• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪ | ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ | গল্প
    Share
  • সময়ের ফাঁদ : অরুণাভ সিংহ

    কলকাতা, ২০০৮। জানুয়ারী মাস। ঠান্ডার আমেজ আছে, যদিও শীত যাই যাই। সুগত রায়-এর বাড়ী, সকাল। close up: বাটিতে কর্ন ফ্লেক্‌স্‌ আর দুধ, চামচ ধরা হাত দ্রুত গতিতে কর্ন ফ্লেক্‌স্‌ তুলে (অদৃশ্য) সুগত রায়-এর মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ সুগতর চোখের। মৃদু স্বরে টেপ রেকর্ডারে বাজছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, “তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ”। হঠাৎ ক্যামেরার সামনে ভেসে ওঠে একটি ডিজিটাল হাতঘড়ি। আটটা সতেরো বাজে। ক্যামেরা চলতে শুরু করে, আওয়াজ শুনে বোঝা যায় সুগত চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠল, টেবিল-এর পাসে রাখা ব্রিফকেস ওঠাল, এবং দ্রুত পায়ে ড্রয়িং রুম হয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। গান বন্ধ হয়ে গেল। ক্যামেরা এখন সুগতর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করছে। সুগত বাইরে দাঁড় করান গাড়ীর দরজা খুলে ড্রাইভার সিটে বসল, ড্যাশবোর্ডে ঘড়ির দিকে তাকাল। আটটা একুশ। ড্যাশবোর্ডে ক্যাসেট র‍্যাকের ওপর হাত নেমে এল, আঙুল দিয়ে পরপর ক্যাসেট গুলো ছুঁতে ছুঁতে বেছে নিল একটা। closeup-এ এ দেখা গেল লেখা আছে, “Classics For Your Ears: 20th Century Time Travel Stories”। সুগত ক্যাসেটটা ঢুকিয়ে দিল টেপ ডেক এ… গাড়ী স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজের ওপর দিয়ে ভেসে এল।

    প্রথম দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। ঘড়ির সময় পর্যন্ত এক। একমাত্র পার্থক্য, আজ সুগত বেছে নিল Paul Davies-এর About Time: Einstein’s Unfinished Revolution.

    প্রথম দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। এবারের বই Ray Bradbury-র A Distant Sound of Thunder.

    প্রথম দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। বইয়ের নাম Ricahrd Feynmanএর Surely You’re Joking. Mr Feynman.

    সুগতর বাড়ী বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড বেকবাগানের ফ্লাইওভারের মুখে ট্র্যাফিক আলোয় দাঁড়িয়ে। পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছেন আনুমানিক চল্লিশ বছর বয়েসের একজন ভদ্রমহিলা। চেহারা দেখে বোঝা যায় বয়েস আটকে রাখার চেষ্টা করেননি, কিন্তু মুখটা দেখলেই আশ্চর্য হতে হয়, কারণ তাঁর মুখ যুবতীর। ধীরগতিতে হেঁটে যেতে যেতে তিনি শুনতে পান সুগতর গাড়ীর টেপ ডেক থেকে ভেসে আসছে “Surely You’re Joking, Mr. Feynman”-এর কয়েকটি কথা।

    গাড়ীর ভেতরে সুগত বসে। স্টিয়ারিং এত শক্ত করে ধরা যে আঙুলগুলো ফ্যাকাশে লাগছে। এই প্রথম তার মুখ দেখতে পাই, পাশ থেকে। সাধারণ চেহারা, রাস্তায় দেখলে মনে রাখার মত নয়। তবে নাকের দুপাশ থেকে গভীর দুটো রেখা নেমে গেছে ঠোঁটের কোণ পর্যন্ত। চুল কাঁচা-পাকা। বয়েস পঁয়তাল্লিশের আশে পাশে। বইটির যে অংশটুকু বাইরে থেকে শোনা গেছিল, তার পরবর্তী অংশ এখন আরো জোরে শোনা যাচ্ছে। সুগত বাইরের দিকে তাকিয়ে, হেঁটে যাওয়া ভদ্রমহিলা চোখে পড়ল বটে, কিন্তু সে মাথা ঘুরিয়ে চোখ দিয়ে তাকে অনুসরণ করল না। ভদ্রমহিলা ভিড়ে হারিয়ে গেলেন, আলো সবুজ হল, পেছনের গাড়ীর হর্ন শুনে সুগত সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি ফার্স্ট গীয়ার দিল।

    সুগতর অফিস। সকাল। পুরনো ধাঁচের আসবাবপত্র। কিন্তু ঘরে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে, যাদের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারণা নেই। সব মিলিয়ে একটা পরিচিত অথচ অপরিচিত চেহারা। সুগত নিজের ডেস্কে বসে বাঁ-দিকে রাখা একটি ছবির দিকে তাকায়। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবতীর ছবি, হাসিমুখ। সুগত ফোন তুলে ডায়াল করে।

    সুগত: আমি বলছি। পৌঁছে গেছি। হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি ফিরব।

    সুগতর সেক্রেটারির প্রবেশ। সুগত তাড়াতাড়ি ছবিটা নিয়ে ড্রয়ারের ভেতরে রাখে। ক্যামেরা ড্রয়ারের ওপর zoom করে… পর্দা অন্ধকার হয়ে যায়… সুগত ও সেক্রেটারির কথাবার্তা শোনা যায়।

    সেক্রেটারি: আজকে ভিডিও-কনফারেন্সের কথাটা ভুলবেন না, সাড়ে ছটায়।

    সুগত: ও হ্যাঁ… কনফারেন্স… কনফারেন্স… আজ কি বার? থাক। তুমি আমায়… আচ্ছা আমি একটু পরে...

    দুজনের গলা মিলিয়ে যায়, এবং রূপান্তরিত হয় মৃদু গুঞ্জনে… বেশ কিছু লোকের সমাবেশে যেমন হয়।

    ক্যামেরা আবার পিছিয়ে আসে, close-up থেকে mid-shot-এ পরিণত হয়। আমরা দেখতে পাই একটা কফিন, কালো কাঠের। পার্ক স্ট্রীট কবরস্থান। কফিন নামানো হচ্ছে কবরে। ক্যামেরা সুগতর মুখের ওপর স্থির হয়, অভিব্যক্তিহীন মুখ, তবে চোখ অস্বাভাবিক রকম লাল। সুগতর বয়েস অন্তত দশ বছর কম। ক্যামেরা ঘুরতে থাকে, যঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাদের পরিক্রমা করতে থাকে। টুকরো টুকরো কথাবার্তা ভেসে আছে…

    ভদ্রমহিলা ১: কত বয়েস হয়েছিল?
    ভদ্রমহিলা ২: তিরিশের আশে পাশে..
    ভদ্রমহিলা ১: সুইসাইড শুনলাম?
    ভদ্রমহিলা ২: সেটা কি কেউ স্বীকার করবে?

    বয়স্ক মহিলা ১: অনেকদিন ডিপ্রেশনে ভুগছিল বেচারি।

    ভদ্রলোক ২: অশোকের জন্য খারাপ লাগছে।

    ক্যামেরা অশোক দত্তর মুখের ওপর স্থির হয়। অশোক নীচু হয়ে এক দলা মাটি তুলে কবরের ভেতরে ফেলে দেয়। তারপর দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যায়, এবং মুখোমুখি হয় সুগতর। সুগত এখনও ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে।

    সুগত: আমি রুক্মিণীকে চিনতাম। আপনার থেকে অনেক আগে।

    অশোক: ও। মাপ করবেন, আমি আপনাকে চিনতে পারলাম না। আর এখন ঠিক কথা বলার…

    সুগত: আপনারও কথা শেষ হবে একদিন।

    অশোক: আসবেন একদিন আমাদের বাড়ী… মানে…

    অশোক চলে যায়।

    সুগত: এত দিন যাইনি, এখন যাবো?

    সময়: আবার বর্তমান। বইয়ের দোকান। সন্ধ্যে। ইস্টার্ন মেট্রপলিটান বাইপাসের পাশে বিরাট দোকান। প্রচুর শেল্ফ। সুগত সায়েন্স ফিকশন বিভাগে অডিওবুক দেখছে।

    সুগতর বাড়ী। রাত। সুগত টিভিতে The Big Sleep দেখছে। Humphrey Bogart আর Lauren Bacall-এর কথাবার্তা চলছে।

    সুগতর শোবার ঘর। সুগত ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করছে। অপর দিকে ফোন বাজার আওয়াজ। সুগত অন্যমনস্কভাবে নিজের চুল টানতে ব্যস্ত। ফোনের ওপর ভেসে আছে অশোকের গলা--

    অশোক: হ্যালো!

    সুগত: নমস্কার। এটা কি অশোক দত্তর বাড়ী?

    অশোক: কে বলছেন?

    সুগত: আমি আপনার স্ত্রী রুক্মিণীর পুরনো বন্ধু, বিদেশে ছিলাম প্রায় কুড়ি বছর, ফিরে অনেক কষ্ট করে আপনাদের নম্বরটা জোগাড় করলাম। রুক্মিণী নেই বাড়ীতে?

    নিস্তব্ধতা। তারপর --

    অশোক: কি নাম বললেন যেন আপনার?

    সুগত: সুগত রায়। আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ হয়নি, আপনাদের বিয়ের আগেই আমি--

    অশোক: সুগত-বাবু, আপনি হয়তো জানেন না, রুক্মিণী বছর দশেক আগে... মারা যায়।

    সুগত (অভিনয় করছে): My God! দশ বছর। আমি একটা খবরও পাইনি। I’m really very sorry.

    অশোক: আসুন না একদিন আমার বাড়ীতে। পুরনো দিনের কথা শুনতাম। সুগত ফোন নামিয়ে রাখে।

    সুগত: এত দিন যাইনি, এখন যাব?

    সকালের দৃশ্যর পুনরাবৃত্তি। সুগত অফিস যাচ্ছে।

    সুগতর বাড়ী। রাত। টিভি চলছে। সুগত মন দিয়ে শুনছে। টাইম মেশিনের আবিষ্কার নিয়ে প্রতিবেদন।

    ঘোষক: যদিও এখনো পরীক্ষামূলক অবস্থায় রয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন শীঘ্রই মানুষ অতীতকালের ঘটনা চাক্ষুষ দেখতে ও শুনতে পারবেন। আপাতত এর সীমা আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে বেঁধে রাখা হচ্ছে, যাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে আরো সুবিধে হয়। তবে আর কিছুদিনের মধ্যেই আপনারা হয়ত অতীতে ফিরে গিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হতে পারবেন।

    রেস্টুরেন্ট। রাত। অশোক দত্ত ও এক ভদ্রমহিলা একটি টেবিলে বসে। ভদ্রমহিলা অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু ওনার কথার মাঝপথে অশোক হঠাৎ উঠে রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

    সুগতর বাড়ী। রাত। সুগত ফোন করে অশোককে। অশোক বেশ মদ্যপ অবশায়।

    অশোক: হ্যালো--
    সুগত: আমি সুগত।
    অশোক: কেমন আছেন?
    সুগত: অশোক, রুক্মিণীকে তুমি খুন করেছ।

    অশোক: তা তো বটেই। এই সহজ ব্যাপারটা আপনার বুঝতে এতদিন লাগলো। ও সরি, আপনি তো একদিন--
    সুগত: অশোক, আমি তোমায় খুন করব।
    সুগত লাইন কেটে দেয়।
    সকালের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। সুগত অফিস যাচ্ছে।

    সুগতর বাড়ী। রাত। সুগত ফোন করে অশোককে।
    সুগত: তুমি ওকে মেরেছ।
    কাট

    সুগতর বাড়ী। রাত। সুগত ফোন করে অশোককে।
    সুগত: এবার আমি তোমায় মারবো।

    কাট

    সুগতর বাড়ী। রাত। সুগত ফোন করে অশোককে।
    সুগত: আমার রাগ মরেনি।

    কাট

    সুগতর বাড়ী। রাত। সুগত ফোন করে অশোককে।
    সুগত: নয় তুমি আমায় মেরে ফেলো।

    সন্ধ্যে। বই-এর দোকানের সায়েন্স ফিকশন বিভাগে সুগত অডিওবুক খুঁজছে। পাশে আরেকজন অল্পবয়স্ক, বাইশ-তেইশ বছরের যুবকও বই ঘাঁটছে।

    যুবক: এত বাজে ভাবে এরা অর্গ্যানাইজ করে বইগুলো --

    সুগত: আপনি কি খুঁজছেন?

    যুবক: টাইম ট্র্যাভেলের ওপর সায়েন্স ফিকশন।

    সুগত: ওগুলো ঐ র‍্যাকটায়… আপনার এ বিষয়ে ইন্টারেস্ট আছে?

    যুবক: আসলে পেশা তো ওটাই, তাই ঐ বিষয়ে গল্প পড়ে মজা পাই। আজকাল অবশ্য সিরিয়াসলি নিতে হচ্ছে, এই গল্পগুলোর মধ্যে কত সত্য লুকিয়ে আছে যাচাই করার সময় এসে গেছে।

    সুগত: আপনি ঐ প্রোজেক্টটাতে ইনভল্ভ্‌ড্‌ নাকি? ঐ টাইম মেশিন?

    যুবক: ও আপনি খবর রাখেন দেখছি।

    সন্ধ্যে। বই-এর দোকানের কফি শপ। সুগত ও যুবক মুখোমুখি বসে।

    যুবক: দেখুন, আমাদের ক্যালকুলেশনগুলো বলছে মেশিনটা কাজ করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তো জন্তু জানোয়ার পাঠিয়ে লাভ নেই, যেমন মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল। মানুষ চাই। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আজকাল যা নিয়মের কড়াকড়ি, কাউকে পাঠানো খুব একটা সহজ হবে না।

    সুগত: কেন? কেউ যেতে চান না? ঝুঁকি নিতে চান না বৈজ্ঞানিকরা?

    যুবক: না না, তা নয়। কিন্তু হাজারো ঝকমারি আছে; অনুমতি পাওয়ার আগে ইউ এন থেকে... জানেন তো।

    সুগত: তো আপনাদের টাইম ট্র্যাভেল প্যারাডক্স কি বলে এই বিষয়ে?

    যুবক: সেটাই তো সত্যি কিনা পরখ করার সুযোগ। কেউ বলে অতীতকে পাল্টানো সম্ভব নয় কেননা তাহলে বর্তমানও পাল্টে যাবে, কেউ বলে সম্ভব, এবং অবশ্যই বর্তমান পাল্টাবে…

    সুগত: আবার কেউ বলে আমাদের সবার অতীত নিজস্ব… আমার অতীত আর আপনার অতীত আলাদা, নিজেরটা পাল্টাতে পারি, আপনার তো পাল্টাতে পারব না….

    কথাবার্তা চলাকালীন ক্যামেরা ধীরে ধীরে একটা কফি-কাপ কে close-up-এ ধরে… এবং zoom-out করে… দেখা যায় টেবিলে দুটো কফি কাপ। একই স্থান। কিন্তু সুগতর মুখোমুখি বসে আছে রুক্মিণী, বেঁচে থাকলে যত বয়েস হত সেই বয়েসের। কোন একটা কথায় দুজনেই হাসছে, হাসতে হাসতে সুগতর বিষম লেগে গেল। রুক্মিণী তাড়াতাড়ি টেবিলের এপাশে উঠে এসে সুগতর পিঠে হাত বোলাতে লাগলো। সুগত বিষম সামলে আবার হাসতে আরম্ভ করল। এই দৃশ্যটা আমরা তিন-চারবার দেখলাম, প্রত্যেকবার ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ আলাদা। এবং একটু একটু করে ক্যামেরা সুগত আর রুক্মিণীর থেকে আরো দূরে চলে যায়, শেষ পর্যন্ত দরজার বাইরে থেকে দৃশ্যটি দেখা যায়, কোন আওয়াজ শোনা যায় না।

    রুক্মিণীর গলা শোনা যায় হঠাৎ “কফি দিই আরেকটু?”

    আসলে ওয়েট্রেসের গলা। সুগত চমকে ওঠে। দৃশ্য ফিরে আসে বাস্তব জগতে।

    সুগতর বাড়ী। রাত। সুগত ফোন করে অশোককে।

    সুগত: আমি তোমায় মেরে ফেলবো।

    অশোক: আমার আপত্তি নেই। অর্ধেক তো মরেই গেছি।

    সুগতর বাড়ী। সন্ধ্যে। সুগত ও সেই যুবকটি সোফায় বসে।

    সুগত: আপনার কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। অবশ্য আপনার কাছে এটা হয়তো অবাস্তব আবদার মনে হবে।

    যুবক: আপনি টাইম মেশিনে যেতে চান, এই তো?

    সুগত: হ্যাঁ। পরিবর্তে আমি একটা বড় ডোনেশান দেব আপনাদের প্রোজেক্টের জন্য।

    যুবক: যদিও আমার হ্যাঁ বা না বলার কোন অধিকার নেই, কিন্তু আমি এখনই বলে দিতে পারি এটা অসম্ভব।

    সুগত: কেন?

    যুবক: কেউ অনুমতি দেবে না।

    সুগত: অনুমতির কথা কে বলছে?

    যুবকঃ মানে?

    সুগত: It’s very simple. আপনারা একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চান। আমার ঝুঁকি নিতে আপত্তি নেই। ইন ফ্যাক্ট আমি ফর্মাল ডিক্লারেশন দিয়ে যাবো আপনাদের কাছে। যদি এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল হয়, তাহলে আপনারা অনেক কিছু শিখবেন। আর যদি আমি ফিরে আসতে না পারি, তাহলেও আপনারা বুঝতে পারবেন ভুল হয়েছে কিছু। একজন মূল্যবান বৈজ্ঞানিককে খোয়াতে হবে না আপনাদের। আর আমি যদি অতীতে আটকেও যাই, আমার আপত্তি নেই।

    যুবক: কিন্তু আপনি কেন যেতে চান?

    সুগত: ধরে নিন আমারও একটা এক্সপেরিমেন্ট করার আছে। অবশ্য আপনাদের নির্দেশ আমি সবই পালন করব। যা যা তথ্য লাগবে সব সংগ্রহ করে আনব।

    রাত। সুগতর বাড়ী। ফোন বাজছে।

    সুগত: হ্যালো--

    যুবক: সুগতদা, এক্ষুনি একবার আসতে পারবেন আমাদের এখানে?

    সকালের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। সুগত অফিস যাচ্ছে।

    সুগতর বাড়ী। রাত। সুগত ফোন করে অশোককে।

    সুগত: আমি তোমায় মেরে ফেলবো। কাল।

    ঘড়িতে ঢং ঢং করে এগারোটা বাজে।

    সকালের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। সুগত অফিস যাচ্ছে।

    সকাল। সুগতর অফিস। কম্প্যুটারের সামনে বসে সুগত এয়ার টিকিট বুক করছে। কলকাতা থেকে বম্বে, বিকেলের ফ্লাইট।

    সন্ধ্যে। সুগত অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে ওঠে। এর পর রাস্তায় নানা জায়গায় লোকেরা দেখে সুগত বিদ্যুৎগতিতে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে।

    সন্ধ্যে। বালিগঞ্জ পার্ক রোডে একটি বহুতল বাড়ীর ফটক। ভেতরে বাচ্চারা খেলছে। সুগতর গাড়ী এসে থামলো। সুগত গাড়ী থেকে বেরিয়ে চাবি দারোয়ানকে দিল পার্ক করার জন্য।

    সুগত: অশোক দত্ত, কত নম্বর অ্যাপার্টমেন্ট?

    দারোয়ান: ভেতরে সিকিওরিটিতে নাম লেখাতে হবে।

    লিফ্‌টের পাশে নিরাপত্তা বিভাগের টেবিল। সুগত দৃঢ়পায়ে হেঁটে টেবিলের সামনে দাঁড়ায়।

    সুগত: অশোক দত্ত, কত নম্বর?

    সিকিওরিটির লোক: আপনার নাম?

    সুগত: সুগত রায়।

    সিকিওরিটি-র লোক: এক মিনিট।

    ফোন তুলে কিছু কথা বলে।

    সিকিওরিটি-র লোক: যেতে পারেন। আট তলা, ৮০৯১।

    সুগত দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ঘুরে বেরিয়ে যায়।

    সুগত দাঁড়িয়ে। লিফ্‌টের দিকে এগোয়। দরজা খুলে যায়। সুগত ভেতরে ঢোকে, দরজা বন্ধ হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ। একটি যান্ত্রিক গলা ভেসে আসে।

    যান্ত্রিক গলা: Which apartment would you like to go to? কত নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে যাবেন?

    সুগত: ৮০৯১

    যান্ত্রিক গলা: Just a moment, please, একটু অপেক্ষা করুন।

    অশোক দত্তর অ্যাপার্টমেন্ট-এর দরজা খোলা। ভেতর থেকে অশোকের গলা ভেসে আসে।

    অশোক: আসুন সুগতবাবু। আপনার জন্য বহুদিন অপেক্ষা করছি।

    সুগত ভেতরে ঢোকে। ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ সুগতর চোখের। দেখা যায় বসবার ঘরে অশোক বসে আছে স্টুলে, বারের ওপর কনুই দিয়ে ভর দিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে।

    অশোক: আমায় খুন করতে এসেছেন তো?

    সুগত: হ্যাঁ। দশ বছর ধরে আমি এই দিনটার অপেক্ষা করেছি।

    অশোক: এতদিন কেন?

    সুগত: কারণ আমি চাই তোমাকে মেরে ফেলার পরে বেঁচে থাকতে। আমি এমন একটা জগৎ ভোগ করতে চাই যেখানে তুমি মৃত।

    অশোক: কিন্তু এইভাবে সবাইকে আপনার নাম জানিয়ে কি আপনি পালাতে পারবেন?

    সুগত: সে ব্যবস্থাও হয়েছে। কেউ আমায় তোমার খুনের জন্য দায়ী করতে পারবে না। এবং তুমি সেটা জেনেই মরবে।

    অশোক: আপনার ধারণা যে রুক্মিণীর মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী?

    সুগত: সেটা ঠিক কি ভুল কিছু আসে যায় না। কারণ আমি তোমায় এখন খুন করব। আর তুমি আত্মরক্ষার জন্য কিছুই করতে পারবে না।

    অশোক: আমি আত্মরক্ষার কেন চেষ্টা করব না সুগতবাবু। কিন্তু আপনি পালাবেন কি করে?

    সুগত: তুমি তো ফিজিক্স পড়াও। তাহলে এটা বুঝতে কোন অসুবিধেই হবে না।

    সুগত পকেট থেকে রিভলবার বার করে।

    সুগত: ঐ দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াও।

    অশোক: কেন অযথা নাটক করছেন? আমি ওসব কিছুই করব না। আপনি স্বচ্ছন্দে এক্ষুনি গুলি চালাতে পারেন।

    সুগত: না। আগে তোমাকে জানতে হবে কেন কেউ আমায় ধরতে পারবে না। তুমি জানো তো, আমাদের শহরে একটা টাইম মেশিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে? সেই মেশিনের প্রথম যাত্রী আমি।

    অশোক: Would you like a drink, Sugata?

    সুগত: আমি তোমায় একটু পরে গুলি করব। তারপর ঐ মেশিনটায় আমি পিছিয়ে যাব চব্বিশ ঘন্টা। অর্থাৎ গতকাল। তারপর সকাল হলে, মানে আজ সকাল…. আমি বম্বে চলে যাব। এবং আজ এই সময় আমি বম্বেতে একটা পার্টিতে থাকব, যেখানে অন্তত কুড়ি জন লোক আমায় চেনে। পার্ফেক্ট অ্যালিবাই।

    অশোক: টাইম মেশিন? আপনি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন।

    সুগত: আমি পাগল হইনি। কেউ আমায় দোষী সাব্যস্ত করতে পারবে না, তোমায় সিকিওরিটির লোক যাই সাক্ষ্য দিক।

    অশোক: একটা ড্রিংক দিই আপনাকে?

    সুগত: গুডবাই অশোক দত্ত।

    সুগত রিভলবার তুলে তিন বার গুলি করে অশোককে। ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ টাল খেয়ে পড়ে যায়, তারপর অশোক-এর মৃত মুখের ওপর স্থির হয়। আমরা শুনতে পাই সুগতর পদক্ষেপ মিলিয়ে যাচ্ছে।

    রাত। শহরতলিতে একটি বিশাল ওয়্যারহাউসের মত বাড়ী। সুগতর গাড়ী সামনে এসে দাঁড়ায়।

    যুবক বেরিয়ে আসে।

    যুবক: আসুন, আসুন, দেরী হয়ে গেছে।

    সকাল। সুগতর বাড়ী। আগের দিনের সকাল-এর পুনরাবৃত্তি। সুগতর একই জামাকাপড়। সুগত অফিস যাচ্ছে।

    বিকেল। সুগত অফিস থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দর রওনা হয়।

    বিকেল। বিমানবন্দর। সুগত চেক-ইন করছে বম্বে ফ্লাইটের জন্য। হাঁটতে শুরু করে বিমানের দিকে। সুরক্ষা বিভাগের দরজা দিয়ে ঢোকে….

    এবং বেরোয় নিজের শোবার ঘরের দরজা দিয়ে খাবার ঘরে, সেই সকালের পরিচিত দৃশ্য যে ঘরে আমরা বহুবার দেখেছি। সুগত অফিস যায়।

    বিকেল। সুগত অফিস থেকে বেরিয়ে বিমানবন্দর রওনা হয়।

    বিকেল। বিমানবন্দর। সুগত চেক-ইন করছে বম্বে ফ্লাইটের জন্য। হাঁটতে শুরু করে বিমানের দিকে। সুরক্ষা বিভাগের দরজা দিয়ে ঢোকে….

    এবং বেরোয় নিজের শোবার ঘরের দরজা দিয়ে খাবার ঘরে, সেই সকালের পরিচিত দৃশ্য যে ঘরে আমরা বহুবার দেখেছি। সুগত অফিস যায়।

    বিকেল। অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে উঠতে গিয়ে সুগত এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। মাথা নেড়ে, একটু হেসে, গাড়ীতে ওঠে।

    সন্ধ্যে। বালিগঞ্জ পার্ক রোডে একটি বহুতল বাড়ীর ফটক। ভেতরে বাচ্চারা খেলছে। সুগতর গাড়ী এসে থামল। সুগত গাড়ী থেকে বেরিয়ে চাবি দারোয়ানকে দিল পার্ক করার জন্য।

    সুগত: অশোক দত্ত, কত নম্বর অ্যাপার্টমেন্ট?

    দারোয়ান: ভেতরে সিকিওরিটিতে নাম লেখাতে হবে।

    পর্দা অন্ধকার হয়। তিনটে গুলির আওয়াজ শোনা যায়।

    সকাল। গবেষণাগার। আমাদের পরিচিত যুবক কথা বলছে একটি মাঝবয়স্ক রাশভারি চেহারার লোকের সাথে। দুজনেরই পরনে ল্যাবকোট। পেছনে দেখতে পাই পুরনো ধাঁচের টেপ রেকর্ডার, যাতে স্পুল টেপ ব্যবহৃত হত। টেপ ঘুরছে।

    যুবক: এই হল সুগত রায়ের কাহিনী। ভদ্রলোক পরিকল্পনাটা ফেঁদেছিলেন ভালোই। চব্বিশ তারিখ রাতে অশোক দত্তকে খুন করবেন, ফিরে যাবেন তেইশ তারিখে, আর চব্বিশ তারিখে বিকেলে বম্বে চলে যাবেন। একাই লোক তো আর একই সময় দু জায়গায় থাকতে পারেন…. পার্ফেক্ট অ্যালিবাই। কিন্তু…

    অন্য ভদ্রলোক: কিন্তু কি?

    যুবক: ঐ যে। অতীতকে পাল্টানোর উপায় নেই। একবার যদি আপনি অতীতে গিয়ে পাল্টানোর চেষ্টা করেন, আপনি একটা চক্র, একটা লুপের মধ্যে পড়ে যাবেন, ঐ অতীতেই আটক থাকবেন, যে বর্তমানটা আপনি তৈরী করেছিলেন সেটা পাল্টানোর কোন উপায় নেই। তাই সময় আপনাকে আর বর্তমানে আসতেই দেবে না।

    অন্য ভদ্রলোক: সুগত রায় এটা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই না?

    যুবক: বুদ্ধিমান লোক, আর সায়েন্স ফিকশন গুলে খেয়েছেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ওনার কোন উপায় নেই। অতীত পাল্টাতে গেলে ঐ চক্রেই ঘুরপাক খেতে হবে। আর নয়তো না পাল্টে বাস্তবে যা করেছিলেন, সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে।

    কথা চলাকালীন ক্যামেরা টেপ রেকর্ডারের ওপর zoom করে। Close-up: টেপদুটো রিলের মধ্যে ঘুরে যাচ্ছে, লুপ হয়ে।



    অলংকরণ (Artwork) : ভাস্কর সরকার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments