• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • দূরের কবিতা: প্রেমে দিওয়ানা কুকুরের গান—রোবের্তো বোলানোর লাগামহীন রচনা : অংকুর সাহা

    দূরের কবিতা: প্রেমে দিওয়ানা কুকুরের গান—রোবের্তো বোলানোর লাগামহীন রচনা
    অংকুর সাহা
    রোবের্তো বোলানো মূলত কবি এবং কবিতাই তাঁর কাছে সাহিত্যের প্রিয়তম অবয়ব, কিন্তু ২০০৩ সালের ১৫ই জুলাই তাঁর মৃত্যুর আগের প্রায় এক দশকে তিনি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে, ঝড়ের বেগে লিখে ফেলেন অনেক কটি উপন্যাস, নভেলা, ও ছোট গল্প। তার মধ্যে একটি (১৯৯৮ সালে প্রকাশিত “হিংস্র গোয়েন্দা”, “The Savage Defective”) রচনা সাড়া ফেলেছিল লাতিন আমেরিকায়—যেমনটি অনেকদিন, অন্তত গ্যাব্রিয়েল হোসে দিলা কনকর্দিয়া গার্সিয়া মার্কেস (১৯২৭ - ২০১৪) রচিত এবং ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত “এক শত বছরের নিঃসঙ্গতা” (One Hundred Years of Solitude) উপন্যাসটির পরে, আর ঘটেনি। এসপানিওল ভাষার উৎকৃষ্ট গল্প উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়ে পড়ে দ্রুতগতিতে, কিন্তু ভাল মানের কবিতা পড়ে থাকে পেছনে। সেই কারণে ইংরেজিভাষী পাঠকের কাছে বোলানোর পরিচয় কথাসাহিত্যিক হিশেবে; আর কবি হিশেবে তাঁর পরিচয় কেবল এসপানিওলভাষী কবিতাপ্রেমীদের কাছে। অথচ তাঁর পরিচিতেরা সবাই জানেন কবিতাই তাঁর প্রথম এবং একমাত্র প্রেম। এমনকী তাঁর ভিজিটিং কার্ডেও স্পষ্ট অক্ষরে লেখা—“রোবের্তো বোলানো কবি এবং ভবঘুরে”।

    রোবের্তো বোলানো আবালোস-এর জন্ম চিলে নামক দেশটির সানতিয়াগো শহরে ১৯৫৩ সালের ২৮ এপ্রিল—তিনি আমাদের সত্তর দশকের কবিদের সতীর্থ ও সমবয়েসি। তাঁর পিতার পেশা ছিল ট্রাক চালানো আর শখ ছিল বক্সিং লড়াইএর; তাঁর মা স্কুলের শিক্ষিকা। রোবের্তো আর তাঁর ছোটবোনের শৈশব কাটে দক্ষিণ চিলের উপকূলবর্তী বন্দর-শহরগুলিতে; তাঁর নিজের রচনা থেকেই জানা যায়—বালক রোবের্তো “হাড্ডিসার, চোখে কম দেখে, সব সময় বইমুখো কিন্তু বিশেষ কোন অলৌকিক প্রতিভাহীন অস্তিত্ব”। এছাড়া ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia) নামে একটি মানসিক পঠন-অক্ষমতায় ভুগতেন তিনি—পড়তে পড়তে একটি শব্দের অন্তর্গত অক্ষরগুলি অবলীলায় উল্টেপাল্টে যেত তাঁর মস্তিষ্কে। এছাড়া স্কুলের সহপাঠীরা নিয়মিত মারধর করত তাঁকে—তিনিও মিশতে পারতেন না কারুর সঙ্গে সহজে। তবে শিশু বয়েস থেকেই কবিতা পড়তে ভালবাসতেন তিনি এবং মায়েরও ভীষণ উৎসাহ ছিল তাতে।

