• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৬ | অক্টোবর ২০২৪ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • উপহার : রূপসা দাশগুপ্ত

    দিল্লীর অভিজাত এক স্কুলে ছ বছরের স্বর্ণরেণু মিত্র ওরফে সোনা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হল। নামী-দামি ব্যবসায়ী পরিবারের বাচ্চারা সেই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, তার বাবা-মা সুকান্ত ও দেবলীনা অনেকদিন পর যেন ঠিক করে শ্বাস নিল, কদিন যা টেনশন আর স্ট্রেস গেল! সুকান্ত মিত্র সরকারি উচ্চপদে আছে, তাদের পরিবার কলকাতায় বেশ বড় ব্যবসায়ী, কিন্তু এইসব রাঘব বোয়ালদের কাছে তারা চুনোপুঁটি, তাই সন্দেহ ছিল এমন স্কুলে ছেলে চান্স পাবে কিনা।

    সুকান্তর স্ত্রী দেবলীনা নিজেও বড়লোকের মেয়ে। কিন্তু এই স্কুলে ছেলেকে পড়তে দিয়ে থেকে দেবলীনারও চোখ ছানাবড়া। কী চাকচিক্য! কী বাড়ি গাড়ি! কী পোশাকের বাহার! পার্টি ক্লাব, বাপরে বাপ!! তার ওপরে স্কুলের ডোনেশনের বক্স ভরার কম্পিটিশন আর কর্তৃপক্ষের তেল তোয়াজ সেই সব বড়লোক পেরেন্টদের।

    কিছু দিনের মধ্যেই ছেলের বন্ধুদের বার্থডে ইনভিটেশন আসতে শুরু করল। প্রথমে কয়েকটা পার্টিতে গিয়ে মা দেবলীনা ব্যাপারস্যাপার বুঝে গেল, ফলে বেশিরভাগ ইনভিটেশন এড়াতে শুরু করল তারা।

    এইভাবে দেখতে দেখতে সেই স্কুলে বছর দুয়েক কাটল সোনার, যত পুরনো হয় তত বন্ধু বাড়ে তার, পড়াশোনায় সে বেশ ভালো, আবার মিশুকও, তাই বন্ধুর অভাব হয় না। এবারে নিমন্ত্রণ এসেছে বেস্ট ফ্রেন্ড-এর জন্মদিনে, সোনা যাবেই, দেবলীনা আর এড়াতেও পারে না। সাথে আবার মা-বাবাকেও ডেকেছে। দেবলীনা গিফট কী দেবে ভেবেই অস্থির। তার মধ্যে আবার ছেলে জানাল, আদর্শ তাকে আর তার অন্য বন্ধুদের জানিয়েছে যে সে "আর্মানি কিড" ব্র্যান্ডের স্যুট পরবে। তারাও যেন একই ধরনের ড্রেস পরে আসে।

    দেবলীনার শুনে মাথা গরম, "আর্মানি তো ফিল্মস্টাররা রেড কার্পেটে পরে বলে শুনেছি, কুচো বাচ্চারা বার্থডেতে পরে বলে এই প্রথম শুনছি, যেতে হবে না তোকে ওই পার্টিতে।" সোনা কেঁদেকেটে মান-অভিমান করে একসা কাণ্ড করল সারা দিন।

    সুকান্ত-দেবলীনা অনেক শলাপরামর্শের শেষে আদর্শের জন্য স্টারওয়ার-এর স্পেস শিপ মডেল কিনল; ছেলেই পছন্দ করল বন্ধুর জন্য। ফলে তার বাবার বাজেট অনেকটাই ছাড়িয়ে গেল।

    যেমন আশা করা হয়েছিল সেরকম জাঁকজমক হলও পার্টিতে, সোনাকে অবশ্য স্যুট পরানো হল না, অন্য বন্ধুরা সকলেই প্রায় ব্র্যান্ড বাহারি হয়ে এল। পেরেণ্টরা মিঃ অ্যান্ড মিসেস মিত্রকে মনে করিয়ে দিতে ভুলল না--এবার আপনাদের পার্টি দেবার পালা।

    আদর্শের জন্মদিনের মাস কয়েক পর সোনা ও তার বন্ধুরা ক্লাস থ্রিতে উঠল। নতুন বছরের শুরুতে স্কুলে জামাকাপড় ও খেলনা ডোনেশন নেয়া হয়। এগুলো দুঃস্থ বাচ্চাদের মধ্যে বিতরণ করা হবে শহরের বিভিন্ন এলাকায়।

    টয় ডোনেশন বক্সে স্বর্ণরেণু দেখতে পেল তার দেয়া গিফট-এর মত অবিকল একটা বাক্স। বাক্স একদম নতুনই আছে, তুলে দেখে সেটার পিছনে একটা স্টিকার লাগিয়েছিল সে, সেটাও আছে। সে চুপি চুপি বাক্সটা একটা প্যাকেটে জড়িয়ে বাড়ি নিয়ে এল।

    মাকে দেখিয়ে বলল, "দেখো মা, আদর্শ এটা খুলেও দেখেনি।"

    "তোমার বাবা এতগুলো টাকা দিয়ে কিনল গিফটটা, এইসব অতি বড়লোকের বাচ্চার সঙ্গে তুমি যদি আর মিশেছ।" বলল দেবলীনা, একদম স্বভাব নষ্ট হয়ে যাবে।"

    সোনা ছল ছল চোখে খেলনার বাক্সটা খুলে নিজেই খেলতে লাগল। কিন্তু কোথায় একটা তীব্র কষ্ট অবহেলা অপমান তার ছোট্ট মনকে ভারী করে তুলল!

    ছেলের সেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেবলীনার স্মৃতিতে হঠাৎ ভেসে উঠল অনেক বছর আগের একটা দৃশ্য--চোখের জল মুছতে মুছতে, একটা বড় টেডি বেয়ার কোলে খুকু আয়া চলে যাচ্ছে তাদের কলকাতার বাড়ির গেট ঠেলে।

    সোনাবাবু ভাত খাবে, মাছ খাবে, পায়েস খাবে, হে-হে খুব হাসি, ফোকলা দাঁতে। দাঁত আর বার হোক দুটো, না হলে খাবে কী করে?

    খুকু গাবলুগুবলু বাচ্চাটাকে কোলে দোলাতে দোলাতে নিজেই হেসে আকুল। মাসিমা বলেন, "তুমি সব্বাইকে নিয়ে আসবে খুকু, কজন তোমরা?"

    "এইতো, ছেলে মেয়ে শাউড়িমা আর বর।"

    "বৌমা খুকুরা পাঁচজন মনে রেখো, লিস্টে লেখো।"

    গরমের তাতাপোড়া দুপুরে পাথরের ঠান্ডা মেঝেতে একটু জিরিয়ে নিতে নিতে বাচ্চার দোলনা দোলায় খুকু আয়া। কী উঁচু ঘরগুলো এদের বাড়ির। মার্বেলের ঠান্ডা মেঝে। যেমন খুশি ঠান্ডা জল খায় ফ্রিজ থেকে, দিনের শেষে এক বোতল নিয়েও যায় বাড়ির জন্য, খুব বড় মানুষ মিত্ররা, বিজনেসে বড়বাবুর পয়সা, আবার ছোটবাবু চাকরিও করে নাকি অনেক বড়সড় আপিসে, ভগবানের এমন একচোখেমো কেন? খুকু ভাবে। তারপরেই দেবশিশুর মত দোলনায় শোয়ানো বাচ্চাটার দিকে চোখ পড়তেই নিজেকে খুব ছোটলোক মনে হয়। "সোনাবাবুর পয়সায় নজর দিচ্ছি, ছি ছি, আহা তোমার আরো পয়সা হোক, সুখী হও--" বিড়বিড় করে কপালে হাত ঠেকায় খুকু।

    সন্ধ্যেয় বাড়ি পৌঁছে খুকু ওর বরকে বলে, "সোনাবাবুর মুখে ভাত, আমাদের সকলের নেমন্তন্ন। শুধু খেলে হবে না তোমার দোকানের সেরা খেলনাটা আমি দেব সোনাবাবুকে।"

    খুকুর বর বলাই বলে, "যতই সেরা খেলনা দি না কেন, আমার ছোট্ট দোকানে ওই বড়লোকের বাচ্চার মন ওঠার খেলনা থাকে না। শুধুমুধু পয়সা খচচা কোরো না, কোথায় টান মেরে ফেলে দেবে।"

    "মোটেই না, ওরা অমন নয়। আমাকে কত ভালোবাসে; নইলে পাঁচজনকে নেমন্তন্ন অমনি কলল না? আমি পছন্দ করব তোমার দোকানে গিয়ে, আমার পয়সায়।"

    বলাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সে জানে ওই বড়লোকের নাড়ুগোপালে খুকু এখন মগ্ন, কোন কথা কানে নেবে না।

    খুকুর সাত বছরের ছেলে এবারে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, "বাবা আমাকে দোকানের কোন খেলনা ধোততেও দেয় না। যেগুলো আর বিক্কিরি হয় না সেগুলো দেয় শুদু, আর তুমি কিনা সোনাবাবুকে সেরা খেলনা দেবে?"

    খুকু বলে, "তুই বুজবি না একটা মান-সনমান বলে বস্তু থাকে মানুষের। পাঁচ জন খাব ভালো কিছু দেব না?"

    বলাই বলে, "ধুত্তর! অত জিনিসের মধ্যে তুমি কী দিলে ওরা জানবে?"

    খুকু বলে, "যাতে জানে এমনভাবেই দেব।"

    মিত্র বাড়িতে অন্নপ্রাশনের তিন চারদিন আগে থেকে খুকু আয়া ধাঁধোশে কাজ করল। যে কাজ তার করার কথা নয় তাও করে দিল। বৌদি ও মাসিমা খুব প্রশংসা করলে। বাড়ি যাওয়ার সময় ফল-মিষ্টিও দিলে এই কদিন।

    মুখেভাতের সকালে খুকু বিরাট আকারের টেডি বেয়ারটা কোলে করে মিত্র বাড়িতে যখন ঢুকল, তার দেহটা গর্বে একটু বেশিই টান টান ছিল। বেয়ারটা বাদামি লোমের, পেটের দিকটা গোলাপি। কালো বোতামের চোখ আর নাক। বেশ ভারী জিনিসটা। খুকুর ছেলে দেখেই কেঁদে একসা করেছে, এমন বড় ভাল্লুক সে নিজের বাবার দোকান থাকতেও কোনদিন পায়নি। মাসিমা বৌদি সবাই কেমন চমকে যাবে!! এত বড় গিফট খুকু এনেছে দেখে। সে কথা ভেবে খুকুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সোনাবাবুর ঘরে পুতুল হাতে ঢোকার মুখে মাসিমা ধাঁ করে ওর হাত থেকে বড় ভাল্লুকটা নিয়ে বললেন--"বাবুর জন্য এনেছো খুকু? দাও আমাকে আমি রেখে দিচ্ছি।"

    খুকু আমতা আমতা করে বলল, "বাবুকে একবার দেই না ধরতে--"

    "তুমি বাচ্চার কাজ করছ এতকাল কবে বুদ্ধি হবে তোমার? এই লোম লোম জিনিস দিলে ওইটুকু বাচ্চা হেঁচেকেশে একশা হবে, জানো না?"

    "তবে কি অন্য কিছু আনলে ভালো হতো মাসিমা? আমাদের তো নিজেদের দোকান--"

    "না না আমি কি তাই বলেছি? উঁচুতে সাজিয়ে রাখব, হাতে না দিলেই হল।"

    "কেমন হয়েছে মাসিমা জিনিসটা?"

    "খুব সুন্দর খুকু, কত বড় পুতুল এনেছো তুমি তোমার সোনাবাবুর জন্যে, খুব ভালো হয়েছে।"

    রাতে শাশুড়ি বউ বলাবলি করে--কী ভারী দেখেছ, সস্তার সফট টয়, কী বিশ্রী ফার, ইঁটের মত শক্ত, নামেই সফট টয়। কিন্তু ফেলা যাবে না, খুকুকে চটালে এমন খাটার লোক আরেকটা পাবে কোথায়?

    তাই দামি দামি গিফটের মধ্যে গোলাপি, পেটে ছোবা-ভরা খুকুর টেডি বেয়ার বসে থাকে।

    মুখেভাতের এক বছর পরে খুকুর সোনাবাবু তার বাবা-মার সাথে দিল্লী পাড়ি দেবে। তার বাবা মিত্রবাড়ির ছোট দাদাবাবু সেখানে পোস্টিং পেয়েছেন।

    খুকু আবদার করেছিল তার দেওয়া গিফটটা সোনাবাবুর জন্য যেন নিয়ে যায়, এখন সে বড় হয়েছে নাকে রোঁয়া ঢোকার অত ভয় নেই। তাছাড়া উনকোটি চৌষট্টি জিনিস যখন যাচ্ছেই বিশাল ট্রাকে।

    ওরা চলে যাওয়ার একদিন আগে মাসীমা টেডিটা স্টোর রুম থেকে বের করে দিয়ে বললেন, "তুমি আর একটা বাড়িতে কাজ ধরবে তো খুকু। তোমার গিফটটা নিয়ে যাও একদম নতুনই আছে। তোমার বরের দোকানে আবার বিক্রি করে দাও অথবা আর কোন বাচ্চাকে গিফট দাও।"

    টেডি কোলে চোখের জল মুছতে মুছতে খুকু মিত্রবাড়ি ছাড়ল। খুকুর ছেলে নয় বছর বয়সে সেই টেডি পেয়ে আর ততখানি উল্লসিত হল না। বর বলল, "বলেছিলাম পয়সা নষ্ট, দেখলে তো? দাও দেখি যদি সস্তায় হলেও বিক্‌কিরি করতে পারি।"



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments