এঁকে আমি প্রথম দেখেছি টনসিল ছবিতে। গনশার চরিত্রে। তখন আমি শিশুমাত্র। তারপর চাক্ষুষ দেখেছি অনেকবার। বিশ্বরূপায় আসার পর প্রতি সপ্তাহে দেখেছি তিন দিন করে। বিশ্বরূপা থিয়েটারে আমার বাবা, বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক "ক্ষুধা" তখন হইহই করে চলছে৷ ইনি ছিলেন সেই নাটকের মূল চরিত্র৷ এঁকে দেখতেই দর্শক আসতেন ক্ষুধা দেখতে। ইনি কালী ব্যানার্জী৷ আমরা যে বাড়িটায় থাকতাম বিশ্বরূপার ভেতরে, সেটা ছিল থিয়েটারের পেছন দিক। সেখান দিয়েই ঢুকতেন সব অভিনেতারা৷ তিনিও ঢুকতেন দেখতাম। আমরা ওই বাড়িতে যাবার পর একদিন এলেন আমাদের বাড়ি৷ সকলের সঙ্গে আলাপ করলেন। আমাকে দেখিয়ে বাবা বললেন - এটা সর্বকনিষ্ঠ। সবচেয়ে পাপিষ্ঠ৷ শুধু খেলে বেড়ায়। পড়াশোনায় মন নেই। আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন - কী খেলিস তুই? আমি ফুটবল বলাতে খুবই খুশি হলেন। বললেন - আরে, আমার তো ফুটবলার হওয়ার কথাই ছিল। আর দ্যাখ, অভিনেতা হয়ে গেলাম। ভাল করে খেল বাবা। তবে পড়াশোনাটা করে। ঠিক আছে?
আমার তখন কোন ধারণাই ছিল না উনি কতবড় অভিনেতা৷ পরে যখন "ক্ষুধা" দেখতাম প্রায় প্রতি অভিনয়ের দিন, দেখতাম কী অবলীলায় তিনি নাটকটি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একার কাঁধে। নায়ক বলতেই আমরা তখন বুঝতাম সুদর্শন হতেই হবে। তিনিই আমার দেখা প্রথম নায়ক যিনি একেবারে সাধারণ দেখতে ছিলেন।
ইনি প্রথম পেশাদারী মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন শরৎচন্দ্রের বিপ্রদাস নাটকে। নাট্যরূপ বাবার ছিল। পরের নাটকও বাবার। তাইতো। মাত্র একদিন অভিনয় করেছিলেন সেই নাটকে। এরপর এলেন যখন শিশিরবাবুর শ্রীরঙ্গম নিয়ে নিলেন দক্ষিণেশ্বর সরকার ও রাসবিহারী সরকার। মঞ্চের নতুন নাম হল বিশ্বরূপা। প্রথম নাটক তারাশংকরের "আরোগ্য নিকেতন"। বহুলপঠিত সেই উপন্যাসের এক উল্লেখযোগ্য চরিত্রে আবার আসেন কালীবাবু। শশী কম্পাউন্ডার। স্বয়ং তারাশংকর নাটক দেখতে এসে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন তাঁকে।
পরের নাটক "ক্ষুধা"। বাংলা পেশাদারী মঞ্চের অন্যতম সফল নাটক। টানা চলার ক্ষেত্রে এশিয়ান রেকর্ড করে সেই নাটক। সেই সময়েই আমরা চলে আসি বিশ্বরূপা থিয়েটারের মধ্যেই একটি বাড়িতে। পেছনের দিকে। মূল চরিত্র সদা করতেন তিনি। তিন বেকার যুবকের কাহিনী। একটি দৃশ্যে ক্ষিধের জ্বালায় ওরা তিনজন একটি বিয়েবাড়িতে ঢুকে পড়ে বিনা নিমন্ত্রণে৷ ধরা পড়ে মার খায় তিনজনই। তিনজনই এসে বলে তাদের কেমন করে মেরেছে৷ কালী ব্যানার্জী বলতেন একটা গামছা হাতে নিয়ে - আমার মারে নি তো... আমায় নিংড়েছে। বলে গামছাটা নিংড়োতেন। তখন ইন্টারভালের পর্দা পড়তো। প্রতি শো-য়ে, ছুটির দিন আর রবিবার দুবার হল ফেটে পড়তো হাততালিতে৷ আমি নিজে দেখেছি পাঠক, শুনেছি সেই করতালধ্বনি কয়েক বছর ধরে বাড়িতে বসেই৷ আমাদের সেই ভাড়াবাড়ির রান্নাঘরের লাগোয়া ছিল স্টেজ৷ জানলাটা টিন দিয়ে মোড়া ছিল। কয়েকটা ছিদ্র ছিল তাতে। তা দিতে সকালবেলায় পুরো খালি প্রেক্ষাগৃহ দেখতে পেতাম আমরা।
আমি ছোট ছেলে৷ বাবা মায়ের সঙ্গে শুতাম রাত্রে৷ একদিন শো-এর শেষে বাবা এসে বললেন মাকে - কালী ছেড়ে দিচ্ছে বিশ্বরূপা৷ মা কেন জিজ্ঞাসা করাতে বাবা বললেন - হেমন্ত একটা ছবি করছে। মৃণাল সেন পরিচালক। তাতে মেন চরিত্র করবে কালী।
করলেন কালী ব্যানার্জী সেই চরিত্র৷ ছবির নাম নীল আকাশের নীচে। এক চীনে ফেরিওয়ালা সাজলেন তিনি৷ এই ছবিতে হেমন্তবাবুই পছন্দ করেছিলেন কালী ব্যানার্জীকে ক্ষুধা দেখার পর৷ এমনিই শুনেছি আমি। এই ছবিই কালী ব্যানার্জীকে প্রতিষ্ঠিত করে। দেশ-বিদেশে কালী ব্যানার্জী প্রশংসিত হন৷ প্রচুর কাজ পেতে শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত হন লৌহকপাট ছবিতে অভিনয় করে৷ তপন সিংহের ছবি। এক ফাঁসির আসামী৷ কাশিম ফকির৷ পাঠক, আজ একবার লৌহকপাট দেখুন৷ ছবি শেষ হয়ে যাবার পর ওই কাশিম ফকিরকে ভুলতে পারবেন না আপনি। কাশিম ফকির এক ধুরন্ধর খুনী। মানুষজনকে টাকা ডবল করে দেবেন বলে ডেকে নিয়ে এসে খুন করতেন তাদের তারপর দেহ লোপাট করে দিতেন। মঞ্জু দে ( আহা... কী সুন্দর অভিনেত্রী ছিলেন) করেছিলেন ওঁর স্ত্রীর চরিত্র। তিনিই ধরিয়ে দেন কাশিমকে। ফাঁসির সাজা হয় কাশিমের, আমার দেখা সেরা চরিত্র কালী ব্যানার্জীর।
চৌরঙ্গী একটি কালী ব্যানার্জী শতবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। সেটি পড়ছিলাম। সেটা পড়েই মনে হল আমিও কালী ব্যানার্জীকে নিয়ে কিছু লিখি। তাই এই লেখা।
আমার বাবার মুখে আমি প্রথম শুনি সিরিও-কমিক কথাটি। বলতেন আমার “সদা"কে প্রাণ দিয়েছে কালী তার সিরিও-কমিক অভিনয় দিয়ে। সেই কথা শোনার পর এবং ক্ষুধা দেখে আমি বুঝি সিরিও-কমিক অভিনয় কাকে বলে।
একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম ওই বইটায়। তাতে জানলাম যে তিনি একটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন সুরের আগুন নামে। চলে নি সেই ছবি। তিনি বলেছিলেন - প্রথম আটদিন আমায় চা খাইয়েছিলেন হল মালিক, ন দিনের পর থেকে তিনি গেলেই হল মালিক পালাতেন। এমনই ছিল তাঁব রসবোধ। এত বলিষ্ঠ অভিনেতা শেষ জীবনে কাজ পেতেন না। অঞ্জন চৌধুরী তাঁকে আবার প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা ছবিতে।
সেই প্রথম দর্শনের পর আমায় দেখতে পেলে তিনি একটাই প্রশ্ন করতেন - খেলছিস তো বাবা৷ পড়াশোনা কর সঙ্গে চুটিয়ে খেলাধুলা কর৷ ক্লাস ফাইভে আমার চশমা হল। তারপর যেদিন আমায় দেখলেন থিয়েটারে ঢোকার সময়, বললেন-- হয়ে গেল। আরে, চশমা পরে কী করে ফুটবল খেলবি? তারপর অবশ্য বেশিদিন উনি আর "ক্ষুধা"তে অভিনয় করেন নি। পরে হাসি নাটকে উনি আবার আসেন তবে বাবা সে নাটকে ছিলেন না। তবে যেহেতু আমরা থিয়েটারের ভেতরেই থাকতাম তখনও দেখা হয়ে যেত কখনোসখনো। স্মিত হেসে চলে যেতেন।
শেষবার দেখেছি আমাদের বি টি রোডের ভাড়া বাড়িতে। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। বাবার কাছে এসেছিলেন নাটকের স্ক্রিপ্ট শুনতে। বাদার চৌকিতে মাথার পেছনে দু হাত দিয়ে শুনছিলেন নাটক৷ সেদিন একটু বয়স্ক লাগছিল ওঁকে৷
একটি ঘটনা লিখে শেষ করি লেখাটি৷ চৌরঙ্গী-র সেই সংখ্যাতে লিখেছেন রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়৷ অজিতেশ আর কালীবাবু গেছেন বিহারের এক গণ্ডগ্রামে একটি হিন্দি ছবির সুটিং করতে। মেক আপ করছেন দুজনে একটি জরাজীর্ণ ঘরে৷ জানলা নেই। সেখান দিয়ে এক দেহাতি ঢুকে পড়েছেন৷ কালী ব্যানার্জী অজিতেশবাবুকে বললেন যে - অজিত, তুমি মেকাপ করো আমি এর সঙ্গে একটু হিন্দিতে কথা বলি৷
কালীবাবু- আপ কেয়া করতে হ্যায়?
লোকটি- ক্ষেতিবারি হুজুর৷
কালীবাবু- লেড়কা লেড়কি হ্যায়?
লোকটি- দো লেড়কা, এক লেড়কি। লেড়কি কা শাদি হো গয়া।
কালীবাবু- (একটু হেসে) দো লেড়কা ক্যা করতা হ্যায়? আপকে সঙ্গ ক্ষেতিবারি?
লোকটি- বড়া লেড়কা আই এ এস ঔর ছোটা ইঞ্জিনিয়ার।
কালীবাবু- আপতো "বর্ণচোরা" আম হ্যায়।
বড় ভাল, সহজ মানুষ ছিলেন এই অসামান্য, আন্তর্জাতিক মানের অভিনেতা কালী ব্যানার্জী...