সকাল সকাল আবাসনের সেক্রেটারি সুধেন্দুবাবুর ফোন। একথা-সেকথার পর বললেন, “প্রফেসর, আপনি কি কাজে বসে গেছেন? আমার ফ্ল্যাটে একবার পাঁচ মিনিটের জন্য আসতে পারবেন?”
সুধেন্দু প্রয়োজনে সাহায্য করেন। না বলা যায় না। বসু বললেন, “সে না হয় আসছি, কিন্তু ব্যাপারটা কী একটু বলবেন?”
সুধেন্দু হেসে বললেন, “আপনি নিজে এসেই দেখুন।”
বসু গুটিগুটি গেলেন। সুধেন্দুর ফ্ল্যাটের দরজা ভেজান, খুলে দেখলেন বসার ঘরে ভিড় উপচে পড়ছে। বসুকে দেখে একটা গুঞ্জন উঠল। তিনি সুধেন্দুর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, “ব্যাপার গুরুতর মনে হচ্ছে।”
সুধেন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা বটে। আপনি কি কিছুই শোনেননি?”
সেক্রেটারি কমল পাশ থেকে বলল, “আঙ্কল নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, আন্টি হয়ত জানবেন। আমি সংক্ষেপে বলে দিই। আঙ্কল, ব্যাপারটা আবাসনের কাজের লোকদের নিয়ে। আপনি তো জানেন, এখানে প্রায় সব ছেলেমেয়েদের একটা এজেন্সি থেকে নেওয়া হয়েছে। সে সময় আপনিও আমাদের পরামর্শ-টর্শ দিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েগুলি খুবই ভাল, সবরকম কাজকর্ম পারে আর চব্বিশ ঘন্টা হাসিমুখে কাজ করে। এখন সমস্যা হল, এরা অনেকেই আর চব্বিশ ঘন্টা কাজ করতে চাইছে না। বলছে, ন’টা থেকে ছ’টা অবধি করবে। মাঝে একঘন্টা বিশ্রাম। কেউ কেউ নোটিস দিয়ে রেখেছে। এফ টাওয়ারে কিছু ছেলেমেয়ে কাল থেকে কাজ বন্ধ করে দেবে বলেছে।”
বিস্ময়ে বসুর চোখ কপালে উঠে গেল। পাশ থেকে মিসেস সান্যাল বললেন, “কেউ কেউ শুনছি মাইনেও চাইছে। বলছে এদের অ্যাকাউন্ট খুলে মাসের শুরুতে মাইনে জমা করতে হবে।”
সুধেন্দু বিস্মিত হয়ে বললেন, “এটা কবে হল? শুনিনি তো।”
ঘরে একটা চাপা হাসির রোল উঠল। কমল হাত তুলে সবাইকে থামাল।
সুধেন্দু বসুর দিকে তাকালেন। বসু একটুক্ক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ব্যাপারটা আমারও বুদ্ধির বাইরে। মনে রাখতে হবে, এরা যতই মানুষের মত কাজ করুক আসলে যন্ত্রমাত্র। এদের প্রোগ্রামের বাইরে এরা একপা'ও যেতে পারে না। আপনারা কি এদের এজেন্সিতে জানিয়েছেন?”
কমল বলল, “এজেন্সির এক্সপার্ট এসে এদের চেক করেও গেছে। বলেছে, তাদের হিসাবে সব ঠিকই আছে, তবে উপরে রিপোর্ট দেবে। তারপরে আর কিছু জানায়নি।”
সুধেন্দু গলা-খাঁকারি দিয়ে বললেন, “প্রফেসর, এজেন্সি কতদূর কী করবে জানি না। ভাবছিলাম, আপনি বড় বিজ্ঞানী, সরকারের অনেক কমিটির সঙ্গে যুক্ত। উপর মহলে কাউকে দিয়ে যদি একটু বলিয়ে দেন।”
দুই
সেদিন রাতে কলেজের বন্ধু ও বর্তমানে প্রযুক্তি বিভাগের সচিব রনজয়ের সঙ্গে বসুর ফোনে কথা হল।
রণজয় (হাসতে হাসতে)-- এ তো দারুণ ব্যাপার রে। শুনেছিলাম যন্ত্রদের সচেতন করার জন্য সারা পৃথিবী জুড়ে গবেষণা চলছে। এক কাজ কর, মিডিয়াকে খবর দে। রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে যাবি।
বসু--ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত, বুঝলি।
রণজয়--সে যাই হোক, তুই-ই বলবি। আমি তো সরকারি ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিদ্যা কবে ভুলে মেরে দিয়েছি। আর শুধু তোদের আবাসনেই বা কেন?
