কনডাকটেড ট্যুর আমাদের পছন্দ নয়। শুধু দুজনেই বেরিয়ে পড়ি নিজেদের ইচ্ছেমতো বেড়াবো বলে। যাতে কোনো জায়গা ভালো লাগলে আরো একটা দুটো দিন সেখানে থেকে যাওয়া যায়।
কিন্তু লাদাখ এমন একটা জায়গা যেখানে পথের বিপদ পায়ে পায়ে। যেকোনো সময় পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে বরফের দেয়াল, কিংবা পাথরের চাঁই। কাজেই এবার আমরা সহযাত্রী চাইলাম ডেভিল অন হুইলস-এর কাছে। অনেক অফার থেকে তিনজনকে নির্বাচন করলাম। একটা বড় গাড়িতে পাঁচজন খুব ভালোভাবে যাওয়া যায় ভেবে। তাতে গাড়ির খরচও কিছু কম হয়। দুর্গম এলাকায় সঙ্গীও পাওয়া যায়।
দিল্লি এয়ারপোর্টে হোয়াটসঅ্যাপ-এর ছবি দেখে মুম্বাইএর ভাবনা জৈন আমাকে আর জমিলকে চিনে নিলো । লাদাখ ভ্রমণে ও আমাদের অন্যতম সঙ্গী। ১২-৩০এর দিল্লি-শ্রীনগর ফ্লাইট প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরি করে ছেড়ে সোয়া দুটো নাগাদ আমাদের তিন জনকে নামিয়ে দিলো শ্রীনগর এয়ারপোর্টে। শান্ত কোলাহলহীন ছোট্ট এয়ারপোর্ট। দিল্লি থেকে বসুন্ধরা আসবে পরের ফ্লাইটে। চন্ডীগড়ের কুশলদীপ শর্মা আগের দিন পৌঁছে গেছে শ্রীনগরে। পাঁচজনের দল। ওদের তিনজনের সঙ্গে Devils on Wheel-এর মাধ্যমে জোট বাঁধা। দু’দিন আমরা শ্রীনগরে থাকব। হাউসবোটে।
অনেকে লাদাখ ভ্রমণে সময় বাঁচানোর জন্যে ফ্লাইটে সরাসরি লেহ চলে আসেন। তাতে প্রথমত আকস্মিক উচ্চতাজনিত কারণে শারীরিক অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা, দ্বিতীয়ত শ্রীনগর-লেহ যাত্রাপথের অপার সৌন্দর্য থেকে অনেকখানি বঞ্চিত হন। শুরুটা মানালির দিক থে্কেও করা যায়। আমাদের ভ্রমণ শুরু শ্রীনগর থেকে। ধাপে ধাপে উচ্চতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে নতুন এক ভূখণ্ডকে আবিষ্কার করা । এ পথের সৌন্দর্যও অসাধারণ। যেন এক স্বর্গ থেকে অন্য আর এক স্বর্গের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া। রাস্তা আগে ছিল এবড়োখেবড়ো, একটা পথ-রেখা মাত্র। ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের পর শ্রীনগর-লেহ ন্যাশনাল হাইওয়ে নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৭৪-এ এটি খুলে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জন্যে। নভেম্বর থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ থাকে বরফের কারণে। এদিক থেকে তিন তিনটি উঁচু গিরিপথ পেরিয়ে তবেই পৌঁছুতে হয় লেহ। অতুলনীয় এক অনির্বচনীয় চিত্রপট।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে নিতে গল্পগুজবে ওদের তিনজনের সঙ্গে যে ভারচুয়াল বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল তাকে বাস্তবের উষ্ণতায় সেঁকে নেওয়া গেল। তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে আমরা শিকারা নিয়ে ডাল লেকে ভাসলাম। আবহাওয়া মনোরম, না শীত না গরম। ভাসমান সব্জিক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আনন্দের চিলতে হাসি উপহার দিয়ে, রূপসী কাশ্মীরি তরুণীর নৌকো বেয়ে চলে যাওয়া বুঝিয়ে দিয়ে গেল আমরা ওদের কাঙ্ক্ষিত অতিথি। রকমারি কাশ্মীরি সম্ভারে সজ্জিত ভাসমান বাজারে ঊঁকি মেরে প্রায় পনেরো দিনের লাদাখ ভ্রমণের সূচনাটা আনন্দঘন হয়ে উঠলো। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ঘন্টাখানেক জলভ্রমণ শেষে শহরের রাস্তায় পা রাখলাম। মিডিয়ার খবরে প্রভাবিত, আমাদের কিছুটা আশঙ্কাই ছিল শ্রীনগরের পরিস্থিতি নিয়ে। ডাললেকের তীর বরাবর বুলেভার্ড রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে আশঙ্কা দূর হলো। দশ হাত অন্তর সেনাবাহিনীর জওয়ানদের উপস্থিতি ছাড়া অন্য কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলাম না। তারা তীব্রচোখে পর্যবেক্ষণ করছে পথচারীদের। সেই দৃষ্টির নিচেই স্থানীয় মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাপন চলছে। এছাড়া অন্য কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়েনি।
এখানে সূর্য অস্ত যায় অনেক দেরিতে, দিনের আলো থাকে প্রায় সাড়ে সাত পৌনে আটটা অব্দি। রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত নিশ্চিন্তে ঘুরলাম আমরা। বোটে ফিরে সাড়ে ন’টার মধ্যে নৈশ আহার সেরে, লিভিং রুমে বসে সবাই মিলে ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে দেখতে কিছুটা হতাশ হয়েই ঘুমোতে চলে গেলাম।
পরদিন খুব সকালে চায়ের কাপ হাতে হাউসবোটের অলিন্দে এসে বসতেই আমাকে দেখে ছোট্ট নৌকো নিয়ে এগিয়ে এলো প্রথমে ফুলওয়ালি, পরে ফলওয়ালা। তাদের সঙ্গে পণ্য বিনিময় না হলেও আলাপ বিনিময় হলো। গল্পগুজব হলো। কাঙ্ক্ষিত আত্মীয়স্বজন বাড়িতে এলে যতটা আনন্দিত হয় মানুষ, তাদের কথাবার্তায় সেটাই প্রকাশ পেলো। এই মুহূর্তে মিডিয়ার দৌলতে কাশ্মীরে লাগাতার অশান্তির খবরের কারণেই হয়তো শ্রীনগরে ট্যুরিস্টের ভিড় নেই। সু-সজ্জিত শিকারায় করে ভ্রমণার্থীদের বিলাসভ্রমণ খুব একটা চোখে পড়েনি। মনমরা হাউসবোটগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ডাল লেকের বুকে। সাধারণ মানুষগুলোর মুখেও সেই বিষাদ। কথাবার্তার সঙ্গেও মিশে থাকছে হতাশা, দীর্ঘশ্বাস।
হজরতবাল মসজিদের সামনে ডাল লেক বরাবর ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিলাম মোবাইল ক্যামেরায়। স্কুল ইউনিফরম পরা ফুটফুটে দুই কিশোরী হাসিমুখে কাছে এলো, একজন জানতে চাইলো কোথা থেকে এসেছি। তারপর ওদের ছবি তুলে দিতে বললো। দিলাম। দেখে খুব খুশি। ওর কাছে মোবাইল দেখে নম্বর চাইলাম, ওর ছবিটা পাঠিয়ে দেব বলে।ও শুধু একবার ছবিটা দেখলো, ফোন নম্বর দিতে চাইল না, বললো, আপ কি নাম্বার দিজিয়ে। দিলাম। বোকা মেয়ে বুঝলো না আমার ফোনে যোগাযোগ করলেই ওর নম্বর পৌঁছে যাবে আমার কাছে। ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করলো। কাছেই বাড়ি। যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তখন লাঞ্চের সময়। সঙ্গীরা তাড়া দিলো। যাওয়া হলো না। দুপুরের লাঞ্চের জন্যে ড্রাইভারই নিয়ে গেল লাসা রেস্টুরেন্টে। এর বছর চারেক আগে শ্রীনগর এসে ওখানে খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। খুবই সুস্বাদু খাবার। বিকেলটা বোটের বারান্দায়। ডাল লেককে চোখে আটকে নিয়ে গল্পগুজব আর নিজেদের সওদা নিয়ে নৌকো বেয়ে ঘাটে আসা স্থানীয় লোকের কাছ থেকে টুকটাক কেনাকাটা করে কাটলো। প্রয়োজন ছাড়াই কিনলাম। পরদিন ভোরে উঠতে হবে বলে মকবুল সাড়ে আটটায় ডিনার সাজিয়ে ডাকলো। রীতিমতো ভুরিভোজ।
শ্রীনগর থেকে লেহ্-র দূরত্ব প্রায় ৪৩৪ কিমি। আমরা যাবো সোনমার্গ, জোজিলা পাস হয়ে । মাঝে কার্গিলে রাত্রিবাস।
২০শে জুন ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমাদের ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেললো মকবুল। শিকারাও হাউসবোটের সামনে প্রস্তুত। ডাল লেকের জলের মায়া ছেড়ে এবার আমাদের মূল গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু। ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। ছ’টা নাগাদ তারই মধ্যে বেরোতে হলো। হাসিখুশি মিষ্টি চেহারার এরশাদ তার টাভেরা নিয়ে ন’নম্বর ঘাটের সামনে বুলেভার্ড রোডে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ও আমাদের লে পর্যন্ত নিয়ে যাবে। লে-র গাড়ি এখানে আসবে না। কিংবা শ্রীনগরের গাড়ি লে-তে চলবে না। ড্রাইভারদের মধ্যে এই বোঝাপড়া।
জোজিলা পাস পার হওয়ার পর সহসাই প্রকৃতির রূপ পালটে যেতে থাকলো। পাহাড় তার গা থেকে ধীরে ধীরে সবুজ মুছতে শুরু করলো। তবু সে অপরূপ। ঊষর পাহাড় নিজেই নিজের গায়ে বিচিত্র বর্ণের ভাস্কর্য রচনা করেছে। ধূসরতারও যে এত বর্ণবৈচিত্র থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এসব জায়গাও এতদিন বরফে ঢাকা ছিল। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ ভ্রমণার্থীর জন্যে পথটা খুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা চলেছি জুনের ২০ তারিখে। তবু মাঝে মধ্যে দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়ছে বরফের দেয়াল। এখন গ্রীষ্মকাল। বরফ গলতে শুরু করেছে। আর সেই বরফ গলা জলের ধারা ঝরণা হয়ে স্বাগত জানাচ্ছে আমাদের। কোথাও কোথাও তার দুরন্ত গতি পথ ভেঙে নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। রাস্তা দেখে শঙ্কিত হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু চলার উদ্বেগ ভুলিয়ে দিচ্ছে মনোহারিণী প্রকৃতি।
দ্রাস পৌঁছুতেই সোয়া বারোটা বাজলো। লাদাখের একটা ছোট্ট জনপদ। ১৯৯৯-এর ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের সময় নামটা বারবার উচ্চারিত হতো। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে খানিকটা তো রোমাঞ্চিত হতেই হয়। এর অনেকটাই পাকিস্তান দখল করে নিয়েছিল। আমাদের সেনাবাহিনী আবার তাকে পুনরুদ্ধার করে। এখন শান্ত সবুজ দ্রাসকে দেখলে সেটা অনুমান করে নেয়া মুশকিল এর সেই ভয়ঙ্কর রক্তক্ষরণকে। এখানে একটা সাধারণ রেস্তোঁরাতে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নেয়া হলো। দ্রাস থেকে আরো ৫কিমি এগিয়ে কার্গিল ওয়ার-মেমোরিয়াল । ১৯৯৯-এ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতের জয়ের স্মারক স্মৃতিস্তম্ভ। পাশেই মিউজিয়াম। যুদ্ধের অনুপুঙ্খ তথ্য ও শহীদ বীর সৈনিকদের সচিত্র জীবনকাহিনী দিয়ে সাজানো। পড়তে পড়তে আবেগে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
দ্রাস থেকে কার্গিলের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। রাস্তাঘাট খুবই ভালো। দুপুর আড়াইটে নাগাদ কার্গিল শহরে পৌঁছোলাম। সুরু নদীকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কার্গিলে প্রবেশমাত্রই মনে হল মধ্যপ্রাচ্যের কোনো জনপদে এসে গেছি।
বুকিং ছিল না। রাস্তার ওপরেই জমজমাট বাজারের ওপর একটা হোটেলে নিয়ে গেল ড্রাইভার। ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দুপুরবেলাটা সামান্য বিশ্রাম নিতে চাইলো সবাই। বিকেলে পায়ে হেঁটে শহরটা ঘুরতে বেরোলাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সুরু নদী। তীব্র তার স্রোত। মুসলিম অধ্যুষিত শহর কার্গিল। এদের বেশিরভাগ বালটি উপজাতীয় শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। জায়গাটা ছোট হলেও সরকারি ট্যুরিস্ট লজ, বেশ কিছু হোটেল আর ভালো রেস্তোরাঁও আছে। রমজানের মাস চলছিল। সন্ধের আগে খাবারের দোকান খুলবে না। অনেক খুঁজে একটা পর্দা-ঢাকা চায়ের দোকান মিললো, সেখানেই চমৎকার স্ন্যাকস সহ চা পাওয়া গেল। স্থানীয় মানুষ খুব সহযোগিতাপূর্ণ। তারাই বলে দিলো কোন হোটেলের খাবার সুস্বাদু। ডিনারটা তাই খুবই উপাদেয় হলো। বেশ লাগছিল ছোট্ট শহরটাকে। পুরো একটা দিন পেলে ভালো হতো।
কার্গিলে কিছু প্রাচীন মনাস্ট্রিও আছে কিন্তু সেগুলো ভ্রমণার্থীদের দ্রষ্টব্যের বাইরে থেকে যায়। কারণ শ্রীনগর থেকে লে-র ৪৩৪ কিলোমিটার দূরত্বের যাত্রাপথের ক্লান্তি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যেই সবাই কার্গিলে রাত্রিবাস করে। আমরাও এখানে একটা রাত কাটিয়ে পরদিন ২১ জুন সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়লাম।
কার্গিল থেকে লেহ্-র দিকে আরো প্রায় ৪৫ কিমি গেলে মুলবেক গ্রাম। নিচে বয়ে চলেছে ওয়াখা নদী। দ্রাস থেকে কার্গিল, প্রায় পুরোটাই মুসলিম অধ্যুষিত। কিন্তু মুলবেক-এ বৌদ্ধ আর মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন। যেখানে থামলাম, সেখানে রাস্তার ডান দিকে পাহাড় কেটে জাগিয়ে তোলা হয়েছে মৈত্রেয় বুদ্ধের ৩০ ফুট দীর্ঘ মূর্তি। মৈত্রেয়, যিনি আগামীতে আসবেন। চোখ ফেরানো দায়। মাথায় শিবের মতো জটাজুট, তা নেমে এসেছে কাঁধ ছাড়িয়ে। গলায়, কোমরে রুদ্রাক্ষের মালা, বাঁ-হাতে কমণ্ডলু। তথাগতের এই রূপ আগে কোথাও দেখিনি। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন এটা কুশাণ যুগের স্থাপত্য। আধুনিক বিদ্বজ্জনদের মতে এটা অষ্টম শতকের কাছাকাছি সময়ের। সব তথ্য আর মতামতকে পাশে সরিয়ে রেখে বলা যায় এই মহান শিল্পের গায়ে সময় কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি, এমনই অবিচল।
মুলবেক থেকে প্রায় ৬০ কিমি যাওয়ার পর নামিক লা, শ্রীনগর-লে সড়কের দ্বিতীয় গিরিপথ ১২,১৯৮ ফুট উঁচু। আরো ৪০কিমি পর ১৩,৪৭৯ ফুট উচ্চতার ফোতু-লা গিরিপথ পার হওয়ার পর দূর থেকে দেখা দিল পাহাড়ের গায়ে আটকে থাকা লাদাখের অন্যতম প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির, লামায়ুরু মনাস্ট্রি। এই পথে আরো কয়েকটা মনাস্ট্রি আছে, সব জায়গায় থামা সম্ভব ছিল না, কেননা লামায়ুরু মনাস্ট্রিতে সেদিন চলছিল ‘য়ুরু-কারগিয়াত’ উৎসব। অসাধারণ বর্ণময় সেই উৎসব চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হলো আমাদের। প্রচুর জনসমাগমের কারণে আমাদের গাড়ি কিছুটা দূরে পার্ক করে বেশ খানিকটা চড়াই পথ হেঁটেই গুম্ফায় পৌঁছুতে হলো। প্রবেশ পথেই বিশাল ধর্মচক্র। মূল মন্দিরে বুদ্ধমূর্তির পাশাপাশি আছে পদ্মসম্ভব, মহাকাল, এবং অন্যান্য ধর্মগুরুদের মূর্তি। একজন বললেন অন্য একটি ঘরে অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি আছে। উৎসবের কারণেই কি না জানি না ঘরটি বন্ধ ছিল বলে দেখতে পাইনি। উৎসব প্রাঙ্গণেই একজন স্থানীয় মহিলার সঙ্গে আলাপ হলো। নাচের মূল থিম হলো দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। তিনি বললেন, আগে এখানে প্রায় ৪০০ জন লামা থাকতেন। তাঁরা সবাই এখন আশপাশের অন্যান্য মনাস্ট্রিতে চলে গেছেন। এখন এখানে ১৫০ জন লামা থাকেন। বছরে দু’বার এখানে মুখোশ নাচের (ছাম নাচ) উৎসব হয়। আশে পাশের বিভিন্ন মনাস্ট্রি থেকে সবাই এসে অংশ নেয়।
লামায়ুরু থেকে প্রায় ২৭ কিমি উৎরাই-এর পর সিন্ধু পেরিয়ে পৌঁছোলাম ছোট্ট শহর খালসেতে। এখানে প্রচুর রেস্টুরেন্ট। অধিকাংশ ট্যুরিস্ট এখানেই মধ্যাহ্ণভোজন সেরে নেন। আমরাও এখানে খাওয়াদাওয়া সেরে আশপাশ একটু ঘুরে দেখে নিলাম। আমাদের দেখার আকাঙ্খা তো আর ফুরোয় না। মনে হয় আরো কিছু ছবি তুলে নিই চোখের চিত্রপটে।
খালসে, সাসপু্, বাসগো, অচেনা সব পার্বত্য উপত্যকা পেরিয়ে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল, আহা এখানে যদি বাড়ি হতো আমার, এই হিমালয়ের কোলে সিন্ধু নদের ধারে। হলে হয়তো এই বিস্ময় মেশানো মুগ্ধতা আর অনুভব করতাম না। বাসগো ঢোকার মুখে চোখে পড়লো সাদা রঙের বিশাল বুদ্ধমূর্তি আর সারি সারি চোর্তেন। লাদাখের পুরোনো রাজধানী এই বাসগো।
অনেক ভ্রমণার্থী আছেন, ট্যুরিস্ট স্পটের একটা তালিকা সামনে রেখে এক জায়গা থেকে পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছোতেই উৎসুক থাকেন। আমাদের ঠিক উল্টোটাই ঘটে। সারা পথটাকেই মনে হয় আমাদের গন্তব্য। বারে বারে থামতে হয়, থেমে যাই, থেমেই থাকি। অনেক ড্রাইভার বিরক্ত হয়, বারে বারে তার চলার গতি থামলে। আমাদের ড্রাইভার এরশাদ অবশ্য খুবই ‘ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি’। তার নিজের জায়গাকে ভালোবেসে আমরা আমাদের মুগ্ধতা, উচ্ছাস প্রকাশ করছি এতেই সে খুশি। বারে বারে জিজ্ঞেস করছে, আচ্ছা লাগা? যেন আমাদের ভালোলাগাটুকু ওর উপহার।
প্রাসাদের প্রবেশ মুখে সুন্দর করে সাজানো রেস্টুরেন্ট, যেখানে প্যালেসের পারিবারিক রেসিপি সমৃদ্ধ সুস্বাদু লাদাখী, এবং তিব্বতী খাবার পরিবেশিত হয়। আমাদের রিসর্টে বৈচিত্রপূর্ণ প্রাতঃরাশের বিপুল আয়োজন থাকতো, কাজেই সকাল ন’টায় ব্রেকফাস্টের পর সাড়ে এগারোটায় লাঞ্চ করা সম্ভব ছিলো না বলে এ যাত্রা রাজকীয় রেসিপির আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হলাম।
আমাদের আজকের বেড়ানোর যে সূচি, তার মধ্যে এটাই ছিল দূরবর্তী। এবার লেহ্-র দিকে ফেরা। ফেরার পথে সিন্ধুঘাটে কিছুক্ষণ কাটালাম। ঢাপলাজি জানালো, কয়েক বছর ধরে এই সময় এখানে মহা আড়ম্বরে সিন্ধু উৎসব পালিত হয়। দেখলাম তারই তোড়জোড় চলছে। সিন্ধুনদকে হাতে ছুঁয়ে, খরস্রোতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছিল। অনেকে দেখলাম প্লাস্টিকের বোতলে জল ভরে নিয়ে যাচ্ছে, পবিত্র জল মনে করে। কেউ কেউ অঞ্জলি ভরে পান করছে। সবার দেখাদেখি ‘যাহা প্রাকৃতিক, তাহাই পবিত্র’ মনে করে আমাদের দুই সঙ্গীও দু’চুমুক পান করলো।
এবারের গন্তব্য থিকসে মনাস্ট্রি। গাড়িতে করেই পৌঁছে গেলাম অনেক উঁচু টিলার ওপর ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা এই গুম্ফায়। নিচে সারিবদ্ধ চোর্তেন। তারই পাশ দিয়ে মূল মন্দিরে ওঠার রাস্তা। সব গুম্ফাতেই একই আরাধ্য, কিন্তু কত ভিন্ন ভিন্ন তাঁর অপরূপ রূপবৈচিত্র। থিকসে গুম্ফায় আছে প্রাচীন পুঁথির অনন্য সম্ভার। গুম্ফার পাদদেশে মনাস্ট্রি পরিচালিত সুদৃশ্য গেস্টহাউস এবং সুসজ্জিত রেস্তোঁরা। সুন্দর পরিবেশ। লাঞ্চ করার পক্ষে আদর্শ জায়গা। আমরা ঢুকেও চলে আসতে বাধ্য হলাম ট্যুরিস্টের ভিড় দেখে।
একজন গাইড আমাদের সঙ্গে করে স্কুলের ভেতরে নিয়ে গেল। নির্দেশ ছিল, ছাত্রদের কোনোভাবে ডিসটার্ব করা বা তাদের ছবি তোলা চলবে না। রং দিয়ে স্কুলবিল্ডিংএর দেয়ালে থ্রি ইডিয়টস সিনেমার ছবি আঁকা। দেখলাম অনেকে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবিটবি তুলছে। আমির খান নাকি স্কুলকে প্রচুর আর্থিক সাহায্য করেন।
থিকসে মনাস্ট্রি থেকে চার কিলোমিটার দূরে লে-মানালি রোডের ওপর ১১,২০৪ ফুট উঁচুতে শ্যে প্যালেস ও মনাস্ট্রি। ১৬৫৫ খ্রি নির্মিত লাদাখের প্রাচীন রাজধানী। নামগিয়াল রাজাদের গ্রীষ্মাবকাশের জন্যে এটা তৈরি হয়েছিল। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে জম্মুর ডোগরা রাজপুতরা লাদাখ আক্রমণ করলে নামগিয়ালরা শে ছেড়ে স্তোক প্যালেসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। জৌলুসহীন ভগ্নপ্রায় শে প্যালেস নয়, এখানে দর্শনীয় শে মনস্ট্রির সোনালি রঙের শাক্যমুনি বুদ্ধের ৩৯ ফুট আবক্ষ মূর্তি। রাস্তা থেকে পায়ে হেঁটে অনেকটা চড়াই। ওঠাটা সার্থক হলো।
নিচে নামার পর কাছেই একটা পাঞ্জাবি ধাবায় লাঞ্চ সারা হলো, কেন না তখন প্রায় আড়াইটে বাজে। সামনেই তিব্বতী রিফিউজিদের হস্তশিল্পের বাজার দেখে চোখ ফেরানো দায়, কিছু কেনাকাটাও হলো।
আমাদের আজকের শেষ গন্তব্য লেহ্ প্যালেস। শহরের মাঝখানে দোকান বাজারের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে অলিগলি ধরে অল্পবিস্তর চড়াই পেরিয়ে পৌঁছোলাম দুর্গসদৃশ রাজপ্রাসাদের প্রবেশদ্বারে। এখানে প্রবেশমূল্য আছে। ঢোকার মুখেই টিকিট কাউন্টার। ন’তলা প্রাসাদ। ন’টি তলা না বলে বলা ভালো ন’টি স্তর। ইলেকট্রিসিটি নেই। আলো আঁধারি ভেদ করে কখনও মাটির তৈরি সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, কখনও কাঠের মই বেয়ে নিচের দিকে নামছি। হারিয়ে যাওয়ার চমৎকার আয়োজন। আমরা পাঁচজন ঘুরতে ঘুরতে পরষ্পরের থেকে আক্ষরিক অর্থেই হারিয়ে গেলাম। এ যেন রূপকথার রাজাদের বাড়ি। কোনদিক থেকে কোথায় চলেছি সহজে বোঝার উপায় নেই।
সেঙ্গে নামগিয়াল, লাসার পটোলা প্যালেসের মডেলে সপ্তদশ শতকে এই প্রাসাদটি তৈরি করেন। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলিতে মাটি কাঠ আর পাথরে তৈরি ন’তলা প্রাসাদটিতেই একসময় নামগিয়াল বংশ বাস করতেন। ডোগরাদের আক্রমণে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হন এবং স্তোক প্যালেসে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। নবম তলটি ছিল পরিবারের বসবাসের জন্যে নির্ধারিত, নিচের তলাগুলি নাকি ছিল আস্তাবল আর স্টোররুম। সাড়ে চারশো বছরের পুরোনো এই প্রাসাদ এতদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এখন কিছুটা সংস্কার করেছে। দোতলায় বা আড়াই তলায় একটি চমৎকার গুম্ফা আছে। সেখানেও আলো আঁধারি। মোমের আলোয় যেটুকু আলো, তারই মধ্যে চোখে পড়লো দেয়াল তাক জুড়ে লাল কাপড়ে মোড়া সারি সারি প্রাচীন পুঁথি। এখানেও একটি অসামান্য মিউজিয়াম আছে। রাজকীয় অলঙ্কার, বিয়ের পোশাক, তিব্বতি থাঙ্কা, এখনও উজ্জ্বল। প্যালেসটা সত্যিই দর্শনীয়।
বিকেল ও সন্ধেটা যথারীতি লেহ্ শহরে পায়ে হেঁটে ঘুরে কাটানো হলো। পরদিন অর্থাৎ ২৩শে জুন আমরা যাবো নুবরা ভ্যালি। হিমালয়ের কোলে সযত্নে লালিত এক রহস্যময় সৌন্দর্য।
সকালবেলায় ব্রেকফাস্ট করে আটটার মধ্যে আমরা প্রস্তুত। গন্তব্য নুবরা উপত্যকা। আগেরদিন ঢাপলাজি বলে দিয়েছিল, যত তাড়াতাড়ি বেরুবো ট্রাফিকের জটে তত কম পড়তে হবে। রাস্তা তো ভয়ঙ্কর। লে পৌঁছোনর পরই আমরা ইনার লাইন পারমিট করিয়ে নিয়েছি। হোটেল থেকেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই পথে বেশ কয়েকটা জায়গায় ওটা প্রয়োজন হবে।
লেহ্ ছাড়ানোর পর ধীরে ধীরে উঁচুতে উঠছি। রাস্তায় সারি সারি টুরিস্টদের গাড়ির পাশাপাশি চলেছে মিলিটারি কনভয়। মাঝে মাঝেই গড়ি চলছে শম্বুক গতিতে, কখনও বা সে গতিও থমকে যাচ্ছে। বরফ গলা জল রাস্তার বাঁধন আলগা করে দিয়ে নিচে নামছে। কোথাও কোথাও তো পাশাপাশি দুটো গাড়ি যাওয়ারও পথ নেই। যানজটে ফেঁসে কোথাও আধ ঘন্টা এক ঘন্টাও থেমে থাকতে হচ্ছে। এই থেমে থাকার সদব্যবহার করে আমাদের ছবি তোলা, বরফখেলা চললো। সেনাবাহিনী অবশ্য খুবই তৎপর। তারা যথাসাধ্য দ্রুত অবস্থা আয়ত্বে আনার চেষ্টা করেছে।
লেহ্ থেকে সকাল আটটায় বেরিয়ে ৪৫কিমি পথ অতিক্রম করতে আমাদের লেগে গেল প্রায় আড়াই তিন ঘন্টা। পৌঁছোলাম ১৮,৩৮০ ফুট উঁচুতে বরফাবৃত খারদুংলায়। এখানে মিলিটারি ক্যাম্পএ সেনাবাহিনী পরিচালিত রেস্টুরেন্ট, এবং প্রাথমিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা আছে, আছে টুরিস্টদের সুবিধার্থে কিছু ওয়াশরুমও। উল্লেখ করলাম এইজন্যে আমাদের দেশের পর্যটন ব্যবস্থায় ওয়াশরুমের কথা ভাবাই হয় না। ঘন্টার পর ঘন্টা মাইলের পর মাইল যাত্রায় কোথাও ওয়াশরুম চোখে পড়বে না। প্রয়োজনে রাস্তার পাশে কোনো রেস্টুরেন্টে কিছু কেনার বিনিময়ে ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়। সে তো সর্বত্র মেলে না এই দুর্গম পথে।
খারদুংলায় ইনারলাইন পারমিট দেখাতে হলো। অপূর্ব এই গিরিবর্ত্ম থেকে চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো উত্তরে কারাকোরাম পর্বতমালার বিস্তার আর দক্ষিণ-পশ্চিমে সিন্ধুর প্রবাহ। এবার নিচে নামার পালা। ধীরে ধীরে শায়ক নদী কাছে এগিয়ে এলো। পাশে পাশে চললো। নিয়ে দাঁড় করালো দশ কিলোমিটার দূরের খালসার-এ। এটা বেশ জমজমাট জায়গা। আমাদের মধ্যাহ্ণভোজন এখানে সারা হলো। সামনে বসিয়ে বানিয়ে দিলো গরম গরম হাতে গড়া রুটি আর মিক্সড সব্জি। এখান থেকে পথ দু’দিকে বেঁকে গেছে। একটা গেছে শায়ক নদী পেরিয়ে সুমুর মনাস্ট্রি হয়ে পানামিক, অন্য পথটি আমাদের নিয়ে গেল ডিসকিট।
পথের ধকলে ক্লান্ত আমরা বিকেলটা রিসর্টের চমৎকার লনে আখরোট আর পপলার গাছের নিচে বসে চা স্ন্যাক্স নিয়ে আড্ডা দিলাম। পরদিন কোথায় যাওয়া হবে সেই বিতর্ক ও অবশেষে সিদ্ধান্ত নিতেই কাটলো। বিতর্ক এই কারণে যে ঢাপলাজি আমাদের কনভিন্স করার চেষ্টা করছিল সুমুর গুম্ফা আর পানামিক এর উষ্ণপ্রস্রবণ দেখতে যাওয়ার জন্যে। ডিসকিট থেকে পানামিকের দূরত্ব ৪৫ থেকে ৪৮ কিমি। আর তুরতুক প্রায় ৯০ কিলোমিটার, এবং রাস্তাও নাকি খুব খারাপ। কাজেই ড্রাইভারের আকর্ষণ পানামিকের দিকেই। আর আমাদের মনে তুরতুক গ্রাম বসে আছে। উষ্ণ প্রস্রবণ তো অনেক দেখেছি, কিন্তু তুরতুকের গল্প আলাদা। এবার ড্রাইভার শতমুখে তুরতুককে নস্যাৎ করার চেষ্টা করলো। ওখানে দেখার কিছু নেই, তুরতুকের লোকজন ‘গন্ধা আদমি’। ওরা তিনচারমাস স্নান না করে থাকে, গায়ে ‘বদবু’। এ হেন বর্ণনায় আমরা আরো মজা পেলাম। অতএব চলো তুরতুক।
সারা পথে প্রচুর মিলিটারি ক্যাম্প এবং তাদের অতন্দ্র সতর্ক পাহারা। মাঝে দু’তিনবার ইনার লাইন পারমিট দেখাতে হলো। হুন্ডার পেরনোর পর টুরিস্টের ভিড় নেই। কদাচিৎ দু’একটা গাড়ির দেখা মিললো। তবে সেনাবাহিনীর তৎপরতা খুব বেশি। পাশে পাশে শায়ক নদীকে নিয়ে পৌঁছোলাম তুরতুক। শায়ক আমাদের ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেল পাকিস্তানে। পথের বর্ণনায় বলা যেতে পারে শুধু সুন্দর বললে কিছুই বোঝানো হয় না। এ পথের বর্ণনার কাছে ভাষা স্তব্ধ। রুক্ষ ধূসর পাহাড়ি চড়াই উৎরাই শেষে যেখানে পৌঁছোলাম তাকে লাদাখের স্বর্গও বলা যেতে পারে। ঊষর পাহাড়ের পায়ের কাছে একখণ্ড সবুজ ঐশ্বর্য। কোথাও বা বিস্তৃত যব আর গমক্ষেতের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বরফাবৃত হিমালয়। রকমারি সবজি ক্ষেত। আর চারদিকে আপেল আর এপ্রিকট গাছ, ফাঁকে ফাঁকে ঘরবাড়ি। ছোট্ট গ্রামের মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা বাঁধানো রাস্তা। দুপাশে ছোট ছোট পাকা বাড়ি। দেখলে বোঝা যায় বেশ সম্পন্ন গ্রাম।
১৯৭১ এর ১৩ ডিসেম্বর রাতে তুরতুকের মানুষ পাকিস্তানে ঘুমিয়ে ছিল। পরদিন ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে জেগে উঠলো ভারতে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তুরতুক ছিল বালটিস্তানের অংশ, যা পাকিস্তান দখল করে রেখেছিল। বছর শেষে আবার তাকে ফিরিয়ে আনে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাকিস্তান সীমান্তরেখায় লাদাখের শেষতম গ্রাম, তুরতুক। যানবাহন বলতে রেশন নিয়ে সপ্তাহে একটা সরকারি বাস আসে, আবার ফিরে যায়। অধিবাসীরা বালটি গোষ্ঠীর মানুষ। তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে দু’দেশের এই টানাপোড়েনের মাঝখানে কেমন আছে তারা, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেটা মানবিক গবেণার বিষয়। আমরা তো মুগ্ধ হয়ে দেখলাম গ্রামের পথে, বাড়ির অলিন্দে, গোলাপি গাল আর নীল চোখের পরীর মতো হাসি খুশি মেয়েরা আমাদের দিকে হাত নাড়ছে। আলাপ করার চেষ্টা করে খুব একটা সফল হলাম না। তারা আড়ষ্ট হয়ে শুধু হাসি বিনিময় করলো। বয়স্ক দু’চারজন মহিলা একটু-আধটু কথা বললেন মাত্র, কোথা থেকে এসেছি। ২০০৯ সালের আগে তুরতুকে টুরিস্টদের প্রবেশাধিকার ছিল না। এখন সরকারি উৎসাহে কিছু হোম-স্টে তৈরি হয়েছে।
আপেল আর এপ্রিকট গাছের ছায়ায় ছায়ায় সরু পায়ে চলার পথ ধরে যেতে যেতে আমি গিয়ে আলাপ করলাম কিছু উৎসুক মহিলা ও দুই কিশোরীর সঙ্গে। না কোনো ‘বদবু’ পাইনি। স্কুলে পড়ে ওরা, একজন ইলেভেন, একজন নাইন। ছবি তুলতে চাইলাম, তারা খুবই ইচ্ছুক, কিন্তু মায়েরা আপত্তি জানালো। গ্রামের ছবি তুলতে গিয়ে আমার ক্যামেরায় ধরা পড়লো এক ফুটফুটে বালটি বালিকা। ফল, ফসল, নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ তুরতুকের সুখী চেহারা দেখে আবার কখনো এখানে এসে অন্তত একটা গোটা দিন ও রাত্রিবাসের ইচ্ছে উঁকি দিল মনে। এক বয়স্ক ভদ্রলোক নিজে এসে আলাপ করলেন। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি তাদের গ্রাম দেখতে শুনে আপ্লুত হলেন। জানালেন গ্রামে বেশ কয়েকটা হোমস্টে আছে, থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধা নেই। আবার কখনও আসার আমন্ত্রণও জানালেন। গ্রামটি মুসলিম অধ্যুষিত হলেও এখানে একটা মনাস্ট্রি আছে। আছে একটা পুরোনো প্রাসাদও। সবুজের মায়া নিয়ে ফিরে আসছি, চোখে পড়লো গ্রামের মহিলারা হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে।
ডিস্কিট পৌঁছোনোর আট কিলোমিটার আগে বাঁদিকে কিছুটা এগিয়ে যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম, বরফের পাহাড়ের পায়ের কাছে ধূ-ধূ বালিয়াড়ি। চরে বেড়াচ্ছে দুই কুঁজ বিশিষ্ট উটের দল। না তারা নিজের আনন্দে চরছে না, টুরিস্টদেরকে পিঠে চাপিয়ে এক পাক ঘুরিয়ে আনার জন্যে ধুঁকতে ধুঁকতেও হেঁটে চলেছে। দুশো টাকার টিকিট কেটে উঠের পিঠে এক চক্কর ঘোরার জন্যে টুরিস্টের ভিড় চোখে পড়ার মতো।
ডিসকিটে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। পরদিন ব্রেকফাস্টের পর আবার লে তে ফিরে যাবো আমরা।
দেখতে দেখতে আমাদের ভ্রমণসুচির দিন ফুরিয়ে আসছে। তখনও উত্তেজনার পারদ নামেনি, কেননা সামনে এখনও নীল হ্রদের হাতছানি। ভ্রমণার্থীদের স্বপ্নের প্যাংগং লেক। লেহ্-কে এবার বিদায় জানানোর পালা।
নুবরা ভ্যালি থেকে ফিরে লেহ্-তে একটা দিন বিশ্রাম। বিশ্রাম আবার কী! বিশ্রাম তো কলকাতায় ফিরে। আবার একটা দিন পায়ে হেঁটে, কখনও বা খানিকটা অটোতে লে-র পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে স্থানীয় মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের (পর্যবেক্ষণ করে) সুরভি নিয়ে কাটানো উপরি পাওনা মনে হলো।
চাং লা পেরোনোর পর থেকে পথ বন্ধুর হলেও আবহাওয়া রোদ ঝলমল। চাংলা থেকে উৎরাই পথ ধরে দুরবুক। এর পর রাস্তা বেশ ভালো তাংসে পর্যন্ত। এই রুটে তাংসে বেশ জমজমাট জনপদ। দোকানপাট, বেশ কিছু হোটেল আর গেস্ট হাউস আছে এখানে। এখান থেকে আর দশ বারো কিলোমিটার গেলেই পৌঁছে যাবো প্যাংগং, হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে সার সার গাড়ি। যে সব গাড়ি সামনে এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটা, তারা উলটো দিক থেকে ফিরে আসছে দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে, আর এগোনো যাবে না।
আমাদের ড্রাইভার তবু সবার পাশ কাটিয়ে কিছুদুর এগোলো। রাস্তা ভেঙে গেছে, জল কাদায় থইথই গর্তে জানালার কাচ অব্দি ডুবে আছে একটা স্করপিও। সামনের রাস্তার অবস্থা নাকি আরো ভয়ঙ্কর। সকাল থেকে ঝলমলে রোদ্দুরের কারণেই নাকি এই বিপত্তি। জমে থাকা বরফ রোদের তাপে দ্রুত গলতে শুরু করেছে। আর সেই বরফ গলা জলের তীব্র স্রোত রাস্তা ভেঙে নিয়ে নিচে নামছে। আধঘন্টা খানেক তবু আশায় বুক বেঁধে অন্য ভ্রমণার্থীর সঙ্গে আমরাও অপেক্ষা করলাম। সেনা জওয়ানরা যদি কিছু করে। জানা গেল পথের যা অবস্থা, তাতে দু’দিন লেগে যাবে রাস্তা সারাই করে চলনসই করতে। বুঝলাম এ যাত্রায় প্যাংগং আমাদের অধরা রয়ে গেল।
অগত্যা মনখারাপ নিয়ে ফেরার পথ ধরতে হলো। যে শুকনো এবড়ো খেবড়ো পাথুরে পথ দিয়ে আমরা এসেছিলাম, ফেরার সময় দেখলাম সে পথ নদীর রূপ নিয়েছে। সেই জলস্রোত ভেঙে আমাদের জাইলো পেরিয়ে এলো বটে, অনেক ছোট গাড়ি দেখলাম জলে ডুবে আছে। অনেকে মিলে চেষ্টা করছে ঠেলে তুলতে।
প্যাংগং থেকে সরাসরি সোমোরিরি যাওয়া যায়। সে পথের সৌন্দর্য্যও নাকি অতুলনীয়। আমাদেরও পরিকল্পনা ছিল সেটাই। দূরত্ব অনেকটা কমে যাবে। সেটা আর সম্ভব হলো না। সবার মন খারাপ দেখে ঢাপলাজি সান্ত্বনা দিল, প্যাংগং এর চেয়ে সোমোরিরি বেশি সুন্দর। সোমোরিরির অবস্থান আরো উঁচুতে। এই ব্যর্থ যাওয়া আসায় বেলা গড়িয়ে গেল। সেদিন আর যাওয়া সম্ভব নয় সোমোরিরি পর্যন্ত। স্থির হল আমরা কারু-তে রাত কাটাবো। কারু পৌঁছনোর কিছু আগে প্রকৃতি এক অনির্বচণীয় দৃশ্য উপহার দিল আমাদের ...আচমকা বাঁ দিকের জানালা দিয়ে দেখি কাছের পাহাড়ের গায়ে ধূসর ছায়া পেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে আগুনরঙা পাহাড়চূড়া। গাড়ি থামলো। সম্মোহিতের মতো নেমে এলাম আমরা। চোখ ফেরানো দায়। তবু চোখ ফেরাতে হয়। মন বলে চরৈবেতি।
কারু-তে মনখরাপের রাত্রিবাস। পরদিন ঘুম ভেঙে টের পেলাম মনখারাপ উধাও, কেননা তখন ১৫০০০ ফুট উঁচুতে প্রায় ৩০ কিমি দীর্ঘ আর ৮ কিমি চওড়া এক হ্রদের নীল জলের ডাক পৌঁছে গেছে ভেতরে। কারু হয়ে যেতে হচ্ছে বলে কিছুটা বেশি পথ অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু এ পথের দূরত্ব ক্লান্ত করে না।
কারু থেকে সোমোরিরির দূরত্ব ২০৪ কিমি। সকাল সাড়ে আটটায় কারু থেকে প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। ৩৬ কিমি পর উপসি। দুদিকে চলে গেছে পথ। আমরা সোজা পথ ধরে কুমদোক, কেরে হয়ে চলে এলাম চুমাথাং। এখানে থামতে হলো উষ্ণপ্রস্রবণের টানে। সিন্ধুনদের ধার বরাবর বেশ কয়েকটা জায়গায় দেখলাম ফুটন্ত জলের উদ্গীরণ। ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সিন্ধুর জলে পা ডুবিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে দারুণ লাগলো।
মাহে পর্যন্ত এসে সিন্ধু আমাদের সঙ্গ ছাড়লো। আমরা ডানদিকে বেঁকে গেলাম। ১৩ কিমি দূরে সুমদো-তে এসে পথ আবার দুদিকে ভাগ হয়েছে। ডানদিকের পথ চলে গেছে মানালির দিকে। বাঁদিকের পথ ধরলাম আমরা।
গুগল ম্যাপের ওপর আস্থা রেখে এগোলে বিভ্রান্ত হতে হবে, ওরা যে দূরত্ব এবং সময়ের কথা বলে, সেটা অনেকাংশে ভারচুয়াল, বাস্তবের সঙ্গে প্রায়ই মেলে না। বিশেষত লাদাখ হিমালয়ের এই পথযাত্রায়। তবে দৃঢ়তার সঙ্গে এটুকু বলা যায় এই দূরত্ব একঘেয়ে মনে হয় না। উত্তেজিত করে রোমাঞ্চিত করে। সম্মোহিত করে।
রূপসু উপত্যকা । সত্যিই রূপের আকর। তারই বুকে এই নীল জলের হ্রদ সোমোরিরি। যেখানে ভেসে বেড়ায় ব্রাহ্মণী হাঁস, খেলা চলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির।হিমালয়ের গা বেয়ে নীল আকাশ গড়িয়ে নামে জলের ওপর। পাহাড়কে সাক্ষী রেখে গল্প চলে নিজেদের মধ্যে , নির্জনতার গল্প।
পথের নেশায় বুঁদ হয়ে থেকে হঠাৎ দূর থেকে নীল জলের আভাস চোখে পড়তেই আমরা উল্লসিত। এই বুঝি এসে পড়েছি সোমোরিরির পাশে। কিন্তু না। এর নাম কিয়াগার (ক্যাগারও হতে পারে উচ্চারণ)। এটাও নোনাজলের লেক। উপেক্ষা নিয়ে নিরিবিলিতে যেন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে আছে। ভারি ভালো লাগলো। সবাই এর পাশ কাটিয়ে চলে যায় ২৮ কিমি দূরের রাজকীয় হ্রদ সোমোরিরির টানে। ঢাপলাজির আপত্তি উপেক্ষা করে আমরা কিন্তু থামলাম। নেমে কাছে গেলাম। লেকের ধারে ধারে চরে বেড়াচ্ছে কিছু পাহাড়ি ছাগল, ইয়াক আর বুনো গাধা । হিমবাহের ক্রম সঙ্কোচনের ফলে লেকের জলস্তর ক্রমেই কমে আসছে। কিন্তু মোটেই অবহেলা করার মতো নয় এর রূপ।নীল আকাশকে সেও বুকে ধরে আছে। মনে হলো সোমোরিরি পৌঁছোনোর আগে কিয়োগার লেক যেন এক মহাকাব্যের ভূমিকা।
ধূসর, কোথাও কোথাও বরফে ঢাকা পাহাড়ে ঘেরা বিস্তৃত শূন্য প্রান্তর জুড়ে সবুজ তৃণ, তার মাঝে ছড়িয়ে থাকা যাযাবর মেষপালকদের শাদা তাঁবু আর তাদের অনন্য জীবনচারণ দেখতে দেখতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পৌঁছে গেলাম সোমোরিরি ক্যাম্প রিসর্টে। সামনে দিগন্তছোঁয়া নীল জল। হিমালয় এখানে কালার প্যালেটের কাজ করেছে।
লেক এরিয়ায় প্রবেশের জন্যে ইনারলাইন পারমিট দেখাতে হলো সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে।
ট্যুরিস্ট এর ভিড় কম। আমরা দেখা পেলাম কয়েকজন মাত্র বিদেশির। মনে হচ্ছিল সোমোরিরি আমাদের ব্যক্তিগত চারণ ভূমি। খুব অন্তরঙ্গভাবে উপভোগ করলাম এর সান্নিধ্য। পুরো লাদাখ ভ্রমণে এমন আত্মীয় অনুভূতি আর কোথাও হয়নি।
লেকের ঠিক সামনেই সবরকম আধুনিক ব্যবস্থায় সজ্জিত সারি সারি শাদা রঙের তাঁবু। এটাই ছিল আমাদের ক্যাম্প। কফি আর কুকিস দিয়ে ওয়েলকাম জানালো রিসর্টের মালিক। এখানে আমাদের ব্রেকফাস্ট আর ডিনারের ব্যবস্থা,লাঞ্চের দায়িত্ব নিজেদের । সুতরাং তাবুতে ব্যাগেজ রেখে মধ্যাহ্নভোজন সারতে গ্রামে ঢুকলাম। প্রায় ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে চাংপাদের গ্রাম এই কোরজোক। ছোট ছোট সাধারন বাড়ী। লোকজনও কম । একজন গ্রামবাসী আমাদের সতর্ক করে বললো, দ্রুত না হাঁটতে। কেননা এখানে অক্সিজেনের মাত্রা কম, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। । চারপাশে রুক্ষ পাহাড়, গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে, অক্সিজেন তো কম হবেই । বেশ কিছু বাড়ির গায়ে ‘হোম স্টে’ সাইনবোর্ড লেখা। একটা বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট ঘরোয়া রেস্তোরাঁ। মাটির দেয়াল আর মেঝে, সাত-আট জনের বসার ব্যবস্থা, কিন্তু খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।। সেখানেই বসলাম আমরা। জানালা দিয়ে লেকের নীল জল দেখা যাচ্ছে। আমরা কী খাবো জেনে নিয়ে খাবার বানাতে শুরু করলেন চাংপা মহিলা। আমরা তার পুতুলের মতো বাচ্চাটার সঙ্গে মজা করে সময় কাটাতে থাকলাম। আধ ঘন্টার মধ্যে গরম গরম রুটি সব্জি ডাল রেডি।
খাওয়া দাওয়ার পর রোদে গা ভিজিয়ে আমরা লেকের একেবারে কাছে চলে গেলাম। এই উচ্চতায় ভারতের বৃহত্তম হ্রদ সোমোরিরি । এটা সংরক্ষিত আর্দ্রভূমি। যে কারণে লেকের খুব কাছ ঘেঁসে কোনো তাঁবু বা কোনো রকম নির্মাণ নিষেধ। ভ্রমণার্থীদের জন্যে একটিমাত্র সিমেন্টের অতিথিনিবাস আছে এখানে। বেশিরভাগই তাঁবু। আর বেশ কিছু হোম স্টে। এইসব হোম স্টে-তে থাকার একটা আলাদা মজা আছে। বাহুল্যহীন আন্তরিক আপ্যায়ন মিলবে। ইলেকট্রিসিটি নেই । অতিথি আবাসগুলো সবই জেনারেটার আর সোলার পাওয়ার এর সাহায্যে তাদের প্রয়োজন মেটায়। যে কারনে চব্বিশ ঘন্টা গরম জল পাওয়ার আশা করা ভুল। চাইলে বালতি করে গরম জল মেলে। ডিনারও তাড়াতাড়ি সারতে হয়।
লেকের নীল জলে বিকেলের আলো পড়ে যতই বিমুগ্ধ করুক আমাদের, এখানকার অধিবাসীরা জানে এর কঠিন বাস্তবতা। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত লেকের জল বরফ হয়ে থাকে। প্রবল ঠান্ডা। এখানে কোনো ফসল ফলে না। গ্রাসাচ্ছাদনের যাবতীয় সামগ্রী আনতে হয় ২৫০ কিমি দুরের লে থেকে। এপ্রিল থেকে বরফ গলতে শুরু করে আর লেকের জল নীলের বিভিন্ন শেডে সেজে ওঠে।
সূর্য একটু নিচে নামতেই আমরা লেকের ধার থেকে গ্রামের ভেতর চলে এলাম। এখানে এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো জাঁকজমকহীন মনাস্ট্রিটি খুবই সুন্দর।
রাস্তার পাশেই একটা সরাইখানা সদৃশ রেস্টুরেন্টে গদির ওপর পা তুলে আরাম করে বসে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে মোমো , লেমন টি, বাটার টি সেবন। মা মেয়ে চালায় রেস্তোরাঁটি। পেছন দিকে একটা বিরাট ঘরে সারি সারি ম্যাট্রেস আর কার্পেট পাতা । সেখানে চাইলে কেউ রাত্রিবাস করতে পারে ২৫০ টাকার বিনিময়ে। বিদেশী ট্যুরিস্টরা দেখলাম এদের অতিথি হয়ে আছে। সন্ধেটা এখানে আড্ডা দিয়ে ক্যাম্পে ফিরলাম। বাইরে কনকনে ঠান্ডা হলেও তাবুর ভেতরটা খুবই আরামদায়ক। ন’টার মধ্যে ডিনার সারা। ডিনার এর পর সবার হাতে একটি করে হট ওয়াটার ব্যাগ ধরিয়ে দেওয়া হলো ঠান্ডার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে। চাঁদের আলোয় আর একবার সোমোরিরিকে দেখে নিয়ে হট ওয়াটার ব্যাগ সহ বিছানার নরম আরামে ঘুমের মধ্যে ডুব। লাদাখ ভ্রমণে আজই আমাদের সর্বোচ্চ উচ্চতায় রাত্রিবাস।
কেলং যাওয়ার পথে হিমালয়ের বিভিন্ন বাঁক তার ভয়ঙ্করতম রূপে বারে বারে পথ আটকে দাঁড়ালো। কোথাও পথ ভেঙে কোথাও ধ্বস নামিয়ে...গাড়ির মাথায় মাঝে মাঝে গড়িয়ে নামছে পাথরের টুকরো, সঙ্গে থেকে থেকে বৃষ্টি। প্রায় প্রাণ হাতে করে আমাদের দক্ষ ড্রাইভার ট্রাফিক জ্যামে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য গাড়িকে পাশ কাটিয়ে প্রায় ট্র্যাপিজের খেলার মতো করে পেরিয়ে গেল কম বেশি সাড়ে ষোলো হাজার ফুট উচ্চতার তিন তিনটি গিরিবর্ত্ম,লাচুং লা,নামিক লা আর বারচা লা। সন্ধের আগেই পৌঁছে গেলাম কেলং। লাদাখএর পালা সাঙ্গ করে এবার আমরা হিমাচলের অতিথি। কেলং-এ একরাত কাটিয়ে মানালি। এখান থেকে আমাদের ভ্রমণসঙ্গীরা আলাদা হয়ে গেল। একজন দিল্লি, অন্যজন চণ্ডীগড়ের বাসে উঠে বিদায় জানালো আমাদের।