আপাত রুক্ষ কোলিয়ারি অঞ্চলের পটভূমিতে মানবজমিনের কৃষিকাজে লেখক তার কুশলী কলমে সু-ফসলের প্রমাণ রেখে গেছেন সর্বত্র। পড়তে পড়তে কোনও গল্পের মধ্যে নয়,যেন সেই জায়গার চারপাশ – বালিজুড়ি, কোন্দা, গোগলা, বনগাঁ, সেই বুনো কুলের ঝোঁপ, পোয়াবাগানের ভিতর পাঠক নিজেকে মানিয়ে নিয়ে একাত্ম হতে চাইছে। নির্দিষ্ট পরিসীমায় আবদ্ধ না থেকে এই কথকতা যেন ভূগোল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে চায় সবখানে। গ্রাম্য সরল আন্তরিকতার পাশে রাজনীতির গা ঘষাঘষি যেমন আছে তেমনই গ্রামীণ সুরে বাঁধা প্রেম প্রীতি স্নেহের স্পর্শ জীবন্ত করে তুলেছে পাঠকের সঙ্গে গল্পের চরিত্রগুলোর সম্পর্ক।
সময়টা যেহেতু সত্তরের দশকের আশপাশ তাই গাঁ গঞ্জের রাজনীতিতেও খুনখারাপি আছে। ট্রেড ইউনিয়নের উত্তাপ আছে। কয়লাখনির জাতীয়করণের পাশে কাঁচা টাকার আমদানি আছে।ঠিকাদার আর মালিক শ্রেণির বিভেদ আর অসাম্যের বুনন আছে। তেমনই একটি চরিত্র অশোকবাবু, রাজনীতি করেন। ক্ষমতার লড়াই মানুষকে নীতিহীন করে। তার কাছে আর কাজ করতে মন চায় না সরল সাদামনের জীবন নামের ছেলেটির। সে বুঝেছে এইসব কাজ সোজাপথের নয়। তাই সে ফাগুমাস্টারের কাছে গান শিখতে চায়। থাকতে চায় ফাগুমাস্টারের ছায়ায়। বাঁচতে চায় তার গ্রামীণ প্রেমিকাকে নিয়ে...ধবলী নামের মেয়েটি তার প্রেম। ধবলীকে দেখে 'বুকের ভিতরে ট্রেন এসেছিল জীবনের। ভালোবাসার ট্রেন।'
লেখকের কলমে গ্রামময়তার ভালোবাসার ছবিটি যেরকম- "ওদিকে বাঁধের জল থেকে একে একে বাগদীদের মেয়েরা জল থেকে উঠে আসছে। জীবনের ভয় হোল। ধবলীর মা বাদলী তার ফর্সা বিটিকে পাহারা দিয়ে রাখে। খুব ভালো করে জানে, এমন সুন্দরী মেয়ের তাদের গাঁয়ে ঘরে খুব চাহিদা। জীবন বলল, ঠিকই ধরেছিস আমি শিরশেতে হারুর সঙ্গে দেখা করতে চললুম, ঐ দ্যাখ, তুর মা উঠে আসছে, আমি পালাই, বড় ভয় করে তুর মাকে।
কিছুটা মেঠো পথ, আলের উপর দিয়ে রাস্তা, সেটা পেরোলেই কয়েকটা অর্জুন আর মউলগাছ, কুলের ঝোঁপ। একটা ছোট্ট ডোবার মতন জলাশয়, তার কাঁকুড়েপাড়ের উপরে কয়েকটা শালিক, টাসকোনা পাখি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্জুন গাছে দুটো কাঠবিড়ালি তরতর করে উঠে গেল। জীবন ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছিল কালিপুর স্কুলে, তারপরেই বাবা মরে গেল, সংসারের বোঝাটা কাঁধে চাপল। এখনও তার মনে অনেক কিছু শেখার শখ। গোঁসাইদাদার মতন বাঁশি বাজাতে ও গায়েন করতে তারও খুব মন হয়।"
ফাগু মাস্টার আসলে এমনই একজন মানুষ যে তার চারপাশের এইসব প্রত্যন্ত ছেলেমেয়েদের নিয়ে বালকসঙ্গীতের দল গড়েছেন যা আদতে কৃষ্ণযাত্রা। ওঁর ভালো নাম নবকিশোর নায়ক। তবে ফাগুমাস্টার নামেই পরিচিতি তাঁর। বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বালকসঙ্গীত পরিবেশন করে গ্রামের অনাড়ম্বর মানুষকে আনন্দ দেন। ফাগুমাস্টার বালকসঙ্গীত পালাগানের মধ্যে দিয়ে মানুষের মানবিক দিকগুলিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। চেষ্টা করেছেন নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে। ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন মানুষের মনে ভালোবাসা।
রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন "প্রেমের অসাধ্য কিছু নেই। লেখাপড়া, শরীরচর্চা, গানবাজনা সবেতেই প্রেম দরকার, মানে একনিষ্ঠতা প্রয়োজন। সুর চাই। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সুরের মূর্ছনা চাই, তবেই এগিয়ে যাবে সমাজ।"
নিজের বাড়িতে বালক সঙ্গীত মহড়ার এমন আন্তরিক এমন নির্মল আনন্দের ছবিটি ধরা আছে লেখকের কলমে-
"এমন মরমিয়া সুরের রেশ বুঝি আমগাছের তলার বাতাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, পৌঁছে যায় আশেপাশের বাড়িতে, মাস্টারের অন্দরমহলে। গাছের উপরে কোথায় ঘাপটি মেরে ছিল কোকিলেশ্বরটি, সেও এবার ডেকে ওঠে, কুউকুউউ । কুউকুউউ।
আকাশ কোনো ষড়যন্ত্র করে না, বাতাস হিল্লোল বজায় রাখে, এ যেন এক শিল্পমহল। হারা বলল, অসে, আমি বাঁশিটঅ বাজাই?
মনোরমা আর শীতলা ধামাতে করে মুড়ি, পকড়ি, পিঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা নিয়ে আসে। শালপাতার ঠোঙাতে মুড়ি দেয় সবাইকে। বালতিতে কুয়োর জল আর ঘটি এনে দেন, বিনোদিনী বলেন, তুমরা সব জলখাবার ঘেঁয়ে লাও, ভাত খেতে দেরি হবেক। আমি তুমাদের জন্য লাল চা পাঠায় দিছি। ভাত খাওয়ার আগে একটু রিহারসেল করে লাও, খেয়ে তখন ভরতি পেটে গা লড়বেক নাইখো। আমি টুকদু বাদে তুমাদের মাস্টারকে পাঠায় দিছি। উনি চান করে চা-টা খেঁয়েই আসব্যেন। আরাম করে খাও তুমরা।"
পৃথিবীর প্রতিটি শিল্পরচনার ক্ষেত্রভূমিটি এইরকমই। এই রঙ্গমঞ্চে মা, ভাই, বোন, গুরু সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়ে, সৃষ্টি নিয়ে মশগুল থাকে, আর নীরবে যোগান দিয়ে যায় মনোরমারা। হারা বলে উঠল, মা ঠাকরুণকে যতো দেখি, অবাক হয়ে যাই।"
প্রশ্ন জাগে এই সরল জীবনের চাহিদা কি আজ ফুরিয়েছে? এই বিলাসময় আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রার ভিতরে আন্তরিকতা হারিয়ে গেছে। সবই কৃত্রিম, প্রাণহীন। বর্তমানের অবক্ষয়, অশান্ত পরিবেশ, সীমাবদ্ধ যাপনে মানবমনের এই সহজ প্রবৃত্তি গুলি মানুষের মন থেকে সরে যাচ্ছে দ্রুত। মানুষের এই ইতিবাচক দিকটি খুব সুন্দর ভাবে লেখক এই বইয়ে তুলে ধরেছেন।
উপন্যাস পড়তে পড়তে কোলিয়ারি জীবন সম্বন্ধেও একটা সম্যক ধারণা গড়ে ওঠে। খনিগর্ভে যারা জীবন বাজি রেখে কয়লা তুলে আনে তাদের অমানুষিক পরিশ্রমের মূল্য তারা পায় না। তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ একদিন বেরিয়ে আসে। গদাধর মিলু ঘোষের মতো কিছু সৎ মানুষ তাদের সংঘবদ্ধ করে। ফাগু মাস্টারও যোগ দেয়, যদিও সে শ্রমিক রাজনীতি করে না। তবু মঞ্চে উঠে তার আন্তরিক কথাগুলো সবাইকে আবিষ্ট করে।
“কাজই বড়ো কথা নয়, কাজের পর মানুষের বিনোদন দরকার। মনের ও আত্মার বিকাশের জন্য। তাই যে যা পারেন, তাই নিয়ে নিজেদের ভরিয়ে রাখুন, যেমন আমি কলিয়ারিতে চাকরি করি, কিন্তু অবসরের সময় ছেলে ছোকরাদের নিয়ে বালকসঙ্গীত করি, তাতে কিছু রোজগারও হয়। ঝুলি ভরে, মনও ভরে। আপনাদের বহু পুরোনো একটা কবিতার লাইন মনে পড়িয়ে দিই, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর লেখা, "জোটে যদি একটি পয়সা, খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/দুটি যদি জোটে তবে ফুল কিনো হে অনুরাগী।" আজ এই পর্যন্ত। নমস্কার। সবাই ভালো থাকবেন, আনন্দে থাকবেন, অপরকেও আনন্দে রাখার চেষ্টা করবেন।" এভাবেই এক মহৎ বার্তা তিনি সঞ্চারিত করেন মানুষের মনে "মানুষকে ভালোবাসার মতো ধর্ম পৃথিবীতে আর কিছুই নেইখো"।
রাজনীতি তথা ট্রেড ইউনিয়নের কড়া রোদে সাহিত্যেরও ছায়া এসে প্রভাব ফেলেছে ফাগুমাস্টার তথা এই উপন্যাসের চরিত্র গুলির বয়ে চলা প্রাত্যহিকতায়। আসলে জীবন যে সাহিত্যের বাইরে কিছু নয়, সেকথা এই উপন্যাসের চরিত্রগুলি প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রমাণ রেখে গেছে। যে কারণে চন্দনের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় - রাজনীতি আর সাহিত্য রবীন্দ্রগান বা লালনগানের মতোই একাকার হয়ে যায় যদি না সেই রাজনীতিতে স্বার্থ থাকে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকে।