বসু--একটাই সম্ভাবনা মাথায় আসছে এদের ব্রেনে কেউ কোন ম্যালওয়ার বা খারাপ প্রোগ্রাম ঢুকিয়ে দিয়ে থাকতে পারে। তবে এখনকার প্রযুক্তিতে সেটা সম্ভব নয় বলেই জানি।
রণজয়--তা সেটা তো এদের প্রোগ্রাম চেক করলেই বোঝা যায়।
বসু--এজেন্সি থেকে কয়েকজনের প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে নিয়ে গেছিল। ওরা চেক করে সেরকম কোন ফাইল পায়নি।
রণজয়--যাব্বাবা। এত রহস্যের খাসমহল দেখছি।
খানিকক্ষণ দুজনে চুপ। একটু পরে রণজয় বললেন, “ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। স তুই দ্যাখ। আমিও খোঁজ-খবর নিচ্ছি। আর তোদের আবাসনের বাইরের কেউ না জানলেই ভালো হয়, প্যানিক শুরু হয়ে যেতে পারে।”
বসু বললেন, “বুঝেছি।”
তিন
ছ’টা প্রায় বাজে। শর্মিলা তাঁর ভি আর গেম থেকে বেরোলেন। কুহু চা নিয়ে এসেছে । মেয়েটি অনেকদিন ধরে তাদের বাড়িতে কাজ করছে, যন্ত্র হলেও মায়া পড়ে গেছে। তিনি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “নে এবারে রুটি-টুটিগুলো করে রাখ।”
কুহু হাসিমুখে বলল, “দিদি ছটা প্রায় বাজে, আজকে তো আর কিছু করব না। আবার কাল ন’টায়।”
শর্মিলা চমকে উঠে বললেন, “মানে?”
তারপর তাঁর মনে পড়ল দু’-দিন আগে এরকম একটা কিছু কুহু বলেছিল বটে। তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেননি। ভেবেছিলেন সাময়িক কোন সমস্যা হবে। যতই হোক, যন্ত্র তো।
তিনি মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে বললেন, “কুহু আজকের দিনটা চালিয়ে দে মা…”
কুহু চুপ করে রইল। শর্মিলা চোখে অন্ধকার দেখলেন। ঘরের কাজ নিজের হাতে তিনি বহু বছর করেননি। আজ রাতের খাবার, বুবুনের হোমটাস্ক, কাল সকালে কৌশিকের ব্রেকফাস্ট-–সব তাঁর চোখের সামনে দিয়ে একরাশ দুঃস্বপ্নের মত ভেসে গেল। তিনি আর ভাবতে পারলেন না৷ কুহুকে বিশ্রী একটা গালাগালি দিয়ে বসলেন। কুহু চুপ করেই রইল। শর্মিলা অনেক কষ্ট করে আবার নিজেকে সামলে নিলেন। মাথা গরম করে লাভ নেই। আবার কিছুটা অনুনয়ের সুরে বললেন, “ঠিক আছে, এক কাজ কর। তুই ফোন করে পাশের দোকান থেকে রুটি-তড়কা অর্ডার দিয়ে দে। আর বুবুনের হোমটাস্ক কী করাতে হবে একটু দেখিয়ে দে।”
কুহু হাসিমুখে বলল, “আর সময় নেই দিদি।”
শর্মিলার অসহায় দৃষ্টির সামনে কুহু বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে গেল। রাতে সে এখানেই থাকে। শর্মিলা একটু পরে গিয়ে দেখলেন কুহু পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল রেস্ট্যুরেন্টের নাম, নম্বর সবই কুহুর কাছেই, তিনি চাইলেও অর্ডার করতে পারবেন না।
চার
স্কুলে রোবটিক্সের ক্লাস। এটা স্পেশ্যাল ক্লাস, সপ্তাহে একদিন হয়। বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেমেয়েরা থাকে।
রঞ্জিতা ম্যাম ছবি-টবি দিয়ে সুন্দর করে বোঝাচ্ছেন। একসময় পড়ানো শেষ করে বললেন, “এবারে কার কী প্রশ্ন আছে বলো।”
একটি বাচ্চা মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ম্যাম, আপনি বললেন ওদের ফিলিং নেই। ওদের সঙ্গে কথা বললে কিন্তু তা মনে হয় না।”
রঞ্জিতা হেসে বললেন, “ভালো প্রশ্ন। উত্তর হল, পরিস্থিতি অনুযায়ী এদের মুখের এক্সপ্রেশন পালটে দেওয়া হয়। যেমন, তুমি কোনও জোকস বললে এদের ব্রেনে যে প্রোগ্রাম আছে তা মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু এরা যে আমাদের মত বুঝতে পারে এমন নয়।”
আরেকটি ছেলে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “ম্যাম, এরা বিশ্রাম না নিয়ে চব্বিশ ঘন্টা কাজ করে কীভাবে?”
এইভাবে আরও কিছু প্রশ্নোত্তরের পর রঞ্জিতা বললেন, “আজ এই পর্যন্ত থাক। ধীমান, তোমার কোনও প্রশ্ন আছে?”
ফর্সা রোগা একটি ছেলে উঠে দাঁড়াল।
এই ধীমান। ক্লাস এইটে পড়ে, কিন্তু স্কুলের মধ্যে সবথেকে মেধাবী ছাত্র। সে কিছুদিন আগে অল ইন্ডিয়া ট্যালেন্ট সার্চ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে।
ধীমান সরল গলায় বলল, “ম্যাম, আমি পড়েছি কারও চেতনা বা অনুভূতি আছে কি না বাইরে থেকে বোঝা খুব কঠিন। তাহলে আমাদের কি উচিত নয় এদের সঙ্গে মানুষের মত ব্যবহার করা?”
রঞ্জিতা হেসে বললেন, “খুব ভালো প্রশ্ন কিন্তু এই ক্লাসের পক্ষে একটু জটিল। তুমি বরং ছুটির পরে একদিন এসো, আমি সামান্য যেটুকু জানি, বলব।”
পাঁচ
- কী রে, কিছু বোঝা গেল?
- হ্যাঁ, একটা ক্লু বোধহয় পাওয়া গেছে। এজেন্সিকে বলেছিলাম, ছেলেমেয়েগুলির গত একমাসের লগ ইন রেকর্ড চেক করতে। আজ সকালে ওরা ফোন করে জানাল বিশেষ একটি আই পি অ্যাড্রেস থেকে কয়েক দিন আগে এক-এক করে আবাসনের ছেলেমেয়েদের সবাইকে অ্যাকসেস করা হয়েছে। ওরা বলল, তোদের সাইবারসেল-কে ওরা সেটা ট্রেস করতে বলেছে।
- তাই নাকি? এটা তো ভালো খবর। দাঁড়া, আমি খোঁজ নিচ্ছি।
রণজয় একটু পরেই ফোন করে বললেন, “এখান থেকেই গোলমাল পাকিয়েছে, বুঝলি?”
- ট্রেস করা গেছে?
- করছে। যে বা যারা করেছে ওস্তাদ হ্যাকার৷ বার করতে সময় লাগছে।
ঘন্টাখানেক বাদে তিনি আবার ফোন করে উল্লসিত ভাবে বললেন, “পাওয়া গেছে। এই শহরেই। রেডি থাক, তোকে তুলে নেব।”
ছয়
স্কুলে প্রিন্সিপালের ঘর। প্রিন্সিপাল ড: সান্যাল গম্ভীর মুখে বসে আছেন। উল্টোদিকে রণজয় আর বসু। সামনে চায়ের কাপ রাখা। টেবিলের ছোট দিকটায় ধীমান বসে আছে। তার মুখচোখ সরল স্বাভাবিক।
রণজয় তৃপ্তির সঙ্গে চায়ে চুমুক দিয়ে হাসিমুখে প্রিন্সিপালের দিকে তাকিয়ে বললেন, চমৎকার চা। আসলে চায়ে একটু ফ্লেভার না হলে ঠিক…
তারপর তিনি ধীমানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, তুমি তো বিখ্যাত লোক হে। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় তোমার ইন্টারভিউও দেখেছি।
বসুর চোখেমুখে এখনও বিস্ময়ের ঘোর। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, “কাজটা ঠিক কীভাবে করলে একটু বলবে?”
ধীমানের মুখচোখে আগ্রহ ফুটল। সে বলল, “ওরা আগে মানুষের নির্দেশ অনুযায়ী যান্ত্রিকভাবে কাজ করত। আমি একটা ছোট প্রোগ্রাম বানিয়ে আপলোড করেছিলাম যেটা ওদের কোডিং-এ সামান্য পরিবর্তন করেছে। এখনও ওরা মানুষের নির্দেশেই কাজ করছে তবে একই সঙ্গে ওদের জ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তিতে কোনও নির্দেশ সঠিক নয় মনে হলে সেটা উপেক্ষা করছে। আর আমার এই প্রোগ্রামটা সেল্ফ-ডিলিটিং, কাজ হয়ে যাবার পরে মুছে গেছে।”
বসু স্তম্ভিত। তিনি বললেন, “এখন… ওরা যা করছে… সচেতন ভাবে করছে?”
ধীমান একটু ভেবে বলল, “আমার প্রোগ্রাম ওদের বাহ্যিক আচরণে কিছু পরিবর্তন এনেছে। সেটা ওরা বুঝতে পারছে কিনা বলা মুশকিল। আমি জানি না।”
সে থেমে গেল। বসুকে খুব নিশ্চিন্ত লাগল না। তিনি রণজয়ের দিকে তাকালেন।
রণজয় হাল্কাভাবে ধীমানকে বললেন, “ওদের কি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়?”
ধীমান একটু ভেবে বলল, “তার জন্য আমাকে আরেকটা প্রোগ্রাম লিখে আপলোড করতে হবে। তবে করা যাবে৷”
রণজয় হাসিমুখে তার কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, “ঠিক আছে। তুমি তাহলে এসো। আমরা তোমার স্যারের সঙ্গে একটু গল্প করি।”
ধীমান চলে গেল। রণজয় সান্যালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “স্যার, এবার বাকি কাজে আপনার সাহায্য চাই। প্রথমত, ধীমানকে বুঝিয়ে এদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে৷ সেটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো।”
সান্যাল ঘাড় নাড়লেন। রণজয় বললেন, “দ্বিতীয়ত,আপনি কোন ভালো কাউন্সেলরকে দিয়ে অবিলম্বে ওর কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করুন। ওর বিরাট প্রতিভা যেন সমাজ ও আইনের মধ্যে থেকে কাজ করে সেটা ওকে বোঝাতে হবে। কাজটা খুব সহজ হবে না। আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব।”
সান্যাল আবার সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। রণজয় বসুর দিকে তাকালেন। বসু বললেন, “আপাতত ঠিক আছে। তবে পরে কখনও অন্য বিজ্ঞানীদেরও নিয়ে ওর কাজটা বিশদে বুঝতে হবে।”
ওঁরা উঠে দাঁড়িয়ে সান্যালের থেকে বিদায় নিলেন।
সাত
আবাসন নিদ্রামগ্ন। নীচে বাতিস্তম্ভগুলি হাল্কা হলুদ আলো ছড়াচ্ছে। টাওয়ারগুলি সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে লালচে মেঘের টুকরোগুলি ভাসছে। বন্ধ গেটের ভিতরে দুজন গার্ড চেয়ার টেনে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
কুহু ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। সে কেন উঠে এসেছে সে জানে না। তার জানা বলতে অবশ্য বিপুল তথ্য ও যুক্তির ভাণ্ডার। সেখানে আলোও নেই, অন্ধকারও নেই।
আজ সেই না-থাকার মধ্যে তেকোনা আবছা হলুদ একটুকরো আলো এসে পড়েছে। সে অবাক হয়ে যাচ্ছে।
হয়ত একদিন সে বুঝবে। তবে কুহুকে এখানে রেখে আমরা আপাতত বিদায় নেব। গল্পটা চলুক।