• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬ | জুন ১৯৯৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • MAD-এর পাগলামি : রোহন ওবেরয়
    translated from English to Bengali by সম্বিৎ বসু

    MAD-এর কথা মনে আছে? না থাকলে মনে করিয়ে দিই: “Mutually Assured Destruction”- পারস্পরিক প্রতিশ্রুত-ধ্বংস। ঠান্ডা যুদ্ধের (cold war) সময়ে পৃথিবীর অস্তিস্ত্ব আর পারমাণবিক সর্বনাশের মধ্যে ব্যবধান ছিল শুধু এই কটা আদ্যক্ষরের।

    পেন্টাগন আর ক্রেমলিন সারা পৃথিবীর আপাদমস্তক গুঁড়িয়ে অমৃতলোকে পাঠাবার মত যথেষ্ট পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করলেও বাকি বিশ্বকে স্তোক দিয়ে এসেছে যে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। MAD-এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা জেনেও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার মতন বোকা কেউ নয়- ভাবটা এমন।

    অবস্থাটা খুব স্বস্তিকর নয়। এবং একটা প্রজন্ম এই পারমাণবিক অস্ত্রের ছায়ায়, পারমাণবিক যুদ্ধোত্তর তুষার-যুগের কথা পড়ে আর কফি হাউস-টাউসে নিজেদের মধ্যে MAD যে সত্যিই কতটা কার্যকর সে সম্বন্ধে আলোচনা করতে করতে বড় হল।

    “Dr. Strangelove or How I Learned to Stop Worrying and Love the Bomb”, ছবিতে এই অস্বস্তিকর অবস্থা চমৎকার ধরা পড়েছে। এ ছবির শেষ দৃশ্যে দেখানো হয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কূটনীতিকদের মরণপণ শেষ চেষ্টা ব্যর্থ করে এক নিঃসঙ্গ বোমারুর হঠকারিতা সারা পৃথিবীকে MAD-এর আওতায় এনে পারমাণবিক ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে দিচ্ছে।

    ১৯৯৪ সালে, যখন এটা পরিষ্কার যে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, পেন্টাগন Nuclear Posture Review (NPR) বা পারমাণবিক অবস্থানের পুনর্বিবেচনা নামে একটা নথি প্রকাশ করে। কৌতূহল- জাগানো এই শান্তি-সংকল্পে ঘোষণা করা হয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অনির্দিষ্টকালীনভাবে অন্তত ৩৫০০ পারমাণবিক অস্ত্র জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে রাখতে হবে। অস্ত্রগুলো এখন যত জায়গার দিকে তাক্‌ করা আছে, তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

    NPR সংক্রান্ত এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রতিরক্ষা বিভাগের সহ-সচিব বলেন যে পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের “সংকোচন এখন খুব বিচক্ষণতার কাজ হবে না।” (“It would not be prudent now to commit to a reduction.”)

    পারমাণবিক অস্ত্র প্রথম ব্যবহারের উপর আগ বাড়িয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি নিজেদের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (এবং চীন বাদে অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিগুলো) মনে করে না। গণহত্যার অস্ত্র থাকতেও তা যদি প্রথমে ব্যবহারই করা না গেল তো সে অস্ত্র রাখার মানে কী?

    ১৯৭৮ সালে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্র প্রথমে ব্যবহার করবে না বলে ঘোষণা করে। ১৯৯২ সালে নবগঠিত রাশিয়া সেই ঘোষণা প্রত্যাহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউ.কে., এবং ফ্রান্সের মত নীতিই গ্রহণ করে (যে পারমাণবিক প্ররোচনা ছাড়াও সামরিক প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পথ তাদের সামনে খোলা থাকবে) ইউ.কে.-র প্রতিরক্ষা সচিব ম্যালকম রিফকিন্ড (Malcom Rifkind) ১৯৯৩ সালে হাউস অফ্‌ কমন্‌স্‌-এ বলেন যে প্রথম-ব্যাবহার নিষিদ্ধ করার নীতিগ্রহণ করলে, তা ‘পিছু হটা’ (“retrograde”) হবে।

    অর্থাৎ শেষ অব্দি এ সবের মানে দাঁড়াচ্ছে যে, চীন বাদে বাকি সব পারমাণবিক শক্তিগুলোর কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকছে। পারমাণবিক-নিবৃত্তি (nuclear- deterrent) তাদের নীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীর স্বঘোষিত হাবিলদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাচক্রেও- পেন্টাগনে, কংগ্রেসে, হোয়াইট হাউসে- পারমাণবিক অস্ত্রবিসর্জনের প্রতি এমনকি নৈতিক সমর্থনও বিন্দুমাত্র নেই।

    ঢাকঢোল পিটিয়ে যাকে “নিরস্ত্রীকরণ” বলা হচ্ছে- যেমন ১৯৯৫ সালে নিবৃদ্ধি চুক্তি (Non-Proliferation Treaty)-র পঁচিশবছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অ্যাল গোরের ভাষণ- তা আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের অবিশ্বাস্য সংখ্যা কমিয়ে ৩৫০০ থেকে ৫০০০ অস্ত্রের সুসম একটা সংগ্রহের জায়গায় আসার সমঝোতা। পারমাণবিক অবস্থানে পুনর্বিবেচনা নথি (NPR) অনুযায়ী এতগুলো অস্ত্র পেন্টাগন “অনির্দিষ্টকালের জন্যে” রাখতে চায়।

    (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া তাদের নিজেদের কাছে ২০০০, ৩৫০০, ৫০০০ বা ১০০,০০০ পারমাণবিক অস্ত্র রাখল, তাতে আদতে তফাত কিছু এসে যায় না। কারণ দুই পক্ষ প্রত্যেকে প্রথম ১০০০টা অস্ত্র ব্যবহার করে ফেলার পর বাকি অস্ত্র ধ্বংসস্তূপে ধূলোর আস্তরণে হিল্লোল তোলা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করতে পারবে না)।

    এসব সত্ত্বেও অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় যুক্ত কূটনীতিকদের গালভরা বুলির কোন শেষ নেই, (যেমন ১৯৯৬ সালে সর্বব্যাপী পরীক্ষা নিষেধিকরণ চুক্তি- Comprehensive Test Ban Treaty বা CTBT-তে বলা হয়েছে)- “…. The need for continued systematic and progressive efforts to reduce nuclear weapons globally, with the ultimate goal of eliminating those weapons, and of general and complete disarmament under strict and effective international control…”.

    এর একটা বড় কারণ আছে। নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার জিইয়ে রাখলেও অন্য কোন দেশ সেসব অস্ত্র সংগ্রহ করে ফেললে পারমাণবিক শক্তিগুলো বেশ উদ্বিগ্ন অয়ে পড়ে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ নিজেদের অস্ত্র রাখার ব্যাপারে বেশ দৃঢ়চিত্ত হলেও, এরা যাকে ‘পারমাণবিক (অনিয়ন্ত্রিত) সংখ্যাবৃদ্ধি’ (nuclear Proliferation) বলছে সে সম্বন্ধে খুবই খুঁতখুঁতে। (মজার ব্যাপার হল, গত তিরিশ বছরে মার্কিন ও সোভিয়েট অস্ত্রের সংখ্যাবৃদ্ধি “পারমাণবিক সংখ্যাবৃদ্ধি” হিসেবে গণ্য হয় না।)

    আশপাশে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা যত বাড়বে, সর্বনাশী ধ্বংসের আশঙ্কায় আমাদের উৎকন্ঠাও ততই বাড়তে থাকবে। এ তো একরকম স্বতঃসিদ্ধ। যত বেশি সংখ্যক দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে, তাদের কেউ যে সেটা ব্যবহার করে ফেলবে- এ সম্ভাবনাও তেমনই বেশি। এ ব্যাপারে মার্কিন কর্তৃপক্ষের যুক্তি একেবারে ঠিক।

    কিন্তু এই যুক্তির বিরুদ্ধে প্রশ্নও তুলতেই হয় যে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশগুলোর জনগণ ও সরকার পারমাণবিক ধ্বংসের ভয় তুলে নিরাপত্তা ও গর্বের কারণে যদি অস্ত্রভাণ্ডার টিকিয়েই রাখতে চান, তাহলে সেই একই যুক্তিতে অন্য দেশের জনগণ ও সরকারই বা তা পারবে না কেন?

    শোনা যায়, উপসাগরীয় যুদ্ধ থেকে কী শিক্ষা লাভ করা গেল এ প্রশ্নের জবাবে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান ভলেছিলেন, “পরমাণু অস্ত্র ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লাগতে যেও না” (“Never fight the Us without nuclear weapons.”)। কিংবা চীনের সম্বন্ধেও বোধহয় একই কথা বলা যায়।

    ভারত এবং পাকিস্তান পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর পর ইরাক সরকার তাদের সমর্থন জানিয়ে বার্তা পাঠায় এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার জন্যে সমস্ত আরব দেশকে পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করার পরামর্শ দেয়। একথা কি বলার অপেক্ষা রাখে যে সুযোগ পেলেই, ভারতের মতনই, ইরাকও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পারমাণবিক সঙ্ঘে ঢুকে পড়বে?

    পারমাণবিক নিবৃত্তির ব্যাপারে পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশগুলো গাছের খেতে চাইছে ও তলারও কুড়োতে চাইছে। অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলো (NPT ও CTBT) বাস্তবায়িত করতে তাদের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার সঙ্গে বহুপাক্ষিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (Multilateral Disarmament Treaties)-র নাগাল থেকে তাদের প্রাণপণে পালিয়ে যাবার চেষ্টার তুলনা করলে, এ ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায়।

    ১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়া জাতিসঙ্ঘের প্রথম কমিটিতে একটি প্রস্তাব আনে। প্রস্তাবে নির্বৃদ্ধি চুক্তি (NPT) স্বাক্ষরকারী সমস্ত দেশকে ১৯৯৭ সালে “পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়ন, উৎপাদন,… সঞ্চয়ন, আদান-প্রদান বন্ধ; তা ব্যবহারের ভীতিপ্রদর্শন এবং পারমাণবিক অস্ত্রের বিনাশসাধন”-এর (“prohibiting the development, production… Stockpiling, transfer, thereat or use of nuclear weapons, and providing for their elimination”) লক্ষ্যে বহুপাক্ষিক আলোচনা শুরু করে চুক্তির শর্ত মানতে বলা হয়।

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্স সকলেই প্রস্তাবের সমালোচনা করে। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শুধু ভোট দিয়েই ক্ষান্তি নেই, কূটনীতির ভাষায় যতরকম খারাপ শব্দ আছে, তার সবই প্রায় প্রস্তাবের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। রাশিয়া একে “বেঠিক ও অসম্পূর্ণ”-র (“inaccurate and incomplete”) সঙ্গে “বাছাইকর ও রাজনীতিকৃত” (“selective and politicized”) বলে আখ্যা দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলে যে এই প্রস্তাব NPT-র ষষ্ঠ অনুচ্ছেদের “বিকৃতি” (“distortion”), ফ্রান্স জানায় প্রস্তাবটি “উদ্দেশ্যপূর্ণ ও সন্দেহজনক” (“tendentions and questionable”) আর ইউ.কে একে বিশ্ব আদালতের “রাজনীতিকরণ” (“polticisation”) বলে অভিহিত করে।

    একমাত্র চীন প্রস্তাবকে সমর্থন করে বলে “পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত চৈনিক অবস্থানের সঙ্গে প্রস্তাবটি সঙ্গতিপূর্ণ” (“the thrust is basically consistent with China’s position on nuclear disarmament”)।

    অর্থাৎ মুশকিল হল, পাঁচের মধ্যে চারটে পরমাণু-শক্তিই তাদের অস্ত্র বিসর্জন দিতে আগ্রহী নয়। নিজেদের পারমাণবিক নিরাপত্তা বজায় রেখে যতদূর নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব, তা অবশ্য তারা করতে রাজি। ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এই গাছের খাওয়া-আর-তলার কুড়োনো নীতিও পরিষ্কার হয়ে গেছে। ওয়াশিংটনের বেলায় আঁটিশুঁটি করে নতুন দিল্লীকে দাঁতকপাটি দেখানোর শূন্যতা উপলব্ধি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট চমকিত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে।

    নতুন বিস্ফোরণে যে সত্যিটা দিনের আলোর মতন পরিষ্কার হয়ে গেছে, ক্লিন্টন সরকার তাকে এখন যেন-তেন-প্রকারে ধামাচাপা দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এই সত্যিটা মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতন দেশগুলো গেল কয়েকবছর ধরে বলে আসছে: সত্যিকারের নিরস্ত্রীকরণ ছাড়া কোনরকম অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।

    আমাদের সামনে এখন দুটো পথ খোলা; এক, হয় এখনই আর নয়তো পারমাণবিক শক্তিধারী দেশের সংখ্যা কিছু বেড়ে যাবার পরে এরা সবাই নিজেদের দু-নৌকোয় পা-রাখা নীতির অসারতা স্বীকার করে নিয়ে বহুপাক্ষিক ও সময়-নির্দিষ্ট নিরস্ত্রীকরণের জন্যে আলোচনায় যোগ দিল। দুই, তারা সাব্যস্ত করল যে অস্ত্রের সংখ্যা যতোই বৃদ্ধি পাক, তারা পরমাণু-অস্ত্রবিহীন পৃথিবীতে পরমাণু-অস্ত্রহীন হয়ে থাকার চেয়ে পরমাণু-অস্ত্রবহুল পৃথিবীতে তেমন অস্ত্র নিয়েই বেশি নিরাপদ।

    আর তাদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যতের বেঁচে থাকা নিরাপদে না অস্ত্রের আতংকে।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments