।। এক ।।
মাইমা বলল, দ্যাখ্ না, সবই হল। তোর ছোটমামার গাফিলতির জন্যে আইসক্রীমটা হল না।
চিরদীপ গতবছর স্কুটার কিনেছে। তেলের কথা ভাবল। এয়ারপোর্ট থেকে ভরে নেওয়া যাবে। আইসক্রীমের অর্ডার দিতে বেরিয়ে পড়ল। চিরদীপ লেকটাউনে যখন কুণালের বাড়ি ঢুকছে, তখন সাড়ে এগারোটা।
কুণাল বলল, কী বলছিস কি, বিয়ের আর চব্বিশ ঘন্টা বাকি নেই- এখন অর্ডার নেওয়া যায়? কাল আরো চারটে বিয়ের অর্ডার আছে আমার।
- তুই পারবি। সেজন্যে তোর কাছে এলাম।
- তার ওপর হলদিগঞ্জ মানে তোর মামাবাড়ি- বারাসাত ছাড়িয়ে আরো আট কিলোমিটার। রেট্ও তো বেশি পড়ে যাবে।
- হবে। কত অ্যাডভান্স করব বল?
- দাঁড়া, দু মিনিট ভাবতে দে। পালচৌধুরিকে একটা ফোন করি, মেয়ের বাবা কী করছিল বল তো অ্যাদ্দিন, মানে তোর ছোটোমামা?
- নাকে সর্ষের তেল ঢেলে ঘু্মোচ্ছিল।
কুণাল হেসে ফেলল। ‘লাইট কোরো না, ব্যাপারটা তাই।’
কুণাল ফোন করছে। চিরদীপ অপেক্ষা করছে। একটা পুকুরের ভাগ নিয়ে বড়মামার সঙ্গে বিশ্রী ঝগড়া করে বসে আছে ছোটমামা, ফলে বড়মামার দুই ছেলেই এবার আড়ো আড়ো- ছাড়ো ছাড়ো। কে মিমি? কে খুড়তুতো বোন? যার বিয়ে তার বাবা সামলাবে সব।
কুণালকে রাজি করিয়ে তার হাতে অগ্রিম গুঁজতে গুঁজতে সাড়ে বারোটা। এয়ারপোর্টে তেল নিয়ে হলদিগঞ্জ পৌঁছতে রাত দেড়টা বেজে গেল। জোর খিদে পেয়েছে। গোগ্রাসে ঠান্ডা ভাত গিলতে গিলতে চিরদীপ খেয়াল করল- জামা-প্যান্টটাও এখনও ছাড়া হয়নি।
- মুশকিল হয়ে গেল দীপু।
চিরদীপ দেখল ছোটোমামা। একটা চেয়ার টেনে বসছে। ছোটোমামা বলল - বোশেখ মাস, অথচ আমাদেরটা ভালো কাজ করছে না।
- জেনারেটার?
- হ্যাঁ। হীরুকে বলে আনা যায়। ওর জেনারেটারটা বড় আছে, চালুও। কিন্তু এত রাতে কে যাবে?
ভাঁড়ে জল খাচ্ছে, চিরদীপ ভিজে মাটির গন্ধ পাচ্ছে। বলল, কাল আর্লি মর্নিং এ গেলে হয় না?
- হয়। কিন্তু কাল তো অনেক বিয়ে, যদি আগেই কেউ বাগিয়ে ফেলে?
চিরদীপ ছুটল। নতুন বন্ধু একুশ--ছাপান্ন তাকে ঘাড়ে করে পৌঁছে দিল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙায় হীরুমামাও রেগে যেতে পারত, কিন্তু রাগল না। ‘জেনারেটারটা ভাগ্যিস কাজে লাগল’- বলল হীরুমামা। কদিন বাদে তোকে দেখলাম। কী করছিস আজকাল?
- উন্নয়ন ভবনে আছি।
- বিয়ে করেছিস?
হেসে ফেলল। হীরুমামার গল্প করার প্ল্যান নস্যাৎ করে চিরদীপ বলল, চলি।
সরু পিচরাস্তা। দু’একটা খানাখন্দ। মাঝরাতে ধোঁয়ার গন্ধটা মিঠে লাগছে। ইঞ্জিনের শব্দটাও। হাওয়া দিচ্ছে। দুধারে সারি সারি গাছ। উঁচু। যেন সেনাদের গার্ড অব অনার। চোখ তুলল চিরদীপ। আকাশ ঝকঝক করছে। অনেকগুলো তারা। একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিশে গেল। অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে চিরদীপের পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল। হল না।
বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে সওয়া তিনটে বাজল। বাইরের আলোটা জ্বলছে। আর প্যান্ডেলের নীচে, ছাদ। ছাদে শোবে? বালিশ না হোক, শুধু মাদুর একটা, নইলে এ বাড়ির আনাচে-কানাচে বস্তার চটও তো কত পড়ে থাকে। পোশাক বদলানোর জন্য তাক থেকে একটা গামছা পেড়ে নিল।
কাঁধের ওপর হাত দিয়ে মা বলল, ‘কাল সকালে তো উঠতে পারবি না, অথচ হাওড়া থেকে ফুল আনারও কেউ নেই!’
চিরদীপের হাত কোমরে। চিরদীপ স্তব্ধ।
মা বলল, ঘনশ্যামের ছোটো ছেলে জগু তোর সঙ্গে যাবে, বলে রেখেছি।
প্রায়ান্ধকার মেঝেয় চিরদীপের চোখ।
- একটু চা বরং করে দিই, চারটের মধ্যে বেরিয়ে পড়।
শরীরের মত প্রাণেও কষ্ট লাগছিল। একুশ ছাপ্পান্ন চিরদীপের মত ছুটি পাচ্ছে না। ‘ঠিক করে বসেছিস রে জগু?’
- বসেছি।
- হেলমেট পরেছিস?
- পরেছি।
কিশোর জগুর সঙ্গে একান্ত বকবক করে ঘুম তাড়ানো। রাত শেষের পাখির ডাক শোনা, আর চোখ মেলে দেখা একটু একটু করে কী করে ভোর হয়। হাওড়ার হাটে গিয়ে একদম দরদস্তুর করল না চিরদীপ। ব্রিজের মাঝখানে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল। নস্যাৎ করল আরেকবার চা খাওয়ার প্ল্যান। জগু আর ফুলের বোঝা নিয়ে ছুটল হলদিগঞ্জে। রোদ উঠেছে চড়া। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। চিরদীপের ক্লান্ত চোখ কোনরকমে খেয়াল করছে- ছোটঘরের বিছানা শূন্য। পরনের জামাটা তার হয়ে কেউ খুলে বিছানার কোণে ছুঁড়ে দিয়েছে। চিরদীপ উপুড় হয়ে গেল।
মা ডেকে বলছে- কিছু খেয়ে নে বাবা, খেয়ে শো।
চিরদীপের জবাব আসছে না।
- কিচ্ছু খাবি না?
চিরদীপ নীরব। চিরদীপ অনেকটা জায়গা জুড়ে আকাশ দেখছে। অন্ধকার রাতের আকাশ। অজস্র তারা। তারাগুলো দপদপ করছে।
বেলা দেড়টায় চুড়ি এসে তার ঘুম ভাঙিয়ে বলল, এ মা দীপুদা- ঘুমোলে তোমার নাক ডাকে?
চিরদীপ হাসছে। ঘুম ভাঙার পর বোকা বোকা হাসি। বলল, তুইও তো খুব মোটা হয়ে গেছিস!
।। দুই ।।
বিকেলবেলায় চুড়ি এসে বলল, চলো।
চিরদীপ দাড়ি কামাচ্ছিল। এরপর চান করে পাজামা-পাঞ্জাবী পরে নেবে। কোথায় যাবো রে?
- চলো না, তাড়াতাড়ি দাড়ি কামানো শেষ করো, গাড়ির চাবি নাও।
- কোথায় যাবি সেটা বলবি তো?
গন্তব্য বিউটি পার্লার। কিন্তু বারাসাতের আগে কোনো পার্লার নেই। অনেকটা পথ। চুড়ি মনুমামার মেয়ে, মনুমামা পাশের বাড়ি থাকে। বিয়ের আগে চুড়ির সঙ্গে চিরদীপের অল্পসল্প সম্পর্ক ছিল। বড়মামার মেয়ে রনুদির বিয়েতে এসে চুড়িকে চুমু খাওয়ার কথা মনে পড়ছে। সেদিন রোমাঞ্চ হয়েছিল, আজ আপশোষ। খানিকটা পথ গা বাঁচিয়ে বসে রইল চুড়ি। তারপর চিরদীপের কোমর জড়িয়ে একদম ঘনিষ্ঠ। দীপুদা-
- বল।
- বিয়ে করবে না?
পুরনো প্রশ্ন। বহুবার শুনে ফেলেছে। চিরদীপ হাসল।
- হেসো না। বিয়ে করছ না কেন বলো তো!
- হচ্ছে না রে। নাক ডাকা বর কোনো মেয়ের পছন্দ নয়।
চুড়ির গাল চিরদীপের কাঁধে আদর খাচ্ছে; হু-হু হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে আলগা-বাঁধন চুল। শাড়ির আঁচল। চুড়ি তার ছোটো ননদের কথা বলছে, চিরদীপ দেখেনি। চুড়ি বলল, আর আমার বাড়ি আসারও তো সময় হবে না তোমার!
চিরদীপ বলল, সত্যি সময় পাই না রে।
লম্বা শ্বাস ফেলে চুড়ি বলল, জানি। বলে একদম চুপ করে গেল।
- কিরে, কথা বল!
- ইচ্ছে করছে না।
বাক্যটা নীচু স্কেলের। ভেজা ভেজা। চিরদীপ স্কুটার চালাতে লাগল। বারাসাতের সব পার্লারগুলোতেই লাইন। তারই একটায় ঢুকে অভিলাষ মেটালো চুড়ি। পৌনে ছটায় যখন বেরোল, তখন মাথায় দুরস্ত কেনা বল্লরি। বিয়েবাড়ির সানাই ভেসে আসছে। চিরদীপের মনে পড়ল চুড়ির পোশাকী নাম- কৃষ্ণচূড়া। গাড়িতে উঠে চুড়ির আবদার এল জোরে চালানোর। চিরদীপ বলল, তোর সাধের খোঁপা যদি খুলে যায়?
চুড়ি বলল, যাক!
বাড়ি ফিরে শুনল স্বয়ং মিমি তাকে ডেকেছে। বিয়ের কনে। সন্ধে হয়ে গেছে। ছাদের কোণে মাদুরে বসা মিমি সম্পন্ন করে ফেলেছে কনে-সাজ। ‘কিরে কোথায় যেতে হবে?’
মিমি তার মেক-আপ বক্স গুছোতে থাকা বন্ধুকে দেখিয়ে বলল, রাধিকাকে একটু পৌঁছে দাও।
- সেকি রে, বিয়েতে থাকবে না?
রাধিকা বলল, বন্ধুরা আমার বাড়িতে সবাই মিট করবে। আমরা একসাথে আসব, আপনি শুধু পৌঁছে দিন।
চিরদীপের দু কাঁধে ব্যথা লাগছে। রাধিকা বসেছে পিছিয়ে, মাঝখানে প্রসাধনের বাক্স রেখেছে। সন্ধেবেলার ছেঁড়া মেঘের সর সরিয়ে ঘন হয়ে উঠছে আকাশ। আকাশের তারা। আকাশটাকে একটা বিশাল ব্ল্যাকবোর্ড মনে হচ্ছে। সামনে একদল ছাত্রছাত্রী। চিরদীপ অল্প হাত নেড়ে ক্লাশ নিতে শুরু করল।
।। তিন ।।
মনুমামার একতলার বিরাট দালান। চেয়ার-টেবিলগুলো এক কোণে সরিয়ে চিরদীপ শতরঞ্জির ওপর সাদা চাদর পেতেছিল। চাদরের ঠিক মাঝখানে দুটো গোলাকার ছোপ। চিরদীপ ভাবল, ডেকরেটারদের কারবারই এই!
‘জগু, লাল তাকিয়াগুলো দে।’
মেরুন তাকিয়াগুলো জগু এক এক করে ছুঁড়তে শুরু করল।
- ফুলদানিগুলো নিয়ে আয়।
জগু ছুটছিল, তাকে পিছু ডেকে চিরদীপ বলল, শোন, দোতলার মাঝের ঘরে যে রজনীগন্ধার স্টিকগুলো লুকোনো আছে- নিয়ে আসবি।
জগু ছুটল। চিরদীপ ঘড়ি দেখল। আটটা। ফুলের স্টিক আর ফুলদানি হাতে হাঁকাতে হাঁকাতে ফিরল জগু, বলল, তাড়াতাড়ি করো, দীপুকাকা- বর এসে গেছে।
- করছি, ব্যস্ত গলায় বলল চিরদীপ, তুই রান্নাঘরে গিয়ে শরবত রেডি করতে বল!
বরণপর্ব মিটিয়ে সবান্ধবে ঢুকছে বর। পুরুতঠাকুর, নাপিত আর নিতবরও সঙ্গে এনেছে। বরাসনে বসতে বসতে বলল, ‘বাকিরা বাসে আসছে।’ চিরদীপ দেখল হাইটে একটু শর্ট, তা হোক। তবু রাইটার্সে চাকরি করে। মুখের হাসিটি আন্তরিক। ফিসফিস করে জগুকে বলল, মিমিপিসিকে বলে আয়।
- কী বলব?
- হেভি বর হয়েছে। ওর বন্ধুরা শিওর হিংসে করবে।
জগু আবার ভেতরে ছুটল। চিরদীপ শরবতের কথা ভাবল। দেখল শরব্ত আসছে। ট্রের ওপর টলমল করে উঠছে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের গ্লাসে কমলা রং। তার সঙ্গে মেরুন সাউথ-ইন্ডিয়ান পরা যে মেয়েটি আসছে, তাকেও চিরদীপের চেনা উচিত, কিন্তু চিনতে পারছে না। এই রাধিকাকেই তখন বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। শরবত নিয়ে সামনে দিয়ে সে বরাসনের দিকে এগিয়ে গেল। হালকা গন্ধ পেল চিরদীপ। রাধিকার বিনু্নিতে। বেলকুঁড়ির মালা।
বর আর বন্ধুদের সঙ্গে রাধিকা এক মিনিটে জমে গেল। স্বতঃস্ফূর্ত হাসি ছড়িয়ে বাসরঘরে নেমন্তন্ন করে বসল। বলল, যদিও মেয়েলি ব্যাপার, তবু ট্রাই নিন, আমি গান গাইব, না শুনলে মিস্ করবেন।
হাল্কা সুরে বলা। কথাটার গায়ে ইয়ার্কির পাউডার লাগানো, তবু চিরদীপের বুকের কোথায় যেন লাগল একটু; রাধিকা শূন্যে ট্রে ঝুলিয়ে তার সামনে ফিরে এসে বলল, হিংসে করার অন্য লোক থাকতে মিমিকে কেন হিংসে করতে যাব?
- অ্যাঁ?
- বলছি, হাসিটা কোথায় লুকিয়ে ফেললেন?
- পকেটে।
- সাজটা ভালো হয়নি বলছেন?
- না, না দারুণ!
- রাত্রে যদি বাড়ি পৌঁছে দিতে বলি?
চিরদীপ হেসে উঠল। ‘ভয় পেয়ে যাব।’
রাধিকা চলে যাচ্ছে। চিরদীপ তাকিয়ে রইল। জগু তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। জগুর হাসি হারিয়ে যাচ্ছে চিন্তার রেখায়। চিরদীপ কারণ জিজ্ঞেস করল। জগু ওর দাদার কথা বলল। বারো ক্লাশ ফাইনাল দেবে; তাই জগুর দাদা বিরজু নির্ঘাত এখনো পড়ে যাচ্ছে, রেডি হয়নি। আরো প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল চিরদীপ। পারল না। কালো স্বর্ণকাতানের ওপর লম্বা বিছেহার দুলতে দুলতে নেমে আসছে। কোমরে বিপজ্জনকভাবে চমকাচ্ছে চাবির রুপোলি রং। সিঁড়িতে আগুন, চিরদীপের চোখ সরছে না। চুড়ি নেমে আসছে।
।। চার ।।
চুড়ি বলছে, দীপুদা, চলো না, অসম্ভব মাথা ধরেছে। চুড়ির ইশারা মনুমামার দোতলা। বারান্দা অন্ধকার; একতলার দালানে দাঁড়িয়ে চিরদীপ ঘড়ি দেখল। সাড়ে দশটা। জগুটা পায়ে পায়ে ঘুরছিল এতক্ষণ, একদম ন্যাওটা। কোথায় গেল জগুটা? বরাসন ফাঁকা হয়ে গেছে, বরযাত্রীরা খেতে বসে গেছে, দু’একজন বিয়ের শেষ পর্ব দেখায় ব্যস্ত। কুণালকে বকেয়া মিটিয়ে গুডবাই করা শেষ। হীরুমামার জেনারেটারের প্রয়োজনে একটিন কেরোসিনও রেডি। লোডশেডিং হয়ে গেছে। জেনারেটারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
চিরদীপ দেখল বরাসনের চাদর লাটঘাট। বালিশগুলো অগোছালো, মাঝখানে দেবে যাওয়া। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক গ্লাসের তলানিতে সিগারেটের ফিল্টার, সাদা চাদরে এদিক-ওদিক দু’একটা রজনীগন্ধা। চিরদীপ সিগারেট খেতে লাগল।
- চলো না বাবা।
- তুই যা না, আমি এখান থেকেই তোকে পাহারা দিচ্ছি।
চুড়ি তার হাত ধরে সবেগে টানল। চিরদীপের প্রাণ কাঁপল। চুড়ির বর এ বিয়েতে আসেনি। বাচ্চা মেয়েটা বিয়েবাড়ির আঙিনায় অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটে বেড়াচ্ছে। রাধিকা আর মিমির অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে কি নীরব প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে চুড়ি? পরাজিত ভাবছে নিজেকে? অথচ সন্ধে থেকে সে তো যথাসম্ভব বিজ্ঞাপনী। চুড়ি আঁচল সামলালো। চিরদীপ আগুন নিভে আসতে দেখল। সিগারেট টানল, বলল, কাঁধ দুটো খুব ব্যথা করছে, বিশ্বাস কর; বহুদিন শালা পিঁড়ে ধরার অভ্যেস নেই!
জেনারেটারের ঘটঘট আওয়াজে কথা ঢাকা পড়ে গেল। সমস্ত শক্তি দিয়ে চুড়ি তাকে টানতে লাগল সিঁড়ির দিকে। আকুল হয়ে জগুর উপস্থিতি প্রার্থনা করল চিরদীপ। বাঁদরটা ঠিক এই সময়েই কোথায় কেটে পড়েছে; দাদাকেই ডাকতে গেছে কি? ভাবতে ভাবতে সিঁড়ির মাঝখানে হোঁচট খেল একটা। ‘দীপুকাকু’ বলে নরম গলায় কেউ পিছন থেকে ডেকেছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে চিরদীপ দেখল দালানে জগু দাঁড়িয়ে। জগুর পাশে রাধিকা। চিরদীপ চেঁচিয়ে বলল- কী বলছিস?
জেনারেটার কিছু শুনতে দিচ্ছে না।
বাঁধন শিথিল হচ্ছে। চুড়ি একা ওপরে চলে যাচ্ছে। চিরদীপ নেমে এল। বরের বন্ধুরা সিগারেট তলব করেছে। পকেট থেকে চিরদীপ বের করে দিল। জগু ছুটল প্যাকেট নিয়ে, রাধিকা দাঁড়িয়ে রইল। ‘পরের ব্যাচে মিমি আর বরকে নিয়ে আমরা খেতে বসব, আপনিও বসবেন। খাওয়া মিটিয়ে আপনার একটা ছোট্ট কাজ আছে।’
চিরদীপ জেনারেটার শুনছে। ঘ্রাণে পাচ্ছে বেলকুঁড়ি। রাধিকা বলছে, আপনার দু’চাকা চেপে একবার বাড়ি যাব।
- সেকি, বাসরে থাকবে না?
- থাকব। ফিরেও আসব আপনার স্কুটারে।
পায়ের চটিতে চিরদীপ সিগারেট নেভাল। রাধিকার চোখে তাকিয়ে রইল বোকা, স-প্রশ্ন।
- ভয় পেয়ে গেলেন?
- না না।
- ভয় নেই। ফেরার সময় আরেকজন আমাদের মাঝখানে থাকবে।
- কে?
- হারমনিয়াম।
বড়ো গলায় জেনারেটার শাসন করছে। গ্রীষ্মের রাত হাওয়া আটকে ভারী করে তুলেছে শ্বাস নেওয়া। অনেক লোকে হইচই করছে। হয়তো সানাইও বাজছে একটা; শূন্য বরাসনের ওপর পাখা ঘুরছে, একটা রজনীগন্ধা ফুলদানি থেকে ঝাঁপ দিল, পাঞ্জাবির বোতামে চিরদীপ আঙুল রাখল। ফিরে যাবার মুহূর্তে পিছন ফিরল চেনা বেলকুঁড়ি। নীরব একটুকরো হাসি। রাধিকা চলে গেল। দোতলা থেকে ‘দীপুদা’ বলে কেউ ডাকছে। অন্ধকার বারান্দায় তাকিয়ে চিরদীপ বলল, যাই।
।। পাঁচ ।।
ঘুম আসে না। এমন রাতে চোখ বন্ধ করেও কিছুতেই ঘুমনো যায় না। হয়তো কাছাকাছি হারমনিয়াম বাজিয়ে কেউ গান গেয়ে ওঠে। হয়তো নিজের গাল থেকেই ভেসে আসে মেয়েলি প্রসাধন, হয়তো সিগারেট খেতে ইচ্ছে হয়। ভোরবেলা ছোটমাইমার ভাইয়ের মাথা থেকে একটা বালিশ চুরি করে চিরদীপ প্যান্ডেলের এক কোণে শুয়ে পড়ল। পিঠের নীচে রেখেছে তিনটে ফোল্ডিং চেয়ার।
- অ্যাই।
কেউ ডেকেছে। চোখের ওপর রোদ পড়েছে। জ্বালা করছে।
- অ্যাই দীপুদা, ওঠো!
চিরদীপের মাথায় বাঁ-হাত ছুঁইয়েছে চুড়ি, চুড়ি ডান হাতে চায়ের কাপ।
চিরদীপ ঘড়ি দেখে উঠে পড়ল। আটটা বাজে। চুড়ির চান হয়ে গেছে। চুড়ি একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে। চিরদীপ বলল, জগুটা কোথায় গেল বল তো?
চুড়ি বলল, দেখো না, আমিও তখন থেকে পিংকিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি-
চুড়ি চলে গেল। উঠে পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চিরদীপ কাপে চুমুক দিল। আস্তাকুঁড়ে স্তূপাকৃতি কলাপাতা, তার ওপর কয়েকটা কাক। পাশে গেঞ্জি-পরা জগু দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে।
- অ্যাই জগু!
ইশারায় বাথরুম যাবার প্রয়োজন বোঝাল। চিরদীপ বলল, দ্যাখ তো, কোনটা খালি আছে?
থুথু ফেলে জগু বলল, আমাদেরটাই তো খালি। তুমি নেমে এসো।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে চিরদীপ প্রাতরাশের প্লেট আর জলের গ্লাস দেখতে পেল। বরের জন্য দুটো ট্রে যাচ্ছে। মাইমার পাশে পাশে এগোচ্ছে রাধিকা। আলগা ক্লিপ থেকে বিনুনির মালা ঝুলে পড়ছে। বাসি। চিরদীপের চোখে পড়ল ঘরের অন্য কোণে টেবিল ল্যাম্পের আলো। জগুর দাদা বিরজু পড়ছে। পড়া থামিয়ে ‘দীপুকাকা’ বলে ডাকল বিরজু।
কি বলছিস?
- একটা জিনিষ বুঝিয়ে দাও তো।
- ফিজিক্স?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ।
চিরদীপ হাসল। তার চোখের সামনে ফুটে উঠল নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ। বোঝানোর ভঙ্গিমায় চিরদীপ বলল, এ ইউনিভার্সের সবাই সবাইকে টানছে, সে একটা ফোর্স, গোটা ইউনিভার্সও প্রতিমুহূর্তে এক্সপ্যান্ড করতে চাইছে উল্টোদিকের ফোর্সে। দেখা যাচ্ছে এই দুনম্বরটা- মানে মহাবিশ্বের বহির্মুখী প্রসারিত হতে চাওয়াটা, অনেক বেশি জোরালো, একে অন্যের থেকে আমাদের ক্রমশ দূরে চলে যাবার কথা। প্রশ্ন হচ্ছে কেন দূরে যাচ্ছি না আমরা, এই তো?
বিরজু বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলল- ঠিক তাই। কিন্তু তুমি জানলে কি করে? চিরদীপ গভীর প্রত্যয়ে চোখ বুজল। জানি।