আজ তোতার আঁকার দিন। সিঁড়ির রেলিং বেয়ে খানিকটা রেপ্টাইল মোশানে উঠে দেড়তলায় ল্যান্ড করল। দেখা হল মানুর সাথে। দোতলার বন্ধ দরজায় সেও পেন্টিং চালাচ্ছে, জল রঙে কতগুলো তাল গাছ আর সুপারি গাছ। ব্যাস, এটুকুই। চোখ বুজে, লেজ ঝেড়ে এতোটাই বেরোল। তারপর বিজয়োল্লাস। চিল্লিয়ে বাড়ি মাত করতে করতে ছুটল, একসময় ভ্যানিস। মানু এ পাড়ার হুলো। কমলালেবুর মতো মুখ। ওর দৌরাত্ম্য হজম করা মুশকিল।
দেড়তলার জানলাটা খোলা। আকাশে লেড পেন্সিলের মতো কুচকুচে কালো মেঘ জমেছে। "জল রঙে একটা লেড পেন্সিল আঁকলে কেমন হয়?" যেমন ভাবা তেমন আঁকা। কালোতে জলেতে তুলি গুলে লেড পেন্সিলের মুখ আঁকা তো হল। মেঘ ফুঁপিয়ে উঠতেই জানলা দিয়ে পাতায় টপ টপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল...পেন্সিলের নিব এক সময় ধুয়ে দাদুর কালো ছাতার চেহারা নিল। তারপর ভ্যাঁ....আর দু ফোঁটা তুড়বুড়ি জল মিশে পেন্সিল এবার পেন্সিলভেনিয়ার ঘন জঙ্গলের চেহারা নিল! "এই যাহ্! আচ্ছা কুছ পরোয়া নহি। হি হি! জঙ্গলের মধ্যিখানে সিনসারাস অ্যান্টিকাস আঁকি।" সিনসারাস অ্যান্টিকাস হল আইস এজের একটা দৈত্য মহিষ।
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।
দাদু স্তোত্র পাঠ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। হাতে একটা মজিলপুরের মাটির পুতুল। সাদা শাড়ি পরা দুর্গার মূর্তি, যার কোলে বালক গণেশ। দাদু কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলেন, "কি দিদিভাই, কাল কুমোরপাড়ায় যাবে নাকি?" তোতা এক্কেবারে দ্বিগুণ উৎসাহে, "আজই চলো।" দাদু তোতার কপালে হাত ছুঁয়ে বললেন, "জ্বর যে এখনও খানিক … আজ থাক বরং। কাল হবে, প্রমিস।" দেওয়ালে সত্যজিৎ রায়ের মস্ত বড় স্কেচ, কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। তার ডান পাশ থেকে একটা টিকটিকিও দাদুর পক্ষ নিল। ২-১ গোলে হেরে অগত্যা তোতা মাথা নাড়ল। চোখটা ঝাপসা লাগছে, হাতে পায়ে জোর কমে আসছে। দাদুর হাত ধরে আস্তে আস্তে একতলায় নেমে এসে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
তারপর দুদিন ধুম জ্বরে তোতা বিছানায়। আজ একটু সুস্থ বোধ করতেই আবদার, "দাদু চলো।" দাদু হেসে ঘাড় নাড়লেন, "বিকেলে।" তোতা এখন তার দাদুর বাড়ি, উত্তরপাড়ায়। দুদিনের ছুটিতে এসে জ্বরে পড়েছে। এই জ্বরটা গত এক মাস হল প্রায়ই আসছে। এদিকে দিম্মার মাথায় হাত, একে নাতনির জ্বর আর ওদিকে বাড়ির আড়াই ইঞ্চির গণেশ জননী হঠাৎ ভ্যানিস। দাদুও ঠাহর করতে পারছেন না। বুক শেলফেই রাখা থাকে। রবীন্দ্র রচনাবলীর দশম আর নবম খণ্ডের ঠিক সামনে। "গেল কোথায়?"
বিকেলে দাদু আর নাতনি একটা টোটোয় চেপে কুমোরপাড়ায় গিয়ে ঠাকুর গড়া দেখল, নিরস্ত্র দুর্গা, ত্রিপলে ঢাকা। দাদু ওখান থেকে বেরিয়ে একটা গলি ধরল। অনেকক্ষণ এ গলি সে গলি ঘুরতে ঘুরতে একটা বড়ো রাস্তা এলো। তারপর শর্টকাট নিতে একটা মাঠ। ওটা পেরোলেই নাকি সাহেব জ্যেঠুর বাড়ি। ওখানেই দাদুর বাড়ির দুর্গা প্রতিমা তৈরি হচ্ছে। লতায় পাতায় মোড়ানো একটা পাল্লা বোজা গুমটি দোকান, বন্ধ হবার মুখে। সেখান থেকে দাদু কতগুলো লজেন্স, বাদামের প্যাকেট আর দুটো বাপুজি কেক কিনছেন। তোতা মাঠের দিকে তাকিয়ে। লালচে হলুদ আলো মাঠের গাছগুলোর ওপর সা রে গা মা সেধে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘাসগুলো বাতাসের দোলায় ওয়াল্টজ নাচতে ব্যস্ত। তার মধ্যেই একটা শালিক চ্যাপলিনের ঢঙে 'ননসেন্স সং'-এ নাচছে। এসব দেখে তোতাও তিড়িং বিড়িং লাফাতে লাগল। একটা কাক অনেকক্ষণ ধরে দাদুর কানের কাছে 'কা কা' করেই যাচ্ছে। কী যেন একটা বলতে চাইছে। দাদু ওকে একটা বিস্কুট কিনে খাওয়ালেন। তবু সে থামে না, অস্থির। দাদু একটা দোতলা বাড়ির নীচের রকে এসে বসে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে, কানে কর্ড গুঁজে বসলেন। প্রথমে মোবাইলে Kreisler-এর Hungarian Rondo চালালেন। সেটা থামিয়ে Beethoven-এর Ninth Symphony. সেটাও থামিয়ে বিড়বিড় করে চণ্ডীপাঠ... ক্রমশই তাল কাটছে।
মেঘেরা আলোর মেঝেতে হাত পেতেছে। আলো ঢেকে ইকির মিকির খেলছে। এক সময় আকাশ সব আলো হারিয়ে কাগেয়াপট্টি, কালো স্লেটের গায়ে চকে আঁকা ভরাট মেঘ, আবছা। ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে শাঁখের শব্দ ভেসে আসছে। সাথে একটা ছোট্ট মেয়ের গলায় কবিগুরুর আবৃত্তি, "হারিয়ে গেছি আমি..."। এখানের পেল্লাই পেল্লাই ফ্ল্যাট বাড়িগুলো ফোল্ডিং কার্ড-এর মতো ভাঁজ খাওয়া। তাই দেখে তোতা দাদুকে জিজ্ঞেস করল, "দাদু আমি যা দেখি তুমি তা দেখো? বলো দেখি পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়নের বেলো কোথায় দেখতে পাচ্ছি?" তোতা দাদুর হাতে হাত রাখল, "দাদুউউউ তোমার জ্বর এসেছে! ও দাদু, ওঠো। দাদু? দাদু?" দাদু বেহুঁশ। হাতের মোবাইল ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুতেই অন হচ্ছে না। রাস্তায় একটা মাত্র পোস্টের আলো জ্বলছিল। একজন সাইকেল চেপে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন, মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে। তোতা ছুটে তার কাছে গিয়ে, "কাকু, সাহেব জ্যেঠুর বাড়ি কোথায়? বড়ো ঠাকুর করে, মই চড়ে। বাড়িতে। কুমোরপাড়াতেই।"
ভদ্রলোকের তাড়া ছিলো। সাইকেল না থামিয়েই বলতে বলতে চলে গেলেন, "এটা তো কুমোরপাড়া নয় দিদি। দূর আছে। একটু দাঁড়াও, টোটো আসবে। বোলো দোলতলা কুমোরপাড়া যাব…" শেষের কথাগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আর একই সাথে ভদ্রলোকও অন্ধকারে। শোঁ শোঁ হাওয়া। একটা কান ফাটানো বাজের শব্দ। কতগুলো শেয়াল ভয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। ঝড় শুরু হতেই রাস্তার আলো, বাড়ির আলো দপ করে নিভে গেল। অন্ধকার। ওপর-নিচ, আশপাশ সবটাই ন্যাচারাল ব্ল্যাক। পাশে দাদুই তো, নাকি দাদুর ছায়া? তোতা ভয়ে দাদুকে জড়িয়ে ধরল। "আজ রাত দখল হবে না? কথা বলো দাদু, স্তোত্রগান করো না, দাদু? ও দাদু?" তোতা আর আকাশ অঝোরে কাঁদছে। কেউ থামছে না। ব্যাগ থেকে নিজের রেইন কোট বের করে দাদুর গায়ে জড়িয়ে, দুজনের মাথায় দাদুর ছাতা ধরে বসল। "এতো বাড়ি। আমাদের ঘর কোথায় দাদু? ও দাদু আর ঘুমিও না। আমি কাউক্কে চিনি না। ঘরে যাব। ওঠো না ... ভয় করছে..." বুক পকেট থেকে বাদামের প্যাকেট বের করে দাদুর মুখে দিতেই সে টের পেল, দাদুর ঠোঁটের চারপাশ ভিজে, ফ্যানার মতো কী যেন! মুখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে। প্যাকেট রেখে তোতা ফুঁপিয়ে উঠলো, সারা শরীর কাঁপছে। একটানা বাজের ধমকানি, হাওয়ার দাপট। অসহায় গাছগুলো মাথা মুড়িয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে।
একটা আলো মিটমিট করে বৃষ্টির পর্দা সরিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। তোতার চোখ ঘুমে ঢুলে আসছে। একটা টোটো থেকে একজন নামলেন। সাদা রেইনকোট পরা, খুব লম্বা চওড়া, তিনি তোতাদের দিকেই ছুটে আসছেন। এসেই দুহাত বাড়িয়ে দাদুকে কোলে তুলে নিলেন। "ভয় পেয়ো না, খুকি। আমি ক্ষেমঙ্করী। ওটা আমার টোটো, ওঠো। ঘরে ফিরব, চলো।" ক্ষেমঙ্করীর হেড টর্চের আলো জ্বলে উঠল। অবিকল এক চোখ! দাদু জড়ানো উচ্চারণে গেয়ে উঠলেন, "নয়নত্রিতয়ং যজ্ঞে তথা পাবকতেজসা॥" তোতাও একই সাথে, "ও দাদু মজিলপুরের গণেশ জননী! জ্যান্ত!"
বিছানায় দাদু শুয়ে, জ্বর নেই। পাশে দিম্মা। ডাক্তারবাবু ওষুধ লিখতে লিখতে জানালেন, "মেসোমশাই এখন একদম সুস্থ। No worry. পুজোর তোড়জোড় নিশ্চিন্তে করুন।" দিম্মা ফুলের সাজি থেকে দোলনচাঁপা ফুলগুলো বেছে মালা গাঁথছিলেন। দাদুর দোলনচাঁপার মালা খুব পছন্দ। তোতাকে বললেন, "দ্যাখ্ তোর দাদুর কাণ্ড! কী ভুলো মন! দুদিন দুর্গা মাকে বুক পকেটে রেখে সারা বাড়ি মাথায় করছিলো! কাল যখন ফিরল, প্রায় বেহুঁশ। দরজায় একেবারে আছড়ে পড়ল। কিন্তু ওটাকে বুকে জড়িয়েই ধরে ছিলো! হ্যাঁ রে সেদিন ফিরলি কী করে? কে তোদের পৌঁছে দিয়ে গেল?" তোতা বলল, "গণেশের মা।"
এই পর্যন্ত কুট্টি পড়ে শোনাতেই ঘরে আলো জ্বলে উঠল। পুজোর সময় এদিকে বেশিক্ষণ লোডশেডিং থাকে না। মোচার চপে এক কামড় দিয়ে কুট্টি বলল, এবার বলো কে কোন পার্ট করবে। মুখস্থ চাই। মহালয়া আর মাত্র এক সপ্তাহ। তাতা ক্যাপ্সিকামের চপটা শেষ না করেই হাতে আরেকটা আলুর চপ তুলতে তুলতে বলল, "কুট্টি এটা গল্প নাকি সত্যি ঘটনা?" নাহ্, আবার লোডশেডিং! এই ঘরের পুব আর উত্তর দিকের দেওয়ালে কুট্টির দাদু, দিম্মার ছবি রাখা। সমকোণে। আজ দাদুর ছবিতে বেলফুলের আর দিম্মার ফ্রেমে দোলনচাঁপার মালা পরানো। কুট্টি স্যালাডের প্লেট থেকে একটা শসা তুলে কামড় দিতে দিতে বলল, "ভারতচন্দ্র লিখে গেছেন, সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর। চল চল আর কথা বাড়াস না। পার্টগুলো লিখে নে, মিউজিক রেডি করতে হবে।" কুট্টি ছবির দাদুকে চোখ টিপল। দাদুও! ভাগ্যিস অন্ধকার! দাদু আর দিম্মা এই সুযোগে ফ্রেম পাল্টাপাল্টি করে নিলেন। ব্যাস! নিঃশব্দে মালা বদল হয়ে গেল!