একটু বেলার দিকে চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছি এমন সময় আবার শুনলাম ঠক ঠক ঠক। জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম, দেখি সেই পাখিটা এসেছে। বোঝার চেষ্টা করছিলাম পাখিটা কেন বন্ধ কাচের পাল্লায় ঠোকর মারতে থাকে! কাচটার ওপর রোদ্দুর কমানোর হালকা কালো প্রলেপ লাগানো আছে। ভেতর থেকে দেখলে সব সময়ই মনে হয় বাইরে যেন মেঘ করেছে।
আমি এই জানালাটার কাছে এসে বসা জোড়া শালিখের ছবি নিতে অনেকবার চেষ্টা করেছি। কথায় বলে ‘টু ফর জয়’ তাই। পা টিপে টিপে গেলেও ওরা জানলার এপারে নড়াচড়া ঠিক ধরে ফেলে। দুটোর মধ্যে একটা উড়ে যাবেই যাবে। ‘ওয়ান ফর সরো’ তুলে আর কী করব। তাই ছবি তোলা হয়নি কখনো। তার মানে পাখিরা এই হালকা ছায়া-মাখা কাচের ভেতর কেউ নড়াচড়া করলে বুঝতে পারে। এই অভিজ্ঞতাটি ছিল বলেই আমি আরও অবাক হলাম।
সেদিন আমি পায়ে পায়ে চুপি চুপি জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম। পাখির কোন হুঁস নেই, সে জানালার কাচে ঠোকর মারছে আর মাঝে মাঝে ঝটপট করে কাচ বেয়ে যেন উঠতে চাইছে। ওরে পাখি, তুই এত অন্যমনস্ক কেন রে? তোর এত কাছে একটা গোটা মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে আর তুই খেয়ালই করছিস না! এরকম হলে তোদের চলবে না। কে কখন ধরে ফেলবে, তখন কী হবে? মাথার ওপর চিল ওড়ে দেখেছিস তো!
আমি জানালার আরও কাছে আসলাম। তারপর অনায়াসে আটত্রিশ সেকেন্ডের একটা ভিডিও তুলে ফেললাম।
পাখি কি আমাকে একটুও দেখতে পায়নি? টের পাওয়া তো উচিত বিশেষ করে পাখির মতো সাবধানী আর চঞ্চল প্রাণীদের। কিন্তু বুঝলাম জানালার কাচে ওর এত মন যে আর কিছু খেয়ালই হচ্ছে না।
জানালাটার সামনেই দুটো গাছ আছে। একটা করম গাছ (আমি গাছ একদম চিনি না, কে একজন বলেছিল)। গাছের ডালপালা যেমন অনেক সময় নাচের মুদ্রার মতো সুন্দর ভঙ্গীতে আকাশের দিকে ওঠে, এ গাছ সেরকম কিছু নয়। বলতে গেলে এর তেমন রূপ নেই। শুকনো শুকনো ডালপালা। তার ওপর যত্রতত্র কীরকম বিচ্ছিরি কালো কালো ছাপ। গাছটার চর্মরোগ হয়েছে হয়তো। পাতা খুব কম। এ বাড়ি যখন তৈরি হয়েছিল তখন মনে হয় গাছের অনেক ডাল কেটে দিয়েছিল। সেগুলো আর গজায়নি। যা পড়ে আছে তাই নিয়ে বেচারা জীবন ধারণ করে আছে। কিন্তু পাশের দেবদারু গাছটি সুন্দর। দেবদারু মূলত একটা সোজা ডালের উঁচু গাছ। পাতাগুলো লম্বাটে, ধার খাঁজ-কাটা। কচি পাতার রংটা সবুজের কোন গোত্রে পড়ে তা আমি ঠিক জানি না। দেবদারুর পাতার গুচ্ছ অনেক জায়গায় শুকনো গাছের ডালের ঠিক পেছনে। দূর থেকে ঠাহর করা যায় না কোন পাতা কার।
আমি বেশ খানিকক্ষণ স্থাণুর মতন দাঁড়িয়ে পাখির আচরণ লক্ষ করলাম। এতক্ষণে বুঝলাম ব্যাপারটা কী। বাইরে থেকে জানালার কাচে গাছের ছায়া পড়েছে। সে ছায়া বোধ হয় আয়নার মত সঠিক প্রতিচ্ছবি নয়। হালকা মেঘরঙা কাচে সে ছায়া হয়তো এতই মায়াময় যে পাখির চোখে স্বপ্ন নিয়ে আসে। পাখি তুই মাইকেল পড়েছিস রে? – “ছিনু মোরা সুলোচনে গোদাবরী তীরে/ কপোত-কপোতী যথা উচ্চবৃক্ষচূড়ে বাঁধি নীড় থাকে সুখে. . .” না পড়লেও আমি জানি জানালার কাচের মায়াদর্পণে তুই ওইরকম নীড়ের স্বপ্ন দেখছিস। শুকনো গাছের ডালে তুই ঠোঁটে শান দেবার জন্য ঠক ঠক করবি, আর তোর বাসা হবে ঝুপঝুপে পাতার আড়ালে। সেখানে তোর সঙ্গিনী বসে বসে ডিমে তা দেবে। সারা এলাকা ঘুরে ঘুরে তুই তার জন্য ভালো ভালো খাবার নিয়ে আসবি। কিন্তু সে ছায়াছন্ন পল্লবঘন নীড় কোথায়? দেখতে তো পাচ্ছিস, কিন্তু যেখানে তা আছে মনে হচ্ছে তা শতবার ঠুকরেও সেখানে যেতে পারছিস না। কখনো ভাবছিস ওই ঠান্ডা পিছল জিনিসটা বেয়ে কিছুটা উঠতে পারলে তুই খুঁজে পাবি। বারবার কতবার তুই ডানা ঝটপটিয়ে কত চেষ্টা করলি তবু পেলি না। তুই কি এখনো বুঝিসনি ঘনহরিৎপল্লবসজ্জিত নিবিড়ছায়াছন্ন ওই গহনবৃক্ষশাখা মায়াদর্পণের প্রতিচ্ছবি মাত্র?
না কি তুই বুঝেছিস। পাখি তুই কি জেনে গিয়েছিস যে সে মিথ্যে হয় হোক, তবু সেই স্বপ্নকে জড়িয়ে ধরে পাখা ঝাপটাতে বড় সুখ। পাব না তো কী হয়েছে?
এই রে, ডিমসেদ্ধ চাপিয়ে ছিলাম, গেল বোধ হয়। জলটল শুকিয়ে ফট করে ডিমটা না ফেটে যায়। দৌড়ে গেলাম রান্না ঘরে। উফ, এই পাখিটার কাণ্ড দেখে কখনো কবি কখনো দার্শনিক টাইপ হয়ে যাচ্ছি।
জল ফুটে ফুটে শুকিয়ে এসেছে, ডিম এতক্ষণে পাথরের মতো শক্ত হয়ে হয়ে গেছে! যাক গে। এবার মনে পড়ল একবার তো বেরোতে হয়, কটা টুকিটাকি জিনিস আজ না কিনলেই নয়। ফোন, কটা টাকা আর চাবি নিয়ে বেরোচ্ছি এমন সময় জানালাটা আবার নজরে পড়ল। না, পাখি এখন নেই কিন্তু পাল্লা সরিয়ে দেখলাম বাইরে থেকে ঠুকরে ঠুকরে কাচে বিচ্ছিরি দাগ করে দিয়েছে পাখিটা। ওরে পাখি, কবে তোর মায়াদর্পণের নেশা কাটবে! এ কাচ পাল্টাতে বা সারাতে বেশ খরচা পড়ে যাবে রে।
হঠাৎ মনে পড়ল, এত মন দিয়ে কাঠঠোকরার ভিডিও তুললাম, ওটা তো পোস্ট করতে হবে। তক্ষুণি না বেরিয়ে, ফোন নিয়ে বসলাম। দু-তিনটে গ্রুপে আর কজন বন্ধুকে পাঠালাম। এই করতে গিয়ে চোখে পড়ল এক বন্ধু উটি থেকে ছবি পাঠিয়েছে। এর বাড়িতে ওর মেয়েকে নিয়ে বিস্তর সমস্যা হয়েছে, আমি জানি। তবে এ ছবিতে তার কোনো চিহ্ন নেই। পাহাড়ের ঢালে মিয়াঁ-বিবি যেন সিনেমার স্টার। এবার জমাটি ভালোবাসার গান শুরু হবে। পটাপট বুড়ো আঙুল মানে লাইক দিয়ে দিলাম। এই করতে গিয়ে হাত পড়ে গেল ছোটহাতের এফ অক্ষরটায়, ফেসবুক আইকনে। ফেসবুক খুলে গিয়ে সরসর করে ছবি আসতে লাগলো। একটাতে চোখ আটকে গেল। বসার+খাবার ঘর কী সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র দিয়ে সাজিয়েছে!! দারুণ। এসব আসবাবপত্র হয় বিদেশের, নয় খুব দামি। আমার সাধ্যের অনেক অনেক বাইরে। এরকম আমার ঘরে কখনো হবে না ঠিকই কিন্তু তাতে কী হয়েছে! দেখেও তো সুখ।
ফেসবুকে একবার আটকে গেলে চট করে অন্য কাজে যাওয়া যায় না। সুরেলা গলায় এক সুন্দরীর গান, ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকায় ভরা বাগানের ছবি, কোন দূর দেশের আলো-ছায়াতে মাখা উপত্যকার রোপওয়ে থেকে তোলা অসাধারণ ভিডিও, সমুদ্রতটে নাম-না-জানা শিল্পীর বালির প্রাসাদ। এসব জায়গায় সশরীরে পৌঁছোবার কথাই ওঠে না তবু দেখতে দেখতে মজে গিয়েছিলাম। সময় অনেকটা চলে গেল। রোজই যায়।
গোটা কয়েক দোকান ঘুরে জিনিসগুলো কিনলাম। ফিরছি, মোড়ের মাথায় দেখলাম দুলালের দোকানটায় দু-চারটে কলেজের ছেলেমেয়ে মোবাইল ফোনের রংবেরঙের ঢাকা কিনছে। অত্যধিক ব্যবহারে আমার ফোনের ঢাকাটাও বিচ্ছিরি হয়ে গেছে। পকেটে রাখা চাবির সঙ্গে ঘষাঘষিতে জায়গায় জায়গায় ছাল উঠে গেছে, বেগুন ভাজার তেলের ছাপ, পার্কের রেলিঙের কাঁচা রঙের নাছোড়বান্দা আলপনা সব নীরবে এতদিন ধরে সহ্য করেছে ফোনের খোলশটা। কদিন ধরে ভাবছিলাম ঢাকাটা পাল্টাতে হবে। আজ ঠিক জায়গায় ঠিক সময় মনে যখন পড়েছে তখন দুলালের কাছে যাওয়াই যাক।
দুলাল পাড়ারই ছেলে, অনেকদিনের চেনা। বললাম, “বাঃ, তোর ব্যাবসা তো ভালো চলছে দেখছি। কলেজের ছেলেমেয়েগুলো সবাই তোর খদ্দের।”
“অত বলবেন না কাকু, কলেজ থাকলে বিক্রি হয়। যেই এদের গরমের ছুটি হয় অমনি ব্যবসা ঢিলে হয়ে পড়ে”
“আরে সে তো হবেই। সারা বছর খদ্দেরের ভিড় কোথাও হয় না। দে রে দুলাল, আমার মায়াদর্পণের একটা ভালো ঢাকা দে তো দেখি”
“তা তো নেই।”
“নেই কেন! এই তো এতগুলো বিক্রি করলি এইমাত্র।”
“আমি তো শুধু মোবাইল ফোনের ঢাকা রাখি, আপনি মায়া কী যেন বললেন”
তিন ফুট বাই পাঁচ ফুট জানালার কাচে ঘন পাতায় ঘেরা ঘরের প্রতিচ্ছবি দেখে কাঠঠোকরা। অবুঝ শিশুর মতো পাখিটা। বোঝেই না যে কাচে যা দেখছে তা শুধু ছায়া, সেখানে যাওয়া যায় না। তবু বেচারা স্বপ্নের মোহে সে ঘর ছুঁতে চায়। হাতের তেলোয় স্মার্টফোনের তিন ইঞ্চি বাই পাঁচ ইঞ্চি কাচে আমিও দেখি স্বপ্নের ঘরবাড়ি, স্বপ্নের দুনিয়া। আজ-কাল-পরশুর ঝামেলাটামেলার থেকে অনেক দূরে। ঘোর লেগে যায়, ধরা ছোঁয়ার বাইরে তো কী হয়েছে।
এত সব জেনে দুলাল কী করবে? আমি তাই বললাম, “ওই হলো, মায়াদর্পণ মানে মোবাইল ফোনের ঢাকাই চাইছি রে”