স্মরণীয়, আগেরবার এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে এই মেলা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। নানা শতাব্দীর সঞ্চিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও স্বপ্ন ধ্বংস হতে মাত্র কয়েক ঘন্টা লেগেছিল। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বইপ্রেমী এক বৃদ্ধ--শারীরিক কোন আঘাতের শিকার হননি তিনি, শুধু শোকের কারণেই স্তব্ধ হয়ে যান চিরদিনের মতো। পুরো ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে হয়ত আপাততুচ্ছ হয়ে যাবে এই একটি মৃত্যু, তবু ঘটনাটির অস্বস্তিকর প্রতীকী ব্যঞ্জনা এড়িয়ে যাওয়া শক্ত। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী ব্যবস্থাপকদের চূড়ান্ত অবহেলার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। হয়ত সত্যি, কিন্তু সেটা বলে শুধু এই একটি ঘটনারই দায়ভাগ ছাড়া আর কিছু কি এড়াতে পারব আমরা? এই অব্যবস্থা ও অবহেলা তো একটা ঘটনা বা একটা দিনে থেমে থাকে না। চার বছরের শিশু খোলা ম্যানহোলে পড়ে মারা যায়, খারাপ রাস্তা ও ড্রাইভারের অসাবধানতার কারণে নিমেষে প্রাণ হারায় ছেষট্টি জন: কদিন আলোচনা হয়ত, কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয় না। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এবারে ফায়ার ব্রিগেডের তরফ থেকে কিছু নির্দেশ ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বইমেলা কর্তৃপক্ষকে। শেষ খবর যা জানা যায় তাতে দেখা যাচ্ছে যে তার অধিকাংশ না মেনেই এই বছরের বইমেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা কি ক্রমশ দুর্ভাগ্যকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছি আরো বেশি করে? নইলে চার বছরের শিশুটির আকস্মিক মৃত্যুর পরেও কলকাতার ক্ষমতাশীল কর্তৃপক্ষ অত সহজে বলেন কী করে যে এরকম ঘটনা আবার ঘটতেই পারে? মাসখানেক আগে আমেরিকা প্রবাসী এক বাঙালি আমাদের শুনিয়েছেন এক মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ। দাবি করা চাঁদা না দেওয়ার জন্য কলকাতায় তাঁর বাবা পাড়ার গুন্ডাশ্রেণীর কিছু লোকের হাতে নিগৃহীত হন; হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কর্তাদের প্রভাবে পুলিশী সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন তাঁর বাড়ির লোকজন। কোন সংবাদপত্রও এই খবর ছাপেনি। আশার দিকটা এইটুকুই যে ইন্টারনেট আপাতত একটা ছোট পদক্ষেপ হলেও, ব্যক্তিস্বাধীনতার পূর্ণ লক্ষ্যে পৌঁছবার পথে তার যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা আছে তা কেউই বোধহয় অস্বীকার অরবেন না।
এই সূত্রেই স্মরণ করি একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে মানবাধিকার, মানবমুক্তি এবং সংস্কৃতি বা কৃষ্টির চর্চার বিষয়গুলি পুরোপুরি বিচ্ছিম্ন নয়। যখনই একটির উপর আঘাত এসেছে তখনই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গিয়েছে অন্যগুলিও। যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে আজকের পৃথিবীর তিয়েনানমেন বা মায়ানমার বা দু দশকের পুরনো ভারতের জরুরি অবস্থার কথা কিন্তু এখনি ভুলে গেলে চলবে না। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের আদর্শ তাই আজও আমাদের স্মরণীয়। “এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য তবু শেষ সত্য নয়।”