    ১৯৬৮ সাল বোলানো পরিবারটি সানতিয়াগোর পাট চুকিয়ে চলে গেল মেহিকো এবং বসবাস শুরু করল মেহিকো সিটিতে। মহানগরীতে পৌঁছে তিনি স্কুলের পড়া ছাড়লেন, কিন্তু অন্যান্য পাঠ বেড়ে গেল অনেক গুণ। দোকানে বা গ্রন্থাগারে কোন বই দেখে ভাল লাগলেই তিনি নির্বিবাদে চুরি করতেন। এই চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমেই তাঁর স্বশিক্ষা—কবিতায় ও রাজনীতিতে। বয়েস একটু বাড়লে অল্পস্বল্প সাংবাদিকতার কাজ; আর যোগ দিলেন নানান স্থানীয় বামপন্থী আন্দোলনে। একটি প্রবন্ধে বোলানো লিখেছেন, “আমার জন্ম সেই বছরে যে বছরে জোসেফ স্তালিন আর ডিলান টমাসের মৃত্যু।” আর মেহিকো সিটিতে যে বাড়িতে তাঁরা থাকতেন সেটি তার স্মৃতিতে, “A vast, almost imaginary place where freedom and metamorphosis were a daily spectacle.”

    মেহিকোতেই তাঁর কবিতা লেখার শুরু এবং দুটি কবিতা সংকলনও নাকি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০-এর দশাব্দে, কিন্তু সেগুলির আর সন্ধান পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক জীবনে তিনি এই সময় ট্রটস্কিবাদে দীক্ষা নেন এবং ইনফ্রা-রিয়েলিসমো (infrarealismo, অববাস্তববাদ) নামে একটি ক্ষণজন্মা কবিতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। পরের দিকে, তাঁর “হিংস্র গোয়েন্দা” উপন্যাসে এই কবিতা আন্দোলনকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছিলেন তিনি। এই সময় থেকেই শুরু হল তাঁর একাকী ভবঘুরে জীবন।

    ১৯৭০ সালে চিলে-তে সরকার গঠন করেছেন নবনির্বাচিত সমাজতন্ত্রী নেতা সালবাদোর আইয়েন্দে (১৯০৮-১৯৭৩); ১৯৭৩ সালের বসন্তে তাঁর বামপন্থী আন্দোলনে অংশ নেবার জন্যে রোবের্তো ফিরে গেলেন দেশে, কিন্তু তার কয়েক মাস পরেই ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, ঘটল বিপর্যয়—আমেরিকার প্ররোচনায়, অন্যায় সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলেন জেনারেল আগুস্তো পিনোশে (১৯১৫-২০০৬)। চিলের প্রতিটি কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীর জীবনে রয়েছে এই কালো দিনটির করুণ প্রভাব। বিপ্লবী কবি ও সঙ্গীত শিল্পী বিক্তর হারা (১৯৩২-১৯৭৩) অন্য হাজার মানুষের মত বন্দী হয়েছিলেন সানতিয়াগোর সেই কুখ্যাত স্টেডিয়ামে; সৈন্যেরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর বুকের প্রতিটি পাঁজর তার পর মেশিন গান চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল তাঁর শরীর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩। মৃত্যুর আগে বিক্তর তাঁর শেষ কবিতাটি লিখেছলেন, “এস্তাদিও চিলে”—এক বন্ধু তাঁর জুতোর মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন কবিতাটি। হাসপাতালে ছিলেন দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত পাবলো নেরুদা, তাই তাঁকে সহ্য করতে হয়নি নিগ্রহ বা অপমান; তাঁর মৃত্যু হয় কয়েক দিন পরে ২৩ সেপ্টেম্বর।

    সেই তুলনায় বোলানোর ফাঁড়া কেটেছিল অল্পে—আতংকবাদী সন্দেহে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিস; তিনি আশংকা করেছিলেন তাঁকে অত্যাচার করার পর খুন করা হবে অন্যদের মতন। কিন্তু আট দিন জেলে থাকার পর তিনি অলৌকিকভাবে মুক্তি পেয়ে যান—কারণ দুজন কারারক্ষী ছিলেন তাঁর ছোটবেলার বন্ধু এবং স্কুলের সহপাঠী। অনেক বছর পরে লেখা “নাচের চিঠি” গল্পে তিনি ঘটনাটির কথা লিখেছেন, “In the small hours I could hear them torturing others. I could not sleep and there was nothing to read except a magazine in English that someone left behind. The only interesting article in it was about a house that once belonged to Dylan Thomas.”

    জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি গেলেন এল সালবাদোর; সেখানে কিছুদিন কাটালেন রোকে দালতোন (১৯৩৫ - ১৯৭৫) এবং ফারাবুন্দো মার্তি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা দলের গেরিলা কবিদের সঙ্গে—যাঁদের এক হাতে কবিতা লেখার নোটবই, অন্য হাতে মুক্তিযুদ্ধের বন্দুক। কিন্তু চার মাস সেখানে বাস করেও যখন দেখলেন যে লেখা হয়েছে মাত্র একটি কবিতা (আর সেটিও বেশ বাজে), তখন ফিরে গেলেন মেহিকো সিটি। সেখানে কয়েক বছর কাটালেন লাতিন আমেরিকার র‍্যাঁবোর ভূমিকায় বোহেমিয় কবি, আপাদমাথা প্রতিষ্ঠানবিরোধী এবং পেশাদার সাহিত্য-প্ররোচক। যদিও তাঁর কবিতা পড়েনি কেউ, তাঁর নাম সবাই জানে—কখন প্রকাশকের আপিসে গিয়ে হামলা শুরু করবেন—এইসব আজেবাজে জঞ্জাল ছেপে কী লাভ? কখনো নামকরা কবিদের কবিতাপাঠের আসরে বিনা আমন্ত্রণে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অনর্গল কবিতা পাঠ। তাঁর হাতে নিগ্রহ সয়েছেন স্বয়ং অক্তাভিও পাস (১৯১৪ - ১৯৯৮)। মেহিকোর রবীন্দ্রনাথ, তিনিও কবিতা পড়তে মঞ্চে ওঠার আগে প্রেক্ষাগৃহে উঁকি মেরে দেখে নিতেন বোলানো বা তাঁর দলবল ওত পেতে রয়েছেন কি না। এবং কবিতার পাশাপাশি শারীরিক এবং মানসিক নৈরাচার—মদ, গাঁজা, আফিম, মারিহুয়ানা, হেরোইন—“মেহিকোর কবিতার খোলনলচে বদলে ফেলার জন্য” এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ—মারামারি, চৌর্যবৃত্তি (মাঝারি একটা লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছিলেন চুরি-করা বই দিয়ে), হরেক রকমের গুন্ডাগিরি ও চোরাচালান। এবং লজ্জাহীন, সীমাহীন, লাগামহীন যৌনতা—পুরুষ ও নারী উভয়ের সঙ্গে; গণিকা কেনার রেস্ত না থাকলে পানশালার পরিচারিকাদের মধ্যে যাঁরা তাঁর কবিতার অনুরাগী, ওষ্ঠমেহনে তৃপ্ত করতেন তাঁকে।

    এর মধ্যেই তিনি ফুরসত পেয়েছিলেন প্রেমে পড়ার—প্রেমে ব্যর্থ হয়ে গভীরতম মানসিক অবসাদের প্রকোপে পড়লেন, মেহিকোয় থাকলে গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ১৯৭৭ সালে তিনি দেশ ছেড়ে চিরকালের মত রওনা হলেন ইওরোপ। নিজের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, রূপকথার হ্যানসেল আর গ্রেটেল যেমন পথনির্দেশ দেবার জন্য রুটির গুঁড়ো ছড়িয়েছিল, তিনিও যে শহরে বাস করেছেন, একটি দুটি ভাঙা দাঁত রেখে এসেছেন সেখানে! এবং নিয়মিত কবিতা লিখে গেছেন, “রক্ত, ঘাম, বীর্য, অশ্রুর অপরূপ বিচিত্র বর্ষণে।” কোনটি তাঁর প্রিয় কর্ম, এই প্রশ্নের উত্তরে দু দশক ধরে তাঁর একই উত্তর—“বর্হেস পাঠ এবং নিবিড় সঙ্গম।”

    কবিতার নিজস্ব গৃহ বলতে দুটি—বইএর দোকান আর গ্রন্থাগার; এছাড়া পানশালা আর গণিকালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ঘটে মাঝে মাঝে; ইওরোপ গিয়েও এই জীবনদর্শন অব্যাহত রইল বোলানোর। ফ্রান্স, স্পেন আর উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে ভবঘুরের জীবন কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত শিকড় ছড়ালেন ভূমধ্যসাগরের তীরে, বার্সিলোনা শহরের নিকটে, বিবাহ করলেন এক স্পেনীয় মহিলাকে আশির দশাব্দের মাঝামাঝি। তাঁর স্ত্রী সেনোরা ক্যারোলাইনা লোপেস-এর সহায়তায় নিষিদ্ধ ভেষজের নেশাটি ঘুচল তাঁর, কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছে—এত বছর ধরে অন্য নেশাড়ুদের সঙ্গে একই সিরিন্‌জ ব্যবহার করেছেন না ধুয়ে, অতএব দীর্ঘজীবী হবার কোন সম্ভাবনাই নেই তাঁর।

    ১৯৯০ সালে জন্মাল প্রথম পুত্র, নাম রাখলেন “লাউতারো”, চিলের মাপুচো উপজাতির বীর নেতার নামে, যিনি প্রাণ দিয়ে চিলের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চেয়েছিলেন স্পেনীয় সাম্রাজ্যের আগ্রাসনের হাত থেকে। লাউতারোর জীবন অবলম্বনেই ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল চিলের প্রথম মহাকাব্য, “লা আরাউকানা”। এবং বোলানো শপথ নিলেন আর যতদিন বাঁচবেন—গল্প উপন্যাস লিখে অর্থ উপার্জন করবেন সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্যে; কবিতা হবে তাঁর দ্বিতীয় প্রেম। এক দশকের মধ্যেই তিনি উঠে এলেন এসপানিওল ভাষার কথাসাহিত্যের শীর্ষস্থানে।

    তাঁর কাব্যগ্রন্থ কুল্লে তিনটি—সেগুলি শেষ তেইশ বছরের রচনা; ইওরোপে এসে উপস্থিত হবার আগের রচনাগুলি বোধহয় হারিয়ে গেছে চিরকালের মত। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় “প্রেম দিওয়ানা কুকুরঃ কবিতা ১৯৮০-১৯৯৮” (“লস পেরোস রোমান্তিকোসঃ পোয়েমাস ১৯৮০-১৯৯৮”। অতি সম্প্রতি গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন লরা হিলি এবং ইংরেজি ও এসপানিওল ভাষায় দ্বিভাষিক গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন ন্যু ডাইরেকশানস (নভেম্বর ২৮, ২০০৮)। গ্রন্থটি তৈরি হয়েছে তাড়াহুড়োয়—অনুবাদের মান ভাল হলেও ভূমিকা, আলোচনা বা টীকা ও অনুষঙ্গ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কিন্তু কবিতাগুলির অমোঘ টানে আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বাংলা অনুবাদ শুরু করি। আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে বোলানোর—২০০০ সালে প্রকাশিত “তিন” (“Tres”) এবং ২০০৭ সালে প্রকাশিত “লা উনিভার্সিদাদ দেসকোনোসিদা” (“অচেনা বিশ্ববিদ্যালয়”)। তাঁর গল্পে উপন্যাসেও যখন-তখন এসে উপস্থিত হন কবিরা রাস্তায়, ঘাটে, কারাগারে, পানশালায়, গণিকালয়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে, গির্জায়; জীবিত কবি, মৃত কবি, বাস্তবের কবি, কল্পনার কবি। “People are coward to the last breath. Poetry is the only thing that is not contaminated… Only poetry is not shit.” ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর অন্য একটি কাব্যগ্রন্থের নামা জানা গেছে— “প্রেমের পুনরাবিষ্কারে” মেহিকো সিটি থেকে, কিন্তু তার সন্ধান পাওয়া যায়নি।

    তাঁর অসুস্থতার সংবাদটিও রহস্যে ঢাকা; যতদূর জানা যায়, অনেক বছর ধরে তিনি “হেপাটাইটিস সি”-এর প্রকোপে পীড়িত ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা পরিণত হয় যকৃতের দুরারোগ্য ব্যাধিতে। অকেজো যকৃৎ পালটে অন্য যকৃৎ প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা চলছিল—অপেক্ষার সারণিতে তাঁর নাম ছিল উঁচুর দিকে, এমন সময় তাঁর মৃত্যু ঘটে ১৫ জুলাই ২০০৩। জীবনের শেষ পাঁচ বছর ধরে তিনি একটানা লিখে গেছেন তাঁর মহতী উপন্যাস—১১০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ “২৬৬৬” (“ছাব্বিশ শো ছেষট্টি”)—পাঁচ খণ্ডের গোয়ন্দা উপন্যাস—মৃত্যুর কয়েকদিন আগে রচনাটি সমাপ্ত হয়। ৮৯৮ পৃষ্ঠার ইংরেজি অনুবাদটি করেছেন নাতাশা ওয়াইমার, প্রকাশিত হয়েছে ২০০৮ সালে এবং শোরগোল তুলেছে সাহিত্যরসিক মহলে। একবিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস—কোন কোন সমালোচকের মতে।

    ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর অপ্রকাশিত, অগ্রন্থিত কবিতাগুলি—আশা করব সেগুলি কেউ প্রকাশ করবেন সুসম্পাদিত সংকলনে।

    প্রেমে দিওয়ানা কুকুর
    অনেক কাল হ’ল, বয়েস তখন আমার বিশ ছুঁই ছুঁই, আমি
    আপাদমাথা উন্মাদ।
    আমি হারিয়েছি স্বদেশ
    কিন্তু জিতে নিয়েছি স্বপ্ন।
    এবং সেই স্বপ্ন যতক্ষণ আমার সহায়
    পরোয়া করি না অন্য কিছুর।
    না করি কাজকর্ম, না করি পুজো,
    না করি ভোরের আলোয়
    প্রেমে দিওয়ানা কুকুরদের পাশে বসে লেখাপড়া।
    আমার অস্তিত্বের শূন্যতায় শিকড় গাড়ে স্বপ্ন।
    আলো আঁধারের কম্বলে মোড়া
    কাঠের শয়নকক্ষে
    যা গ্রীষ্মমণ্ডলের ফুসফুসের গভীরে বসানো।
    মাঝে মাঝে আমি নিজের অন্তরে পিছু হটে
    স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছাই; তরল ভাবনায়
    চিরন্তন ভাস্কর্য,
    কামনায় শিউরে ওঠা
    শুভ্র কীট।
    পলাতক প্রেম।
    স্বপ্নের অভ্যন্তরে আরো এক স্বপ্ন।
    দুঃস্বপ্ন আমাকে ডেকে বলেঃ বয়েস বাড়বে তোমার।
    যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি ও তার গোলকধাঁধা পেছনে ফেলে
    এগোবে তুমি, ভুলেও যাবে তাদের।
    কিন্তু অনেক কাল আগে, সেই বয়েস বাড়াটাও ছিল অপরাধ।
    যা বলছিলাম, আমি এখন হাজির, প্রেমে দিওয়ানা
    কুকুরদের সঙ্গে এবং এলাকা ছেড়ে নড়ছি না আমি।

    The Romantic Dogs


    নার্সের দল
    কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে নার্সের দল। রোদ চশমায়
    চোখে ঢেকে আমি পর্যবেক্ষণ করি তাদের আসা যাওয়া।
    সূর্যাস্ত রক্ষা করে তাদের।
    এক দল নার্স আর এক দঙ্গল কাঁকড়াবিছে
    কেবল আসে আর যায়।
    সন্ধে ছ’টায়?
    রাত আটটায়?
    আমার পানে তাকিয়ে হাত নাড়ে একজন। তারপর
    গাড়ির দরজা খুলে ঢোকে, আর পেছন না ফিরেই রওনা দেয়,
    তাকে রক্ষা করে সূর্যাস্ত, আমাকে আমার রোদচশমা,
    দুজনের দুই দুর্বলতার ফাঁকে রাখা পো’র ভস্মাধার।
    অন্তহীন ফুলদানিতে রাখা সূর্যাস্ত,
    রোদচশমার কাচ
    আর পৃথিবীর যত হাসপাতাল।

    The Nurses

    টীকা—পো-এডগার অ্যালেন পো (১৮০৯-১৮৪৯), খুব সম্ভবত তাঁর “রু মর্গের হত্যাকাণ্ড” গল্পের অনুষঙ্গ এসেছে এখানে

    লুপে
    মেয়েটি শরীর বেচতো না গুয়েরেরো শহরে, জুলিয়েনের বাড়ি থেকে
    খানিকটা দূরে, বয়েস মোটে ১৭, কোলের ছেলেটি মরেছে আঁতুড়ে।
    ত্রেবোল হোটেলে আমার কক্ষটি প্রশস্ত, আলোকবিহীন,
    বাথটব আর বিদে-সমেত ঘরে কাটানো যায় কয়েক বছর—সেখানে
    সন্তানের স্মৃতিতে কেঁদেছিল সে। সেখানে বসে আমি লিখতে চেয়েছিলাম
    বিভীষিকার কবিতাগুচ্ছ অথবা সন্দেহজনক
    স্মৃতিচারণার গ্রন্থ। লুপে মেয়েটি
    খ্যাংরাকাঠি রোগা, লম্বা উরু দুটোয়
    চিতাবাঘের মতন ছোপ ছোপ।
    প্রথমবার আমার যন্তর তো দাঁড়ালোই নাঃ
    তবে তাতে একেবারেই ভেঙে পড়ি নি আমি। লুপে তার
    জীবনের কথা বলে যায়, কিসে তার সুখ হয়, সেই কথা।
    এক হপ্তা পর আবার দেখা—রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে
    পুরানো ক্যাডিলাকের গায়ে হেলান দিয়ে, অন্য কিশোরী বেশ্যাদের সঙ্গে।
    দেখা হয়ে আমরা দুজনেই খুশি। সেদিন থেকে শুরু হল তার
    মনের কথা বলা আমাকে, কখনো কাঁদতে কাঁদতে,
    কখনো ঠাপাতে ঠাপাতে, অথবা হাত ধরাধরি করে
    বিছানায় শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে, সর্বদা নগ্ন।
    তার ছেলেটা পেট থেকে পড়েই রুগ্ন, লুপে মানত করেছিল
    জাগ্রত মা মেরির কাছে—বাচ্চাটি সেরে উঠলে
    সে দেহ ব্যবসা ছেড়ে দেবে। দুয়েক মাস
    কথা রেখেছিল, কিন্তু ভাত না জোটায় ফিরে গেল নরকে।
    কয়েক দিন পরেই মরলো শিশুটি, লুপে বলে দোষটা তারই
    মানত করেও সে কথা রাখতে সমর্থ হয়নি।
    শপথভঙ্গের মূল্য হিশেবে মা মেরি নিজের হাতে
    তুলে নিলেন তার দেবশিশুকে ধরাধাম থেকে।
    আমি কিছু উত্তর দিতে নারাজ তখন।
    আমি শিশুদের পছন্দ করি অবশ্যই, কিন্তু
    অনেক বছর পরে যখন সন্তান এলো আমার নিজের জীবনে,
    বুঝলাম দুধের শিশুকে হারানো কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
    তাই চুপ ছিলাম আমি, চরাচরে বা হোটেলের কোন ঘরেই
    শব্দের রেশ নেই, শিরশিরে আতংকজনক নীরবতা।
    হয় দেওয়ালগুলো খুব পুরু অথবা কেউ নেই অন্য ঘরগুলোতে,
    অথবা থাকলেও বলছে না কিছু, শীৎকার তো নয়ই।
    লুপের তরুণী শরীরে আরোহণ করা সোজা, নিজেকে
    মনে হয় পুরুষালি আবার একই সঙ্গে হতভাগ্য।
    লুপেও তালে তালে যখন নেড়ে সাড়া দেয় আর
    তলঠাপের সঙ্গে সঙ্গে গপ্পো মারে—বুকারেলি থিয়েটারে
    নতুন কি রোমহর্ষক সিনেমা দেখেছে।
    চিতাবাঘ উরু দিয়ে আশ্লেষে জড়ায় কোমর,
    মাথা ডুবিয়ে দেয় আমার বুকে আর জিভ দিয়ে
    খোঁজে আমার নিপ্‌ল্‌ অথবা হৃদস্পন্দন।
    এক রাত্তিরে বলে সে,
    এই খানটিতে চোষো আমায়, খুব আরাম হবে।
    কোথায় লুপে? তোমার হৃদয়ে?

    Lupe


    পুনর্জন্ম
    কবিতা ঢুকে যায় স্বপ্নের অতলে
    হ্রদের জলে একা ডুবুরীর মতন।
    সবার চোখে সাহসী কবিতা
    পিছলে যায় আর
    সিসের মতন ডোবে সে হ্রদে, সেটা
    লখ নেসের মতন সীমাহীন অথবা
    লেক বালাতোনের মতন আবিল আর বিষণ্ণ।
    নীচের থেকে মুখ তুলে দেখ-
    এক ডুবুরি
    নিষ্পাপ
    ইচ্ছাশক্তির
    পালকে সাজানো।
    কবিতা ঢুকে যায় স্বপ্নের অতলে
    ঈশ্বরের চোখে মৃত
    ডুবুরির মতন।

    Resurrection

    টীকা—গেলিক ভাষায় “লখ” মানে হল “লেক” বা “হ্রদ”। “লখ নেস” স্কটল্যান্ডের একটি বিশাল হ্রদ—কাল্পনিক “লখ নেসের দৈত্য” এর জন্যে ভুবন বিখ্যাত।
    হাঙ্গেরিতে অবস্থিত “লেক বালাতোন” মধ্য ইওরোপের বৃহত্তম হ্রদ। স্পাভ ভাষায় “ব্লাতো” নামে হল “কাদা”। বিশাল অথচ অগভীর (গড় গভীরতা ৩-২ মিটার) হ্রদটির জল কর্দমাক্ত।



    নরকের পাঠকক্ষে
    নরকের পাঠকক্ষে কল্পবিজ্ঞানের
    ফ্যান ক্লাব সভ্যেরা হাজির
    তুষারে ভরা ঝুলবারান্দায় শয়নকক্ষের ভেতর দিয়ে পথ
    বরফজমা রাস্তায় শেষ পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায় সব
    এবং প্রতিটি মুহূর্ত যেন ক্রমশ উত্তম অথচ কম গুরুত্বপূর্ণ
    মুখে সিগারেট প্রাণে ভয় চোখে সবুজ দ্যূতি
    কখনো বয়েস ২৬ আপনার বিশ্বস্ত স্বয়ং আমি

    In the Reading Room of Hell


    ছিন্নবিচ্ছিন্ন
    গাড়ি চাপা পড়া গোয়েন্দা দূরের শহর
    তাদের গ্রিক নামের নাট্যশালা
    মায়োরকার ছেলেটি আত্মঘাতী হল
    ভোর চারটের সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে
    মেয়েটি ঝোঁকে জানালায় প্রথম গুলির শব্দ শুনে
    ডিওনিসাস অ্যাপোলো ভেনাস হারকিউলিস
    বৈচিত্র ভোর আসে
    বহুতল বাড়ির সারি পেরিয়ে
    গাড়িতে বসে খবর শোনে মানুষটি
    গাড়ির গায়ে বৃষ্টির পদশব্দ
    অর্ফিউস…

    Fragments


    টীকাঃ মায়োরকা (Majorca)—ভুমধ্যসাগরে অবস্থিত স্পেনের একটি সুন্দর দ্বীপ।

    মাছিদের সঙ্গে
    ট্রয়ের কবিরা
    যা কিছু সম্বল ছিল তোমাদের
    হাওয়ায় উড়ে গেছে সব


    মন্দির নেই বাগানগুলোও নেই
    কবিতাও অদৃশ্য


    তোমরা এখন স্বাধীন
    ট্রয়ের মাননীয় কবিরা

    With the Flies


    এর্নেস্তো কার্দেনাল আর আমি
    হাঁটতে বেরিয়েছি, ঘামে সপসপে জামাকাপড়, মাথার চুল
    কপালে আঠার মতন সেঁটে
    হঠাৎ দেখি উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসছেন
    এর্নেস্তো কার্দেনাল
    প্রীতি সম্ভাষণ সেরে আমই শুধাই;
    হে শ্রদ্ধেয় পিতা, কমিউনিজম নামের
    যে স্বর্গরাজ্য
    সেখানে কি সমকামীদের স্থান আছে?
    “হ্যাঁ, অবশ্যই”, তিনি বলেন।
    আর অনুতাপহীন হস্তমৈথুনকারীদের?
    যৌন ক্রীতদাসদের?
    আর যৌনতার বিদূষকদের?
    ধর্ষ-মর্ষকামীদের, গণিকাদের, গুহ্যদ্বারে এনিমা লাগিয়ে
    অবিচ্ছিন্ন আনন্দ পান যাঁরাঃ তাঁদের?
    যাঁদের কাছে জীবন দুর্বিষহ এবং অসম্ভব রকমের
    অসহ্য তাঁদের?
    আর কার্দেনাল বলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই”!
    আমি দু চোখ তুলে আকাশে তাকাই
    বেড়ালের নীরক্ত, গোলাপী হাসি মুখের মতন
    ঘুরে বেড়ায় মেঘগুলো
    আর পাহাড়ের গায়ে শেলাই করা গাছের দল
    ডালপালা নাড়ে।
    (ওই পাহাড়েই উঠবো আমরা হেঁটে হেঁটে।)
    অসভ্য জানোয়ার গাছের দল, যেন বলতে চায়,
    বাছাধন একদিন আসতেই হবে এখানে, খুব বশি
    দেরি নেইঃ আমাদের হাড্ডিসার বাহুর, আমাদের
    থলথলে বাহুর, আমাদের শীতল বাহুর আলিঙ্গনে।
    উদ্ভিদ জগতের নিষ্প্রাণ শীতলতায়
    মাথার চুল খাড়া হয় আতংকে।

    Ernesto Cardenal and I


    টীকা—এর্নেস্তো কার্দেনাল (১৯২৫-) নিকারাগুয়ার শীর্ষস্থানীয় কবি, গুরু, নেতা, বুদ্ধিজীবী ও ধর্মপ্রচারক। বাংলায় কবীর সুমন তাঁর কথা লিখেছিলেন প্রায় দু দশক আগে।


    বৃষ্টি
    বৃষ্টি ঝরে যায় আর তুমি বলো মেঘেরা যেন
    ডুকরে কেঁদে উঠলো হঠাৎ। তারপর মুখে করতল চেপে
    হাঁটার গতি বাড়াও। কংকালসার মেঘগুলো খামোকা
    কাঁদবে কোন্‌ দুঃখে? অসম্ভব! এত রাগ কেন তা হ’লে?
    এই অসহায়তাই কি নরকের দোরগোড়ায় নিয়ে যাবে
    আমাদের? প্রকৃতির অনেক কৃতকর্মই আড়াল করে
    তাঁর সক্রিয় সৎভাই, রহস্য। অতএব, সব ভাবনা চিন্তা
    শেষ হবার আগেই, আজ বিকেলেই, তুমি যদি
    মনে করো আজ বিকেলেই কলি যুগের সমাপ্তি, তা হ’লেও
    বিকেলটা বিষণ্ণই থাকবে, নির্জনতায় আকীর্ণ বিকেল
    মিলিয়ে যাবে, প্রকৃতির আরশি, অর্থাৎ স্মৃতিতে।
    অথবা সবই ভুলবে তুমি। বর্ষণ, ক্রন্দন, শৈলশিরায়
    তোমার একাকী পদক্ষেপের প্রতিধ্বনি। কিছু আসে যায় না
    তাতে। কাঁদো তুমি এখন আর সমুদ্র সৈকতে সারি সারি
    পার্ক করা গাড়ির কাচে মিলিয়ে যেতে দাও তোমার
    প্রতিচ্ছবিকে। কিন্তু ভুলেও হারিয়ে ফেলো না নিজেকে।

    Rain

    ভাগ্য
    গত এক হপ্তা গ্রামে তার হাড় হারামজাদা মনিবের খিদমত করে
    বাড়ি ফিরলো সে, তখন হবে ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাস,
    সঠিক মনে পড়ে না, কিন্তু ভীষণ শীত তখন এবং ট্রেন
    যখন বার্সিলোনায় ঢুকলোঃ তুষার পড়ছে জোর কদম,
    সেখান থেকে মেট্রো ধরে সোজা তার বান্ধবীর ফ্ল্যাটবাড়ির দোরগোড়ায়,
    রাস্তা থেকেই ফোন করলো তাকে, এসো, তুষার দেখি দুজনে।
    সুদৃশ্য রজনী, সন্দেহ নেই, বান্ধবী ঘরে ডাকলো তাকে, এক কাপ কফি খেতে, তারপর তুমুল সঙ্গম এবং সংলাপ, অনেক পরে
    যখন ঘুমিয়ে পড়লো সে, স্বপ্ন দেখে এক খামার বাড়িতে সে
    উপস্থিত, তুষার পড়ছে উঠোনে, পিছনে, দূরের পাহাড় এবং
    সেই উপত্যকায় সে বন্দী, বারবার ফোন করে বন্ধুকে এবং বন্ধুর
    শীতল কন্ঠ (শীতল অথচ সহৃদয়) শুনে মনে হবে মানুষটিরঃ
    এমন নিখুঁত, সুঠাম, সুন্দর সমাধি খুব সাহসী লোকেও পায় না,
    যদি না তার ভাগ্য সহায় হয়।

    Luck

    সব কবিতাগুলির এসপানিওল ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ—লরা হিলি (Romatic Dogs by Roberto Bolano. Trans. Laura Healy, New Ditections, 2008)


    অলংকরণ (Artwork) : উইকিপেডিয়া থেকে
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments