• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬ | জুন ১৯৯৮ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • চীনা দেবদেবীদের গল্প : চৈতালী বসু

    অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মত, চীনদেশেরও ছিল এক কোটি দেবতা। পৃথিবীর মত স্বর্গেও ছিল সমাজ ব্যবস্থা। দেবতাদেরও ছিল রাজা, রানি, সেনাপতি। এক একজন দেবতা ছিলেন এক একটা বিভাগের দায়িত্বে। বেশিরভাগ বিভাগেরই কাজ মানুষের নানা সুখ-সুবিধে দেখা ও বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করা। তাই মানুষই দেবতাদের প্রধান প্রজা। মানুষ রাজাকে ও তার প্রজাদের সব সময় খুশি রাখতে হয় দেবতাদের। চীনেরা বিশ্বাস করে যে সব দেবতাই কোন এক সময় মানুষ ছিলেন; মানুষ জন্মের পুণ্যের পুরস্কার হিসেবে তাঁরা স্বর্গের চিরস্থায়ী আসন পেয়েছেন। তাই প্রত্যেকটা দেবতারই একটা মানুষ জন্মের গল্প আছে।

    রাজরাজড়াদের গল্পের মতই শুরু করা যাক চীনা দেবতাদের কথা। এক কোটি থেকে বেছে মাত্র কয়েকজন ক্ষমতাশালী দেব-দেবীর কথা বলছি। স্বর্গের সবচেয়ে শক্তিশালী তিনমূর্তি হলেন- জেড সম্রাট, তাও চুন ও লাও সু। জেড সম্রাট হলেন দেবতাদের সম্রাট। তিনি একাধারে দেবতা ও মানুষ, সবার কাজের ওপর নজর রাখেন। প্রতি বছরের শেষ দিনে দেবতাদের তাঁর দরবারে উপস্থিত থেকে নিজেদের কাজের হিসেব দিতে হয়। তার ভিত্তিতে জেড সম্রাট তাদের পুরস্কার দেন। পৃথিবীর রাজাদের কাজের হিসেবও সম্রাট রাখেন। যদি কোন রাজা ও তার পারিষদ তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন- তাহলে জেড সম্রাট সেই রাজ্যকে শাস্তি দেন- দুর্ভিক্ষ, মহামারী, বন্যা, ভূমিকম্প, সূর্যগ্রহণ- এরকম নানা হাতিয়ার প্রয়োগ করে। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায় ও রাজা সিংহাসনচ্যূত হন। এরই মধ্যে প্রজারা নতুন রাজা নিয়োগ করে আর জেড সম্রাট সেই রাজাকে আশীর্বাদ করেন স্বর্গ থেকে।

    অনেক দিন আগে চিঙ তি নামে ভারী ভালো রাজা ছিল। রাজার ঘরে এক রাজপুত্র এলো। জন্মাবামাত্র তার রূপের ছটায় চতুর্দিক আলোকিত হয়ে গেল। রাজপুত্র আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। সে যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি দয়ালু। রাজার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসে সে হুকুম দিল রাজভাণ্ডার খুলে দেওয়ার। গরীব দুঃখী সবাই প্রাণ ভরে ধনদৌলত পেয়ে রাজাকে ধন্য ধন্য করল। কিছু দিন রাজ্যশাসনের পর রাজার মনে হল এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের আসল মানে কী? তিনি রাজ্যের দায়িত্ব নিজের মন্ত্রীদের হাতে দিয়ে, দুর্গম পর্বতে চলে যান তপস্যা করতে। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে আর সংযম ও গুণে মুগ্ধ হয়ে দেবতারা তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যান তাঁদের সম্রাট করে। চীনেরা বিশ্বাস করে যে যখনই পৃথিবীতে অনাচার বেড়ে যায়- জেড সম্রাট জন্ম নেন তাদের রক্ষা করতে আর সহনশীলতা শেখাতে। চীনেদের কাছে জেড হল পুরুষশক্তি বা ইয়াং-এর প্রতীক। তাই জেড সম্রাট মূলত পৌরুষ প্রতিমূর্তি। পরের দিকে তার সঙ্গে মুকপাও-ও (যা কিনা নারী বা ঈণ্‌-এর প্রতীক) জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

    স্বর্গের রাজার সৈন্যের ভার নেবার জন্য সেনাপতি দরকার। দেব সেনার সেনাপতির নাম কুয়ান তি। তি শব্দের মানে আবার রাজাও। মানুষের কাছে ইনি যুদ্ধের দেবতা। চীন দেশে এনার চেয়ে জনপ্রিয় আর কেউ নেই। সমস্ত বাড়ি ও মন্দিরে এই দেবতার মূর্তি থাকে দরজার দিকে মুখ করে। চীনাদের বিশ্বাস যে কুয়ান তি যেখানে উপস্থিত থাকবেন সেখানে মানুষ তো কোন ছার কোন অশরীরী আত্মাও আসতে পারবে না। কুয়ান তির পূজো হয় মূলত দ্বিতীয় চন্দ্রের পঞ্চদশ দিনে ও পঞ্চম চন্দ্রের ত্রয়োদশ দিনে। সৈন্য, পুলিশ ও সমস্ত গুপ্ত বাহিনীর আরাধ্য দেবতা কুয়ান তি। গল্প আছে এনার স্মৃতি শক্তি ছিল অসাধারণ। যে কোন বই একবার পড়েই পুরো বইটা মুখস্থ বলতে পারতেন। তাই এনাকে সাহিত্যেরও দেবতা বলা হয়। কুয়ান তির মুখের রং লাল। এই লাল রঙের উৎস জানতে হলে আমাদের তার মানুষ জন্মে যেতে হবে।

    বহুদিন আগে ইউন্‌ চ্যাঙ নামে একটা খুব ভাল ছেলে ছিল। একদিন গ্রামের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ইউন্‌ কাছের একটা বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ শুনে কৌতূহলী হয়ে বড়ির মধ্যে যায়। গিয়ে দেখে এক বৃদ্ধ ও তার পরমা সুন্দরী মেয়ে দুজনে বসে অঝোরে কাঁদছে। কারণ জিজ্ঞেস করে ইউন্‌ জানতে পারে যে গ্রামের রাজ কর্মচারীর কাকা এই মেয়েটাকে তার রক্ষিতা করতে চায়। মেয়েটা একজনের বাগদত্তা জানানোর পরও সেই কর্মচারী নানাভাবে তাদের বাপ-মেয়েকে বিরক্ত করেছে। এই কথা শুনে ইউন্‌ রাগে অন্ধ হয়ে খোলা তলোয়ার নিয়ে সেই রাজ কর্মচারীর বাড়ি গিয়ে তাকে ও তার কাকা দুজনকেই মেরে ফেলে। কিন্তু এরপর রাজার সিপাহিরা তাকে সমাজবিরোধী বলে ঘোষণা করে। তখন আর উপায় না দেখে ইউন্‌ পর্বতের রাস্তায় পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখানকার সৈনিকদের কী করে চোখে ধুলো দেবে ভাবতে ভাবতে ইউন্‌ ঝরনার জলে মুখ ধুতে গিয়ে দেখে যে তার মুখের রঙ বদলে লাল হয়ে গেছে। রক্ষীদের কাছে সে নিজের নাম বলে কুয়ায়ন; ওই তুয়ান কুয়ান পর্বতের অনুকরণে।

    যে-কোন মন্দিরে কুয়ান তির পাশে তার দুই ভাই লিউ পেঙ ও চ্যাঙ ফেঈকেও দেখা যায়। এঁদের তিনজনের পরিচয় হয় মর্তেই। গোটা চীনে তখন প্রবল প্রজাবিক্ষোভ চলছে। দলে দলে তরুণ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে ‘হলুদ পাগড়ি’ দলে যোগ দিচ্ছে। দৈবক্রমে এদের তিনজনের পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তারা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলে যে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য একই। নিজেদের বন্ধুত্বকে আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধতে, তারা একটা পীচ গাছকে সাক্ষী রেখে- একটা কালো ষাঁড় ও একটা সাদা ঘোড়া বলি দিয়ে- পরস্পরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়ে। এই তিনজন লোকই হল কুয়ান তি, লিউ পেঙ ও চ্যাঙ ফেঈ। লিউ পেঙ ছিল এক রাজকুমার। তাকেই বড় ভাইয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। শারীরিক দিক থেকে দুর্বল হলেও লিউ ছিল সব রাজসিক গুণের অধিকারী। কুয়ান হল মধ্যম ভ্রাতা। তখন সে তো সমাজবিরোধী হয়েই গেছে। কিন্তু তার মত বিশ্বস্ত লোক তখন চীন দেশে আর দুটি মেলে না। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দেখে বহু লোক সহজেই মুগ্ধ হত। চ্যাঙ ছিল সবচেয়ে ছোট ভাই। বাড়ি থেকে চলে আসার আগে তার একটা কসাইখানা ও একটা ভাটিখানা ছিল। সে খুব পেটুক ছিল আর সুরার নেশা চড়লে তো আর কথাই নেই। কিন্তু নৈতিকতায় তার সঙ্গে পাল্লা দেবে এমন লোক মেলা ভার।

    কুয়ানের বীরত্বের গল্প যুগ যুগ ধরে লোকে মুখে ফেরে। নিজের মেয়ের বিয়ে উ রাজকুমারের সঙ্গে দিতে অস্বীকার করায় উ-রা তাকে লোক লাগিয়ে বিষাক্ত তীর দিয়ে বিদ্ধ করে। গল্প আছে চিকিৎসক যখন তার হাত কেটে সেই তীর বার করছিল, কুয়ান নাকি তখন অন্য হাত দিয়ে তার সঙ্গীদের সঙ্গে দাবা খেলছিলেন। তিনি কোন যন্ত্রণাই অনুভব করেননি। একবার তাঁর শত্রুরা তাঁকে নেমতন্ন করে, খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয় মারার জন্য। সব ষড়যন্ত্র জানতে পেরেও কুয়ান একা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান। তাঁর সাহস দেখে শত্রু তাঁকে মারার সংকেত দিতে ভুলে যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই হঠকারিতার জন্যই কুয়ান শত্রুর হাতে ধরা পড়েন ও তাঁর গর্দান নেওয়া হয়। তারপরই দেবতারা তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যান দেবসেনার সেনাপতি করে।

    কুয়ান তি যেমন শক্তি, বিশ্বস্ততা ও সততার প্রতিমূর্তি, তেমনি লিউ পেঈ হলেন মানবতা, ধৈর্য ও রাজসিক গুণের অধিকারী। লিউ-এর জায়গা মাঝখানে কারণ তাঁর কাঁধেই স্বর্গের নিয়ম রক্ষার দায়িত্ব। তাঁর একদিকে কুয়ান গ্রীষ্ম শক্তির দায় নিয়ে ও অন্যদিকে চ্যাঙ শীতের শক্তির ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

    চীনের প্রাচীনতম দেবতা হলেন পাদ-তাই। প্রায় চার হাজার বছর আগে এনার আবির্ভাব। পৃথিবী যখন পাপে ডুবে যায়, তখন পাদ তাই আসেন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করতে। ইনিও স্বর্গের সেনার অধিনায়ক বলে অনেকে এনাকে কুয়ান তি’র সঙ্গে গণ্ডগোল করে। বহুদিন আগে একটা বিশাল কচ্ছপ আর একটা বিরাট সাপ স্বর্গ আক্রমণ করলে পাদ তাই তাদের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ করেন ও হারিয়ে দিয়ে শেষে মেরে ফেলেন। যুদ্ধের শেষে দেবতারা তাকে ‘উত্তরের সম্রাট’ উপাধি দিয়ে ধ্রুবতারাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কী করে পাদ তাই প্রথম স্বর্গে গেলেন তা নিয়ে নানা মানুষের নানা মত।

    একটা গল্প অনুযায়ী মানুষ-জন্মে পাদ তাই ছিলেন এক সন্ন্যাসী যিনি সত্যের সন্ধানে পাহাড়ে তপস্যা করতে গিয়েছিলেন। তপস্যার জেরে অমরত্ব লাভ করলে দেবতারা তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যান। আরেকটা গল্প অনুযায়ী তাঁর নাম ছিল লী। একদিন ঝরনায় পা ধুতে ধুতে স্বর্গ থেকে তাঁর ডাক আসে ওই কচ্ছপ আর সাপের সঙ্গে যুদ্ধের সেনাপতিত্ব করার জন্য। আবার আরেকটা গল্প অনুযায়ী লী’র জন্মের পরই তাঁর বাবা-মা মারা যান। অনাথ শিশুকে মাসি মানুষ করত। লী মোটে চান করতে চাইত না। একদিন সে হঠাৎ বায়না ধরে তার মাসিকে জল এনে দিতে হবে চানের জন্য। চান হয়ে গেলে সে তার মাসিকে জলটা ফেলতে বারণ করে। বোনঝির ছেলেমানুষিতে পাত্তা না দিয়ে মাসি জলটা বাড়ির বাইরে একটা খানায় ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পরে বাইরে হইচই শুনে বেরিয়ে এসে দেখে পড়শিরা সব সেই খানা থেকে সোনা তুলছে। মাসি নিজেও কয়েকটা সোনার টুকরো কুড়িয়ে নেয়। তার বোনপোর ক্ষমতা বুঝতে পেরে দৌড়ে তার ঘরে এসে দেখে সে আর নেই। লোকে বলে তখনই পাদ তাই স্বর্গে চলে যান।

    এবার দেবীদের গল্পে আসা যাক। দেবীদের মধ্যে সবচেয়ে পুজো পান কুয়ান ইন। কুয়ান ইনের মূল কাজ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করা। সন্তান ও ভালোবাসার প্রতীক এই দেবী। ইনি বসে থাকেন পদ্ম ফুলের ওপর- এক হাতে একটা কলসি ও অন্য হাতে একটা উইলো গাছের ডাল নিয়ে। দেবীর সঙ্গে আরও দুজন সেবিকা- সেন সাই জোড়হাতে এনার আরাধনা করছে আর লুঙ নু একটা মুক্তো হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কুয়ান ইন-এর বাহন হল একটা ময়ূর। পদ্ম আর উইলোর ডাল দু’টোই সৌন্দর্যের প্রতীক। উইলোর ডাল আবার দুর্ভাগ্য সরিয়ে রাখার কাজও করে। মৃতপ্রায় রোগীর বিছানার পাশে কুয়ান ইনকে অনেকেই দেখেছে- কলসি থেকে মৃতসঞ্জীবনী ছড়িয়ে দিচ্ছেন উইলো ডাল দিয়ে রোগীর ওপর। রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে শীগগিরই। মুক্তো হল নারীশক্তি বা ইন-এর প্রতীক। তাই প্রেম ভালোবাসা- সব সুন্দর অনুভূতির দেবী ইনি। মানুষ জন্মে ইনি ঠিক চীনের মূল ভূখণ্ডের অধিবাসী ছিলেন না। বর্মা, ভারত বা কম্বোজের সীমানার একটা ছোট রাজ্যের রাজার কোন সন্তান ছিল না।

    অনেক যাগযজ্ঞের পর রাজার তিনটি কন্যা হয় পর পর তিন বছর। রাজা ঠিক করলেন যে তিন জামাতার মধ্যে যোগ্যতমকে তিনি রাজ্য দিয়ে যাবেন। কিন্তু রাজার ছোট মেয়ে মিয়াও স্যান সেই ইচ্ছেতে বাধ সাধল। মিয়াও বিয়ে করতে রাজি নয়। সে তার জীবন সমাজের কাজে নিয়োগ করতে চায়। অনেক বাকবিতর্কের পর মিয়াও বলে যে সে বিয়ে করতে রাজি, তবে বিয়ে করবে কোন চিকিৎসককে যে নিজের জীবন মানুষের সেবায় নিয়োগ করেছে। এরকম জামাতা দিয়ে কোন লাভ নেই দেখে রাজা শেষ পর্যন্ত মিয়াওকে সংঘে যেতে দিতে রাজি হন। রাজার হুকুমে সংঘের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলো তাকে করতে হয়। কিন্তু দেবতারা পশুপাখিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তার কাজের বিরাট অংশ করে দিতেন। এই খবর পেয়ে রাগে রাজা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে হুকুম দিলেন সংঘে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার। মিয়াও অবশ্য শেষপর্যন্ত দেবতাদের সাহা্য্যে সংঘকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। কিন্তু নিজের বাবার এই ব্যবহারে দুঃখে ঘেন্নায় মিয়াও আত্মহত্যা করে। দেবতারা তখন মিয়াওকে একটা সুন্দর দ্বীপে নিয়ে যান। দ্বীপের চতুর্দিকের সমুদ্রে ছিল ড্রাগন রাজার প্রাসাদ। একদিন একটা জেলের জালে ড্রাগন রাজের তৃতীয় কুমার ধরা পড়ে। এই খবর পেয়ে মিয়াও লোক পাঠিয়ে জেলের কাছ থেকে রাজকুমারকে কিনে নেয় ও সমুদ্রে ছেড়ে দেয়। কৃতজ্ঞ হয়ে ড্রাগন রাজ একটা অতি মূল্যবান মুক্তো দিয়ে নিজের নাতনি লুঙ নু-কে পাঠান মিয়াও-এর কাছে। মিয়াও-এর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে লুঙ তার কাছেই থেকে যায়।

    চীনের বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলের মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী হলেন তিন হাউ। তিন হাউ নাবিকদের দেবী। মানুষ জন্মে ইনি ছিলেন এক নাবিক কন্যা। একদিন তার বাবা ও ভাইরা সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। ঘরে বসে তখন হঠাৎ তিন-এর ভর হয়। ভরের মধ্যে ছোট্ট মেয়েটার আত্মা সমুদ্রে গিয়ে তার ভাইদের নৌকোতে বসে একটা একটা করে তাদের পথ দেখিয়ে ফিরিয়ে আনে। তিন-এর মা মেয়ের অচৈতন্য অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে তাকে ঝাঁকানি দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন।

    তখনও সে তার বাবার নৌকোটাকে ফিরিয়ে আনেনি। তিন-এর বাবা সমুদ্র থেকে আর ফেরেননি। এরপর থেকে সব নাবিক ও জেলেরা তাকে পুজো করে প্রত্যেকবার সমুদ্রে যাবার আগে তাদের রক্ষার জন্য। তিন হাউকে অনেকে তাও মোউ-এর আরেক রূপ বলে। তার কারণ স্বর্গের রানির পদে আমরা দু’জনকেই সময় বিশেষে পাই। মানুষ জন্মে তাও মোউ ছিলেন এক পরমা সুন্দরী কন্যা। জ্যোতির্বিদ্যায় ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। লোকে বলে তিনি নাকি জলের ওপর হাঁটতে পারতেন, পা না-ভিজিয়ে। বহু দূর দূর রাজ্যে তাঁর রূপ ও গুণের খবর ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর প্রশংসার খবর শুনে চীনের সম্রাট তাঁকে বিয়ে করেন। কালক্রমে তাঁদের ন’টা সুন্দর রাজপুত্র হয়। মৃত্যুর পর স্বর্গ থেকে দেবতারা তাঁকে আমন্ত্রণ জানান তাদের রানির পদ অধিকার করার জন্য। তাঁর বাসস্থান ঠিক হয় ধ্রুবতারা। এই দেবীর তিনটে চোখ আছে। তৃতীয় চোখ দিয়ে ইনি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- সব দেখতে পান। তাও মোউ-এর আরাধনা করে নিজেদের আয়ু বাড়িয়েছে এরকম অনেক লোক আছে। তাঁর ছেলেরাও মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়ে ধ্রুবতারার আশপাশের তারাগুলোতে বাস করে।

    চীনের ধর্ম বলতে আমরা মূলত বৌদ্ধ, তাও ও কনফুসিয়াসই জানি। কিন্তু এই তিনটে ধর্মের কোনটাতেই কোন দেব-দেবী থাকার কথা নয়। অথচ অত পুরনো একটা সভ্যতার কোন দেবতার প্রয়োজন হয়নি- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সুখ দুঃখ- এ সবের ভাগ ও ভার নিতে? ভাবতে আশ্চর্য লেগেছিল। খুঁজতে গিয়ে দেখলাম অন্যান্যদের মত চীনেরও অনেক দেব-দেবী ছিল। পরের ধর্মগুলো বেশ কয়েকজন দেব-দেবীকে নিজেদের মন্দিরে জায়গা দিয়েছে। বাধ্য হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের জনপ্রিয় করাতে। তাও হামেশাই কুয়ান তি, জেড সম্রাট বা কুয়ান ইন-কে বৌদ্ধ স্তূপে বা তাও মন্দিরে বা কনফুসিয়াস মন্দিরে পাওয়া যায়। একাধিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এই দেব-দেবীরা কোন বিশেষ ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে চীনের দেব-দেবী হয়েই বেঁচে আছেন।


    তথ্যসূত্রঃ Chinese Gods, Jonathan Chamberlain; Pelanduk Press

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments