ছোটবেলায় কলকাতাতে পাড়াতুতো দাদা ছিল পারিবারিক দাদার মতই ট্রান্সিটিভ, মানে অমুকদাদার তমুকদাদা আমারও দাদা। সেটা এখনো সত্যি। উপরন্তু গত পঞ্চাশ বছরে শব্দটা রিফ্লেক্সিভও হয়ে গেছে, মানে আমি যাকে দাদা বলি তিনিও অম্লানবদনে আমাকে দাদা বলতে পারেন। অনেকটা বল্ বাউন্স করার মত। আমি তোমার দিকে একটা ’দাদা’ ছুঁড়ে দিলাম, তুমি সেটা তক্ষুণি আমার দিকে ফেরত পাঠালে।
রাজা পালের চুল-কাটার সেলুন বাসরাস্তার উপর। আমি সেখানে নিয়মিত খদ্দের। রাজাদা আমার ছেলের বয়সী। আমরা পরস্পরকে দাদা ব’লে ডাকি। রাজাদার অ্যাসিস্টেন্টও আমাকে দাদা বলে, কিন্তু আমি তাকে বিশ্বজিৎ ব’লে ডাকি। মানে ওই বলটা বাউন্স করে না।
আমি গেছি দাড়ি কামাতে। রাজাদা কারুর চুল কাটছিলেন, তাই বিশ্বজিতের কাছে বসলাম।
এ কথা সে কথার পর রাজাদা বললেন, কাল মাছের দোকানে কি দেখলাম জানেন?
আমরা কৌতূহল প্রকাশ করলাম।
ভবতোষবাবুকে চেনেন তো?
ওই যিনি টাকমাথা বয়স্ক লোক? পার্কের ওপারে থাকেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ, ইস্কুলের পাশের বাড়ি। ভবতোষবাবু কাল এসেছিলেন মাছ কিনতে।
তারপর?
মাছওয়ালা ভালো দামে রুই দিচ্ছিল। বড় রুই, ডিমভরা। ভবতোষবাবু বেছে বেছে লেজ-মুড়ো ছেড়ে মাঝের থেকে পিস্ কাটিয়ে নিলেন। দু-তিনটে বড় বড় পেটি, একটা বড় একছেয়ে। আর আধখানা মুড়ো। সাথে খানিকটা মাছের ডিম। সব মিলে সাড়ে সাত শ’ গ্রাম। অনেক দর ক’রে দাম ঠিক হ’ল ১৩০ টাকা।
মাছওয়ালা সব কেটেকুটে প্লাস্টিক ব্যাগে ভ’রে দিল।
এমন সময়ে ভবতোষবাবুর ফোন বাজল।
“হ্যালো?”
কথোপকথনের অন্য দিকটা শোনা গেল না।
“না, না, আমার হয়ে গেছে। রুই মাছ কিনছি।”
“অ্যাঁ!”
“সে কি! কিন্তু আমার তো কেনা প্রায় হয়ে গেছে! প্যাকেট…”
“না, না, শোনো না…”
তারপর একটা লম্বা ফাঁক। ভবতোষবাবু কাঁচুমাচু মুখ ক’রে কানে ফোন ধ’রে আছেন আর লাইনের অন্য দিক থেকে শোনা যাচ্ছে কোনো উত্তেজিত মহিলার ক্রুদ্ধ গলার আওয়াজ।
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে।”
ভবতোষবাবু ফোন বন্ধ করলেন।
“মাছটা নিতে পারব না, ভাই।”
“তার মানে?” মাছওয়ালা আর্তনাদ ক’রে উঠল। “মাছ তো কাটা হয়ে গেছে!”
“সে তো ঠিক কথা। একদম ঠিক কথা! কিন্তু গিন্নি বললেন মাছ না কিনতে। আজকের রান্নাকরা মাছ…”
“আমি এই কাটামাছ নিয়ে কি করব, বাবু?”
“খুব সরি, ভাই। কি করব বলো?”
“আমার খুব ক্ষতি হ’য়ে যাবে, বাবু। আপনি মাছটা নিয়ে যান।”
এইভাবে খানিকক্ষণ কথাবার্তা চলল।
রাজাদা গল্পটা ব’লে চলেছেন – মাছওয়ালা বলে মাছ নিতে হবে, ভবতোষবাবু বলেন কিন্তু গিন্নি না বলেছেন।
শেষমেশ রফা হ’ল এই যে ভবতোষবাবু কোনো মাছ না নিয়ে, মাছওয়ালাকে ৫০ টাকা দেবেন। কাটা মাছ অন্য কোনো খদ্দের নেবে। বিক্রি হ’য়ে যাবে ঠিক, ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভবতোষবাবু টাকা দিয়ে, মধ্যবিত্ত ভেড়ার মত, রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে, হেঁটে হেঁটে বাড়ি চ’লে গেলেন। বেচারা।
রাজাদা ব’লে চললেন, বড় শান্ত মানুষ ভবতোষবাবু, অমায়িক ভদ্রলোক যাকে বলে। ভারী ভদ্রলোক।
সেলুনে আমার তখন অর্ধেক দাড়ি কামানো হয়েছে, মুখ ভর্তি সাবান। বিশ্বজিৎ আর আমি রাজাদার দিকে তাকালাম একটা অনুচ্চারিত ’তারপর’ প্রশ্ন নিয়ে।
রাজাদা আবার বলতে থাকলেন।
খানিক পরে আরেক খদ্দেরকে মাছওয়ালা সেই মাছের প্যাকেটটা দেখালো। বলল, “আরেক জনের জন্য প্যাকেট করেছিলাম। তিনি কেনেননি। খুব ভালো মাছ, বাবু। পেটি আছে, মুড়ো আছে, ডিম আছে। ১৩০ টাকা দাম, আপনার জন্য ৯০।”
খদ্দেরবাবু বললেন ৭০ টাকা দেবেন।
মাছওয়ালা বলল, “না বাবু, ৯০ টাকার কমে হবে না।”
রফা হ’ল না। মাছের প্যাকেট প’ড়ে রইল।
খানিক পরে আর এক খদ্দের। আবার সেই দাম দরাদরি। কিছুতেই রফা হচ্ছে না। খদ্দের চ’লে গেল।
আমি তো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে মজা দেখছিলাম। মাছওয়ালাকে বললাম, “৯০ টাকার কমে দেবে না?”
“না।”
“৮০ টাকা হ’লে নেবো।”
“না, তাহলে লস্ হয়ে যাবে।”
“কেন তোমার লস্ হবে? ভবতোষবাবুর সাথে কথা হয়েছিল ১৩০ টাকার। উনি তোমাকে ৫০ টাকা দিয়েছেন। বাকি তো রয়েছে ৮০।”
মাছওয়ালা খানিক চুপ ক’রে থাকল। তারপর দুঃখিত স্বরে বলল, “ঠিক আছে।”
আমি চায়ের ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে সবে পকেট থেকে টাকা বার করতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি আমার বউ হেঁটে হেঁটে আসছে। কোথাও কাজে গিয়েছিল, এখন বাড়ি ফিরছে।
আমি বললাম আমি মাছ কিনছি।
“কেন?”
“না, মানে, ভালো মাছ পেলাম, খুব ভালো দাম, ডিমও আছে।”
“না, না, আজকের মাছ রান্না হয়ে গেছে। আর কোনো মাছ নেবে না। আমি রান্না করতে পারব না।”
আমি মাছওয়ালার বিহ্বল মুখের দিকে একবার তাকিয়ে, মরিয়া হ’য়ে বউকে বললাম, “আচ্ছা, না হয় ভেজে দিও!”
“তুমি ভেজো! আমি পারব না।”
বউ হাওয়াই চপ্পল ফটর্ ফটর্ করতে করতে চ’লে গেল। মাছওয়ালা আর আমি দু’জনেই যে ডিম-বের-করা মাছের পেটির মত চুপসে গেলাম, তা ফিরেও দেখল না।
রাজাদার গল্প শেষ।
এতক্ষণে বিশ্বজিৎ মুখ খুললো, আহা, সবারই ক্ষতি হয়ে গেল। ভবতোষবাবুর ক্ষতি, আপনার ক্ষতি…
আমি বললাম, ভবতোষবাবুর ক্ষতি তো বুঝলাম। কিন্তু রাজাদার ক্ষতিটা কোথায় হ’ল?
বিশ্বজিৎ বলল, আহা, মাছটা তো কেনা হ’ল না!
তা অবশ্য ঠিক।
বিশ্বজিৎ বলল, আর মাছওয়ালারও ক্ষতি… হয়তো।
নিঃশব্দ সেলুনে বিশ্বজিৎ আমার গোঁফটা চেঁছে ফেলে দিল। বাইরে বাসের আওয়াজ। কোনো কন্ডাক্টর বলল, “রোখ্ কে রোখ্ কে”। কাছে এক তরুণ কন্ঠস্বর শোনা গেল, “তোকে মাইরি কাল দারুণ দেখাচ্ছিল।”
কলকাতা শহরে রোজ রোজ কোথায় কার ক্ষতি, তার হিসেব করার সময় নেই কারো। আমি বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। কেউ অপেক্ষা করছে। হয়তো।