সকলের সম্মিলিত পরিশ্রমে এই মফস্সলে একদিন পত্রিকা প্রকাশ পায়। পাঞ্চজন্য পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে কত অজানা প্রতিভার আবিষ্কার হয়। সম্পাদক বীরেনদা চন্দনের চোখে যেন অন্য ভাবে ধরা দেয়। "চন্দন এভাবেই থমকে যায়। বীরনেদার স্বপ্নিল চোখের ভিতরে সে দেখতে পায় এক উদাসীন দৃষ্টি, তাদের দেখার সঙ্গে মেলে না, বীরেনদার লেখালিখির মধ্যেও মিলেমিশে থাকে অন্য ভাবনা। কখনও সামাজিক অবক্ষয়ের কথা, কখনও বা পুরাণের কোনো প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে তাকে সামাজিক রূপ দেওয়া। বীরেনদা গ্রীক মাইথোলজিকেও নিজের মতন করে নিয়ে সাজিয়ে নিয়েছেন, আটপৌরে চালচলনের মধ্যে নিয়ে এসেছেন অর্ফিউস ও ইউরিপিদিসকে, চন্দন যতো দেখে ততোই বিস্মিত হয়।"
এই উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র ফাগু মাস্টারের শিল্পীসত্তার যতখানি পরিচয় পাই,তার রক্তমাংসের যাপনের ছবি ততটা সোচ্চার নয়।কোনও কোনও চরিত্রের রূপরেখা বাস্তবতায় ফাগুমাস্টারকে অতিক্রম করে যায়। তবুও লেখকের নিপুণ কলম বাস্তব সময়ের নিখুঁত দর্পন হয়ে ওঠে। কোলিয়ারির প্রি ন্যাশালাইজেশন,আঞ্চলিক ছোটো সাহিত্য পত্রিকা,ছাপাখানার খুঁটিনাটি গল্পের প্রেক্ষিত হয়ে ওঠে। ফাগুমাস্টার নামে একটি বাস্তব চরিত্রের ভিতর দিয়ে সেখানকার হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির ছবি, মুসলিমদের মধ্যে কৃষ্ণপ্রীতি... বর্তমান সময়ের অবক্ষয়ের চেহারাকে আরও নগ্ন করে পাঠকের কাছে।সময়ের পরিবর্তনের ছাপ সেখানকার লোকশিল্পে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল যার পরিণতি হিসেবে আমরা দেখেছি বালকসঙ্গীতের স্রষ্টাকে যাত্রাপালার দিকে অভিমুখ বদল করতে।
ফাগুমাস্টার উপন্যাসটি আসলে জীবনী নয়, কোলিয়ারিকে কেন্দ্র করে বয়ে চলা মানুষের জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ হতাশার চালচিত্রে সর্বত্র ফাগুমাস্টারের অকৃপণ ভালোবাসার স্পর্শ জড়িয়ে যায়। সব মানুষের সুখে দুঃখে ফাগুমাস্টার তার সহৃদয় হাতটি বাড়িয়ে দেন। যে কারণে যেখানেই বালকসঙ্গীত পরিবেশন করেন সেখানেই কিছু ছাত্রছাত্রী জুটে যায়। তাদের সঙ্গে ভালোবাসার স্নেহের সম্পর্কে জড়িয়ে যান।
ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেললে বিষণ্ণ চন্দনের দিকে স্বভাবসিদ্ধ স্বান্তনার হাত বাড়িয়ে দেন ফাগুমাস্টার। চন্দনকে উৎসাহ জোগান কবিতা লেখার। কবিতায় ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখার কথা বলেন। চন্দন মনে মনে অনুভব করে, "তার এবং ফাণ্ডমাস্টারের জীবনরেখা যেন একই দিগন্তের সীমায় মিলে গেছে। তার মনে অনেক কথা ভেসে বেড়াচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, এক জীবনে সবকিছু পায় না মানুষ। তাই বুঝি বারে বারে ফিরে আসতে হয় 'জীবনানন্দে'র মতো, 'ধানসিড়ি নদী তো তাদের নেই, তার আবাল্যের নদীতট হোল টুমুনি, আর তার অববাহিকা। আবার সে কি ফিরে আসবে গাঙচিল্, শালিকের বেশে অথবা 'নবান্নের কাক' হয়ে?"...
"সমুখপানে হাঁটতে লাগলো দুই দিগন্তের বাউল।ভালোবাসার বিচ্ছুরণে ভরে উঠছিল তাদের মুখমন্ডল"....
হয়তো পাঠকেরও....