সবারই গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ততা। রুডির বাবা ও মা আগেই বেশিরভাগ মালপত্র নিয়ে চলে গেছেন। খালি বাড়িতে রুডি একা ওর বইপত্র, কাপড়জামা গোছাচ্ছিল। সেদিন ওর বন্ধুর বাড়িতে একটা লাস্ট পার্টি। পরদিন বাড়ি তালাবন্ধ করে, বাড়িওয়ালার হাতে চাবি দিয়ে, ওর ব্যাগ বাক্স নিয়ে সোজা গাড়িতে উঠবে। প্ল্যান সোজা এমস, আইওয়ায় নতুন বাড়িতে ওঠার। ওখানেই ইউনিভারসিটিতে অ্যাডমিশন পেয়েছে। দু' মাস পরে ক্লাস শুরু।

    সেদিন রুডি একটু বেশি রাত করে বাড়ি ফিরল। হাসিগল্প, খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে একটু বেশি বিয়ার হয়ে গেছিল। বাড়ি ফিরে বিছানায় গড়াতেই ওপরে দুমদাম শব্দে ঘুম চটে গেল। এবার বেশিই মনে হল শব্দটা। কোনো জন্তুজানোয়ার ঢুকে পড়ল নাকি? বাইরে রাত নিঃশব্দ। ঝড়-বৃষ্টির চিহ্ন নেই, হাওয়াও নেই একদম। একটু ইতস্তত করে রুডি টর্চ হাতে ওপরে চললো। চিলেকুঠুরিটা আগের মতোই ফাঁকা। ওদের কয়েকটা বাক্স আগেই আইওয়া রওনা হয়ে গেছে। দরজা, জানলার পাল্লা বন্ধ। তবে আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে?

    দেখতে দেখতে জানলার পাল্লা আপনাআপনি খুলে দড়াম শব্দে বন্ধ হল। শব্দগুলো এত জোরে ও এত ঘন ঘন রুডি আগে কখনো শোনেনি। হঠাৎ ওর মনে হল কেউ যেন খুব রেগে গিয়ে দুমদাম শব্দ করছে। কেন এরকম মনে হল তা সে বলতে পারবে না। আগে কখনো একটু-আধটু শব্দে এরকম মনে হয়নি। হঠাৎ ওর মনে হল দরজাটা দমাস করে বন্ধ হয়ে যাবে আর ও আটকে যাবে চিলেকুঠুরির ভিতর। হয়তো কেউ ওকে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে দিতে চায় না। তারই অসন্তুষ্টির প্রকাশ এই জোর শব্দের মধ্যে। যদি বন্দী হয়ে যায় তাহলে তো আর এই বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না। চিরকাল এখানেই মরে ভূত হয়ে থাকবে। খালি বাড়িতে কাউকে ডাকতেও পারবে না। (তখনকার দিনে তো আর সেল ফোন ছিল না।) মনে হতেই রুডি এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এসেই দুদ্দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে। পিছনে তখনো দুমদাম শব্দ চলছে।

    ঘুমটুম মাথায় রইল। রুডির ব্যাগ দুটো আগে থেকেই প্যাক করা ছিল। সেদুটো গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে এক লাফে উঠে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিল। পড়ে রইল বাকি জিনিশ, ঘরের চাবি। ভাগ্যিস গাড়িতে পেট্রল ভরা ছিল! সঙ্গে সঙ্গে স্পিড তুলে সে ছুটল হাইওয়ের দিকে। পিছনে খালি বাড়িতে খটখট দমাদম শব্দ হতে থাকল।

    সারা রাত গাড়ি চালিয়ে, কোথাও না থেমে, ভোর বেলা রুডি এমস-এ ওদের নতুন বাড়িতে পৌঁছল। কাউকে কিছু বলল না। দিনের আলোয় সব ব্যাপারটাই কেমন হাস্যকর মনে হচ্ছিল। হয়তো রাত্তিরে মদটা একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিল, আর সবই হয়তো একটা দুঃস্বপ্ন। এসব কথা বললে বড়োরা নিশ্চয়ই বকুনি দেবে আর ছোটরা নির্ঘাত হাসাহাসি করবে। ওর আসার কথা ছিল দুপুর বেলায়। একটু আগে পৌঁছতে কেউ কিছু প্রশ্নও করল না।

    এর পর কলেজ, চাকরি, সবাই নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। আর কখনোই সিউ ফলস-এর সেই বাড়িতে যাওয়া হল না। সেই বাড়ির কথা ক্রমশ সবার স্মৃতি থেকে মুছে গেল। শুনেছিল বাড়িটা ভেঙে ওখানে নাকি একটা শপিং মল হয়েছে। রুডি আর কখনো ওমুখো হয়নি।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments