এক যে ছিল রাজা। তাঁর নাম ছিল মোক্ষব্যথী। সারাক্ষণ তাঁর মনে ছিল সংশয়। প্রাণে ছিল গোপন কোনো অপরাধবোধ। অষ্টপ্রহর একটা আতঙ্কে ভুগতেন তিনি –
একটা সন্দেহ
একটা দ্বন্দ্ব
একটা অবিরাম অশান্তি।
রাজা এই মানসিক অবস্থায় পৌঁছনোর অনেক দিন আগে তিন জন নারী তাঁর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। তারা বলেছিল যে যতদিন বীরনামী বন তাঁর কেল্লায় না অগ্রসর হয়, ততদিন রাজা সিংহাসনে বহাল থাকবেন।
কিন্তু বন আবার আসে না কি? আমরা সবাই জানি
গাছপালা
হাঁটে না
চলে না
নড়াচড়া করে না।
গাছগাছড়া দিয়ে ভরা যে বন, সেও অতএব চিরকাল একই জায়গায় থাকে, স্থান পরিবর্তন করে না।
তাই আশংকা ও প্যারানয়া নিয়েও রাজা একটা বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন – বীরনামী বনের অগ্রসর সম্ভব নয়। তাই তিনি জানতেন যে তাঁর রাজত্বও বহাল থাকবে।
কিন্তু একদিন শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনী এল। সেইসব সেনারা বীরনামী বনের গাছ থেকে
ডালপালা ভেঙে নিয়ে
ছদ্ম-আবরণ বানিয়ে
পোশাকের উপর গায়ে প’রে
আস্তে আস্তে
মোক্ষব্যথীর কেল্লার দিকে এগোতে থাকল।
দূর থেকে দুর্গের জানলা দিয়ে রাজা দেখলেন বীরনামী বন যেন তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে।
ভবিষ্যদ্বাণী মনে পড়ল তাঁর।
বিস্ময়ে বিহ্বল হলেন তিনি।
অবিশ্বাসী মনে উঠল চূড়ান্ত হতাশার ঝড়।
নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় তিনি নতজানু হলেন।
অনতিকাল পরেই রাজা শত্রুর হাতে প্রাণ হারালেন।
গল্পটা১ আগেও শুনেছেন হয়তো। কিন্তু গাছ কি সত্যিই কখনো নড়ে না? বা কোনো ভাবেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায় না? হয়তো বীরনামী বনের সব গাছগুলো অলীক এক মায়াবী ষড়যন্ত্রী পরিকল্পনা ক’রে মানুষের সাহায্যে নড়েছিল সে দিন! সেটা কি সম্ভব? বিধাতার বিধান যাতে বৃথা না হয়, সেই জন্য গাছেরা চলমান সৈন্যদের কাজে লাগিয়ে ছিল নিজেদের চলনশীল করার জন্য।
না, সেটা বড়ই অবাস্তব শোনাচ্ছে।
ছোটবেলায় বাড়ির পাশে যে পেয়ারা গাছটা ছিল,
সেটা কোনোদিনও হেঁটে পাড়া-বেড়াতে যায়নি।
শরৎ কালে শিউলি গাছ অনেক ফুল ছড়িয়েছে মাটিতে,
কিন্তু কোনোদিন গাছটা নিজেই মাটিতে শুয়ে পড়েনি।
হাসনুহানা হাওয়ায় নড়েছে বিস্তর,
পাখির মত উড়ে গিয়ে হাওয়া হয়ে যায়নি কখনো।
এটাই আমার গাছপালা সম্বন্ধে ছোটবেলার অভিজ্ঞতা। অদ্ভুত উদ্ভিদদের সাথে তখন আলাপ হয়নি।
যেমন সুন্দরী গাছ। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের মধ্যে একটি। নোনাজলে বেঁচে থাকে। জোয়ারের উঁচু জলে আর ভাঁটার নিচু জলে দিনে চারবার ক’রে মানিয়ে নেয়। আশিটার বেশি রকমের ম্যানগ্রোভ গাছ আছে, তার মধ্যে অনেকেই জরায়ুজ। মানে,
ফল অবস্থাতেই বীজ থেকে অঙ্কুর বেরোয়।
মাটিতে বা জলে যতক্ষণে ফল পড়ছে,
ততক্ষণে শিকড় বেরিয়ে গেঁথে যাবার জন্য
বীজ তৈরী।
বিশেষ বিস্ময়কর হ’ল red mangrove (Rhizophora mangle L.). এর ফল আসলে একটা জীবন্ত চারা। গাছ থেকে প’ড়ে নোনা জলে এই চারা-ফল ভেসে যায়। ভেসে অনেক দূর চ’লে যেতে পারে, এক বছরের উপর পর্যন্ত ভেসে থাকতে পারে। তারপর যখন পছন্দমত জায়গায় পৌঁছয়,
চড়াৎ ক’রে
শোয়া-অবস্থা থেকে দাঁড়ানো-অবস্থা হ’য়ে গিয়ে শিকড় গাড়ে।
কে বলেছে গাছ নড়ে না? শুধু যে ফাগুন মাসে,
কী উচ্ছ্বাসে,
শিরীষ-ডালে নাচের মাতন লাগে
তা-ই নয়, কখনো কখনো গাছ মাটির বাঁধন উপেক্ষা ক’রে যেতে পারে অন্য কোথা, অন্য কোন্খানে।
আর যে গাছ তা করতে পারে না, তার হয়তো আমাদের মত নির্মূল জীবদের দেখে সহানুভূতী হয়।
যেমন এক যে ছিল রাজপুত্র। একবার পথ হারিয়ে তিনি এক জনমানবহীন মরুভূমি পেরিয়ে একটা একাকী ফুলের দেখা পেয়েছিলেন - সামান্য সে ফুল, মাত্র তিনটে পাপড়ি তার। রাজপুত্র ফুলটাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
মানুষরা সব কোথায়?
ফুলটা কয়েকদিন আগে একটা কাফেলা (caravan) দেখেছিল। সে বলল,
আমার মনে হয় ছ’সাত জন মানুষ আছে পৃথিবীতে।
কিন্তু কেউ জানে না তাদের কোথায় পাওয়া যায়।
হাওয়া তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়।
তাদের কোনো শিকড় নেই ব’লে খুবই কষ্টকর জীবন।
সেই রাজপুত্রকেই২এক বিচক্ষণ শেয়াল বলেছিল,
যা সত্যি, তাকে একমাত্র হৃদয় দিয়েই দেখা যায়।
যা সারপদার্থ, চোখের দৃষ্টিতে তা ধরা পড়ে না।
কথাটা হয়তো ঠিক। একটা আক্ষরিক উদাহরণ দিই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী কি? নীল তিমি? নাকি দৈত্য-প্রমাণ সেকোয়া গাছ? কোনোটাই নয়। সবচেয়ে বড় হ’ল একটা ছত্রাক (fungus) যেটা আছে আমেরিকার অরিগন-এ।
আয়তনে প্রায় ২৪০০ একর।
বয়সে অন্তত আড়াই হাজার বছর –
আট হাজার বছরের বেশি হ’লেও বিজ্ঞানীরা অবাক হবেন না।
এই প্রাণীটা মানুষ প্রথম আবিষ্কার করে ১৯৯৮-এ।৩
আগে আমরা এর কথা জানতাম না কেন? কারণ বেশিরভাগ ছত্রাকের শরীরের অধিকাংশ ভাগই থাকে মাটির নিচে। মাটির উপরে শুধু বেরোয় মাশরুম বা ব্যাঙের ছাতা। মাটির নিচে থাকে একটা বিরাট শিকড়ের জাল, যাকে বলে মাইসেলিয়াম। সারা পৃথিবী জুড়ে আছে এই সব মাইসেলিয়াম জাল। গত কয়েক দশক ধ’রে সবে আমরা মাইসেলিয়াম সম্বন্ধে জানতে ও বুঝতে শিখেছি। এই জাল অনেকটা আমাদের internet-এর মত। নানা রকম গাছপালারা এই জাল দিয়ে
একে অন্যের খবরাখবর করে,
পুষ্টি ভাগাভাগি করে,
প্রতিযোগিতাও করে,
এবং আরো কত কী যে করে
এখনো আমরা বুঝে উঠতে পারিনি।
ছত্রাকদের একসময় আমরা উদ্ভিদ মনে করতাম। এখন পশুজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ এই দু’জায়গা থেকেই আমরা ওদের বার ক’রে দিয়েছি। ওরা বড় বেশি অদ্ভুত – আমাদের কাছে – আমরা সবাই যারা বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদে ডুবে আছি। বিরাট একটা অন্ধকার ঘরে একটা ছোট্ট মোমবাতির আলোয় যা দেখতে পাই, ভাবি তার বাইরে আর কিছুই নেই।
হৃদয়ে কি জং ধরে পুরোনো খাপে?
কারো কারো কল্পনাশক্তি কিন্তু বেঁচে থাকে আমরণ।
যেমন এক যে ছিল কবি। তাঁর বুকে ছিল প্রেম,
মুখে ছিল ভাষা,
প্রাণে ছিল গান।
আহা, বড় মধুর সে ভাষা, মধুর সে গান!
এই টেরি-কাটা চিক্কণ বিজ্ঞানের যুগে আমরা বাস্তবকে বুঝতে শিখেছি পোক্ত মনে, যুঝতে শিখেছি শক্ত হাতে। সেই কবি কিন্তু বলেছিলেন,
বাস্তবকে যত একান্ত করে দেখি ততই সে আমাদের পেয়ে বসে,
আভাসমাত্রে সত্যকে যখন দেখি তখনই মুক্তির হাওয়া গায়ে লাগে।
তিনি আমার আত্মার শান্তি।
দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি,
এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার
আমার এই মলিন অহঙ্কার।
এই কবি উপমা তৈরি করেন এমন যা আমাদের বুকের মধ্যে নিঃশব্দে প্রবেশ ক’রে একটা ‘অবাস্তব’ অথচ অমোঘ সত্যের সুগন্ধ দেয়। অনেক সময়ে খোলসা ক’রে বলতেই পারব না উপমাটা ঠিক কিসের, কিন্তু তাও অর্থবহ মনে হয়। কবি যেন
ভাষার চূড়ান্ত সীমায়,
জ্ঞানের অবধারিত সীমান্তে,
বাগানের শেষ প্রান্তে
নিয়ে গিয়ে
উঁকি মেরে দেখাতে পারেন
বেড়ার অন্য দিকের
এক ঝলক দৃশ্য।
যেমন -
এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে;
আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি-
লহো লহো করুণ করে।
স্কুলের দিদিমণি হয়তো বলবেন, ভাব সম্প্রসারণ করো।
আমি বলব, যদি বাক্য বিস্তার করার কোন কারণ বা প্রয়োজন থাকত, কবি নিজেই করতেন।
আর কবি তখন নিঃশব্দে হাসবেন।
ভাষার ঠিক বাইরে যে দাঁড়িয়ে থাকে, তার দিকে ইঙ্গিত করা যায়। ভাষা ও যুক্তির গণ্ডির মধ্যে তাকে সব সময় টেনে আনতে পারব, এমন আশা করা যায় না।
যাই হোক। উদ্ভিদ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কবি আমাকে দুটো কথোপকথন শুনিয়েছিলেন ‘চাঁপা’র সঙ্গে।
প্রথমটাতে চাঁপা নদীকে বলছে তার গোপন চলার কথা।
ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা,...
আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি,
আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা…
আমার চলা যায় না বলা-- আলোর পানে প্রাণের চলা--
আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তারা
এ কি তবে অন্য কোনো রকম চলা? না কি চলার এক কাব্যিক উপমা? গতির প্রতীক নাকি গতিই প্রতীক?
দ্বিতীয় কথোপকথনে পাখি প্রশ্ন করছে, চাঁপা কেন ওড়ে না আর গানও গায় না।
চাঁপা শুনে বলে, 'হায় গো হায়,
যে আমারই গাওয়া শুনিতে পায়
নহ নহ পাখি, সে তুমি নও।' …
চাঁপা শুনে বলে, 'হায় গো হায়,
যে আমারই ওড়া দেখিতে পায়
নহ নহ পাখি, সে তুমি নও।'
এও কি তবে আরেক রকমের গতি? উপমার সাংকেতিক চিহ্ন?
আমি মানসচক্ষে দেখতে পারছি আমার এই প্রলাপ প’ড়ে
বাস্তবের প্রহরীরা নিরাশ মাথা নাড়ছেন গম্ভীর ভাবে।
কবি হাসছেন।
দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে
হয়তো উদ্ভিদ চলে,
নড়ে,
ওড়ে,
কথা বলে,
গান গায়।
হয়তো উদ্ভিদ ভালোবাসে।
হয়তো কোথাও একটা উপমা লুকিয়ে আছে!
কি জানি!
সারপদার্থ তো চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না।
চাঁপার কথায়, কবির কথায় কোথাও যেন এক সত্যের আভাস পাই।
তখন মুক্তির হাওয়া গায়ে লাগে।
[২] Antoine de Saint-Exupéry-র 'Le Petit Prince'
[৩] https://www.scientificamerican.com/article/strange-but-true-largest-organism-is-fungus/