• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪ | ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • ‘ইমেল’-এ বাংলা : শেখ মিজান

    কম্পিউটার প্রযুক্তির বর্তমান স্তরে বাংলা হরফে ‘ইমেল’ বা ‘আধানডাক’ পাঠানো এখনও সকলের জন্য সহজসাধ্য হয়ে ওঠে নি, তবুও তড়িৎ প্রবাহের মধ্য দিয়ে (প্রায়শই বিনামূল্যে) তড়িৎ গতিতে ডাক পাঠানোর এমন সুযোগটিকে তো উপেক্ষা করা যায় না। তাই প্রথম প্রথম যথারীতি ইংরেজি ভাষাতেই ডাক পাঠানো শুরু হলো। কিন্তু অচিরেই আবারও প্রমাণ পাওয়া গেল যে মনের একান্ত আবেগ-অনুভূতির আদান-প্রদানে মাতৃভাষার কোন বিকল্প হয় না। শুরু হলো ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা। বোধকরি বর্তমানে আধানডাক ব্যবহারকারী ৯০ শতাংশ বাঙালিই মনের মানুষ, বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়-পরিজনের কাছে ইংরেজি হরফে বাংলায় আধানচিঠি লিখে থাকেন।

    কিন্তু, বাংলা ধ্বনি ইংরেজি হরফে লেখার জন্য কোন প্রতিষ্ঠিত রীতি নেই, তাই ইংরেজি হরফে বাংলা বানান এবং উচ্চারণের কোন সুষ্ঠু এবং সর্বসম্মত উপায় গড়ে উঠছে না। এই সমস্যা ঘোরতর হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমত, বাংলার ধ্বনিবৈচিত্র্য ইংরেজির চেয়ে বেশি। দ্বিতীয়ত, বাংলার যে সব ধ্বনি ইংরেজি ভাষাতেও রয়েছে সেগুলিও কোন সুনির্দ্দিষ্ট ইংরেজি বর্ণের সাহায্যে প্রকাশ করার উপায় নেই; যেমন ইংরেজি ‘a’, বর্ণটি দিয়ে ‘অ’, ‘আ’, ‘অ্যা’, ‘এই’, ‘এয়া’- এই সব ধ্বনিই উচ্চারণ করা হয় (call, car, can, cane, care); উল্টোভাবে, ‘আ’ ধ্বনিটি ‘a’, ‘e’, ‘i’, ‘o’, ‘u’ সব কয়টি স্বরবর্ণ দিয়েই প্রকাশ করা হয় (car, certify, circle, colour, cut)। বস্তুতপক্ষে, উচ্চারণ-বানান সঙ্গতির বিষয়ে ইংরেজি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ভাষাগুলির অন্যতম। এমন একটি ভাষার বানানের নিয়ম অনুসরণ করে বাংলা উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করতে গেলে অবস্থা কী দাঁড়াবে তা বিশেষ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না; আধানডাক ব্যবহারকারী প্রতিটি বাঙালি ভুক্তভোগীই এ সম্পর্কে কিছু না কিছু ধারণা রাখেন। এসব ক্ষেত্রে নিজের মর্জিমত একটি বানান লেখার পূর্ণ স্বাধীনতা লেখকের থাকলেও পাঠকের জন্য বেশিরভাগ সময়ে প্রসঙ্গের উপর নির্ভর করেই উচ্চারণটি আন্দাজ করে নিতে হয়; আর, লেখক যদি পাঠকের কাছে কম পরিচিত বা অপরিচিত কোন শব্দ লেখেন তা হলে সেটির সঠিক উচ্চারণ উদ্ধার করা পাঠকের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, কোনরকমে গোঁজায় মিল দিয়ে কাজ চালানো গেলেও যেটি ব্যাহত হয় সেটি হলো লেখা এবং পড়ার গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য।

    আধানডাকে ইংরেজি হরফ ব্যবহারের তুলনায় সুবিধাজনক বিকল্প যেহেতু অধিকাংশ লেখকের কাছে খোলা নেই, সেহেতু এই কাজের জন্য ইংরেজির অনিয়মকে পাশ কাটিয়ে, ইংরেজি হরফে বাংলা লেখার একটি সঙ্গতিশীল নিয়ম আমরা গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারি। সেই উদ্দেশ্যে, আমার সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধিকে অবলম্বন করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি এবং কিছু প্রস্তাব রাখছি।

    এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বাংলা ভাষা সহ ভারতবর্ষের সকল ভাষার লেখনরীতির জন্য প্রচলিত হরফ এবং লেখনকৌশল বাদ দিয়ে রোমীয় হরফ (ধ্বনি নয়) এবং বানান পদ্ধতি গ্রহণ করতে; রোমীয় হরফগুলি ইংরেজির মতো উচ্চারণ না করে, সংস্কৃতীয় বর্ণমালার রীতি অনুসারে সাজিয়ে, প্রচলিত সংস্কৃতীয় রীতি অনুসারে উচ্চারণ করতে; এবং ইংরেজি-সহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ভষা যে কৌশলে, কেবল মাত্র মৌলিক বর্ণগুলির মাধ্যমে ‘(,।’, ি’ –এই ধরনের বিশেষ স্বরচিহ্ন কিংবা যুক্তাক্ষর ব্যবহার না করে) বানান লেখে, সেই কৌশলে বানান লিখতে। তাঁর প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি ছিল এই যে রোমীয় হরফ এবং লেখনকৌশল সংস্কৃতীয় কৌশলের তুলনায় সহজতর এবং অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত। অন্যদিকে সংস্কৃতীয় বর্ণমালার কাঠামো ও ধ্বনি-বর্ণ সম্পর্ক রোমীয় ভাষাগুলির তুলনায় অধিকতর যুক্তিসঙ্গত এবং বিকশিত। এ বিষয়ে তিনি ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Calcutta University Journal of the Department of Letters (XXVII:- 1-58)-এ “A Roman Alphabet for India” নামে একটি বড় প্রবন্ধ লেখেন এবং পরবর্তী কালে একটি বইয়েও সংক্ষেপে আলোচনা করেন (Indo-Aryan & Hindi, 2nd ed. Firma K.L Mukhopadhyay, Calcutta 1960: 304-315)। (তবে এই নিবন্ধটি লেখার সময় আমি মূল প্রবন্ধটি জোগাড় করতে পারি নি, শুধু বইটির উপর নির্ভর করতে হয়েছে)।

    সুনীতি কুমার ইংরেজি হরফ এবং কয়েকটি চিহ্নের সাহায্যে, ভারতবর্ষীয় ভাষা সমূহের জন্য একটি বর্ণমালা প্রস্তাব করেন। তাঁর প্রস্তাবিত বর্ণমালার একটি বড় সুবিধা এই যে সাধারণ ইংরেজি টাইপলেখনি বা কম্পিউটারের হরফগুলির মাধ্যমেই বাংলার সব ধ্বনি প্রকাশ করা যাবে। তিনি স্বরবর্ণের দীর্ঘস্বরগুলি বোঝানোর জন্য কোলন ( : ) চিহ্ন, ‘ঞ’ এবং ‘শ’- এর জন্য (‘, accent mark), -‘ঋ’ এবং ‘ঙ’-এর জন্য বর্ণের পাশে ঊর্ধ্ববিন্দু (¬¬-)-এর সাহায্য নিয়েছিলেন। [পরবাসে ঊর্ধ্ববিন্দুর ব্দলে একটি তারকাচিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে- সম্পাদক।] নিচে তাঁর প্রস্তাবিত বর্ণমালা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো। (বিস্তৃত আলোচনার জন্য তাঁর মূল প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।)

    স্বরবর্ণ:

    (অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ,এ, ঐ, ও, ঔ):

    a, a:, I i: u u:

    r* e e: o o:

    ব্যঞ্জনবর্ণ

    k kh g gh n*

    c ch j jh n’

    t’ t’h d’ d’h n’

    t th d dh n

    p ph b bh m

    y r l w

    s’ s’ s h

    (ড়, ঢ়, ং, :, ঁ) :

    r’ r’h m: h: (italics) n অথবা ~

    নাসিকা ধ্বনি (চন্দ্রবিন্দু)-এর জন্য স্বরবর্ণের পর বাঁকা (italics) ন, অথবা স্বরবর্ণের আগে (~) চিহ্ন বসাতে বলেছেন।

    সুনীতি কুমারের প্রস্তাবিত সর্বভারতীয় বর্ণমালা বাংলায় ব্যবহারে একাধিক অসুবিধা রয়েছে বলে মনে হয়। প্রথমত লক্ষণীয় ইংরেজি এবং বাংলা উভয় ভাষাতেই কোলন এবং ঊর্ধ্বকমা চিহ্নদুটির বিশেষ ব্যবহার রয়েছে, সেজন্য ওই চিহ্নদুটি তাদের প্রচলিত ব্যবহারের জন্য রেখে দেওয়াই ভাল হয়। ওই দুটির বদলে বরং (‘, accent mark) দিয়ে কাজ সারা গেলেই ভাল।

    দ্বিতীয়ত, তিনি ‘ত’ ও ‘দ’-এর জন্য যথাক্রমে ‘t’ এবং ‘d’ ব্যবহার করেছেন। তাঁর অমন ব্যবহারের কারণ বোধ করি এই যে এই বর্ণদুটির উচ্চারণ ইউরোপীয় ভাষাবিদগণ ভারতবর্ষীয় বর্ণমালার প্রতিবর্ণীকরণের সময় অমনটিই করেছেন। তাঁদের অমন কাজে দোষ দেওয়া যায় না, কারণ ‘t’ এবং ‘d’ বর্ণদুটির উচ্চারণ ইউরোপীয় ভাষাগুলির কোন কোনটিতে, যেমন, ইংরেজি, জার্মান, ইত্যাদি ভাষায় বাংলা ‘ট’ এবং ‘ড’ ধ্বনি; আবার কোন কোনটিতে, যেমন, ইটালীয়, স্পেনীয়, ইত্যাদি ভাষায় ‘ত’ এবং ‘দ’ ধ্বনির কাছাকাছি। কিন্তু আমরা বাঙালিরা প্রধানত ইংরেজি ভাশার সাথেই পরিচিত; আমরা যখন কম্পিউটারে ইংরেজি হরফ ব্যবহার করি তখন ইংরেজি উচ্চারণ কানে রেখে তা করে থাকি। আমাদের কানে ইংরেজির Tom, train, dog, dollar, ইত্যাদি কখনই ‘তম’, ‘ত্রেন’, ‘দগ’, ‘দলার’ ইত্যাদি হিসেবে প্রতিভাত হয় না। তাই বাংলা ‘ত’, এবং ‘দ’-এর জন্য ‘t’ এবং ‘d’ ব্যবহার করা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে; ‘ত’ এবং ‘দ’-এর চেয়ে ‘ট’ এবং ‘ড’-এর সাথেই t এবং d স্বাভাবিক ভাবে বেশি মেলে।

    তৃতীয়ত, তাঁর প্রস্তাবিত বর্ণমালায় সংস্কৃতীয় বর্ণমালার সকল ধ্বনিই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে, বাংলা ভাষায় যেহেতু সংস্কৃতের সকল ধ্বনি ব্যবহৃত হয় না সেহেতু অব্যবহৃত ধ্বনি প্রকশক হরফের বোঝা বাড়ানোর কোন যুক্তি থাকতে পারে না। উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লিখতে ঈ, ঊ, ঋ, ঐ, ঔ, ঙ, ণ, য, য়, ষ, ঢ়, ৎ, ং- এই ১৩টি হরফের কোন প্রয়োজন হবে না। এই হরফগুলি যে-সব ধ্বনি প্রকাশ করে সেগুলি হয় বাংলায় উচ্চারিত হয় না, নয় অন্য কোন হরফ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। অর্থাৎ এদের জন্য কোন পৃথক রোমীয় / ইংরেজি হরফের প্রয়োজন নেই।

    বাংলা ভাষায়, দেশী-বিদেশী, সংস্কৃত-আরবি ইত্যাদি কোন শব্দের জন্যই যে ‘ঈ’ এবং ‘উ’-এর কোন বিশেষ প্রয়োজন নেই সে কথা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। তারপর লক্ষণীয়, ‘ঐ’ এবং ‘ঔ’ ধ্বনিদুটি কোন মৌলিক স্বরধ্বনি নয়, ও+ই এবং ও+উ-এর সহযোগে গঠিত যৌগিক স্বর। বাংলা উচ্চারণে এমনতর অন্তত পঁচিশটি যৌগিক স্বর রয়েছে, যেমন ‘আই’ (যাই), ‘আও’ (খাও), ‘ইউ’ (পিউ), ‘উই’ (যুঁই), ‘এউ’ (কেউ), ‘এও’ (দেও) ইত্যাদি। ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ যৌগিক স্বর যদি মৌলিক স্বরগুলির সাহায্যে লেখা যেতে পারে, তাহলে ‘ওই’ এবং ‘ওউ’- ধ্বনির জন্য বিশেষ হরফ বরাদ্দ করার কোন যুক্তি থাকে না। উল্লেখ্য, বর্ণমালার যৌক্তিক উদ্দেশ্যটি হলো- একটি ভাষার মৌলিক ধ্বনিগুলি বিশেষ বিশেষ বর্ণের সাহায্যে প্রকাশ করা যাতে যে কোন যৌগিক ধ্বনি সেই বর্ণগুলির সমন্বয়ে প্রকাশ করা যায়। সে কারণে বর্ণমালায় কেবল মাত্র মৌলিক ধ্বনিগুলি থাকাই কাম্য।

    অন্যদিকে, বাংলা উচ্চারণে উপস্থিত ‘অ্যা’ ধ্বনিটি একটি মৌলিক স্বরধ্বনি, এটির জন্য একটি বিশেষ ধ্বনিচিহ্ন থাকা খুবই যুক্তিসঙ্গত। সংস্কৃতে এই ধ্বনিটি নেই বলে বাংলা বর্ণমালায় এর অধিকার অস্বীকার করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।

    বাংলা বর্ণমালার একটি বিশেষ গোলমেলে বর্ণ হলো ‘য়’। শব্দের মাঝে এটির উচ্চারণ কখবনও ‘এ’ (‘হয়’, ‘যায়’, ইত্যাদি): আবার কখনও এর উচ্চারণ কিছুই না, যেমন ‘দিয়ো’ শব্দটিতে ‘য়’-এর কোন উচ্চারণ নেই, ‘য়’ বাদ দিয়ে শুধু ‘(।’ রাখলে অর্থাৎ ‘দিও’ লিখলেও উচ্চারণ একই থাকবে; তেমনি ‘বিয়ে’, ‘ধুয়ে’, ‘ভুয়া’ ইত্যাদি। অর্থাৎ বাংলা ভাষায় ‘য়’-এর নিজস্ব কোন ধ্বনি নেই, সে কারণে পৃথক বর্ণ হিসেবে এর কোন উপযোগিতা থাকতে পারে না। প্রথম ক্ষেত্রে ‘য়’ বর্ণটির বদলে ‘এ’- এর তুল্য ইংরেজি e- বর্ণটি ব্যবহার করা যায়, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘(’- কারযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণের পরে আবার ‘য়ে’ থাকে, যেমন ‘খেয়ে’, ‘পেয়েছি’, ইত্যাদি ক্ষেত্রেও পর পর দুই বার e-বর্ণটি ব্যবহার করলেই চলবে। এসব ক্ষেত্রে ‘এ’- উচ্চারণটি নিছিক দীর্ঘ নয়, বরং মাঝখানে সূক্ষ্মভাবে ভেঙ্গে গিয়ে দুবার ‘এ’ উচ্চারিত হয়। সে কারনে ‘খেয়ে’, ‘খেয়েছি’, ইত্যাদি বানানে দুটি ‘এ’-ধ্বনির মাঝখানে সূক্ষ্ম বিরাম বঝানোর জন্য ‘হাইফেন’ ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন khe-e, pe-echi, ইত্যাদি। উল্লেখ্য, এসব ক্ষেতে ‘এ’-ধ্বনি দুটির মাঝে কোন বিশেষ স্বরধ্বনি নেই। তাই, ‘য়’- বর্ণটিকে যান্ত্রিকভাবে ইংরেজি ‘y’- বর্ণটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা সমর্থনযোগ্য নয়; kheye, peyechi, লিখলে উচ্চারণটি ‘খেইয়ে’, ‘পেইয়েছি’, ইত্যাদি ব্যঙ্গাত্মক, হাস্যকর উচ্চারণে পর্যবসিত হয়।

    ‘অতীত’, ‘বধূ’, ‘যাব’, ‘সরণ’, ‘বাদল’, ইত্যাদি শব্দে একটি হ্রস্ব ‘ও’-ধ্বনি কিংবা ‘অ’ এবং ‘ও’-এর মাঝামাঝি একটি বিশেষ স্বরধ্বনি উপস্থিত বলে অনেকে মনে করেন; এটিকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘হ্রস্ব-ও’, আব্দুল হাই বলেছেন ‘অভিশ্রুত-ও’, আবার কেউ কেউ এটিকে ‘সংবৃত-অ’ নামেও অভিহিত করেছেন। লক্ষণীয় ‘ও’- এর উচ্চারণ হ্রস্ব হওয়া এক কথা, আর ‘ও’ এবং ‘অ’-এর মাঝামাঝি কোন স্বরধ্বনি উচ্চারিত হওয়া আর এক কথা। বাংলা ভাষার দিকপালদের মধ্যেকার এই মতভেদই প্রমাণ করে যে এখানে তারতম্যটি অতি সূক্ষ্ম। এই বিশেষ ধ্বনিটি ঠিক কোথায় উপস্থিত এবং কোথায় নয় সেটির বিষয়ে আমি নিজেও অনেক সময় নিশ্চিত হতে পারিনে, এবং আমার মত অবস্থা অনেকেরই হবে বলে মনে হয়। সেজন্য এই ধ্বনিটির বিষয়ে, এই মুহূর্তে বাড়তি জটিলতা সৃষ্টি না করাই বোধ করি ভাল হবে। তবে, কেউ ইচ্ছে করলেও ‘ও’ চিহ্নটি ব্যবহার করতে পারেন।

    উপরোক্ত একাধিক বিবেচনা সাপেক্ষে সুনীতি কুমারের প্রস্তাবিত সর্বভারতীয় বর্ণমালা কিছুটা পরিবর্তন করে বাংলা আধানডাকের জন্য নিচের বর্ণমালা প্রস্তাব করছি-

    স্বরবর্ণ: (অ, আ, ই, উ, এ, অ্যা, ও):

    a a’ I u

    ব্যাঞ্জনবর্ণ (‘অ’- ধ্বনি সহযোগে):

    Ka kha ga gha n’a

    ca cha ja jha

    ta tha da dha’ra (ড়)

    t’a t’ha d’a d’ha na

    pa pha ba bha ma

    ra la s’a (শ) sa (স) ha

    (s’a এবং sa যথাক্রমে ‘শ এবং ‘স’। ) বিসর্গ ( : )-এর জন্য h’; এবং চন্দ্রবিন্দু (ঁ)-এর জন্য ব্যঞ্জনবর্ণের পরে, নাসিক স্বরবর্ণ কিংবা স্বরচিহ্নের ঠিক আগে ~ চিহ্নটি ব্যবহার করা যাতে পারে।

    এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যখন রোমীয় হরফ এবং বানান কৌশল ব্যবহার করা হবে তখন বাংলা বানান অনুসারে সংস্কৃতীয় হরফ থেকে রোমীয় হরফে বর্ণান্তর না করে, বরং বাংলার গৃহীত উচ্চারণ অনুসারে রোমীয় হরফে লেখাই যুক্তিসঙ্গত হবে। অর্থাৎ ‘সাগর’ শব্দটি ‘sa’gar না লিখে ‘s’agor’ লেখাই ভাল হবে। তাতে করে বাংলায় বর্তমানে বিরাজিত বানান সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

    এবার দেখা যাক উপরের বর্ণমালা খাতা-কলমে প্রয়োগ করে। কিছু নতুন নিয়মের জন্য প্রথম বারে পড়তে একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু, একথা জোর দিয়ে বলা যায় যে নিচের কয়েক লাইন পড়তে পড়তেই জড়তা অর্ধেক কেটে যাবে, এবং কেউ যদি কষ্ট করে এক পৃষ্ঠা লিখতে পারেন তাহলেই লেখা-পড়ায় স্বাচ্ছন্দ্য এসে যাবে। প্রথমে শুরু করা যাক একটি সুপরিচিত ছড়া দিয়ে-

    A’ma’d’er choto nod’I cale bak’e ba’ke
    Bois’a’kh ma’se t’a’r ha’tu jal t’ha’ke
    Pa’r hoe ja’e goru pa’r hae ga’r’i
    D’ui d’dh’r ucu t’a’r dha’lu t’a’r pa’r’i

    উপরে শব্দের মাঝের ফাঁকগুলি দ্বিগুণ রাখতে হবে দুবার ‘space bar’ টিপে। নাহলে ‘accent mark’ ব্যবহার জনিত ফাঁকগুলি শব্দের মাঝের ফাঁকগুলির সাথে গোলমাল হয়ে বোঝার সমস্যা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। তবে, কেউ এটিকে সমস্যা মনে না করলে ফাঁক স্বাভাবিক রাখতে পারেন। এরপর রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে কয়েকটি লাইন রোমীয় পদ্ধতিতে লেখা যাক-

    ‘রাশিয়া ঘুরে এসে আজ আমেরিকার মুখে চলেছি, এমন সন্ধিক্ষণে তোমার চিঠি পেলুম। রাশিয়ায় গিয়েছিলুম ওদের শিক্ষাবিধি দেখবার জন্যে। দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছি। আট বছরের মধ্যে শিক্ষার জোরে সমস্ত দেশের লোকের মনের চেহার বদলে দিয়েছে”।

    ra’s’ia’ ghure es’e a’j a’ merikar’r mukhe colechi, e’mon s’ond’hikkhane t’oma’r cithi pelum. ra’s’ia’ giechilum od’er s’ikkha’bid’hi d’ekhba’r jonne. D’ekhe khub-i bis’s’it’o hoechi. a’t bachorer mod’d’he s’ikkha’r jore s’omost’o d’es’er loker moner ceha’ra’ bod’le d’ieche.

    লক্ষণীয় যে অনভ্যস্ততার জন্যে কিছুটা বাধো বাধো ঠেকলেও, বর্তমানে বাংলায় প্রচলিত কুখ্যাত বানান এবং যুক্তাক্ষর সমস্যা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যে কেউ উপরের বর্ণমালাটি জানলেই যে কোন বানান লিখতে পারবেন।

    এখুনি কোন আধানডাক লেখক যদি উপরে বর্ণিত পদ্ধতির সাথে একমত হয়ে ডাক পাঠানো শুরু করেন তাহলে গ্রাহকের পক্ষে তখনই সে ডাকের পাঠোদ্ধার করা সমস্যা হবে, কারণ নিয়মটি যত সহজই হোক না কেন নিয়মগুলি অধিকাংশ মানুষেরই হাতের কাছে থাকবে না। এই সমস্যাটি সুন্দরভাবে সমাধান করা যায় যদি আধানডাকের মাধ্যমেই উপরের বর্ণমালা এবং বানান পদ্ধতিটি লেখক পাঠিয়ে দিতে পারেন। সে উদ্দেশ্যে নিয়মটি সম্পূর্ণ রোমীয় বর্ণমালা এবং বানান পদ্ধতিতে নিচে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো। নিচের অংশটি আধানচিঠির সাথে পাঠিয়ে দিলে পাঠোদ্ধার করতে আর কোনো অসুবিধা থাকবে না।

    “We are trying to make e-mails in Bangla easier and consistent by adopting modified Suniti Kumar alphabet. All the sounds in Bangla could be written distinctly, without any confusion by using the keys in a normal English keyboard. The alphabets and the rules of spelling are presented here briefly. Please try and give your opinion.”

    THE ALPHABETS

    Vowels: (pronounce as in Bangla)
    a (all) a‘ (up) I (ink) u (fool)
    e (end) e‘ (at) o (go)
    Note the completely new novel alphabet [e‘]. All the excesses are omitted.
    The accent mark (‘) is at the top-left corner of the key board.
    Consonants: (pronounce as in Bangla)
    Ka kha ga gha n‘a
    ca cha ja jha-
    ta tha da dha r‘a(dae bind‘ur‘a)
    t‘a t‘ha d‘a d‘ha na
    pa pha ba bha ma
    ra la s‘a (sh) sa(s)h
    h‘ (bis‘ arga)~ (candrobindu, put before the nasalized vowel).
    THE RULES:

    1. Spelling is strictly according to the pronunciation.

    2. Uppercase letters are not used anywhere.

    3. For clarity double blank spaces are used in between the words”.

    উপরের ইংরেজি বর্ণে লেখা অংশটি কম্পিউটারে একবার কষ্ট করে তুলে রাখলে যে কোন আধানডাকের সাথেই কপি করে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। গ্রাহক আবার সেটি থেকেই কপি করে আর একজনের কাছে পাঠাতে পারবেন। এভাবে অত্যন্ত দ্রুত এই পদ্ধতিটি সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে।

    বি.দ্র: রচনাটির একাধিক প্রসঙ্গে বন্ধুবর আলম খোরশেদ এবং ড: মাহবুবুর রহমানের গঠনমূলক সমালোচনা এবং পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। রচনটির যে কোন প্রসঙ্গে যে কোন পাঠক আধানডাকে মতামত জানালে খুশি হব।

    (কম্পিউটার প্রোগ্রামের কিছু সমস্যার কারণে আমরা accent mark-এর জায়গায় আপাতত উল্টো-ঊর্ধ্বকমা ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছি- পরবাস সম্পাদক। )



    অলংকরণ (Artwork) : ভাস্কর সরকার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments