• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪ | ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ | প্রবন্ধ
    Share
  • ‘ভূমিপুত্র’ : রোহন ওবেরয়
    translated from English to Bengali by শম্পা ভট্টাচার্য (১)

    মালয়েশিয়ার ভাষায় ‘বূমিপুত্র’—মানে ‘ভূমিপুত্র’, মাটির সন্তান যারা, বলতে গেলে তারাই যেন সেই মাটির রাজা। ১৯৬৯ সালে মালয়েশিয়ায় জাতিগত দাঙ্গায় ২০০০ মানুষ প্রাণ হারালে এই ‘রাজকীয়’ শিরোনাম ও তার আড়ালে মালয়েশিয়ার সরকার স্থানীয় মালয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য প্রচুর সুবিধাদায়ী এক বহুমুখী নীতি চালু করে। অনেকাংশেই এই ভারতের তফসিলী জাতি/ উপজাতিদের জন্য করা বিশেষ স্থান সংরক্ষণ নীতিটির মত। ভূমিপুত্র নীতিরও মূল উদ্দেশ্য হল মালয়ীদের আর্থিক ও সামাজিক মান উন্নত করে দেশের অপরাপর জাতির লোকেদের সাথে সমান করা।

    নামেমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫০%-এর সামান্য বেশি) হলেও প্রধানত মুসলমান মালয়ীরা কিন্তু মালয়েশিয়ার আদিম অধিবাসীই নয়—সেই সম্মান দেওয়া যায় বরঞ্চ ‘ওরাং আসলি’ (Orang Asli) নামে পরিচিত দেশজ উপজাতিদের। মালয়েশিয়দের প্রায় একের-তিন ভাগ লোক অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী চীনা; ভারতীয়রা হল সেদেশে তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ।

    ভূমিপুত্রদের এই সব বাড়তি সুবিধাদায়ক ব্যবস্থার জন্য মালয়েশিয়া মোটামুটি একটা আর্থিক ও রাজনৈতিক স্থিতাবস্থায় এসেছে। আর্থিক দিক থেকে এখনও পিছিয়ে থাকলেও ভূমিপুত্র মালয়দের হাতেই রাজনৈতিক ক্ষমতা; এবং কয়েকটা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও তাদের উপস্থিতি ক্রমশ লক্ষ্য করার মত। চীনারা সবচেয়ে স্বচ্ছল; আর সামগ্রিকভাবে ভারতীয়দের আর্থিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতা কোনটাই বিশেষ না থাকলেও এদের আর্থিক অবস্থা মালয়ীদের থেকে খুব সামান্যই ভালো।

    লক্ষণীয়, ভারত বা আমেরিকার মত না হয়ে, মালয়েশিয়ার ভূমিপুত্র নীতিটি প্রথম থেকেই সংখ্যালঘুদের বদলে সংখ্যাগরিষ্ঠদের উদ্দেশ্যেই তৈরী। বোধহয় সেই কারণেই অল্পস্বল্প যথারীতি খুঁতখুঁত করা ছাড়া এই নীতিটির বিরুদ্ধে কোন গুরুতর আপত্তি ওঠে নি বাকিদের কাছ থেকে। সংরক্ষণ নীতির ক্রমবর্ধমান পরিসরে এখন ‘অন্যান্য অনগ্রসর জাতিগুলি’ (Other Backward Castes, OBC) যুক্ত হওয়ায় ভারতও হয়তো এই পথেই চলেছে।

    গত প্রায় তিন দশকের মধ্যে একবারই মাত্র মালয়েশিয়া ভূমিপুত্র নীতি ঠিকমত অনুসরণ করে নি। আশির গোড়ার দিকে আর্থিক সমস্যায় বিব্রত সরকার এই নীতির কিছু কিছু অংশ সাময়িকভাবে অপসারিত করে। এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসাবে সে দেশের প্রভাবশালী প্রধান মন্ত্রী শ্রী মহাথিরের বক্তব্য ছিলো: ভাগ করার মত ‘কেক’-ই না থাকলে সমবন্টনের নীতিকে কাজে লাগানো যায় না। অনুমান হয়, বর্তমান এশিয়া-জোড়া অর্থনৈতিক সংকট (যাতে রিংগিট (ringgit)-এর দাম প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে) দেখে সরকার আবারও হয়তো এই রকম ব্যবস্থা নিতে পারে।

    মলাক্কা প্রণালীর অপর পারে ইন্দোনেশিয়ায় ভূমিপুত্র নীতির মত কোন নীতি নেই এবং সেখানকার পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায় মালয়েশিয়ায় কী হতে পারতো। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় সম্পদের প্রায় ৬০% মুষ্টিমেয় (নাগরিকদের মাত্র ৫%) চীনাদের হাতে। উপর্যুপরি ওদের বিরুদ্ধে কয়েকটি দাঙ্গা হয়েছে (শেষটি হয়েছে এই বছরেই, মুদ্রা-সংকটের সময়), এবং অন্যদের মধ্যে চীনাবিরোধী মতবোধ অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠায় সম্প্রতি চীনাদের স্বাধীনভাবে জীবন যাপন নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি, প্রকাশ্যে চীনাদের নববর্ষ পালন পর্যন্ত নিষিদ্ধ এখন ইন্দোনেশিয়ায়।

    ভূমিপুত্র প্রণালীর প্রধান ত্রুটিগুলি যথারীতি তুলনীয় পক্ষপাতদুষ্ট যেকোন কর্মসূচীর মতই। একটি অপেক্ষাকৃত ছোট, কিন্তু বিশাল বিত্তবান মালয়ী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এর দ্বারা প্রচুর লাভবান হচ্ছে। যেখানে বাকিরা, সংখ্যাতে বেশি হলেও, বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না।

    আসলে ভূমিপুত্র নীতি থেকে এ পর্যন্ত এটাই বোঝা যায় যে সাম্যের চেয়ে সাম্যের ভানটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়দের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন সমঝোতা আছে: মালয়রা পাবে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কিছু বাঁধাধরা অর্থনৈতিক সুবিধা (quota), আর দেশের বাকি নাগরিকরা তাহলে নির্ঝঞ্ঝাটে টাকা করতে পারবে। এই চুক্তিটি দারুণভাবে সফল। এমনকি এই বছরের ঘটনাগুলির পরিপ্রেক্ষিতেও, চুক্তিটি শুধু যে টিকে আছে তাই নয়, এটা মালয়েশিয়াকে আদর্শস্থানীয় করে তুলেছে উন্নতির বিচারে। এ কথা মনে রাখা দরকার যে ঐ অঞ্চলের অন্য ‘টাইগার ইকনমি’র দেশগুলোর (হংকং, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান) থেকে মালয়েশিয়া একটি ব্যতিক্রম—এদের মত দেশটা মোটেই ছোট নয়, আর তাছাড়া এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় পুরুষানুক্রমিকভাবে কম শিক্ষিত ও অনুন্নত।

    সম্প্রতি তেহেরানে দেওয়া একটি বক্তৃতায় প্রধান মন্ত্রী মহাথির বলেন যে রিংগিত-এর অবমূল্যায়নের ফলে মালয়েশিয়দের মাথাপিছু আয় $৩০০০-এ নেমে এসেছে $৫০০০ থেকে, যেটি অর্জন করতে ১৫ বছর লেগেছিলো। অবশ্য মনে হয় যে ঐ $৫০০০-এ ফিরে যেতে ১৫ বছর আর লাগবে না, কারণ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভালো (বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৮%), এবং বেকার সমস্যা আয়ত্বের মধ্যে। মালয়েশিয়ার মুদ্রা-সংকটের একমাত্র কারণ বিনিয়োগকারীদের আশংকা—কোরিয়া সমেত অন্যান্য আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলোর মত বেহিসাবি ধার বা পর্বতপ্রমাণ ঋণের বোঝায় মালয়েশিয়া নত হয়ে নেই। এমনকি $৩০০০ ধরলেও মালয়েশিয়ার মাথাপিছু আয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির তুলনায় প্রায় দশগুণ। আজ যদি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর অর্থনীতবিদেরা নিজেদের পিঠ চাপড়ান এই ভেবে যে ওঁদের দূরদৃষ্টিক্রমে নিজেদের দেশগুলো দক্ষিণ-পূর্বের জ্ঞাতিদের মত ফাটকাবাজির কবলে পড়লো না—সেটা হয়তো ঠিক, কিন্তু কী মূল্যে?

    ভূমিপুত্র নীতি অনুসরণের ফলে মালয়েশিয়ার আর্থিক উন্নতি হয়তো যথেষ্ট হয়নি, কিন্তু এই নীতিটি যেখানে উচিত সেখানেই আঘাত করেছে বলে মনে হয়। গত দু’দশকের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা ৫০% (বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় যা) থেকে ১০%-এরও নীচে নেমে গেছে, আর সাক্ষরতার হার ৮৩% এবং আরও উঠছে (দক্ষিণ এশিয়াতে এটাও ৫০%-এর নিশানার কাছেই ঘোরাফেরা করছে)।

    এইসব থেকে দক্ষিণ এশিয়া কিছু উপযুক্ত শিক্ষা পেতে পারে। সে কেবলমাত্র সাম্প্রতিক মুদ্রা-সংকট বা পূর্ব এশিয়ায় গত দশকের বিদেশী বিনিয়োগের বন্যার বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া তাৎক্ষণিক বা স্বল্পমেয়াদী শিক্ষা নয়। সমতা আনার ও জনসম্পদ উন্নয়নের জন্য দীর্ঘস্থায়ী নীতি কীভাবে যে একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেটাই শেখার। সে শিক্ষার মেয়াদ ও ফল দুটোই সুদূরপ্রসারী।

    মালয়েশিয়ার ভূমিপুত্র নীতির সঙ্গে ভারতের সংরক্ষণ নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। ভারতের নীতি নিয়ে যখন তর্ক ওঠে তখন দেখা হয় না যে নীতিটি শুধু স্কুল-কলেজে ও সরকারি চাকরিতে আসন সংরক্ষণের ব্যাপারেই আছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোতেই চাকরি বেশি, অথচ তারা সংরক্ষণের আওতায় পড়ে না। সংরক্ষিত আসনে ভর্তি হয়ে স্কুল-কলেজ পাশ করে পরে চাকরি পেয়েছে এমন ‘অনগ্রসর’ কিছু লোকের কথা না ধরলেও হয়। মালয়েশিয়ার ভূমিপুত্র নীতি আরও অনেক ব্যাপক, সেখানে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা, করমুক্তি, এ সব ছাড়াও আরও অনেক লোভনীয় আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয় মালয়দের। ভূমিপুত্র নীতি প্রবর্তনের সময়, বিশেষ কোন যুক্তি ছাড়াই, প্রায় সমস্ত কিছুতেই ৩০% মালিকানা ভূমিপুত্রদের হাতে আইন করে দেওয়া হয়েছিলো। এর ফলে বহু ধনী চীনা ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা-সম্পত্তি অনেক সময় বেশ লোকসানেই বিক্রী করে দিতে বাধ্য হয়েছিলো।

    ভারতের নীতিগুলি কোন কিছু ভালো করা দূরে থাক, উল্টে বিরক্তি উৎপাদনই করছে বেশি। ভারতের তুলনায় চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক সাফল্যের আসল বীজ, এখন শোনা যাচ্ছে, রোপিত হয়েছিলো সেই ১৯৫০-৬০-এর বাড়াবাড়ি রকমের আন্দোলনের সময়—যখন চীনে চাষের জমি পুনর্বন্টন করার ফলে এক ক্ষমতাশালী কৃষকশ্রেণীর সৃষ্টি হয়। এরকম অন্তত উত্তর ভারতের বেশিরভাগ জায়গাতেই হয়নি।

    ভারতের ‘ভূমিপুত্র’ নীতি তৈরী করা যেতে পারে তাদের জন্য যারা থাকে মাটির খুব কাছাকাছি—যেমন ভূমিহীন ভাগচাষী বা শ্রমিক, বা জমি থাকলেও, যাদের নিজেদের পেটে দু-মুঠো দেবার পরে আর অবশিষ্ট থাকে না কিছু বিক্রী করার মত। বিহার, উত্তর প্রদেশ সমেত উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় এরাই দারিদ্র্যের প্রচণ্ড জাঁতাকলের তলায় নিষ্পিষ্ট হচ্ছে।

    সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়ীদের মধ্যে জাতগত বিভেদ না থাকায়, মালয়েশিয় সরকারের পক্ষে এমন অনেক রাজনীতিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে যা বহু গোষ্ঠীর পক্ষে যথেষ্ট আর্থিক অসুবিধার কারণ হলেও সামগ্রিকভাবে দেশের আর্থিক উন্নতির পক্ষে জরুরি ছিলো। ভারতে কোন রাজনৈতিক সংকল্প দূরে থাক, কোন বিতর্কের আভাসমাত্র পাওয়া যায় না সাধারণ পুনর্বন্টনের উপরে। নামমাত্র যে ভূমিবন্টন আইনটুকু ছিলো, যেমন জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত, সেটাও যেন জাতীয় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। নির্মম সত্য এই যে আমাদের বহুজাতিক সমাজ-ই দেশের প্রগতির অন্তরায়, এবং তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে অতিক্রম করতে না পারলে দেশের উন্নতি সম্ভব নয়।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments