আমার যখন কৈশোর, তখন থেকেই দশরথের প্রতি আমার একটা সহানুভূতি ছিল। আহা, বুড়ো মানুষ। অনেক দিন আগে যে প্রতিশ্রুতি করেছিলেন স্ত্রীকে, তা রক্ষা করার জন্য প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তানকে বনে পাঠাতে হল। পাঠিয়ে এমন একটা বুকফাটা কষ্ট হ’ল, যে তাতেই প্রাণ হারালেন।
কিন্ত আমার প্রিয় কবি, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, একেবারেই অন্য রকম মত প্রকাশ ক’রেছিলেন এই বিষয়ে, বলিষ্ঠ ভাষায় –
আমাকে দেয় নি শাপ
শোকগ্রস্ত কোনো অন্ধ মুনি।
বুক খুলে দেখাই না লোক ডেকে ডেকে চোখের জলছাপ।
আমি নই স্ত্রীর বশ
ইক্ষাকু বংশের সেই ভগ্নস্নায়ু দ্বিধাদীর্ণ মেনিমুখো রাজা।
মুখ বুঁজে সগৌরবে আমি বই কালের এ সাজা।
অসহায় মানুষের অসহ্য যন্ত্রণায় আমার করুণা হয়েছিল। কালের সাজা কাঁধে ক’রে চলতে চলতে কবি কোনো সমবেদনা খুঁজে পাননি। আমি যে বুড়ো মানুষকে নিরুপায় দায়বদ্ধ মনে করেছিলাম, কবি তাকে নির্দ্বিধায় দায়ী ঠাহর করেছিলেন।
আমার কৈশোরের ঝরনা এখন বিস্তৃত নদী হ’য়ে সাগরে মিশতে এসেছে। অভিজ্ঞতা হয়েছে খানিকটা। এখন একটু একটু বুঝতে পারি কবির অসহিষ্ণু বিচারের রায় –
কাছে এসো রত্নাকর, দূর হটো বাল্মীকি।।
কী তার কারণ?
এক কথায় বলতে গেলে বাল্মীকির দশরথ ব্যর্থ। এবং সেই ব্যর্থতা হয়তো কবির কাছে ক্ষমাযোগ্য হয়নি।
অনুমান ক’রে নিতে অসুবিধা নেই যে কৈকেয়ী এসে যখন দশরথকে তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি মনে করালেন, তখন দশরথের মনে একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হ’ল। দুটো অসঙ্গত সুর একসাথে বেজে উঠলো প্রাণের বীণায়। এখানে ‘সুর’ মানে অন্তস্থিত দুই কন্ঠস্বরও মনে করতে পারি। দুটো স্বাধীন শক্তি। দুটো স্বেচ্ছাচারী মনস্তাত্বিক সত্তা। সবচেয়ে লক্ষণীয় হ’ল এদের স্বশাসন – মানুষের মনের এই সুরগুলো মানুষের অধীনে থাকে না। তারা নিজেদের মত আসে যায়। সেই জন্য, “সুরাসুর” কথাটার মধ্যে যে সুর আছে, এইসব সুরকে সেই ধরনের সুর হিসাবেও কল্পনা ক’রে নিতে পারি।
এক সুর দশরথকে বললো, ‘নিজের প্রতিশ্রুতি তোমায় রক্ষা করতে হবে। তোমার কথারই যদি দাম না থাকে, তাহলে তোমার জীবনের আর কী অর্থ বাকি রইল?’
অন্য সুর বললো, ‘তুমি তোমার প্রিয় সন্তানকে অনুচিত শাস্তি দিতে পারো না। সেও অকারণ কষ্ট পাবে, এবং তুমিও। সে ঘোর অন্যায় হবে।’
এই অবস্থায় রাজা করবেটা কী? আহা রাজা, বেচারা রাজার ভারি দুখ্!
দশরথের চেতনা তখন হ’ল ঝোড়ো হাওয়ায় সমুদ্রের উপরিতলের উত্তেজিত জলের মত। ঢেউয়ে ঢেউয়ে উথাল-পাথাল। সাদা ফেনায় চারপাশ ছেয়ে গেছে। জলের সব স্বচ্ছতা চ’লে গিয়ে একটা ঘোলা বিশ্রী বিশৃঙ্খলা।
কিন্তু তলায়, অনেক গভীরে, গভীর থেকে গভীরতর প্রদেশে ছিল দশরথের অচেতন মন। অবচেতন নয়, সম্পূর্ণ অচেতন। মূল জার্মান শব্দটা হ’ল unbewußte (উনবিওয়েস্টে) – ইংরিজিতে বলে unconscious, বিশেষ্য – যেটার প্রচলন হয়েছিল আধুনিক মনস্তত্ত্ব বিদ্যায়, ইয়োরোপের ভিয়েনা শহরে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে। অচেতন-কেন্দ্রিক এই মনস্তত্ত্ব বিদ্যাকে বলা হয় ‘গহিনতা মনস্তত্ত্ব’ (depth psychology)।
তখন মনস্তত্ত্ব নিয়ে কিছু নতুন ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে ফ্রয়েডের (Freud) নাম অনেকেই জানে। ইউং (Jung) এবং অ্যাডলার (Adler) কম পরিচিত। ফ্রয়েডের অনেক কথাই পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইউং-কে নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে, বিশেষ ক’রে শেষ জীবনে লেখা তাঁর আত্মজীবনীতে বিবরিত ’অবৈজ্ঞানিক’ আধ্যাত্মিকতার দূষণ নিয়ে। কিন্তু মানুষের অচেতন মনের অস্তিত্ব নিয়ে বিশেষ কোনো সন্দেহ নেই। ওই অচেতন অন্ধকারেই সুরাসুরের কারবার, আমাদের অগোচরে। অবশ্য মাঝে মাঝে তারা চেতনাতেও নিজেদের জানান দেয়।
কয়েকটা উদাহরণ দিই।
যেমন, আপনি সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরোলেন রোজকার মত। যখন অফিস পৌঁছলেন, তখন হঠাৎ লক্ষ্য করলেন যে যাত্রার প্রথম এবং শেষ মুহূর্ত ছাড়া আপনার আর কোনো স্মৃতি নেই। কোন রাস্তা দিয়ে এসেছেন, অমুক মোড়ে ডান দিকে গিয়েছিলেন না বাঁ-দিকে, কোথায় গাড়ি ভিড়ে আটকেছিল, ইত্যাদি কোনো কিছুই আপনার মনে নেই। যেন যাত্রার আগাগোড়াই আপনি ঘুমোচ্ছিলেন আর আপনার অচেতন মন আপনাকে সব বিপদ এড়িয়ে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দিয়েছে।
যেমন, আপনি কড়া পাক সন্দেশ পছন্দ করেন, নরম সন্দেশ খান না। বন্ধুর বাড়িতে দু’রকমের সন্দেশ দিয়েছে প্লেটে সাজিয়ে। বন্ধুর কথা শুনতে শুনতে সম্পূর্ণ বিনা কারণে জেনেশুনে আপনি নরম সন্দেশ খেলেন। আশ্চর্য।
যেমন, আপনার সদ্য বিয়ে হয়েছে। নতুন শ্বশুরের সাথে কথা বলছেন। ওনার মাথায় কোনো চুল নেই। পেছনের জানলা দিয়ে ঝকঝকে রোদ এসে ইন্দ্রলুপ্ত আলোকিত করেছে, চকচক করছে পালিশ করা কাঠের মত। উনি খুব মন দিয়ে আপনাকে জ্ঞান দিচ্ছেন। গল্প করছেন নিজের প্রথম জীবনের আর্থিক কষ্ট সম্বন্ধে। সুন্দর জীবন যাপনের জন্য কত কী দরকার তার লিস্ট দিচ্ছেন — জামাকাপড়, খাবার, বাড়ি ইত্যাদি। আপনি আগ্রহ দেখানোর জন্য কিছু বলতে চাইলেন। “টাকা” না ব’লে, বললেন, “সে তো বটেই, টাকের খুব প্রয়োজন।”
যেমন, আপনি একটা কঠিন সমস্যার সমাধান খুঁজছেন। সেটা পারিবারিক, কিম্বা অফিসের রাজনীতি সংক্রান্ত, অথবা কলেজের গণিত ক্লাসের একটা জটিল অংক। আপনি ভেবে ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছেন না। সমস্যাটা দুরূহ। কয়েকদিন চেষ্টা ক’রে শেষে হাল ছেড়ে দিলেন। তার ঠিক পরদিন সকালে ঘুম ভাঙা মাত্র চোখের সামনে একটা সুন্দর মীমাংসা পরিষ্কার দেখতে পেলেন।
এইসব নানা উদাহরণ দেখলে এবং ‘গহিনতা মনস্তত্ত্ব’-এর মনীষিদের লেখা পড়লে — বিশেষ ক’রে ইউং-এর লেখা — মানুষের অচেতন মনের অস্তিত্ব নিয়ে বিশেষ কোনো সন্দেহ থাকে না। কিন্তু এখনকার আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদ্যা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়েছে – এখন তার চিন্তা-ভাবনার আকর্ষণ আচরণগত (behavioral) দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি। এখন গহিনতার চল উঠে গেছে, বিশেষ ক’রে ইউং-এর মতামত।
অচেতন-এর প্রধান সমস্যা হ’ল এই যে তা অচেতন, পর্যবেক্ষণীয় নয়। যা দেখা যায় না, মাপা যায় না, যাকে যথেচ্ছ পুনরুদ্পাদন করা যায় না — আমাদের সর্বোচ্চ বস্তুবাদী বিজ্ঞান তাকে অস্বীকার করে। আচরণ মাপা যায়, ব্যবহার দেখা যায়। তাই এখন আমরা মনস্তত্ত্ববিদ্যায় আচরণ-কেন্দ্রিক ভাবনাচিন্তা করি। কেউ কেউ অচেতনের অস্তিত্ব সংক্রান্ত উদাহরণগুলোকে একান্তই অস্বীকার করতে না পারলে মরিয়া হয়ে আজকাল অন্য নামে ডাকতে পছন্দ করেন, যেমন স্বয়ংক্রিয় (automatic) বা মনোযোগ (attention)-রহিত আচরণ।
হাজার হাজার বছরের কুসংস্কার ও অন্ধকার পেরিয়ে - যে সমস্ত ভণ্ড লোভী ব্যবসায়ীরা ‘মহাপুরুষ’ সেজে আমাদের বিশ্বাসের সুযোগ নিত, তাদের হটিয়ে — আমরা এখন একটা দুর্দান্ত হাতুড়ি পেয়েছি, যার নাম বস্তুবাদী বিজ্ঞান। তাই সব কিছুই আমাদের চোখে পেরেকের মত ঠেকে! আর যেটাকে কিছুতেই পেরেকসুলভ ক’রে উঠতে পারি না, সেটাকে ওই প্রাচীন কুসংস্কার পর্যায়ে ফেলে, পিটিয়ে, আরাম বোধ করি। এটাকেই জার্মানে (এবং ইংরিজিতে) বলে স্নান করা জল ফেলে দেওয়ার সাথে শিশুকেও ফেলে দেওয়া।
যাই হোক। অচেতনের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কাছে এসো বাল্মীকি।
আমাদের অচেতনে চলে অবিরাম সুরাসুরের কারবার। লালন ফকিরের ভাষায় -
তোমার ঘরে বসত করে কারা
ও মন জানো না!
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা!
একজনে সুর তোলে একতারে,
ও মন, আরেকজনে মন্দিরাতে তাল তোলে।
ও আবার বেসুরা সুর ধরে দেখো কোন জনা!
রবি ঠাকুর গেয়েছিলেন -
শত ভাগ মোর শত দিকে ধায়,
আপনা-আপনি বিবাদ বাধায়–
কারে সামালিব, একি হল দায়–
একা যে অনেকগুলি হে।
পদে পদে পথ ভুলি হে।
ওয়াল্ট উইটম্যান লিখেছিলেন -
আমি কি নিজেরই বিরোধী?
বেশ, আমি তবে নিজেরই বিরোধী।
(আমি সুবিশাল, আমারই মধ্যে আছে জনতার ভিড়।) ১
আমাদের অচেতনের এই চরিত্র সমষ্টি আমাদের স্বাভাবিক অবস্থা। এটা স্কিজোফ্রিনিয়া (schizophrenia) বা একাধিক ব্যক্তিত্ব ব্যাধি (multiple personality disorder)-এর মত কোনো চরম মানসিক অসুখ নয়।
সর্বজনীন ও সাধারণ এই চরিত্রসমষ্টিকে একটা উপমায় দেখা যেতে পারে, ইউং-এর ভঙ্গিতে। এরা সবাই নিজের ইচ্ছায় ও প্রবৃত্তিতে আসে, যায়, কাজ করে। এরা কেউ আমাদের অধীন নয়। যেন এক একজন এক একটা দেবতা। দেবতা শব্দটা অত্যধিক ব্যবহারে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আস্তিক-নাস্তিক বিবাদে, তেত্রিশ কোটি মতবাদে বরবাদ হয়েছে শব্দটা। ওটা বাদ দিয়ে বরং আরেকটা পুরোনো শব্দ, ’সুর’, বলতে পারি।
আমাদের সব কাজ এই সব সুরদের জন্য। আমরা এঁদেরই আজ্ঞাবহ। যতই যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে পথে হেঁটে চলি, আমাদের সেই যুক্তি ও বুদ্ধির পেছনে অন্য এক স্তরে সুরগণ তাঁদের নিজেদের ইচ্ছার পরিতৃপ্তি খোঁজেন। আমরা টের পাই না মোটে। টের পাই না। টের পাই না – যতক্ষণ না দুই সুরের মধ্যে হঠাৎ বিবাদ ঘটে। তখন আমরা চমকে উঠে নিজেকে খুঁজতে যাই, আয়নার প্রতিবিম্বকে বুঝতে পারি না। আমরা বিভ্রান্ত হই।
অচেতন সুরাসুরের এই আকস্মিক সংঘাত যখন আমাদের চেতনায় প্রকাশ পায় – যেটা সবার জীবনেই কোনো না কোনো সময়ে ঘ’টে থাকে – তখন আমাদের একটা কর্তব্য থাকে। কোন্ সুরের কথা মানব সেই সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব আমাদের। কোনো না কোনো সুরের কথাতেই আমাদের চলতে হবে। কিন্ত কোন জনা? সব সুরের বক্তব্যই আমাদের অনুধাবন করতে হবে। যে সুরকেই প্রাধান্য না দিই, তিনি আমাদের উপহার দেবেন একটা জ্বালাময় অপরাধবোধ। তবু মানুষ হিসাবে, গভীর বিনয়ে, ইচ্ছাকৃত ভাবে, একজন সুরের কাছে আমাদের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। যদি না করি, তাহলে সুরাসুরের যুদ্ধ চলতে থাকবে, আমরা হব উলু খাগড়া। ইউং মানসিক পীড়াকে (neurosis) বলেছিলেন এক আহত সুর।
এই সুরাসুরের যুদ্ধকে যদি পথের একটা মোড় মনে করি, যেখানে অগ্রসর হবার জন্য আমাদের ইচ্ছাকৃত ভাবে একটা দিক ঠিক ক’রে নিতে হবে, তাহলে সেই মুহূর্তে নিজেকে একটা প্রশ্ন করা যায়। ইয়ুং-বিষারদ জেম্স হলিসের মতে সেই প্রশ্নটা হ’ল — “অমুক দিকে গেলে কী আমার বৃদ্ধি হবে, না ক্ষয় হবে?”২ আমি বড় হব, না আমি খাটো হব?
প্রশ্নটা বিজ্ঞানের নয়, প্রযুক্তির নয়, সম্পূর্ণ যুক্তিরও নয়। হয়তো মনস্তাত্বিক, হয়তো আধ্যাত্মিক। ইংরিজি psychology শব্দটার মূলে রয়েছে “psyche”, যেটা ল্যাটিন, মানে আত্মা (soul)। প্রশ্নটার উত্তর দিতে সাধারণ বুদ্ধির প্রয়োজন আছে, সংবেদনের প্রয়োজন আছে, বুদ্ধিজীবী মস্তিষ্কের নিপুণ পারদর্শিতার প্রয়োজন নেই।
দশরথ সেখানেই একজন ব্যর্থ মানুষ। তিনি একজন সুরকে সচেতনভাবে নির্বাচন ক’রে আধিপত্য দেননি। কিম্বা, দশরথ যে সুরকে আধিপত্য দিয়েছেন তিনি দশরথকে খাটো করেছেন, বড় করেননি। এবং সেই ব্যর্থতার চরম দাম দশরথকে দিতে হয়েছে মৃত্যুতে। প্রতিশ্রুতি-রক্ষা কি একটা অলঙ্ঘ্যনীয় নিয়ম, একটা অকাট্য বিধান? নাকি তিনি একজন সুর – অনেকের মধ্যে এক, কখনো কখনো কোনো কোনো চরম অবস্থায় বর্জনীয়?
রবি ঠাকুরের ভাষায় -
কার হাতে যে ধরা দেব, প্রাণ,
তাই ভাবতে বেলা অবসান।
ডান দিকেতে তাকাই যখন বাঁয়ের লাগি কাঁদে রে মন-
বাঁয়ের লাগি ফিরলে তখন দক্ষিণেতে পড়ে টান।।
সুরাসুরের গল্পটা ভালো-মন্দের গল্প নয়, মূল্যবোধের ব্যাপারও নয়। এক একটা সুর এক একটা জাগতিক প্রবৃত্তি, এক একটা প্রবণতা বা ঝোঁক। সুরগণ মানুষের নৈতিকতার ঊর্ধ্বে। অবস্থা বিশেষে আজ আমার যাকে অসুর মনে হয়, তিনিও অন্য অবস্থায় এক সুর, অন্য কোনো দিন।
সুরাসুরের গল্পটা সুখ বা আরামেরও নয়। যদি সুরাসুরের দ্বন্দ্বে একজনকে বেছে নিয়ে আমি একটা মীমাংসা করতে পারি, তার মানে এই নয় যে আমি তক্ষুনি খুব শান্তি পাব। যে সুরকে মানলাম না, তাঁর শাস্তি হিসেবে আমাকে মেনে নিতে হবে আমার অপরাধবোধ। যদি আমার পছন্দ করা পথ সত্যিই আমাকে বড়ো করে, তাহলে ক্রমশ সেটা আমার কাছে পরিষ্কার হবে। একটা বোধ জন্মাবে, একটা প্রাণশক্তি পাবো, একটা তেজ বা জোর বা উদ্যম বা উৎসাহ অনুভব করবো, যা আমার পথচলাকে সহজ ও আনন্দদায়ক করবে।
কোন্ দিকে গেলে আমার বৃদ্ধি হবে? রিলকে লিখেছেন -
জীবনে আমি বাঁচি
এক বৃত্ত থেকে বৃহত্তর বৃত্তে,
যেগুলো বড় থেকে আরো বড় হ’য়ে
পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
এই শেষ বৃত্তটা হয়তো বা শেষ করব না,
তবু তারই কাছে
নিজেকে করেছি উৎসর্গ।
ঈশ্বরের চারপাশে আমার কক্ষপথ,
আদিম উত্তুঙ্গ স্তম্ভের পরিধি বেষ্টন ক’রে।
এভাবেই ঘুরে ঘুরে
কেটে গেছে হাজার বছর।
তবু আজও জানি নাকো:
আমি কি বাজপাখি?
নাকি আমি ঝড়?
অথবা কোনো মহৎ সংগীত?২
আর রবি ঠাকুর গেয়েছিলেন -
তিমির-অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি
কে তুমি মম অঙ্গনে দাঁড়ালে একাকী?
রয়েছি বাঁধা বন্ধনে, ছিঁড়িব, যাব বাটে--
যেন এ বৃথা ক্রন্দনে এ নিশি নাহি কাটে।
কঠিন বাধা-লঙ্ঘনে দিব না আমি ফাঁকি॥
দশরথের প্রতি আমার সহানুভুতি রয়েই গেছে।
বরং হয়তো আরো বেড়েছে তাঁর ব্যর্থতার জন্যই।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন -
ভাবতেও আশ্চর্য লাগে, এই কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে সাতকাণ্ড বানিয়ে
কী করে গেলেন তরে কঠিন এ সংসারে বাল্মীকি!
আমি ভাবছি – ওই কাণ্ডজ্ঞানের জন্যই তো সীতাহরণ! ওর জন্যই লংকার যুদ্ধ! পুরো গল্পটাই দাঁড়িয়ে আছে দশরথের অচেতন মনে সুরাসুরের দ্বন্দ্বের উপর। দশরথের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ছাড়া রামায়ণের সূত্র গাঁথা হয় না।
২) Rainer Maria Rilke, Das Stunden-Buch