আমাদের স্কুলে দুধরনের ছাত্র ছিল। একদল, যারা রোজ স্কুলে আসত, আর অন্যদল, যারা স্কুলেই থাকত। আমরা, যারা বাড়িতে থাকতাম, তাদেরকে বলতাম বোর্ডার। বোর্ডাররা সংখ্যায় খুব কম ছিল, চল্লিশজনের ক্লাশে- হয়তো চারজন।
বোর্ডাররা পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল না। তারা সাধারণত দূর গ্রামের দুঃস্থ পরিবার থেকে আসত। হয়তো তারা শহরে মানাতে পারত না, হয়তো তাদের মন খারাপ করত, আর তাই মোটেই পড়াশোনা করতে চাইত না। স্কুল তাদের উপকার করার জন্যই নিয়ে আসত, কিন্তু আশ্রয় দেবার পর তাদের দেখাশোনায় হয়তো ঘাটতি পড়ে যেত।
বোর্ডারদের কিন্তু স্কুলের প্রতি- অর্থাৎ স্কুলের বাড়িগুলোর প্রতি আর স্কুলের মাঠগুলোর প্রতি, একটা অধিকারবোধ ছিল। আমরা ডে-স্কলাররা যে সপ্তাহে পাঁচদিন এসে তাদের বাড়ি হৈহুল্লোড় করে ভরে ফেলতাম, তাতে বোধহয় তারা খুব প্রসন্ন ছিল না। মোটের উপর, আমরা দু-তরফ দুটো পৃথক জগতে থাকতাম, সংকোচ ছিল, অপরিচয় ছিল, বন্ধুত্ব প্রায় হত না বললেই চলে।
নরেশ কেরকাট্টা দেখতে ছিল লম্বা, কুচকুচে কালো। ক্লাশের পেছনদিকে বসত, পরীক্ষায় মাঝের দিকে আসত, আর ভাল হকি খেলতে পারত। একদিন সকালবেলা স্কুলে পৌঁছেছি, ক্লাশে যাচ্ছি, করিডরে নরেশের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা, নরেশ হাসিহাসি মুখে তাড়াতাড়ি উল্টোদিকে কোথাও যাচ্ছে। চারপাশে আর কেউ ছিল না, নরেশ বোধহয় আর কাউকে না পেয়ে আমাকেই একগাল হাসি দিয়ে বলল, “আমার মা এসেছে।”
আমি বেশ অপ্রস্তুতই হয়েছিলাম। নরেশের সঙ্গে আমার তো হৃদ্যতা ছিল না, বুঝিনি আমাকে এই আনন্দসংবাদ দেবার কারণ কি। নরেশ থামেনি, কিন্তু আমি তারই মধ্যে খুশিভাব করে বলে উঠলাম, “বাঃ, দারুণ তো!”
নরেশের সেই একগাল হাসি, আর লম্বা লম্বা পা ফেলে মাকে দেখতে যাওয়া এখনো মনে আছে।
কন্যা
আমার অপিসবাড়ির নীচে কতকগুলো রেস্তোরাঁ আছে। তাদের কোনটা চীনা, জাপানী, মেক্সিকান, মার্কিন এইসব। একটি আছে ইতালীয়। চারপাশের অপিসবাড়ির অনেকে এই দোকানগুলিতে খেয়ে জীবনধারণ করে।
আলন্তি নামের ইতালীয় রেস্তোরাঁতে আমি মাঝে মাঝে বেলা দশটার বেগেল খেতে যাই। যেখানে বুকসমান উঁচু কাচে-ঢাকা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ফরমাস জানাতে হয়। কাউন্টারের অপরদিকে একদল মেয়ে কাজ করে চলে- ঝুড়িবোঝাই টমেটো, পেঁয়াজ, পাঁউরুটি, মাংস কেটে জোগাড় করা থেকে স্যান্ডউইচ বানিয়ে চালান দেওয়া পর্যন্ত। তারা সবাই মেক্সিকান। তাদের পরনে কালো ইউনিফর্ম, মাথায় আলন্তি লেখা টুপি, গলায় ঝোলানো অ্যাপ্রন। সকলেই অল্পবয়েসী একজন বাদে, যার দিদিমণির মতো হাবভাব। তারা নিজেদের মধ্যে স্প্যানিশে খুনসুটি করে, আমি কিচ্ছু বুঝি না। হয়তো এইসব মেয়েরা রাতের অন্ধকারে মেক্সিকোতে তাদের গ্রাম ছেড়ে নদী পার হয়ে টেক্সাসে এসেছে, এসে মনের আনন্দে স্যান্ডউইচ বানিয়ে চলেছে দুপুর সন্ধ্যে। আর তাদের গ্রামের সীমানায় শুকনো ঘাসের প্রান্তরে দাবানল লেগেছে একমাস হল, তার ধোঁয়া উড়ে এসে অন্ধকার করে দিচ্ছে টেক্সাসের আকাশ।
আমার বেগেলের বৈশিষ্ট্য আছে। অন্য খরিদ্দাররা টোস্ট করিয়ে ক্রীমচীজ মাখিয়ে নিয়ে যায়, আমি আবদার করি মাখন মাখিয়ে (বেশি নয়, সামান্য) ভেতরে লেটুস আর টমেটো শুদ্ধু আমার বেগেলটা দিতে। ইংরেজিতে সে কথাটা বোঝাতে প্রথম প্রথম মুশকিল হত। তাছাড়া তাদের ধন্ধ লাগত দামের ব্যাপারে। আলোচনা করে তারা ঠিক করেছে বেগেলের দাম ৭৫ পয়সা দিলেই হবে, লেটুস টমেটো ফ্রী।
এই ভাবে টুপির নীচে খোঁপাবাঁধা এক নতুন আলন্তিকন্যা আমাকে চিনে ফেলেছে। আমি এলেই চিনতে-পেরেছি হাসি দিয়ে সে বেগেল কেটে টোস্টারে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর হিসেব করে কম মাখন লাগিয়ে মাঝখানে লেটুস টমেটো শুদ্ধু আমার বেগেল আমাকে দেয়। তার মনোসংযোগ দেখে মনে হয় স্যান্ডউইচ বানাবার কাজ এখনো তার রপ্ত হয়নি। একদিন তার নাম জিগ্যেস করেছিলাম। বলল, “অল্গা”। বাড়ি কোথায়? --মেক্সিকো।
অবাক লাগল। অল্গা নামটা স্প্যানিশ হয় জানা ছিল না। ধারণা ছিল, রাশিয়ান নামই বুঝি, যেটা কোন ভরাট বুকের রুশ যুবতীকেই মানায়। সেই কারণেই বোধহয় ওয়ার্নার কোম্পানী তাদের শৌখীন বক্ষবন্ধনীর নাম রেখেছে ওল্গা। মনে হল, অল্গা কি সেই কথা জানে? হয়তো জানে, হয়তো ছুটির দিনে সখীদের সঙ্গে আউটলেট সেন্টারে গিয়ে তার নামের দোকান দেখে এর ওর গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
জননী
কুকুরেরা হাসে না। সত্যজিৎ রায়ের লেখার সঙ্গে যারা বড় হয়েছে, তারা সবাই এ কথা জানে। কিন্তু টিমা কখন হাসছে, সেটা বাবা দেখেই বলে দিতে পারত। আমরা কেউ পারতাম না। এবং বলে দিয়েই বাবা টিমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করত, যেটা হাইফাইভেরই অন্তর্প্রজাতীয় সংস্করণ। হয়তো টিমা হাসত না, হয়তো হাসতে পারতই না, কিন্তু বাড়ির কর্তাকে ভজাতে হাসির ভান করত না, সেটা বলা মুশকিল।
টিমার একবারই বাচ্চা হয়েছিল। তার কিছুদিন পরে বাচ্চাদের বাবা জিমি কোথায় চলে গেল। টিমা খুব সতীসাধ্বী ছিল, অন্য কুকুরদের মতো না, সে আর সংসার করল না। টিমার পাঁচটা বাচ্চাকে আমরা বিলিয়ে দিলাম- ভাল ভাল ঘরেই। নতুন বাবা-মারা তাদের খুব ভালবাসত সে কথা চাক্ষুষ দেখেছি। তাদের কেউ কেউ যে তালেবর হয়েছিল সে কথাও সত্যি।
আমাদের বেড়ালসুন্দরী খুব লঘুচিত্ত মহিলা ছিল। নিজেরটা ছাড়া কিছু বুঝতো না, নৈতিকবোধও বেশ শিথিল ছিল। টিমার সঙ্গে স্বভাবে মিলত না একদম, সদ্ভাবও ছিল না। সুন্দরী বছরে চারবার বিয়োত, কিন্তু তুলোর বলের মতো চোখ-না-ফোটা বাচ্চাগুলোর দিকে ফিরেও চাইত না, দু্ধ খাওয়াত না, শুধু রান্না মাছের পিস্ আর নতুন বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করার তালে থাকত। টিমা সুন্দরীর এই ব্যবহার হতবাক হয়ে দেখত, এবং প্রথম প্রথম বকাঝকা করতেও শুনেছি। পরে অবশ্য হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
সুন্দরীর বাচ্চাগুলোকে মানুষ করত টিমা। তাদেরকে চেটে চেটে পরিষ্কার করে দিত, পোকা বাছত, খেলা করত নাক দিয়ে ঠেলে ঠেলে।
আমরা টিমাকে খ্যাপাতাম- সারাদিন বেড়ালদের সঙ্গে থেকে-থেকে বেড়ালই হয়ে গেছিস। টিমা কিচ্ছু বলত না, শুধু জিবটা ভেতরে রেখে মুখটা ফাঁক করত একটু, বাবা দেখে বলত, “ওই দেখ, টিমা হাসছে!”