দুর্নীতি ব্যাজার মুখে বলল- “তাহলে আমার কী হবে?”
নেতা নিজের প্রাসাদোপম অট্টালিকার বলরুমের মত বিশাল বৈঠকখানার গদিতে হাঁটু মুড়ে বসে এক পা তুলে তার ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে, দুটো চোখই বুজে, মুখটা একটু বিকৃত করে কান খোঁচাচ্ছিলেন। দুর্নীতির কথায় পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে তার মুখের দিকে খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- “কেন, তোমার আবার কী হল?”
দুর্নীতি ঐরকম পাঁচন খাওয়া পাঁচের মত মুখেই জবাব দিল- “এবারে ভোটে তো আমার জায়গা হচ্ছে না।”
নেতা ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন, “কে বলল এ কথা?” - কে আবার বলবে, দেখতেই তো পাচ্ছি।
- কী দেখতে পাচ্ছ?
- এই যে। বুথ দখল ঠেকাতে আধা-সামরিক বাহিনী নামানো হচ্ছে, সচিত্র পরিচয়পত্র করা হচ্ছে, চরম নিরাপত্তার মধ্যে ব্যালট বাক্স রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কেন বাপু, ভোট হবে আর কারচুপি হবে না! এ যেন চান করব অথচ গা ভেজাবো না। এর পর হয়ত দেখবো কম্প্যুটারে ভোট গোনা হচ্ছে। এভাবে চললে আমার আয়ু আর কতদিন!
নেতা কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন- “তোমার কি আমার ওপর ভরসা নেই?”
কথাটায় কাজ হল বলে মনে হল। দুর্নীতি কিছুটা বিনীত হয়ে জবাব দিল- “আছে বলেই তো স্যার আপনার সঙ্গে লেপটে আছি, এক দণ্ডের জন্যেও আপনাকে কাছছাড়া করছি নে। আপনারাই তো আমার বল ভরসা। আজ যে এদেশে আমি শেকড় গেড়ে বসেছি, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমার ডালপালা এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছি যে সাধারণ মানুষও এর বাইরে যেতে না পেরে ক্রমেই আরো এদিক পানে আসছে, মানে আসতে বাধ্য হচ্ছে, সে তো স্যার আপনার এবং আপনার বাপ-ঠাকুর্দার জন্যেই। তাঁরাও তো স্যার আপনার মতই ধুরন্ধর, সরি, মানে দুঁদে আমলা ছিলেন।”
নেতা বললেন- “সামরিক বাহিনী বুথ দখল আটকাবে! হুঁহ! আমরা এবারে ওপথ মাড়াবই না। স্রেফ ভোটার কিনে নেব। তার তাতেও যদি কাজ না হয় তবে একেবারে প্রার্থীই কিনে নেব। অপনেন্ট পার্টিতে বিভীষণ তৈরি করে ভেতর থেকে ওদের দুমড়ে দেব।
- কিন্তু স্যার সচিত্র পরিচয়পত্র! ভুয়ো ভোটার আটকে যাবে।
- ফুহ্! ওটা একটা গাঁজাখুরি গপ্পো। অনেকটা রাবণের স্বর্গের সিঁড়ির মতন। এদেশের জনগণ তো রাবণেরই গুষ্টি, আর তাছাড়া এখানে প্রশাসন জনস্বার্থকে যতটা গুরুত্ব দেয়, জনগণ নিজে তার চেয়েও ঢের কম দেয়। আবার তারাই প্রশাসন জনস্বার্থের দিকে চায় না বলে চেঁচায়। কাজেই ওটা কোনদিনই ঠিক ঠিক হাতে পৌঁছোবে না। ওটাকে বাদ দাও।
- কিন্তু স্যার ভোট গোনায় কারচুপি--
- দূর দূর! আরে যত কড়া গার্ডই দিক, যে দেবে সেও তো মানুষ না কি? আর পয়সা ফেললে পালটি খায় না এরকম মানুষ কজন আছে? আচ্ছা তোমার কি নিজের ওপর থেকে বিশ্বাস-টিশ্বাস সব উঠে গেল নাকি?
দুর্নীতি জিভ কেটে বললো- “না, না স্যার কী যে বলেন।”
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার খানিকটা মনমরা হয়ে বলল- “কিন্তু স্যার, এবার নির্বাচনে তো আপনি আমাকেই ইশ্যু করেছেন।”
নেতা মুচকি হাসলেন- “সত্যি, তুমি দেখছি খোকাটি রয়ে গেলে। এটাও জানো না যে লোকটা মদ খাওয়ার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়, মরার আগের মুহূর্তেও তার মুখে মদের গন্ধ পাওয়া যায়।”
দুর্নীতিকে এবার কিছুটা উৎফুল্ল মনে হল। কিছু পরে সে বেশ রস ঢালা স্বরে বললো- “একটা কথা জিজ্ঞেস করব স্যার?”
- বল।
- বলছিলাম, এতদিন আমাকে কাজে লাগিয়ে একটার পর একটা “ওলা” মার্কা কেস বেশ সুন্দরভাবে নামিয়েছেন এবং তা থেকে দেদার কামিয়েওছেন। আবার সেগুলো ফাঁস হবার পর পর আমাকেই ঠিক ঠিক ইউজ্ করে পাঁকাল মাছের মত গলে বেরিয়ে এসেছেন। কেউ আপনার টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। তা এবারে স্যার কোন “ওলা”?
- এবার ওপরোলা।
- সেটা কী স্যার?
- রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কিন্তু ব্ল্যাকগ্রাউন্ড নেই, অর্থাৎ কোন স্ক্যাম নেই প্লাস কোন কারণে দেশের জনগণের সেন্টিমেন্ট পেতে পারে এমন কাউকে ওপরওলা করা, মানে ভাব করা যেন তিনি দলের হর্তাকর্তা। এই প্রার্থী কোন মহিলা হলে আরো ভালো হয়, তাহলে মেয়েদের ভোটটাও আরো বেশি করে পাওয়া যাবে। অবশ্য এদেশে মেয়েরা ভোট দেয় কমই আর বেশিরভাগ সময়ই তাদের দিয়ে ইচ্ছেমতন ভোট দিইয়ে নেওয়া যায়। তবে ব্যাপারটা ক্রমশই কমছে, কারণ লেখাপড়া শিখে মেয়েরাও নিজেদের মতামত দিতে জানছে। তবে তেমন দেখলে ভোটে নাম না তুললেই হল। যেমন এবারেই তো শহরের বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমের প্রায় পনেরো হাজার বিধবা মহিলার নাম তোলা হয়নি, কারণ ওদের স্বামী, ছেলে বা অন্য কোন লোকাল গার্জেন নেই যারা ওদের ভোট দেওয়া ইন্ফ্লুয়েন্স করতে পারে।
- বাহ স্যার বাহ! সত্যি আপনার দিমাগের তুলনা নেই।
আবার কিছুক্ষণ বিরতি। ফের দুর্নীতির গলা শোনা গেল। কেমন যেন আবদারের সুরে--
- আমার নামটা স্যার খুব বাজে। দুর্নীতি। শুনলেই কেমন যেন দূর-দূর ছাই-ছাই ভাব মনে আসে। এটাকে পালটানো যায় না?
নেতা খানিক্ষণ ভেবে বললেন- “নাম পালটানো তো সোজা নয়। আর তোমার নাম কেউ এফিডেভিট করে পালটাতে রাজি হবে বলেও মনে হয় না। কারণ তোমার নামটাই তোমার ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে। তবে নেহাতই যদি এটা পছন্দ না হয় তবে বরং তুমি পলিটিক্স বা বাংলায় রাজনীতি নামটা ইউজ্ করতে পারো। আসলে দুর্নীতি আর রাজনীতি তো এখন প্রায় সমার্থক।
দুর্নীতির চোখে-মুখে খুশির ছাপ লক্ষ্য করা গেল। কিন্তু সে সেটাকে বাইরে প্রকাশ না করে কিছুটা মনমরা ভাব দেখিয়েই বলল- “কিন্তু স্যার, আমার প্রতিপত্তি সেভাবে বাড়ছে না। এখন সব জায়গায় তেমনভাবে আমি গ্রহণযোগ্য নই। কিছু কিছু মানুষ এখনও আছেন যাঁরা আমাকে সহ্য করতে পারেন না, অসম্ভব ঘৃণা করেন। এ ব্যাপারে আপনাকে কিছু একটা করতেই হবে স্যার।”
নেতা দুর্নীতির দিকে একবার চোখ তুলে চাইলেন। তারপর শান্ত স্বরে বললেন- ‘এবারের ইলেক্শানটা ভালো ভাবে জিতিয়ে দাও। কথা দিচ্ছি তোমার দিকটা দেখবো।”