গত এপ্রিল মাসের ৯ - ১১ তারিখে শিকাগো শহরের জগদ্বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অফ্ শিকাগোতে আধুনিক গণতন্ত্র বিষয়ক এক বিরাট আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়। ১০ তারিখের আলোচনাসভার মূল আকর্ষণ ছিল “অর্থনীতি ও আধুনিক গণতন্ত্র” সংক্রান্ত একটি বিতর্ক। অংশগ্রহণকারী ছিলেন অর্থনীতির দুই দিকপাল, গ্যারি বেকর এবং অমর্ত্য সেন। শিক্ষিত বাঙালির কাছে অমর্ত্য সেনের পরিচয় দেওয়াই বাহুল্য। গত এক দশক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে “ল্যামন্ট্ ইউনিভার্সিটি প্রফেসর”-এর পদ অলংকৃত করার পর তিনি কিছুদিন আগে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে “মাস্টার অফ ট্রিনিটি কলেজ” পদে যোগদান করেছেন। সেনের দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত গবেষণা অর্থনৈতিক চিন্তাধারার এক নতুন দিক উন্মোচন করেছিল। বর্তমান অর্থনীতিতে Neo-Classicism বিরোধী যে চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে সেন তার অন্যতম পথিকৃৎ। অন্য দিকে নোবেল বিজয়ী গ্যারি বেকর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিখ্যাত অর্থনীতি বিভাগের অন্যতম। Neo-Classicism-এর কট্টর সমর্থক। Neo-Classicism সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনায় আমরা ফিরে আসব গ্যারি বেকরের বক্তব্য আলোচনা করার সময়।
এই দুই দিকপালের সম্মুখসমর চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতা যে বড় প্রাপ্তি তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সভাগৃহের ভিড় সামলাতে আয়োজকরা গলদঘর্ম হয়ে উঠেছিলেন। ভিড়ের মধ্যে বর্তমান লেখিকার মতো অনেকেই ছিলেন যাঁরা হাজার খানেক মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছিলেন শুধুই এই এক ঘন্টার আলোচনা দেখতে ও শুনতে। কিন্তু ওই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যেই আলোচনাটি আশানুরূপ জমে উঠতে পারল না। দুই বক্তার জন্যে মাথাপিছু মাত্র কুড়ি মিনিট বরাদ্দ ছিল এবং প্রত্যুত্তরের ও প্রশ্নোত্তরের জন্যে আরো কুড়ি মিনিট। বাক্যুদ্ধ যখন সবেমাত্র কিছুটা উগ্র হয়ে উঠেছিল এবং দুই প্রতিপক্ষ কিছুটা গরম হয়ে উঠছিলেন, তখনি সময়শেষের ঘন্টা পড়ে গেল।
গ্যারি বেকর তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই বিনীতভাবে জানালেন যে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর অর্থনীতি সংক্রান্ত বিরোধ সামান্য, লোকমুখে যা শোনা যায় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জিত। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে Neo-Classical চিন্তাধারা অভ্রান্ত এবং সেই চিন্তাধারা যে পন্থা নির্দেশ করে তা সব গণতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যখনই সরকার কিংবা জনগণ সেই পন্থা ত্যাগ করে অন্য রাস্তা ধরে তখনই বিভ্রাট দেখা দেয়।
অর্থনীতি তত্ত্বের মূলে যে বিশ্বাসটি কার্যকর তা হচ্ছে মানুষের চাহিদা অন্তহীন এবং সেই তুলনায় মানুষের এবং পৃথিবীর সম্পদ সীমিত। অতএব সীমিত সম্পদ নিয়ে এই অন্তহীন চাহিদা যথাসাধ্য মেটানোর সহজতম উপায়টি কী - এই নিয়েই অর্থনীতির যত বিতর্ক। Neo-Classical অর্থনৈতিক চিন্তাধারা মূলত দুটি বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে- এক, মানুষ স্বার্থসচেতন (man is selfish) এবং দুই, মানুষ যুক্তিবোধসম্পন্ন (man is rational)। সীমিত উপায়ের মধ্যেও কীভাবে যথাসাধ্য সুখস্বাচ্ছন্দ্য আহরণ করা যায়- এই চিন্তাই মানুষের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে। Neo-Classical অর্থনীতিবিদরা তাই এটা ধরেই নেন যে মানুষের যে কোন আচরণই একটি যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ- কোন কাজটি করলে তার সবচেয়ে বেশি লাভ হবে। সুতরাং তাঁদের মতে মানুষের ব্যবহারে পরিবর্তন আনার সহজতম উপায় হল পুরস্কার ও তিরস্কার পদ্ধতি বা সহজ বাংলায় সামনের লাঠির আগায় মুলো বাঁধা এবং সঙ্গে সঙ্গে পিছনেও একটি লাঠির ব্যবস্থাও রাখা। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেরই এটা মাথায় রাখা উচিত বলে বেকার তাঁর মত দেন।
পুরো ব্যাপারটা সহজে বোঝানোর জন্য বেকর দুটি উদাহরণ দেন। প্রথমটি হল মানুষের অপরাধপ্রবণতা সংক্রান্ত। বেকরের মতে অপরাধ প্রবণতা কমানোর সহজতম উপায় হল কড়া দণ্ডনীতি বলবৎ করা। ১৯৬০-এর দশকে সমাজ সংস্কারকেরা ধুয়ো তুলেছিলেন যে অপরাধীদের মানসিকতা সাধারণ মানুষদের থেকে একটু পৃথক। তারা অর্বাচীন ও অবিবেচক- অপরাধ করার সময় দণ্ডের গুরুত্ব বিচার করতে পারে না। অতএব তাদের শাস্তি দিয়ে কোনো লাভ নেই, বরং মিষ্টি কথায় বোঝানো ও শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করা ভালো। সমাজসংস্কারকদের কথায় সত্তরের দশকের শুরুতে মার্কিন সরকার দণ্ডনীতি শিথিল করে পুনর্বাসনে বেশি লক্ষ্য দেন। ফলে দেশে দুষ্কৃতির সংখ্যা হু-হু করে বেড়ে চলল। অবশেষে সত্তরের দশকের শেষে তিতিবিরক্ত জনসাধারণের প্রবল চাপে সরকার পুনরায় কড়া আইন এবং দণ্ডনীতির প্রয়োগ শুরু করলেন, দুষ্কৃতির পরিসংখ্যানও দ্রুত পড়তে শুরু করল।
বেকরের দ্বিতীয় উদাহরণটি ছিল উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত। তরুণ-তরুণীদের কীভাবে উচ্চশিক্ষা (অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষা) লাভে উৎসাহিত করা যায় এই নিয়ে বহু তর্কবিতর্ক হয়েছে। বেকরের মতে এটা করার সহজতম উপায় অল্পশিক্ষিতদের তুলনায় উচ্চশিক্ষিতদের রোজকার তুলনামূলকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া। ৮০-র দশকে এইরকম বৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে কলেজ-খরচার বৃদ্ধি সত্ত্বেও কলেজ স্তরে পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কোনরকম সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি।
Neo-Classical অর্থনীতিবিদদের পবিত্রতম মন্ত্র বেসরকারিকরণের উপর জোর দিয়ে বেকর তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। বললেন যে ব্যক্তিগত মুনাফার প্রয়োজনে মানুষের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকে যে দক্ষতা পাওয়া যায় সেরকম সুফল সরকার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে পাওয়া সম্ভব নয়। তার কারণ সরকারি পন্থা নির্দেশিত হয় বিশেষ রাজনৈতিক দলের স্বার্থ অনুসারে, সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্যে নয়। ভোটদাতারাও উদাসীন, ভোট দেওয়ার আগে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করেন না। ফলে বহু অযোগ্য প্রার্থী জয়ী হন এবং সুযোগ পেলেই তাঁরা ভুল পন্থা উপস্থাপন করেন। অতএব অর্থনীতিতে সরকারের অত্যাধিক হস্তক্ষেপে অনর্থ ঘটবার সম্ভাবনাই বেশি।
অর্মত্য সেনও তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন এই জানিয়ে যে বেকরের সঙ্গে তাঁর বিরোধ মোটেই মাত্রাতিরিক্ত কিছু নয়। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এটাও বিনীতভাবে জানিয়ে দিলেন যে সভাগৃহে ঢোকার সময় তাঁর এক ভক্ত তাঁকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন বেকরকে “এক হাত” নেওয়ার এবং তা পালন করতে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ।
সেন শুরু করলেন Neo-Classical অর্থনীতির মূল বিশ্বাসগুলিকে প্রশ্ন করে। তাঁর মতে এই ধারণাগুলিতেই Neo-Classical অর্থনীতির ভ্রান্তির কারণ লুকিয়ে আছে। সুতরাং সেই অর্থনীতিরই রাজনৈতিক বা সামাজিক পথনির্দেশের চেষ্টা, তাঁর মতে, অনেকটা আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ের স্বপ্নের সঙ্গে তুলনীয়। আলেকজান্ডার ম্যাসিডোনিয়াতে নিজের ভিত একটু দৃঢ় করেই ভেবেছিলেন এবার পৃথিবীটা জয় করে নিলেই হলো। দুঃখের বিষয়, জয়যাত্রা শুরু করার পরেই বুঝলেন যে একই পদ্ধতিতে সারা পৃথিবীকে পদানত করা অসম্ভব কারণ ম্যাসিডোনিয়াতেই তাঁর ক্ষমতার ভিত ইতিমধ্যে টলমল করছে। প্রসঙ্গত সেন জানালেন যে নয়াদিল্লীর স্কুল অফ্ ইকনমিক্স-এ এই উপমাটি তিনি ব্যবহার করায় জনৈক ছাত্র তীব্র আপত্তি প্রকাশ করে। অবশ্য ছাত্রটির উষ্মার কারণ Neo-Classicism-এর প্রতি সেনের বক্রোক্তি নয়, তা হলো ম্যাসিডোনিয়ার মতো অনুর্বর, অতি ফালতু দেশকে অর্থনীতির মতো বৃহৎ বিষয়ের সঙ্গে তুলনার জন্যে!
Neo-Classical অর্থনীতির কয়েকটি মৌলিক ভ্রান্তির (তাঁর মতে) উদাহরণ সেন দেন- যেমন লক্ষ্যটিকেই সর্বস্ব করে পথ বা উপায়কে কোন গুরুত্ব না দেওয়া। (পরিষ্কার করে বোঝার প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষার প্রচার সংক্রান্ত বেকরের উদাহরণটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে। উচ্চশিক্ষার বিস্তারের একটি উপায় অল্পশিক্ষিতদের উপার্জন না বাড়িয়ে তুলনামূলকভাবে উচ্চশিক্ষিতদের উপার্জন বাড়ানো। আবার এই একই ফল লাভ করা যাবে যদি উচ্চশিক্ষিতদের উপার্জন এক রেখে অল্পশিক্ষিতদের উপার্জন কমিয়ে দেওয়া যায়। দুই ক্ষেত্রেই একই ফল দেখা যাবে- উচ্চশিক্ষার জন্য হঠাৎ কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। কিন্তু একথা কি অস্বীকার করা যায় যে দুটি পথের নৈতিক বিচারে পার্থক্য প্রচুর? লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে অল্পশিক্ষিত জনসাধারণকে যে কষ্ট পোহাতে হবে তা দুটি উপায়ের ক্ষেত্রে মোটেই এক হবে না।) সেনের মতে তাই আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির যেখানে যে কোন প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ লাভক্ষতি বিচার করা সম্ভব। সেই বিচারে শুধু লক্ষ্যটিই গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা অর্জন করার যে উপায় সেটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের উপর তার প্রভাব কী হতে পারে তা সমান গুরুত্বে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সেনের দ্বিতীয় আপত্তি Neo-Classicist-দের যুক্তিবাদীতা এবং স্বার্থপরতার অনুমান নিয়ে। তাঁর মতে বাস্তবে এটা দেখা যায় সে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে স্বার্থেরও সংজ্ঞা বদলায়। এ প্রসঙ্গে সেন তাঁর প্রিয় একটি উদাহরণ তুলে ধরেন। গ্রামবাংলার নারীকুলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে আত্মসচেতনতা বলে কিছু নেই। পুরোটাই সংসারের কর্মস্রোতে তলিয়ে গেছে। কিন্তু এটাও দেখা গেছে যে তাঁদের উপার্জনের সুযোগ হলেই এই আত্মসচেতনতা (“স্বার্থসচেতনতা” বললে ঠিক বলা হবে) বেড়েছে। একই সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে তাদের প্রসারের হার। তাই, Neo-Classical অর্থনীতিবিদদের প্রধান একটি বিশ্বাসেই (যে মানুষ সবসময় নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করে) সেনের আস্থা নেই। তিনি মনে করেন Neo-Classical অর্থনীতিবিদদের আরো নজর দেওয়া উচিত কীভাবে আত্মচিন্তা ও আত্মসুখের সচেতনতা মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে তার উপর।
সবশেষে সেন ভোটারদের ঔদাসীন্য তথা সরকারের নিষ্প্রয়োজনিয়তার ধারণাটি সম্বন্ধেও প্রবল আপত্তি জানালেন। মানুষ কিছুটা স্বার্থকেন্দ্রিক বটে, তবে তাদের মধ্যে একটি বৃহত্তর সমাজ সচেতনতাও কাজ করে। এ্রর উৎকৃষ্টতম উদাহরণ- গণতান্ত্রিক দেশে সচরাচর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় না। যে কোন দুর্ভিক্ষেই একটি দেশের শতকরা দশ থেকে পনেরোভাগ জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হন। তা সত্ত্বেও যে সরকারের শাসনকালে দুর্ভিক্ষ ঘটে অনতিবিলম্বেই তার পতন ঘটে। অর্থাৎ, বাকি নব্বই ভাগ জনসাধারণ যাঁরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হননি, তাঁরা চুপ করে থাকেন না। সেনের মতে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বন্ধন যতই দৃঢ় হয়, এই সমাজসচেতনতাও ততই গভীর হয়। এইরূপ সমাজচেতনার কারণ অনুসন্ধান করাও অর্থনীতিবিদদের কর্তব্য।
বেকর কিন্তু সেনের করা Neo-Classicism-এর সমালোচনা উত্তর দেওয়ার পথে গেলেন না। তিনি তা কিছুটা এড়িয়ে গেলেন এই যুক্তি দিয়ে যে সামাজিক সচেতনতা বা সাংস্কৃতিক পটভূমি এতদিন অর্থনীতির বিষয়ের অন্তর্ভুক্তই ছিল না। তিনি এও মনে করেন যে পরিধি বাড়িয়ে এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগও Neo-Classicism-এ আছে।
নারীশিক্ষা এবং নারীর স্বার্থসচেতনতার ব্যাপারে শেষ অবধি দুজনেই দ্বিমত বজায় রাখলেন। বেকরের মতে শিক্ষা ও চাকুরির অবকাশ পেলে সন্তানসংখ্যা কমে যায়, কারণ তখন সন্তানধারণ এবং সন্তানপালনে অত্যাধিক সময় ব্যয় করলে মেয়েরা নতুন অর্থনৈতিক সুযোগগুলির সদ্ব্যবহার করতে পারে না। অতএব এর সঙ্গে যুক্তিবাদের কোন বিরোধ নেই। সেনের মতে নারীশিক্ষা এবং চাকু্রির ফলে মেয়েরা স্বার্থসচেতন হয়ে ওঠে। ক্রমাগত সন্তানধারণের নিদারুণ শারীরিক কষ্টের বিরুদ্ধে আপত্তি করবার অধিকার যে তার আছে, এই বোধ জন্ম নেয় তার মনে। অর্থাৎ মানুষের যুক্তিবোধ বা স্বার্থসচেতনতা নির্দেশিত হয় তার পরিবেশ, শিক্ষাদীক্ষা এবং সামাজিকতার দ্বারা। (এই তর্কের মীমাংসা সেদিন হয়নি, তবে হাততালির বহর দেখে মনে হচ্ছিল যে সেনের যুক্তিই দর্শকদের বেশি আকর্ষণ করেছিল।)
বিতর্কের শেষে দর্শকদের অনুরোধে আবারও উত্থাপিত হল সরকারের কার্যকারিতা প্রসঙ্গ। বেকর পুনরায় বললেন যে তাঁর মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৈনন্দিন অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ বড়ই বেশি, এবং তা সামগ্রিক সমাজ ও অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকারক। তাঁর নিজের এ বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছিল বব ডোলের নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়বার ফলে। তিনি দেখেছিলেন যে রাজনীতিবিদরা অর্থনীতির পণ্ডিতদের কথায় কর্ণপাত করতে নারাজ, কারণ তাঁরা ‘special interest group’- দের স্বার্থরক্ষার জন্যেই ব্যাকুল। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফলে তাঁর আরোই দৃঢ় ধারণা হয়েছে যে সরকার কেবলই ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহার করে থাকেন। অতএব যেকোন গণতান্ত্রিক দেশেই জনগণের “সীমিত সরকার” বা “small government”-এর দাবি করা দরকার। নেহাত যেটুকু প্রয়োজন, অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা এবং দেশরক্ষা, তার বাইরে যাতে সরকার হস্তক্ষেপ না করেন সেইদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
সেন বিনীতভাবে জানালেন যে বেকরের তুলনায় তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কম, কারণ তিনি আজ অবধি রাষ্ট্রপতি-পদের জন্যে কোন ব্যর্থ প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারে সাহায্য করেননি। কিন্তু বর্তমান সরকারের কাজকর্মে গলদ আছে বলেই সীমিত সরকারই সঠিক বিকল্প- এই যুক্তি তিনি মেনে নেন না। বরং মানুষের সামাজিক সচেতনতাকে সরকারি সিদ্ধান্তে সফলভাবে রূপান্তরিত করার চাবিকাঠিটি হাতে এলে আরো বেশি করে বড় সরকারের প্রয়োজন হবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
দুঃখের বিষয়, তর্ক যখন রীতিমতো জমে উঠেছে তখনই সভাপতি জানালেন যে সময় ফুরিয়ে গেছে। অন্য সভাগৃহে তখন পরের বক্তারা পৌঁছে গেছেন এবং দর্শকেরা যেন সেইদিকে যান- এই অনু্রোধ করলেন তিনি। স্বেচ্ছাসেবীদের আকুল অনুরোধ উপেক্ষা করে দলে দলে ভক্ত এবং অটোগ্রাফশিকারী দুই বক্তাকে ছেঁকে ধরল।