ঐ দিন পাকিস্তানী শাসক চক্র এবং তাদের কিছু জো-হুজুর বর্গ সিদ্ধান্ত নিল নতুন জাতিটি আগমনী গান গাওয়ার আগেই তার হবু রূপকার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সরিয়ে ফেলার। পঁচিশে মার্চ-এর করাল রাতের পর থেকে যত বাঙালির ইন্তেকাল হয়েছে, যত নারীর সম্মানকে কোরবানি দেওয়া হয়েছে, তার থেকেও অনেক ভারী থেকেছে চোদ্দই-এর সেই ব্যথা, বহু বহু দিন ধরে। মানুষের অভাব পূরণ হয়েছে, এমনকি ধর্ষিতারা সসম্মানে পরিবারে স্থান পেয়েছেন (বাংলাদেশে তাঁদের বীরাঙ্গনা বলা হয়ে থাকে), কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের এই অভাব পূরণ তো হয়ইনি, সেটা আরো বড় করে পরিলক্ষিত হয়েছে পরবর্তী বছরগুলোতে।
এই প্রথম রাজনৈতিক প্রয়োজনে একটি দেশের বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যা করার লাইসেন্স মিলল শাসকদের হাতে, ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার আগে এই শুরু হল শেষ মরণকামড়-এর প্রারম্ভিক যাত্রাপথ। এর আগে শোনা যেত সামরিক বাহিনী “burn and slash” পদ্ধতি ব্যবহার করে শত্রু-পক্ষের বাহিনীকে অনুৎসাহী করে দিত, কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের গণহত্যা করে একটি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার এই ইতিহাস এই প্রথম একটি সামরিক, রাজনৈতিক কৌশল আকারে প্রকাশ পেল। ঠিক সেই বছরই বাংলার অপর পারের এক ‘সু’সন্তান এক বড়সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে ফাটকে পুরলেন, বেশ কয়েকজনের ভবলীলা সাঙ্গ করলেন, অনেককে দেশান্তরিত করে ছাড়লেন। ব্যাপক ভাবে গণহত্যা ও পরবাস প্রেরণের এরকম নজির আগে পাওয়া যায়নি।
একটি যুগের শুরু হল সেই দিন থেকে। আজ প্রায় সাতাশ বছর হতে চলল, তিনটি দশক হতে আর বেশি দেরি নেই, উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে ফ্যাসিবাদিরা যখনই সুযোগ পেল, বুদ্ধিজীবীদের হয় শারীরিকভাবে নয় অর্থনৈতিকভাবে, নয় পেশাগতভাবে, নয় দেশগতভাবে মির্মূল বা বিতাড়ন শুরু করে দিল।
বাংলাদেশ
মাত্র চার বছর যেতে না যেতেই বাংলাদেশ তার রূপ বদলালো, তার জন্মমুহূর্ত অনেকটাই ভুলে গিয়ে পুরনো অবস্থানের খোঁজ শুরু করে দিল। নতুন চেতনা ঢোকানো হোলো যে সে দেশের নাগরিকরা নাকি বাঙালি নয়, তাঁরা বাংলাদেশী। জাতিগত পরিচয়কে প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা শুরু হোলো রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের দ্বারা। বুদ্ধিজীবীকুলকে নির্দিষ্ট করা হোলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে আর শিক্ষাকে দেখা হোলো ধর্মবিরোধী, ইস্লামিয় সংস্কৃতিবিরোধী একটি পশ্চিমী বিষয় হিসেবে (এই “পশ্চিম” কথাটি কিন্তু দু রকমের দ্যোতনা আনল, এক ইউরোপ ও আমেরিকা, আর একটি পশ্চিমবঙ্গ, -দুটোই নাকি ইস্লামের চরম শত্রু)। বাংলাদেশী রাষ্ট্রীয় পরিচয়কে প্রচার করা হোলো জাতীয় চরিত্র হিসেবে, অর্থাৎ রাষ্ট্র আর জাতিকে একটি সমার্থ দেওয়া হল। কৌতুকের বিষয় এখানেই যে ইস্লামের নামে এই কাজটি করা হলেও, ইস্লাম কিন্তু সবসময় রাষ্ট্রীয় অনুসরণকে জাতীয় অনুসরণের থেকে নিকৃষ্ট মনে করেছে এবং জাতীয় অনুসরণকে ধর্মীয় অনুসরণের থেকে নীচু মনে দেখতে শিখিয়েছে। এখানে এক মজার সমীকরণ টানা হল যে রাষ্ট্রীয় চরিত্রায়ন হচ্ছে জাতীয় ও ধর্মীয় চরিত্রায়নের একই পর্যায়ের বস্তু, তাই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একই অর্থে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে আর মুসলমান চরিত্রের একটি নৈধর্মিক (secular) নামকরণ করতে পারে।
এত বড় ভেজালিকরণ সম্ভব করা কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্ব না কমিয়ে সম্ভব নয়, তাই প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থাকে সুচারুভাবে ভাঙ্গার প্রক্রিয়া শুরু হল। জাতীয় জীবনে শিক্ষার গুরুত্বকে অন্যান্য অনেক পেশার থেকে নিম্ন স্তরে নামিয়ে আনা হল, আর এর পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের ধীরে ধীরে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে পর্যবসিত করা হোলো। এর পাশাপাশি আর একটি প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা হতে লাগলো, তা হল শিক্ষাকে মধ্যযুগীয় নির্দেশনির্ভর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি অধ্যাপক ড: কুদ্রত এ খুদা নিযুক্ত ছিলেন দেশের জন্য একটি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের কাজে। সরাসরি ড: খুদাকে ভারতের দালাল বলা হল এবং বলা হল যে সেই শিক্ষা সংস্কার একটি পশ্চিমী শিক্ষা সংস্কার যা কিনা মুসলমানদের নাস্তিকে পরিণত করবে এবং তাদের ধর্মীয় (আরবী কায়দায়) শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে ড: খুদা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অভূতপূর্ব ফল দেখিয়ে স্বনামধন্য বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন, তবে দেশ ভাগের পরে তাঁর ভবানীপুরের বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানে হিজ্রত নেন এবং বেশ ভালো রকমের পশ্চিমবঙ্গ বিরোধীতা শুরু করেন। এত করেও স্বাধীন বাংলাদেশের নব্য “ঐস্লামিক সামরিক junta” তাঁকে ভারত বিরোধী শ্লেষ থেকে রেহাই দিল না। এর পিছনে দুটো কারণ আছে। এক, সামরিক সরকার প্রধান জে: জিয়া দেখলেন যে বাংলাদেশকে আধুনিক শিক্ষার দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে গেলে যে পরিমাণ সম্পদের প্রয়োজন সেটা যদি নব-উদ্ভূত ভুঁইফোড় পয়সাওয়ালা অংশকে ত্যাগ করতে বলা হয় তাহলে তাঁর সামরিক অথচ জন-অপ্রিয় সরকার টেঁকে না। আবার শিক্ষার প্রসার যেকোনো সামরিক শাসকের পক্ষেই অমঙ্গল-সূচক। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে যদি অর্ধশিক্ষিত করে রাখা যায় তাহলে তাঁদের সহজে অন্যান্য দেশে কায়িক মজুর হিসেবে পাঠানো যাবে, এবং তাঁদের পাঠানো টাকাতে (unilateral transfer-একমুখী অর্থের সঞ্চালন) দেশে বসে পশ্চিমী দেশের জীবন-পদ্ধতি চালিয়ে যাওয়া যাবে। এই ভাবে বাংলাদেশের অকর্মণ্য অনুদ্যোগপতিরা ‘ইধার কা মাল উধার’ করে রাজার হালে থাকতে পারবেন, আর এঁরাই হবেন সামরিক শক্তির ধারক ও বাহক। হলও তাই, এঁরাই হলেন নব্য বাংলাদেশী, যাঁরা নাতির জন্মদিনে ব্যাংকক, লন্ডনে ‘শপিং’-এ বেরোন এবং ঢাকার বড়লোকি পাড়ায় কোটি টাকার ফ্ল্যাট্ ‘বাসা’-তে থাকেন। এটাই হচ্ছে জে: জিয়ার ‘জনশক্তি’ তত্ত্ব। একটিও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হল না, অথচ হাজার হাজার মাদ্রাসা শুরু হল। আজ বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে অন্তত একাধিক মাদ্রাসা নেই, অথচ প্রচুর গ্রাম আছে যেখানে কোনো সাধারণ শিক্ষার বিদ্যালয় নেই। একটি NGO সংস্থার হিসেবে পাওয়া যায় যে বাংলাদেশে আরবীতে নিজের নাম পড়তে পাড়ার মত লোকসংখ্যা নাকি বাংলায় নিজের নাম পড়তে পারা লোকসংখ্যার থেকে বেশি। সংস্থাটি যেহেতু একটি ইস্লামীয় NGO, তাই তার সত্যাসত্য বেশ সন্দেহজনক, কিন্তু এই অবস্থা যে এক শ্রেণির লোকের স্বপ্ন, এটা বোধহয় এই তথ্য থেকে পরিষ্কার। সৌদি আরব এবং অন্যান্য মুসলমানপ্রধান দেশে কায়িক মজুর পাঠানোর প্রয়োজন থেকে আরবী পড়ার আর শিক্ষার পিছনে স্ব-লগ্নী করার অনীহার জন্ম হয়েছে। যেখানে এখনো ভারত থেকে স্নাতক না হলে বা আয়কর দেওয়ার কাগজপত্র না থাকলে “emigration clearance not required (ECNR)” ছাড়পত্র দেওয়া হয় না, সেখানে কোনোরকমে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হলেই হাজার হাজার ছেলেমেয়েদের কোনো-না-কোনো উপায়ে পশ্চিমী দেশগুলোতে অবৈধভাবে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার কার্পণ্য করেন না, এমনকি সব সরকারি রীতিমতো সাহায্য করেন এই কথা প্রমাণ করতে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিপরীত মতামতের জন্য অনুকূল নয়। ওপরে ওপরে মনে হয় নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা এত সুখকর করার প্রচেষ্টা একটু অবিশ্বাসযোগ্য। আসলে অবৈধদের পড়াশোনা করানোর জন্য বাংলাদেশকে পয়সা খরচ করতেই হয় নি। অথচ এরা অন্য দেশে গিয়ে অবৈধ হয়ে থাকলেও দেশে যে একমুখী সম্পদ আনয়ন করতে পারবে। পশ্চিম বাংলায় আজও ১/২ ডলারে প্রযুক্তি ও ১ ডলারে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ানো হয়, আজও প্রেসিডেন্সির মতন কলেজে ছাত্রছাত্রীরা ঐ ১/২ ডলার না দিয়ে বরং ৫ ডলার অর্থে মাসে জলপানি পায়। আজও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা অবৈতনিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্নাতক স্তরেও তা অবৈতনিক (আর যেখানে নয় সেখানে তো ছেলেপিলেরা ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে নিজের খরচা ও নিজের কোচিং ক্লাসের খরচা চালায়)। অথচ বাংলাদেশের মতন দরিদ্র দেশে পড়াশোনা কিন্তু মোটেই অবৈতনিক নয়, রীতিমত ভারী খরচা লাগে। সেই বাংলাদেশেই কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক জায়গাতেই অবৈতনিক। মাদ্রাসার পাঠক্রম নিয়ে পশ্চিমবাংলার মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের শত আপত্তি সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে তাতে যাই শেখানো হোক না কেন মাদ্রাসা থেকে পাস করে কিন্তু ছাত্রদের চাকরিও হয়। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা পরীক্ষার পরে যে কোনো ছাত্র ইচ্ছা করলে সাধারণ সার্বজনীন পরীক্ষাগুলোতে বসতে পারে। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষার স্তর সাধারণ শিক্ষার থেকে খুব একটা আসমান-জমিন আলাদা নয়। মাদ্রাসা থেকে উর্ত্তীর্ণ হয়ে অনেকেই IAS, WBCS পরীক্ষাতে উর্ত্তীর্ণ হয়েছে, সেখানে আরবী ছাড়াও ফারসী ও ঊর্দু সাহিত্য, এমনকি বিজ্ঞান ও অংক-ও শেখানো হয়। অংকের স্তর উচ্চমাধ্যমিকের চাইতে খুব খারাপও নয়। বাংলাদেশে কিন্তু চিত্রটা একেবারেই অন্যরকম। পশ্চিমবাংলার উচ্চমাদ্রাসাতে যে পরীক্ষা হয় তাতে নাকি প্রতিবছর বাংলাদেশীরাও বসেন, কিন্তু খুব কমই কৃতকার্য হন। এই তো অবস্থা। ফারসী, ঊর্দু তো দূরে থাক এমনকি আধুনিক আরবীও পড়ানো হয় না সেখানে। কুরআন পড়ানোর প্রয়োজনে প্রাচীন আরবী পড়ানো হয়ে থাকে মুখস্থের মতো। বাংলাদেশে বহু হাফেজ আছেন, কিন্তু তাঁদের যদি প্রশ্ন করা হয় আয়াতের তফ্সীর বা concordance (সাযুজ্য-অধ্যয়ন), হাস্যকর সব উত্তরের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যেমন “তৌহীদ” ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক মৌলানা (এক সময়ের আতর ব্যবসায়ী) বলেছেন যে তার মানে হচ্ছে “আল্লাহর কোনো শরিক নেই”, তাঁকে তারপর “ইত্তেহাদ” শব্দর অর্থ জিজ্ঞেস করে গরম চক্ষুর আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। এত কথা বলতে হোলো শুধু এইটুকু বোঝানোর জন্য যে ইচ্ছা করে লেখাপড়ার মান নিচু করে রাখার প্রয়োজনে এটা করা হয়, এটাই হচ্ছে জনশক্তির তত্ত্ব। এটাই দেশের মধ্যে অগণতান্ত্রিক আবহাওয়া বজায় রাখতে সাহায্য করে।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্রতীদের বা কারু ও চারুশিল্পীদের যে কী সম্মান হবে তা বোঝা অসাধ্য নয়। রমেন্দু মজুমদার, মুন্তাসীর মামুন, শামসুর রহমান, সইদ শামসুল হক-এর ওপর শারীরিক আঘাত হবে বা হয় কিন্তু “ব্যান্ড্” সঙ্গীত শিল্পীদের ওপর হয় না। এই “ব্যান্ড্” শিল্পীদের অনেকেই কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময়েই কলকাতাতে কাটাতে কাটান, লাস্যময়ী শরীরপ্রদর্শক নায়িকারা বলিউডে একটা সুযোগের জন্যে হত্যে দিয়ে এবং অনেক কিছুর বিনিময়ে দিন অতিবাহিত করে, তাঁরা এক-আধটা সুযোগ পেলে ফলাও করে তা ঢাকার কাগজগুলোতে পাতা ভরে ছাপানো হয়। তখন কিন্তু তাঁদের কেউ ভারতের দালাল বলেন না। কিন্তু যেসব বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ ছাড়েন নি, যাঁরা পড়ে থেকে লড়াই করে চলেন, তাঁরা ভারতের দালাল হয়ে যান। আর যাঁরা কলকাতা বা ভারত থেকে পুরস্কার পান তাঁদের তো কথাই নেই। হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে এই পরস্পর পরস্পরকে গাল দেওয়ার খেলায় যাঁরা কলকাতার পত্রপত্রিকাতে লেখা পাঠিয়ে ছাপাতে পারেননি, তাঁরাই অন্যান্যদের ভারতের দালাল বলে গলা ফাটিয়ে চেঁচান। এটা করলেই আবার তাঁরা বামপন্থী হয়ে যান। বাংলাদেশ ও প্রবাসে এরকম কিছু বাংলাদেশী আছেন (হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই) যাঁদের লেখা আনন্দবাজার বা আজকাল ছাপতে চায় নি, তাঁদের মধ্যে একদল হঠাৎ শোরগোল তুলল যে বাংলাদেশকে নাকি পশ্চিমবঙ্গ তাচ্ছিল্য করে। আর একদল বলল যে যাদের লেখা পশ্চিমবঙ্গের কাগজে বেরোবে তার বাংলাদেশের শত্রু। মানের লড়াইটা যেন কোনো ব্যাপারই নয়। লিখলে ও পাঠালেই সেটাকে ছাপতে হবে- এটা তাদের জন্মগত অধিকার। এই ধরনের মানসিকতা আসে দীর্ঘদিনের নিচুমানের শিক্ষার কারণে। বাংলাদেশের যেসব শিল্পীদের লেখা ও শিল্প পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জনপ্রিয় হয় সেগুলো কি করে যেন বাংলাদেশে অনেক কম জনপ্রিয়। বেঁচে থাকতে আখতারদা (আখতারুজ্জমান ইলিয়াস) আমাকে নিজে অনেক বার অনুযোগ করেছেন “খোয়াবনামা” নিয়ে, “খোয়াবনামা” বহুবার পশ্চিমবাংলার বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে, অনেক সংস্করণ বেরিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে তার যা-তা অবস্থা, নাম আছে অথচ কাটতি নেই। আমি বহুসংখ্যক বাংলাদেশীকে প্রশ্ন করে দেখেছি ইফ্ফাত আরা খান সম্বন্ধে, ক্বচিৎ দু-এক জনের কাছে শুনেছি যে উনি পুরাতনী বাংলা গান ভালো গান, প্রায় সবাই বলেছেন উনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। মিতা হক বেশ অজানা, নিলুফার ইয়াসমিনের পরিচয় সাবিনা ইয়াসমিনের অগ্রজা হিসেবে। অথচ এই কয়েক বছরে পশ্চিমবাংলায় তাঁরা কী দুর্দান্ত জনপ্রিয়। কয়েকজন তো আমাকে বলেই ফেলল এরা ভারতের দালাল, এদের ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত কারণ এঁরা “মালাউন” গান গেয়ে থাকেন। আন্তর্জালে, soc.culture.bangladesh-এর আলোচনাচক্রে, এক “শিক্ষিত” বাংলাদেশী বছরখানেক ধরে তর্ক করে গেল যে নজরুল নাকি কালীকীর্তন লেখেননি, বা কৃষ্ণকীর্তন লেখেননি, বা সর্বহারার আন্তর্জাতিক অনুবাদ করেননি। সে নিজের পরিচয় দিয়েছিল বাংলাভাষার স্নাতক হিসেবে। কোন উদকে স্নাত হয়েছেন এসব প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পাওয়া যায় নি। এগুলো কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা জাতিকে ধীরে ধীরে শিক্ষা সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দিলে এ ছাড়া আর কী আশা করা যেতে পারে? ও দেশে “মার্কসবাদী” হিসেবে যাঁরা নিজেদের চালান এমন সব দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম। (JSD-র বর্তমান নেতৃত্ব সহ) যে তাঁরা কোনোদিন মার্ক্স্ বা লেনিনের লেখা পড়েননি, গান্ধী বা এমনকি জিন্নাহ-ও পড়েননি। জানে না যে ফজলুল হক প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন এবং তিনি ও সুরাবর্দি কোনোদিন কলকাতা ছাড়েন নি। শুধু জানেন যে তাঁকে শের-এ বাংলা বলা হয়েছে কারণ তাঁর মুখের আয়তন আর হুংকার নাকি বাঘের মতন ছিলো। এই পুরো ব্যাপারটা যখন একজন মন্ত্রীপর্যায়ের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার অন্যতম ঘোষকের কাছ থেকে আসে তখন ভয় হয় যে পুরো ব্যাপারটার জন্য বাংলাদেশের মানুষদের দোষ দিয়ে উতরে যাওয়া যাবে তো? এই শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার মতাদর্শের একটা প্রতিচ্ছায়া (এ ব্যাপারে Paulo Freire- এর অসাধারণ কিছু লেখা আছে)। বাংলাদেশের মানুষ দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা কী দুর্দান্ত গতিতে নতুন জিনিস আয়ত্ত করতে পারেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে ও সাফল্য অর্জন করার মতো ক্ষমতা পৃথিবীর আর কোনো জনগোষ্ঠীর এমনটা আছে কিনা সন্দেহ। সমস্যাটা হচ্ছে প্রতিকূল চক্রান্তটা এতটাই গভীরে প্রোথিত যে সেটাকে নির্মূল করা কয়েক দশকের কাজ নয়। নবলব্ধ স্বাধীন দেশের কীভাবে বারোটা বাজানো যায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন দেখিয়েছেন জিয়া, এরশাদ ও খালেদা।
তাজিন মুরশিদ তাঁর বইতে দেখিয়েছেন যে ১৯৪৭-এর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু অধ্যাপক ছিলেন যাঁরা মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণ হননি। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা বোধহয় বিরল। ৮৯.৯ শতাংশ শিক্ষক (বিভিন্ন স্তরে, সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে) ছিলেন ম্যাট্রিক-ফেল। বব নোভাকের বক্তব্য এই যে একটা দেশে যখন এক প্রজন্মের মধ্যে তিন তিনটি শিক্ষিত শ্রেণিকে তাড়ানো হোলো (ইংরেজ, হিন্দু, পাঞ্জাবী মুসলমান) ও আর একটি অংশকে (শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীকে) জোর করে বিকাশ করতে দেওয়া হোলো না তখন সেখানে সব সময়েই গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি বিরাজ করে। নোভাক লোকটির সম্বন্ধে যতই বিরূপমত থাকুক না কেন, কথাটা কি একেবারেই অবান্তর? আজকের বাংলাদেশের ছাত্র পরিস্থিতি কি অন্য কিছু বলে? সারা হুসেনের নেতৃত্বের নারী জাগরণ সমিতি এবং নারীদের অধিকারের প্রশ্নে গড়ে তোলা সংগঠনের (সম্মিলীত নারী সমাজ) এক পুস্তিকায় প্রকাশ যে সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশে বাকি ছাত্রমহলে নারী-ধর্ষণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাঙালি হিসেবে এই লজ্জা কী করে ঢাকা যায়? ওই সংগঠনকে ধন্যবাদ যে তাঁরা এই খবরটি বাংলা ছাড়া আর অন্য কোনো ভাষায় কেউ অনুবাদ করে দেননি। এখনো অন্যান্যরা মূর্খের স্বর্গেই না হয় থাকুন!
ভারতীয় উদ্যোগকর্মী, উদ্যোগপতি, প্রযুক্তিবিদ ও প্রয়োগকুশলীরা যখন বারে বারে বাংলাদেশী উচ্চবিত্তদের অনুরোধ করেন যে বাংলাদেশে যদি উন্নত প্রযুক্তির গাড়ি বানানো হয় তাহলে ভারতের পূর্বাঞ্চলের চাহিদা অনেকটা তাঁরা মেটাতে পারেন, তখন বাংলাদেশ চেম্বার অফ কর্মাস্-এর আধিকারিকরা বলে পাঠান কিভাবে ভারতীয় গাড়ি আরো সহজতর উপায়ে সে দেশে নিয়ে যাওয়া যায় তার ব্যবস্থা তাঁরা করবেন। এ রকম প্রস্তাব এর আগে পৃথিবীতে অন্য কোনো দেশের মুখপাত্রেরা করেছেন কিনা সন্দেহ। পুরো ব্যাপারটার জন্য দায়ী কিন্তু সামরিক সরকার ও সামরিক রাজনীতির আমল। আজকে তা এতই দূরে চলে গিয়েছে যে তাকে ঘুরিয়ে আনা খুবই দুরূহ।
ভারতের রূপ
বাংলাদেশের কথা দিয়ে লেখা শুরু হোলো কারণ নতুন করে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের উপরে পরিকল্পিত আঘাত হানা শুরু হয়েছে। আগে খালেদা বা এরশাদের আমলে কোনো না কোনো দাঙ্গা করিয়ে নেওয়া হত এবং সেই ঢেউয়ের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের উপর এক হাত নেওয়া হত। পালাবদলের পরে এখন বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে বিরোধীপক্ষের ছাত্রবাহিনী (তাঁরা অবশ্য গত কুড়ি বছর ধরে ছাত্রই আছেন) এই কাজটি করে বেড়াচ্ছে। তাদের রুখতে গেলেই পশ্চিমে বসে থাকা বাংলাদেশী লবি আর্তনাদ করছে রাজনৈতিক অত্যাচারের ধুয়ো তুলে। বিরোধী পক্ষ এখন প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে যে বৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার যে কোনো রকমের প্রচেষ্টাকে নাকি তারা প্রতিহত করবে, কারণ তাতে নাকি মানুষের ধর্মীয় চেতনার ঘাটতি হবে। ঠিক এ জায়গা থেকেই আমার বক্তব্য শুরু। এই জায়গা থেকেই একই সুরে গাওনা গাইছে ভারতের হিন্দুবাদিরা। তাই সেখানে বেশ কিছু রাজ্যে ডারউইনের মতবাদ না পড়িয়ে নাকি “বেদভিত্তিক গণিতশাস্ত্র ও মানুষের জন্মবৃত্তান্ত” শেখানো হচ্ছে। ঠিক একই ধরনের আওয়াজ তুলে সেখানে বুদ্ধিজীবীদের উপর আঘাত হানা হচ্ছে। সম্প্রতি তারা ঐতিহাসিকদের নিখিল ভারতীয় বৌদ্ধিক সংগঠন “ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস্”- কে কম্যুনিস্ট আখ্যা দিয়ে দিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে কারু- ও চারুশিল্পীদের ওপর শারীরিক আঘাত হানা হচ্ছে। কুড়ি বছর আগের আঁকা সীতা ও সরস্বতীর প্রতিচ্ছবি নিয়ে হুসেন ও যতীন দাসকে হেনস্থা করা হয়েছে। একেবারে একই দিনে ভারতে যখন মকবুল ফিদা এবং যতীনবাবুকে হেনস্থা করা হোলো, সেই দিনই রমেন্দুবাবু এবং মুনতাসির মামুনকে হেনস্থা করা হোলো বাংলাদেশে। একই ভাবে, একই ভাষায় এবং একই আওয়াজ দিয়ে (এক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দালাল বলে, অন্য ক্ষেত্রে ভারতের দালাল বলে)। সময়টা হল ঠিক যখন ভারতের নির্বাচন চলছে, তখন। উদ্দেশ্য- এই ফাঁকে একটু সাম্প্রদায়িক হাওয়া ওঠানোই যাক, “এলোমেলো করে দে মা, লুটে পুটে খাই”। ভারতের উন্নত শিক্ষার কেন্দ্রগুলো নাকি কম্যুনিস্ট্ তৈরির কারখানা। জে এন ইউ, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, এ এম ইউ, জামিয়া মিলিয়া এমনকি বেনারস হিন্দু ইউনিভারসিটি থেকেও নাকি পালে পালে কম্যুনিস্ট বেরোচ্ছে। তাই লেখাপড়া নাকি আর এস এস-এর মত ও প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী করতে হবে, এখন থেকে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুত্বের দর্শন শেখানো হবে। উত্তর প্রদেশে অংক করতে দেওয়া হয় যে “যদি ১৫০ করসেবকের প্রয়োজন হয় তিন দিনে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গতে, তবে ৫৫০ করসেবক কতদিনে সেটা ভাঙ্গতে পারবে?”- এই বলে। শেখানো হয় যে এখনো ভারত স্বাধীন নয়, ভারত পরাধীন সেই ২০০০ বছর ধরে। যতদিন “হিন্দুরা” ক্ষমতায় না যাবে ততদিন ভারত স্বাধীন নয়। অর্থাৎ এখন যাঁরা ক্ষমতা চালাচ্ছেন তাঁরা কেউ “হিন্দু” নন। বিভিন্ন শিশুপাঠ্যে এটাই শেখানো হচ্ছে যে আর্যরা ভারত থেকেই উদ্ভুত এবং তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। ঠিক যেমন কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে শেখানো হতো যে ইলতুৎমিস ও গিয়াসুদ্দিন-এর আগে নাকি বাংলায় খুব বিশেষ একটা কেউ থাকতো না, তারপর সেনেদের নেতৃত্বে কিছু দক্ষিণ ভারতীয় ঢুকে পড়ে, তাদের তাড়িয়ে বাংলা মুক্ত করে পাঠানকুল। ঠিক যেমন পাকিস্তানে আজও শেখানো হয় যে মুসলমানেরা আসার আগে নাকি ভারতের লোকে ঠিকমতো খেতে বা পরতে পেত না, পড়াশোনা জানতো না, এমনকি লিখতে পড়তেও জানতো না।
সাম্প্রদায়িকতার রূপ
ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার প্রথম কাজ, তারপর তারা বৈজ্ঞানিক শিক্ষাকে স্তব্ধ করতে চায়, বা অনুসন্ধিৎসাকে রুখে দিতে চায়। কোথাও কোথাও ব্যবহারিক বিজ্ঞানের চর্চা করা হয় কিন্তু কোনো যৌক্তিক বা বৌদ্ধিক অনুসন্ধিৎসাকে বাড়তে দেওয়া হয় না- যেমন দক্ষিণ ভারতে আজও কিছু কিছু জায়গায় করা হয়। কম্পিউটারের প্রযুক্তিবিদ জানে না যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল মাইল-ফলক গুলো কী কী। জানে না যে স্বাধীনতা সংগ্রামে কত বাঙালি, কত ভারতী, কত পাঞ্জাবীরা প্রাণ দিয়েছিলেন। জানেই না আন্দামানে কাদের পাঠানো হতো। সূর্য্য সেন বা আসফাকুদ্দিন, মঙ্গল পাণ্ডে, বাহাদুর শাহ, ভগৎ সিং এমনকি আল্লুরি সিতারামারাজুর নামও শোনেনি। আর নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন, কৃষেণ চন্দের, ফণীশ্বরনাথ রেণু, শামসুর রহমান বা বিষ্ণু রাভা, জ্যোতিপ্রকাশ আগারওয়ালা, রানি গুইডালং-এর নাম জানে কিনা জিজ্ঞেস করলে তো মারতে আসে। অথচ অনেকেই বিজেপির দৌলতে বঙ্কিমের নাম শুনেছে, তাঁর একটা কাজের নাম যদিও বলতে পারে না। কিম্বা জ্যোতি বসুর নাম শুনেছে, এবং অবশ্যই সুভাষ বোসের নাম, এদিকে আবার খালেদা জিয়ার নাম হয়ত শুনেছে বা অবশ্যই বেনজির ভুট্টো, অর্থাৎ এদের জ্ঞানভাণ্ডার বর্তমানের বাজারি কাগজপত্র থেকে, কোনো বই পড়ে নয়।
সাম্প্রদায়িকতা একটু অদ্ভুত হাঁসজারু মার্কা অতীতচারী দর্শন। সে বেঁচে থাকে অতীতের কোনো এক কাল্পনিক সময়ের খোয়াবকে পুঁজি করে। আবার এর সঙ্গে চেষ্টা করে তাকে এক বর্তমান রূপ দিতে যেখানে সেই বিশিষ্ট অতীতের কোনো বিশ্লেষণ চলবে না, অর্থাৎ সেই কাল্পনিক অতীতকে তারা যেরকমভাবে দেখাতে চায় একমাত্র সেইভাবেই যেন সমগ্র দেশের জনসাধারণ দেখে। এই শেষোক্ত অর্থে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ইতিহাস-কেন্দ্রিক ভাবধারা নয়। এটা একটা কাল্পনিক অতীতের (যে অতীত কখনো তাদের দর্শানো রূপে ছিল না) বর্তমান পুনর্নির্মাণ।
যদিও আমরা জানি যে ইতহাস ভীষণভাবেই বিজয়ী শক্তির পক্ষপাতিত্ব করে থাকে, তবুও সেটা একটা বাহ্য বস্তু (tangible product)। ইতিহাসের কার্যকারণ প্রবাহ কিন্তু খুবই শক্তপোক্ত এক পথ ধরে এগোয়। সাম্প্রদায়িকতা সে পথে এগোয় না, তাই সাম্প্রদায়িকতা পৃথিবীতে কখনোই একটি বড় সময় ধরে টিকে থাকে নি, সবসময়েই তা কোনো না কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, অপরিপক্ক রাজনৈতিক ও সমাজ-দার্শনিক ব্যবহারের ফল হিসেবে এসেছে। তাই এর কোনো ভবিষ্যত ছিলো না, হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। সাম্প্রদায়িকতা তাই সবসময়েই সমাজের কঠিন সময়গুলোতে কিম্বা ছেঁড়াখোঁড়া ব্যবস্থার সময়তেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ এক রকমের মহাশ্মশানের হায়না ও শকুনের দর্শন। বুড়ি চাঁদ যখন অস্তাচলেই গেছে, ধরা যাক কয়েকটা ইঁদুর এবার, এ তো চমৎকার পরিস্থিতি। এই ব্যবস্থা কিন্তু আবার সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থার মধ্যে বেড়ে ওঠে না, কারণ সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থায় বহুরকম শক্তি সমস্তদিক থেকে মাথাচাড়া দেয়। সাম্প্রদায়িকতা একটি কড়া শাসনের দর্শন, সেখানে কায়েমি শক্তিটির দর্শন ছাড়া আর কোনো চিন্তার কোনো স্থান নেই। সাম্প্রদায়িক দর্শন ভীষণ ভাবেই একটি চিন্তা, দর্শন, একটি দল, একটি নেতা বা একটি গোষ্ঠীর নেতৃত্ব, একটি কথা, একটি দেশ, একটি জাত, একটি ধর্ম, একটি ভাষা, একটি পোষাক, একটি চলন বলন এবং একটি লিঙ্গর কথা বলে। যেমন বাল ঠাক্রে নির্বাচনী সভাগুলোতে কৌতুক অভিনয় করেছেন, বিষয়বস্তু কেমন ভাবে সোনিয়া গান্ধী শাড়ি পরে চলেন, কথা বলেন ইত্যাদি। এ রকম নিম্নমানের রসিকতার জন্য বাল ঠাক্রেকে দোষ দিয়ে পার পেয়ে যাওয়া খুবই সহজ, কিন্তু কঠিন তখনই যখন ভাবার প্রয়োজন হয় কী করে মহারাষ্ট্র প্রদেশের সচেতন এবং সংস্কৃতি-প্রবণ মানুষ এগুলোকে মেনে নিচ্ছেন (অবশ্য এবারের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে মহারাষ্ট্রের জন-সাধারণ ব্যাপারটাকে খুব ভালো নজরে দেখেন নি)।
সাম্প্রদায়িক দর্শন কখনই কোনো উন্নত চিন্তার বা কোনো ধরনেরই চিন্তার নব-উন্মেষ বা কর্ষণকে সাহায্য করে না বা প্রশ্রয় দেয় না। এই অর্থে তা খুবই প্রাচীনপন্থী এবং নিয়মমাফিক। মেডিওক্রিটি (যার বাংলা অর্থানুবাদ “মধ্যানুগ” না হয়ে “সৃজন-বিরূপতা” হলে একটু বেশি প্রণিধানযোগ্য হয়) হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার মতাদর্শ। আর এই সৃজন-বিরূপতা সমাজে বিকাশ লাভ করতে পারে একমাত্র যদি শিক্ষালব্ধ অনুসন্ধিৎসাকে বন্ধ করা যায়। আর তা করার জন্য অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষাব্রতীদের হেনস্থা দিয়ে শুরু করে তাদের হয় ক্লীব করে দেওয়া কিম্বা প্রয়োজনে নিমূল করা।
এবার সামাজিক-ফ্যাসিবাদি রূপ
অবশ্যই আরো একটি “উন্নততর” পদ্ধতি আছে, সেটা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার থেকে অনুসন্ধিৎসার অংশকে সরিয়ে শিক্ষা-ব্যবস্থাকে একটি নির্দেশ-ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করা। ফ্যাসীবাদ অনেক মোটা দাগের কর্মপদ্ধতি। তা শিক্ষাকে বন্ধ করে ও শিক্ষাব্রতীদের হেনস্থা করে, সমাজে তাঁদের গুরুত্বকে লাঘব করে। শিক্ষা বিকাশের এতটাই নিম্ন পর্যায়ে ফ্যাসীবাদের উৎপত্তি এবং তার প্রবক্তাদের অবস্থান যেহেতু শিক্ষাক্ষেত্রে কোনোরকম কারিগরই করার ক্ষমতা রাখে না, তাই তার বিকাশের প্রয়োজনে ফ্যাসীবাদ গোড়া থেকেই গাছটাকে কেটে ফেলবার প্রচেষ্টা করে, অর্থাৎ শিক্ষাব্রতীদের পুরোপুরি উৎপাটিত করার পদক্ষেপ নেয়। সামাজিক ফ্যাসীবাদ কিন্তু অন্য চিজ। অনেক উন্নত সে, অনেক সুপরিকল্পিত ভাবে সে মাঠে নামে। তার পদ্ধতি শিক্ষাব্রতীদের অপ্রয়োজনীয় করে তোলা সমাজের চোখে, আর সেটা করবার জন্যে সে “নোটবুক-সমাজ” গড়ে তোলে, যেখানে পাঠ্য বইএর গুরুত্ব অধ্যয়নমুখী অনেক বইএর চাইতে বেশি, এবং মানের বই বা নোটবই বা “মেড-ইসি”-র গুরুত্ব পাঠ্য বইয়ের চেয়েও অনেক বেশি। আমি এরকম বহু স্নাতক দেখেছি যাদের বাড়িতে পাঠ্য-বইটা পাতুরি হয়ে গিয়েছে, সেটা আর হাতে নেওয়া যায় না। অনেকের কাছে সেটা নেইও, মানে বাড়ি ঢুঁড়েও পাওয়া গেল না, কিন্তু নোটবইটা পড়ার টেবিলে একেবারে সামনে। আর আছে গত দশ বছরে কী কী প্রশ্ন এসেছিল আর এ বছরের জন্য “সাজেসন”। ব্যাস, তাতেই কর্ম সারা। আমি এরকম কয়েকজনকে প্রথমশ্রেণিতে উৎরোতে দেখেছি। এই জিনিস আমরা পাই আমাদের প্রাণের পশ্চিম-বাংলাতে। এটা অবশ্য বাংলাদেশেও খুবই প্রবল, তবে এই রূপটা অনেক সময়েই সেখানে প্রগতিশীল মনে হয় কারণ সেখানে উন্মুক্ত ফ্যাসীবাদ এতই দুর্মর যে এই সূক্ষ্ম গরলটি সেখানে দেখাই যায় না বা অনেক সময় স্বাদে লাগে অমৃতের মতো।
উত্তর ভারতের মতো অশালীনভাবে হয়ত পশ্চিমবাংলায় শিক্ষার উপর আঘাত আসে না, বা দক্ষিণভারতের মতো শূন্যতার মধ্যে দিয়ে হয়ত শিক্ষার হানি করা হয় না, কিন্তু পশ্চিমবাংলায় শিক্ষার উপর আঘাত অনেক সুচারুভাবে নেমে এসেছে। শিক্ষাকে পশ্চিমভারতে একটি অন্যতম ব্যবসায় পরিণত করা হয়েছে। এতে মাঝে মাঝে কিছু ভালো দিক পরিলক্ষিত হয়, যেমন খুব ক্ষুদ্র এক অংশের কাছে তার পেশাদার রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এই রূপ কিন্তু শুধুই কারিগরি এবং ব্যবহারিক বিদ্যার ছাত্রকুলকে গড়ে তোলে, কোনো মৌলিক বা বৌদ্ধিক পথে তাকে বিকাশ করে না। সেই অর্থে শিক্ষাকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করা শিক্ষার অবনয়নের সবচেয়ে সূক্ষ্মতম পন্থা। যে পন্থা যত বেশি সূক্ষ্ম হয় তার দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে তত বেশি সময় নেয় বটে, তবে প্রতিরোধও ততই ক্লীব ও দূরের বস্তু হয়ে ওঠে। ফ্যাসীবাদ, এবং ব্যবসায়িক দর্শন- এই তিনটি শক্তি শিক্ষা ও শিক্ষাব্রতীদের সমাজে অপাঙ্ক্তেয় ও অপ্রয়োজনীয় করে তোলে।
যেখানে যত রকমের সামাজিক আন্দোলন বা সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যত রকমের সাংস্কৃতিক উৎসরণ বা অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছে সবগুলোই কিন্তু কোনো না কোন শিক্ষা-ও-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরেই হয়েছে। ফরাসী দেশে সংস্কৃতির অঙ্গনে সাত সাতটি বিপ্লব হয়ে যাওয়ার পরেই ১৯৬৮-র বিপ্লব হতে পেরেছে। বাংলায় নবজাগরণের পরেই কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রাম এসেছে। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ হতে পেরেছে।
গৌতম ভদ্রর আত্মজীবনীমূলক একটি লেখায় পেয়েছিলাম যে চেতলা বয়েজ স্কুলের (উনি তাকে “সেন্ট্ চেতলা” আখ্যা দিয়েছেন) দশম শ্রেণী কলা বিভাগে সংস্কৃত শিক্ষক কালিদাস ভট্টাচার্য্য মহাশয় “রঘুবংশ” পড়াতেন। পড়াতে পড়াতে তিনি হারিয়ে যেতেন ফারসি শাহনামার মধ্যে, বীর রসের সন্ধানে। তুলে ধরতেন সাদৃশ্য। এটাই ছিল তখনকার দিনের মান। যাই পড়াতেন না কেন তাতে মার্গদর্শনের মতন মহান কাজ তখনকার দিনের মাস্টারমশাইরা করে দিতেন। ভাবলে চমকে যেতে হয় যে একাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়া ছেলেপিলেরা তখনই সাহিত্য-সমালোচনার প্রাথমিক পদ্ধতিগুলো সম্বন্ধে অবগত ছিল। তখন বালিগঞ্জ গভ: স্কুলে একাদশ শ্রেণীতে বাংলা পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়েছিল যে বিশ্ব-সাহিত্যের কোন কোন উপাখ্যানে গান্ধারীর আবেদনের সাদৃশ্য পাওয়া যায় এবং কীভাবে গান্ধারীর ব্যথার মধ্যে সন্তানবাৎসল্য, নীতিবোধ ও সামাজিক শাসনের সংঘর্ষ খুঁজে পাওয়া যায়। এই ধরনের শিক্ষার ফলও পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা ও ইংরেজি বিভাগে দরখাস্ত পড়েছিল পদার্থবিদ্যার থেকে বেশি-- তাদের মধ্যে অনেকেই বিজ্ঞান বিভাগে সম্মানপত্র (লেটার) নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, এবং আই আই টি, যাদবপুর ছেড়ে প্রেসিডেন্সিতে বাংলা বা ইংরেজি বা অর্থনীতি পড়তে এসেছিলেন। আজকে সেটা কল্পনাই করা যায় না। তখনও বাংলায় স্নাতক হলে চাকরির বাজার থরথরে ছিল না, আজো তাই। তবে আজ দর্শনের স্নাতক একটি দুটি কম্পিউটারের সফ্ট্ওয়্যারের ছোটো পথিক করে মা কম্পুলক্ষ্মীর সেবাইত হয়ে ওঠেন। কম্পুলক্ষ্মীর হাত আজ এতই প্রসারিত যে মার্কিন মুলুকের চাহিদা পূরণ করবার জন্য ভারতের মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উত্তীর্ণ হওয়ামাত্র ছাত্রছাত্রীদের হাতে মার্কিন-ছাড়পত্র এসে যাচ্ছে। এই সব অর্ধ-শিক্ষিত মকরধ্বজেরা এসে ট্যাঁশগরু হয়ে ওঠবার জন্য প্রাণপাত করছে। ট্যাঁশগরু যে গরুও নয়, আসলে সে যে একটি জাতি, এটা বোঝার ক্ষমতাও হয়ত আমরা এখন হারিয়ে ফেলেছি। আর এটা করবার জন্য একটি ছোট্ট পদক্ষেপ আমরা কিন্তু নিয়েই রেখেছি। আমরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অনেক আগেই কোতল করে রেখেছি। আল বর্দ্ আর গোলাম আজমেরা বোকা ছিল, তারা সত্যি সত্যি ধারালো অস্ত্র দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের ও শিক্ষাব্রতীদের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিলো চোদ্দই ডিসেম্বরে। আমরা অনেক সুচারুভাবে তাদের প্রয়োজনীয়তাকেই নিঃশেষ করে দিয়েছি।
রয়ের বাজারের সেই বধ্যভূমি এখন ঢাকা শহরে কী অবস্থায় আছে বলা মুস্কিল কিন্তু তা যে উপমহাদেশের প্রতিটি শহরে নগরে, বাড়িতে উঠোনে পাতা আছে মানুষের পরিকল্পনায় ও বৈষয়িক চিন্তায়, সেটা আর কষ্ট করেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। শিক্ষার জন্য আমাদের আর সময় নেই।
বাংলাদেশ থেকে প্রত্যেকটি যুবক মার্কিন মুলুকে আসেন ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র নিয়ে, এক বছর যেতে না যেতে তাঁদের পাওয়া যায় নিউ ইয়র্কের রেস্তোরাঁগুলোতে। হাতে আসা ভালো পরিমাণ কাঁচা ডলার, যে পরিমাণ ডলার ট্যাক্স্ দেওয়ার পরে উপার্জন করতে বহু পড়াশোনা করে বহুবছর চেষ্টা করে মিলতে পারে। তাই রেস্তোরাঁর বয়ের কাজ অনেক “লাভজনক”, পড়াশোনা মাথায় থাক। পশ্চিমবাংলা থেকে আসা ও ভারতের অন্যান্য প্রদেশের থেকে আসা কম্পুলক্ষ্মীর সেবাইতদের বাসস্থানগুলোতে গিয়ে দেখেছি বসবার ঘরে সুন্দর সুন্দর সব অত্যাধুনিক যন্ত্রাদি, চিত্তবিনোদনের জন্য, কিন্তু বুদ্ধিবিকাশ আর উন্মোচনের জন্য কোনো কেতাব বা আকর গ্রন্থই নেই, অনেকে একটু আধটু স্বরচিত কাব্যচর্চা করে থাকেন, কিন্তু দেশীয় বা বিশ্ব-সাহিত্যের কোনো আকর বা পরিচায়িক গ্রন্থ রাখেন না।
প্রতি বছর বইমেলাতে বই বিক্রি দিন-কে-দিন বেড়ে যাচ্ছে, এখন তা পৃথিবীর যেকোনো রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে মানে বই, পাঠ্য বই ও ইংরেজিতে ব্যবহারিক বই ও কারিগরি বইই উত্তরোত্তর হারে বিক্রি হচ্ছে। বিদেশী সাহিত্য প্রায় সবই বিক্রি হয়ে যায়, তবে তাদের সংখ্যা কিন্তু একই পর্যায়ে থাকে। আজও হয়ত সিরিয়াস বই লোকে পড়ে, তবে সেটা একটি ছোট্ট ক্ষুদ্র অ-বর্ধমান অংশ। শিশু সাহিত্যর বিক্রি অবশ্য খুব বেড়ে গিয়েছে। সমস্ত প্রদেশে একই মানের বাংলা শিক্ষার ফলে একেবারে কচিকাঁচারা খুব করে পড়ছে। আর একটি জিনিস খুব বিক্রি হচ্ছে। আজ সবাই কম বেশি কবি, কবিরা আজকে একটি জাতি, যারা পরস্পর পরস্পরের লেখা কিনে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখেন। তার সঙ্গে মাল্টি-মিডিয়ার ধাক্কা তো আছেই। আজ বুদ্ধিজীবীদের অনেক ভাবেই মেরে রাখা হয়েছে। মিডিয়া বুদ্ধিজীবীদের ধ্বংস করার সবচেয়ে কার্যকরী শক্তি। “প্রথম আলো”র বিক্রী কিন্তু “সেই সময়”-এর থেকে কম হয়েছে, “মৈত্রেয় জাতক” আরো কম। “অলীক মানুষ” তার চেয়েও কম, তবে কী করে যেন “লেডি ডায়না” প্রচুর বিক্রি হয়েছেন। এবারের বৃটিশদের কল্যাণে সবাই একেবারে লন্ডনবাসী শোকস্তব্ধদের সাথে একাত্মতা বোধ করেছেন, অবশ্যই কলকাতায় বসে। সেই সঙ্গে প্রচুর বিক্রি হয়েছে ঠান্ডা পানীয়, এমনকি “সংগ্রামী” হকার ভাইএর কাছ থেকে কেনা বাহারি শাড়ী।
বুদ্ধিজীবীরা রয়ের বাজার নয়, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নিহত হচ্ছেন আমাদের মনের বাজারে। চোদ্দই ডিসেম্বরকে দীর্ঘজীবী করছি আমরা, নিজেদের মধ্যে, নিজেদের হাতে। জামাত আল বর্দ্, সাইদিরা কি দূরদ্রষ্টাই না ছিলেন!
পরিশিষ্ট: যে বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছিলেন চোদ্দই ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ ঢাকা শহরের রয়েরবাজারে:
মুনির চৌধুরি
সৈদ সিরাজুদ্দীন হুসেন (সাংবাদিক)
এ এন এম মুস্তাফা (সাংবাদিক)
ড: মুফাজ্জিল হায়দার (অধ্যাপক)
ড: জি সি দেব (দর্শনের অধ্যাপক)
ড: মনিরুজ্জমান (অধ্যাপক)
আনোয়ার পাশা (সাহিত্যিক)
শহীদুল্লাহ কাইসার (কবি সাহিত্যিক)
জাহীর রাইহান (চিত্রপরিচালক)
ড: ফাজলে রাব্বি (চিকিৎসক)
আলতাফ মাহমুদ (সঙ্গীতশিল্পী)