• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৬ | অক্টোবর ২০২৪ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • জীবন জুড়ে ছড়ার ভুবন : সৃজা মণ্ডল

    লৌকিক ছড়ায় বঙ্গীয় সমাজ — দেবযানী ভট্টাচার্য ; প্রচ্ছদ-ভাবনা ও সজ্জা- শুভঙ্কর মাজি; প্রকাশক- আখরকথা, হাওড়া; প্রথম প্রকাশ- বৈশাখ ১৪৩১; ISBN: 978-93-91851-92-7

    ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমি ছড়াকে মেঘের সহিত তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যদৃচ্ছাভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক। ছড়াও কলাবিচার- শাস্ত্রের বাহির, মেঘ বিজ্ঞানও শাস্ত্র নিয়মের মধ্যে ভালো করিয়া ধরা দেয় নাই। অথচ জড়জগতে এবং মানবজগতে এই দুই উচ্ছৃঙ্খল অদ্ভুত পদার্থ চিরকাল মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিয়া আসিতেছে।”

    প্রাচীন লোকসাহিত্যের অন্তরমহলে ছড়ার জন্ম। বর্তমান সময়ে লোকসাহিত্যের তথাকথিত ঐতিহ্যের গণ্ডি অতিক্রম করে ছড়া তৈরি করেছে এক নতুন রূপ। আদতে ছড়া বৃহত্তর প্রেক্ষিতে সমাজের অন্যতম দর্পণ, যা মৌখিক আবৃত্তির মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিবিম্বিত করে― রচনার সমকাল বা অতীতের অভিজ্ঞতা। সেই অতীত, বর্তমানের মতোই জীবন্ত এবং সত্য। সেই সত্যের সন্ধানে ব্রতী হওয়ার লক্ষ্যে, ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ প্রণেতা নীহাররঞ্জন রায় শুধুমাত্র জ্ঞানস্পৃহাকেই একক কৃতিত্ব দেননি। বরং তাঁর কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল প্রাণের আবেগ। স্বভূমি-স্বদেশকে ভালবাসাই তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল জ্ঞানের পথে। নীহাররঞ্জন তাঁর সেই ব্যাপ্ত কর্মের উদ্দেশ্যটিকে স্পষ্ট করে দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর এই সন্ধান ‘দেশকে আরও গভীর আরও নিবিড় করিয়া পাইবার উদ্দেশ্যে’। সমসময়ের কোনও লেখিকা যখন একই রকম আগ্রহে তাঁর ইতিহাস ও সমাজের দিকে ফিরে তাকান, তখন বোঝা যায় তিনিও বুঝে নিতে চাইছেন তাঁর দেশ, জন্মভূমি, সমাজকে। দেবযানী ভট্টাচার্যের ‘লৌকিক ছড়ায় বঙ্গীয় সমাজ’ সেই অর্থে বাঙালি সমাজকে গভীরভাবে জানার একটি নতুন বই, নতুন আঙ্গিকের বই। অন্বেষণের নিরিখে একটি মাইলস্টোন।

    এই বইটির দশটি অধ্যয়ে লেখিকা সাজিয়েছেন ছড়ার ভুবন। ছড়া কি? ছড়ার সংগ্রাহক ও সংকলকদের কথা উল্লেখ করেছেন এবং একই সাথে লেখিকা ছড়া–রাজ্যের সিংহদুয়ার খুলে অন্দরে প্রবেশ করে মণিমুক্তো আহরণ করেছেন। তুলে ধরেছেন কলকাতাকে ঘিরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারিত হওয়া বিবিধ ছড়া। ছড়ার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা পৌরাণিক কিংবদন্তি বা উপকথাও ঠাঁই পেয়েছে এই গ্রন্থে। এছাড়াও আছে ফসলের বারামাস্যা থেকে পার্বণের বারামাস্যার তালিকা। কিন্তু আসলে সব ছড়ার আলোচনার অভিমুখই হল তৎকালীন সামাজিক রীতিনীতি, কাঠামো, কায়দাকানুন, জনমানসে পুরুষ-স্ত্রী উভয়ের ওপর ন্যস্ত সামগ্রিক দায়িত্বের প্রকারভেদের ওপর। এই বইয়ের মোট দশটি অধ্যয়ের উদ্দেশ্যই হল প্রত্যেকটি ছড়ার অন্তঃস্থলে ঘুমিয়ে থাকা আখ্যানগুলিকে জাগিয়ে তোলা। গ্রন্থ জুড়ে তাই প্রচেষ্টা রয়েছে বিবিধ প্রকার ছড়ার আড়ালে জমে থাকা ইতিবৃত্ত এবং কল্পকথা তুলে আনবার। বঙ্গীয় সমাজকে কেন্দ্র করে ভেসে চলেছে লেখিকার অনুসন্ধিৎসু মন।

    বোঝা যায় আপাত শিশুতোষ ছাড়াও কীভাবে ছড়া তার দেহে ইতিহাস ও সমকালীন সমাজকে ধারণ করে, তার পরতে পরতে বুনে দেয় তৎকালীন স্বপ্ন ও মূল্যবোধ। উদাহরণ হিসাবে এই গ্রন্থেরই একটি ছড়া তুলে আনি—

    খোকা হবে নায়েব
    দেখবে কত সাহেব।
    খোকার পুজোয় হবে ধূম;
    সোনার খাটে শোবে যাদু,-
    আয়রে যাদুর ঘুম।
    এটা শুধুই ঘুমপাড়ানি ছড়া নয়, এর সাথে জুড়ে আছে মাতৃহৃদয়ের চিরন্তন স্বপ্ন, যা পূর্ণতা পাবে খোকার নায়েব হয়ে ওঠার সামাজিক প্রতিষ্ঠার মধ্যে। তারপর খোকা পুজোর আয়োজনে ব্রতী হবে। দুর্গোৎসব উদযাপন সম্পন্ন বাঙালির চিরকালীন স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন একটি চার লাইনের ছড়ায় বুনে দেওয়া হয়েছে।

    লৌকিক বয়ানের রূপভেদ থেকে মেলে সমাজবাস্তবতার আঁচ। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করতে পারি এই ছড়াটি—

    আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
    ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।।
    বাজতে বাজতে চললো ডুলি।
    ডুলি গেল সেই কমলাপুলি।।
    কমলাপুলির টিয়েটা।
    সুয্যিমামার বিয়েটা।।
    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছেলেভুলোনোর ছড়া’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই ছড়াটির প্রথম কয়টি ছত্রে বিবাহ যাত্রার বর্ণনা আছে। আগে অভিজাত পরিবারের বিবাহের শোভাযাত্রা ছিল যুদ্ধযাত্রারই পরিবর্তিত রূপ। কারণ একসময় বিজয়ী গোষ্ঠীর লোক বিজিত গোষ্ঠীর মেয়েদের বিয়ে করবে, এমন প্রথা ছিল। এই ছড়াটিতে সেই বিবাহযাত্রারই একটি রূপের বর্ণনা পাই আমরা। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও এমন বীররসাত্মক বর্ণনায় বরযাত্রীদের শোভাযাত্রার কথা বলা আছে। এমনকি তখনকার দিনে বিয়েতেও জয়ঢাক যে বাজানো হত, তার উল্লেখ আছে ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে।

    কিন্তু মূল ছড়ার প্রথম অংশ আসলে ‘ডোম চতুরঙ্গের’ বর্ণনা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের ‘বেনের মেয়ে’ গ্রন্থে আমরা এই ছড়ার একটি অন্য রূপ পাই—

    আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে।
    ঢাক মৃগল ঘাঘর বাজে,
    বাজতে বাজতে পড়লো সাড়া
    সাড়া গেল বামনপাড়া।
                                                      (একাদশ পরিচ্ছেদ, দ্বিতীয়াংশ) রাঢ় অঞ্চলের এই ডোম জাতি তথাকথিত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর শরিক, যারা একদিন নির্ভীক বীরের মতো যুদ্ধ করতেন সমাজের উঁচু তলার রাজা, মহারাজা ও সামন্তপ্রভুদের জন্য। যাদের বীরগাথা ঠাঁই পায়নি কোনো ইতিহাসের পাতায়। ডোমসেনাদের বীরগাথা লুকিয়ে আছে বাংলার ছোট ছোট ছেলেদের খেলার ছড়ায়।

    সৃষ্টি আর রূপান্তরের নিত্য পথে জেগে থাকে আমাদের লোকায়ত জীবন। লোকজ জীবনের যে ছায়াপথ— তা কুটির, নকশি কাঁথা, আলপনা, খেলাধুলো, ছড়া-প্রবাদের মতো অজস্র বিষয়-উপাদানের এক অখণ্ড জীবনপ্রণালী। চমৎকার এক ক্যালাইডোস্কোপিক সমাজচিত্র ফুটে ওঠে অসংখ্য ছড়ার একত্রিত শরীরে। এ সমাজ শ্রমজীবী, কৌম দরদি, ঘোর আকালেও স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা-রাখা জনগণের নিজস্ব সমাজ। আপাতনিরীহ ছড়াগুলি বহন করে সমাজ বিবর্তনের চিত্র। ছড়াগুলি মানসিক তৃপ্তি দানের পাশাপাশি সমাজ মনটিকেও একতাবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করে এসেছে। মিশেল ফুকো-র মতে ছড়ার মধ্যে আছে এক নিম্নবর্গীয় জ্ঞান যা কোনোকালে এবং বর্তমানেও নির্জিত অবস্থায় চাপা পড়ে আছে। গভীর এবং কালানুক্রমিক অনুসন্ধানের ফলেই যার উদ্ঘাটন সম্ভব। এই বই সেই অনুসন্ধানের ফসল। যে অনুসন্ধানের ফলে বেরিয়ে আসে সমাজগত রাজনীতিগত অথবা ব্যক্তিগত কোনো সংঘর্ষ, সমর্পণ বা উত্তরণের ছবি।

    সন্দেহ নেই, এ-কাজ শ্রমসাধ্য। শুধুমাত্র জ্ঞানস্পৃহা দিয়ে গবেষণা হয়তো চালানো যায়, তবে ওই প্রাণের আবেগ আর দেশকে ভালবাসার চালিকাশক্তি না থাকলে অনুসন্ধান স্রোতস্বিনী হয়ে ওঠে না। বাংলার সমাজের অতীত সত্যে পৌঁছতে গিয়ে লেখিকা বহুবিধ বই পড়েছেন। এই ধরনের গবেষণা কাজে যেরকম নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় লাগে, এই বইয়ের সর্বত্র সে-ছাপ স্পষ্ট। এই বইয়ের আরও একটি গুরুত্ব থেকে যায়। যা রাখা আছে ওই আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান আর মায়ার ভিতর। মনে রাখতে হবে, যে-সময়ে দাঁড়িয়ে এই কাজ করছেন লেখিকা সেই সময়ে সবথেকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছড়ার ইতিহাস এবং পরিচয়কেই। অঞ্চলভেদে নিজস্ব ভাষা ও ছড়াকারদের নামগোত্র ইতিমধ্যে চিরতরে মুছে ফেলেছে আত্মবিস্মৃত জাতি। অজস্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে, পথে প্রান্তরে ঘুরে লৌকিক ছড়া সংগ্রহের যে অত্যন্ত কঠিন কাজে আত্মনিবেদন করেছেন ছড়া সংগ্রাহক ও ব্যাখ্যাকাররা, যারা জাতীয় সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের এই মহতী প্রচেষ্টার সৈনিক রূপে, জীবনপণ করেই, নিজেদের কাজ করে গিয়েছেন, তাঁদের অস্তিত্ব মুছে ফেলবার চেষ্টা চলছে। ইতিহাসকে ঠিকভাবে জানা, নানা উপায়ে অতীত সত্যের কাছে পৌঁছনো — এসবই সমসময়ের জরুরি এবং আবশ্যিক অনুশীলন। এই বই নিবিষ্টভাবে ছড়ার অন্তরালে বাংলার সমাজের ইতিহাস সন্ধানীই বটে, তবে একই সঙ্গে সময়ের চরিত্র বুঝেই তার চাহিদাগুলোকে পূরণ করেছে। সেই নিরিখে বইয়ের অন্তরতম সত্যটি যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক; ইতিহাসের বিকৃতির যুগে ইতিহাসের কাছে পৌঁছনোই স্বদেশব্রত। এ-বই ছড়ার ইতিহাসের বিপুল সম্ভার নিয়ে সে-কথা পাঠককে বলতে দ্বিধা করে না।

    এই বইয়ের পাতা উল্টোতে উল্টোতে বার বার মনে হচ্ছে, সমগ্র বাংলাব্যাপী এই সমীক্ষা-তথ্য বাঙালি জাতির আত্মবৈভবকেই পরখ করা। এই খোঁজে পাঠক স্মৃতিসত্তায় মগ্ন হবে— থাকবে অনুভবী গবেষণার রসদও। ছড়ার এই বর্ণিল রূপ বঙ্গজীবন ও সংস্কৃতির সহজপাঠ। এটাই জাত্যাভিমান— ভালবাসা আর একাত্মতার নিবিড় টানেই রূপায়িত হতে পারে এমন সার্বিক ভাবনা। বাঙালি জীবনের লোকজ ধারার বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ধরা রইল এই সারস্বত অন্বেষণে। আর যে-কথা বলতেই হয়, তা হল বইটি নির্মাণের পারদর্শিতা। শুভঙ্কর মাজির প্রচ্ছদ লৌকিক ইতিহাসের সেই মেজাজ গোড়াতেই বেঁধে দেয়। আসলে বই তো শুধু লেখা নয়, বই তার সমগ্রতা পায় ভাবনায়। এক্ষেত্রে সবার আগে ধন্যবাদ প্রাপ্য প্রকাশক ‘আখরকথা’-র। এরকম একটি বইয়ের স্বপ্ন তাঁরা শুধু দেখেছেন তাই-ই নয় , অতি যত্ন ও নিষ্ঠায় বইটিকে নির্মাণ করেছেন। লেখিকা দেবযানী ভট্টাচার্যের কলমে স্মৃতি যেন কোন্‌ জাদুতে ভাস্বর হয়ে ওঠে। উঠে আসতে থাকে আলো। আমরা প্রদীপ্ত হই।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments