যখনকার কথা বলতে যাচ্ছি, তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছ বছর। আমার ভাই আরো ছোট আর আমার বোনের তখন চোখ ফোটেনি বললেই চলে। সারাদিন সে কাঁথার মধ্যে শুয়ে শুয়ে যা হাতের কাছে পায় তাই ধরার চেষ্টা করে। সেই সময়টা আমরা সবাই—বাবা, মা, ভাই-বোনেরা আমার দাদুর বাড়িতে ছিলাম। সেখানে আমার দাদু, দিদা ছাড়াও দুই মাসি সারাক্ষণ আমাদের তিন ভাই-বোনেদের কী করে খুশি রাখা যায় তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।
আমার দাদুর বাড়িতে যে শুধু আমাদের ছোটদের আবদার চলতো তা নয়, আমার বাবার আবদারের সীমা ছিল না। বাবার যখন যা ইচ্ছে বাবা তাই করে বেড়াতো, কেউ বাধা এবার ছিলো না। বাধা দিতে গেলে দাদু চোখ পাকিয়ে বলতো- “অ্যাই, সঞ্জিতকে কেউ কিছু বলবে না!”
একদিন রবিবার সকালে চেঁচামেচিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কীসের এত চেঁচামেচি দেখার জন্য বারান্দায় বেরিয়ে দেখি বাড়ির উঠোনে একটা মস্ত গরু ও তার পাশে একটা ছোট বাছুর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে আমার মনে হল স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু যখন ভাই আমার হাত ধরে বললো- “দিদি, দ্যাখ কত বড় গরু,” তখন বুঝলাম যা দেখছি সবই সত্যি। রোগা, সাদা রঙের গরুটা আর তার বাচ্চাটাকে দেখলেই বোঝা যায় যে তারা গরীব ঘর থেকে এসেছে। বাছুরটা তো এত রোগা যে মাঝে মাঝে চার চারটে পা বেঁকে গিয়ে সে পড়ে যাচ্ছে। বাড়ির সবাই বর-কনে দেখার মত তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমার বাবা একটা বিরাট কানা-উঁচু থালায় গুড় আর ছোলা সিদ্ধ ঢালছে।
আমার দুই মাসি হইহই করে উঠে বললো- “জামাইবাবু, গরু আবার ছোলা, গুড় খায় নাকি? ওদের খড়, ঘাস এসব খাওয়াতে হয়!”
আমার বাবা উত্তর দিল- “দ্যাখো, যার কাছ থেকে কিনেছি সে বলেছে প্রতিদিন সকালে ছোলা, গুড় খাওয়ালে গরু ভালো দুধ দেবে। ভেবে দ্যাখো, প্রত্যেক দিনের জল মেশানো দুধ খাওয়া আজ থেকে শেষ হয়ে গেল।”
মা জিজ্ঞেস করলো- “বাছুরটাকেও কি কিনতে হল?”
বাবা হেসে গর্বের সাথে বললো- “আরে না, না ওটাকে ফাউ পেয়েছি। লোকটা পয়সার বেলায় সেয়ানা হলে কি হবে, মনে দয়া-মায়া আছে। নিজেই বললো- বাবু, মাকে নিয়ে যাচ্ছেন, বাচ্চা বাছুরটা একা কী করে থাকবে? ওটাকেও নিয়ে যান। আমি আর না করি? মনে মনে ভেবে দেখলাম বড় হলে এটাও দুধ দেবে।”
বাবার কথা শেষ হতে না হতেই ছোট মাসি চিৎকার করে উঠে বললো- “কী যে বলেন জামাইবাবু, এটা তো দেখছি এঁড়ে বাছুর! দুধ দেবে কি? বড় হলে তো এটা ষাঁড় হবে! আপনাকে বোকা পেয়ে একটা ষাঁড় গছিয়ে দিয়েছে।”
বাবা কোন কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো- “যে যাই বলো, আমি আর মাথা ঘামাতে চাই না। এখন আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক দিন গরুর তাজা দুধ খেয়ে শরীর ভালো করা।”
আমার দাদু, দিদা কিন্তু বাবার খুব প্রশংসা করলো। বাবাই নাকি শুধু এই বাড়িতে সকলের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবে, আর কেউ ভাবে না। এত কাণ্ডের মধ্যে গরুটা আর তার বাছুর কারো দিকে না তাকিয়ে একমনে ছোলা-গুড় খাচ্ছিল। তাদের খাওয়া শেষ হলে বাবা বললো—“চলো গৌরী, কার্তিক, তোমাদের থাকার ঘর দেখিয়ে দিই।”
বাড়ির পিছনে একটা ভাঙ্গা মত ঘর ছিল। তার মধ্যে একটা চৌবাচ্চাও কেন জানি না ছিল। সেখানে আমরা ছোটরা লুকোচুরি খেলবার সময় ছাড়া বিশেষ যেতাম না। কারণ সেখানে কয়লা, ঘুঁটে আর কী কী সব রাখা হত বলে একটা পচা পচা গন্ধ বেরোত। সেখানে নিজের গৌরী-কার্তিককে নিয়ে বাবা চলে গেল।
মা আর মাসিরা এই ব্যাপারে একটুও খুশি হয়নি। কিন্তু দাদু-দিদার সামনে বাবাকে আরো কিছু বলার সাহস ছিল না। তাই কিছু বলল না। তবে সবাই যখন বাড়ির ভিতরে চলে গেল তখন মা আমাকে আর ভাইকে শাসিয়ে বলে দিল—“খবরদার, আজ থেকে বাড়ির পিছনে আর কেউ একা যাবি না।”
বিকেল না হতেই দেখি বাবা একটা নতুন বালতি নিয়ে বাড়ির পিছনে চলে গেল আর আমাদের সবাইকে বলে গেল—“তোমরা গেলাশ হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে থাকো। এক্ষুনি এক বালতি দুধ নিয়ে আসছি।”
গরুর ঘরের দিকে যাওয়া বারণ বলে আমরা বারান্দাতেই বসে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম আর কান পেতে শুনতে লাগলাম বাবার “উফ্ আফ্” শব্দ। প্রায় পনেরো মিনিট পরে বাবা—“উফ্ উফ্। এ আমার দ্বারা কিছুতেই হবে না,” বলতে বলতে ফিরে এল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখলাম বাবার হাত ছড়ে গিতে রক্ত পড়ছে। দাদু সঙ্গে সঙ্গে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বসে গেল। বাবা বলল—“এরকম পাজি গরু কোথাও দেখিনি। এক ফোঁটা দুধ তো পেলাম না, উলটে লাথি মেরে হাত ফাটিয়ে দিল। আর একটা দিন সময় দিলাম। কাল সকালে যদি দুধ না পাই তাহলে এই গরুকে বিদায় করবো।”
দাদু-দিদা বাবাকে খুব সান্ত্বনা দিল আর আমার দুই মাসি হেসে গড়াগড়ি খেয়ে বললো—“যেমন কর্ম তেমনি ফল।”
পরের দিন সকালে বাবা কোমরে একটা গামছা বেঁধে আবার চললো বালতি হাতে দুধ আনতে। দাদুও তুলো ব্যান্ডেজ নিয়ে রেডি। সেদিনও আমার বারান্দায় বসে বসে শুনলাম বাবার উফ্ আফ্ শব্দ। তবে পনেরো কুড়ি মিনিট পরে দেখি বাবা লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলল—“দেখে যাও সবাই, আজ দুধ পেয়েছি!”
এক মিনিটের মধ্যে আমরা সবাই বালতির উপর ঝুঁকে পড়লাম দুধ দেখার জন্য। ওমা, দেখি বালতির সেই নীচে মাত্র এক গেলাশের মত দুধ পড়ে আছে! তাতেই বাবার কী আনন্দ! মাকে বলল—এক্ষুনি আবার বাবার প্রশংসা শুরু করে দিল। মা আর মা্সিরা আঁচল মুখে দিয়ে চাপা হাসি চাপার চেষ্টা করতে লাগলো। মেজো মাসি বললো—এই দুধ সবাইকে ভাগ করে দিতে হলে তো প্রত্যেকে এক ঝিনুক করে পাবে।”
যাই হোক আমাকে আর ভাইকে সেই দুধ গরম করে খেতে দেওয়া হল। খেয়ে এমন কিছু ভালো লাগেনি। বরং একটু যেন পচা পচা গন্ধ, যে রকম গন্ধ ওই গরুর ঘরটা থেকে পেতাম। ভাই আমাকে আস্তে আস্তে বলল—“দিদি, আমি এই দুধ খেতে পারবো না। তুই আমারটাও খেয়ে নে।” আমি বললাম—“নাক টিপে খেয়ে নে। নইলে বাবা দুঃখ পাবে।”
দুধ খাওয়া হলে বাবা হাসিমুখে জিজ্ঞস করল—“কী রে, কী রকম লাগলো খেতে?”
আমরা দুজনেই ঘাড় নেড়ে বললাম-- “খুব ভালো খেতে।”
আমার দুই মাসি হাসতে হাসতে বলল—“এই এঁড়ে বাছুরকে অন্য কোথাও রেখে না এলে এক গেলাশের বেশি দুধ কোনদিনও পাবেন না।” কিন্তু বাবা কোন কথায় কান না দিয়ে খুশি মনে অফিস যাবার জন্য তৈরি হতে লাগলো।
সেই দিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখি তুলকালাম কাণ্ড। ছোট মাসি ভীষণ রেগে তারস্বরে চিৎকার করছে। রাগটা আসলে সেই বাছুরের উপর। দুপুরে ছোটমাসির একটা দামি শাড়ি বারান্দায় শুকোচ্ছিলো। বাছুর সেটাকে চিবিয়ে অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে। বাবা বাড়ি ফিরতেই ছোট মাসির রাগ গিয়ে পড়লো বাবার উপর—“জামাইবাবু, আপনি বাছুরটাকে বেঁধে রাখেননি কেন?” বাবা সব শুনে টুনে বলল—“আসলে বাছুরটা এত রোগা বলে বাঁধতে সাহস পাইনি। আজ থেকে বেঁধে রাখবো।”
পরের দিন সকালে বাবা আবার এক গেলাশ দুধ পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে অফিস চলে গেল। সেই দিন বাছুরের গলায় দড়ি বাঁধা হয়েছিল বটে কিন্তু বাছুরটা অনায়াসে সেই দড়িটাই চিবিয়ে খেয়ে ফেললো। তারপর সুযোগ বুঝে একসময় উঠে এল বারান্দায়।
একটু পরে ছোট মাসি এসে দেখে সেখানে জুতোর উপর রাখা সব মোজা চিবিয়ে শেষ করছে কার্তিক। তাই না দেখে মা-মাসিরা যে কী হইহই করে উঠলো তা বলার নয়। মা আর মেজো মাসি “হ্যাট্ হ্যাট্” করে তাকে তাড়াতে লাগলো আর ছোট মাসি রাগ সামলাতে না পেরে রান্নাঘর থেকে মস্ত একটা কাঠের বেলুনী এনে দমদম পিটতে শুরু করলো বাছুরটাকে। অবাক কাণ্ড, এতে বাছুরটার কিছু তো হলই না, উলটে বেলুনীটা ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেল!
সেদিন বিকেলে বাবা ফিরতে, মা মাসিরা ভীষণ রাগারাগি করল। মা বলল—“এই বাছুর তো দেখতে দেখতে ষাঁড় হয়ে যাচ্ছে। এর পর বাচ্চাদেরকে গুঁতোবে না তা কি বলা যায়? আর গরুটাও কিছু দুধ দিচ্ছে না। তুমি যদি এদের বিদায় না করো তাহলে আমি বাচ্চাদের নিয়ে অন্য কোথাও থাকবো।”
বাবা আর কোন উপায় না দেখে তাই পরদিন সকালে যে লোকটার কাছ থেকে কিনেছিল তার কাছেই গৌরী-কার্তিককে ফেরত নিয়ে এল। পরে শোনা গিয়েছিল যে সেই লোকটা দাম ফেরত দিতে চায়নি বলে বাবাকে এমনিতেই গরু দিয়ে আসতে হয়।
আমাদের গৌরী-কার্তিক চলে যাওয়াতে মা-মাসিরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ছোট মাসি বললো—“জামাইবাবুর এই খামখেয়াল বন্ধ হওয়াতে আমাদের জামাকাপড়গুলো বাঁচবে।” অবশ্য আমার আর ভাইয়ের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যদিও দুধটা খেতে ভালো ছিলো না, তবুও বারবার মনে হচ্ছিল—বাড়িতে একটা গরু না থাকলে চলে? বাবাকে মনমরা দেখে দাদু-দিদা সান্ত্বনা দিয়ে বলল—“তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোরো না সঞ্জিত, সামনের মাসে পার্বতীপুরে গরুর হাট বসবে। সেখান থেকে এবার ভালো গরু নিয়ে আসবে।” বাবা কিন্তু আর উৎসাহ দেখায়নি গরু কেনার।
গৌরী-কার্তিক চলে যাওয়াতে উঠোনটা কিছুদিন ফাঁকা ফাঁকা দেখাতো। সেই ফাঁকা উঠোনে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো বাবা। তারপর আর কিছু করতে না পেরে শেষে একটা কুয়োই খুঁড়ে ফেললো।
কিন্তু সে তো আর এক গল্প…।