• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫ | এপ্রিল ১৯৯৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন : সুগতা সেন

    “মানুষ এই দুনিয়ায় আসে বিশেষ কালে ও বিশেষ সামাজিক পরিবেশে। ওই কাল ও পরিবেশের মধ্যেই তাকে নিজের জীবন গড়ে তুলতে হয় নিজের ইচ্ছা ও শক্তি অনুসারে। জীবনের খেলা শেষ হয়ে গেলে ফলাফল ও তার খেলার সাজসরঞ্জাম সবই চলে যায় ভবিষ্যৎ কাল ও সমাজের হাতে। ভবিষ্যতের উপর তার আর কোনো অধিকারই থাকে না, থাকতে পারে না। যে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তার আবার অধিকার কি?

    সমাজনিরপেক্ষ কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা মানুষের থাকে না। মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক সত্তারূপেই তার উদ্ভব, বিকাশ ও পরিণতি। সামাজিক সত্তা হিসেবেই এক-একজনের যে বিশিষ্ট রূপ, তাকেই বলি তার ব্যক্তিত্ব। মানুষের পক্ষে বিশেষতঃ অল্প বয়সে তার পারিবারিক সত্তাও সামাজিক সত্তায় উত্তরণের পাদপীঠ মাত্র। তার পরিণতি সামাজিক সত্তাতেই। মানুষ একান্তভাবে পারিবারিক জীবমাত্র নয়। সে আসলে সামাজিক জীব। আমাদের জীবনের খেলাটা আসলে সমাজেরই খেলা। এ খেলায় যে সব সাজসরঞ্জাম (যাকে লোকে বলে বিষয়সম্পদ) লাগে তাও পাই সমাজের কাছেই। তাই খেলাশেষে সেই খেলনাগুলিও ফিরিয়ে দিতে হবে সমাজকেই। আর সারাজীবনের খেলার যা ফলাফল (চলতি কথায় যাকে বলা হয় কর্মফল) তাও তো স্বভাবতঃই সমাজেরই প্রাপ্য। এই নীতিকে আমি স্বীকার করে নিয়েছি আমার কর্মজীবনের প্রথম পর্বেই। তখনই মনে মনে যে সংকল্প করেছিলাম আজও তাতে অবিচল আছি।”

    “আমার অন্তিম ইচ্ছাপত্র”
    --প্রবোধচন্দ্র সেন


    ছান্দসিক, ইতিহাসবিদ ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন-এর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে ১৩০৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। শিক্ষিত বাঙ্গালী সমাজে তাঁর খ্যাতির কারণ বাংলা কাব্য ছন্দের গবেষণায় তাঁর অমূল্য অবদানের জন্য। তাঁর মনন অবশ্য ছন্দের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্নদাশংকর রায়ের ভাষায় প্রবোধচন্দ্র ছিলেন “ফরাসীতে যাঁদের বলা হয় savant তাঁদেরই একজন। …তাঁরা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা তো করতেনই, তাঁদের জীবন দর্শন ছিল তাঁদের মনোনীত সাধনায় মগ্ন থেকে নিঃস্বার্থ ভাবে জগতের জ্ঞান বর্ধন করা।”

    পিতা শ্রী হরিদাস সেন ও মাতা শ্রীযুক্তা স্বর্ণময়ী দেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেনের জন্ম ১৫ বৈশাখ ১৩০৪ (২৭ এপ্রিল ১৮৯৭) বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ত্রিপুরা জিলার কুমিল্লা শহরের অনতিদূরে তাঁর মামাবাড়ি ‘মনিয়ন্দ’ নামে এক অখ্যাত গ্রামে। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাসও ত্রিপুরা জিলারই ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অন্তর্গত ‘চুনটা’ গ্রামে। কর্মোপলক্ষ্যে তাঁর পিতা কুমিল্লা শহরেই বাস করতেন বলে প্রবোধচন্দ্রের বাল্য, কৈশোর, যৌবন কেটেছে কুমিল্লাতেই।

    পাঁচ বছর বয়সে ‘হাতেখড়ি’ হবার পর পিতা তাঁকে ভর্তি করে দেন ‘গিরিধারী পাঠশালা’য়। সেখানে এক বছর পড়বার পর ভর্তি হলেন ইউসুফ হাই ইংলিশ স্কুলে। অল্প বয়স থেকেই জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে এবং সে জ্ঞানপিপাসার ক্ষেত্র পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বহুদূরে ব্যাপ্ত হতে থাকে। তবে পাঠ্য বিষয়ের প্রতি অনীহা বা অবহেলা কখনও প্রকাশ পায় নি। ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও বৃত্তি পান। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯২০ খৃষ্টাব্দে আই.এ., ‘শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজ’ থেকে ১৯২৪ খৃষ্টাব্দে ইতিহাসে অনার্স-সহ বি.এ. এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ খৃষ্টাব্দে ‘প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বিষয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে এম.এ. পাশ করেন। তবে, প্রথমাবধি সকল পরীক্ষাতেই কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যে প্রবোধচন্দ্রের অসাধারণ চারিত্র্যের পরিচয় নিহিত নেই। সে পরিচয় আছে অন্যত্র।

    সুদুর্লভ মনোবল ও সুদৃঢ় চারিত্র্যশক্তির অধিকারী প্রবোধচন্দ্র নিজের জীবন নিজে গড়ে তুলেছিলেন--একজন যথার্থ self-made man. তাঁর মানসিক স্বাতন্ত্র্য বাল্যবয়স থেকে সুপরিস্ফুট হতে থাকে--তাই পণ্ডিতমশাই-এর বহু বেত্রাঘাতও তাঁকে দিয়ে পড়া মুখস্থ করাতে পারেনি। অথচ স্বীয় পদ্ধতিতে নানা প্রচলিত প্রথা ও পদ্ধতির নির্বিচার স্বীকৃতির প্রতিবাদ করে এসেছেন। বিচারহীন শক্তির বশ্যতা কখনই স্বীকার করেন নি। পারিবারিক, মানসিক, ও শারীরিক বহু প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন একা, কঠোর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে আত্মগঠন করেছেন--কারো কাছে নতি স্বীকার করেন নি। তাঁর সমগ্র ছাত্রজীবনই কঠিন সংগ্রামের ইতিহাস। আর্থিক অভাববশতঃ ছাত্র পড়িয়ে, খবরের কাগজে কম্পোজিটারের কাজ করে আধপেটা খেয়ে, ডাক্তারের চেম্বারের খালি বেঞ্চে রাত্রি কাটিয়ে পড়াশোনা চালিয়েছেন--কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাতেন নি। সবচেয়ে লক্ষণীয় যে কেবল নিজের জীবন বা জীবিকা নিয়েই তিনি মেতে থাকেন নি, অনুজ ভ্রাতাদের তথা খুড়তুতো পিসতুতো ভাইদের এমন কি সহপাঠীদের পথনির্দেশ করা, অধ্যয়নে অনুপ্রেরণা যোগানোর ভার তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে তাঁদের পরিবারের বাইরেও যেন একটি ‘institution’ তৈরী হয়েছিল।

    অবশ্য আধিভৌতিক জীবন গঠনে কৃচ্ছ্রসাধন বা সংগ্রামের নজির কোনো কালেই বিরল নয়। প্রবোধচন্দ্রের জীবনে যথার্থ যা লক্ষণীয় তা হল তাঁর মানসজীবন। এই মানসজমিনের কৃষক তিনি নিজেই। কোনো প্রত্যক্ষ friend, philosopher বা guide তাঁকে পথ দেখান নি। জীবনের পথে চলার পাথেয় তিনি নিজেই সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। তাঁর উক্তি তুলে দিই--

    পৃথিবীর বুকে আমার আবির্ভাব ১৩০৪ সালের ১৫ বৈশাখ (ইং ১৮৯৭ এপ্রিল ২৭) তারিখে। কিন্তু সে তো আমার জৈব জীবনের কথা। আমার দ্বিতীয় জন্মের তারিখ ১৩১২ সালের ৩০-এ আশ্বিন (১৯০৫ অক্টোবর ১৬)। সেদিন থেকেই আমার মানস জীবন আরম্ভ। আমার চোখ ফুটে গেল স্বদেশের আলোয়। প্রথম জন্মের পর যে আলোয় চোখ মেলেছিলাম সে তো ছিল জাগতিক আলো, সে আলোয় আমার চোখ জুড়িয়েছিল কি না জানি না। কিন্তু ১৩১২ সালের ৩০-এ আশ্বিন তারিখে চোখ মেলে যে আলো দেখলাম সে ছিল আমার স্বদেশের আলো। সে দিনকে স্মরণ করে আমি সত্যি বলতে পারি- ‘আঁখি মেলে তোমার আলোয় প্রথম আমার চোখ জুড়ালো।”

    সেই দিনটিতে তাঁর মামাবাড়িতে অরন্ধন ও রাখীবন্ধন উৎসব উদযাপিত হয়। আট বৎসরের বালক প্রবোধচন্দ্রও বড়দের সঙ্গে সারাদিন উপবাসী রইলেন। বিকেলে বাড়িতে যে সভা হল, সেখানে তিনি আবৃত্তি করলেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’- বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঐ ঐক্যমন্ত্রটি। সেই দিনটির বক্তৃতার প্রত্যেকটি শব্দ, এই বিশেষ গানটির প্রতিটি ধ্বনি তাঁর মর্মে অমনভাবে গাঁথা হয়ে গেল, যে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তা অম্লান রইল। “সেই আমার দ্বিতীয় জন্মদিনে আমি ভূমিষ্ঠ হলাম আমার স্বদেশের মাটিতে, চোখ মেললাম বাংলাদেশের আলোতে। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটি যেন আমার জীবনে স্বদেশবোধের দীক্ষামন্ত্র।” সেদিন থেকে এই বালকও যেন শপথ নিলেন-

    “স্বদেশের কাছে দাঁড়ায়ে প্রভাতে
      কহিলাম জোড়করে
    এই লহ মাতঃ এ চিরজীবন
      সঁপিনু তোমারই তরে।”

    স্কুলজীবনই এই শপথ ফলপ্রসূ হতে শুরু করে--তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। তদানীন্তন গুপ্ত সমিতি- ‘অনুশীলন সমিতি’র সক্রিয় সভ্য ছিলেন তিনি। বিপ্লববাদী গোষ্ঠী পরিচালিত ‘আত্মশক্তি’, ‘যুগান্তর’, ‘বেণু’ প্রভৃতি পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। শুধু তাই নয়, বহু সহপাঠী বন্ধুর কাছে দেশের দুর্দশা ব্যাখ্যা করে সখারাম গণেশ দেউস্করের ‘দেশের কথা’ গ্রন্থ পাঠ করে শুনিয়ে, স্কুল ছুটির পর অস্ত্র ব্যবহারের অভ্যাস করিয়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে অগ্রসর একটি দল গঠন করেছিলেন। রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য তাঁকে বিদেশী শাসকের হাতে বহু নিগ্রহ ভোগ করতে হয়েছিল। রাজরোষে তিনি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, বেশ কিছুদিন অন্তর্বাসিত (interned) থাকেন। ফলে তাঁর পড়াশোনা ব্যাহত হয়, পরীক্ষা পাশ করতে বহু দেরি হয় এবং আই.এ. পাশ করার পর রাজসরকারের আদেশে ত্রিপুরা জিলায় অধ্যয়নের অধিকারে বঞ্ছিত হন। বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক কারণে ক্রমশঃ সশস্ত্র ও প্রত্যক্ষ রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে সরে এলেও তাঁর স্বদেশানুরাগে কখনো ছেদ পড়ে নি। পরে গান্ধীজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে, কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনেও প্রবোধচন্দ্র প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। বালকবয়সে যে স্বদেশের দীক্ষা তিনি গ্রহণ করেছিলেন, সেই দীক্ষা, সেই নীরব শপথ তিনি কোনদিন বিস্মৃত হন নি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে নিষ্কাম ও নিঃশর্ত এই স্বদেশানুরাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হবার পরে ভারত সরকার প্রদত্ত বৃত্তি অথবা পদক নিতে রাজি হন নি। অর্থাৎ তাঁর আবাল্যপোষিত স্বদেশপ্রীতি ছিল তাঁর নিজস্ব হৃদয়গত সম্পদ, তাকে জাহির করবার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। কেবল তাঁর দ্বিতীয় জন্মের শুভক্ষণে স্বদেশপ্রেমের যে বীজমন্ত্রটি তাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল, মৃত্যুর পূর্বে লেখা তার ‘অন্তিম ইচ্ছা’পত্রে শোনা গেল তারই প্রতিধ্বনি--“আমার মৃত্যুকালে আমার কপালে যেন খানিকটা মাটি মাখিয়ে দেওয়া হয়। তখন গাওয়া হবে ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটি।”

    প্রবোধচন্দ্র লিখেছেন “সেই বঙ্গবিভাগের দিনটিতে আমার জীবনের স্মরণীয়তম দিনটিতেই আমার সদ্যোলব্ধ স্বদেশানুভূতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাম অবিচ্ছেদ্যরূপে জড়িত হয়ে গেল।” রবীন্দ্রনাথের গানে স্বদেশপ্রেমের যে বীজটি উপ্ত হয় তাঁর মনে, রবীন্দ্রনাথের গানেই তা অঙ্কুরে পরিণত হয় এবং রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় তাঁর স্বদেশবোধকে নিছক আবাগের গণ্ডি ছাড়িয়ে চিন্তা ও বিচারের যোগে বিশাল মহীরুহে পরিণত করে। তাঁর স্বদেশচেতনা এই ভাবেই বাংলাদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয় সমগ্র ভারতভূমিতে। সেইসঙ্গে সুচিন্তিত ইতিহাসবোধ ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী ক্ষমতার সংযোগে তাঁর মনে যে ভারতবোধ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে- তার প্রত্যক্ষ পরিচয় আছে তাঁর রচিত “ধম্মপদ পরিচয়’, ‘ধর্মবিজয়ী অশোক’, ‘রামায়ণ ও ভারতসংস্কৃতি’, ‘ভারতাত্মা কবি কালিদাস’, ‘ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ’ প্রভৃতি গ্রন্থে। এই ভারতপথ পরিক্রমায় তাঁর প্রধান আদর্শ এবং আশ্রয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ-- এ কথা অত্যুক্তি নয়।

    বাঙালির মনে আচার্য প্রবোধচন্দ্রের প্রধান পরিচয় দক্ষ ইতিহাসবিদ রূপে নয়, ছান্দসিক রূপে। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় যেমন তাঁর মনে স্বদেশপ্রেমের সঞ্চার, তেমনই রবীন্দ্রনাথের কবিতাতেই তাঁর মনে ছন্দজিজ্ঞাসারও সূত্রপাত--সেই হিসাবে রবীন্দ্রনাথই তাঁর প্রথম ছন্দোগুরু। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়বার সময়েই ‘আজি কি তোমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে’ কবিতাটির ছন্দের দোলা প্রবোধচন্দ্রের বালকচিত্তকে নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর পাঠ্য ‘সাহিত্যপ্রবেশ ব্যাকরণ’ নামক বইএর ছন্দবিষয়ক অধ্যায়ের সাহায্যে এই কবিতার ছন্দোবিভাজন সম্ভব হল না। একটা অতৃপ্তি নিয়ে কিছুদিন কাটাবার পর অষ্টম শ্রেণীতে পড়বার সময় তাঁর হাতে এল রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থটি। “এই বইখানির মধ্যেই আমি আবিষ্কার করলাম রবীন্দ্রনাথকে, বাংলার কবিতার ছন্দকে এবং নিজেকে।” ‘কল্পনা’-র প্রথম কবিতা ‘দুঃসময়’ পড়তে পড়তে তাঁর মনে বাংলা ছন্দের তাল ও নিয়মের সূত্র বিদ্যুচ্চমকের মত জেগে ওঠে। তদবধি ‘দুঃসময়’ তাঁর অন্যতম প্রিয় কবিতা হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষত কবিতাটির রচনা তাঁরই জন্মদিনে (১৫ বৈশাখ ১৩০৪) বলে সেটি আরও মূল্যবান তাঁর কাছে। এই কবিতাই তাঁর ছন্দ-বোধের জনক। নবজাত ছন্দোবোধ ক্রমশঃ সুনির্দিষ্ট পরিণতি লাভ করতে থাকে এবং সেই পরিপূরণে সহায়তা করে সবুজপত্রে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের তিনটি প্রবন্ধ ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছন্দ-সরস্বতী’ প্রবন্ধ। প্রবোধচন্দ্রের ছন্দজিজ্ঞাসা এক প্রণালীবদ্ধ ছন্দব্যাকরণ রচনার প্রয়াসী হয়, যার ফসল তাঁর বাংলাছন্দ বিষয়ক প্রবন্ধের ধারা (‘প্রবাসী’ পত্রিকায় পাঁচ কিস্তিতে প্রকাশিত, ১৩২৯ পৌষ-চৈত্র, ১৩৩০ বৈশাখ)। এই প্রবন্ধধারা প্রকাশের পরে রবীন্দ্রনাথের পত্র পেলেন (১৯২৩ এপ্রিল) প্রবোধচন্দ্র--“ছন্দ সম্বন্ধে তোমার প্রবন্ধগুলি আমি পূর্বেই প্রবাসীতে পড়েছি এবং পড়ে খুশী হয়েছি। … তোমার বয়স অল্প, কিন্তু তোমার লেখার মধ্যে প্রবীণতা আছে।” প্রবোধচন্দ্রের ছন্দচর্চার জয়যাত্রা শুরু তখন থেকেই। পরবর্তী সুদীর্ঘ ৬৪ বৎসর সেই ছন্দচর্চা, ছন্দচিন্তা ও ছন্দসাধনা ছিল নিরন্তর ও নিরবচ্ছিন্ন। ফলস্বরূপ যে বিজ্ঞানসম্মত ছন্দোবিজ্ঞান তিনি সৃষ্টি করে গেছেন তা বাংলা ছন্দসাহিত্যের ইতিহাসে যুগান্তর এনেছে এবং ছন্দবিজ্ঞান পাঠকের অনুসন্ধিৎসা ও কৌতূহলের বহুতর মীমাংসা ঘটিয়েছে। প্রবোধচন্দ্রের ছন্দবিচার ও বিশ্লেষণের পরিচয় বিধৃত রয়েছে- ‘ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাংলা ছন্দের রূপকার রবীন্দ্রনাথ’, ‘ছন্দজিজ্ঞাসা’, ‘বাংলা ছন্দচিন্তার ক্রমবিকাশ’, ‘ছন্দ সোপান’, ‘আধুনিক বাংলা ছন্দসাহিত্য’, ‘ছন্দ পরিক্রমা’, ‘নূতন ছন্দ পরিক্রমা’, ‘বাংলা ছন্দ সমীক্ষা’ (প্রায় অধিকাংশ প্রবোধচন্দ্রের), ‘ছন্দ’ (রবীন্দ্রনাথের ‘ছন্দ’ গ্রন্থের সুবিন্যস্ত ও সুবিখ্যাত সম্পাদনা) ইত্যাদি গ্রন্থাবলী ও আরও অসংখ্য ছন্দবিষয়ক প্রবন্ধাবলীতে। ছন্দ বিষয়ক শেষ গ্রন্থ ‘নূতন ছন্দ পরিক্রমা’ প্রকাশিত হল প্রবোধচন্দ্রের মৃত্যুর (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬, ৩ আশ্বিন ১৩৯৩) আটমাস পূর্বে। আর শেষ প্রবন্ধ ‘ছন্দশিল্পী সুকুমার রায়’ প্রকাশিত হল মৃত্যুর মাত্র ১৪ দিন আগে (‘দেশ’, ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৬)। তাছাড়া ‘ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থটির আদ্যোপান্ত পরিমার্জন ও সংস্করণ করে প্রকাশকের হাতে দিয়ে গেছেন, প্রকাশ দেখে গেলেন না।

    পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরি। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রবোধচন্দ্রের মনে যে ছন্দবোধের জন্ম, রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ও প্রণোদনায় সেই ছন্দবোধের ক্রমবিকাশ এবং এই ছন্দ-আলোচনার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ আলাপ-আলোচনা ও ঘনিষ্ঠতা। তাঁর ‘ছান্দসিক’ আখ্যাটিও রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সংযোগসূত্রেই তাঁর জীবনের গতিও নতুনপথে বাঁক নেয়, এবার সে কথায় আসি।

    এম.এ. পাশ করবার পর ১৯২৮-৩২ কালপর্বে প্রবোধচন্দ্র প্রথমে ডি. আর. ভান্ডারকর ও পরে অধ্যাপক বেণীমাধব বড়ুয়ার পরিচালনাধীনে গবেষণাকার্যে রত ছিলেন। প্রধানতঃ রাজনৈতিক ও গৌণতঃ আর্থিক অভাববশতঃ তাঁর লেখাপড়া শেষ করতে বহু দেরি হয়। গবেষণাকালীনও তিনি তেলেনীপাড়ার জমিদার সত্যবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহশিক্ষক ছিলেন। ১৯৩২ সালে ‘দৌলতপুর হিন্দু একাডেমী’ কলেজে আমন্ত্রিত হন--বাংলা ও ইতিহাস দুই বিষয়ে অধ্যাপনার ভারগ্রহণের জন্য। ইতিমধ্যেই ছন্দ আলোচনার সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। সে পরিচয় ক্রমশই ঘনিষ্ঠ হতে থাকে এবং তিনি একাধিকবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবির সঙ্গে দেখা করেন। কবির তিরোধানের অল্পকাল পূর্বে (১৯৩৯ মার্চ-এপ্রিল) কথাপ্রসঙ্গে কবি তাঁকে বলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে বাংলা বিভাগের ভার নিলে তিনি খুশী হবেন। প্রবোধচন্দ্রও জানান যে ডাক পেলেই তিনি যাবেন। অবশ্য কবির জীবিতকালে ডাকবার সুযোগ হয় নি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের আহ্বানে (১৯৪৮ ভাদ্র) প্রবোধচন্দ্র শান্তিনিকেতনে গেলেন ‘রবীন্দ্রচেয়ার’ নামক বিশেষ পদের অধিকারী হয়ে (১৯৪২)। এই পদের বিশেষ দায়িত্ব ছিল রবীন্দ্রসাহিত্য অধ্যাপনা ও রবীন্দ্রসাহিত্য বিষয়ক গবেষণা। ১৯৪৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তৎসঙ্গে রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষতার ভারও তাঁর উপরে ন্যস্ত হয়। অবশ্য সেই দুই পদের গুরুভার বহনের ফলে অধ্যাপনার কাজে ত্রুটি ঘটে বলে তাঁর ধারণা ছিল। তাই, ১৯৫১ খৃষ্টাব্দে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হলে তিনি রবীন্দ্রভবনের ভার ছেড়ে বাংলাবিভাগের প্রধান অধ্যাপক রূপে কেবল অধ্যাপনার কাজেই নিরত রইলেন। আবার, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর বছরে ‘রবীন্দ্র-অধ্যাপক’ পদ সৃষ্টি হলে তিনিই সর্বপ্রথম সে পদ লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের আশ্রম তিনি ছেড়ে যান নি। পূর্বপল্লীতে নিজস্ব বাসগৃহে আমৃত্যু বসবাস করেছেন এবং আশ্রমের প্রান্তে তাঁর নিভৃত কোণটিতে অনলস জ্ঞানচর্চা, অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় একটি দিনের জন্যেও বিরত থাকেন নি। যে রবীন্দ্রনাথকে তিনি তাঁর ‘স্বদেশমন্ত্রের দীক্ষাগুরু, কাব্যপাঠের ছন্দোগুরু এবং মনুষ্যত্বের শিক্ষাগুরু’ রূপে গ্রহণ করেছিলেন তাঁর আশ্রমেই জীবনের অর্ধাংশ কাটিয়ে গেলেন প্রবোধচন্দ্র শান্তিতে।

    ভারতের ইতিহাসে প্রবোধচন্দ্রের বিশেষ দান ‘ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত’ ও ‘India’s National Anthem’ নামক গ্রন্থদ্বয় (১৩৫৬/১৯৪৯)। রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটিকে ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত রূপে গ্রহণ করায় কিছু কিছু রবীন্দ্রবিরোধী স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি এই মর্মে আপত্তি জানান যে এই গান ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষ্যে স্তুতিবাদন রূপে রচিত; অতএব স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংগীতের অযোগ্য। প্রবোধচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের ভাষণ, চিঠিপত্র প্রবন্ধাদি, দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এই গান ‘পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জেরই’ অভিবাদনগীতি হওয়া সম্ভব নয় এবং গানটিকে তিনি তার স্ব-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে রবীন্দ্রনাথের মহিমাও অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। ফলতঃ আর কোনো কবির কোনো গানই ভারতের জাতীয় সংগীত রূপে শ্রেষ্ঠতর বলে বিবেচিত হতে পারে নি।

    ছাত্রাবস্থায় প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি তাঁর অধীত বিষয় ছিল এবং সেই বিষয়েই তিনি গবেষণাকর্মে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু বাংলাসাহিত্যে ও বাংলা ছন্দ ছিল তাঁর নিজস্ব ভালবাসার বিষয়। তাই এম.এ. পড়াকালীনই তিনি বাংলা ছন্দ নিয়ে আলোচনা ও প্রবন্ধ রচনায় রত হন। চাকুরিজীবনে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমীতে একাধারে ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু কালক্রমে তিনি প্রত্যক্ষতঃ ইতিহাস বিষয়টি থেকে সরে এলেন। বাংলার ইতিহাস সাধনা, ধম্মবিজয়ী অশোক, ধম্মপদ-পরিচয় বা ছোটদের জন্য রচিত ‘ভারত নায়ক’ প্রভৃতি গ্রন্থের পরে নিছক ইতিহাস বিষয়ে গ্রন্থরচনাও আর করেন নি। তবে ঐতিহাসিক প্রবন্ধরচনা থেমে থাকে নি। তাঁর দৃষ্টি ও চিন্তা ক্রমশঃ সুনিবদ্ধ হল রবীন্দ্রসাহিত্য ও সংস্কৃতি ও বিশেষতঃ ছন্দ শাস্ত্র আলোচনার প্রতি। কিন্তু ইতিহাসবোধ বা ইতিহাস চেতনা তাঁর মননে চিরকালই কাজ করে গেছে। সাহিত্য আলোচনা তথা ছন্দ আলোচনাতেও সেই সুশৃঙ্খল ইতিহাসবোধের প্রতিফলন আছে সুস্পষ্ট। বস্তুতঃ তাঁর রচনায় যে পরিমিতি, যুক্তিসম্মত শৃঙ্খলাবোধ এবং পদ্ধতির প্রমাণ ছড়িয়ে আছে--ইতিহাসের সম্যক বোধই তার জনক। পুত্রকন্যাদের নামকরণে সেই ইতিহাস প্রীতির পরিচয়--অপালা, গার্গী, দীপঙ্কর, শীল্ভদ্র, সংঘমিত্রা ও সুগতা। এমন কি নাতি-নাতনীদের নামেও তার রেশ মুছে যায় নি- কারুবাকি, প্রিয়দর্শী, বিশাখা, সুজাতা প্রভৃতি নাম তাঁরই দেওয়া। তাই বলছিলাম আপাতদৃষ্টিতে ইতিহাস থেকে সরে এলেও তাঁর জীবন ছেড়ে ইতিহাস চিন্তা ও ইতিহাসবোধ কখনো বিদূরিত হয়নি।

    পারিবারিক জীবনে প্রবোধচন্দ্র ছিলেন সুখী ও কৃতী পুরুষ। তাঁর জন্ম তাঁদের পরিবারের এক গভীর দুঃখের সময়ে সান্ত্বনা, আশা ও আনন্দের আলো বহন করে আনে, তাই তাঁর নাম ‘প্রবোধ’। সকলের স্নেহে ও যত্নে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। পিতার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, ছিল অশেষ জ্ঞানানুরাগ। এই জ্ঞানানুরাগ তিনি পুত্রের মনে সঞ্চার করে দিয়েছিলেন। প্রবোধচন্দ্র আবাল্য জ্ঞানপিপাসু ও আবাল্য শিক্ষক। অনুজ ভ্রাতাদের গুরু ছিলেন তাঁদের ‘বড়দা’। সহপাঠীদেরও বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ভার নিয়েছিলেন তিনি। একথা তাঁর সহপাঠী বন্ধু শ্রী সন্তোষ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় (‘প্রবোধচন্দ্র প্রসঙ্গ’) পাই। আর তাঁর অগণিত ছাত্রের স্মৃতিতে আছে তাঁর শিক্ষকসত্তার বিশেষ পরিচয়। তাঁর শিক্ষাদানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে তাঁর স্বগৃহে। দৌলতপুরে ও শান্তিনিকেতনে কত ছাত্র যে তাঁর গৃহে বাস করেছেন তার হিসাব নেই। প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে তাঁর গৃহ যথার্থ গুরুগৃহে পরিণত হয়েছিল। নিজের চার কন্যা ও দুই পুত্রকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে যেমন তাঁর সচেষ্ট আগ্রহ ও উৎসাহের শেষ ছিল না, প্রতিটি ছাত্রকেও তেমনি করার আগ্রহে তিনি বিদ্যাদান করে গেছেন। ব্যক্তিগত পরিবারের বাইরে তাঁকে ঘিরে যে একটি ছাত্রপরিবার গড়ে উঠেছিল তার নজির আজকাল খুব সুলভ নয়। এবং এই সাধনায় প্রবোধচন্দ্রের যথার্থ সহধর্মিণী ছিলেন তাঁর স্ত্রী রুচিরা দেবী। এই মাতৃসমা গুরুপত্নীকে একাধিক ছাত্র ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন।


    ১৯২৫ সালের ২রা আষাঢ় প্রবোধচন্দ্রের বিবাহ হয় শ্রীহট্ট জিলার হরিগঞ্জের শিক্ষিত ধনী পরিবারের চতুর্দশবর্ষীয়া কন্যা রুচিরা দেবীর সঙ্গে। রুচিরা নামটি অবশ্য তাঁর পিতৃদত্ত নাম হয়, ছান্দসিক স্বামীর দেওয়া নাম। এই সুখী আদর্শ দম্পতি ১৯৮৩ খৃষ্টাব্দে তাঁদের বিবাহিত জীবনের ৬১ বৎসর পূর্ণ করলেন। প্রতি বছরই ২রা আষাঢ় দিনটি তাঁরা শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে উদযাপন করতেন। সুখে দুঃখে নিত্যসঙ্গিনী রুচিরা দেবীর নামেই প্রবোধচন্দ্র স্বীয় বাসভবনের নামকরণ করেন ‘রুচিরা’ এবং ঐ ভবনে প্রবেশের শুভদিনটিও নির্ধারিত হয় ২রা আষাঢ় (১৯৬৩)। বিবাহের দিনটিকে প্রবোধচন্দ্র একটি বিশেষ শুভদিন বলে সারাজীবনই পালন করেছেন এবং তাঁর অন্তিম ইচ্ছাপত্রে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন যে তাঁর জন্মদিন বা মৃত্যুদিন পালনের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী জীবিতা থাকবেন, ২রা আষাঢ় দিনটি যেন অনাড়ম্বরভাবে পালন করা হয়।

    কেবল দাম্পত্যজীবনেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রবোধচন্দ্র ছিলেন সুখী। কারণ সুখ বা সন্তোষ নামক মানসিক অবস্থাটি ছিল তাঁর সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন। জ্ঞানস্পৃহা ছাড়া ব্যবহারিক জীবনে আর কোনো কিছুর প্রতিই তাঁর আকাঙ্ক্ষা বা আসক্তি ছিল না--তাই অসন্তোষ জন্মাবার কোনো কারণও ঘটে নি। কোনো খ্যাতি প্রতিপত্তির জন্যে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। জীবিকা উপার্জনের জন্যে যতটুকু ডিগ্রীলাভ করা প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই তিনি করেছেন। জ্ঞানসাধনার ফলশ্রুতি রূপেই গ্রন্থরচনা করেছেন- তাঁর কোনো গ্রন্থই অর্থাগমের উপযুক্ত নয়। কোনো ফলের দাবি না রেখেই তাঁর কর্ম ও জ্ঞানসাধনা চলেছিল--বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি. লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রথম বঙ্কিম পুরস্কারটি তিনিই পান- ‘ভারতাত্মা কবি কালিদাস’ গ্রন্থের জন্য। এ ছাড়া আনন্দ পুরস্কার, রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি এবং অন্যান্য নানাবিধ সম্মান তিনি লাভ করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। কিন্তু কোনটিই কখনোই তাঁকে বিমোহিত করতে পারে নি। ১৯৮৭ খৃষ্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির পক্ষ থেকে তাঁর উদ্দেশে মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র-শতবার্ষিকী স্মারক পদক’ দেওয়া হয়।

    প্রবোধচন্দ্রের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও মনীষার পরিচয়ে কিন্তু ব্যক্তিমানুষটির সম্যক পরিচয় পাওয়া যায় না। তাঁর প্রশান্ত আপাত গম্ভীর, মৃদুভাষী, ছোটখাটো সুদর্শন চেহারাটির মধ্যে একদিকে যেমন অনমনীয় প্রচণ্ড তেজ ও মনোবল লুকিয়ে ছিল অন্যদিকে এক পরিহাসপ্রিয় হাস্যোচ্ছ্বল উপরন্তু সমবেদনাপূর্ণ স্পর্শকাতর মনও ক্ষণে ক্ষণে আত্মপ্রকাশ করত। তাঁর নির্মল পরিহাস ও কথায় কথায় pun ব্যবহারের কিছু নমুনা আছে ড: দেবীপদ ভট্টাচার্যের ‘পিতা নো বোধি’: প্রবোধচন্দ্র সেন’ নামক প্রবন্ধটিতে (‘দেশ’, ১ নভেম্বর, ১৯৮৬)। রোগী, শিশু এবং বাড়ির দাসদাসীর প্রতি ছিল তাঁর গভীর সমবেদনা। শিশুর কান্না তিনি কখনো সহ্য করতে পারতেন না। আত্মীয় অনাত্মীয় নির্বিশেষে রোগীর যন্ত্রণা উপশম করবার জন্য নিজে বই পড়ে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগ করতেন। পরের দুঃখে সহজেই তাঁর চোখে জল আসত। কিন্তু ব্যক্তিগত দুঃখশোক বা বিপদে তিনি কখনো কাতর হয়ে পড়েন নি। সুদৃঢ় মনোবলে অতি বড় দুঃখকেও জয় করেছেন- এ ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের যোগ্য শিষ্য। হোমিওপ্যাথি তাঁর একটি শখ ছিল; দ্বিতীয় শখ উদ্ভিদবিজ্ঞান (Botany) চর্চা। এ বিষয়ে তাঁর জ্ঞানও ছিল গভীর। নিজের বাগানে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছাপত্রে একটি নির্দেশে গাছপালার প্রতি সুগভীর প্রীতির পরিচয় আছে- “যদি প্রচলিত নিয়মে শবদাহ করতেই হয় তবে বিনা দ্বিধায় যেন পেট্রোল বা কেরোসিনের নেওয়া হয়. . .” তাতে অযথা গাছ কাটা ও কাঠ পোড়ানোর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে।

    জীবনে কোনো অবস্থাতেই আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেন নি। দরখাস্ত করে কোনো চাকুরি নেন নি, আবার চাকুরিজগতে কোনো compromise-এও তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। নিজের মনের এক অকম্পিত আদর্শে অবিচলিত ছিলেন, কোনো অবস্থাতেই সেই আদর্শ ত্যাগে রাজি ছিলেন না। এই আদর্শেরই এক প্রকাশ আত্মা বা ভগবানে তাঁর অনাস্থা। কোনোরকম শাস্ত্রচর্চা, পূজার্চনা তিনি কখনো করেন নি। মৃত্যুর পরেও প্রচলিত বিধিমতে তাঁর আত্মার শান্তিকামনায় শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়াকর্ম, অশৌচপালন এবং প্রার্থনা উপাসনা ইত্যাদি যেন না হয়- এ বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল। স্ব-ইচ্ছা এবং স্ব-চিন্তা প্রণোদিত বিচার বিবেচনাই ছিল তাঁর জীবনের পথে চলার মূল পাথেয়। ছন্দ আলোচনায়, সাহিত্য সমালোচনায় কিংবা ইতিহাস বিচারে যেমন সুতীক্ষ্ণ বিচার ও যুক্তিপ্রয়োগ করেই পথ কেটে চলেছেন, জীবনের পথে চলার মূলধনও ছিল নিজের সুচিন্তিত বিচারবুদ্ধি ও যুক্তিসম্মত পর্যবেক্ষণ। সে কারণেই হয়তো নিজের জীবন সম্পর্কে এমন নিস্পৃহ, নিরাসক্ত মনোভাব অবলম্বন করতে পেরেছিলেন। কোনো অভাব অবিচার তাঁর মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করতে পারে নি। সুদীর্ঘ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগিয়েছেন- যেদিন মৃত্যুর ডাক এল, যেন কাজ থেকে উঠে গেলেন। এক নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী প্রবোধচন্দ্র বলে গেলেন- “আমার মৃত্যুতে শোকের কোনো কারণ নেই, বরং আনন্দেরই কারণ আছে।”

    অথচ, জীবনরসের রসিক ছিলেন আচার্য প্রবোধচন্দ্র। ভগবান বিশ্বাস করেন নি তিনি, করেছেন মানুষে। এই পৃথিবী ছিল তাঁর কাছে পরম প্রিয়, পৃথিবীর মানুষ ছিল পরম প্রিয়। ভালবাসতেন শুনতে রবীন্দ্রনাথের গান-

     এই তো ভালো লেগেছিল
       আলোর নাচন পাতায় পাতায়
     সামনে চেয়ে এই যা দেখি
       চোখে আমার বীণা বাজায়’

    রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্য ঋষিপ্রতিম, জ্ঞানতাপস ও কর্মযোগী এই মানুষটি এক অনন্যসাধারণ জীবন যাপন করে গেলেন। তাঁর জীবনের স্বরূপটি যেন তাঁর অতিপ্রিয় একটি রবীন্দ্রসংগীতে যথার্থ ভাষা পায়-

    ‘একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা।
    ফুলবনে তোর একটি কুসুম তাই দিয়ে তোর ডালি সাজা।

    লোকের কথা নিস নি কানে
    ফিরিস নে আর হাজার টানে
    যেন রে তোর হৃদয় জানে হৃদয়ে তোর আছেন রাজা
    একতারাতে একটি যে তার আপন মনে সেইটি বাজা।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments