শিশুর জন্মের পর পিতৃদত্ত নামটা তার অস্তিত্বকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। পরে, জীবনের দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে অন্য সব অধিকার যদি চলেও যায়, অন্তত নিজের নামটুকু বলার অধিকার হয়তো সারাজীবন থেকে যায়।
সেই নামটাও যখন মুছে ফেলতে হয়, তখন অস্তিত্বের কতটুকু বাকি থাকে?
খাগের কলম হাতে সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর শুধু দুটো শব্দ লিখল –
রাজার স্ত্রী
ব্যাস, ছাঁটতে ছাঁটতে পরিচয়ের এতটুকুই বাকি আছে। আর ক'দিন বাদে হয়তো এটাও থাকবে না। নতুন রাজা সিংহাসনে বসবে। যদিও সেই রাজাকে বৈধতা দিতে গেলে তাকেই ডেকে নিয়ে যাওয়া হবে, তার শরীরে বইতে থাকা শেষ বিন্দু রক্তের লোভে।
বারান্দা থেকে খসখস শব্দ ভেসে আসছে। সে চমকে উঠে চিঠিটা বালিশের নীচে লুকিয়ে ফেলল।
ঝরা পাতার শব্দ না কারুর পায়ের আওয়াজ?
আজকাল কিছুই ভরসা নেই। ছায়াসঙ্গীর মতো কারা যেন তার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়, তার গতিবিধির ওপর নজর রাখে। তাদের কান টানলে কার মাথা আসবে? প্রধান পুরোহিত আয়, নাকি সেনাপতি হোরেমহেব? আয় বলে মানতে তার কষ্ট হয়। ছোটবেলা থেকে যে দাদুর স্নেহে মানুষ করেছে সে-ই এখন তাকে একরকম গৃহবন্দী করে রাখছে? হবেও বা। জীবনে যা-কিছু সে ধ্রুব বলে, সত্য বলে মনে করেছিল সবই তো এক এক করে ঝরে পড়ে গেছে। শেষ যাকে আপন বলে জানত সেও নয় পর হয়ে গেল।
হাতে একটা ছোট অথচ তীক্ষ্ণ ছুরি লুকিয়ে নিয়ে সে পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর এক ঝটকায় হাল্কা সুতির পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিল। একটু আগে কেউ লুকিয়ে থাকলেও এখন আর নেই। শুধু বারান্দায় রাখা প্রদীপের আলো বাগানের অন্ধকার ঠেলে ঠেলে বিকট সব অবয়ব বানাচ্ছে। যেন কার ছড়িয়ে থাকা কুচকুচে কালো চুলের গোছা মৃদু মৃদু দুলছে। মা-কে যখন ওরা মমি বানানোর জন্য নিয়ে গেছিল তখন পরচুলাটা এভাবেই আয়নার সামনে ছড়িয়ে ছিল। একই সঙ্গে ভৌতিক এবং অসহায়।
অসহ্য!
ওই আলোছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলে চেপে রাখা ভয়ের কথা, ভুলে যাওয়া কথা সব ঢাকনা সরিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। বাগান থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে আকাশের দিকে তাকাল। আজ পূর্ণিমা। থালার মতো বড় রুপোলী চাঁদ সারা আকাশটা আলো করে রেখেছে। স্থির, ভাস্বর, দেখে মনটা শান্ত হয়। এই একই চাঁদ তো আখেতাতেনের আকাশেও উঠত। বাড়ির ছাদের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ত, রুপোর বান ডেকে আনত।
সে অনেকদিন আগের কথা, যখন তার একটা নামও ছিল।
আংখেসেনপা-আতেন
মানে 'যে আতেনের জন্যই বেঁচে আছে'। বাবার দেওয়া নাম। মানেটাও বাবা-ই বুঝিয়ে দিয়েছিল। “আমার নামের মানে কী বাবা? যে আতেন দেবতার সেবা করে সারা জীবন কাটাবে?”
“আতেন কোন বিশেষ দেবতা নন,” বাবা একটু হেসে বলেছিল, “আতেন হল সর্বব্যাপী ঈশ্বরের করুণা, যা প্রত্যেক দেশের সমস্ত প্রাণীর ওপর সমানভাবে ঝরে পড়ে। তুমি যারই সেবা করবে তার মাধ্যমে আতেনেরই সেবা করা হবে।”
আজকাল তার মনে হয় কথাটার একটা গভীর তাৎপর্য ছিল। কিন্তু আখেতাতেনে থাকার সময়ে পুরো ব্যাপারটা সে নিয়ম বলেই মেনে নিয়েছিল। ঈশ্বর এক – আতেন। তাঁর রূপ নেই, মূর্তি নেই। সূর্যের যে আলো ফল, ফুল, ধূপের ওপর এসে পড়ে তা-ই আতেনের নৈবেদ্য। দিনের বেলা যখন আতেন থাকেন তখন পৃথিবী নিরাপদ থাকে। কিন্তু রাত বড় ভয়ংকর সময়। আতেনের অভাবে অশুভ শক্তিরা জেগে ওঠে। ওই আলোছায়ার মতো ভয়াবহ পিশাচের দল উন্মত্ত নাচে মেতে যায়।
দু'হাতে মাথার রগ টিপে ধরল আংখেসেনপা-আতেন। ওঃ না, এখন সে আংখেসেন-আমুন – অর্থাৎ যার জীবন আমুনের। এইবার মানেটা আয় বুঝিয়ে দিয়েছিল। ভেড়ারূপী দেবতা আমুন – যাঁর বউ আছে, ছেলেপুলে আছে। খেতে পরতে না পেলে মানুষের মতো রাগারাগি করেন, আবার চাহিদা মেটালে শান্ত হয়ে যান। বাবা ওই আমুন আর তার পুরোহিতদের দু'চক্ষে দেখতে পারত না। অনুভূতিটা দু'দিকেই এক ছিল তাই প্রায় রাতারাতি ওয়াসেতের চেনা রাজপ্রাসাদ, রাস্তাঘাট, মঠমন্দির পেছনে ফেলে রেখে অনন্ত বালির রাজ্য আখেতাতেনের পথে যাত্রা শুরু হল। মা, ঠাকুমা দু'জনেই চুপ। এই একটা ব্যাপারে আংখেসেনপা-আতেন দু'জনকে একমত হতে দেখেছিল।
সুদূর আখেতাতেন…
চক্রান্ত আর আতংকে ভরা পুরনো রাজধানী ওয়াসেত থেকে বহু দূরে বাবার তৈরি করা নতুন শহর। সেখানে ছিল ঢেউ খেলানো সোনালী বালি, নীলনদ…আর নলখাগড়া আর পদ্মফুল দিয়ে সাজানো তার ভালোবাসার বাড়িটা। বাড়ির উঠোনে, নকল পুকুরের ধারে ছাগল আর হরিণ চরে বেড়াত। দুপুর হলে পানিহেসে আতেনের প্রসাদ নিয়ে আসত। আর সন্ধে নামলে রামোসে তার সুগন্ধির সম্ভার নিয়ে বসত। স্বপ্নের এক মায়ারাজ্য ছিল আখেতাতেন, যেখানে এখন শুধু স্বপ্নের মাধ্যমেই পৌঁছনো যায়।
আর সেই স্বপ্নের মতোই সবাই একদিন আখেতাতেনে মিলিয়ে গেল - মা, বাবা, ঠাকুমা, দিদি মেরিতাতেন…বালির ঢেউয়ের তৃপ্তি নেই। বলির পর বলি নিয়ে চলে। নাকি তার পেছনেও অন্য কারুর হাত ছিল? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়। বাবাও কিছু সন্দেহ করত ঠিকই। নাহলে দুর্গম বালির রাজ্যে নতুন রাজধানীর পত্তন হল কেন? আর কেনই বা তা উঁচু পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল?
নাঃ, স্বপ্নের মধ্যে বাস করে লাভ নেই।
“আখেতাতেন এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ,” তুত মাথা নেড়ে আক্ষেপ করেছিল। “ওরা কিচ্ছু বাঁচিয়ে রাখল না। বহু কষ্টেসৃষ্টে সবার মমিগুলো ওয়াসেতে ফেরত নিয়ে যেতে রাজি করিয়েছি। বাবার মমি তো নিতেই চাইছিল না।”
“নতুন করে কবর দেওয়া হবে?”
“আর কী করা যাবে? ওখানে তো আর ফেলে রেখে আসতে পারব না।”
“না! প্রশ্নই ওঠে না!”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আংখেসেনপা-আতেন ধরা গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
“আমার বাড়িটার কিছু বাকি নেই, না?”
তুত উত্তরে কিছু বলেনি।
মাঝে মাঝে আংখেসেনপা-আতেনের ইচ্ছে করে মা-বাবার কবরে গিয়ে প্রার্থনা করে আসে, কিন্তু ইনেব হেদজে থেকে ওয়াসেতও কত্ত দূরে…
ডানা ঝাপটিয়ে একটা বিশাল প্যাঁচা আকাশে উড়ে গেল। ধূসর তারার পথ বেয়ে। কতদূর যাবে কে জানে? ওসাইরিসের সঙ্গে মৃতদের নৌকো চড়ে ঘুরতে বেরবে হয়তো। একবার তার মনে হল ডাক দেয়।
আমাকেও নিয়ে যাও!
কে বলতে পারে? গেলে হয়তো ওসাইরিসের মৃত্যুর রাজ্যে আবার তুতের সঙ্গেও দেখা হবে। আখেতাতেন থেকে ফেরার পরে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে ওরা বেঁচে ছিল, দুই ভয়ার্ত শিশুর মতো। কী লাজুক ছিল রে বাবা ছেলেটা! বিয়ের রাতে তো দৌড়ে পালিয়েই গেল। আংখেসেনপা-আতেনও ছুটল পেছন পেছন। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল পদ্মফুলের বাগানে লুকিয়ে আছে সে। গিয়ে দেখে সত্যিই তাই। একেই কোলকুঁজো লজ্জায় আরো কুঁজো হয়ে বসে আছে।
“কি রে এখানে লুকিয়ে বসে আছিস কেন? তুই না দেশের রাজা?”
“আমি পারব না, তুমি যাও, আমি পরে আসছি।”
ডাবের মতো মাথাটা নাড়াতে দেখে আংখেসেনপা-আতেনের হাসিই পেয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে গিয়ে তুতের পাশে বসে পড়ল। দু'জনকে ঘিয়ে পদ্মফুলের হাল্কা সুগন্ধ ভেসে বেড়াতে লাগল।
“তোর 'পরে আসছি' আমার জানা আছে। এখনই চল বলছি আমার সঙ্গে!”
তুত ধীরে ধীরে মাথা তুলল। চাঁদের আবছায়া আলোতেও দেশ বোঝা যাচ্ছে তার কান দুটো টকটকে লাল।
“এর থেকে যুদ্ধে যাওয়া অনেক ভালো।”
“কেন রে? আমার সঙ্গে থাকতে এত বাজে লাগে?”
তুত কিছুক্ষণ গোঁজ মুখে বসে রইল। তারপর আংখেসেনপা-আতেনের কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলেছিল,
“যদি আমি কিছু না পারি?”
আংখেসেনপা-আতেন হেসে ফেলেছিল।
“আমি বলছি, তুই পারবি। আর তোর নয় প্রথম বিয়ে, আমার তো আগেও হয়েছে। সেরকম হলে আমি তোকে শিখিয়ে দেব।”
হাতের মধ্যে ধরা ঠান্ডা হাত দুটো যেন একটু শিথিল হল।
“তুমি হাসবে না তো?”
“একদম হাসব না। আতেনের দিব্যি।”
পুরোহিতদের চাপে পড়ে দু'জনে আমুনকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু নিভৃতে, পদ্মবনে প্রতিজ্ঞা করার সময়ে আতেনের নামই মুখে আসত। আতেন ছাড়া যে কোন ঈশ্বর নেই, আর কাউকে বাবা কোনদিন স্বীকার করেনি। পুরোহিতেরা আংখেসেনপা-আতেনের ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়েছে, ধর্ম কেড়ে নিয়েছে, এমনকি নামটাও কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তার মনের মধ্যে বসানো বাবার শিক্ষা কোনদিন কেড়ে নিতে পারেনি।
চোখ ঘুমে ঢুলে আসছে। আংখেসেনপা-আতেন ঘরে ফিরে এল। পাত্রে রাখা ঠান্ডা জল চোখে মুখে ছিটিয়ে নিল। যত রাতই হোক, আজ তার ঘু্মোলে চলবে না। প্রাসাদের মধ্যে আজও যারা তার প্রতি বিশ্বস্ত তাদের একজন আসবে চিঠি নিয়ে যেতে। তার অপেক্ষায় জেগে থাকতে হবে।
বালিশের তলা থেকে চিঠিটা বের করে আংখেসেনপা-আতেন একবার চোখ বুলিয়ে নিল।
আমার স্বামী মারা গেছেন। কোন ছেলে নেই। লোকের মুখে শুনেছি আপনার অনেক ছেলে আছে। তাদের একজনকে দিন, আমি তাকে বিয়ে করব। আমার প্রজাদের কাউকে বিয়ে করতে আমি অনিচ্ছুক…বড় ভয়ে ভয়ে আছি।
রাজার স্ত্রী
আংখেসেনপা-আতেন গালে হাত দিয়ে ভাবে, চিঠিটা পেয়ে রাজা সুপ্পিলুলিউমা কী মনে করবেন? সম্ভবত ভাববেন কোন চক্রান্ত। যে দেশের রাজকন্যাদের পর্যন্ত বিয়ে দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয় না, সে দেশের রানী একজন বিদেশীকে বিয়ে করে নিজের রাজত্ব দিয়ে দেবে? কথাটা তার নিজের কানেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
তবু, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ যে কোন উপায় ধরে বাঁচার পথ খোঁজে। যদি সন্দেহ করেও রাজা একজন ছেলেকে পাঠান। অন্তত সেই আশাটুকু থাক। আখেন-আতেনের রক্তকে পণ্য করে রাজনীতির এই খেলাটা যদি ভেস্তে দেওয়া যায়।
দরজার ওপারে কার ছায়া পড়ল। আংখেসেনপা-আতেন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
“কে আছে ওখানে?”
“আজ্ঞে আমি, আহমোসে।”
আহমোসে…তুতের বিশ্বস্ত অঙ্গরক্ষক আহমোসে…
“ভেতরে এস।”
বলেই আংখেসেনপা-আতেন ঘরের প্রদীপ নিভিয়ে দিল। ভাবুক, অদৃশ্য গুপ্তচরেরা রানীকে চরিত্রহীন ভাবুক। সত্যিটা জানার চেয়ে বরং ভালোই।
চিঠিটা একটা সুতোয় বেঁধে সে আহমোসের হাতে দিয়ে দিল।
“রাজা সুপ্পিলুলিউমাকে চিঠিটা দিয়েই ফিরে আসবে। উত্তরের জন্য অপেক্ষা করবে না। পথে অনেক গুপ্তচর তোমার পেছনে লেগে থাকবে। তাদের হাত এড়িয়ে সাবধানে যেয়ো। আতেন তোমার মঙ্গল করুন।”
আহমোসে অবাক চোখে রানীর দিকে তাকাল।
“উত্তর না নিয়েই চলে আসব?”
আংখেসেনপা-আতেন দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। যাকে সে কোনদিন দেখেনি সেই বিদেশী রাজার কাছে হাস্যস্পদ হওয়া এক কথা আর নিজের প্রজার সামনে হাস্যস্পদ হওয়া অন্য কথা। গৃহবন্দী অবস্থাতেও আখেন-আতেনের মেয়ে নিজেকে ছোট করতে পারবে না।
“মহারানী,” আহমোসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে দেখে আংখেসেনপা-আতেন কয়েক পা এগিয়ে এল।
“যা বলবে নির্ভয়ে বল।”
“বলছিলাম, কানাঘুষো শুনছি নাকি প্রধান পুরোহিত আয় রাজা হবেন বলে প্রস্তুতি শুরু করেছেন। চিঠির জবাব যদি সময়মতো না আসে?”
আংখেসেনপা-আতেনের হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস যেন শেষ রাতের তুঁতে রঙের আকাশে ছড়িয়ে গেল। ঈষৎ হেসে রানী বলল,
“সে ক্ষেত্রে আমার যা দায়িত্ব তা আমাকে পালন করতেই হবে। আয়ের বংশকে স্বীকৃতি দিতে হবে।”
তারপর…অবসর তো কত ভাবেই এসে পড়ে।
আহমোসে চিঠি নিয়ে ছায়ার মতো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আংখেসেনপা-আতেন ক্লান্ত পায়ে ঘরের দিকে রওনা দিল।
রাত প্রায় শেষ। চাঁদ কখন অস্তাচলে গেছে। একে একে মুছে যাচ্ছে তারারাও।