এই আমি হলাম বিশিষ্ট ফেসবুক লেখিকা পারমিতা মুকুটি। আমার পেশা শিক্ষকতা, নেশা সাহিত্যচর্চা। নেশাটি বছর দুয়েক হল আমার মনে অঙ্কুরিত হয়েছে। সত্যি বলতে কি আমি খুব টিভি সিরিয়াল দেখি আর ফেসবুক করি। তা ওই সিরিয়ালগুলো দেখতে দেখতে কেমন যেন আমার মনে হয়েছে এরকম গল্প লিখতে ‘আম্মো পারি’। বাস্তবে যা যা হয় না, কিন্তু হলে ভালো হত সে ঘটনাগুলোই হচ্ছে সিরিয়ালের গল্প। যেমন বিশাল যৌথপরিবার, অনেক ভাইবোন। তাদের স্বামী বা স্ত্রী। অবধারিতভাবে তার মধ্যে একজন নিজেকে বঞ্চিত ভেবে অন্যদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে ইত্যাদি। আর অবশ্যই একটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে হওয়া বিয়ে এবং পরে পরে সেটাই আদর্শ বিয়েতে পরিণত হওয়া – এই তো বিষয়। নায়িকা হয় ‘গোপাল’, নয় ‘মহেশ্বর’, নয় মা কালী আর নয়ত ‘জগন্নাথ’-এর একান্ত ভক্ত (এগুলো রিসেন্ট সংযোজন)। আরেকটা হিট বিষয় অবশ্যই বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক।
আমার সাহিত্যচর্চার আরেকটা অনুপ্রেরণা অবশ্যই ফেসবুক। আমার ফেসবুকের বন্ধুরা সবাই কিছু না কিছু পোষ্ট করে। আমারও খুব ইচ্ছে করে ফেসবুকে কিছু পোষ্ট করতে এবং অবশ্যই লাইক পেতে। কিন্তু আমি বেজায় আগোছালো আর কুঁড়ে। এই আগোছালো ঘরদোরের ছবি দেবার কোন ইচ্ছে হয়নি। বাগান নেই, দেখাবার মত আসবাবপত্র নেই, নেই দেখনসই চেহারা। আছে শুধু পোষ্ট দিয়ে লাইক পাবার ইচ্ছে। অনেক ভেবেচিন্তে একদিন আমার কর্তাকে বললাম, “ভাবছি গল্প লিখব।” উনি তো ভারি খুশি কারণ তাহলে আমার মুখ অন্তত কিছুক্ষণ বন্ধ থাকবে। বলতে নেই কথাটা আমি একটু বেশিই বলি। আর একমাত্র ছেলে হায়দ্রাবাদে চাকরি করে, ফলে সবটাই ওনাকে শুনতে হয়। আমার কপালগুণে উনি খুব কম কথা বলেন।
কিন্তু লিখব বললেই তো লেখা যায় না। গল্পের তো বিষয়বস্তু চাই। আমি যেহেতু একজন শিক্ষিকা তাই প্রথমেই অবৈধ প্রেমের গল্প হাতে এল না। ভেবেচিন্তে ভোলুকে নিয়েই একটা গল্প লিখলাম। ভোলু রাস্তার নেড়ি। কিন্তু দুবেলা আমিই খাবার দিই বলে আমারই গেটের সামনে শুয়ে থাকে। সেই ভোলুর আমার প্রতি ভালোবাসার গল্প (কে না জানে কুকুরের প্রভুভক্তির কোন তুলনা নেই)। গল্পের সঙ্গে ভোলুর একখানা ছবি দিয়ে পোষ্ট করে দিলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সাতাশ জন লাইক করল আর উনিশ জন কমেন্ট করল। বিভিন্ন ভাষায় এবং ইমোজিতে সবাই অসাধারণ বলেছে। আমার অবশ্য সাড়ে তিনশোর ওপরে বন্ধু। আমি প্রথমে একটু দমে গেছিলাম কিন্তু সঞ্জনা বলল, “একবারেই অনেক পাঠক পাবি ভাবিস না। তুই লিখতে থাক। সবাই আস্তে আস্তে জানবে। আপসেট হোস না।” আমি একের পর এক গল্প লিখতে লাগলাম। কর্তাকে শোনাতাম প্রথম প্রথম। তারপর দেখি আমি যখনই গল্প শোনবার কথা বলি ঠিক তখনই ওনার কোন না কোন দরকারি কাজের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু এতেও না দমে আমি লিখি আর পোষ্ট করি। অচিরেই লাইকের সংখ্যা বাড়ল, সঙ্গে আমার আত্মবিশ্বাস।
আমি যেমন আমার লেখা পোষ্ট করি তেমনি ফেসবুকে অন্যদের লেখাও পড়ি। পড়তে পড়তে মনে হোল গল্পের থেকে কবিতার কদর বেশি। আচ্ছা, আমি কবিতা লিখলে কেমন হয়? আগে কখনও লিখি নি কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কি? বাংলাই তো পড়াই। ভেবেই বেশ উত্তেজনা হল। শুরু হল আমার কাব্য-অভিযান। প্রথমেই পোষ্ট করতে সাহস হল না। আমার পাশেই বসে সাগরিকা, ওকে পড়ে শোনালাম। আর নিজের দ্বিধার কথাও বললাম। ওই বুদ্ধি দিল প্রথমেই পোষ্ট না করে স্টাটাস-এ দে। তোর আত্মীয়-বন্ধুরা কি বলছে দেখে নে। আমার যুক্তিটা পছন্দ হল। আমি ঘন ঘন কবিতা লিখে স্টাটাস আপডেট করতে লাগলাম। কেউ কেউ হাততালির ইমোজি পাঠাল। যখনই ভাবছি কবিতার হাতটা একটু পেকেছে এবার ফেসবুকে দেওয়া যেতে পারে তখনই বাবুয়া, মানে আমার ছেলের ফোন, “প্লিজ মা তোমার কবিতা লেখাটা বন্ধ কর নাহলে রিহানার সাথে আমার ব্রেক আপ হয়ে যাবে।”
রিহানা বাবুয়ার গার্লফ্রেন্ড। আমার সাথেও ফেসবুক এবং হোয়াটস অ্যাপ-এ কথা চালাচালি হয়। আমি কবিতাগুলো আপডেট করে ওর মতামত চাই। ও লেখে, “নট ব্যাড।” সেটা আমার একটা আত্মবিশ্বাসের কারণ ছিল। বাবুয়ার কথায় আমি খুবই দুঃখ পেলাম। তার মানে রিহানা নিতান্ত ভদ্রতা করেছিল! আজকালকার দিনে ছেলের বৌ পাওয়া সহজ নয়, তাই কবিতা লেখা এখনকার মত মুলতুবি।
এই মুষড়ে পড়া মনের অবস্থায় এই প্রধান অতিথি হবার আমন্ত্রণ। আমার সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল। নিমেষে আমার বয়স যেন দশ বছর কমে গেল। কিন্তু যারা আমায় আমন্ত্রণ জানাতে এসেছেন তাদের এককথায় হ্যাঁ বললাম না। নিজের দাম, আজকালকার ভাষায় ঘ্যাম, বাড়াবার জন্য বললাম, “ফোন নাম্বার রেখে যান, কাল জানাব।”
“ডাঙ্গারামপুর – এরকম নামের আবার জায়গা আছে নাকি? আর বাঁকুড়ার লোক তোমাকে চিনলই বা কি করে?” – কর্তা সন্দিগ্ধ।
কর্তা আমার এক বেসরকারি কোম্পানীর চিফ অ্যাকাউন্টেণ্ট। মানুষ ভালোই কিন্তু নীরস। ফেসবুকে নেই। আধুনিক সাহিত্য বলতে বোঝেন তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু আর অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। কবিতার কথা না বলাই ভালো। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত ছাড়া বোধহয় কারো নাম মনে করতে পারবেন না। পড়েন শুধু খবরের কাগজ আর দেখেন নিউজ চ্যানেল। সুতরাং রাগ না করে আমি বোঝালাম যে সম্ভবত ফেসবুকে আমার গল্প ওদের ভালো লেগেছে।
“তোমার ফ্যান বলছ? তাই এতটা ঠেঙিয়ে এন্টালী এসেছে তোমাকে প্রধান অতিথি করতে?”
এবার আর রাগটা সামলে রাখতে পারলাম না। “ওদের লাইব্রেরীর পঁচিশবছর পূর্তি। বই কিনতে কলেজস্ট্রীট এসেছে। একসাথে আমাকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে গেল।”
“তাই বল, কাছাকাছি এসেছিল তাই… নাহলে কলিকাতায় সাহিত্যিক কি কম পড়িয়াছে?”
আমার গনগনে মুখের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি সামলে নিল, “এটাও কম কথা নয়। তোমার ইনফো যোগাড় করতে হয়েছে, ঠিকানা খুঁজে বার করতে হয়েছে। নাঃ, অভিনন্দন জানাতেই হচ্ছে। কিন্তু তুমি যাবে কিভাবে? গাড়ি পাঠাবে?”
আমতা আমতা করে বলি, “না, আমাকে ডিরেকশন দিয়ে দিয়েছে। তেমন কঠিন কিছু নয়। যেতে পারব। বাসে সুবিধা। বাসস্ট্যান্ডে ওদের লোক গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে।”
“বেশ তবে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেও। আর ডিরেকশনটা আমাকে আর বাবুয়াকে পাঠিয়ে রেখ।”
আমি আর কথা বাড়াইনি।
বাস থেকে নেমে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। চারিদিকে কোথাও কোন গাড়ির নামগন্ধ নেই। একাই এসেছি, ছুটির দিন নয় তাই কোন সঙ্গী পাইনি। এদিকে লোকজনও দেখতে পাচ্ছি না। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছাড়িয়ে আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে। বাসস্ট্যান্ডে একটি তোবড়ানো টিনের শেড। আমি সেখানেই দাঁড়ালাম। এধার-ওধার কয়েকটা আধপাকা দোকানঘর। আধপাকা কারণ সবগুলোরই মাথায় টিনের ছাদ। একটি দরমার দরজা দেওয়া দোকান, গায়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা ‘পাঁটা-খাসির’ দোকান। এর অনেক রকম মানে হতে পারে। বুঝে নিলাম এখানে পাঁঠা এবং খাসির মাংস পাওয়া যায়।
উদ্যোক্তাদের ফোন করতে যাব এমন সময়ে মাথার চুল অদ্ভুতভাবে কাটা একটি ছেলে মোটরবাইকে আমার কাছে এসে দাঁড়াল, “আপনি কলকাতা থেকে আসছেন তো? পারমিতা ম্যা’ম? সরি একটু দেরি হয়ে গেল। আসলে যে টোটোটা আপনার জন্য বুক করেছিলাম সেটা অন্য ভাড়া নিয়ে চলে গেছে,তাই মোটরবাইকেই নিতে এলাম। আমার নাম অসীম।” আমি আরও একটু দমে গেলাম। টোটোতে নিয়ে যাবে ভেবেছিল? টোটোকে ঠিক গাড়ি বলা যায় কিনা বুঝতে পারছি না।
আমি এভাবে অপরিচিত কারোর সাথে মোটর বাইকে উঠিনি। সত্যি বলতে কি মোটরবাইকে চাপাই আমার অভ্যেস নেই। যাই হোক পঞ্চাশ পেরনো আমি বাঁ-হাঁটু সামলে (ওই হাঁটুটাতে মাঝে মাঝেই বাতের ব্যথা চাগাড় দেয়) অনেক কেরামতির পর মোটরবাইকে সওয়ার হলাম। কিন্তু আমার এথনিক ডিজাইনের শাড়ি বাঁচাতে গিয়ে আমার ব্যাগটি মাটিতে পড়ে গেল। নামলে আবার উঠতে পারব এই ভরসা অসীমেরও ছিল না। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটি বাচ্চা ছেলেকে দেখে হাঁক পাড়ল, “এ্যাই ভোলা, ম্যাডামের ব্যাগটা তুলে দিয়ে যা।” আমার সাদা ব্যাগের একদিক এখন গেরুয়া। মনের ভেতরটা উথাল-পাথাল করে উঠল। মাত্র ছ-মাস আগে বাবুয়া হায়দ্রাবাদ থেকে এনে দিয়েছে।
“আমাকে শক্ত করে ধরে বসুন, রাস্তা একটু ভাঙ্গা আছে।”
আমরা সরু এক পিচের রাস্তা ধরে চলেছি। দু-পাশে কিছু ইউক্যালিপ্টাস। আমি দু-পাশের গ্রাম্য সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছি। পাকাবাড়ির সংখ্যাই বেশি, মাঝে মাঝে মাটির বাড়িও আছে। বাড়িঘর, সজনে গাছ, লাউয়ের মাচা, ধানক্ষেত, মুরগির পোলট্রি, মোবাইল সারানো এবং রিচার্জের ব্যবস্থা সবকিছুই চোখে পড়ল। যখনই ভাবতে শুরু করেছি দূর হলেও জায়গাটা নেহাত মন্দ নয় তখনই এক রামঝাঁকুনি। আমি অসীমের একেবারে ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। অসীম কিন্তু অসীম তৎপরতায় আমার ভার বয়েও বাইক সামলে নিল। এরপরের রাস্তা এতটাই খারাপ যে প্রকৃতি ছেড়ে চোখ পথের দিকেই আটকে গেল। বেশ অনেকক্ষণ এইভাবে চলার পর আমরা একটি ডানহাতি রাস্তায় ঢুকলাম। রাস্তার মুখে বোর্ড লাগানো, “গ্রামীণ পথ যোজনা” এবং আমাকে অবাক করে এটি সত্যিই একটি ভালো রাস্তা। কিলোমিটার খানেক গিয়ে মোটরবাইকটি একটি লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়াল, ‘নিত্যানন্দপুর গ্রামীণ পাঠাগার’। দরজায় গাঁদাফুলের মালা আর মঙ্গলঘট দিয়ে সাজানো।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
মোটরবাইকের আওয়াজ পাওয়ামাত্র লাইব্রেরী-লাগোয়া দোতলা বাড়ি থেকে কিছু লোকজন বেরিয়ে এলেন। অসীম আমাকে একজন মাঝবয়সী মহিলার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল, “লাও জেঠি, তোমার অতিথ পৌঁছাই দিলম।” আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম উপস্থিত মানুষজনের মধ্যে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে গেছিলেন যাঁরা তাঁরাও আছেন। আমি একটু স্বচ্ছন্দ বোধ করলাম। হঠাৎ শাঁখের আওয়াজে চমকে তাকাতেই দেখলাম দু-চারজন মহিলা ও পুরুষ আমায় আপ্যায়ন করে লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে বসালেন। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম লাইব্রেরীর উত্তর দিকে একটি মন্দির এবং মন্দিরের সামনে প্রশস্ত খোলা জায়গায় একটা মেলা বসেছে। এখন অবশ্য মেলার দোকানগুলো বন্ধ।
একটু পরে সেই মাঝবয়সী মহিলা আমায় বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন। বেলা বেশ বেড়েছে। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, আর ভীষণ খিদে পেয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন সেখানে ভিড় করেছেন। তাদের সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। সাহিত্য আলোচনা ও গল্পপাঠের আসর দু’টো থেকে সাড়ে চারটে। আমার ফেরার বাস সওয়া পাঁচটায়, তাতেও বেশ রাত হয়ে যাবে। আমি মুখে একটা ভদ্রতার হাসি ধরে রেখে এইসব ভাবছি আর সকলের কথার উত্তর দিচ্ছি। সেই মাঝবয়সী মহিলা আমায় বললেন, “অনেক রাস্তা আইছ, যাও চোখেমুখে জল দিয়ে দু’টি খায়ে লাও।” আমার খুব ফ্রেশ হওয়া দরকার ছিল। বাথরুম থেকে বেরোতেই খাবার দেওয়া হল এবং আমি কোনরকম আপত্তি না করে খেতে বসে গেলাম।
একটা বেজে গেছে, আমাকে বলা হয়েছে একটু বিশ্রাম করে নিতে। দু’টোর পর সাহিত্যসভা শুরু হবে। আমার উৎসাহে ভাঁটার টান। যাদের সাথে এখন পর্যন্ত পরিচয় হয়েছে তাঁরা আমার লেখা পড়েছেন বলে মনে হল না। ফেসবুকে অবশ্য অনেকেই আছেন। কমবয়সীরা অনেকেই বলেছেন একবার যখন আলাপ হল এবার নিশ্চয়ই পড়বেন। যাইহোক অনুষ্ঠান শুরু হোল। অনুষ্ঠানের জন্য একটি প্যান্ডেল করা হয়েছে। তারই মধ্যে একটি মঞ্চ, বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং আমন্ত্রিত সাহিত্যিকেরা সেখানে বসবেন। আমিও সেখানে জায়গা পেয়েছি। আরও জনা পাঁচেক আছেন, তবে মহিলা একমাত্র আমি। এধার-ওধার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জনা পনেরো দর্শক বা শ্রোতা। সঞ্চালক খুব আবেগ দিয়ে এই অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ও আমার উপস্থিতির কথা বললেন। আমি আবার চাঙ্গা। সেই রোমাঞ্চ আবার আমার ভেতরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ব্যাগ থেকে আমার লেখাটা বার করে ঝালিয়ে নিলাম। মঞ্চে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ তিনি গ্রামের প্রধান এবং আজকের সভাপতি (লাইব্রেরীটি ওনার বাড়িরই বাইরের ঘরে, তাই উনি আমরণ সভাপতি)। একজন স্থানীয় কবি, একজন লিটল ম্যাগাজিনের লেখক, এবং ওই লাইব্রেরীর লাইব্রেরীয়ান। আরেকজন পুরুলিয়ার কবির আসবার কথা, কিন্তু এখনও পৌঁছননি। লাইব্রেরীয়ান ভদ্রলোকের সাথেই একটু কথাবার্তা হল। জানা গেল দোল উপলক্ষ্যে এখানে প্রতি বছর মেলা বসে, এবারে তার সাথে এই লাইব্রেরীর অনুষ্ঠান জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দোলের মূল আকর্ষণ যাত্রা। তিনদিনই যাত্রা হয়। মাঝের দিনে কলকাতা থেকে দল আসে। আজ সেই মাঝের দিন। তাই এখন ভিড় নেই। বেলা পড়লেই ভিড় বাড়বে। কথার ফাঁকে একটি বাচ্চা মেয়ে এসে নিয়মমাফিক চন্দনের ফোঁটা ও ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নিল।
এরপর সভাপতির বক্তব্য। সেই গরুর রচনার মত বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে দু-চার কথা বলেই তিনি প্রধান হবার পর লাইব্রেরী রং করিয়ে দিয়েছিলেন (কিন্তু ওটাতো ওনারই বাড়ি!) এবং দু-টি বেঞ্চ কিনে দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে আরও কত কি করবেন ইত্যদি বলে চললেন। গতকাল দোল ছিল কিন্তু তাও তেমন গরম পড়েনি। ভোরবেলা ওঠা, সারাদিন জার্নির ধকল, পেটভর্তি মাছভাত এবং ঝিরঝিরে হাওয়া আমার চোখদুটো আর খোলা রাখতে দিল না। চটকাটা ভাঙল যখন কানে গেল সঞ্চালক বলছেন যে লেখিকা পারমিতা মুকুটি এইগ্রামে বই পড়ার উৎসাহ দেখে বাচ্চাদের গল্পের বই কেনার জন্য দশহাজার টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমি অবাক হতেও ভুলে গেলাম। উপস্থিত জনা পঁচিশেকের হাততালিতে প্রতিবাদ করা হল না। গলাটা একদম শুকনো। সামনে রাখা জলের জাগ থেকে জল খেতে গিয়ে ডিজাইনার শাড়ি খানিক ভিজল। আমার ভ্রূক্ষেপ নেই।
লাইব্রেরীয়ান ভদ্রলোকের বক্তব্য চলছে। ভদ্রতা করে তিনি আমার লেখার প্রশংসা করলেন। নেহাতই মামুলি প্রশংসা এবং আমার কোন সন্দেহ নেই যে তিনি আমার কোন লেখা পড়েননি। যাইহোক ভাবনাগুলোকে পিছু হঠিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। প্রধান অতিথির বক্তব্য আর স্বরচিত গল্পপাঠের জন্য আমার ডাক পড়েছে। উপস্থিত পঁচিশ জন মিলে সারাজীবনে পঁচিশটি গল্পও হয়ত পড়েননি, তাও খ্যাতির মোহে আমি দু-চার কথায় আমার গল্পলেখার শুরু ও ভালোলাগার কথা বললাম। দু-চারটে মাত্র হাততালি পড়ল। আমার গল্প পড়তে শুরু করলাম। মিনিট কুড়ি লাগল শেষ করতে। মাইকটা গাঁক-গাঁক করছে কিন্তু সবই অসাড় জেনেও আমি আবেগতাড়িত।
হঠাৎ চারদিকে “আগুন, আগুন” বলে আওয়াজ ঊঠল। আমি তখনও মাইকের সামনে। প্যান্ডেলের পাশেই মিষ্টির দোকানে আগুন লেগেছে। সবাই সেদিকে ছুটল। চারপাশে হুড়োহুড়ি, চেঁচামেচির মাঝে পেছন ফিরে দেখি মঞ্চে কেউ নেই। সবাই ছুটছে দেখে আমিও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটলাম। হাইহিল ফ্যাশনেবল চটি। নিয়মিত পরি না, বিশেষ বিশেষ জায়গায় পরে থাকি। ফলে টাল সামলাতে পারলাম না, কোথাও আটকে গিয়ে পা পিছলে এক্কেবারে যাকে বলে ভূপতিত। উঠতে চেষ্টা করেও পারলাম না। অসহ্য ব্যথা ডান পায়ে, ডান হাতে কব্জির কাছটা নিমেষে ফুলে ঢোল। তীব্র যন্ত্রণা সেখানে, বোধহয় ভেঙ্গেছে।
সন্ধ্যে অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে। আমি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শুয়ে আছি। ডান-পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজের সাময়িক চিকিৎসা। ডানহাতের কব্জিতে প্লাস্টার। আয়োজকরা জেলা সদরের মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি কিছুতেই রাজী হইনি। বেরসিক কর্তার অপেক্ষা করছি। তাকেই সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে।
আমার সঙ্গে অনেক লোকই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন, কিন্তু যাত্রাদলের লোকজন এসে পড়েছেন শুনে ভিড় পাতলা। একজন নার্সদিদি আর অসীম ও তার জ্যেঠি আমার কাছে বসে। আমার খ্যাতির মোহ সরে গিয়ে সাধারণ বোধবুদ্ধি ফিরে এসেছে। ব্যথায় কাতর হয়েও আমি জানতে চাইলাম, “সত্যি করে বলো তো আমার খবর তোমার পেলে কি করে আর আমি যে লিখি তাই বা জানলে কি করে?” অসীম লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বলল, “সরোজদা বলেছেন। উনি তো বিলাসজ্যাঠা, মানে আমাদের প্রধানের ভাগ্নীজামাই।”
সরোজ! ও তো আমাদের স্কুলের ক্লার্ক। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম ওর সাথে আমার কোন ঝামেলা আছে কি না। আমি কি ওর কোন অসুবিধার কারণ হয়েছি কখনও? দু-এক বার অবশ্য আমাদের চাপে পড়ে আমার গল্প শুনতে ও বাধ্য হয়েছিল। এটা কি প্রতিশোধ?
হঠাৎ খেয়াল হল কম্পাউন্ডারবাবু তার মোবাইলে ভিডিও তুলে চলেছেন। আমি লক্ষ করছি দেখে একটু থতমত খেলেন, তারপর লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, “আমার বৌ ইউটিউবে ব্লগ করা শুরু করেছে। এখানকার দোলযাত্রা আর মেলারও করছে। আপনি এখানে রয়েছেন শুনে আমাকে এই অংশটার ভিডিওটা করতে বলেছে। কিছু মনে করলেন না তো?”
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ডানহাতের ভাঙ্গা কব্জির দিকে তাকালাম। বেশ কিছুদিনের জন্য অন্তত আমার গল্প পোষ্ট করা হবে না। অতএব লাইকের আশা নেই। আমার জন্য অন্য কেউ যদি ভিউয়ার পায় মন্দ কি? আমারও হয়ত তাতে একটু বিজ্ঞাপন হবে, আর হয়ত পরিচিতিও বাড়বে।
অমায়িক হেসে কম্পাউন্ডারবাবুকে নিশ্চিন্ত করে আমি ডানহাতের প্লাস্টার সামনে বাড়িয়ে ধরে ব্যথিত মুখের পোজ দিলাম।