• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬ | জুন ১৯৯৮ | নাটক
    Share
  • আয়না : নিখিল রঞ্জন দাস

    [এক/দেড় শতাব্দীর প্রাচীন আসবাবপত্রে সাজানো একটা বসার ঘর। বেশ বড়সড়। দুপাশে এবং সামনে চারটি দরজা চারটি ঘরে যাওয়ার জন্য। বাইরের দিকে একটি জানালা, যা দিয়ে অদূরে সমুদ্র দেখা যায়।]

    অলকা: উরে ব্বাস! মনে হচ্ছে কয়েকশ বছর আগেকার কোনও সময়ে ঢুকে পড়েছি।

    [জাভেদ শেলফের ওপর রাখা একটা মিনিয়েচার তুলে নেয়।]

    জাভেদ: বলুন তো এটা কী?

    অলকা: ওরে ব্বাস। এটা কী? মাথাটা ষাঁড়ের শরীরটা মানুষের।

    অনিল: দেখি, দেখি। খুবই আশ্চর্যজনক!

    জাভেদ: গ্রীক মিথোলজিতে আছে। এর নাম মিনোটর। অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ষাঁড়। হলে কি হবে খাদ্য ছিল মানুষের মাংস।

    অলকা: ও বাবা। রেখে দিন তো।

    [জাভেদ যথাস্থানে রাখতে যাচ্ছিল, তার হাত থেকে নিয়ে নেয় অনিল।]

    অনিল: অরিজিনাল তো নিশ্চয়ই নয়।

    জাভেদ: তা কী করে হবে? মিনিয়েচার!

    অনিল: তবু, দাম নিশ্চয়ই কম হবে না। কী বলো?

    জাভেদ: মেটাল-এ তৈরি। কম হবে না।

    অনিল: মনে হচ্ছে এরকম জিনিস অনেক পেয়ে যাব এখানে। খেয়াল রেখো জাভেদ।

    অলকা: মাথায় বিজনেস আইডিয়া এসে গেছে তো। ওহ, যেখানেই যাবে, সেখানেই।

    [ইতিমধ্যে জাভেদ আরও একটি মিনিয়েচার হাতে নিয়ে দেখছে, সঙ্গে রয়েছে অনিল।]

    জাভেদ: দূষ্প্রাপ্য অ্যান্টিক। খুবই দুর্মূল্য। সময় মানুষকেই কতো পাল্টে দিয়েছে। তার রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ।

    অলকা: তবুও, মানুষের কতোগুলি প্রাইমাল ফিচার নিয়ে মানুষ এখনও অপরিবর্তিত- আদি অকৃত্রিম।

    জাভেদ: তা ঠিকই। তবে মানুষ যেভাবে দ্রুত তার পরিবেশ এবং নিজের অবস্থানকে পরিবর্তিত করছে, তাতে-

    অলকা: দোহাই। এ সময়ে আমাকে আর অ্যানথ্রোপোলজি পড়াতে বসবেন না। আগে দেখুন, আমরা কোথায় এসে উঠেছি- ট্রেসপাসার কিনা।

    জাভেদ: “ট্রেসপাসার উইল বি প্রসিকিউটেড” বলে অন্তত কোন নোটিস তো দেখছি না।

    [সকৌতুকে হাসে।]

    অনিল: তাছাড়া আমাদের কাছে ড: হোসেনের চিঠি তো রয়েইছে। আমাদের কোনও ভয় নেই। [কৌতুক করে]- এমনকি, নরমাংসভুক্‌ ওই রাক্ষসকেও নয়।

    অলকা: আরে বাবা, ঠাট্টা রাখো। আমি মোটেই অতো ভীতু নই। খামের ওপর লেখা ঠিকানাই তো শুধু পড়তে পেরেছো, আর তো কিছু পাঠোদ্ধার করতে পারনি। এখন কাউকে ডাকো।

    অনিল: দরজার সামনে কলিং বেল তো দেখলাম না। দাঁড়াও।

    [দরজার পাশে দোদুল্যমান একটা সুদৃশ্য দড়ির দিকে এগোয় এবং দড়ি ধরে টানে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য এক ঘরে মন্দিরের ঘন্টাধ্বনির মতো মিষ্টি ঘন্টাধ্বনি শোনা যায়। ]

    অলকা: কী মিষ্টি আওয়াজ!

    জাভেদ: ড: হোসেনের দেখছি পুরনো জিনিসের প্রতি খুব আগ্রহ।

    অনিল: বাড়িতে ইলেকট্রিক লাইন আছে তো?

    অলকা: [টিভি সেট এবং ল্যাম্প দেখিয়ে], কেন, ওই তো।

    জাভেদ: ড: হোসেন এখনও পুরনো সুন্দর কোন কোন জিনিসকে ধরে রাখতে চান মনে হচ্চে।

    অনিল: আসলে ভদ্রলোক অদ্ভুত। [একটু থেমে] আচ্ছা ধরো ওই চিঠির ভেতরে লেখা আছে- এই তিনজনকে খুন করবে।

    অলকা: আঃ! কী সব কথা!

    জাভেদ: ওই নরমাংসভুক্‌ মিনোটরের ভাবনা অনিলকে পেয়ে বসেছে।

    অলকা: আঃ। আপনিও আবার আরম্ভ করলেন জাভেদ? কিন্তু কেউ তো এখনও এলো না। এই থমথমে অবস্থা ভালো লাগে?

    জাভেদ: দাঁড়ান আবার ঘন্টা বাজাচ্ছি।

    [ঘন্টার দড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন দরজায় এসে দাড়ালো মুবারক- এক প্রৌঢ়।]

    মুবারক: সালাম! গোস্তাকি মাপ করবেন। একটু দেরি হয়ে গেল।

    জাভেদ: আপনার নাম?

    মুবারক: বান্দার নাম মুবারক, সাহাব। এক মকানের দেখভাল করি।

    অলকা: আপনার নামে একটা চিঠি আছে।

    [ব্যাগ খুলে একটা বড়সড় খাম দেয়। পকেট থেকে চশমা বের করে পড়তে পড়তে মুবারক বলে]।

    মুবারক: মালিক লিখেচে।

    অনিল: উর্দুতে লেখা। আমরা কেউ পড়তে পারিনি, শুধু ইংরেজিতে লেখা নাম-ঠিকানা-

    জাভেদ: বলছি তো উর্দু নয়। তাহলে আমি এক আধটু পড়তে পারতাম।

    মুবারক: আরবিতে লেখা, সাহাব।

    অলকা: ও, তাই বলো।

    অনিল: বলছিলাম না, ভদ্রলোক বেশ রহস্যময়- চিঠির কথাগুলিও গোপন রাখতে চান আমাদের কাছে।

    মুবারক: নেহি সাহাব, বিলকুল নেহি। আমি আরবি ছাড়া আর কোন লিখা পড়তে পারে না।

    অলকা: তুমি বাঙালি নও?

    জাভেদ: সে তো ওর intonation-এই বোঝা যাচ্ছে।

    মুবারক: আমার দেশ আরবে, মেম সাহাব।

    অনিল: তোমার মালিক বাঙালি তো?

    মুবারক: [হেসে] হাঁ সাহাব। মালিক বাঙালি আছে। মালিকের সঙ্গে আমার পহলেবার মোলাকাত হল ইরানে।

    অলকা: পারস্যে!

    অনিল: Strange thing- one after another.

    [ইতিমধ্যে মুবারক একটা চিঠি পড়েছে।]

    মুবারক: সাহাব, মালিক লেখেছে, আপনারা এখানে তিন রোজ থাকবেন।

    অনিল: ড: হোসেনের সঙ্গে আমাদের গোপালপুর বীচে দেখা হয়েছিল।

    জাভেদ: প্রায় এক সপ্তাহ আমরা একসঙ্গে ছিলাম। উনিই আমাদের এখানে আসার জন্য-

    মুবারক: কোই বাৎ নেহি সাহাব। এমন অনেকে আসে। আপনারা থাকছেন তো হহুশিকি বাৎ। আপনারা বসেন। আমি চাবি নিয়ে আসছি।

    [মুবারক চলে যায় ভেতরে। ওরা নানা স্থানে বসে। ]

    অনিল: এই নির্জন জায়গায় তিনদিন কাটাতে হবে।

    অলকা: তুমি না এলেই পারতে। তোমার বিজনেস এক্সপ্যানশানের কোন গন্ধ না পেলে, সে জায়গায় ঘুরতে তো তোমার ভালো লাগে না।

    অনিল: ওহ্‌ হো! আমাদের বেড়ানোরও তো একটা উদ্দেশ্য থাকবে।

    অলকা: ওখানেই তোমার সঙ্গে আমার তফাত।

    অনিল: আছেই তো তফাত। ড: হোসেন বললেন আর তুমিও তাতেই নেচে উঠলে। ওইটা আমি পারি না।

    অলকা: নেচে ওঠা আবার কি! অমন একজন জ্ঞানী মানুষ কথাটা বললেন, আমরা যাচাই করে দেখবো না একবার?

    অনিল: জ্ঞানী! Mysterious, mysterious! দেখে নিও।

    জাভেদ: তোমরা মিথ্যেই ঝগড়া করছো। আমি তো ড: হোসেনের প্রস্তাবটা প্রথম accept করেছিলাম।

    অলকা: আমিও তো বলেছিলাম- “আমি আর জাভেদ মিঞা চলে যাই”--কি কথা!

    জাভেদ: অনিল, দেখতেই দাও না আমাকে, তোমার জন্য কিছু সংগ্রহ করে দিতে পারো কিনা।

    অনিল: এই একটা কাজের কথা। Let’s hope for the best.

    [চাবি নিয়ে প্রবেশ করে মুবারক। তিনট ঘর খোলে।]

    মুবারক: অনিলবাবু কে আছেন?

    অনিল: আমি।

    মুবারক: এহি ঘর আপনার। আর মেম সাহাব এহি ঘর আপনার।

    [দুটো পাশাপাশি ঘর দেখায়।]

    অনিল: আমাদের একটা ঘর হলেই চলত।

    মুবারক: নেহি সাহাব। মালিক এহি বলল। [জাভেদকে] আপনি জাভেদ মিঞা? আপনার ঘর ওহি। [একপ্রান্তের ঘর দেখায় ] দিন আপনাদের সামান।

    অলকা: কোনও দরকার নেউ মুবারক। আমাদের হালকা লাগেজ আমরা নিজেরাই ঘরে নিতে পারবো।

    মুবারক: নেহি মেমসাহাব। আপনারা মেহমান। মালিক রাগ করবে।

    [ইতিমধ্যে জাভেদ ঘুরে ঘুরে তিনটি ঘরের নাম পড়ে ফেলেছে। মুবারক ঘরে মালপত্র ঢোকাতে থাকে। ]

    অলকা: জাভেদের ঘরের নাম রত্নকোষ!

    অনিল: রত্নকোষ! দেখি দেখি।

    [অনিল ছুটে গিয়ে সে ঘরে ঢোকে এবং একটু পরেই বেরিয়ে আসে। ]

    অনিল: উফ্‌। ড: হোসেন বেশ রসিক লোকও বটে। স্রেফ একটা লাইব্রেরির নাম রত্নকোষ।

    [মালপত্র ঘরে তুলে মুবারক বাইরে যায়।]

    অলকা: ঠিকই তো আছে। বই রত্ন নয়?

    অনিল: ও বাবা! তোমাদের বাংলা ব্যাকরণের আজকাল এই হাল হয়েছে নাকি?

    জাভেদ: অলকার ঘরের নাম নীড়।

    অনিল: পাখির বাসা তো? দেখো খড়কুটো দিয়ে তৈরি কিনা।

    [অলকা ছুটে ঘরে যায়। ]

    অনিল: নিজের ঘরটাই তো আমার দেখা হল না। [ঘরের কাছে আসে] কী নাম? নির্জন সঙ্গ।

    [ঘরে ঢোকে অনিল। অলকা ধীর পায়ে নিজের ঘরের বাইরে আসে। জাভেদের কাছে যায়।]

    অলকা: [বিষণ্ণ কন্ঠে] জাভেদ মিঞা, নীড় কথাটার মানে কী?

    [জাভেদ অপলক তাকায় অলকার মুখের দিকে। ]

    জাভেদ: আপনি জানেন না?

    অলকা: না, জানি না। শেখারই সুযোগ হয়নি।

    জাভেদ: কী বলছেন আপনি!

    অলকা: কেন আপনি বোঝেন না দেখে? শেখাবেন আমাকে নীড় কথাটার মানে? [জাভেদ নীরব থাকে। অলকা তার বুকে হাত রাখে একটুক্ষণ। ] আমার মধ্যে আপনি এক devoted student পেতেন।

    অনিল: [নেপথ্যে] অসহ্য, অসহ্য।

    [ঘরের বাইরে আসে অনিল। সোফায় বসে পড়ে ধপাস করে। অলকা অনিলের পাশে বসে।]

    অলকা: কী হল?

    অনিল: অসম্ভব। ও ঘরে আমি থাকতে পারবো না।

    জাভেদ: কেন কী হয়েছে?

    অনিল: যাও না, যাও। ঘরে গিয়ে দেখো। একটা মরুভূমি। [জাভেদ “নির্জন সঙ্গ”-এ ঢোকে] তুমি কবিতাটবিতা লেখো, তোমার ভালো লাগতে পারে, আমার নয়।

    অলকা: দাঁড়াও, দেখে আসি।

    [ঘরে ঢোকার জন্য উঠতেই বেরিয়ে আসে জাভেদ।]

    জাভেদ: ও, এই ব্যাপার।

    অলকা: হেঁয়ালি রাখুন তো। বলুন কী আছে।

    জাভেদ: খুব কম আসবাবপত্র। একটা দেওয়াল জুড়ে বিশাল এক মরু প্রান্তরের ছবি। ঘরে বসে থাকলে সত্যি মরুভূমির পাশে বসে আছি বলে অনুভূতি হয়। সামনে ধূ-ধূ করা মরুভূমি। যতদূর চোখ যায় রুক্ষ তপ্ত শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই।

    অলকা: Really a poet.

    জাভেদ: [হেসে] কে? আমি?

    অলকা: না, ড: হোসেন। এই সবুজের দেশেও এক শূন্যতার সন্ধান করেছেন। আশ্চর্য।

    অনিল: তোমার কবিতা আসে। তুমি থাকো ওই ঘরে। অথবা জাভেদ। আমি পারবো না।

    অলকা: আমার ঘরেও আমার কষ্ট হবে। তবু ওখানেই আমি থাকব।

    অনিল: ও ঘরও বিচুলি-টিচুলি দিয়ে সাজানো নাকি? যা অদ্ভুত মানুষ।

    অলকা: যাও, একবার, দেখে এসো এক ঝলক। বৈভব তো আমাদের অনেক, এখানে অনেক কম। কিন্তু এখানে বৈভব যেন ফুলের মতো ঝলমল করে উঠছে চারদিকে।

    [জাভেদ নীড়-এর দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে লক্ষ করে। তখন অলকা বলে চলেছে- ]

    তাদের ফুটে ওঠার শব্দ, গন্ধ, মৃদু মিষ্টি গানের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে যেন।

    অনিল: A psychic patient. A sheer psychic patient.

    অলকা: ও আমার স্বপ্নের নীড়। হোক্‌ সে মাত্র তিনদিনের জন্য।

    অনিল: তোমার যে কী ভালো লাগে, আমি বুঝি না। এই বলছ কষ্ট হবে- তবুও থাকবে।

    [মুবারক চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। টেবিলে রাখে। কাপে চা ঢালে। ]

    মুবারক: সাহাব, চা।

    অনিল: মুবারক, আমার ঘর ওই লাইব্রেরি ঘরে দাও আর জাভেদের ঘর নির্জন সঙ্গে।

    মুবারক: কেন সাহাব।

    অনিল: আমরা দুজনে ঘর পাল্টে নেব।

    মুবারক: সে তো হবে না, সাহাব। মালিকের চিঠিতে সাফ লিখা আছে। সেই মাফিক কাজ।

    জাভেদ: কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে পাল্টে দিলে তফাত কী? ঘর তো তিনজনের আলাদাই রইলো।

    মুবারক: ফারাক কুছু তো জরুর আছে। আমার মালুম হচ্ছে না, লেকিন মালিক যখন-

    অনিল: তোমার মালিক যে কেন এত কড়াকড়ি করছে-

    মুবারক: খারাপ নিবেন না সাহাব। আপনারা কেন এসেছেন মালুম নেই আমার। লেকিন-

    অলকা: কেন তোমার মালিক লেখেননি?

    মুবারক: আমাকে এখুন বলবেন না মেমসাহাব। আমার যখন জানার তখন জেনে যাব চিঠিতে।

    অনিল: তোমার এখন জানতে ইচ্ছে করছে না?

    মুবারক: আমি বুঝে নেব কী মালিক চাইল- আমার জানা জরুরি নাই।

    জাভেদ: তুমি নিজে জানতে চাও না?

    মুবারক: সাহাব, এ মস্ত দুনিয়ায়- কত্তো কুছু জানার। আপনা জিন্দেগির জন্য যা জানা জরুরি তাই জেনে শেষ করা যায় না। বেদরকার জিনিস জেনে ফালতু সময় বরবাদ করি কেন?

    অনিল: তুমি ভারি অদ্ভুত কথা বলো তো!

    মুবারক: সাচ বাত, সাহাব। অদ্ভুত কেন হবে? এখন শোনেন, মালিক যেমন লিখে দিল, ধরে নেব কি ওহি ঠিক। পরে যে যা কাম আছে তা হবে।

    অলকা: ঠিক আছে মুবারক তোমার মালিক যেমন বলেছেন সেই রকমভাবেই আমরা থাকব।

    অনিল: আর উপায় কী?

    অলকা: মুবারক এবার বলো তো আমার ঘরে ওই ছবিটা কার? খুব সুন্দরী এক মেয়ে।

    মুবারক: মেম সাহাব, শুনেছি ওই লেড়কিরই এ মকানের ঘরওয়ালির হওয়ার কথা ছিল। ওটা হবে তার বেডরুম।

    অনিল: বেশ রোম্যান্টিক গল্পের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

    অলকা: চুপ করো তো।

    মুবারক: মালিক আমাকে সঙ্গে নিয়ে ও দুই ঘর সাজাল। লেকিন সে আর এলো না। আসা হল না।

    জাভেদ: কেন কী হয়েছিল?

    মুবারক: মালিক দুসরাবার যখন তাকে আনতে গেল ইরানে, সে মুল্লুকে আইনকানুন বহুত বদল হয়েছে। কানুন আটকে দিল। তো ঠিক হল, দুজনেই সুইসাইড করবে। কে লেড়কি আপনা শিরপে গোলি চালাল, লেকিন মালিক পারল না। আপনা ঘর ওয়াপাস এলো, বিলকুল দুসরা আদমি।

    অলকা: এইবার বোঝা গেল। ড: হোসেনকে দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল- মাত্র পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশ বয়স, অথচ একমুখ দাড়ি, উশকোখুশকো চুল, ওই পোশাক- কী তাকে অমন ঘরছাড়া করেছে।

    [ঘরে কিছুক্ষণ নীরবতা]

    অনিল: আর তুমি? কীভাবে এখানে এলে? এই চাকরিতে?

    মুবারক: সে এক মজাদার কাহানি সাহাব। আমি আসলে এক চোর। চুরির লাইন ধরে একদিন চলে এলাম ইরানে। মালিকের কাছে ধরা পড়ে গেলাম।

    জাভেদ: ওসব দেশের আইন তো খুব কড়া শুনেছি।

    মুবারক: হাঁ সাহাব। লেকিন গরীবের ভালর জন্য নয়। আমার কী হাল হবে জানতাম। লেকিন নসীব ভাল।

    অনিল: কি, জেল হয়নি?

    মুবারক: নেহি সাহাব। মালিক আমাকে বলল, তোমাকে আমার ল্যাবরেটরির গিনিপিগ বানাবো। চলো।

    অনিল: ল্যাবরেটরি, গিনিপিগ। কোথায়?

    মুবারক: সে তো আমার মালুম নেই, সাহাব। এতো বড় মকান-এর দেখভাল- মালিক আজ থাকল, কাল নেই! আমিও ছুটি মিললে ইখানে উখানে চলে যাই। কবে মালিক আমাকে গিনিপিগ বানাবে মালুম নাই।

    জাভেদ: সে তোমার মালুম হওয়ার দরকার নেই মুবারক। তোমার ওপর অপারেশন হয়েই গেছে। আর একটু চায়ের বরং দরকার আমাদের।

    মুবারক: এখুনি আনছি সাহাব। [দ্রুত প্রস্থান করে ]

    অলকা: সত্যি চমকপ্রদ সাফল্য ড: হোসেনের।

    অনিল: কোথায়?

    অলকা: [হেসে ঠেলে দেয়] ওহ সত্যিই। তুমি না- এত দেরি লাগে বুঝতে। [ওরা হাসতে থাকে]।


    ।। অন্ধকার ।।

    ।। ২ ।।

    [জানালার ধারে একটি চেয়ারে বসে অলকা বাইরের দিকে চেয়ে বসেছিল। নিজের ঘর থেকেই “ইউরেকা, ইউরেকা” বলতে বলতে প্রবেশ করে জাভেদ, একহাতে একটা বই অন্য হাতে একটা ভিডিও ক্যাসেট। ]

    জাভেদ: ইউরেকা- পেয়ে গেছি। [হঠাৎ অলকাকে লক্ষ্য করে] অলকা, একমনে এভাবে একা একা বসে।

    অলকা: [মুখ ফিরিয়ে] যাক্‌ তবু এতক্ষণে নজরে পড়ল, অলকা একা একা। সারারাত দেখলাম আপনার ঘরে আলো জ্বলছে। বই থেকে মুখ তুলে একবারও অন্য কিছু মনে পড়ল না?

    জাভেদ: আপনি ঘুমোননি?... অনিল কী করছে?

    অলকা: আপনি কি মনে করেন, আপনার বন্ধু সারা রাত নাক ডেকে ঘুমিয়ে এখন আমার কাছে বসে থাকবে? গেছে বাইরে, তার মতো।

    জাভেদ: আপনিও যেতে পারতেন সঙ্গে।

    অলকা: কী করতে? আমি হয় বললাম, দেখো কী চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ। বলবে এখানে একটা ভালো হোটেল চলতে পারে টুরিস্টদের জন্য। আমি যদি বলি- পথটা কতদূর উধাও হয়ে গেছে বলো। ও ঠিক বলবে- ওখানে একটা ইন্ডাসট্রিয়াল টাউন আছে। বলবেই। বলুন কতক্ষণ ওর সঙ্গে থাকা যায়!

    জাভেদ: সত্যি অনিলের উচিত, আপনার সম্বন্ধে আরও একটু ভাবা।

    অলকা: আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে নিলু আমার সম্বন্ধে অনেকই ভাবে- শুধু আমার দাবি- আরও একটু বেশি।

    জাভেদ: ইয়ে- না মানে…

    অলকা: জাভেদ মিঞা, তুমি দেখতে পাও না পৃথিবীটা আমাদের কাছ থেকে সরে সরে যাচ্ছে, সূর্য ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে, স্তিমিত হয়ে আসছে আমাদের আশাআকাঙ্ক্ষা।

    জাভেদ: কী সব বলছেন এলোমেলো। রাতে ভাল ঘুম না হওয়ার জন্য নিশ্চয়ই- আপনার শরীর ঠিক আছে তো?

    [অলকা আবেগে উঠে দাঁড়ায়, দুহাতে জাভেদের দুবাহু ধরে ঝাঁকুনি দেয়। ]

    অলকা: Oh heartless man, এত কিছু শিখেছ, মানুষকে দয়া করতে শেখোনি।

    [জাভেদের বুকে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অলকা। প্রায় স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে জাভেদ। হঠাৎ বাইরে শোনা যায় অনিলের গলা। অলকা জাভেদকে ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে নেয়। জাভেদ নিজের ঘরে চলে যায়।

    অনিল: [নেপথ্যে] অলকা, অলকা।

    [অনিল প্রবেশ করে। সোফায় বসে আরাম করে। ]

    অলকা: কোথায় গিয়েছিলে?

    অনিল: কাজে, কাজে। জাভেদ কোথায়?

    অলকা: হবে নিজের ঘরে। বইয়ের পোকা, নতুন নতুন সব বই পেয়েছে, মহা আনন্দে পড়ছে।

    অনিল: জাভেদ মিঞা, বেরোও ভাই। কোন রত্ন আর তুমি খুঁজবে?

    [জাভেদ বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সেই বই আর ভিডিও ক্যাসেট। ]

    অনিল: শোনো হে এখান থেকে পঁচিশ ত্রিশ কিলোমিটার দূরে নাকি পুকুর খুঁড়তে গিয়ে এক অদ্ভুত পাথর পাওয়া গেছে। আমরা কালই সেখানে যাচ্ছি। অলকা, এখানে ড: হোসেনের সেই মিরাকল মিরার যদি দেখা নাই হয় দুঃখ কোরো না। পরে কোন সময়ে আসা যাবে। আর জাভেদ তো কিছুই করতে পারল না। কেবল বই পড়েই-

    জাভেদ: না, মোটেই না। আমিও দারুণ জিনিস পেয়ে গেছি। তার নমুনা এই। [ক্যাসেট দেখায়]।

    অনিল: কী আছে ওতে?

    [জাভেদ ক্যাসেট ঢুকিয়ে অন করে দেয়। ওরা তিনজনে বসে দেখে। সেটটি দর্শকদের দিকে উল্টো করে বসিয়ে শুধু শব্দ শোনাতে হবে। ]

    শব্দ: আমরা আজ পৃথিবীর আদিম কিছু প্রাণীর সঙ্গে পরিচিত হব। এগুলি শুধু দেখতে বীভৎস ছিল না, স্বভাবেও ছিল ভয়ঙ্কর। এটা টিরানোসর- ডাইনোসর প্রজাতির একটি- ভয়ঙ্কর রক্তলোলুপ।

    অলকা: [সভয়ে] ওহ, কী কুৎসিত। ছোট ছোট হাত, অথচ বিশাল পা, শরীর, লেজ।

    জাভেদ: দাঁতগুলো দেখুন। ছোরার ফলার মতো বড় আর ঝকঝক করছে।

    শব্দ: ইন্সটান্সেভিয়া। এরাও ছিল এক হিংস্র জানোয়ার।

    জাভেদ: অনেকটা নেকড়ে বাঘের মতো দেখতে। তাই না?

    অলকা: আরও কুৎসিত।

    জাভেদ: পাহাড়ে পাহাড়ে ঝোপেঝাড়ে ছুটোছুটি করে বেড়াতো শিকারের খোঁজে।

    শব্দ: ডিপ্লোডোকাস। এরা ডাইনোসর প্রজাতির- তবে নিরীহ।

    জাভেদ: কী বিশাল শরীর।

    অলকা: কিন্তু মাথাটা অনুপাতে কত ছোট। দেখুন জাভেদ।

    শব্দ: সাপের মতো লম্বা মাথাটা কখনও গাছের মগডালে, কখনও বা জলের নীচে চালিয়ে দিত খাবারের সন্ধানে। বিশাল শরীরের বিপুল খিদে; কেবলই খেয়ে চলত।

    অলকা: উঃ। বন্ধ করুন তো। আর ভাল লাগছে না। কী সব বীভৎস জীবজন্তু।

    [জাভেদ VCP বন্ধ করে দেয়]

    জাভেদ: এরা সব পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

    অলকা: বাঁচা গেছে।

    জাভেদ: সে তো মানুষও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে।

    অলকা: কী যা তা বলছেন।

    জাভেদ: সত্যি। ধরুন যদি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয় সারা পৃথিবী জুড়ে।

    অনিল: হতেই পারে।

    জাভেদ: অথবা প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরোধী কাজ করে, তাকে নষ্ট করে, তার সঙ্গে নিজেদের adapt করতে না পেরে-

    অলকা: যেমন পারেনি ওই অদ্ভুত প্রাণীরা!

    জাভেদ: হ্যাঁ।

    অনিল: তোমার ওই মিনোটর-ও কম অদ্ভুত নয়। বীভৎসও।

    জাভেদ: প্রাচীন মিশরের বহু দেবদেবীর শরীর মানুষের, কিন্তু মাথা কারও কুমীরের, কারও নেকড়ের, কারও-

    অলকা: ভাবতেও ভয় লাগে।

    জাভেদ: ভয়ঙ্কর এই কারণে যে- মানুষ, অথচ মানুষ নয়। এর চেয়ে বীভৎস আর কী হতে পারে।

    অনিল: আমাদের গণেশ?

    অলকা: মোটেই ভয় লাগে না।

    জাভেদ: সে হয় তো হাতির মাথা বলেই।

    অনিল: আচ্ছা ধরো যদি মাথাই না থাকে।

    জাভেদ: শরীর আছে অথচ মাথা নেই?

    অনিল: হ্যাঁ। কবন্ধ।

    অলকা: কবন্ধ মোটেই দেবতা নয়। প্রেত, দানব।

    জাভেদ: আসলে মানুষের মনের অদ্ভুত সব ধারণা থেকে ওগুলি তৈরি। বাস্তবতা নেই। কিন্তু আদিম প্রাণীরা বাস্তবে ছিল এক সময়ে।

    অলকা: মানুষের মনে এখনও আছে। আছে না? তাতে আশা, নিরাশা, হিংস্রতা লোভ সব আছে।

    [চা নিয়ে প্রবেশ করে মুবারক]

    অলকা: ওহ্‌ মুবারক। একদম দেবদূতের মতো এসে গেছে। কী সব বাজে আলোচনা চলছিল।

    জাভেদ: এবার মুবারকের হাতের চা। দারুণ।

    [মুবারক সকলকে চা দেয়]

    মুবারক: সাহাব।

    অনিল: বলো মুবারক। আজ আমদের কী প্রোগ্রাম?

    [মুবারক পকেট থেকে চিঠি খুলে পড়ে নেয়]

    মুবারক: আজ আপনাদের শিশমহল দেখার কথা লিখা আছে।

    জাভেদ: আমরা জানি।

    অনিল: আমরা কখন দেখব তোমাদের শিশমহল।

    মুবারক: যখন আপনাদের মর্জি।

    অনিল: যদি এখন দেখতে চাই।

    মুবারক: হবে। কুছ্‌ অসুবিধা নাই।

    অল্কা: ও ঘরে নাকি জাদু আয়না আছে?

    মুবারক: হ্যাঁ, মেমসাহাব। আয়না তো জরুর আছে- চারতরফ।

    অলকা: তাতে নিজের ছবি দেখা যায়?

    অনিল: কী বোকার মতো প্রশ্ন করছ।

    মুবারক: [হেসে] সব আয়নাতেই আপনা ছবি দেখা যায়, মেমসাহাব।

    অলকা: না, না। ও ছবি নয়। মনের ছবি। ইয়ে মানে- তোমাকে কীভাবে বোঝাবো।

    অনিল: কী দরকার বোঝানোর, আর কাকেই বা বোঝাচ্ছ।

    মুবারক: হাঁ মেমসাহাব, ও তো আপনার বোঝার ব্যাপার আছে। আমি কী বুঝাব।

    অনিল: দাও, দাও, তুমি ঘর খুলে দাও।

    জাভেদ: তুমি অত উত্তেজিত হচ্ছো কেন?

    অনিল: [ভয় গোপন করতে উচ্চহাস্য] উত্তেজিত। মোটেই না। কুছপরোয়া নেই। খোলো দরজা।

    অলকা: আমি যাব না।

    অনিল: যাবে না। কেন?

    অলকা: ও আয়নায় আমি মুখ দেখব না।

    অনিল: সেকি! ড: হোসেনের কথায় সেদিন অত উৎসাহ দেখালে।

    অলকা: সব দিন মুড সমান থাকে?

    জাভেদ: ভয় পেয়ে গেলেন, অলকা?

    অনিল: যাক তোমার যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি।

    জাভেদ: তারপর আমি যাব, মুবারক।

    মুবারক: তাহলে শিশমহল খুলে দেব, সাহাব?

    অনিল: হ্যাঁ, হ্যাঁ, খোলো।

    [মুবারক চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিয়ে চলে যায়। অনিল ঢোকার উদ্যোগ নেয়]

    অলকা: দাঁড়াও। যাব। আমিই আগে যাব।

    [অনিল দাঁড়িয়ে পড়ে]

    অনিল: যাও! এই তো।

    [অলকা সাহস সঞ্চয় করে নেয়, মুখে হাসির রেখা ফোটাতে চেষ্টা করে এবং অনিল ও জাভেদের দিকে চেয়ে শিশমহলে ঢুকে যায়। উদ্বিগ্ন সময় কাটে। হঠাৎ ছুটে বেরিয়ে আসে অলকা মৃদু অস্ফুট আর্তনাদ করে। সোফায় বসে পড়ে ধপাস করে। চোখ বন্ধ করে, হাতের তালু দিয়ে চোখ ঢাকে। ]

    অলকা: Oh horrible!

    [অনিল উৎকন্ঠিতভাবে অলকার পাশে বসে]।

    অনিল: কী হল? কী হল অলকা?

    [অনিল কিছু বলার জন্য মুখ ঢেকে হাত সরিয়েই আবার সভয়ে চোখ ঢাকে। ভয়ে ঘৃণায় মুখ তার কুঞ্চিত হয়ে আসছে।]

    অলকা: ওহ, অসহ্য!

    [জাভেদ দাঁড়িয়ে ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করে এবং সহসা শিশমহলে প্রবেশ করে। অলকা এবং অনিল সেদিকে উদ্বেগে তাকিয়ে থাকে। সময় কাটে। সহসা অলকার মতোই ছুটে বেরিয়ে আসে জাভেদ। ওদের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, বাইরে তাকিয়ে থাকে।]

    অনিল: কী হল জাভেদ? কী হল? কোন কথা বলছ না!

    [জাভেদ নিরুত্তর থাকে]

    অলকা: জাভেদও নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু একটা দেখেছে।

    [অস্থির ভাবে উঠে দাঁড়ায় অনিল]

    অনিল: কী ভয়ঙ্কর সেটা বলবে তো। দুজনেই চুপ করে আছ।

    [জাভেদের কাছে যায় অনিল]

    জাভেদ: দাঁড়াও, একটু নিঃশ্বাস নিতে নাও ভাল করে।

    [হঠাৎ অনিল নিজের ঘরে ঢোকে এবং রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে আসে। এক মুহূর্ত দাঁড়ায় এ ঘরে। তারপর ছুটে প্রবেশ করে শিশমহলে। জাভেদ ও অলকা স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে সেই দিকে চেয়ে। উদ্বিগ্ন সময় কাটে। হঠাৎ শিশমহলে অনিলের আর্ত চিৎকার শোনা যায়।]

    অনিল: [নেপথ্যে] Be off! I say, be off, you headless demon! Be off!

    [সহসা নেপথ্যে শিশমহলের মধ্যে গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভেঙে পড়ে।

    আর্ত চিৎকার করে সন্ত্রস্ত অলকা ছুটে যায় জাভেদের কাছে। সভয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। অনিল উদ্‌ভ্রান্তের মতো শিশমহলের দরজায় এসে দাঁড়ায়। শূন্য দৃষ্টিতে জাভেদ ও অলকাকে দেখে। এ দৃশ্য তার মনে রেখাপাত করে। ]

    অলকা: অনিল কি মিনোটরের চেয়েও হিংস্র কিছু দেখল?

    জাভেদ: হয় তো ডিপ্লোডোকাসের চেয়েও কদাকার কিছু।

    অনিল: ওহ, headless demon, কবন্ধ।

    [সহসা কানের পাশে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে নিজেকে গুলি করে। পড়ে যায় সেখানেই। অলকা ছুটে যায় অনিলের কাছে, চিৎকার করে। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে তার মাথার কাছে। জাভেদ হতবিহ্বল হয়ে কাছে আসে ওদের। বাইরে থেকে হন্তদন্ত হয়ে আসে মুবারক। দেখে সব। ]

    মুবারক: হায় আল্লা। এ কী হল? সাহাব?

    জাভেদ: মুবারক, আমি তোমাদের আয়নায় কী দেখলাম? একটা কুৎসিত ডিপ্লোডোকাস।

    অলকা: আমি একটা বীভৎস মিনোটর দেখেছি। মুবারক?

    মুবারক: মানুষের মন এক আজব দুনিয়া, মেম সাহাব।

    [ধীরে ধীরে মৃত অনিলের কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে তাকে দেখে। পরে উঠে দাঁড়ায়।]

    হায় আল্লা। এ দুনিয়ায় মানুষ এল কি তার মরণও জরুর হবে। তবু মানুষ কখনও একা, কখনও দল বেঁধে, কখনও অন্যের, কখনও নিজের মৃত্যুর বন্দোবস্ত করে।

    [আলো নিভে যায়।]

    ।। ৩ ।।

    [অলকা ও জাভেদ তল্পিতল্পা গুছোনোর শেষ পর্যায়ে। জাভেদ বাঁধা শেষ করে দাঁড়িয়ে আছে। অলকা নীচু হয়ে হাভারস্যাকের ফিতে বাঁধছে। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে মুবারক। স্তব্ধ পরিবেশ।]

    মুবারক: সাহাব, মেমসাহাব, আপনারা কাল থেকে কোন কথা বলছেন না।

    জাভেদ: মুবারক, পুলিশকে আমাদের দুজনেরই ঠিকানা দেওয়া আছে। দরকার হলে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে।

    মুবারক: ঠিক আছে।

    জাভেদ: তুমি হোসেন সাহাবকে একটা খবর পাঠিয়ে দিও।

    মুবারক: জরুর সাহাব।

    [অলকা বাঁধাছাঁদা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। বিষণ্ণ প্রতিমা সে। ]

    জাভেদ: আর আমাদের একটা ট্যাক্সি ডেকে তুলে দাও, মুবারক।

    [মুবারক চলে যাচ্ছিল]।

    অলকা: একটা নয়, দুটো। দুটো ট্যাক্সি ডেকো, মুবারক।

    [মুবারক একটু থেমে একটা কিছু বুঝে নিয়ে চলে যায়]

    জাভেদ: দুটো! আপনি আমার সঙ্গে যাবেন না, অলকা?

    অলকা: [একটু নীরবতার পরে] না।

    জাভেদ: কোথায় যাবেন তাহলে?

    অলকা: প্রথমে একবার ড: হোসেনের কাছে যাব। দেখি দেখা পাই কিনা।

    জাভেদ: হয়তো পাবেন। কিন্তু কেন?

    অলকা: আরও কিছু জানার আছে।

    জাভেদ: আরও। এরপরও?

    অলকা: জানার আছে আরও কিছু।

    জাভেদ: আরও ভয়ঙ্কর কিছু দেখা যায় কিনা?

    অলকা: আপনি আপনার বিকৃত চেহারা দেখে থমকে গেছেন। কিন্তু আমি যাব না। আমাকে জানতে হবে- মানুষের সুন্দর চেহারা আবার কীভাবে দেখতে পাব।

    [বাইরে ট্যাক্সির হর্ন শোনা যায়। প্রবেশ করে মুবারক। ]

    মুবারক: ট্যাক্সি এসে গেল সাহাব।

    অলকা: মুবারক, হোসেন সাহেবের দেখা পাই তো ভালো। না যদি পাই, তাকে বলবে- আমি আবার আসব। আবার আয়নায় মুখ দেখবো।

    [অলকার কন্ঠ আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। উদ্‌গত কান্না চেপে হাভারস্যাক পিঠে তুলতে যাচ্ছিল।]

    মুবারক: মেমসাহাব, আমাকে দিন। আমি পৌঁছে দেব।

    অলকা: না মুবারক। আমি পারব। পারতেই হবে।

    [এক ঝাঁকুনিতে পিঠে তুলে নেয় হাভারস্যাক।]

    যাই জাভেদ। মুবারক।

    [অলকা মাথা নুইয়ে প্রতি-অভিবাদন করে চলে যায়। নীরবতার পর একটি ট্যাক্সি চলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া যায়। তখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জাভেদ।]

    মুবারক: সাহাব।

    জাভেদ: [সম্বিৎ পেয়ে] ও হ্যাঁ।

    [হাভারস্যাক তোলার উদ্যোগ করে।]

    মুবারক: সাহাব দিন আমি নিয়ে যাই।

    জাভেদ: না, পারবো। শুধু একটা হেল্প করো, এখন যেন বড্ড ভারী লাগছে।

    [মুবারক জাভেদের পিঠে হাভারস্যাক তুলে দেয়। ]

    চলি মুবারক।

    মুবারক: সালাম সাহাব।

    [ধীরে ধীরে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে যায় জাভেদ মিঞা। মুবারক স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরে ট্যাক্সি চলে যাবার শব্দ শোনা যায়। মুবারক পাশের ঘর থেকে একটা ঝাড়ু নিয়ে এসে শিশমহলে ঢোকে। ভাঙা কাঁচের টুকরো ঝাঁট দেবার শব্দ শোনা যায়। ]

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments