রেয়ান ঘুম থেকে উঠেই ঠিক করে ফেলল যে সে আর ভালো ছেলে হবে না। মা-বাবা পাঁচ সাত দিনের জন্যে পাটনা গেছেন বড়ো মামার শরীরটা খারাপ বলে। রেয়ান বাড়িতে রয়েছে কাজের লোক রাধামাসির সঙ্গে। ছোটকাকুও রয়েছেন কিন্তু কাকুর থাকা প্রায় না থাকারই মতন। বেশিরভাগ দিনই কাকুর নাইট ডিউটি থাকে। রেয়ানের সঙ্গে দেখা প্রায় হয় না বললেই চলে! এইটাই মোক্ষম সুযোগ! এখন ওকে কেউ তেমন কিছু বলবে না। সবসময় সবার কথা শুনে শুনে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যেমন রোজ ভোরে উঠে বাস ধরে স্কুলে যাওয়াতে রেয়ানের বেশ আপত্তি। মানে স্কুলে যেতে আপত্তি নেই, স্কুল ওর ভালোই লাগে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় গল্প হয়, কিন্তু ওই সকালবেলা ওঠাতেই ওর ঘোর আপত্তি। আজও যেমন মাসি ভোরবেলা এসে ওকে তুলে দিয়েছে!
রেয়ান বিরক্ত হয়ে বলল, “ও মাসি কেন তুলে দিলে আমাকে? আজ এত সকালে উঠব না! মা তো রোজই ডেকে দেয়!”
মাসি বলল, “সে সব জানি না। বৌদি বলে দিয়েছে এই সময় তুলে দিতে নাহলে স্কুলের বাস ছেড়ে যাবে। আর যা কিছু করো স্কুল কামাই করা চলবে না বলে দিচ্ছি। না হলে আমি দাদা-বৌদিকে ফোন করে বলে দেব!”
রেয়ানের মেজাজ আরো খিঁচড়ে গেল। ঠিক আছে, ঘুম থেকে উঠে যে কথাটা ভেবেছিল সেটাই করবে সে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্কুলের ইউনিফর্ম পরে ব্যাগ নিয়ে রেডি হয়ে গেল সে।
মাসি ওর খাবার জন্যে ডাইনিং টেবিলে দুধ কর্নফ্লেক্স দিয়েছে। রেয়ান সেটা দেখে বলল, “আমি ও সব বাজে খাবার খাব না!”
মাসি বলল, “রেয়ান, তুমি না ভালো ছেলে, খাবারটুকু খেয়ে নাও!”
রেয়ান হেসে বলল, “কে বলেছে আমি ভালো ছেলে? আজ থেকে আমি আর ভালো ছেলে নই! আমি ভালো ছেলে হতেও চাই না! সব সময় ‘এই করো, সেই করো’! আমি আজ থেকে খারাপ ছেলে।“
বলে সে ফ্রিজ থেকে চকোলেটের বড়ো বারটা বের করে কাঁউ কাঁউ করে পুরোটা খেয়ে ফেলল। বাহ কী মজা! ভালো ছেলে রেয়ান হয়তো এক টুকরো খেত, কিম্বা বড়ো জোর দুটো টুকরো, তাই খারাপ ছেলে হওয়ার অনেক লাভ। বরং ভালো ছেলে হয়ে থাকাটাই খুব বোরিং কাজ। চকোলেট খেয়ে স্কুল বাস ধরতে চলে গেল রেয়ান। মাসি ওর কাণ্ড দেখে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না।
ক্লাসে গিয়ে ব্যাগটা রেখেই রেয়ান তার বন্ধু সাকারকে বলল, “জানিস আমি ঠিক করে ফেলেছি। আজ থেকে আমি বাজে ছেলে!”
সাকার কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “মানে?”
“আরে বোকা মানে বুঝতে পারলি না? ভালো ছেলেরা সব কথা শোনে, বড়োরা যা বলে তাই করে, সেটা খুব ঝামেলার ব্যাপার। তাই আমি ঠিক করেছি আমি বাজে ছেলে হয়েই থাকব!”
তাই শুনে সাকার তো আঁতকে উঠল, “অ্যাঁ! বলিস কী রে! মানে শুধু বাড়িতে না সব জায়গায়?”
রেয়ান একটু ভেবে বলল, “শুধু বাড়িতে আর স্কুলে। বাইরে কিছু করার তেমন সাহস নেই। যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তাহলে জেলে পুরে দেবে, সেটা তখন ভালো হবে না।“
সাকার চোখ গোল গোল করে বলল, “স্কুলেও?”
“হ্যাঁ, বাড়িতে তো শুরু করে দিয়েছি। আজ সকালে কী খেয়ে বেরিয়েছি জানিস?”
সাকার আশ্চর্য হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না, কী খেয়েছিস?”
“ইয়া বড়ো একটা চকোলেট!”
“সত্যি?” সাকার যেন ওর কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না।
“সত্যি নয় তো কী মিথ্যে? এবার দেখবি স্কুলে কী করি!”
এর পর সারাদিন ধরে সাকার আর রেয়ানের অন্য বন্ধুরা দেখল খারাপ ছেলে রেয়ানের কাণ্ড কারখানা। সে স্কুলের টাইম টেবিল অনুসারে বই গুছিয়ে আনেনি, তাই অর্ধেক পিরিয়েডের বই নেই তার কাছে। লাঞ্চ ব্রেকে মাসির দেওয়া খাবার না খেয়ে ঠেলা থেকে কিনে উল্টোপাল্টা কী সব খেল। লাঞ্চ ব্রেক শেষ হয়ে যাওয়ার পর ক্লাসে যেতে চাইছিল না শেষে পিটি স্যার বকেঝকে ক্লাসে নিয়ে গেলেন।
বাড়ি ফিরেও রেয়ানের ওই এক রকম কাণ্ড চলল। মাসি খেতে দিতে চিকেনের টুকরোগুলো সব খেয়ে নিল কিন্তু ভাত একটুও খেল না! উলটে কৌটো থেকে চিনি বার করে খেল। সারা বিকেল সন্ধ্যে টিভি দেখে কাটাল, একটাও হোমওয়ার্ক করল না। মা-বাবা ফোন করলেন কিন্তু রেয়ান তাঁদের সঙ্গে কোন কথা বলল না।
মাসি ফোন ছেড়ে বলল, “বৌদি বলেছে কাল তোমার কী একটা পরীক্ষা, ইউনি টেস্ট না কী যেন। তোমাকে পড়তে বলেছে।“
কিন্তু কে শোনে কার কথা। রেয়ান সেই বসে বসে টিভি দেখল। কী মজা পড়া না করে টিভি দেখাতে! রাতের খাবার নিয়েও প্রচুর ঝামেলা করল। মাসি আর কী করবে, রেয়ান একদমই কথা শুনছে না দেখে ওকে টিভির ঘরেই ছেড়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়ল।
রাতে কাকু যখন ডিউটি থেকে ফিরলেন তিনটে নাগাদ তখন রেয়ান বাইরের ঘরের সোফাটায় ঘুমোচ্ছে।
কাকু ওকে টেনে তুলে বললেন, “রেয়ান, এখানে শুয়েছিস কেন? গায়ে ব্যথা হবে। চল খাটে শুবি চল!”
পরদিন স্কুলে সারাদিন ধরে বকুনি খেল রেয়ান কারণ সে একটাও হোমওয়ার্ক করেনি, টেস্টে খালি খাতা জমা দিয়েছে, ক্লাসের অন্য ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করেছে।
মাসির অবস্থাও নাজেহাল কিন্তু ভয়ে মাকে কিছু বলতে পারেনি। ওরা তো এমনিতেই চিন্তিত মামার শরীর খারাপ বলে। কাকু রাগ করবেন বলে কাকুকেও কিছু বলেনি। রেয়ানকে যা দেওয়া হচ্ছে সেই সব সে খাচ্ছে না, স্কুলের পড়া করছে না, রান্নাঘর থেকে চিনি, চানাচুর, বিস্কুট এই সব চুরি করে খাচ্ছে। নিজের জমানো টাকা দিয়ে পাড়ার দোকান থেকে চকোলেট কিনে কিনে খাচ্ছে, কিছু বললে খেঁকিয়ে উঠছে। স্নান করছে না,দাঁত মাজছে না!
তিনদিন এই রকম চলার পর চতুর্থ দিন রেয়ান স্কুলে গিয়ে ব্যাগ রেখে প্রেয়ার করতে গেল। প্রেয়ার হলে একে তাকে চিমটি কাটল। প্রেয়ার শেষ করে ক্লাসে ফিরে এসে প্রথম চমকটা খেল রেয়ান। নিজের জায়গায় বসে সে দেখল তার পাশের সিটটা খালি। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেল সাকার বেশ কিছুটা দূরে একটা সিটে বসে রয়েছে।
রেয়ান চিৎকার করে সাকারকে বলল, “এই তুই ওখানে বসেছিস কেন? তোর সিট তো এখানে আমার পাশে!”
সাকার ওর কথার কোন উত্তর দিল না। মুখ ঘুরিয়ে নিল।
রেয়ান একই ভাবে চেঁচামেচি করছিল এমন সময় ওদের ক্লাস টিচার এসে ঢুকলেন। রেয়ান দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে বললেন, “কী হয়েছে রেয়ান? তুমি দাঁড়িয়ে কেন?”
“আমি সাকারের সঙ্গে কথা বলছিলাম। ও তো আমার পাশে বসত। ওই দূরে কেন গিয়ে বসেছে তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।“
“ও এই ব্যাপার। আমিই সাকারকে ওখানে বসতে বলেছি। ওর মা আজ সকালে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। উনি চান না সাকার তোমার মতন বাজে ছেলের পাশে বসুক তাই ওর জায়গা বদল করে দিয়েছি আমি।“
রেয়ান বিশাল একটা ধাক্কা খেল। সাকার যে ওর সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু! রেয়ান বাজে ছেলে হয়েছে বলে সাকার আর ওর সঙ্গে বসতেই চায় না! ক্রমে সে লক্ষ করল যে ক্লাসের কেউই আর ওর সঙ্গে কথা বলছে না। লাঞ্চের সময় কেউ ওর সঙ্গে খেলতে চাইছে না। সবাই বলছে, “মা-বাবা বলেছেন খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশো না মোটেই তাহলে তোমরাও খারাপ হয়ে যাবে!”
সারাদিন একা একা কাটল রেয়ানের। উল্টে পরীক্ষার খাতাতে শূন্য পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এই রকম বাজে নম্বর সে জীবনে কোনদিন পায়নি। খবরটা এমন ছড়িয়ে গেছে যে বাড়ি ফেরার পথে বাসেও কেউ রেয়ানের পাশে বসতে চাইল না।
বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল রেয়ান। মাসি ডাকল, “কী হল তোমার? অনেক বেলা হল তো, এবার খেয়ে নাও।“
জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে মাসি যা দিয়েছিল তাই খেয়ে নিল রেয়ান তারপর পড়তে বসল।
মাসি তাই দেখে অবাক হয়ে বলল, “এই চারদিন যা করছিলে তাতে আমি তো বেজায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আজকে দাদা-বৌদি আর ছোড়দাকে ফোন করে বলব ভেবেছিলাম। তা তুমি আবার আগের মতন ভালো ছেলে হয়ে গেলে দেখছি। থাক তাহলে আর বলে কাজ নেই!”
রেয়ান বলল, “জানো মাসি আমি ভেবেছিলাম বাজে ছেলে হয়ে গেলে কোন নিয়ম মানতে হবে না, যা খুশি তাই করব, খুব মজা হবে কিন্তু যেটা ভুলে গিয়েছিলাম সেটা হলো বাজে ছেলেদের কেউ পছন্দ করে না। কেউ তাদের বন্ধু হতে চায় না, তাদের সঙ্গে কেউ কথা বলে না! মাও আমাকে যেমন বলেছিলেন তেমন সবার মা-বাবাই বলে দেয় তাদের যে বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশবে না! তা এই কটা দিনেই আমার মাথায় বাজে ছেলে স্টিকার লাগানো হয়ে গেছে যেন! আমার আর কোন বন্ধু নেই! তাই আজ থেকে আবার ভালো ছেলে হওয়ার চেষ্টা করছি। দেখি বন্ধুগুলো কত দিনে ফিরে আসে!”
মাসি শুনে যেন শান্তি পেল, বলল, “তা বন্ধুদের যখন এটা বুঝত সময় লাগেনি যে তুমি বাজে ছেলে হয়ে গিয়েছিলে তখন ভালো ছেলে হয়ে যাওয়াটা বুঝতেও সময় লাগবে না। বৌদিদের ফিরতে আরো তিনটে দিন সময় আছে, দেখো তোমার বন্ধুরা হয়তো তার আগেই তোমার কাছে ফিরে আসবে!”